13-04-2025, 12:50 AM
(২৭)
প্রত্যাবর্তন
রাত একটা নাগাদ ভাইপো থেকে ছেলে হয়ে ওঠা রুদ্রর কথা মেনে নিজের মস্ত গাড়িটা এবং একটা বড় ও আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এক রকম নিঃশব্দে সান্যালবাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকলেন বুলা। বুলার ফোন পেয়ে রুদ্র বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। তবে অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেন বা লাল-নীল আলো জ্বালানো মানা ছিল। গৌরবের বিয়ের পরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এ বাড়িতে পা পড়ল বুলার। গৌরব-রুপশ্রীর বিয়ের সময় তিনি নেহাতই কিশোরী। প্রথমেই দ্রুত ঘুমন্ত দিদাকে তুলে ভুলভাল বুঝিয়ে বুলার গাড়িতে তুলে শুইয়ে দেওয়া হল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হল দুটো হুইলচেয়ার। না হলে সুখন বা রুপশ্রীকে তো তোলা যাবে না। এর পরে ঘরে ঢুকে প্রায় মাস চারেক পরে রুপশ্রীকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বুলা। এমনিতেই বুলা খুব নরম মনের মেয়ে। তা ছাড়া তাঁর বড় ভালবাসার মানুষ ছিল এই বৌদি। দু’জনের কত স্মৃতি ভিড় করে আসছিল তাঁর, আর কেঁদে চলেছিলেন রুপশ্রীকে জড়িয়ে। অনুশোচনা আর নিজের কৃতকর্মের জন্য কাঁদছিলেন রুপশ্রীও। কিন্তু রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বুলার কান্না থেমে গেল। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে টেনে তুললেন রুপশ্রীকে। সুখনকে টেনে তুলল কমলি। তার পরেই রুদ্র এমন একটা কাজ করল, যার জন্য রুপশ্রীতো বটেই, বুলাও প্রস্তুত ছিলেন না। বিকেলেই উপরের ঠাকুর ঘর থেকে একটা সিঁদুর কৌটো নামিয়ে এনেছিল রুদ্র। সেখান থেকে অনেকটা সিঁদুর সুখনের হাতে লাগিয়ে সেই হাতটা ধরে সিঁদুরটা রুপশ্রীর সিঁথিতে লাগিয়ে দিল মোটা করে। কয়েকটা ছবিও তুলল ওই অবস্থার এবং রুপশ্রীর সিঁদুর মাখানো মুখের। লজ্জায়, ঘেন্নায় থরথর কপে কাঁপছিলেন রুপশ্রী। তার পর কমলি সুখনকে নিয়ে হুইলচেয়ারে চাপিয়ে নীচে নামতেই রুপশ্রীর খুব কাছে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নরম গলায় তীব্র ব্যঙ্গ ঢেলে রুদ্র বলল, ‘‘এই সিঁদুরটা ওই লোকটার হাত থেকে পরার জন্যই তো আপনি ওই বাড়ি থেকে বেরনোর দিন কয়েক আগে থেকেই সিঁদুর পরা বন্ধ করে সিঁথি সাদা রাখতেন, তাই না ম্যাডাম? যাক, অবশেষে ছোটবেলার প্রেমিকের হাতে সিঁদুর পরার স্বপ্নটা আপনার পূরণ হল, কী বলেন ম্যাডাম! কী ভাগ্য আপনার, সত্যি হিংসে হয়!’’ রুদ্রর প্রতিটি শব্দ থেকে বেরনো তীব্র ঘৃণা ফের পুড়িয়ে দিতে থাকল রুপশ্রীকে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছিলেন না তিনি। বুলা বিষয়টা বুঝে রুদ্রকে বুকে টেনে নিতেই রুপশ্রীর চোখের সামনে বুলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল এতক্ষণ অনেকটা শক্ত থাকা রুদ্র।
