13-04-2025, 12:59 AM
(২৯)
মুখোমুখি
গৌরব ঘরে ঢুকে একবার সুখন এবং একবার রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে ভাল করে রুপশ্রীর সিঁথিতে চোখ বোলালেন। রুপশ্রীর সিঁথিতে সে দিনের সিঁদুরের দাগ এখনও কিছুটা স্পষ্ট। এর পরে নিঃশব্দে বাবার পিছনে এসে দাঁড়ানো রুদ্র এবং পাশে দাঁড়ানো বুলাকেও প্রচন্ড চমকে দিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। বহু, বহু দিন পরে তাঁর এমন জোরালো হাসি শুনে চমকে উঠল সবাই। রুদ্র, বুলা বা রুপশ্রী তো বটেই, শুয়ে থাকা সুখনও নড়েচড়ে উঠল! তার পরে একেবারে সেদিন রাতের রুদ্রর ঢঙেই গলায় তীব্র ব্যঙ্গ ঢেলে রুপশ্রীকে বললেন, ‘‘এই তোমার ছোটবেলার প্রেমিক? আহা রে! এই ছোটবেলার প্রেমিককে ভুলতে পারোনি বলেই অমন ব্যবহার করতে আমার সঙ্গে? এমনকি রাতেও? এই ছোটবেলার প্রেমিককে বিয়ে করার জন্যই তুমি একগাদা মিথ্যে কথা বলে আমার থেকে ডিভোর্স নিয়েছিলে? আমাকে বললে, আমি নিজেই তো তোমাকে তোমার এই প্রাণের ছোটবেলার প্রেমিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে দিতাম! ইস, কী ভুল করেছো বলো তো? মাঝখান থেকে তিনটে নির্দোষ মেয়ের ঘাড়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে, আমাকে সবার কাছে ছোট করে ডিভোর্স নিলে তোমার এই ছোটবেলার প্রেমিককে বিয়ে করার জন্য?’’ বারবার তীব্র শ্লেষের সঙ্গে ‘তোমার এই ছোটবেলার প্রেমিক’ কথাটা বলে রুপশ্রীকে ক্রমাগত তাঁর রুচি, মিথ্যে কথা, বিয়ের পরের বহু আচরণ— সব কিছু মনে করিয়ে প্রবল ভাবে আঘাত করে চলছিলেন গৌরব।
রুপশ্রী আর সহ্য করতে পারলেন না। পরশু রাতে তাঁর জিভে রুদ্রর দেওয়া ইঞ্জেকশনের প্রভাব গত কাল রাতেই অনেকটা কেটে গেছে। যদিও তিনি বুঝতে পারেননি। পরশু রাতের নানা ঘটনার প্রবল অভিঘাতে কেঁদে কেঁদে ভেঙে যাওয়া গলাও এখন কিছুটা স্বাভাবিক। একটি হাত এবং একটি পায়ে বেশ কিছুটা সাড় ফিরে এসেছে। গৌরবের লাগাতার খোঁচা এবং বিদ্রুপে এই বারে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেন রুপশ্রী। সবাইকে চমকে দিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসা গলায় হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে খাট থেকে ঘষটে ঘষটে নেমে গৌরবের পা ধরতে গেলেন। কিন্তু গৌরব ছিটকে সরে গেলেন, বুলাকেও টেনে আনলেন নিজের দিকে। তার পরে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার স্পর্শও আমার কাছে বিষ! তার পরেই বুলা এবং রুদ্রর দিকে তাকিয়ে নির্দেশের ঢঙে বললেন, ‘‘আমি যদি আগে মরি, একটা কথা তোমাদের বলে দিয়ে গেলাম। এই মহিলা ওই খাটটিতে শুয়ে থাকা লোকটির স্ত্রী। উনি যেন আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত না করেন। উনি অন্যের স্ত্রী, এই বাড়িতে যেন ওনার অসম্মান না হয়। তবে তোমরা দয়া করে ওনাকে আমার মৃতদেহও স্পর্শ করতে দিও না, এটা আমার অনুরোধ।’’ তার পরেই গলায় সেই পুরনো ব্যঙ্গের রেশ ফের টেনে বললেন, ‘‘আমি আগে মারা গেলে ওনাকে কেউ খবরও দিও না। আর দেখো, উনি যেন অশৌচ পালন করতে না যান। তা হলে ওনার ছোটবেলার প্রেমিক তথা স্বামী, যাঁর হাতের সিঁদুর ওঁর মাথায়, ওঁর সেই সোয়ামির অমঙ্গল হবে।’’ বলে ফের রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বুলার কাঁধে হাত দিয়ে।
