27-04-2025, 12:52 AM
এক নাগাড়ে বলে গেলো বন্দনা। মেয়েটাকে যতোই দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে তমাল। প্রথাগত এবং পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত নয় মেয়েটা কিন্তু অদ্ভুত এক দৃঢ়তা আছে মেয়েটার চরিত্রে। সহজ অথচ পরিস্কার একটা চিন্তাধারা মেয়েটাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। কোনো সংস্কারের অচলায়তনে এই মেয়ে বাঁধা পড়তে অনিচ্ছুক। তমাল ভাষা হারিয়ে ফেললো তার সোজাসাপটা যুক্তির কাছে। তবুও একটা দ্বিধা নিয়ে বললো...
- কিন্তু তোমরা দুজনে তোমাদের পরিবারের বিশ্বাস ভাঙতে চলেছো, সেটা ভেবে দেখেছো। পরে আমাকে দোষ দিওনা যেন।
এতোক্ষণ গম্ভীর গলায় কথা বলছিলো বন্দনা। এবারে খিলখিল করে হেসে বললো...
- তুমি কি নেটে সেই গল্পটা পড়নি?.. এভরিথিং ইজ ফেয়ার হোয়েন লাভ মেকিং ইজ দেয়ার! না পড়লে আমি তোমাকে লিংক পাঠিয়ে দেবো।
গল্পটা পড়েছে তমাল। তাই সেও এবার হেসে ফেললো। বললো..
- সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু রাধা গেলে তো তোমাদের জন্য আলাদা একটা ঘর নিতে হবে, তখন তুমি আমার কাছে আসবে কিভাবে?
- তুমি কি ভাবছো রাধা আমাকে একা ছেড়ে দেবে? আমার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমার সম্পর্কে সব শুনেছে। সব মানে সব... তোমার সাইজ কতো, কতোক্ষণ করতে পারো, কি কি ভাবে করো, কি করতে ভালোবাসো, সব কিছু। সেইজন্যই তো তার এতো উৎসাহ! কেন তুমি পারবে না দুজনকে একসাথে ঠান্ডা করতে?
- দেখা যাক! আগে তো পাই দুজনকে? তারপর ভাবা যাবে।
- তাহলে তো চুকেই গেলো। কখন আসছো তুমি?
- কাল ভোরে বেরিয়ে প্রথমে ধানবাদ যাবো। সেখানে একটা কাজ সেরে তোমাদের তুলে নেবো দুপুরে বা বিকেলে।
- এই শোনো না রাধা কি বলছে। বলছে দুপুরে তুমি এখানে এসে লাঞ্চ করবে। কোনো আপত্তি শুনবে না বলছে। মনে থাকে যেন।
তমাল একটু আপত্তি করেছিলো, কিন্তু রাধার জোরাজুরিতে রাজি হতে বাধ্য হলো। তারপরে ফোন রেখে দিলো সে।
চোখে মুখে জল দিয়ে তমালের মনটা এককাপ চায়ের জন্য হু হু করে উঠলো। সে জামা কাপড় বদলে তৈরি হয়ে নিলো। অন্যের কাম-রস মাখা পোষাকে অপর মেয়েদের কাছে যেতে নেই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে গেছে তমাল। ছেলেরা বুঝতে না পারলেও মেয়েরা ঠিক ধরে ফেলে অন্যের শরীরের গন্ধ। মৌপিয়ার যৌন আতর মেখে তাই অদিতির সামনে পড়তে চাইলো না তমাল। প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে গায়ে পাউফিউম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।
নীচে যাওয়ার আগে উঁকি দিলো অদিতির ঘরে। খাটের উপরে আধশোয়া হয়ে মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে অদিতি। তমাল বললো, গুড ইভিনিং অদিতি! বই থেকে মুখ তুলে হেসে প্রত্যুত্তর দিলো সে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ঘুম হলো? আমি একবার গিয়েছিলাম তোমার ঘরে, তুমি ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিলে।
তমাল অবাক হবার ভান করে বললো, তাই? টের পাইনি তো? কিছু দরকার ছিলো? অদিতি বললো, না না, জাস্ট এমনিই গিয়েছিলাম। তুমি কখন বেরোচ্ছো? তমাল বললো, আজ আর যাবো না, ভাবছি কাল সকালেই যাবো। এখানে কয়েকটা কাজ বাকী আছে। আচ্ছা অদিতি, তোমাদের বাড়িতে যতো কর্মচারী কাজ করেছে, তাদের ভিতরে সব চেয়ে পুরানো কাকে তুমি মনে করতে পারো, মানে জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছো এমন কেউ?
অদিতি একটু ভেবে বললো, একটু বুঝতে শিখেই দেখেছি তিনজনকে, সুরেশবাবু, সুলতা পিসি আর রামহরি কাকুকে। হ্যাঁ ঘনশ্যাম কাকুকেও দেখেছি তবে ওদের মতো অতো পুরানো নয়।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, ওদের মধ্যে শুধু সুলতা পিসিই রয়ে গেছেন, বাকীদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কেন বলতে পারো? অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, ঠিক বলতে পারবো না তমালদা, তুমি সুলতা পিসিকেই জিজ্ঞেস করো না একবার? তমাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, নাহ্ থাক, সবাইকে সব কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। আচ্ছা বরাবরই কি তোমরা এতো ধনী? নাকি কোনো একটা সময় তোমাদের হঠাৎ সম্পদ বৃদ্ধি হয়?
অদিতি বললো, যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমাদের অবস্থা খারাপ ছিলো বলবো না, তবে এখন যতোটা ভালো দেখছো, তেমন ছিলো না। এসবই আমার বাবা করেছেন। ঠাকুরদা তখন অন্য ব্যবসা করতেন। মোটামুটি ভদ্রস্থ উপার্জন করেছেন জীবনে। কিন্তু বাবা সংসারের হাল ধরার পরে আমূল পরিবর্তন হয়। স্টিলের বিজনেস বাবাই তৈরি করেন প্রায় নিজের হাতে। কেন বলোতো?
