26-04-2025, 09:41 PM
শুরুর শুরু
‘‘তোমায় একটা মজার গল্প বলি, শোনো। সেটা ১৯১৬ সাল। নোবেল পুরস্কারের দৌলতে রবীন্দ্রনাথ ততদিনে বিদেশেও বেশ বিখ্যাত লোক। তো সে বার ‘তোসামারু’ নামে একটা জাহাজে চেপে চীন সাগরের উপর দিয়ে জাপান হয়ে আমেরিকা যাচ্ছেন তিনি। সঙ্গী বলতে পিয়ারসন সাহেব এবং মুকুল দত্ত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বেশ কয়েক জায়গায় লিখেছেন, তিনি জাহাজের কেবিনে ঘুমোতে পারতেন না, তাই ডেকেই বিছানা নিয়ে ঘুমোতেন। হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে ঝড় উঠলো। উথাল-পাথাল সাগরে ওই প্রবল ঝড়! সবাই আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। চারদিকে হৈচৈ, কান্নাকাটি। কিন্তু তাঁর যেন কোনও হুঁশ নেই। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ওই প্রবল ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে নিজেরই লেখা গোটাকতক গানও গেয়ে ফেললেন। কিন্তু তাণ্ডব আর থামে না। বাধ্য হয়ে ঢুকে গেলেন কেবিনে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কাগজ-কলম টেনে নিখে ফেললেন একটা গোটা গান।’’
আন্দামানের বিজয়নগর বিচের শুনশান বালির উপরে বসে বৈঠকী ঢঙে বলা গল্প শুনতে শুনতে পাশের মুখটি এ বারে ফিরল বক্তার দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। অবশ্য বলা যায়, কিছু বলার সুযোগই পেল না। তাকে বেশ বিস্মিত করেই একটা ভরাট পুরুষালী গলা নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার ভেঙে সুরেলা কন্ঠে গেয়ে উঠল, ‘ভুবনজোড়া আসনখানি, আমার হৃদয় মাঝে বিছাও আনি’।
*****
এমনিতেই আন্দামানের এই বিজয়নগর বিচটি ভারী শান্ত। তুলনায় অগভীর জল এবং প্রবাল প্রাচীর দেখার পাশাপাশি নির্জনতা খুঁজতেই এখানে আসে লোকেরা। তবে তত ভিড় হয় না। তার উপরে এত রাত। অবাক হয়ে গানটা শুনতে শুনতে বেখেয়ালে গায়কের কাঁধের উপরে মাথাটা নামিয়ে আনল সদ্য বিবাহিতা ঈশিতা। আপন খেয়ালে গান গাওয়ার ফাঁকেই সেটা খেয়াল করে বড় যত্নের সঙ্গে মাথাটিতে একটি হাত রেখে গানটা গেয়েই চলল বছর তিরিশের ফরেস্ট সার্ভে অফিসার সৌমাভ সরকার। গানটা যখন প্রায় শেষ, তখন ও খেয়াল করল কাঁধটা একটু ভিজে লাগছে। সৌমাভ বুঝল, তার নতুন বিয়ে করা বউ কাঁদছে আবার। তবে এই কান্নাটা যেন অন্য রকম। গানের রেশ থামার পরপরই স্ত্রীর মাথা ঢুকে গেল তাঁর বুকের মধ্যে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি অঘ্রাণ মাসের প্রথম বিয়ের তারিখটিতেই একেবারে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে কার্যত সৌমাভর হাতেপায়ে এবং কন্যের ঘাড়ে ধরে মাত্র দু’দিন আগে আঠেরো বছরে পা দেওয়া ঈশিতা রায়চৌধুরী নামক মেয়েটিকে প্রায় সৌমাভর কোলে তুলে দিয়ে কলকাতায় নিজেদের বাড়ি ফিরে গেছে রায়চৌধুরী পরিবার। সেই ইস্তক স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া তো দূর, একঘরেও শোননি সৌমাভ। অল্প বয়সেই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ঢুকে পরপর কয়েকটা বিভাগীয় পরীক্ষা দিয়ে পছন্দের ফরেস্ট বিভাগে জয়েন করেছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। বছর তিনেক আগে একটা ছোট পদোন্নতি হয়, ফরেস্ট সার্ভে বিভাগে। তখনই পোস্টিং হয়েছিল আন্দামানে। সরকারের মাঝারি পদে কর্মরত সৌমাভ কেন্দ্রের রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়াগুলোর নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের অরণ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতির প্রণয়নেও যুক্ত থাকায় বিশেষ বিশেষ রিজার্ভ ফরেস্টে ওদের মতো অফিসারদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ফিল্ডে যেতে হয়, থাকতেও হয়। এ বারে ওর ভার ছিল আন্দামান-নিকোবরের রেন ফরেস্ট এবং ম্যানগ্রোভ ফরেস্টগুলো নিয়ে সরকারের নানা কাজ দেখাশোনা করা। এ হেন অফিসার তাঁর থেকে বয়সে ১২ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করার একটা অপরাধবোধে এমনিতেই ভুগছিলেন বিস্তর। তার উপর যে ভাবে বিয়ের সেই রাত থেকে মেয়েটি প্রথম তিন-চার দিন সমানে কেঁদে গিয়েছে, এমনকি খাওয়ার সময়েও, তাতে তার গায়ে হাত দেওয়া তো দূর, বিশেষ কাছে যাওয়ারও সাহস হয়নি তার। তবে গত দু’দিনে একটু ধাতস্ত এবং টুকটাক কথা স্ত্রীকে বলতে দেখে কিছুটা ইতস্তত করেই আজ ডিনারের পরে তাকে বিচে আসার একটা প্রস্তাব দিয়েছিল সৌমাভ। এসে অবধি পাশাপাশি বসলেও অতি সাধারণ কিছু কথা বাদে প্রেমালাপ তাদের মধ্যে হয়নি। শেষে নিজের অস্বস্তি কাটাতেই গল্প বলে এবং গান গেয়ে পরিবেশটা হালকা করতে চেয়েছিল সৌমাভ। কিন্তু তার ফলে যে কন্যে একেবারে তার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দেবে, সেটা ভাবেনি সে।
ঈশিতার সঙ্গে সৌমাভর বিয়েটা রীতিমতো চমকপ্রদ বলা যায়। কলকাতা থেকে প্রায় ঘাড় ধরে আনা একজন খেঁকুড়ে উকিল ও মড়াখেকো পুরুতের সামনে একটি ছোট অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ করে কপালে সিঁদুর তুলে সৌমাভর এক স্বল্প পরিচিত কাকা এবং মেয়ের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে নমো নমো করে বিয়েটা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক কালরাত্রি, বৌভাত জাতীয় অনুষ্ঠানের তো প্রশ্নই ওঠে না। সৌমাভর অফিসের কোনও সহকর্মীকেও ডাকা হয়নি মেয়ের পরিবারের লোকেদেরই অনুরোধে। ঠিক হয়েছে, আপাতত রেজিস্ট্রির নোটিসটা দেওয়া হবে। আগামী বছররের গোড়ায় ওদের একবার কলকাতা যেতে হবে, তখন সইসাবুদ হবে। এই গোলমেলে বিয়েতে গোড়ায় ভড়কে গেলেও ঈশিতাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে সৌমাভ। এমনিও তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোন বা কাছের আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। যে কাকা এই বিয়ের ঘটক, তাঁকে গত পাঁচ বছরে একবারও সে দেখেনি। মাসখানেক আগে আচমকাই কোথা থেকে তার আন্দামানের অফিসের নম্বর জোগাড় করে একবার খালি ফোন করে সৌমাভর বাসাটা কোথায়, কটা ঘর এই সব হাবিজাবি খবর জানতে চেয়েছিলেন ওই কাকা। সম্পর্কে তিনি সৌমাভর বাবার দূর সম্পর্কের এক পিসতুতো ভাই, তাই আবাল্যের শিষ্টাচারে সৌমাভ তাঁকে কাকা বলেই ডেকেছে। এমনিতে ও কলকাতার ছেলেই নয়। আদি বাড়ি বর্ধমানে। গ্রামটা বীরভূম লাগোয়া একেবারে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে ও জন্ম ইস্তক বেলুড়েই থেকেছে। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মাকে হারানোর পরে বাবা ওকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বেলুড়ের এক কলেজে। সেখানেই হোস্টেলে থেকে একেবারে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় এবং সেখানেও হোস্টেলেই থাকত। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরনোর পরে একবছর দেঁড়েমুশে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে প্রথম চান্সেই লাগিয়ে দেয়। তবে পোস্টিং হয় দিল্লিতে। সেখানে তিন বছর কাটানোর ফাঁকে বটানি নিয়ে মাস্টার্স এবং তার পরেই চাকরিতে পদোন্নতির সূত্রে আন্দামান পাড়ি। ফলে সেই কাকার সঙ্গেও বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। বছরে দু’বার— নববর্ষ এবং বিজয়ার চিঠি ছাড়া। তবে বাবার মৃত্যুসংবাদটা দিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিল। আন্দামানে নেমে পরের দু’দিন কাকা যে এই ক’বছরে ওর বিয়ের জন্য কত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেটা বোঝাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং দাবি করলেন, এই রকম লক্ষ্মীমন্ত মেয়েকে তিনিই বেছে ঈশিতার বাড়ির লোককে অনেক বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। এখন সৌমাভ বিয়ে না করলে তাঁর সম্মানও যাবে, বিয়েটাও হবে না। মেয়ের নাকি এক মাসের মধ্যে বিয়ে না দিলে মৃত্যুযোগ বলে জানিয়েছে এক জ্যোতিষী। বলাবাহুল্য সবটাই ডাঁহা মিথ্যে। সেটা বুঝতে সৌমাভর অসুবিধাও হয়নি বিন্দুমাত্র। কিন্তু স্বাভাবিক সৌজন্যে চুপ করেই ছিল। মেয়ের বাবা-মা সমেত সকলেই পরের দু’দিন শুধু সৌমাভর পায়ে ধরতে বাকি রাখলেন। শেষে উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে বিয়েটা করতে একরকম বাধ্যই হল সৌমাভ। কাকা যে এমন কাকার-কীর্তি করে বসবেন, তা কোনও দিনও ভাবেনি তরুণ ফরেস্ট অফিসারটি। ঈশিতা সদ্য দিন দুয়েক আগে আঠেরোয় পা দিয়ে সাবালকত্ব পেয়েছে। যদিও তার গড়নের জন্য দেখলে একটু বেশি মনে হয়। মুখটিও মোটের উপর সুন্দর। আগামী বছর মার্চ-এপ্রিলে উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা ঠিকই, কিন্তু পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় সে পরীক্ষা বিশ বাঁও জলে।
‘‘তোমায় একটা মজার গল্প বলি, শোনো। সেটা ১৯১৬ সাল। নোবেল পুরস্কারের দৌলতে রবীন্দ্রনাথ ততদিনে বিদেশেও বেশ বিখ্যাত লোক। তো সে বার ‘তোসামারু’ নামে একটা জাহাজে চেপে চীন সাগরের উপর দিয়ে জাপান হয়ে আমেরিকা যাচ্ছেন তিনি। সঙ্গী বলতে পিয়ারসন সাহেব এবং মুকুল দত্ত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বেশ কয়েক জায়গায় লিখেছেন, তিনি জাহাজের কেবিনে ঘুমোতে পারতেন না, তাই ডেকেই বিছানা নিয়ে ঘুমোতেন। হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে ঝড় উঠলো। উথাল-পাথাল সাগরে ওই প্রবল ঝড়! সবাই আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। চারদিকে হৈচৈ, কান্নাকাটি। কিন্তু তাঁর যেন কোনও হুঁশ নেই। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ওই প্রবল ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে নিজেরই লেখা গোটাকতক গানও গেয়ে ফেললেন। কিন্তু তাণ্ডব আর থামে না। বাধ্য হয়ে ঢুকে গেলেন কেবিনে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কাগজ-কলম টেনে নিখে ফেললেন একটা গোটা গান।’’
আন্দামানের বিজয়নগর বিচের শুনশান বালির উপরে বসে বৈঠকী ঢঙে বলা গল্প শুনতে শুনতে পাশের মুখটি এ বারে ফিরল বক্তার দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। অবশ্য বলা যায়, কিছু বলার সুযোগই পেল না। তাকে বেশ বিস্মিত করেই একটা ভরাট পুরুষালী গলা নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার ভেঙে সুরেলা কন্ঠে গেয়ে উঠল, ‘ভুবনজোড়া আসনখানি, আমার হৃদয় মাঝে বিছাও আনি’।