বরাবরের শান্ত নিরীহ গৌরব। এমনকি রাতে সঙ্গমের সময় একবার গায়ে-চুলে বীর্য ফেলায় একাধিক থাপ্পড়ও মেরেছিলেন তাঁকে রুপশ্রী। কিন্তু স্ত্রীকে কোনও দিন কিছু বলেননি তিনি। সেই মানুষটাই আজ তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে রুপশ্রীকে ফালাফালা করার পাশাপাশি এও জানিয়ে দিলেন, তাঁর স্পর্শও তিনি নেবেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও যেন তাঁকে না ছুঁতে পারেন, কারণ তিনি অন্যের স্ত্রী! অথচ ঘরে দাঁড়ানো রুদ্র এবং রুপশ্রী এই দু’জনেই জানেন, সুখনের সঙ্গে শারীরিক ভাবে সব কিছু করলেও সে দিন তাঁদের দু’জনের বিয়েটাই হয়নি। সান্যালবাড়ি ছাড়ার সময় এই সিঁদুর জোর করে সুখনকে দিয়ে চাপিয়ে দিয়েছিল রুদ্রই। গৌরব ঘর ছাড়তেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে রুপশ্রী বললেন, ‘‘তুই সে দিনই আমাকে একেবারে খুন করে ফেললি না কেন বাবু? আমি পাপী, ভয়ঙ্কর পাপী। তোদের সবার সঙ্গে অনেক পাপ করেছি আমি। আমাকে খুন করে ফেল তুই। না হলে অন্তত বিষ দে, খেয়ে মরি। এই রোজকার যন্ত্রণা আর কতদিন আমাকে দিবি তুই, বলতে পারিস?’’ রুদ্র নিচু হয়ে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে হিসহিসে গলায় বলল, ‘‘সেদিন ফুলশয্যা হয়নি বলে রাগ? নাকি আগের মতো করে ওই লোকটার সঙ্গে ওই সব করতে পারছেন না বলে রাগের চোটে এ সব নাটুকে কথা বলছেন ম্যাডাম? আর বাবু কে? এ ঘরে তো কোনও বাবু নেই ম্যাডাম! আপনার বাবু নামের কোনও সন্তান আছে নাকি? আপনার তো ওই লোকটাকে বিয়ে করে তার সন্তান পেটে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল বলে জানি। তার ভিডিও-ও আছে, দেখবেন নাকি? নাকি বাবু নামে আর কোনও সন্তান আপনার আছে ম্যাডাম?’’ রুদ্রর এই তীব্র ব্যঙ্গে ফের ডুকরে কেঁদে উঠলেন রুপশ্রী। রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
একটু পরেই বাড়ির গেটে ট্যাক্সি থেকে নামলেন জয়ন্তানুজ। এসেই সোজা উপরে উঠে গেলেন। তিনি শেষবার যখন এসেছিলেন, তখনই দেখেছিলেন, সবাই দোতলার বাসিন্দা, একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। দোতলায় উঠে গৌরবকে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। এত ভেঙে গেছে লোকটার শরীর! কেন? তার পরেই চোখ গেল ঘরে মায়ের দিকে। তিনি সদ্য তখন উঠে বসেছেন। রুদ্র মামাকে দেখে টেনে দিদার সামনে থেকে সরিয়ে এনে বলল, আগে তুমি ফ্রেস হও, তার পর কথা বোলো সবার সঙ্গে।