না, এমনি কৌতুহল। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তোমাদের সম্পদ পৈতৃক সূত্রে পাওয়া, নাকি কোনো এক পুরুষের নিজের চেষ্টায় অর্জিত?.. বললো তমাল।
সেটা যদি বলো তাহলে বাবাই আমাদের সম্পদ লক্ষ্মীর সবচেয়ে বড় উপাসক, মজার ছলে হেসে বললো অদিতি। তমাল বললো, ধন্যবাদ, গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিলে তুমি। চা খেয়েছো, নাকি যাবে নীচে আমার সাথে এক কাপ খেতে? অদিতি বই বন্ধ করে বললো, চলো।
ডাইনিং এ এসে দুজনে দু'কাপ চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো। সেই সময় সুলতা দেবীকে দেখে কাছে ডাকলো তমাল। তিনি এলে তমাল জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা সুলতা পিসি,আপনার পুরো নাম কি? আপনার বাড়ি কোথায় ছিলো? সুলতা পিসি হেসে বললো, নাম তো ছিলো সুলতা হো, তবে বড় বাবু এখানে আনার পরে পদবি বদলে রায় করে দেন। আর বাড়ির কথা, সে কি আর আজকের কথা বাবা, কবেই ছেড়ে এসেছি, ঠিকঠাক মনেও পড়েনা। তমাল বললো, তবুও গ্রামের নাম বা কোন জেলা সেসব বলুন একটু।
তিনি বললেন জামতারা থেকে পালজোরি হয়ে জামুন্ডির দিকে যেতে হরিপুরা বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানেই ছিলো আমার বাড়ি। তমাল বললো, জামতারা? তাহলে তো চিত্তরঞ্জন হয়ে যেতে হয় তাই না?সুলতা পিসি উত্তর দিলো, হ্যাঁ, চিত্তরঞ্জন হয়ে ধুৎলার পথে। তমাল আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই? দুদিকে বিষন্ন ভাবে মাথা নাড়লেন তিনি। তারপর নীচু স্বরে বললেন, ছিলো তো অনেকেই, কিন্তু কেউ সম্পর্ক রাখলো না। এক ভাইপো খোঁজ খবর নিতো, কিন্তু সেও মারা গেলো। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।
তমাল জানতে চাইলো, যোগাযোগ রাখলো না কেন? সুলতা দেবী এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে রইলেন। আপনার সেই ভাইপোর নাম কি পিসি? তমালের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন তার নাম সুখদেব। তমাল আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি যখন এই বাড়িতে আসেন, তখন আপনার বয়স কতো ছিলো? সুলতা পিসি মাথা নেড়ে বললো, কতো আর হবে ষোলো সতেরো হবে। তমাল আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না তাকে, তিনি উঠে রান্নাঘরের ভিতরে চলে গেলেন।
অদিতি অনেক কথা বলে চলেছে, কিন্তু তমালের সেদিকে মন নেই। সে চিন্তা করে চলেছে সুলতা পিসির কথা গুলো নিয়ে। হো মানে তো উপজাতি পদবি। সুলতা পিসি উপজাতি মেয়ে? দেখলে খুব একটা বোঝা যায় না বটে, আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছেন বলে আরো অসুবিধা হয়। কিন্তু তার পদবি বদলে দেবার কি প্রয়োজন পড়লো, তমাল বুঝতে পারছে না। অদিতি জিজ্ঞেস করলো, কি এতো ভাবছো তমালদা? তমাল বললো, ও কিছু না, চলো ওঠা যাক।
তমাল বাইরে বেরিয়ে কয়েকটা জরুরী কাজ সেরে নিলো। ফোনও করলো কয়েকজনকে। রাতে অনেক্ষণ রাহুলের সাথে আলোচনা সেরে যখন নিজের ঘরে ফিরলো, তমালের ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ঝুলে রইলো। এই বাড়ির কেসটা যখন সে হাতে নেয়, তখন মনে হয়েছিলো অতি সাধারণ একটা কেস, হেসে খেলে সমাধান করে ফেলবে। কিন্তু তার গোয়েন্দা জীবনে এতো জটিল কেস সে আগে কখনো পায়নি। ভীষণ রকমের জড়ানো ছিলো সূত্রগুলো। জটটা এখনো খুলতে না পারলেও সুতোর একটা খোলা মাথা এখন তার হাতে। এবারে আর কোনো অসুবিধা হবে না ভেবে সে নিশ্চিন্ত বোধ করছে।
ডিনার টেবিলে মৌপিয়া, অদিতি এবং রাহুলের সাথে বসেই রাতের খাবার সারলো তমাল। মৌপিয়া আজ যেন লজ্জায় মুখই তুলতে পারছে না। দুপুরে তার নিজের বন্যতায় নিজেই এখন চোখ মেলাতে পারছে না তমালের সাথে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সামনে। কিন্তু কোনো অপরাধবোধ নেই তার মনে। শারীরিক মিলনের পরের স্বাভাবিক লজ্জাই তাকে সংকুচিত করে রেখেছে। অদিতি দুএক বার সে কথা জিজ্ঞেস করলেও মৌপিয়া এড়িয়ে গেছে। আড় চোখে রাহুলকে দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, এখন কিছু জিজ্ঞাসা করিস না, পরে বলবো তোকে।
সেদিন রাতে অনেকদিন পরে তমাল লম্বা ঘুম দিলো। কোনো অতৃপ্ত নারী শরীরকে তৃপ্তি দানের মহান কর্তব্য তার কাঁধে, মানে কোমরে ছিলো না। এক ঘুমেই রাত কাবার করলো সে। সকাল সকালই ঘুম ভাঙলো তমালের। আজ বন্দনা বাড়িতে নেই, তাই কেউ চায়ের কাপ হাতে তাকে জাগালো না। হঠাৎ বন্দনার কথা মনে পড়লো তার। কি করছে এখন মিষ্টি? বহুদিন পরে নিজের বান্ধবীকে কাছে পেয়ে নিশ্চয়ই রাত জেগে গল্প করেছে? নাকি গল্প জুড়ে ছিলো তমালের কথা? ভরা যৌবন দুই যুবতী এক জায়গায় হলে কি ধরনের কথা হয় আন্দাজ করতে পারলো না তমাল। তবে সেই আড্ডার অনেকটা জায়গা যে সেও দখল করে ছিলো, সে সম্পর্কে তার সন্দেহ নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার ঠোঁটের কিনারা জুড়ে। বন্দনা মেয়েটাকে বড্ড ভালো লেগে গেছে তমালের। ওর জন্য ভালো কিছু করে যেতে হবে তমালকে।
সত্যিই কি তাই? ভাবলো তমাল! শুধু কি বন্দনা? অদিতি, মৌপিয়া এদেরও কি ভালোবাসেনি তমাল? গার্গী, কুহেলী, এদেরও তো সে ভালোবাসে। তবে কি যে কোনো মেয়েকেই ভালোবাসে তমাল? একটু চিন্তা করে নিশ্চিত হলো, না তা নয়।শারীরিক সম্পর্ক করার পরেও অনেক।মেয়েকে সে পছন্দ করেনি। আসলে এই মেয়েগুলো সরল, ভালো মনের মেয়ে। যৌবনের অবদমিত কামনায় এরা তমালের কাছে ধরা দেয় ঠিকই কিন্তু কেউ এরা খারাপ নয়। হয়তো তমালকে তারা বিশ্বাস করে ফেলে তাই নিজেদের সব কিছু উজাড় করে দেয়! তমালও তো তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি কখনো। নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে তাদের ভালো করতে, সুখী করতে! হঠাৎ মনে পড়লো সেই নিঃস্বার্থ মেয়েটার কথা। তমালের সুখে দুঃখে যে কোনো দাবী না রেখেই জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্টে.. শালিনী! ভীষণ মন কেমন করে উঠলো তমালের শালিনীর জন্য!