সে দিন ভোর রাতে গাড়িগুলো নিঃশব্দেই এসে থেমেছিল সান্যাল বাড়ির গেটে। সকালেই রুদ্রর কথা মতো গৌরবকে নিজের বাড়িতে স্বামীর জিম্মায় রেখে এসে আগে এ বাড়ির একতলার তিনটে ঘরই সাফসুতরো করিয়েছিলেন বুলা। বাথরুম, কমোড, ঘর, বারান্দা, এমনকি রান্নাঘরও। নীচের ঘরগুলোর ব্যবহার না হওয়া তিনটি খাটেই নতুন বালিশ, তোষক, চাদর সবই লোক দিয়ে পাতিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তিনটে বাথরুমেই লাগানো হল গিজারও। ঠিক হয়েছিল, কমলি আপাতত বুলার কাছেই থাকবে কয়েক মাস। তার যদি সন্তান হয়, তবে তাকে মানুষ করবেন বুলাই। তবে চেষ্টা করা হবে, কমলির সঙ্গে এর আগেই যদি অন্য কারও বিয়ে দেওয়া যায়। তবে সে সব পরে দেখা যাবে। রুপশ্রী আর সুখনকে একই ঘরে রাখার ব্যাপারে বুলার প্রথমে ঘোর আপত্তি থাকলেও রুদ্রর জেদ এবং তার কারণ বুঝে আর না করেননি তিনি। ভোররাতে রুপশ্রীকে নিয়ে এ বাড়িতে ফের পা রাখতেই গেটের সামনে কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। অনেক কষ্টে তাকে তুলে টেনে নিয়ে যাওয়া হল একতলার একটা ঘরে। রুপশ্রী বুঝলেন, এ বাড়ির দোতলায় তাঁর এতকালের ঘরটায় আর ঠাঁই হবে না তাঁর! ইতিমধ্যে বুলার ঠিক করা একজন মেল এবং একজন ফিমেল আয়া সুখন এবং রুপশ্রীকে নিচতলার একটা বড় ঘরে ঢুকিয়ে জামাকাপড় বদলে দু’জনকেই বড় একগ্লাস করে গরম দুধ এবং বেশ কয়েকটা প্রোটিন বিস্কিট খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে। প্রায় ৩৬ ঘন্টা ধরে নিজেদের উপর শারীরিক এবং অত্যাচারের ধকলে ক্লান্ত দুটো দেহ ঘুমিয়েও পড়ল কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
দিদাকে উপরে তুলে নানা রকম বুঝিয়ে একটু চা-বিস্কুট খাইয়ে টিভি খুলে বসিয়ে দিল রুদ্র। দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রথমেই পিসির ড্রাইভারের হাত দিয়ে রুপশ্রীর কলেজে ও ব্যাঙ্কে চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিল। তার পরে মামাকে সিঙ্গাপুরে ফোন করল রুদ্র। মামাকে বলল, ‘‘দিদাকে আজ ভোরে কলকাতায় এনেছি, একটু শরীরটা খারাপ। বাবাও বেশ অসুস্থ। তুমি একবার প্লিজ আসবে কলকাতায়।’’ ভাগ্নের আর্তি শুনে মামা বললেন, আজ রাতে না হোক, কাল ভোরে তিনি কলকাতায় পৌঁছবেন। তার পর মাকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। জয়ন্ত ভেবেই নিয়েছেন, তাঁর মা এবং ভগ্নিপতি দু’জনেই অসুস্থ বলে এ ভাবে তাঁকে ডেকেছে রুদ্র।
এ দিকে বহু দিন পরে এ বাড়িতে এসে অবধি অস্বস্তি বোধ করছিলেন রুপশ্রীর মা। তাঁকে যে রুপু বলেছিল, জামাই লম্পট বলে সে ডিভোর্স দিয়েছে, তা হলে তাঁকে সেই জামাইয়ের বাড়িতেই আনা হল কেন? মেয়েকেও দেখতে পাচ্ছিলেন না বলে অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। এর মধ্যেই বুলা এসে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিতে তাকে বুকে টেনে নিলেন বৃদ্ধা। কমলিও এসে ঢুকল ঘরে। চেনা মুখ দেখে এই বারে বেশ স্বস্তি পেলেন বৃদ্ধা। বিছানায় পা গুটিয়ে বসলেন আরাম করে।