*****
এমনিতেই আন্দামানের এই বিজয়নগর বিচটি ভারী শান্ত। তুলনায় অগভীর জল এবং প্রবাল প্রাচীর দেখার পাশাপাশি নির্জনতা খুঁজতেই এখানে আসে লোকেরা। তবে তত ভিড় হয় না। তার উপরে এত রাত। অবাক হয়ে গানটা শুনতে শুনতে বেখেয়ালে গায়কের কাঁধের উপরে মাথাটা নামিয়ে আনল সদ্য বিবাহিতা ঈশিতা। আপন খেয়ালে গান গাওয়ার ফাঁকেই সেটা খেয়াল করে বড় যত্নের সঙ্গে মাথাটিতে একটি হাত রেখে গানটা গেয়েই চলল বছর তিরিশের ফরেস্ট সার্ভে অফিসার সৌমাভ সরকার। গানটা যখন প্রায় শেষ, তখন ও খেয়াল করল কাঁধটা একটু ভিজে লাগছে। সৌমাভ বুঝল, তার নতুন বিয়ে করা বউ কাঁদছে আবার। তবে এই কান্নাটা যেন অন্য রকম। গানের রেশ থামার পরপরই স্ত্রীর মাথা ঢুকে গেল তাঁর বুকের মধ্যে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি অঘ্রাণ মাসের প্রথম বিয়ের তারিখটিতেই একেবারে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে কার্যত সৌমাভর হাতেপায়ে এবং কন্যের ঘাড়ে ধরে মাত্র দু’দিন আগে আঠেরো বছরে পা দেওয়া ঈশিতা রায়চৌধুরী নামক মেয়েটিকে প্রায় সৌমাভর কোলে তুলে দিয়ে কলকাতায় নিজেদের বাড়ি ফিরে গেছে রায়চৌধুরী পরিবার। সেই ইস্তক স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া তো দূর, একঘরেও শোননি সৌমাভ। অল্প বয়সেই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ঢুকে পরপর কয়েকটা বিভাগীয় পরীক্ষা দিয়ে পছন্দের ফরেস্ট বিভাগে জয়েন করেছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। বছর তিনেক আগে একটা ছোট পদোন্নতি হয়, ফরেস্ট সার্ভে বিভাগে। তখনই পোস্টিং হয়েছিল আন্দামানে। সরকারের মাঝারি পদে কর্মরত সৌমাভ কেন্দ্রের রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়াগুলোর নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের অরণ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতির প্রণয়নেও যুক্ত থাকায় বিশেষ বিশেষ রিজার্ভ ফরেস্টে ওদের মতো অফিসারদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ফিল্ডে যেতে হয়, থাকতেও হয়। এ বারে ওর ভার ছিল আন্দামান-নিকোবরের রেন ফরেস্ট এবং ম্যানগ্রোভ ফরেস্টগুলো নিয়ে সরকারের নানা কাজ দেখাশোনা করা। এ হেন অফিসার তাঁর থেকে বয়সে ১২ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করার একটা অপরাধবোধে এমনিতেই ভুগছিলেন বিস্তর। তার উপর যে ভাবে বিয়ের সেই রাত থেকে মেয়েটি প্রথম তিন-চার দিন সমানে কেঁদে গিয়েছে, এমনকি খাওয়ার সময়েও, তাতে তার গায়ে হাত দেওয়া তো দূর, বিশেষ কাছে যাওয়ারও সাহস হয়নি তার। তবে গত দু’দিনে একটু ধাতস্ত এবং টুকটাক কথা স্ত্রীকে বলতে দেখে কিছুটা ইতস্তত করেই আজ ডিনারের পরে তাকে বিচে আসার একটা প্রস্তাব দিয়েছিল সৌমাভ। এসে অবধি পাশাপাশি বসলেও অতি সাধারণ কিছু কথা বাদে প্রেমালাপ তাদের মধ্যে হয়নি। শেষে নিজের অস্বস্তি কাটাতেই গল্প বলে এবং গান গেয়ে পরিবেশটা হালকা করতে চেয়েছিল সৌমাভ। কিন্তু তার ফলে যে কন্যে একেবারে তার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দেবে, সেটা ভাবেনি সে।