আজ কি হলো তমালের? সকাল থেকেই এতো মন খারাপ লাগছে কেন? কাজ শেষ হয়ে এসেছে, কয়েকদিনের ভিতরেই ফিরে যেতে হবে তমালকে নিজের জগতে। এই ক'দিনে মুখার্জি বাড়িতে যে আন্তরিকতা, আতিথেয়তা পেয়েছে, তা আর পাবে না বলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তমালের। এই বাড়ির মানুষগুলো বড় বেশি আন্তরিক!
উঠে পড়লো তমাল। মদনকে রেডি হতে বলে বাথরুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হতে হতে ভাবলো, এ বাড়ির সাথে তো তার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বিচ্ছেদ তো হচ্ছে না, যোগাযোগ থাকবেই। তাহলে এতো মন খারাপ করবে কেন? বরং নিজের অধিকারের বাইরে গিয়েও সে এই বাড়িকে
সম্পূর্ণ রাহু মুক্ত করে যাবে। যাতে ভবিষ্যতে এদের আর কোনো বিপদে পড়তে না হয়। মনে মনে সংকল্প করার পরেই মন ভালো হয়ে গেলো তমালের।
ব্রেকফাস্ট করতে যাবার সময় অকারণ মৌপিয়া আর অদিতির ঘরে ঢুকে গুড মর্নিং উইশ করলো সে। ঘুমন্ত শিখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপরে ব্রেকফাস্ট সেরে মধুছন্দা দেবীকে জানিয়ে এলো যে সে ধানবাদ যাচ্ছে দুদিনের জন্য।
গাড়ি ছাড়ার আগে অদিতি এলো নীচে। তমালকে বললো, তাড়াতাড়ি ফিরো। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগবে না দুদিন। তমাল হেসে বললো, বুঝেছি, রাহুলকে বলে তোমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর একা লাগবে না। অদিতি লজ্জায় লাল হয়ে বললো, ধ্যাৎ!
হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলো তমাল। মদন গাড়ি ছেড়ে দিলো। তমাল পিছনে তাকিয়ে দেখলো অদিতি হাত নাড়ছে দাঁড়িয়ে। গেট পার করে বাঁদিকে মোর নিতেই চোখের আড়াল হলো অদিতি।
তমাল প্রথমেই কল করলো বন্দনাকে। জানালো সে রওনা দিয়েছে। দুপুর দুপুর নাগাদ পৌঁছাবে নিয়ামতপুরে। বন্দনার ঝর্ণার কতো কলকল করে উঠে নিজের খুশি প্রকাশ করলো। বললো এসো, এখানে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
অনেকদিন গার্গীর খবর নেওয়া হয়নি। তমাল কল করলো তাকে। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে সে তাই বেশি কথা হলো না। তবে জানালো, তার কাজ প্রায় শেষ। দু একদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বাকিটা। তারপরেই ফিরবে। ট্রেনের টিকিট কাটতে পাঠাবে আজকে। তমালের কাজ কতোদূর জিজ্ঞাসা করাতে তমালও জানালো প্রায় শেষের পথে। সে এলে এক সাথেই ফিরতে পারবে গরলমুরিতে।
আসানসোল থেকে ধানবাদের দূরত্ব ষাট কিলোমিটারের কাছাকাছি। গাড়িতে যেতে খুব বেশি হলে ঘন্টা দেড়েক লাগে। তবে রাস্তায় জ্যাম থাকলে দুই ঘন্টা বা সোয়া দুই ঘন্টাই যথেষ্ট। এখন ন'টা বাজে, ঘড়ি দেখলো তমাল, অর্থাৎ সাড়ে এগারোটার ভিতরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।
পৌণে দু'ঘন্টায় ধানবাদে ঢুকলো তমাল। শহরে ঢোকার আগে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামালো তমাল। সুরেশ চাকলাদারের ঠিকানাটা দোকানদারকে দেখিয়ে পথ নির্দেশ জেনে নিলো সে। ঠিকানাটা শহরের ভিতরের নয়, বরং শহর থেকে আরো ছয় সাত কিলোমিটার বাইরের এক কোলিয়ারির। সেদিকেই চললো তমাল।
ঠিকানায় পৌঁছে দেখলো এক গৃহস্থ বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘরে ভাড়া থাকেন তিনি। খাওয়া দাওয়া সেই গৃহস্থের সাথেই, তবে অন্দরমহলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই কোনো। তমাল কড়া নাড়তে একটি ষোল সতের বছরের ছেলে এসে জানালো সুরেশ জেঠু ঘরে নেই, বোধহয় বাজারে গেছে। আজ খনিতে যায়নি জেঠু, আজ তার ছুটি। তমাল জানালো তারা অনেক দূর থেকে এসেছে, একটু অপেক্ষা করতে পারে কি না?