জয়ন্ত ফ্রেস হয়ে এসে চা-জলখাবার খেয়ে মায়ের কাছে এসে বসতেই ধাক্কা খেলেন। ছেলের ভালমন্দের কোনও খোঁজ না নিয়েই বৃদ্ধা মেয়ের কীর্তিকাহিনী বলতে শুরু করে দিলেন। চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল জয়ন্তর। আবার সেই লোক? আবার বোন সেই একই কাজ করেছে এই বয়সে? থমথমে মুখে ভাগ্নের দিকে তাকাতে সে ইশারায় নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। বিভ্রান্তের মতো ভাগ্নের সঙ্গে গেলেন। গেলেন বুলাও। তিনি গৌরবকে আর যেতে দিলেন না। সেখানে প্রথমে রুদ্র এবং পরে বুলা প্রায় সবই তাঁকে বলল। ডিভোর্স থেকে গত কাল এ বাড়িতে আনা অবধি কী কী হয়েছে। শুধু রুদ্র নিজের দু’দিনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা এবং ভিডিয়োর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। বলা হল, আচমকা গিয়ে বিয়ের প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে ঘটনার দিন গিয়ে রুদ্র কী ভাবে তা পন্ড করে দু’জনকে ইঞ্জেকশন দিয়ে শাস্তি দিয়েছে। ভাগ্নের দিকে তাকালেন মামা। বুঝলেন ভাগ্নে অনেক কথা লুকোচ্ছে। তবে জিজ্ঞাসা করলেন না আর। ওইখানে বসেই মাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। বছর সাত-আট আগে একবার মাকে সিঙ্গাপুরে নিজের কাছে নিয়ে গেছিলেন জয়ন্ত। মাকে নিয়ে দেশে ফেরার পর থেকে মায়ের পাসপোর্ট তাঁর কাছেই রাখা ছিল। মা বেশি অসুস্থ হলে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন ভেবে এ বার সেটা সঙ্গেই এনেছিলেন তিনি। দ্রুত একজন এজেন্টকে ফোন করে দুটো টিকিটের ব্যবস্থা করতে বললেন। সেই সঙ্গে ফোনে ফোনে অন্যান্য প্রস্তুতিও নিলেন পরের বেশ কিছুক্ষণ ধরে। তার পরে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমাকে নীচে নিয়ে চল! কথাটা শুনেই বুদ্ধিমতী বুলা নীচের দুই আয়াকে উপরে ডেকে পাঠিয়ে রুদ্রর দিদার ঘরে ঢুকিয়ে হাবিজাবি কথার ছলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। রুদ্র আস্তে করে মামাকে বলল, আমার আর ভাল লাগছে না, তুমি একাই যাও প্লিজ।
ধীর পায়ে নীচে নামলেন জয়ন্ত। বাইরে শান্ত থাকলেও তাঁর মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে! সেই সুখনের জন্য এই গৌরবকে ডিভোর্স দিয়ে এই ছেলেমেয়ে, সংসার সব ছেড়েছিল বোন? এত বছর পরে? অতীতের কথা স্মরণ করে তিনি ধরেই নিয়েছেন, বোন ওখানে ফিরে অবধি সুখনের সঙ্গে রোজ শারীরিক মিলন করেছে এবং সেটাও সান্যালবাড়ির ভিতরে! গনগনে চোখমুখে ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে বোনের সামনে দাঁড়ালেন জয়ন্ত। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল রুপশ্রীর। তিনি কিছু বলার আগেই বোনের মুখে একদলা থুতু দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন জয়ন্ত— ‘‘তুই মরতে পারিসনি?’’ বলেই মাটিতে বসে কেঁদে ফেললেন পঞ্চাশ পেরনো ডাকাবুকো জয়ন্তানুজ সান্যাল। ছেলের মতো দাদাও একই ভাবে তাঁর মুখে থুতু দিল! থুতু না মুছেই ঘষটে ঘষটে দাদার পা ধরতে গেলেন রুপশ্রী। কিন্তু গৌরবের মতোই ঘৃণায় ছিটকে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত বললেন, ‘‘গোলু যেমন মেনে নিয়েছে ওর গর্ভধানিরী মা মরে গেছে, আজ থেকে আমিও মেনে নিলাম, আমার মায়ের পেটের বোন মরে গেছে।’’ বলে বয়সে অনেক ছোট এবং আদরের বোনের দিকে না তাকিয়েই কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উপরে এসে গৌরবকে ধরে কেঁদে ফেললেন বরাবরের সাহসী, সৎ, ডাকাবুকো জয়ন্ত।