ঈশিতার সঙ্গে সৌমাভর বিয়েটা রীতিমতো চমকপ্রদ বলা যায়। কলকাতা থেকে প্রায় ঘাড় ধরে আনা একজন খেঁকুড়ে উকিল ও মড়াখেকো পুরুতের সামনে একটি ছোট অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ করে কপালে সিঁদুর তুলে সৌমাভর এক স্বল্প পরিচিত কাকা এবং মেয়ের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে নমো নমো করে বিয়েটা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক কালরাত্রি, বৌভাত জাতীয় অনুষ্ঠানের তো প্রশ্নই ওঠে না। সৌমাভর অফিসের কোনও সহকর্মীকেও ডাকা হয়নি মেয়ের পরিবারের লোকেদেরই অনুরোধে। ঠিক হয়েছে, আপাতত রেজিস্ট্রির নোটিসটা দেওয়া হবে। আগামী বছররের গোড়ায় ওদের একবার কলকাতা যেতে হবে, তখন সইসাবুদ হবে। এই গোলমেলে বিয়েতে গোড়ায় ভড়কে গেলেও ঈশিতাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে সৌমাভ। এমনিও তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোন বা কাছের আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। যে কাকা এই বিয়ের ঘটক, তাঁকে গত পাঁচ বছরে একবারও সে দেখেনি। মাসখানেক আগে আচমকাই কোথা থেকে তার আন্দামানের অফিসের নম্বর জোগাড় করে একবার খালি ফোন করে সৌমাভর বাসাটা কোথায়, কটা ঘর এই সব হাবিজাবি খবর জানতে চেয়েছিলেন ওই কাকা। সম্পর্কে তিনি সৌমাভর বাবার দূর সম্পর্কের এক পিসতুতো ভাই, তাই আবাল্যের শিষ্টাচারে সৌমাভ তাঁকে কাকা বলেই ডেকেছে। এমনিতে ও কলকাতার ছেলেই নয়। আদি বাড়ি বর্ধমানে। গ্রামটা বীরভূম লাগোয়া একেবারে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে ও জন্ম ইস্তক বেলুড়েই থেকেছে। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মাকে হারানোর পরে বাবা ওকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বেলুড়ের এক কলেজে। সেখানেই হোস্টেলে থেকে একেবারে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় এবং সেখানেও হোস্টেলেই থাকত। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরনোর পরে একবছর দেঁড়েমুশে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে প্রথম চান্সেই লাগিয়ে দেয়। তবে পোস্টিং হয় দিল্লিতে। সেখানে তিন বছর কাটানোর ফাঁকে বটানি নিয়ে মাস্টার্স এবং তার পরেই চাকরিতে পদোন্নতির সূত্রে আন্দামান পাড়ি। ফলে সেই কাকার সঙ্গেও বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। বছরে দু’বার— নববর্ষ এবং বিজয়ার চিঠি ছাড়া। তবে বাবার মৃত্যুসংবাদটা দিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিল। আন্দামানে নেমে পরের দু’দিন কাকা যে এই ক’বছরে ওর বিয়ের জন্য কত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেটা বোঝাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং দাবি করলেন, এই রকম লক্ষ্মীমন্ত মেয়েকে তিনিই বেছে ঈশিতার বাড়ির লোককে অনেক বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। এখন সৌমাভ বিয়ে না করলে তাঁর সম্মানও যাবে, বিয়েটাও হবে না। মেয়ের নাকি এক মাসের মধ্যে বিয়ে না দিলে মৃত্যুযোগ বলে জানিয়েছে এক জ্যোতিষী। বলাবাহুল্য সবটাই ডাঁহা মিথ্যে। সেটা বুঝতে সৌমাভর অসুবিধাও হয়নি বিন্দুমাত্র। কিন্তু স্বাভাবিক সৌজন্যে চুপ করেই ছিল। মেয়ের বাবা-মা সমেত সকলেই পরের দু’দিন শুধু সৌমাভর পায়ে ধরতে বাকি রাখলেন। শেষে উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে বিয়েটা করতে একরকম বাধ্যই হল সৌমাভ। কাকা যে এমন কাকার-কীর্তি করে বসবেন, তা কোনও দিনও ভাবেনি তরুণ ফরেস্ট অফিসারটি। ঈশিতা সদ্য দিন দুয়েক আগে আঠেরোয় পা দিয়ে সাবালকত্ব পেয়েছে। যদিও তার গড়নের জন্য দেখলে একটু বেশি মনে হয়। মুখটিও মোটের উপর সুন্দর। আগামী বছর মার্চ-এপ্রিলে উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা ঠিকই, কিন্তু পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় সে পরীক্ষা বিশ বাঁও জলে।