তমালের এসইউভি আর পোশাক আশাক দেখে ছেলেটি ভিতরে চলে গেলো, সম্ভবত বড়দের অনুমতি আনতে। কিছুক্ষণ পরে একটা চাবি হাতে ফিরে সুরেশ বাবুর ঘরের তালা খুলে বসতে দিলো তমালকে। এতো সারল্য কলকাতায় ভাবাই যায়না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে নিজের ভাড়াটের ঘর খুলে বসতে দিতোনা কিছুতেই।
ঘরটা অতি সাধারণ। ইটের উপরে মাটির আস্তরণ, উপরে টালির চাল। একটা ছোট তক্তাপোশ মলিন চাদরে নিজের নড়বড়ে পরিচয় গোপন রাখতে পারেনি। পাশে একটা চেয়ার, তার একটা হাতল অক্ষত থাকলেও অপরটা অদৃশ্য। তমাল সেখানে বসলো। ঘরে দুটো দড়িতে সুরেশ চাকলাদারের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ঝুলছে। তার একমাত্র কথা বলা সঙ্গী হলো একটা সাত'শ বছরের পুরানো টেবিল ফ্যান। জন্মের সময় তার রঙ কেমন ছিলো সেটা খুঁজে বের করতে তদন্তের ভার তমালকে নিতে হবে আবার।
ছেলেটি যাবার আগে ভদ্রতা করে সেই ফ্যানটম ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেলো। তমালের মনে হলো ধান ঝাড়াই কলের পাশে ইঁদুর ধরা কলে একসাথে গোটা দশেক ইঁদুর আটকা পড়েছে। নানার স্বরে তারা কিঁচকিঁচ শব্দ করে চলেছে ছাড়া পাবার তাগিদে। তমাল বুঝলো অন্তত এই লোকটা মুখার্জি বাড়ির পাত্র থেকে ক্ষীর খেতে পারেনি। তাহলে এতো বছর চাকরি করেও তার এই দুর্দশা হতো না।
সুরেশ চাকলাদার ফিরলেন প্রায় মিনিট কুড়ি পরে। নিজের ঘর খোলা দেখে এবং ভিতরে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন অল্প বয়স্ক ছেলেকে বসে থাকতে দেখে হতচকিত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তমাল হাত জোড় করে নমস্কার করতেই তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কিন্তু মুহুর্তেই সামলে নিলেন নিজেকে। বহুদিন তিনি বনেদি বাড়িতে ম্যানেজারি করেছেন, ভদ্রলোকদের সাথে কথা বলার দস্তুর তার জানা আছে।
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না... প্রশ্ন করলেন সুরেশ বাবু। তমাল বললো, আমি আসানসোল থেকে আসছি। মুখার্জি বাড়ি থেকে। কথাটা শুনেই সুরেশ বাবুর মুখের ভাব বদলে গেলো। প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছেন বোঝা গেলো। একটু রূঢ় স্বরে বললেন, তা আমার কাছে কি দরকার? সে বাড়ির সাথে সম্পর্ক তো তারা অনেকদিন আগেই মিটিয়ে দিয়েছে। আমার পঞ্চাশ বছরের সেবার ভালো প্রতিদানও দিয়েছে তারা। এখন আবার কি চাই? চলে যান, এই শেষ বয়সে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন!
বলতে বলতে ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সুরেশ বাবু। তমাল তাকে শান্ত হতে একটু সময় দিয়ে বললো, আমি জানি মুখার্জি বাড়িতে আপনার উপর অনেক অবিচার হয়েছে সুরেশ বাবু। বলতে পারেন সেই অবিচারের প্রতিকার করতেই আমি এসেছি। কথাটা শুনে একটু ম্লান হাসলেন তিনি। বললেন আর কি প্রতিকার করবেন? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না, দেখিওনি ওই বাড়িতে কোনোদিন। এখন কি দয়া দেখাতে এসেছেন? চাই না আপনাদের দয়া, চলে যান আপনি।
তমাল বললো, আমি মুখার্জি বাড়ির কেউ নই। আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। আর কেউ না জানুক, আপনি তো জানেন ওই বাড়িতে কি কি অনাচার হয়ে চলেছে? আমি সেই অনাচারের তদন্ত করতেই এসেছি সুরেশ বাবু। আপনার সাহায্য আমার ভীষন দরকার।
অবাক হয়ে তমালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সুরেশ চাকলাদার, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানতাম! এতো পাপ কখনো চাপা থাকে না, একদিন ধর্মের কল নড়বেই। তমাল বললো, আপনি কি জানেন, ওই বাড়িতে আপনার জায়গায় একটি ছেলে কাজ করতে এসেছিলো, রাজীব নামে? সুরেশ বাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তমাল আবার বললো, কিন্তু এটা কি জানেন কেউ বা কারা সেই ছেলেটিকে খুন করার চেষ্টা করেছে ছুরি মেরে? আর তার দায় গিয়ে পড়েছে রাহুলের উপর?
চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো সুরেশ বাবুর। অনেক কষ্টে বললেন, কি বলছেন এসব! রাহুল? তমাল বললো, পুলিশের তাই সন্দেহ, কিন্তু আমি পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করছি। সেটা করতে গিয়ে আরও অনেক জটিল অপরাধের কথা জানতে পেরেছি। আপনি রাহুলের ঠাকুরদার আমলের লোক, আপনি সাহায্য করলে দোষীরা যোগ্য শাস্তি পাবে সুরেশ বাবু, আমি কথা দিলাম।
মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি তমালের দিকে। যেন মনস্থির করে ফেলেছেন, এভাবে বললেন, বেশ বলুন কি জানতে চান। তমাল বললো, এখানে এভাবে কথা বলা অসুবিধা। আপনি যদি দয়া করে আমার সাথে শহরে যেতেন, ভালো হতো। সুরেশ বাবু বললেন, বেশ চলুন। তমাল তাকে পোশাক বদলে নেবার সুযোগ দিতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ পরে নোংরা ধুতি আর মলিন ফতুয়া বদলে ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে এলেন সুরেশ চাকলাদার। তমাল তাকে নিয়ে চললো ধানবাদ শহরের উদ্দেশ্যে।
- কিন্তু তোমরা দুজনে তোমাদের পরিবারের বিশ্বাস ভাঙতে চলেছো, সেটা ভেবে দেখেছো। পরে আমাকে দোষ দিওনা যেন।
এতোক্ষণ গম্ভীর গলায় কথা বলছিলো বন্দনা। এবারে খিলখিল করে হেসে বললো...