মামাকে ফোন করে দিদার ঘরে এসে ঢুকল রুদ্র। তার পর কমলিকে সবার জন্য বেশি করে চা-জলখাবার করতে বলে রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিয়ে এল। তার পর পিসির পাশে বসে খুব শান্ত গলায় দিদাকে বলল, ‘‘দিদা, সুখন বলে কাউকে চেন তুমি?’’ চমকে উঠলেন বৃদ্ধা। এই নাম নাতি জানল কী করে? এ নাম তো বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া। তিনি নাতির দিকে তাকাতেই রুদ্র শান্ত গলায় বলল, ওই সুখনকে গত কাল বিয়ে করবে বলেই বাবার নামে মিথ্যে কথা বলে ডিভোর্স দিয়েছিল তোমার মেয়ে। তবে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল দু’জনেই, তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওদেরও এখানে এনেছি। তুমি কিছুই জানতে না বলে জানালাম।’’
নাতির মুখে ফের সুখনের নাম শুনেই আঁতকে উঠেছিলেন বৃদ্ধা। মেয়ের সঙ্গে সুখনের লটঘট ঘিরে একসময় ওই বাড়িতে যে প্রবল অশান্তি হয়েছিল, তাও তাঁর মনে পড়েছিল নাতির মুখ থেকে নামটা শুনেই। কিন্তু মেয়ে যে সুখনকে বিয়ে করবে বলে এই সব করেছে, এমনকি কাল বিয়েও করতে গিয়েছিল, এ সব শুনে জ্বলে উঠলেন বৃদ্ধা। সেই সঙ্গেই তাঁর মনে পড়ল, কয়েক সপ্তাহ আগেও পোস্টঅফিস থেকে এ মাসের পেনশন অবধি তুলে এনেছেন, এমনকি টুকটাক কেনাকাটা করতে চেনা রিক্সায় বাজারেও যেতেন তিনি। কিন্তু গত সপ্তাহ দুয়েক তাঁর সব সময় কেমন যেন দুর্বল লাগত। ঘুম পেত। তিনি নাতিকে সেটা বলতেই বুলা ও রুদ্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওরা বুঝে গেছে, দিদাকে কোনও ভাবে ওষুধ খাইয়ে বা কিছু করে ঘুম পাড়িয়ে সুখনের সঙ্গে রাসলীলা চালাতেন রুপশ্রী। এই বার কমলিকে নিয়েও সন্দেহ জাগল রুদ্রর। তবে ও মুখে কিছু বলল না। হঠাৎ মুখ তুলে বেশ শক্ত গলায় বৃদ্ধা নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ওরা কোথায়? আমি দেখা করব। আমাকে নিয়ে চল।’’
এই ভয়টাই পাচ্ছিল রুদ্র। বুলাপিসি ওকে এখনই এ সব কথা তুলতে মানা করলেও আবেগের বশে বেলে ফেলে এখন ভাবনায় পড়ে গেল। অবস্থা সামাল দিলেন বুলাই। তিনি বললেন, ‘‘ওরা এখন ঘুমোচ্ছে। দু’জনেই অসুস্থ। ওরা উঠুক, আমি নিজে নিয়ে যাব। এখন আপনি বিশ্রাম নিন’’, বলে বৃদ্ধাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রুদ্রকে টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এসে রুদ্রকে মৃদু বকাবকিও করলেন।
