31-12-2018, 04:47 PM
তুলি সুন্দর একটা তুঁতে রঙের চুড়িদার পরে, সাথে মানানসই মেকাপ আর রঙ মিলিয়ে কানের দুল পরেছে। দুধেআলতা গায়ের রঙ্গে তুঁতে রংটা যেন ঝলমল করছে। নিখুঁত ভাবে ঠোঁট আর চোখ একেছে। দেখে মনে হচ্ছে, ফিল্ম ম্যাগাজিন থেকে কোন অল্পবয়েসি সুন্দরি নায়িকা নেমে এসেছে। মাপের সামঞ্জস্যের জন্যে চুড়িদারটা ওর শরীরের নারীসুলভ ভাঁজ গুলো ফুটিয়ে তুলেছে। বুকগুলো বেশ পীনোন্নত লাগছে। সাথে সঠিক মাপের কোমর আর নিতম্বের মিশেল ওকে আরো আকর্ষনিয় করে তুলেছে।
‘কি ব্যাপার এতো সাজুগুজু করে আছো?’
‘বর আসবে এতদিন পরে, সাজবো না?’
আমি ওকে কাছে টেনে গালে একটা হামি খেলাম।
তুলির মার খাটের পাশে একটা টুলের ওপরে বসলাম। হাতটা নাড়াতে পারছেনা। স্লিং দেওয়া। তবু বালিশের ওপর হেলান দিয়ে উঠে বসলো। এমনি সুস্থ যন্ত্রনাটা বাদ দিয়ে।
চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠছে।
তুলি চা করতে গেছে। আমার হাত ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনা দিচ্ছি। আমার বুকে মাথা দিয়ে সে কেঁদেই চলেছে। আমার বুক দুরদুর করছে। মানসিক ভাবে দুর্বল একটা মানুষ আমাকে আঁকরে ধরতে চাইছে, কিন্তু আমি দ্বিধাগ্রস্ত। শরীরের মিলন এক জিনিস। নো কমিটমেন্ট। গরম হোলো তো ঠান্ডা করে নাও। কিন্তু মন যদি মনকে ছুয়ে যায় তাহলে সেটা তো অবহেলা করা যায়না। কিন্তু একটা মানুষ কি দুজনের মন নিতে পারে। ঝর্না আমাকে কি ভাবে পেতে চাইছে? আমার মাও তো মন থেকে আমার ওপর নির্ভর করে, বাবাও। কিন্তু এই সম্পর্কের যুক্তিযুক্তটা কোথায়। কি নাম এর? তুলির সাথে আমার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাহলে?
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হাতেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এইকদিন এই হাত দুটো এই শরিরটার মধুমন্থন করেছে। আজকে সস্নেহে হাত ওঠানামা করছে, ওর ফুলন্ত পিঠে। আমি জানি ও কি রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে ভুগছে। ভালো হতে চেয়ে, জীবনের সবথেকে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে, কখন সর্বসমক্ষে ওর পঙ্কিল অতীত ভেসে ওঠে।
আমি ভগবানে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু মনে মনে কাউকে যেন ডাকছি যে এই দুঃসময়ের থেকে বের করে দিক।
তুলির আসার শব্দে ঠিক হয়ে বসলাম। চোখের জল মুছে, টানটান হয়ে বসলো ও।
চা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলতে বলতে অনেক সময় কেটে গেলো।
তুলিদের গেটখোলার শব্দ হোলো। পুরোনো লোহার গেট, বেশ আওয়াজ করে খুললো। কয়েকজনের আওয়াজ আসছে, সাথে মহিলাও আছে। তুলি জানলা খুলে দেখে দেখলাম কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো।
সিঁড়ি দিয়ে আগন্তুকেরা উঠে আসছে, সাথে তুলির বাবার গলা। বুঝলাম তুলির বাবার সঙ্গেই এরা এসেছে।
অবাক করে দিয়ে রাজু, আর এক বয়স্ক সম্ভ্রান্ত দম্পতি এসে ঢুকল ঘরে। এরা রাজুর মা বাবা, গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিজের কর্নধার।
হাতের ফুলের তোরা তুলির মার বিছানার পাশে রাখলেন উনারা, ভিতরে “get well soon” জাতিয় কার্ড। ফুলের তোরাটা একটা গনেশের মুর্তির মধ্যে গাথা, স্বেত পাথরের সেই মুর্তি এদের আর্থিক বৈভবের পরিচয় দিচ্ছে।
রাজুর মা দেখলাম তুলির গাল টিপে আদর করে, সেই হাত নিয়ে চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করলো। মুখে ওর রুপের অনেক প্রসংশা করছে।
তুলির বাবা রাজুর বাবার সাথে আলতু ফালতু কথা বলে চলেছে। কবে উনাকে টিভিতে দেখেছেন, কোন মিনিস্টারের সাথে দেখেছেন, এসব ফালতু গল্প জুরেছেন। মেরুদন্ডহীন একটা মানুষ।
রাজু ওর মাকে তুলির মার সাহসিকতার গল্প শোনাচ্ছে। কিভাবে খোলা রিভলভারের সামনে উনি বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন। জানিনা কোথা থেকে এত গল্প শুনলো।
তুলি চলে গেছে সবার জন্যে চা করতে, তুলির বাবার আদেশে। আমি রয়ে গেছি কি ঘটতে চলেছে সেটা বোঝার জন্যে।
তুলির মা হাল্কা স্বরে প্রতিবাদ করে উঠলো। এদের হঠাত আগমন যে উনি পছন্দ করেন নি সেটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন উনি। রাজুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ‘যদি কারো কথা বলতে হয় তো ওর কথা বলুক সবাই” আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললো। ‘যে ভাবে ও ঝাপিয়ে পরে ওদের আটকেছে, অন্য ছেলে হলে কি করতো কি জানি, ও না থাকলে আজকে আমার বদলে আমার ছবিতে আপনাদের ফুলমালা দিতে আসতে হোতো।’
রাজুর মুখটা দেখলাম লজ্জার ভাব ফুটে উঠেছে। লজ্জাও আছে তাহলে।
রাজুর মা আমার দিকে ঘুরে তাকালো। সবাই চুপ করে গেলো, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুলির বাবা বলে উঠলো ‘আরে বাবা ও সেদিন না থাকলে যে কি হোত। পুরো হিন্দি সিনেমার নায়কের মত ও লরেছে সেদিন, খুব সাহসি ছেলে ও। আমার বন্ধুর ছেলে।’
তুলির মা বলে উঠলো ‘আমাদের হবু জামাই, এখনো হবু, সামনের বছর তুলি কলেজ থেকে বেরোলে আর হবু থাকবে না।’
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হোলো। সবাই চুপ। রাজুর মুখটা চুপসে গেছে। ভালো রকম জুতোর বাড়ি খেয়েছে।
রাজুর মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন জিজ্ঞেস করছে এটা কি হোলো।
তুলির মা আমার উদ্দেশ্যে বললো ‘যাও না একটু গিয়ে দেখো না তুলি কি করছে? যা ঢিলে মেয়ে আমার, এই কয় কাপ চা করতে রাত না কাবার করে দেয়।’
আরেকটা জুতোর বাড়ি পরলো এদের মুখে, তুলির মা আমাকে এগিয়ে দিলো বলে।
রাজুর মা আগ বাড়িয়ে বলতে গেলো ‘আহাঃ উনি তো ছেলে মানুষ, এর থেকে আমি যাই না...’
‘না না আপনি অতিথি এই প্রথম এলেন আমার বাড়ি কেন শুধু শুধু ...।’
‘আরে প্রথমবার মানে তো শেষবার না, এরকম পর পর ভাবছেন কেন?’
তুলির মা একটু গম্ভির ভাবেই বলে উঠলো ‘আমাদের বাড়ি একটু জটিল, আপনি পারবেন না বরঞ্চ ও যাক আপনি বসুন।’
কুত্তার ল্যাজ সহজে সোজা হয় না। তাই বোধহয় রাজুর মা বলে উঠলো ‘তো রাজু তুইও যা না ওর সাথে। সারাদিন তো তুলি তুলি করে কাজকর্মে শিকেই তুলেছিস।’
আমি বুঝতে পারছি না এরা কি চাইছে, এদের মত লোককে উচিৎ ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া।
চুতিয়াটা আমার সঙ্গ নিলো ‘আপনি খুব লাকি, আপনার ওপর আমার হিংসে হয়?’ সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামতে নামতে আমাকে কথাগুলো বললো।
আমি গম্ভিরভাবে জিজ্ঞেস করলাম ‘কারনটা বুঝলাম না তো?’
‘তুলির মত মেয়েকে জীবনে পেয়ে?’
আমার মাথাটা গরম হয়ে গেলো। বলে ফেললাম ‘সেটা আর সুস্থভাবে হবে বলে তো মনে হচ্ছে না’
রাজু আমার কথার কোন উত্তর দিলো না।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্যাসও জ্বালায় নি। পিছন ঘুরে দারিয়ে কিচেনের স্ল্যাব ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।
আমাদের পায়ের আওয়াজে ও সজাগ হয়ে উঠলো। ঘুরে দাড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাতেই বুঝে গেলাম ও কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি ব্যাপার। কিন্তু ও উত্তর দেবে কি ভাবে? চামউকুনটা তো গায়ের সাথে সেঁটে আছে।
চা খেতে খেতে রাজুর বাবা অনেক গল্প ঝারলো, রাজুর হাত দিয়ে কি ভাবে ওদের ব্যাবসা বড় করবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যে সামান্য চাকরি করি সেটাও বোঝাতে ভুললো না। বলেই ফেললো আমাদের বেশির ভাগ প্রোজেক্টই চাইনিজ পার্টনার নিয়ে যার ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকার। আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানকে উনি ফোন করলেই আমাদের চেয়ারম্যান যেন ফোনেই “ইয়েস স্যার” বলে ওঠে। আরো নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো তুলির মা বাবাকে, যে রাজুর হাতে ওদের মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত এবং বিলাসবহুল।
ওরা চলে যেতেই তুলি কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। তুলির মা, তুলির বাবাকে যা নয় তা বলে মুখ করতে শুরু করলো, সব জেনে শুনেও ওদের এত পাত্তা দেওয়ার জন্যে। তুলির বাবার সেই অবোধ স্বিকারোক্তি, “আমি কি করে বুঝবো ওদের মনে কি আছে।”
তুলি কাঁদতে কাঁদতে আমার পা ধরে ফেললো ওর মা বাবার সামনেই। কারন আমি ওকে ভুল বুঝতে পারি। রাজুরা যে আসবে সেটা ও জানতো না।
এরপরে আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমাদের উকিলের সাথে রনির বাবা এসে হাজির। ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চাইছে কোর্টের বাইরে। তুলির মা আর আমি সহযোগিতা করলে, ওর একমাত্র ছেলেকে আর এই পুলিশি চক্করে পড়তে হয়না। আপাতত ভেবে দেখা হবে বলা হয়েছে। আর যাই হোক সব দিক ভেবেই এগোতে হবে। একবার ছার পেয়ে গেলে সে আবার কি খেল দেখাবে সেটা কে বলতে পারে।
ডালহৌসি এলাকায় অফিস হলে একটা সুবিধে যে নানারকম খাওয়ার দাওয়ার পাওয়া যায়, সাথে ওনেক চেনাপরিচিত লোকেরও দেখা পাওয়া যায়।
এইরকমই একদিন লাঞ্চ করে সিগেরেট খাচ্ছি তখন হঠাৎ করে কনুইয়ে চিমটি খেয়ে ঘুরে দেখি, সানি। সেই যে সানি হোমোর কথা বলেছিলাম শুরুতে সেই ভক্ত।
এখানে অতটা নেকিয়ে নেকিয়ে কথা বলছে না। বেশ একটা সিরিয়াস হাবভাব। মোটের ওপর দাড়িয়ে কথা বললে কেউ কিছু বুঝবে না। কিন্তু যেহেতু আমি ওর নিয়ত জানি, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ওর সেই মেয়েলিপনা রিতিমত বর্তমান।
কথায় কথায় জানতে পারলাম যে ও স্টিল অথোরিটিতে চাকরি করে। কন্ট্রাক্টসেই আছে।
আমিও কন্ট্রাক্টসে আছি শুনে, হই হই করে উঠলো। সে কি উচ্ছাস তার।
আমিও মনে মনে খুশিই হোলাম কারন, আমাদের ব্যাবসাটা মুলতঃ স্টিল প্ল্যান্ট নির্ভরই। পাওয়ার বা রিফাইনারিতে আমাদের অন্য গ্রুপ খুব আক্টিভ।
গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিসের কর্নধারের কথা মনে পরে, আমাদের চেয়ারম্যান নাকি ওকে সেলাম ঠোকে। শালা ও কি ধরনের বোকাচোদা কে জানে। করে তো বালের কিছু দালালির, আর এগ্রো বিষয়ক ব্যাবসা। সাথে লোক ঠকানোর চিটফান্ড। সে কিনা ভারতব্যাপি মোনোপলি একটা বিজনেস গ্রুপের সাথে নিজেকে তুলোনা করে। ওর চিটফান্ডের অনেক তথ্যই আমি আমার পুরানো বসকে দিয়ে এসেছি। বিজনেস সিক্রেট তাই এতোদিন কাউকে বলিনি। এই প্রথম বসকে বললাম, যে ওরা কি ভাবে ভুঁয়ো লগ্নি, ভুঁয়ো ব্যবসা দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলছে। কি ভাবে সারভিস ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে।
নতুন বসকে গিয়ে বললাম যে স্টিল অথোরিটির কন্ট্রাক্টসে আমার একজন পরিচিতর সাথে দেখা হোলো। ব্যবসা সুত্রে পরিচিত সবাইই। আমাদের প্রোডাক্টের জন্যে, আমাদের বেশ সুনাম আছে বাজারে। একপ্রকার একচেটিয়া বলা যায়। কিন্তু কোম্পানি এখন অন্যধরনের প্রোজেক্টেও নামতে চাইছে। সেই জন্যে চিন ও বিভিন্ন ইয়োরোপিয়ান দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির সাথে আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি। নিজেদের দক্ষতার বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের প্রোজেক্টে নিজেদের পা রাখার জন্যে। ইতিমধ্যে দুটো প্রোজেক্ট কমিশানিং হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক চলছে।
এর স্টীল অথোরিটিতেই একটা বিরাট টেন্ডার বেরিয়েছে। বসের কাছে শুনলাম, যে আমরা ছাড়া আরো দুটো কোম্পানি টেন্ডার তুলেছে। সেটা কারা কারা সেটা নিয়ে আমাকে আমার সোর্স লাগাতে বললো।
আমি খোঁজ করছি শুনে সানি যেন আনন্দে আপ্লূত। বললাম আমাকে একটু হেল্প করতে হবে। সানন্দে রাজী সে। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে যেটা বোঝাতে চাইলো সেটার জন্যে মনে হয় এই চাকরিটাও ছারতে হবে।
বুঝতেই পারছি ওর লোভটা কোথায়।
সেদিনের পর থেকে তুলি আর ফাংশান করার জন্যে বায়না করেনি। ও নিজেই বলেছে যেকদিন কলেজ হবে, গুরুত্বপুর্ন ক্লাস ছাড়া আর ও যাবে না। এক বছর এই ভাবেই কাটিয়ে দেবে। আমি ওকে এটেন্ডান্সের দিকে নজর রেখে যা করার করতে বললাম।
সব কিছু এখন ঠিকঠাকই চলছে। খেলার নিয়ন্ত্রন এখন আমার দিকে। শুধু আমি কিছু হিসেবনিকেশ করে চলেছি।
‘কি ব্যাপার এতো সাজুগুজু করে আছো?’
‘বর আসবে এতদিন পরে, সাজবো না?’
আমি ওকে কাছে টেনে গালে একটা হামি খেলাম।
তুলির মার খাটের পাশে একটা টুলের ওপরে বসলাম। হাতটা নাড়াতে পারছেনা। স্লিং দেওয়া। তবু বালিশের ওপর হেলান দিয়ে উঠে বসলো। এমনি সুস্থ যন্ত্রনাটা বাদ দিয়ে।
চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠছে।
তুলি চা করতে গেছে। আমার হাত ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনা দিচ্ছি। আমার বুকে মাথা দিয়ে সে কেঁদেই চলেছে। আমার বুক দুরদুর করছে। মানসিক ভাবে দুর্বল একটা মানুষ আমাকে আঁকরে ধরতে চাইছে, কিন্তু আমি দ্বিধাগ্রস্ত। শরীরের মিলন এক জিনিস। নো কমিটমেন্ট। গরম হোলো তো ঠান্ডা করে নাও। কিন্তু মন যদি মনকে ছুয়ে যায় তাহলে সেটা তো অবহেলা করা যায়না। কিন্তু একটা মানুষ কি দুজনের মন নিতে পারে। ঝর্না আমাকে কি ভাবে পেতে চাইছে? আমার মাও তো মন থেকে আমার ওপর নির্ভর করে, বাবাও। কিন্তু এই সম্পর্কের যুক্তিযুক্তটা কোথায়। কি নাম এর? তুলির সাথে আমার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাহলে?
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হাতেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এইকদিন এই হাত দুটো এই শরিরটার মধুমন্থন করেছে। আজকে সস্নেহে হাত ওঠানামা করছে, ওর ফুলন্ত পিঠে। আমি জানি ও কি রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে ভুগছে। ভালো হতে চেয়ে, জীবনের সবথেকে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে, কখন সর্বসমক্ষে ওর পঙ্কিল অতীত ভেসে ওঠে।
আমি ভগবানে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু মনে মনে কাউকে যেন ডাকছি যে এই দুঃসময়ের থেকে বের করে দিক।
তুলির আসার শব্দে ঠিক হয়ে বসলাম। চোখের জল মুছে, টানটান হয়ে বসলো ও।
চা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলতে বলতে অনেক সময় কেটে গেলো।
তুলিদের গেটখোলার শব্দ হোলো। পুরোনো লোহার গেট, বেশ আওয়াজ করে খুললো। কয়েকজনের আওয়াজ আসছে, সাথে মহিলাও আছে। তুলি জানলা খুলে দেখে দেখলাম কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো।
সিঁড়ি দিয়ে আগন্তুকেরা উঠে আসছে, সাথে তুলির বাবার গলা। বুঝলাম তুলির বাবার সঙ্গেই এরা এসেছে।
অবাক করে দিয়ে রাজু, আর এক বয়স্ক সম্ভ্রান্ত দম্পতি এসে ঢুকল ঘরে। এরা রাজুর মা বাবা, গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিজের কর্নধার।
হাতের ফুলের তোরা তুলির মার বিছানার পাশে রাখলেন উনারা, ভিতরে “get well soon” জাতিয় কার্ড। ফুলের তোরাটা একটা গনেশের মুর্তির মধ্যে গাথা, স্বেত পাথরের সেই মুর্তি এদের আর্থিক বৈভবের পরিচয় দিচ্ছে।
রাজুর মা দেখলাম তুলির গাল টিপে আদর করে, সেই হাত নিয়ে চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করলো। মুখে ওর রুপের অনেক প্রসংশা করছে।
তুলির বাবা রাজুর বাবার সাথে আলতু ফালতু কথা বলে চলেছে। কবে উনাকে টিভিতে দেখেছেন, কোন মিনিস্টারের সাথে দেখেছেন, এসব ফালতু গল্প জুরেছেন। মেরুদন্ডহীন একটা মানুষ।
রাজু ওর মাকে তুলির মার সাহসিকতার গল্প শোনাচ্ছে। কিভাবে খোলা রিভলভারের সামনে উনি বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন। জানিনা কোথা থেকে এত গল্প শুনলো।
তুলি চলে গেছে সবার জন্যে চা করতে, তুলির বাবার আদেশে। আমি রয়ে গেছি কি ঘটতে চলেছে সেটা বোঝার জন্যে।
তুলির মা হাল্কা স্বরে প্রতিবাদ করে উঠলো। এদের হঠাত আগমন যে উনি পছন্দ করেন নি সেটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন উনি। রাজুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ‘যদি কারো কথা বলতে হয় তো ওর কথা বলুক সবাই” আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললো। ‘যে ভাবে ও ঝাপিয়ে পরে ওদের আটকেছে, অন্য ছেলে হলে কি করতো কি জানি, ও না থাকলে আজকে আমার বদলে আমার ছবিতে আপনাদের ফুলমালা দিতে আসতে হোতো।’
রাজুর মুখটা দেখলাম লজ্জার ভাব ফুটে উঠেছে। লজ্জাও আছে তাহলে।
রাজুর মা আমার দিকে ঘুরে তাকালো। সবাই চুপ করে গেলো, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুলির বাবা বলে উঠলো ‘আরে বাবা ও সেদিন না থাকলে যে কি হোত। পুরো হিন্দি সিনেমার নায়কের মত ও লরেছে সেদিন, খুব সাহসি ছেলে ও। আমার বন্ধুর ছেলে।’
তুলির মা বলে উঠলো ‘আমাদের হবু জামাই, এখনো হবু, সামনের বছর তুলি কলেজ থেকে বেরোলে আর হবু থাকবে না।’
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হোলো। সবাই চুপ। রাজুর মুখটা চুপসে গেছে। ভালো রকম জুতোর বাড়ি খেয়েছে।
রাজুর মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন জিজ্ঞেস করছে এটা কি হোলো।
তুলির মা আমার উদ্দেশ্যে বললো ‘যাও না একটু গিয়ে দেখো না তুলি কি করছে? যা ঢিলে মেয়ে আমার, এই কয় কাপ চা করতে রাত না কাবার করে দেয়।’
আরেকটা জুতোর বাড়ি পরলো এদের মুখে, তুলির মা আমাকে এগিয়ে দিলো বলে।
রাজুর মা আগ বাড়িয়ে বলতে গেলো ‘আহাঃ উনি তো ছেলে মানুষ, এর থেকে আমি যাই না...’
‘না না আপনি অতিথি এই প্রথম এলেন আমার বাড়ি কেন শুধু শুধু ...।’
‘আরে প্রথমবার মানে তো শেষবার না, এরকম পর পর ভাবছেন কেন?’
তুলির মা একটু গম্ভির ভাবেই বলে উঠলো ‘আমাদের বাড়ি একটু জটিল, আপনি পারবেন না বরঞ্চ ও যাক আপনি বসুন।’
কুত্তার ল্যাজ সহজে সোজা হয় না। তাই বোধহয় রাজুর মা বলে উঠলো ‘তো রাজু তুইও যা না ওর সাথে। সারাদিন তো তুলি তুলি করে কাজকর্মে শিকেই তুলেছিস।’
আমি বুঝতে পারছি না এরা কি চাইছে, এদের মত লোককে উচিৎ ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া।
চুতিয়াটা আমার সঙ্গ নিলো ‘আপনি খুব লাকি, আপনার ওপর আমার হিংসে হয়?’ সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামতে নামতে আমাকে কথাগুলো বললো।
আমি গম্ভিরভাবে জিজ্ঞেস করলাম ‘কারনটা বুঝলাম না তো?’
‘তুলির মত মেয়েকে জীবনে পেয়ে?’
আমার মাথাটা গরম হয়ে গেলো। বলে ফেললাম ‘সেটা আর সুস্থভাবে হবে বলে তো মনে হচ্ছে না’
রাজু আমার কথার কোন উত্তর দিলো না।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্যাসও জ্বালায় নি। পিছন ঘুরে দারিয়ে কিচেনের স্ল্যাব ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।
আমাদের পায়ের আওয়াজে ও সজাগ হয়ে উঠলো। ঘুরে দাড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাতেই বুঝে গেলাম ও কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি ব্যাপার। কিন্তু ও উত্তর দেবে কি ভাবে? চামউকুনটা তো গায়ের সাথে সেঁটে আছে।
চা খেতে খেতে রাজুর বাবা অনেক গল্প ঝারলো, রাজুর হাত দিয়ে কি ভাবে ওদের ব্যাবসা বড় করবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যে সামান্য চাকরি করি সেটাও বোঝাতে ভুললো না। বলেই ফেললো আমাদের বেশির ভাগ প্রোজেক্টই চাইনিজ পার্টনার নিয়ে যার ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকার। আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানকে উনি ফোন করলেই আমাদের চেয়ারম্যান যেন ফোনেই “ইয়েস স্যার” বলে ওঠে। আরো নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো তুলির মা বাবাকে, যে রাজুর হাতে ওদের মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত এবং বিলাসবহুল।
ওরা চলে যেতেই তুলি কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। তুলির মা, তুলির বাবাকে যা নয় তা বলে মুখ করতে শুরু করলো, সব জেনে শুনেও ওদের এত পাত্তা দেওয়ার জন্যে। তুলির বাবার সেই অবোধ স্বিকারোক্তি, “আমি কি করে বুঝবো ওদের মনে কি আছে।”
তুলি কাঁদতে কাঁদতে আমার পা ধরে ফেললো ওর মা বাবার সামনেই। কারন আমি ওকে ভুল বুঝতে পারি। রাজুরা যে আসবে সেটা ও জানতো না।
এরপরে আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমাদের উকিলের সাথে রনির বাবা এসে হাজির। ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চাইছে কোর্টের বাইরে। তুলির মা আর আমি সহযোগিতা করলে, ওর একমাত্র ছেলেকে আর এই পুলিশি চক্করে পড়তে হয়না। আপাতত ভেবে দেখা হবে বলা হয়েছে। আর যাই হোক সব দিক ভেবেই এগোতে হবে। একবার ছার পেয়ে গেলে সে আবার কি খেল দেখাবে সেটা কে বলতে পারে।
ডালহৌসি এলাকায় অফিস হলে একটা সুবিধে যে নানারকম খাওয়ার দাওয়ার পাওয়া যায়, সাথে ওনেক চেনাপরিচিত লোকেরও দেখা পাওয়া যায়।
এইরকমই একদিন লাঞ্চ করে সিগেরেট খাচ্ছি তখন হঠাৎ করে কনুইয়ে চিমটি খেয়ে ঘুরে দেখি, সানি। সেই যে সানি হোমোর কথা বলেছিলাম শুরুতে সেই ভক্ত।
এখানে অতটা নেকিয়ে নেকিয়ে কথা বলছে না। বেশ একটা সিরিয়াস হাবভাব। মোটের ওপর দাড়িয়ে কথা বললে কেউ কিছু বুঝবে না। কিন্তু যেহেতু আমি ওর নিয়ত জানি, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ওর সেই মেয়েলিপনা রিতিমত বর্তমান।
কথায় কথায় জানতে পারলাম যে ও স্টিল অথোরিটিতে চাকরি করে। কন্ট্রাক্টসেই আছে।
আমিও কন্ট্রাক্টসে আছি শুনে, হই হই করে উঠলো। সে কি উচ্ছাস তার।
আমিও মনে মনে খুশিই হোলাম কারন, আমাদের ব্যাবসাটা মুলতঃ স্টিল প্ল্যান্ট নির্ভরই। পাওয়ার বা রিফাইনারিতে আমাদের অন্য গ্রুপ খুব আক্টিভ।
গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিসের কর্নধারের কথা মনে পরে, আমাদের চেয়ারম্যান নাকি ওকে সেলাম ঠোকে। শালা ও কি ধরনের বোকাচোদা কে জানে। করে তো বালের কিছু দালালির, আর এগ্রো বিষয়ক ব্যাবসা। সাথে লোক ঠকানোর চিটফান্ড। সে কিনা ভারতব্যাপি মোনোপলি একটা বিজনেস গ্রুপের সাথে নিজেকে তুলোনা করে। ওর চিটফান্ডের অনেক তথ্যই আমি আমার পুরানো বসকে দিয়ে এসেছি। বিজনেস সিক্রেট তাই এতোদিন কাউকে বলিনি। এই প্রথম বসকে বললাম, যে ওরা কি ভাবে ভুঁয়ো লগ্নি, ভুঁয়ো ব্যবসা দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলছে। কি ভাবে সারভিস ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে।
নতুন বসকে গিয়ে বললাম যে স্টিল অথোরিটির কন্ট্রাক্টসে আমার একজন পরিচিতর সাথে দেখা হোলো। ব্যবসা সুত্রে পরিচিত সবাইই। আমাদের প্রোডাক্টের জন্যে, আমাদের বেশ সুনাম আছে বাজারে। একপ্রকার একচেটিয়া বলা যায়। কিন্তু কোম্পানি এখন অন্যধরনের প্রোজেক্টেও নামতে চাইছে। সেই জন্যে চিন ও বিভিন্ন ইয়োরোপিয়ান দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির সাথে আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি। নিজেদের দক্ষতার বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের প্রোজেক্টে নিজেদের পা রাখার জন্যে। ইতিমধ্যে দুটো প্রোজেক্ট কমিশানিং হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক চলছে।
এর স্টীল অথোরিটিতেই একটা বিরাট টেন্ডার বেরিয়েছে। বসের কাছে শুনলাম, যে আমরা ছাড়া আরো দুটো কোম্পানি টেন্ডার তুলেছে। সেটা কারা কারা সেটা নিয়ে আমাকে আমার সোর্স লাগাতে বললো।
আমি খোঁজ করছি শুনে সানি যেন আনন্দে আপ্লূত। বললাম আমাকে একটু হেল্প করতে হবে। সানন্দে রাজী সে। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে যেটা বোঝাতে চাইলো সেটার জন্যে মনে হয় এই চাকরিটাও ছারতে হবে।
বুঝতেই পারছি ওর লোভটা কোথায়।
সেদিনের পর থেকে তুলি আর ফাংশান করার জন্যে বায়না করেনি। ও নিজেই বলেছে যেকদিন কলেজ হবে, গুরুত্বপুর্ন ক্লাস ছাড়া আর ও যাবে না। এক বছর এই ভাবেই কাটিয়ে দেবে। আমি ওকে এটেন্ডান্সের দিকে নজর রেখে যা করার করতে বললাম।
সব কিছু এখন ঠিকঠাকই চলছে। খেলার নিয়ন্ত্রন এখন আমার দিকে। শুধু আমি কিছু হিসেবনিকেশ করে চলেছি।