- তুমি কি নেটে সেই গল্পটা পড়নি?.. এভরিথিং ইজ ফেয়ার হোয়েন লাভ মেকিং ইজ দেয়ার! না পড়লে আমি তোমাকে লিংক পাঠিয়ে দেবো।
গল্পটা পড়েছে তমাল। তাই সেও এবার হেসে ফেললো। বললো..
- সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু রাধা গেলে তো তোমাদের জন্য আলাদা একটা ঘর নিতে হবে, তখন তুমি আমার কাছে আসবে কিভাবে?
- তুমি কি ভাবছো রাধা আমাকে একা ছেড়ে দেবে? আমার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমার সম্পর্কে সব শুনেছে। সব মানে সব... তোমার সাইজ কতো, কতোক্ষণ করতে পারো, কি কি ভাবে করো, কি করতে ভালোবাসো, সব কিছু। সেইজন্যই তো তার এতো উৎসাহ! কেন তুমি পারবে না দুজনকে একসাথে ঠান্ডা করতে?
- দেখা যাক! আগে তো পাই দুজনকে? তারপর ভাবা যাবে।
- তাহলে তো চুকেই গেলো। কখন আসছো তুমি?
- কাল ভোরে বেরিয়ে প্রথমে ধানবাদ যাবো। সেখানে একটা কাজ সেরে তোমাদের তুলে নেবো দুপুরে বা বিকেলে।
- এই শোনো না রাধা কি বলছে। বলছে দুপুরে তুমি এখানে এসে লাঞ্চ করবে। কোনো আপত্তি শুনবে না বলছে। মনে থাকে যেন।
তমাল একটু আপত্তি করেছিলো, কিন্তু রাধার জোরাজুরিতে রাজি হতে বাধ্য হলো। তারপরে ফোন রেখে দিলো সে।
চোখে মুখে জল দিয়ে তমালের মনটা এককাপ চায়ের জন্য হু হু করে উঠলো। সে জামা কাপড় বদলে তৈরি হয়ে নিলো। অন্যের কাম-রস মাখা পোষাকে অপর মেয়েদের কাছে যেতে নেই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে গেছে তমাল। ছেলেরা বুঝতে না পারলেও মেয়েরা ঠিক ধরে ফেলে অন্যের শরীরের গন্ধ। মৌপিয়ার যৌন আতর মেখে তাই অদিতির সামনে পড়তে চাইলো না তমাল। প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে গায়ে পাউফিউম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।
নীচে যাওয়ার আগে উঁকি দিলো অদিতির ঘরে। খাটের উপরে আধশোয়া হয়ে মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে অদিতি। তমাল বললো, গুড ইভিনিং অদিতি! বই থেকে মুখ তুলে হেসে প্রত্যুত্তর দিলো সে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ঘুম হলো? আমি একবার গিয়েছিলাম তোমার ঘরে, তুমি ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিলে।
তমাল অবাক হবার ভান করে বললো, তাই? টের পাইনি তো? কিছু দরকার ছিলো? অদিতি বললো, না না, জাস্ট এমনিই গিয়েছিলাম। তুমি কখন বেরোচ্ছো? তমাল বললো, আজ আর যাবো না, ভাবছি কাল সকালেই যাবো। এখানে কয়েকটা কাজ বাকী আছে। আচ্ছা অদিতি, তোমাদের বাড়িতে যতো কর্মচারী কাজ করেছে, তাদের ভিতরে সব চেয়ে পুরানো কাকে তুমি মনে করতে পারো, মানে জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছো এমন কেউ?
অদিতি একটু ভেবে বললো, একটু বুঝতে শিখেই দেখেছি তিনজনকে, সুরেশবাবু, সুলতা পিসি আর রামহরি কাকুকে। হ্যাঁ ঘনশ্যাম কাকুকেও দেখেছি তবে ওদের মতো অতো পুরানো নয়।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, ওদের মধ্যে শুধু সুলতা পিসিই রয়ে গেছেন, বাকীদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কেন বলতে পারো? অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, ঠিক বলতে পারবো না তমালদা, তুমি সুলতা পিসিকেই জিজ্ঞেস করো না একবার? তমাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, নাহ্ থাক, সবাইকে সব কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। আচ্ছা বরাবরই কি তোমরা এতো ধনী? নাকি কোনো একটা সময় তোমাদের হঠাৎ সম্পদ বৃদ্ধি হয়?
অদিতি বললো, যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমাদের অবস্থা খারাপ ছিলো বলবো না, তবে এখন যতোটা ভালো দেখছো, তেমন ছিলো না। এসবই আমার বাবা করেছেন। ঠাকুরদা তখন অন্য ব্যবসা করতেন। মোটামুটি ভদ্রস্থ উপার্জন করেছেন জীবনে। কিন্তু বাবা সংসারের হাল ধরার পরে আমূল পরিবর্তন হয়। স্টিলের বিজনেস বাবাই তৈরি করেন প্রায় নিজের হাতে। কেন বলোতো?
