
অফিসের মিষ্টি প্রেম, পর্ব-১
আমি সত্যম মিত্র। আজ আমার পুরানো দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। ১২ বছর আগের কথা। সালটা ছিল ২০১৩, জুলাই মাস যেদিন আমি আর সানা, মানে আমার বউ সুলতানা, ডাকনাম সানা, আমরা দুজনে অফিস ছেড়ে ছিলাম। আসলে অফিসটা ছিল একটা প্রাইভেট ফার্ম। যিনি আমাদের বস ছিলেন তিনি হলেন ‘বিজয় মুখার্জী ‘। কেউ মুখার্জিদা, আবার কেউ মুখার্জী স্যার, কেউ শুধু মুখার্জী বলেই ডাকতো। আমরা অবশ্য মজা করে মামা বলে ডাকতাম। এই মামা ডাকার পিছনে অবশ্য একটা ইতিহাস আছে। আসলে আমরা যারা অফিসে কাজ করতাম তাদের অনেকেই মাঝেমধ্যে দেরিতে আসতাম, ফলে ঠিক সময়ে সঠিক আউটপুট পাওয়া যেতনা। হেড অফিস থেকে রিপোর্ট চাইলে ঠিক সময়ে পাঠানো যেতনা। বসকে অসুবিধায় পড়তে হতো। যখনি কেউ দেরি করে আসতো, বস মুখার্জী রেগে গিয়ে বলতেন, “ এটা মামাবাড়ি পেয়েছো, যখন খুশি আসবে। তাড়াতাড়ি আসতে অসুবিধা কোথায়? “ ব্যস, ঐ যে তিনি বলে ফেলেছেন মামাবাড়ি, আমাদের অফিসের এক পাজী কলিগ, আমরা শুভদা বলে ডাকতাম, আসলে নাম “শুভাশিস “, সেই থেকে পিছনে ওনাকে মামা ডাকতে শুরু করল, আর পরে সবাই। একটা সময়তো আমরা বসের সামনেই ‘মামা’ নিয়ে আলোচনা করতাম, কিন্ত আমরা যে ওনাকে নিয়ে আলোচনা করছি সেটা উনি বুঝতে পারতেননা, ভাবতেন হয়তো অন্য কোনো ব্যাপারে আলোচনা করছি। কিন্তু প্রায় দুবছর পর উনি ব্যাপারটা জানতে পারেন, এবং সেটা আমাদের সামনেই।
আসলে আমাদের অফিসে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ডকুমেন্টেশনের কাজ হতো। অর্থাৎ যেসকল কাস্টমার তাদের ডকুমেন্ট জমা করে সিম কার্ড তুলত আমরা সেগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে এক্সেল শিটে রিপোর্ট তৈরী করে হেড অফিসে পাঠাতাম। সিম তোলার জন্য কাস্টমারদের ফটো সহ একটা ফর্ম পূরণ করতে হতো। এখন অবশ্য এসব ঝামেলা নেই। আধার নম্বরের দ্বারা বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন করে সিম তুলতে হয়। যাইহোক, একটা ছেলে ছিল দীপঙ্কর। ও রোজ সকালে হেড অফিস সল্টলেক সেক্টর ফাইভ-এ গিয়ে কাজ হয়ে যাওয়া ফর্মগুলো জমা করে নতুন ফর্ম নিয়ে আসতো সকাল দশটার মধ্যেই। স্যার ওকে মাসিক ৩০০০ টাকা বেতন দিত আর বাইকের পেট্রল এর দাম দিত। একদিন ও নতুন ফর্ম আনেনি, আমরা পুরানো ফর্মেই কাজ করছিলাম। আসলে ওর কাছে পেট্রলের টাকা ছিলোনা। ও স্যারকে ফোন করেছিল। স্যার বলেছিলো ওনার আসতে দেরি হবে, কারও কাছ থেকে দু-একশো টাকা নিয়ে নিতে, উনি এসে দিয়ে দেবেন। দীপঙ্কর শুভদার কাছে টাকা চাইলে বলে, “ আমার কাছে টাকা নেই, মামার কাছ থেকে নিয়ে নিস্। “ আমরা কেউই খুব বেশি টাকা নিয়ে যেতামনা, প্রীতমদা অনেক দূর থেকে আসতো, তাই ওনার কাছে অনেক বেশি টাকা থাকতো, আর সেই দিনই প্রীতমদা আসেনি। টাকা না পেয়ে দীপঙ্কর আর ফর্ম আনতে যায়নি, ও অফিসে এমনিই বসেছিল। তারপর বস মুখার্জীদা এসে দেখে দীপঙ্কর বসে আছে ফর্ম আনতে যায়নি। মুখার্জদা জিজ্ঞেস করে, “ কি ব্যাপার দীপঙ্কর, এখনো বসে আছো, ফর্ম আনতে যাওনি? “ আমাদের সামনেই দীপঙ্করের সোজা সাপ্টা জবাব, “শুভদাই তো বলল, আমার কাছে টাকা নেই, মামা এলে মামার কাছ থেকে নিয়ে নিস্। “
দীপঙ্করের মুখে এই কথা শুনে আমরা তো থ। এতদিন যে সিক্রেট মামার স্যারের কাছে লুকানো ছিল তা অচিরেই এতো সহজে তা প্রকাশিত হবে তা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা সবাই চুপ থাকলাম। আগেই বলেছি স্যার বস হিসেবে রাগ দেখালেও তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি ব্যাপারটা বুঝলেন যে আমরা সবাই এতদিন তাকেই মজা করে মামা বলে এসেছি। তিনি প্রাথমিকভাবে অবাক হলেও আর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তারপর থেকে আমরা কখনো আর স্যারের সামনে কোনোদিন ‘মামা’ নিয়ে আলোচনা করিনি।