******
বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে রুপশ্রী বেশ সুস্থ বোধ করলেন। মহিলা আয়াটি তাঁকে বাথরুমে নিয়ে গেল। টয়লেট-পটি করে অনেকটা আরাম হল রুপশ্রীর। রক্ত পড়লেও আজ তা গত কালের চেয়ে কম। মহিলা আয়াটি তাঁকে গরম জলে স্পঞ্জ করালেও স্নান করালেন না। সেই রকমই নির্দেশ ছিল তাঁর উপরে। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসতেই তাঁর খেয়াল হল, এই বাড়িতে এসে এতক্ষণ তিনি সুখনের সঙ্গে একই খাটে ঘুমিয়েছেন! একটু ঘুরতেই বিছানার উল্টো দিকে আয়নায় চোখ যেতে দেখলেন, কপালে সিঁদুর কিছুটা মুছলেও এখনও বেশ মোটা এবং স্পষ্ট। মনে পড়ল, গত কাল রাতে সুখনের নুলো হাত ধরিয়ে এই সিঁদুর তাঁর কপালে তুলে দিয়েছে তাঁরই ছেলে, যাকে কয়েক দিন আগেই তিনি যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছে। গত কাল থেকে নানা প্রতিশোধ তোলার পরে এই সিঁদুর সমেত এ বাড়িতেই ঢোকানো এবং সুখনের সঙ্গে একই ঘরে এমনকী একই খাটে রাখাও সেই প্রতিশোধেরই অংশ বলে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাঁর নিজের দোষেই যে তাঁকে এ সব সহ্য করতে হচ্ছে এবং হবেও বহু দিন ধরে, তা বুঝে কেঁদে ফেললেন তিনি। ও দিকে সুখনের জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারল না। পুরষ আয়াটি সুখনের ঘুম ভেঙেছে দেখে তাকে তুলে বাথরুমে নিয়ে যেতেই ফের গত কালের মতো বাথরুম জুড়ে পেচ্ছাব-পায়খানা করে ফেলেছে সে। কোনও রকমে তাকে সাফ করিয়ে ঘরে এনে এ নিয়ে গজগজ করল কিছুক্ষণ। তার পরে বুলার তরফে মোটা টাকার প্রতিশ্রুতিতে মেনেও নিল এ সব।
প্রত্যাবর্তন
রাত একটা নাগাদ ভাইপো থেকে ছেলে হয়ে ওঠা রুদ্রর কথা মেনে নিজের মস্ত গাড়িটা এবং একটা বড় ও আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এক রকম নিঃশব্দে সান্যালবাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকলেন বুলা। বুলার ফোন পেয়ে রুদ্র বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। তবে অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেন বা লাল-নীল আলো জ্বালানো মানা ছিল। গৌরবের বিয়ের পরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এ বাড়িতে পা পড়ল বুলার। গৌরব-রুপশ্রীর বিয়ের সময় তিনি নেহাতই কিশোরী। প্রথমেই দ্রুত ঘুমন্ত দিদাকে তুলে ভুলভাল বুঝিয়ে বুলার গাড়িতে তুলে শুইয়ে দেওয়া হল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হল দুটো হুইলচেয়ার। না হলে সুখন বা রুপশ্রীকে তো তোলা যাবে না। এর পরে ঘরে ঢুকে প্রায় মাস চারেক পরে রুপশ্রীকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বুলা। এমনিতেই বুলা খুব নরম মনের মেয়ে। তা ছাড়া তাঁর বড় ভালবাসার মানুষ ছিল এই বৌদি। দু’জনের কত স্মৃতি ভিড় করে আসছিল তাঁর, আর কেঁদে চলেছিলেন রুপশ্রীকে জড়িয়ে। অনুশোচনা আর নিজের কৃতকর্মের জন্য কাঁদছিলেন রুপশ্রীও। কিন্তু রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বুলার কান্না থেমে গেল। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে টেনে তুললেন রুপশ্রীকে। সুখনকে টেনে তুলল কমলি। তার পরেই রুদ্র এমন একটা কাজ করল, যার জন্য রুপশ্রীতো বটেই, বুলাও প্রস্তুত ছিলেন না। বিকেলেই উপরের ঠাকুর ঘর থেকে একটা সিঁদুর কৌটো নামিয়ে এনেছিল রুদ্র। সেখান থেকে অনেকটা সিঁদুর সুখনের হাতে লাগিয়ে সেই হাতটা ধরে সিঁদুরটা রুপশ্রীর সিঁথিতে লাগিয়ে দিল মোটা করে। কয়েকটা ছবিও তুলল ওই অবস্থার এবং রুপশ্রীর সিঁদুর মাখানো মুখের। লজ্জায়, ঘেন্নায় থরথর কপে কাঁপছিলেন রুপশ্রী। তার পর কমলি সুখনকে নিয়ে হুইলচেয়ারে চাপিয়ে নীচে নামতেই রুপশ্রীর খুব কাছে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নরম গলায় তীব্র ব্যঙ্গ ঢেলে রুদ্র বলল, ‘‘এই সিঁদুরটা ওই লোকটার হাত থেকে পরার জন্যই তো আপনি ওই বাড়ি থেকে বেরনোর দিন কয়েক আগে থেকেই সিঁদুর পরা বন্ধ করে সিঁথি সাদা রাখতেন, তাই না ম্যাডাম? যাক, অবশেষে ছোটবেলার প্রেমিকের হাতে সিঁদুর পরার স্বপ্নটা আপনার পূরণ হল, কী বলেন ম্যাডাম! কী ভাগ্য আপনার, সত্যি হিংসে হয়!’’ রুদ্রর প্রতিটি শব্দ থেকে বেরনো তীব্র ঘৃণা ফের পুড়িয়ে দিতে থাকল রুপশ্রীকে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছিলেন না তিনি। বুলা বিষয়টা বুঝে রুদ্রকে বুকে টেনে নিতেই রুপশ্রীর চোখের সামনে বুলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল এতক্ষণ অনেকটা শক্ত থাকা রুদ্র।
সে দিন ভোর রাতে গাড়িগুলো নিঃশব্দেই এসে থেমেছিল সান্যাল বাড়ির গেটে। সকালেই রুদ্রর কথা মতো গৌরবকে নিজের বাড়িতে স্বামীর জিম্মায় রেখে এসে আগে এ বাড়ির একতলার তিনটে ঘরই সাফসুতরো করিয়েছিলেন বুলা। বাথরুম, কমোড, ঘর, বারান্দা, এমনকি রান্নাঘরও। নীচের ঘরগুলোর ব্যবহার না হওয়া তিনটি খাটেই নতুন বালিশ, তোষক, চাদর সবই লোক দিয়ে পাতিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তিনটে বাথরুমেই লাগানো হল গিজারও। ঠিক হয়েছিল, কমলি আপাতত বুলার কাছেই থাকবে কয়েক মাস। তার যদি সন্তান হয়, তবে তাকে মানুষ করবেন বুলাই। তবে চেষ্টা করা হবে, কমলির সঙ্গে এর আগেই যদি অন্য কারও বিয়ে দেওয়া যায়। তবে সে সব পরে দেখা যাবে। রুপশ্রী আর সুখনকে একই ঘরে রাখার ব্যাপারে বুলার প্রথমে ঘোর আপত্তি থাকলেও রুদ্রর জেদ এবং তার কারণ বুঝে আর না করেননি তিনি। ভোররাতে রুপশ্রীকে নিয়ে এ বাড়িতে ফের পা রাখতেই গেটের সামনে কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। অনেক কষ্টে তাকে তুলে টেনে নিয়ে যাওয়া হল একতলার একটা ঘরে। রুপশ্রী বুঝলেন, এ বাড়ির দোতলায় তাঁর এতকালের ঘরটায় আর ঠাঁই হবে না তাঁর! ইতিমধ্যে বুলার ঠিক করা একজন মেল এবং একজন ফিমেল আয়া সুখন এবং রুপশ্রীকে নিচতলার একটা বড় ঘরে ঢুকিয়ে জামাকাপড় বদলে দু’জনকেই বড় একগ্লাস করে গরম দুধ এবং বেশ কয়েকটা প্রোটিন বিস্কিট খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে। প্রায় ৩৬ ঘন্টা ধরে নিজেদের উপর শারীরিক এবং অত্যাচারের ধকলে ক্লান্ত দুটো দেহ ঘুমিয়েও পড়ল কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