না, এমনি কৌতুহল। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তোমাদের সম্পদ পৈতৃক সূত্রে পাওয়া, নাকি কোনো এক পুরুষের নিজের চেষ্টায় অর্জিত?.. বললো তমাল।
সেটা যদি বলো তাহলে বাবাই আমাদের সম্পদ লক্ষ্মীর সবচেয়ে বড় উপাসক, মজার ছলে হেসে বললো অদিতি। তমাল বললো, ধন্যবাদ, গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিলে তুমি। চা খেয়েছো, নাকি যাবে নীচে আমার সাথে এক কাপ খেতে? অদিতি বই বন্ধ করে বললো, চলো।
ডাইনিং এ এসে দুজনে দু'কাপ চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো। সেই সময় সুলতা দেবীকে দেখে কাছে ডাকলো তমাল। তিনি এলে তমাল জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা সুলতা পিসি,আপনার পুরো নাম কি? আপনার বাড়ি কোথায় ছিলো? সুলতা পিসি হেসে বললো, নাম তো ছিলো সুলতা হো, তবে বড় বাবু এখানে আনার পরে পদবি বদলে রায় করে দেন। আর বাড়ির কথা, সে কি আর আজকের কথা বাবা, কবেই ছেড়ে এসেছি, ঠিকঠাক মনেও পড়েনা। তমাল বললো, তবুও গ্রামের নাম বা কোন জেলা সেসব বলুন একটু।
তিনি বললেন জামতারা থেকে পালজোরি হয়ে জামুন্ডির দিকে যেতে হরিপুরা বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানেই ছিলো আমার বাড়ি। তমাল বললো, জামতারা? তাহলে তো চিত্তরঞ্জন হয়ে যেতে হয় তাই না?সুলতা পিসি উত্তর দিলো, হ্যাঁ, চিত্তরঞ্জন হয়ে ধুৎলার পথে। তমাল আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই? দুদিকে বিষন্ন ভাবে মাথা নাড়লেন তিনি। তারপর নীচু স্বরে বললেন, ছিলো তো অনেকেই, কিন্তু কেউ সম্পর্ক রাখলো না। এক ভাইপো খোঁজ খবর নিতো, কিন্তু সেও মারা গেলো। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।
তমাল জানতে চাইলো, যোগাযোগ রাখলো না কেন? সুলতা দেবী এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে রইলেন। আপনার সেই ভাইপোর নাম কি পিসি? তমালের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন তার নাম সুখদেব। তমাল আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি যখন এই বাড়িতে আসেন, তখন আপনার বয়স কতো ছিলো? সুলতা পিসি মাথা নেড়ে বললো, কতো আর হবে ষোলো সতেরো হবে। তমাল আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না তাকে, তিনি উঠে রান্নাঘরের ভিতরে চলে গেলেন।
অদিতি অনেক কথা বলে চলেছে, কিন্তু তমালের সেদিকে মন নেই। সে চিন্তা করে চলেছে সুলতা পিসির কথা গুলো নিয়ে। হো মানে তো উপজাতি পদবি। সুলতা পিসি উপজাতি মেয়ে? দেখলে খুব একটা বোঝা যায় না বটে, আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছেন বলে আরো অসুবিধা হয়। কিন্তু তার পদবি বদলে দেবার কি প্রয়োজন পড়লো, তমাল বুঝতে পারছে না। অদিতি জিজ্ঞেস করলো, কি এতো ভাবছো তমালদা? তমাল বললো, ও কিছু না, চলো ওঠা যাক।
তমাল বাইরে বেরিয়ে কয়েকটা জরুরী কাজ সেরে নিলো। ফোনও করলো কয়েকজনকে। রাতে অনেক্ষণ রাহুলের সাথে আলোচনা সেরে যখন নিজের ঘরে ফিরলো, তমালের ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ঝুলে রইলো। এই বাড়ির কেসটা যখন সে হাতে নেয়, তখন মনে হয়েছিলো অতি সাধারণ একটা কেস, হেসে খেলে সমাধান করে ফেলবে। কিন্তু তার গোয়েন্দা জীবনে এতো জটিল কেস সে আগে কখনো পায়নি। ভীষণ রকমের জড়ানো ছিলো সূত্রগুলো। জটটা এখনো খুলতে না পারলেও সুতোর একটা খোলা মাথা এখন তার হাতে। এবারে আর কোনো অসুবিধা হবে না ভেবে সে নিশ্চিন্ত বোধ করছে।
ডিনার টেবিলে মৌপিয়া, অদিতি এবং রাহুলের সাথে বসেই রাতের খাবার সারলো তমাল। মৌপিয়া আজ যেন লজ্জায় মুখই তুলতে পারছে না। দুপুরে তার নিজের বন্যতায় নিজেই এখন চোখ মেলাতে পারছে না তমালের সাথে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সামনে। কিন্তু কোনো অপরাধবোধ নেই তার মনে। শারীরিক মিলনের পরের স্বাভাবিক লজ্জাই তাকে সংকুচিত করে রেখেছে। অদিতি দুএক বার সে কথা জিজ্ঞেস করলেও মৌপিয়া এড়িয়ে গেছে। আড় চোখে রাহুলকে দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, এখন কিছু জিজ্ঞাসা করিস না, পরে বলবো তোকে।
সেদিন রাতে অনেকদিন পরে তমাল লম্বা ঘুম দিলো। কোনো অতৃপ্ত নারী শরীরকে তৃপ্তি দানের মহান কর্তব্য তার কাঁধে, মানে কোমরে ছিলো না। এক ঘুমেই রাত কাবার করলো সে। সকাল সকালই ঘুম ভাঙলো তমালের। আজ বন্দনা বাড়িতে নেই, তাই কেউ চায়ের কাপ হাতে তাকে জাগালো না। হঠাৎ বন্দনার কথা মনে পড়লো তার। কি করছে এখন মিষ্টি? বহুদিন পরে নিজের বান্ধবীকে কাছে পেয়ে নিশ্চয়ই রাত জেগে গল্প করেছে? নাকি গল্প জুড়ে ছিলো তমালের কথা? ভরা যৌবন দুই যুবতী এক জায়গায় হলে কি ধরনের কথা হয় আন্দাজ করতে পারলো না তমাল। তবে সেই আড্ডার অনেকটা জায়গা যে সেও দখল করে ছিলো, সে সম্পর্কে তার সন্দেহ নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার ঠোঁটের কিনারা জুড়ে। বন্দনা মেয়েটাকে বড্ড ভালো লেগে গেছে তমালের। ওর জন্য ভালো কিছু করে যেতে হবে তমালকে।
সত্যিই কি তাই? ভাবলো তমাল! শুধু কি বন্দনা? অদিতি, মৌপিয়া এদেরও কি ভালোবাসেনি তমাল? গার্গী, কুহেলী, এদেরও তো সে ভালোবাসে। তবে কি যে কোনো মেয়েকেই ভালোবাসে তমাল? একটু চিন্তা করে নিশ্চিত হলো, না তা নয়।শারীরিক সম্পর্ক করার পরেও অনেক।মেয়েকে সে পছন্দ করেনি। আসলে এই মেয়েগুলো সরল, ভালো মনের মেয়ে। যৌবনের অবদমিত কামনায় এরা তমালের কাছে ধরা দেয় ঠিকই কিন্তু কেউ এরা খারাপ নয়। হয়তো তমালকে তারা বিশ্বাস করে ফেলে তাই নিজেদের সব কিছু উজাড় করে দেয়! তমালও তো তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি কখনো। নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে তাদের ভালো করতে, সুখী করতে! হঠাৎ মনে পড়লো সেই নিঃস্বার্থ মেয়েটার কথা। তমালের সুখে দুঃখে যে কোনো দাবী না রেখেই জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্টে.. শালিনী! ভীষণ মন কেমন করে উঠলো তমালের শালিনীর জন্য!