অফিস ছিল দমদমে। স্টেশন থেকে হাঁটা দূরত্ব। অফিসের কাজের পরিমান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমিও প্রথমে আর পাঁচজনের মতো ডেটা এন্ট্রির কাজ করতাম, কিন্ত ধীরে ধীরে আমার কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। শুভদা রিপোর্ট বানাতো, তার জন্য সে এক্সট্রা পেমেন্ট পেতো। কিন্তু শুভদা তার পারিবারিক কোনো সমস্যার কারণে আর এই কাজটি করতে আর রাজি হয়নি। সবার শেষে রিপোর্ট বানিয়ে বাড়ি ফিরতে তার অনেক দেরি হয়ে যেত। অগত্যা বস মুখার্জী নিজে হাতে ধরে আমাকে কাজ শিখিয়ে দিলেন। মাসে আমার বেতন দু হাজার টাকা বৃদ্ধি পেলো। আরও কিছুদিন পর দীপঙ্কর তার ফর্ম আনার কাজ ছেড়ে দেয়। ফলে দীপঙ্করের জায়গায় স্যার কাজের ছেলে খুজলেন, কিন্তু পেলেন না। অগত্যা তিনি আমাকেই ধরলেন। আমার জন্য সমস্যা ছিল এতো সকালে সল্টলেক থেকে ফর্ম আনা সম্ভব ছিলোনা। আমার কোন বাইক ছিলোনা। শেষ পর্যন্ত প্ল্যান করে একটা পুরানো সাইকেল কমদামে কিনে বিধাননগর রেলস্টেশনের সামনে গ্যারেজে রাখলাম। রাত্রি আটটার পর রিপোর্ট পাঠিয়ে দুটো বাগে ট্রেনে করে বিধাননগর স্টেশনে নেমে ফের সাইকেল চালিয়ে সেক্টর ফাইভ যাওয়া,আর রাত্রি সাড়ে এগারোটার লাস্ট ট্রেনে ফিরে আসা আমার দৈনিক কর্ম তালিকার মধ্যে পড়ে। এছাড়া অফিস ম্যানেজমেন্ট, ডেটাএন্ট্রি তো করতেই হতো। এমনকি কম্পিউটার খারাপ হলে সেটাও আমাকে দেখতে হতো।
যাইহোক, ২০০৯ এ আমি প্রথম অফিসে জয়েন করেছিলাম। থাকতাম একটা মেসে। যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক। ওপেন থেকে গ্রাজুয়েশন করছি। কারণ সারাদিন অফিস করে রেগুলার কোর্স করে গ্রাজুয়েশন করা সম্ভব নয়। দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর হয়ে যায় মুখার্জীর অফিসে। সময়টা ছিল ২০১১ র ডিসেম্বর। এরমাঝে অফিসের অনেক রূপ বদলেছে। অফিসের কাজ ও পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরানো অনেক কর্মী কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে। আবার নতুন অনেকে এসেছে। আগে যেখানে অফিসে কোনো মহিলা কর্মী একদমই ছিলোনা, সেখানে এখন অনেক মহিলা কর্মী। সবে কলেজ পাশ করে কাজে যোগ দিয়েছে।
সব থেকে বড় ব্যাপার মেয়েদের আবার বেশিরভাগই '. বাড়ি থেকে। দেখেও ভালো লাগে '. বাড়ির মেয়েরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কলেজ পাশ করে অফিসে যোগ দিচ্ছে। তবে আমার সাথে সকলের সখ্যতা খুবই ভালো। কারণ অফিসের জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ, মানে সব কাজ আমি করতাম। ফলে যেকেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তার সমাধানও আমাকেই করতে হতো।
মহিলাকর্মীদের মধ্যে দুইজন খুবই সুন্দরী ছিল। একজন ছিল রুবি রহমান, আর অন্যজন ছিল সুলতানা আফরিন, ডাকনাম সানা। রুবি সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা, রোগা ছিল, তার রূপের অহংকারও ছিল অনেক বেশি। তার পার্সোনালিটি অতটা এট্রাক্টিভ ছিলোনা। অন্যদিকে সানাও সুন্দরী ছিল, কিন্তু রুবির অতটা ছিলোনা। রুবির সৌন্দর্য ওকে সহজেই মডেল কিংবা মডেল বানাতে পারতো। কিন্ত সানা ছিল নম্র, মার্জিত, সংস্কারী। সকলকে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলতো। বাকী '. কর্মচারীরা সানাকে খুবই সম্মান দিয়ে কথা বলতো, যেন সানা ছিল তাদের গার্জেন, মা কিংবা বড় দিদির মতো।
চলবে........