06-05-2025, 07:22 AM
অতৃপ্ত :- তৃতীয় পর্ব
আমার বাড়ির নিচের তলার একটা ঘর বেশ অন্ধকার। সেখানেই পুরু করে খড় বিছিয়ে তার ওপর কঙ্কালটা রাখতে গেলাম। কিন্তু কঙ্কালটা যেন হাত থেকে পিছলে পড়ে গেল। আশ্চর্য হলাম। পড়ে যাবার তো কথা নয়। আমি তো দুহাত দিয়ে ধরেছিলাম। আর পড়বি তো পর উপুড় হয়ে।
আমি হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে করে কঙ্কালটা চিৎ করে দিলাম। চিৎ করে দিতেই মন হলো কঙ্কালটার চোখের গর্তদুটো যেন কেমন। গর্তের ভিতরে কি যেন চিকচিক করছে। ভাবলাম বুঝি চোখের কোটরে এক ঝাঁক জোনাকি বাসা বেঁধেছে। একটা কাঠি দিয়ে খোঁচালাম। কাঠিটা চোখের গর্ত দিয়ে দিব্যি নেমে গেল। কিছু মাটি ঝরে পড়ল। প্রথমে চিকচিক করতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম–এ আবার কীরে বাবা! এখন নিশ্চিন্ত হলাম। জানলা বন্ধ করে, দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ওপরে উঠে এলাম। মনে মনে বললাম, এখানে আরাম করে কিছুদিন ঘুমোও।
ওপরে উঠে এসেও মনটা কেমন খচখচ করতে লাগল। চোখের কোটরে যে কিছু চিকচিক করছিল সে কি সত্যিই আমার দেখার ভুল? নাকি ভয়ংকর কিছুর ইঙ্গিত?
পরের দিনই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (বুড়িমা যা যা আনিয়েছিল) কেনার জন্যে শহরে গেলাম। কিন্তু মাংস, মদ, গুড়, তিল, কুশ, মাষকলাই, পিদিম জ্বালাবার জন্যে খাঁটি সর্ষের তেল, এলাচ, লবঙ্গ, কর্পূর, জ্বাতি খয়ের, আদা, পান, যজ্ঞকাষ্ঠ, পঞ্চগব্য প্রভৃতি কিনে আনলাম। শবের (এখন শবের বদলে কঙ্কাল) ওপরে বসবার জন্যে হরিণের চামড়ার বদলে কম্বলের আসনের ব্যবস্থা হলো।
তারপরে একটা বিশেষ দিন দেখে শাস্ত্রমতে প্রচুর পরিমাণ মাংস ভাত খেলাম। রাত্রেও খাবার কোনো ত্রুটি রাখলাম না। তারপর রাতের অন্ধকারে কঙ্কালটি দু হাতের ওপর শুইয়ে নদীতে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে আনলাম। কঙ্কালটা আকারে ছোটো হলেও বেশ ভারী। বইতে কষ্ট হচ্ছিল। যাই হোক কোনোরকমে বাড়ি এনে কাঁচা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। তারপর কুশের অভাবে খড়ের বিছানায় বুড়িমার সেদিনের নির্দেশ মতো কঙ্কালটাকে পুব দিকে মাথা করে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম (মনে পড়ল কঙ্কালটা আমার হাত থেকে পড়েছিল উপুড় হয়েই)। সর্বাঙ্গে চন্দন মাখিয়ে দিলাম। কেবলমাত্র হাড়ের ওপর কি চন্দন মাখানো যায়? গড়িয়ে পড়তে লাগল। তা আমি আর কি করব? সবটাই তো একটা পরীক্ষার ব্যাপার। এরপর ধূপ জ্বালালাম। তারপর কঙ্কালের ওপর কম্বলের আসন পেতে ঘোড়ায় চড়ার মতো বসলাম। অমনি হাড়গুলো নড়বড় করে উঠল। আমার তখনই কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। কেননা আমি জানি ফাঁকি দিচ্ছি। শবসাধনার নামে কবেকার একটা মহিলা বামন কঙ্কাল নিয়ে ছেলেখেলা করছি। শবসাধনার নামে আমি কঙ্কাল সাধনা করছি।
তবু আমি নানারকম প্রাথমিক ক্রিয়াগুলি সেরে ফেললাম। তারপর চোখ বুজিয়ে গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করলাম, ওঁ ফট। তারপর বললাম, ওঁ হুঁ মৃতকায় নমঃ। হে মৃত ব্যক্তি, তুমি যে-ই হও তোমাকে নমস্কার। তারপর তিনবার পুস্পাঞ্জলি দিলাম।
এইভাবে অনেক রাত পর্যন্ত ধ্যান করতে লাগলাম। অন্ধকার ঘরে শুধু পিদিমের আলো জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়াগুলো অদ্ভুত আকৃতি নিয়ে চোখের সামনে নাচতে লাগল। আমার কেমন ভয় করতে লাগল। একটু পরেই মনে হলো কঙ্কালটা যেন নড়ছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, ঘামে গা ভিজে গেল।
দরকার নেই বাবা। মনে মনে এই কথা বলে এক লাফে নেমে পড়লাম।
ওটাকে ঐভাবে ফেলে রেখেই বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে ওপরে উঠে এলাম। দরজা বন্ধ করার সময় স্পষ্ট শুনলাম কঙ্কালটার হাড়গুলোয় খট খট করে শব্দ হচ্ছে।
এ ঘরে ঢুকি না বটে কিন্তু কী একটা তীব্র আকর্ষণ আমায় ঐ ঘরের দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। আর এই আকর্ষণটা তীব্রতর হয়ে ওঠে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে।
একদিন, তখন বেলা পড়ে এসেছে, নিচের তলাটা এরই মধ্যে অন্ধকার–আমি যেন আমার অজান্তই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। গোটা বাড়িটা নিঝুম, নিস্তব্ধ। হঠাৎ মনে হলো ঘরের মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। চমকে উঠলাম। এ তো মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। কিন্তু
কিন্তু এ ঘরে মানুষ কোথায়? তবে কি কোনো জন্তু
না-না, এ জন্তু নয়, জন্তু ঢুকবেই বা কি করে? এ নিঃশ্বাস মানুষের। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ঘরে জীবিত কেউ আছে।
ভয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসে রইলাম।
এই বাড়িতে বেশ কিছুকাল ধরে একাই থাকি। কোনো দিন ভয় পাইনি। আজ মনে হলো এত বড় বাড়িতে আমি আর একা নই। অন্য কেউ আছে, সে আর যাই হোক মানুষ নয়। আমার গা-হাত-পা কাঁপতে লাগল।
সাধারণত মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙে না। কিন্তু সেদিন ঘটল ব্যতিক্রম।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো মাথার কাছে বন্ধ জানলাটা বাইরে থেকে। কেউ খোলবার চেষ্টা করছে। চমকে উঠে বসলাম–চোর নাকি?
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কান পেতে রইলাম।
কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই। তার পরেই শব্দ–খটখট—
কেউ যেন জানলার পাল্লা ধরে টানছে।
আমি সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে?
শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু মিনিট দুই পরেই অন্যরকম শব্দ হলো–ধুপ। কিছু একটা ভারী জিনিস যেন জানলা থেকে পড়ে গেল। অথবা কেউ লাফিয়ে পড়ল। তারপরেই শুকনো পাতা মাড়িয়ে কিছু যেন দ্রুত চলে গেল।
সে রাতে আর ঘুম হলো না। কে এসেছিল দোতলার জানলায়–কেনইবা জানলা খোলবার চেষ্টা করছিল কিছুই বুঝতে পারলাম না। হাতের কাছে টর্চ ছিল। কিন্তু জ্বালবার সুযোগ হয়নি।
সত্যিই কি চোর কিংবা ডাকাত উঠেছিল? কিন্তু চোরই হোক বা ডাকাতই হোক উঠবে কি করে? এ দিকের দেওয়াল থেকে জল পড়ার কোনো পাইপ নেই। আর দেওয়াল বেয়ে দোতলায় ওঠা কোনো মানুষের সাধ্য নয়। তবে কি লোকটা মই নিয়ে এসেছিল?
তা হতে পারে। কিন্তু নামবার সময়ে লাফ দিয়ে পড়ল কেন?
কী জানি।
পরের দিন সকালে জানলার নিচে কোনো ফেলে যাওয়া মই দেখতে পাইনি
ইদানিং রাতে ভালো করে ঘুম হতো না। কেবলই মনে হতো আবার বুঝি কেউ জানলার কপাট খোলবার চেষ্টা করছে। চোর-ডাকাতে করছে জানলেও নিশ্চিন্ত হয়ে পারতাম। কেননা চোরের কাছ থেকে সাবধান, সতর্ক হওয়া যায়। কিন্তু অন্য কিছু হলে
দ্বিতীয় রাতের ঘটনায় কেউ একজন যেন কাঠের পা নিয়ে খট খট করে দোতলায় উঠে আসছিল। কে আসছিল? যে সেদিন জানলা ভেঙে ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল সেই কি?
যে আসছিল সে যে আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? আমাকে তার কীসের দরকার?
একথা মনে হতেই ভয়ে আমার চুলগুলো খাড়া হয়ে ওঠে।
পরের দিন সকালেই নিচের ঘরের সামনে গিয়ে দেখি দরজা তেমনি শেকল ভোলাই রয়েছে। কিন্তু খিড়কির দরজাটা খোলা।
আশ্চর্য! কে খুলল দরজাটা? পিছনের দরজা তো বন্ধই থাকে।
আমি তখনই বেরিয়ে পড়লাম। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে চলে এলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল বালির ওপর পায়ের চিহ্ন। সে পদচিহ্ন পূর্ণবয়স্ক মানুষের নয়, কোনো বালকেরও নয়। এক বিঘতেরও কম লম্বা কিন্তু বেশ গভীর। গভীরতা দেখে বোঝা যায় যার পায়ের চিহ্ন সে ওজনে ভারী। তা ছাড়া লক্ষ্য করলাম আঙুলগুলো অস্বাভাবিক ফাঁক ফাঁক। হাড়গুলো তুলনায় সরু।
আমি সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করে চললাম শালবনের দিকে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে বেশিদূর চিহ্নগুলো খুঁজে পেলাম না।
ফিরে আসব ভাবছি হঠাৎ জঙ্গলের একপাশে পাঁচ-ছটা বাদুড় মরে পড়ে আছে দেখলাম। সব কটাই খণ্ড-বিখণ্ড। এতগুলো বাদুড় একসঙ্গে কি করে মরল আর কেই বা সেগুলোকে অমন করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে তা বোধগম্য হলো না। পরিষ্কার বোধগম্য না হলেও কেমন একটা সন্দেহ মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। যিনি একদিন আমার জানলা ভাঙতে গিয়েছিলেন কিংবা গভীর রাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন সেই বামন- মহিলাটির কাজ নয় তো? ভাবতেও সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এতদিন নির্জন বাড়িতে একা একা বেশ ছিলাম। কী কুক্ষণে কলাবতী এসে আমার মাথায় মরণখেলার নেশা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল!
বাড়ি ফিরেই শেকলবন্ধ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খুলতে সাহস হলো না। জানলাটা একটু ফাঁক করে দেখলাম তিনি খড়ের বিছানায় দিব্যি শান্তভাবে শায়িত রয়েছেন।
কদিন পর সেটা ছিল বোধহয় রবিবার। আমার বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে বাজারের দিকে যেতে যে ফাঁকা রাস্তাটা একটা বাঁক খেয়ে শালবনের দিকে গেছে সেই মোড়ে পৌঁছাতেই দেখলাম লোকের জটলা। সবারই মুখে-চোখে আতংকের ছাপ। ভাবলাম সাত-সকালে কী এমন ঘটল?
একে-ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তা রীতিমতো ভয়ংকর ব্যাপার। গত রাতে কয়েকজন লোক শালবনের পাশ দিয়ে মড়া নিয়ে কবরখানার দিকে যাচ্ছিল। শববাহীরা আগে আগে চলছিল। পিছনে জনা তিনেক। তাদের হাতে লণ্ঠন, শাবল, কোদাল। হঠাৎ তারা নাকি দেখে মানুষের মতো একটা জীব–প্রায় কঙ্কালসার, তাদের পথ আগলে দাঁড়াল।
আমার বুকটা কেঁপে উঠল। কোনোরকমে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, লম্বায় চওড়ায় কিরকম?
সেও অদ্ভুত মশাই! এই আমার কোমর পর্যন্ত।
শুনে আমি ঢোঁক গিললাম।
তারপর?
তার চোখ দুটো চিকচিক করে জ্বলছিল। হঠাৎ অন্ধকারে শালবনের মধ্যে ঐরকম একটা বীভৎস মূর্তি দেখে সকলে চিৎকার করে উঠেছিল। অদ্ভুত জীবটা অমনি লাফ দিয়ে মড়ার মাচায় উঠে মড়াটা টেনে নিয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই স্বচক্ষে দেখেছে মশাই।
তারপর?
শবযাত্রীরা তো পিশাচ পিশাচ বলে ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।
আমি একরকম হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?
তারপর আজ সকালবেলায় মড়াটা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় শালবনের ধারে পাওয়া গেছে। পুলিশ জায়গাটা ঘিরে আছে। একবার যান না। দূর থেকে দেখে আসুন।
উত্তর না দিয়ে আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম শাস্ত্রর নিয়ম ঠিকমতো না মেনে শবসাধনার বদলে কঙ্কাল সাধনা করতে গিয়ে এই অদ্ভুত জীবের সৃষ্টি করে ফেলেছি। শুধু অদ্ভুত জীবই নয়, ওটা আবার ভয়ংকর মাংসাশী হয়ে উঠেছে। ও যে এখন কতজনের সর্বনাশ করবে তার ঠিক নেই। আমিও নিস্তার পাব না।
চলবে..