আজ কি হলো তমালের? সকাল থেকেই এতো মন খারাপ লাগছে কেন? কাজ শেষ হয়ে এসেছে, কয়েকদিনের ভিতরেই ফিরে যেতে হবে তমালকে নিজের জগতে। এই ক'দিনে মুখার্জি বাড়িতে যে আন্তরিকতা, আতিথেয়তা পেয়েছে, তা আর পাবে না বলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তমালের। এই বাড়ির মানুষগুলো বড় বেশি আন্তরিক!
উঠে পড়লো তমাল। মদনকে রেডি হতে বলে বাথরুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হতে হতে ভাবলো, এ বাড়ির সাথে তো তার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বিচ্ছেদ তো হচ্ছে না, যোগাযোগ থাকবেই। তাহলে এতো মন খারাপ করবে কেন? বরং নিজের অধিকারের বাইরে গিয়েও সে এই বাড়িকে
সম্পূর্ণ রাহু মুক্ত করে যাবে। যাতে ভবিষ্যতে এদের আর কোনো বিপদে পড়তে না হয়। মনে মনে সংকল্প করার পরেই মন ভালো হয়ে গেলো তমালের।
ব্রেকফাস্ট করতে যাবার সময় অকারণ মৌপিয়া আর অদিতির ঘরে ঢুকে গুড মর্নিং উইশ করলো সে। ঘুমন্ত শিখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপরে ব্রেকফাস্ট সেরে মধুছন্দা দেবীকে জানিয়ে এলো যে সে ধানবাদ যাচ্ছে দুদিনের জন্য।
গাড়ি ছাড়ার আগে অদিতি এলো নীচে। তমালকে বললো, তাড়াতাড়ি ফিরো। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগবে না দুদিন। তমাল হেসে বললো, বুঝেছি, রাহুলকে বলে তোমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর একা লাগবে না। অদিতি লজ্জায় লাল হয়ে বললো, ধ্যাৎ!
হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলো তমাল। মদন গাড়ি ছেড়ে দিলো। তমাল পিছনে তাকিয়ে দেখলো অদিতি হাত নাড়ছে দাঁড়িয়ে। গেট পার করে বাঁদিকে মোর নিতেই চোখের আড়াল হলো অদিতি।
তমাল প্রথমেই কল করলো বন্দনাকে। জানালো সে রওনা দিয়েছে। দুপুর দুপুর নাগাদ পৌঁছাবে নিয়ামতপুরে। বন্দনার ঝর্ণার কতো কলকল করে উঠে নিজের খুশি প্রকাশ করলো। বললো এসো, এখানে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
অনেকদিন গার্গীর খবর নেওয়া হয়নি। তমাল কল করলো তাকে। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে সে তাই বেশি কথা হলো না। তবে জানালো, তার কাজ প্রায় শেষ। দু একদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বাকিটা। তারপরেই ফিরবে। ট্রেনের টিকিট কাটতে পাঠাবে আজকে। তমালের কাজ কতোদূর জিজ্ঞাসা করাতে তমালও জানালো প্রায় শেষের পথে। সে এলে এক সাথেই ফিরতে পারবে গরলমুরিতে।
আসানসোল থেকে ধানবাদের দূরত্ব ষাট কিলোমিটারের কাছাকাছি। গাড়িতে যেতে খুব বেশি হলে ঘন্টা দেড়েক লাগে। তবে রাস্তায় জ্যাম থাকলে দুই ঘন্টা বা সোয়া দুই ঘন্টাই যথেষ্ট। এখন ন'টা বাজে, ঘড়ি দেখলো তমাল, অর্থাৎ সাড়ে এগারোটার ভিতরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।
পৌণে দু'ঘন্টায় ধানবাদে ঢুকলো তমাল। শহরে ঢোকার আগে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামালো তমাল। সুরেশ চাকলাদারের ঠিকানাটা দোকানদারকে দেখিয়ে পথ নির্দেশ জেনে নিলো সে। ঠিকানাটা শহরের ভিতরের নয়, বরং শহর থেকে আরো ছয় সাত কিলোমিটার বাইরের এক কোলিয়ারির। সেদিকেই চললো তমাল।
ঠিকানায় পৌঁছে দেখলো এক গৃহস্থ বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘরে ভাড়া থাকেন তিনি। খাওয়া দাওয়া সেই গৃহস্থের সাথেই, তবে অন্দরমহলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই কোনো। তমাল কড়া নাড়তে একটি ষোল সতের বছরের ছেলে এসে জানালো সুরেশ জেঠু ঘরে নেই, বোধহয় বাজারে গেছে। আজ খনিতে যায়নি জেঠু, আজ তার ছুটি। তমাল জানালো তারা অনেক দূর থেকে এসেছে, একটু অপেক্ষা করতে পারে কি না?