দিদাকে উপরে তুলে নানা রকম বুঝিয়ে একটু চা-বিস্কুট খাইয়ে টিভি খুলে বসিয়ে দিল রুদ্র। দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রথমেই পিসির ড্রাইভারের হাত দিয়ে রুপশ্রীর কলেজে ও ব্যাঙ্কে চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিল। তার পরে মামাকে সিঙ্গাপুরে ফোন করল রুদ্র। মামাকে বলল, ‘‘দিদাকে আজ ভোরে কলকাতায় এনেছি, একটু শরীরটা খারাপ। বাবাও বেশ অসুস্থ। তুমি একবার প্লিজ আসবে কলকাতায়।’’ ভাগ্নের আর্তি শুনে মামা বললেন, আজ রাতে না হোক, কাল ভোরে তিনি কলকাতায় পৌঁছবেন। তার পর মাকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। জয়ন্ত ভেবেই নিয়েছেন, তাঁর মা এবং ভগ্নিপতি দু’জনেই অসুস্থ বলে এ ভাবে তাঁকে ডেকেছে রুদ্র।
এ দিকে বহু দিন পরে এ বাড়িতে এসে অবধি অস্বস্তি বোধ করছিলেন রুপশ্রীর মা। তাঁকে যে রুপু বলেছিল, জামাই লম্পট বলে সে ডিভোর্স দিয়েছে, তা হলে তাঁকে সেই জামাইয়ের বাড়িতেই আনা হল কেন? মেয়েকেও দেখতে পাচ্ছিলেন না বলে অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। এর মধ্যেই বুলা এসে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিতে তাকে বুকে টেনে নিলেন বৃদ্ধা। কমলিও এসে ঢুকল ঘরে। চেনা মুখ দেখে এই বারে বেশ স্বস্তি পেলেন বৃদ্ধা। বিছানায় পা গুটিয়ে বসলেন আরাম করে।
মামাকে ফোন করে দিদার ঘরে এসে ঢুকল রুদ্র। তার পর কমলিকে সবার জন্য বেশি করে চা-জলখাবার করতে বলে রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিয়ে এল। তার পর পিসির পাশে বসে খুব শান্ত গলায় দিদাকে বলল, ‘‘দিদা, সুখন বলে কাউকে চেন তুমি?’’ চমকে উঠলেন বৃদ্ধা। এই নাম নাতি জানল কী করে? এ নাম তো বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া। তিনি নাতির দিকে তাকাতেই রুদ্র শান্ত গলায় বলল, ওই সুখনকে গত কাল বিয়ে করবে বলেই বাবার নামে মিথ্যে কথা বলে ডিভোর্স দিয়েছিল তোমার মেয়ে। তবে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল দু’জনেই, তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওদেরও এখানে এনেছি। তুমি কিছুই জানতে না বলে জানালাম।’’
নাতির মুখে ফের সুখনের নাম শুনেই আঁতকে উঠেছিলেন বৃদ্ধা। মেয়ের সঙ্গে সুখনের লটঘট ঘিরে একসময় ওই বাড়িতে যে প্রবল অশান্তি হয়েছিল, তাও তাঁর মনে পড়েছিল নাতির মুখ থেকে নামটা শুনেই। কিন্তু মেয়ে যে সুখনকে বিয়ে করবে বলে এই সব করেছে, এমনকি কাল বিয়েও করতে গিয়েছিল, এ সব শুনে জ্বলে উঠলেন বৃদ্ধা। সেই সঙ্গেই তাঁর মনে পড়ল, কয়েক সপ্তাহ আগেও পোস্টঅফিস থেকে এ মাসের পেনশন অবধি তুলে এনেছেন, এমনকি টুকটাক কেনাকাটা করতে চেনা রিক্সায় বাজারেও যেতেন তিনি। কিন্তু গত সপ্তাহ দুয়েক তাঁর সব সময় কেমন যেন দুর্বল লাগত। ঘুম পেত। তিনি নাতিকে সেটা বলতেই বুলা ও রুদ্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওরা বুঝে গেছে, দিদাকে কোনও ভাবে ওষুধ খাইয়ে বা কিছু করে ঘুম পাড়িয়ে সুখনের সঙ্গে রাসলীলা চালাতেন রুপশ্রী। এই বার কমলিকে নিয়েও সন্দেহ জাগল রুদ্রর। তবে ও মুখে কিছু বলল না। হঠাৎ মুখ তুলে বেশ শক্ত গলায় বৃদ্ধা নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ওরা কোথায়? আমি দেখা করব। আমাকে নিয়ে চল।’’
এই ভয়টাই পাচ্ছিল রুদ্র। বুলাপিসি ওকে এখনই এ সব কথা তুলতে মানা করলেও আবেগের বশে বেলে ফেলে এখন ভাবনায় পড়ে গেল। অবস্থা সামাল দিলেন বুলাই। তিনি বললেন, ‘‘ওরা এখন ঘুমোচ্ছে। দু’জনেই অসুস্থ। ওরা উঠুক, আমি নিজে নিয়ে যাব। এখন আপনি বিশ্রাম নিন’’, বলে বৃদ্ধাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রুদ্রকে টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এসে রুদ্রকে মৃদু বকাবকিও করলেন।
******
বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে রুপশ্রী বেশ সুস্থ বোধ করলেন। মহিলা আয়াটি তাঁকে বাথরুমে নিয়ে গেল। টয়লেট-পটি করে অনেকটা আরাম হল রুপশ্রীর। রক্ত পড়লেও আজ তা গত কালের চেয়ে কম। মহিলা আয়াটি তাঁকে গরম জলে স্পঞ্জ করালেও স্নান করালেন না। সেই রকমই নির্দেশ ছিল তাঁর উপরে। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসতেই তাঁর খেয়াল হল, এই বাড়িতে এসে এতক্ষণ তিনি সুখনের সঙ্গে একই খাটে ঘুমিয়েছেন! একটু ঘুরতেই বিছানার উল্টো দিকে আয়নায় চোখ যেতে দেখলেন, কপালে সিঁদুর কিছুটা মুছলেও এখনও বেশ মোটা এবং স্পষ্ট। মনে পড়ল, গত কাল রাতে সুখনের নুলো হাত ধরিয়ে এই সিঁদুর তাঁর কপালে তুলে দিয়েছে তাঁরই ছেলে, যাকে কয়েক দিন আগেই তিনি যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছে। গত কাল থেকে নানা প্রতিশোধ তোলার পরে এই সিঁদুর সমেত এ বাড়িতেই ঢোকানো এবং সুখনের সঙ্গে একই ঘরে এমনকী একই খাটে রাখাও সেই প্রতিশোধেরই অংশ বলে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাঁর নিজের দোষেই যে তাঁকে এ সব সহ্য করতে হচ্ছে এবং হবেও বহু দিন ধরে, তা বুঝে কেঁদে ফেললেন তিনি। ও দিকে সুখনের জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারল না। পুরষ আয়াটি সুখনের ঘুম ভেঙেছে দেখে তাকে তুলে বাথরুমে নিয়ে যেতেই ফের গত কালের মতো বাথরুম জুড়ে পেচ্ছাব-পায়খানা করে ফেলেছে সে। কোনও রকমে তাকে সাফ করিয়ে ঘরে এনে এ নিয়ে গজগজ করল কিছুক্ষণ। তার পরে বুলার তরফে মোটা টাকার প্রতিশ্রুতিতে মেনেও নিল এ সব।