জয়ন্ত মাকে নিয়ে ফেরার টিকিট পেলেন সাত দিন পরে। কিন্তু তিনি বসে রইলেন না। বাগচী বাড়িতে লোক লাগিয়ে দোতলার বারান্দার বাইরের দিকে একটি ছোট স্ল্যাব ঢালাই করালেন। কেউ প্রশ্ন করলেও উত্তর দিলেন না। তার পরে এক দিন নতুন জামাকাপড় পরে এবং ভাগ্নেকেও পরিয়ে বুলার গাড়িতে দু’জন শ্রমিক নিয়ে বেশি রাতে ঢুকলেন সান্যালবাড়িতে। তবে ভিতরে গেলেন না। শ্রমিকদের দিয়ে একরকম নিঃশব্দে তুলসীমঞ্চ ও সানন্যালবাড়ির বিগ্রহকে তুলে সযত্নে নিয়ে এলেন রুদ্রদের বাড়িতে। তার পরে পুরোহিত ডেকে বিধান নিয়ে ধুমধাম করে সেটা প্রতিষ্ঠা করলেন বাগচী বাড়ির বারান্দার স্ল্যাবে। উপরে কী হচ্ছে, সেটা আয়াদের কাছে শুনে প্রথমটা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝে নিলেন রুপশ্রী। এই ঠাকুর, এই তুলসীমঞ্চ তাঁর ছোটবেলা থেকেই অতি প্রিয়। ছোট থেকেই তিনি এর পুজো করেছেন। বিয়ের পরে যখনই যেতেন, তিনিই পুজো করতেন। সন্ধ্যাবাতি দেখাতেন। এমনকি ডিভোর্স দিয়ে ও বাড়িতে গিয়ে অবধি তিনিই রোজ পুজো করতেন, সন্ধ্যাবাতি দেখাতেন। কিন্তু সুখন তাঁর কাছে ফিরে আসার পর থেকে? আর ভাবতে পারছিলেন না রুপশ্রী। এরই মধ্যে ভাগ্নের কাঁধে হাত দিয়ে নীচে এসে চারদিকে শান্তির জল ছেটাতে ছেটাতে জয়ন্ত বললেন, ‘‘এখন থেকে এই বাড়িতেই এই তুলসীমঞ্চ এবং বিগ্রহের পুজো হবে। সান্যালবাড়ি বরাবরের মতো পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। ও বাড়িতে ভয়ঙ্কর পাপ হয়েছে অনেক দিন ধরে। ও বাড়ি অপবিত্র, অশুচি। ও বাড়িতে এই দেবতার পুজো করা যায় না।’’ ঘরের মধ্যে চোখে জল নিয়েই সব কথা শুনলেন রুপশ্রী। এর পরে ঘরে ঢুকে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়েই জয়ন্ত বলে দিলেন, সে যেন কোনও দিন এই বাড়ির দোতলায় প্রতিষ্ঠা করা সান্যালবাড়ির তুলসীমঞ্চ বা বিগ্রহ স্পর্শ পর্যন্ত না করে। দাদার এই কথা শুনে ভিতরটা খানখান হয়ে গেল বরাবরের ইশ্বরভক্ত রুপশ্রীর। ওই ঠাকুরথানের কয়েক হাত দূরে তিনি প্রায় একমাস ধরে কী করেছেন, সেটা ফের মনে পড়ে গেল তাঁর। সশব্দে কেঁদে ফেললেন তিনি। তাঁকে কাঁদতে দেখে জয়ন্ত জানিয়ে দিলেন, অশুচি কেউ ওই বিগ্রহ স্পর্শ করতে পারে না, এটাই নিয়ম। তা ছাড়া সুখনকে বিয়ে করা রুপশ্রী আর স্যান্যাল বা বাগচী পরিবারের কেউ নয়। রুপশ্রী কাঁদতে কাঁদতে দাদার কাছে তাঁর বিয়ে হয়নি বলায় জয়ন্ত বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন, ‘‘বিয়ের অনুষ্ঠানটা না হয় ঘটা করে লোক ডেকে হয়নি, বাদবাকি সবই তো হয়েছে!’’ রুপশ্রী মাথা নামিয়ে নিলেন।
মুখোমুখি
গৌরব ঘরে ঢুকে একবার সুখন এবং একবার রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে ভাল করে রুপশ্রীর সিঁথিতে চোখ বোলালেন। রুপশ্রীর সিঁথিতে সে দিনের সিঁদুরের দাগ এখনও কিছুটা স্পষ্ট। এর পরে নিঃশব্দে বাবার পিছনে এসে দাঁড়ানো রুদ্র এবং পাশে দাঁড়ানো বুলাকেও প্রচন্ড চমকে দিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। বহু, বহু দিন পরে তাঁর এমন জোরালো হাসি শুনে চমকে উঠল সবাই। রুদ্র, বুলা বা রুপশ্রী তো বটেই, শুয়ে থাকা সুখনও নড়েচড়ে উঠল! তার পরে একেবারে সেদিন রাতের রুদ্রর ঢঙেই গলায় তীব্র ব্যঙ্গ ঢেলে রুপশ্রীকে বললেন, ‘‘এই তোমার ছোটবেলার প্রেমিক? আহা রে! এই ছোটবেলার প্রেমিককে ভুলতে পারোনি বলেই অমন ব্যবহার করতে আমার সঙ্গে? এমনকি রাতেও? এই ছোটবেলার প্রেমিককে বিয়ে করার জন্যই তুমি একগাদা মিথ্যে কথা বলে আমার থেকে ডিভোর্স নিয়েছিলে? আমাকে বললে, আমি নিজেই তো তোমাকে তোমার এই প্রাণের ছোটবেলার প্রেমিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে দিতাম! ইস, কী ভুল করেছো বলো তো? মাঝখান থেকে তিনটে নির্দোষ মেয়ের ঘাড়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে, আমাকে সবার কাছে ছোট করে ডিভোর্স নিলে তোমার এই ছোটবেলার প্রেমিককে বিয়ে করার জন্য?’’ বারবার তীব্র শ্লেষের সঙ্গে ‘তোমার এই ছোটবেলার প্রেমিক’ কথাটা বলে রুপশ্রীকে ক্রমাগত তাঁর রুচি, মিথ্যে কথা, বিয়ের পরের বহু আচরণ— সব কিছু মনে করিয়ে প্রবল ভাবে আঘাত করে চলছিলেন গৌরব।
রুপশ্রী আর সহ্য করতে পারলেন না। পরশু রাতে তাঁর জিভে রুদ্রর দেওয়া ইঞ্জেকশনের প্রভাব গত কাল রাতেই অনেকটা কেটে গেছে। যদিও তিনি বুঝতে পারেননি। পরশু রাতের নানা ঘটনার প্রবল অভিঘাতে কেঁদে কেঁদে ভেঙে যাওয়া গলাও এখন কিছুটা স্বাভাবিক। একটি হাত এবং একটি পায়ে বেশ কিছুটা সাড় ফিরে এসেছে। গৌরবের লাগাতার খোঁচা এবং বিদ্রুপে এই বারে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেন রুপশ্রী। সবাইকে চমকে দিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসা গলায় হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে খাট থেকে ঘষটে ঘষটে নেমে গৌরবের পা ধরতে গেলেন। কিন্তু গৌরব ছিটকে সরে গেলেন, বুলাকেও টেনে আনলেন নিজের দিকে। তার পরে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার স্পর্শও আমার কাছে বিষ! তার পরেই বুলা এবং রুদ্রর দিকে তাকিয়ে নির্দেশের ঢঙে বললেন, ‘‘আমি যদি আগে মরি, একটা কথা তোমাদের বলে দিয়ে গেলাম। এই মহিলা ওই খাটটিতে শুয়ে থাকা লোকটির স্ত্রী। উনি যেন আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত না করেন। উনি অন্যের স্ত্রী, এই বাড়িতে যেন ওনার অসম্মান না হয়। তবে তোমরা দয়া করে ওনাকে আমার মৃতদেহও স্পর্শ করতে দিও না, এটা আমার অনুরোধ।’’ তার পরেই গলায় সেই পুরনো ব্যঙ্গের রেশ ফের টেনে বললেন, ‘‘আমি আগে মারা গেলে ওনাকে কেউ খবরও দিও না। আর দেখো, উনি যেন অশৌচ পালন করতে না যান। তা হলে ওনার ছোটবেলার প্রেমিক তথা স্বামী, যাঁর হাতের সিঁদুর ওঁর মাথায়, ওঁর সেই সোয়ামির অমঙ্গল হবে।’’ বলে ফের রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বুলার কাঁধে হাত দিয়ে।
বরাবরের শান্ত নিরীহ গৌরব। এমনকি রাতে সঙ্গমের সময় একবার গায়ে-চুলে বীর্য ফেলায় একাধিক থাপ্পড়ও মেরেছিলেন তাঁকে রুপশ্রী। কিন্তু স্ত্রীকে কোনও দিন কিছু বলেননি তিনি। সেই মানুষটাই আজ তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে রুপশ্রীকে ফালাফালা করার পাশাপাশি এও জানিয়ে দিলেন, তাঁর স্পর্শও তিনি নেবেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও যেন তাঁকে না ছুঁতে পারেন, কারণ তিনি অন্যের স্ত্রী! অথচ ঘরে দাঁড়ানো রুদ্র এবং রুপশ্রী এই দু’জনেই জানেন, সুখনের সঙ্গে শারীরিক ভাবে সব কিছু করলেও সে দিন তাঁদের দু’জনের বিয়েটাই হয়নি। সান্যালবাড়ি ছাড়ার সময় এই সিঁদুর জোর করে সুখনকে দিয়ে চাপিয়ে দিয়েছিল রুদ্রই। গৌরব ঘর ছাড়তেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে রুপশ্রী বললেন, ‘‘তুই সে দিনই আমাকে একেবারে খুন করে ফেললি না কেন বাবু? আমি পাপী, ভয়ঙ্কর পাপী। তোদের সবার সঙ্গে অনেক পাপ করেছি আমি। আমাকে খুন করে ফেল তুই। না হলে অন্তত বিষ দে, খেয়ে মরি। এই রোজকার যন্ত্রণা আর কতদিন আমাকে দিবি তুই, বলতে পারিস?’’ রুদ্র নিচু হয়ে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়ে হিসহিসে গলায় বলল, ‘‘সেদিন ফুলশয্যা হয়নি বলে রাগ? নাকি আগের মতো করে ওই লোকটার সঙ্গে ওই সব করতে পারছেন না বলে রাগের চোটে এ সব নাটুকে কথা বলছেন ম্যাডাম? আর বাবু কে? এ ঘরে তো কোনও বাবু নেই ম্যাডাম! আপনার বাবু নামের কোনও সন্তান আছে নাকি? আপনার তো ওই লোকটাকে বিয়ে করে তার সন্তান পেটে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল বলে জানি। তার ভিডিও-ও আছে, দেখবেন নাকি? নাকি বাবু নামে আর কোনও সন্তান আপনার আছে ম্যাডাম?’’ রুদ্রর এই তীব্র ব্যঙ্গে ফের ডুকরে কেঁদে উঠলেন রুপশ্রী। রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
একটু পরেই বাড়ির গেটে ট্যাক্সি থেকে নামলেন জয়ন্তানুজ। এসেই সোজা উপরে উঠে গেলেন। তিনি শেষবার যখন এসেছিলেন, তখনই দেখেছিলেন, সবাই দোতলার বাসিন্দা, একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। দোতলায় উঠে গৌরবকে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। এত ভেঙে গেছে লোকটার শরীর! কেন? তার পরেই চোখ গেল ঘরে মায়ের দিকে। তিনি সদ্য তখন উঠে বসেছেন। রুদ্র মামাকে দেখে টেনে দিদার সামনে থেকে সরিয়ে এনে বলল, আগে তুমি ফ্রেস হও, তার পর কথা বোলো সবার সঙ্গে।
জয়ন্ত ফ্রেস হয়ে এসে চা-জলখাবার খেয়ে মায়ের কাছে এসে বসতেই ধাক্কা খেলেন। ছেলের ভালমন্দের কোনও খোঁজ না নিয়েই বৃদ্ধা মেয়ের কীর্তিকাহিনী বলতে শুরু করে দিলেন। চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল জয়ন্তর। আবার সেই লোক? আবার বোন সেই একই কাজ করেছে এই বয়সে? থমথমে মুখে ভাগ্নের দিকে তাকাতে সে ইশারায় নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। বিভ্রান্তের মতো ভাগ্নের সঙ্গে গেলেন। গেলেন বুলাও। তিনি গৌরবকে আর যেতে দিলেন না। সেখানে প্রথমে রুদ্র এবং পরে বুলা প্রায় সবই তাঁকে বলল। ডিভোর্স থেকে গত কাল এ বাড়িতে আনা অবধি কী কী হয়েছে। শুধু রুদ্র নিজের দু’দিনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা এবং ভিডিয়োর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। বলা হল, আচমকা গিয়ে বিয়ের প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে ঘটনার দিন গিয়ে রুদ্র কী ভাবে তা পন্ড করে দু’জনকে ইঞ্জেকশন দিয়ে শাস্তি দিয়েছে। ভাগ্নের দিকে তাকালেন মামা। বুঝলেন ভাগ্নে অনেক কথা লুকোচ্ছে। তবে জিজ্ঞাসা করলেন না আর। ওইখানে বসেই মাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। বছর সাত-আট আগে একবার মাকে সিঙ্গাপুরে নিজের কাছে নিয়ে গেছিলেন জয়ন্ত। মাকে নিয়ে দেশে ফেরার পর থেকে মায়ের পাসপোর্ট তাঁর কাছেই রাখা ছিল। মা বেশি অসুস্থ হলে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন ভেবে এ বার সেটা সঙ্গেই এনেছিলেন তিনি। দ্রুত একজন এজেন্টকে ফোন করে দুটো টিকিটের ব্যবস্থা করতে বললেন। সেই সঙ্গে ফোনে ফোনে অন্যান্য প্রস্তুতিও নিলেন পরের বেশ কিছুক্ষণ ধরে। তার পরে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমাকে নীচে নিয়ে চল! কথাটা শুনেই বুদ্ধিমতী বুলা নীচের দুই আয়াকে উপরে ডেকে পাঠিয়ে রুদ্রর দিদার ঘরে ঢুকিয়ে হাবিজাবি কথার ছলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। রুদ্র আস্তে করে মামাকে বলল, আমার আর ভাল লাগছে না, তুমি একাই যাও প্লিজ।
ধীর পায়ে নীচে নামলেন জয়ন্ত। বাইরে শান্ত থাকলেও তাঁর মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে! সেই সুখনের জন্য এই গৌরবকে ডিভোর্স দিয়ে এই ছেলেমেয়ে, সংসার সব ছেড়েছিল বোন? এত বছর পরে? অতীতের কথা স্মরণ করে তিনি ধরেই নিয়েছেন, বোন ওখানে ফিরে অবধি সুখনের সঙ্গে রোজ শারীরিক মিলন করেছে এবং সেটাও সান্যালবাড়ির ভিতরে! গনগনে চোখমুখে ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে বোনের সামনে দাঁড়ালেন জয়ন্ত। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল রুপশ্রীর। তিনি কিছু বলার আগেই বোনের মুখে একদলা থুতু দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন জয়ন্ত— ‘‘তুই মরতে পারিসনি?’’ বলেই মাটিতে বসে কেঁদে ফেললেন পঞ্চাশ পেরনো ডাকাবুকো জয়ন্তানুজ সান্যাল। ছেলের মতো দাদাও একই ভাবে তাঁর মুখে থুতু দিল! থুতু না মুছেই ঘষটে ঘষটে দাদার পা ধরতে গেলেন রুপশ্রী। কিন্তু গৌরবের মতোই ঘৃণায় ছিটকে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত বললেন, ‘‘গোলু যেমন মেনে নিয়েছে ওর গর্ভধানিরী মা মরে গেছে, আজ থেকে আমিও মেনে নিলাম, আমার মায়ের পেটের বোন মরে গেছে।’’ বলে বয়সে অনেক ছোট এবং আদরের বোনের দিকে না তাকিয়েই কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উপরে এসে গৌরবকে ধরে কেঁদে ফেললেন বরাবরের সাহসী, সৎ, ডাকাবুকো জয়ন্ত।
জয়ন্ত মাকে নিয়ে ফেরার টিকিট পেলেন সাত দিন পরে। কিন্তু তিনি বসে রইলেন না। বাগচী বাড়িতে লোক লাগিয়ে দোতলার বারান্দার বাইরের দিকে একটি ছোট স্ল্যাব ঢালাই করালেন। কেউ প্রশ্ন করলেও উত্তর দিলেন না। তার পরে এক দিন নতুন জামাকাপড় পরে এবং ভাগ্নেকেও পরিয়ে বুলার গাড়িতে দু’জন শ্রমিক নিয়ে বেশি রাতে ঢুকলেন সান্যালবাড়িতে। তবে ভিতরে গেলেন না। শ্রমিকদের দিয়ে একরকম নিঃশব্দে তুলসীমঞ্চ ও সানন্যালবাড়ির বিগ্রহকে তুলে সযত্নে নিয়ে এলেন রুদ্রদের বাড়িতে। তার পরে পুরোহিত ডেকে বিধান নিয়ে ধুমধাম করে সেটা প্রতিষ্ঠা করলেন বাগচী বাড়ির বারান্দার স্ল্যাবে। উপরে কী হচ্ছে, সেটা আয়াদের কাছে শুনে প্রথমটা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝে নিলেন রুপশ্রী। এই ঠাকুর, এই তুলসীমঞ্চ তাঁর ছোটবেলা থেকেই অতি প্রিয়। ছোট থেকেই তিনি এর পুজো করেছেন। বিয়ের পরে যখনই যেতেন, তিনিই পুজো করতেন। সন্ধ্যাবাতি দেখাতেন। এমনকি ডিভোর্স দিয়ে ও বাড়িতে গিয়ে অবধি তিনিই রোজ পুজো করতেন, সন্ধ্যাবাতি দেখাতেন। কিন্তু সুখন তাঁর কাছে ফিরে আসার পর থেকে? আর ভাবতে পারছিলেন না রুপশ্রী। এরই মধ্যে ভাগ্নের কাঁধে হাত দিয়ে নীচে এসে চারদিকে শান্তির জল ছেটাতে ছেটাতে জয়ন্ত বললেন, ‘‘এখন থেকে এই বাড়িতেই এই তুলসীমঞ্চ এবং বিগ্রহের পুজো হবে। সান্যালবাড়ি বরাবরের মতো পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। ও বাড়িতে ভয়ঙ্কর পাপ হয়েছে অনেক দিন ধরে। ও বাড়ি অপবিত্র, অশুচি। ও বাড়িতে এই দেবতার পুজো করা যায় না।’’ ঘরের মধ্যে চোখে জল নিয়েই সব কথা শুনলেন রুপশ্রী। এর পরে ঘরে ঢুকে রুপশ্রীর দিকে তাকিয়েই জয়ন্ত বলে দিলেন, সে যেন কোনও দিন এই বাড়ির দোতলায় প্রতিষ্ঠা করা সান্যালবাড়ির তুলসীমঞ্চ বা বিগ্রহ স্পর্শ পর্যন্ত না করে। দাদার এই কথা শুনে ভিতরটা খানখান হয়ে গেল বরাবরের ইশ্বরভক্ত রুপশ্রীর। ওই ঠাকুরথানের কয়েক হাত দূরে তিনি প্রায় একমাস ধরে কী করেছেন, সেটা ফের মনে পড়ে গেল তাঁর। সশব্দে কেঁদে ফেললেন তিনি। তাঁকে কাঁদতে দেখে জয়ন্ত জানিয়ে দিলেন, অশুচি কেউ ওই বিগ্রহ স্পর্শ করতে পারে না, এটাই নিয়ম। তা ছাড়া সুখনকে বিয়ে করা রুপশ্রী আর স্যান্যাল বা বাগচী পরিবারের কেউ নয়। রুপশ্রী কাঁদতে কাঁদতে দাদার কাছে তাঁর বিয়ে হয়নি বলায় জয়ন্ত বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন, ‘‘বিয়ের অনুষ্ঠানটা না হয় ঘটা করে লোক ডেকে হয়নি, বাদবাকি সবই তো হয়েছে!’’ রুপশ্রী মাথা নামিয়ে নিলেন।