তমালের এসইউভি আর পোশাক আশাক দেখে ছেলেটি ভিতরে চলে গেলো, সম্ভবত বড়দের অনুমতি আনতে। কিছুক্ষণ পরে একটা চাবি হাতে ফিরে সুরেশ বাবুর ঘরের তালা খুলে বসতে দিলো তমালকে। এতো সারল্য কলকাতায় ভাবাই যায়না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে নিজের ভাড়াটের ঘর খুলে বসতে দিতোনা কিছুতেই।
ঘরটা অতি সাধারণ। ইটের উপরে মাটির আস্তরণ, উপরে টালির চাল। একটা ছোট তক্তাপোশ মলিন চাদরে নিজের নড়বড়ে পরিচয় গোপন রাখতে পারেনি। পাশে একটা চেয়ার, তার একটা হাতল অক্ষত থাকলেও অপরটা অদৃশ্য। তমাল সেখানে বসলো। ঘরে দুটো দড়িতে সুরেশ চাকলাদারের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ঝুলছে। তার একমাত্র কথা বলা সঙ্গী হলো একটা সাত'শ বছরের পুরানো টেবিল ফ্যান। জন্মের সময় তার রঙ কেমন ছিলো সেটা খুঁজে বের করতে তদন্তের ভার তমালকে নিতে হবে আবার।
ছেলেটি যাবার আগে ভদ্রতা করে সেই ফ্যানটম ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেলো। তমালের মনে হলো ধান ঝাড়াই কলের পাশে ইঁদুর ধরা কলে একসাথে গোটা দশেক ইঁদুর আটকা পড়েছে। নানার স্বরে তারা কিঁচকিঁচ শব্দ করে চলেছে ছাড়া পাবার তাগিদে। তমাল বুঝলো অন্তত এই লোকটা মুখার্জি বাড়ির পাত্র থেকে ক্ষীর খেতে পারেনি। তাহলে এতো বছর চাকরি করেও তার এই দুর্দশা হতো না।
সুরেশ চাকলাদার ফিরলেন প্রায় মিনিট কুড়ি পরে। নিজের ঘর খোলা দেখে এবং ভিতরে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন অল্প বয়স্ক ছেলেকে বসে থাকতে দেখে হতচকিত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তমাল হাত জোড় করে নমস্কার করতেই তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কিন্তু মুহুর্তেই সামলে নিলেন নিজেকে। বহুদিন তিনি বনেদি বাড়িতে ম্যানেজারি করেছেন, ভদ্রলোকদের সাথে কথা বলার দস্তুর তার জানা আছে।
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না... প্রশ্ন করলেন সুরেশ বাবু। তমাল বললো, আমি আসানসোল থেকে আসছি। মুখার্জি বাড়ি থেকে। কথাটা শুনেই সুরেশ বাবুর মুখের ভাব বদলে গেলো। প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছেন বোঝা গেলো। একটু রূঢ় স্বরে বললেন, তা আমার কাছে কি দরকার? সে বাড়ির সাথে সম্পর্ক তো তারা অনেকদিন আগেই মিটিয়ে দিয়েছে। আমার পঞ্চাশ বছরের সেবার ভালো প্রতিদানও দিয়েছে তারা। এখন আবার কি চাই? চলে যান, এই শেষ বয়সে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন!
বলতে বলতে ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সুরেশ বাবু। তমাল তাকে শান্ত হতে একটু সময় দিয়ে বললো, আমি জানি মুখার্জি বাড়িতে আপনার উপর অনেক অবিচার হয়েছে সুরেশ বাবু। বলতে পারেন সেই অবিচারের প্রতিকার করতেই আমি এসেছি। কথাটা শুনে একটু ম্লান হাসলেন তিনি। বললেন আর কি প্রতিকার করবেন? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না, দেখিওনি ওই বাড়িতে কোনোদিন। এখন কি দয়া দেখাতে এসেছেন? চাই না আপনাদের দয়া, চলে যান আপনি।
তমাল বললো, আমি মুখার্জি বাড়ির কেউ নই। আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। আর কেউ না জানুক, আপনি তো জানেন ওই বাড়িতে কি কি অনাচার হয়ে চলেছে? আমি সেই অনাচারের তদন্ত করতেই এসেছি সুরেশ বাবু। আপনার সাহায্য আমার ভীষন দরকার।
অবাক হয়ে তমালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সুরেশ চাকলাদার, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানতাম! এতো পাপ কখনো চাপা থাকে না, একদিন ধর্মের কল নড়বেই। তমাল বললো, আপনি কি জানেন, ওই বাড়িতে আপনার জায়গায় একটি ছেলে কাজ করতে এসেছিলো, রাজীব নামে? সুরেশ বাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তমাল আবার বললো, কিন্তু এটা কি জানেন কেউ বা কারা সেই ছেলেটিকে খুন করার চেষ্টা করেছে ছুরি মেরে? আর তার দায় গিয়ে পড়েছে রাহুলের উপর?
চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো সুরেশ বাবুর। অনেক কষ্টে বললেন, কি বলছেন এসব! রাহুল? তমাল বললো, পুলিশের তাই সন্দেহ, কিন্তু আমি পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করছি। সেটা করতে গিয়ে আরও অনেক জটিল অপরাধের কথা জানতে পেরেছি। আপনি রাহুলের ঠাকুরদার আমলের লোক, আপনি সাহায্য করলে দোষীরা যোগ্য শাস্তি পাবে সুরেশ বাবু, আমি কথা দিলাম।
মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি তমালের দিকে। যেন মনস্থির করে ফেলেছেন, এভাবে বললেন, বেশ বলুন কি জানতে চান। তমাল বললো, এখানে এভাবে কথা বলা অসুবিধা। আপনি যদি দয়া করে আমার সাথে শহরে যেতেন, ভালো হতো। সুরেশ বাবু বললেন, বেশ চলুন। তমাল তাকে পোশাক বদলে নেবার সুযোগ দিতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ পরে নোংরা ধুতি আর মলিন ফতুয়া বদলে ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে এলেন সুরেশ চাকলাদার। তমাল তাকে নিয়ে চললো ধানবাদ শহরের উদ্দেশ্যে।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম