31-12-2018, 04:45 PM
ভালো থাকতে চাইলেও পারছিনা। সবাই মিলে, সবকিছু, একসাথে আমার উপরে হামলা চালাচ্ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। নেহাত আমার মা বাবার আমার ওপর অগাধ বিশ্বাস তাই সেদিক থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছি আমি। নাহলে আজকের দিনে হয়তো নিজের পথ নিজে দেখে নিতে হোতো। জানিনা কেমন করে আমাকে ভরসা করে। আজকের তারিখে দাড়িয়ে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে এই দাড়ায় যে, আমি এক কামুক পুরুষ। কাম চরিতার্থের জন্য আমি যে কোন উচ্চতায় ভ্রমন করতে পারি। মুল্যবোধ, পাপবোধ সব পিছনে ফেলে আমি নিজের শরীরের ক্ষিদে চরিতার্থ করতে পিছপা হইনা। কিন্তু, অন্ধকারের মধ্যেও আলো থাকে। আজ আমি যা হয়েছি সব কিছুর পিছনে তুলি, আর আমার ভালোবাসা। অপরাধিরা কি ভালবাসতে পারে? নিচুমনের মানুষেরা ভালোবাসতে পারে? পারে কি নিজের জীবনের কথা না ভেবে প্রানঘাতি আগ্নেয়াস্ত্রর সামনে দাড়াতে? মনে হয় না।
তুলির কান্না থামাতে আর পারছিনা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। পুলিশ কেস যেহেতু হয়েছে তুলির মাকে সরকারি হাসপাতালেই কাটাতে হবে। এখনোও তুলির মা অচৈতন্য হয়ে রয়েছে। প্রচুর রক্ত বয়ে গেছে শরীর থেকে। জানিনা বাঁচবে কিনা। নিজেকে খুব অপরাধি মনে হচ্ছে। শুধু শুধু এইরকম মাথা গরম না করলেই পারতাম। সত্যি আমার ইগো সবার ওপরে। রনিকে মালের বোতল নিয়ে বেপরোয়া হাবভাব করতে দেখে এমন মটকা গরম হোলো যে ওকে শিক্ষা দিয়েই ছারলাম, সাথে তুলির মার জীবন বিপন্ন করলাম।
কবিরদা আজকে ছিলো না। আমি তুলিদের ঘরের ছিটকিনি আটকে দিয়েই পুলিশে ফোন করি। অনেক পরে খুজে পেতে কবিরদার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম। পুলিশ এসে রনি আর স্বপনকে রিভলভারের সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো। তুলির মাকেও হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো। রনিও এই হাসপাতালেই ভর্তি।
তুলির মার অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রক্ত দেওয়ার দরকার ছিলো। সামান্য দেরিতে হলেও সেটা জোগার করতে বেশী অসুবিধে হয়নি।
এরকম একটা ব্যাপারে কারো সাহায্য নেবো বা কাউকে বলবো ভাবতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিলো। তাই একা একাই লড়ে যাচ্ছিলাম। যতই হোক না কেন সবকিছুর নেপথ্যে তো সেই আমি।
এখনো তুলির সাথে ঠিক করে কথা বলে উঠতে পারিনি। তুলির বাবাও প্রথমে হতভম্ব হয়ে পরেছিলো। আমার মনের মধ্যে খুব আশঙ্কা হচ্ছে, যে পুলিশি তদন্তে সব কিছু না বেরিয়ে। আমি জানি আমার আর ঝর্নার শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারটা ফাঁস হবেনা তবুও মনের মধ্যে ভীষণ টেনশান হচ্ছে। সেটা ফাঁস না হলেও পুলিশি তদন্তে এমন কিছু উঠে আসবে যেটাতে আমার হবু শ্বশুরবাড়ির বাকি ইজ্জতটা ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিন লোকে ফিসফিস করতো এখন তথ্যপ্রমান শুদ্ধু সব জানতে পারবে।
তুলি কেঁদেই চলেছে। ওদের সেই ম্যাডামকে আজকে ভালো করে ঠাপ(কথার ঠাপ, অন্য কিছু ভাববেন না) দিয়েছি, খানকী মাগি কোনকিছু না জানিয়ে হঠাত করেই সেই রাজুস্যারের বাড়িতে রিহার্সাল করাতে নিয়ে গেছিলো। আমি তুলির বাড়িতে কি হয়েছে অবশ্য জানাই নি। আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো যে আমি কে? কতবড় সাহস!! ভালো করে দিয়েছি, এমনিতেই এরকম দালাল চরিত্র আমার পছন্দ নয়, তারওপর এত কথা।
আর এই শালা রাজুচুদি, শালা মাগিবাজ! আমি তুলিকে বলে দেবো যে আর ফাংশান না করতে। এই রকম মানসিকতায় ও আদৌ ফাংশান করবে কিনা আমি জানিনা। আর ওর ফাংশানের আগে ওর মাও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে কিনা কি জানি।
সরকারি হাসপাতাল, সিকিউরিটির অষ্টরম্ভা। সকাল হতেই আমি তুলিকে নিয়ে ওর মায়ের বেডে গিয়ে পৌছুলাম। ওর মাকে দেখলাম ঘুমোচ্ছে, কিন্তু ঘুমের মধ্যেই আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। বেলার দিকে উনার সেন্স ফিরলো। ডাক্তার বলেছে যে জীবনের ভয় নেই, কিন্তু রক্তপাতের দরুন খুব দুর্বল। উর্ধবাহু ফুরে গিয়ে গুলিটা ঢুকেছিলো। বেরোতে পারেনি। অনেক মাংস কেটে বাঁদ দিতে হয়েছে গুলিটা কেটে বার করতে।
আমি বুঝতে পারছি যে তুলির সামনে ও কোন কথা বলতে চাইছে না ও। আমি তুলি আর তুলির বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে যাবো বলে থেকে গেলাম।
ওরা চলে যেতেই আমি আবার ঝর্নার কাছে চলে এলাম। সিকিউরিটিকে হাতে দশটাকার একটা নোট গুজে দিয়েছি, অন্তত এবেলা আর বাঁধা দেবেনা আশা করি।
ঘুমাচ্ছন্ন গলায় ঝর্না বললো ‘ওয়াসিম, আকবর, এসেছিলো?’
‘কে ওরা?’
‘রনির লোক ওরা।’
‘কেন এসেছিলো?’
‘বলছে মুখ খুললে তুলিকে তুলে নিয়ে যাবে, তোমাকেও শেষ করে দেবে।’
‘আর কেউ শোনেনি?’
‘না আস্তে আস্তে বলছিলো, বলছিলো তোমাকে আর তুলিকে ওরা বাইরে বসে থাকতে দেখেছে।
আমি চুপ করে রইলাম, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করিনা, কিন্তু আজকাল তো কতকিছু হয়, এই ক্ষেত্রে মনে হয় দুঃসাহসি হওয়া ঠিক হবে না। তুলিদের বাড়ির ভিতরে কোনোকিছু হয়ে গেলেও কেউ টের পাবেনা। পুলিশ আর কতক্ষন পাহাড়া দেবে। কালকেও তো প্রথমে কেউ টের পায়নি, পুলিশের গাড়ি আসার পরেই আস্তে আস্তে ভির জমতে শুরু করে, আমি তো তাও ডাকাতি করতে এসেছিলো বলে পাস কাটিয়েছি। সেই সময় আর কি করবো, আগে তুলির মাকে হসপিটালে ভর্তি করাটা জরুরি ছিলো।
আমি বললাম, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করছি।’
ঝর্না কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উঠলো ‘তুমি ওদের চেনো না তাই বলছো...।’
আমার খুব মায়া লাগলো। আমি ওর মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছি, মানুষের পক্ষে অত্যধিক যৌনতা সবথেকে সর্বনাশা। মানুষের জীবনে যে কিভাবে বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা আজ বুঝতে পারছি। সব থেকে বেশী চিন্তা হচ্ছে যে এই খেলায় আমিও এক মহারথি, যে কিনা ধোয়া তুলসি পাতা না।
আমার হাতের ছোয়া পেয়ে তুলির মা হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিলো। আমি অনেক স্বান্তনা দিলাম, ও শান্ত হলেও বুঝলাম আতঙ্ক কাটেনি।
এই অবস্থায় ওকে ফেলে যে বাড়ি যাবো সেটা সম্ভব না। আমার জন্যেই আমার কথায় ও রনির বিরগভজন হয়ে এই পরিনতি ভোগ করছে।
তাই অপারগ হয়েই সামনের একটা সুলভ কমপ্লেক্সে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। স্নানঘরে ঢুকে মাথায় একটু জল দিয়ে নিলাম। রাত জাগা আর মানসিক চাপের ফলে বেশ ক্লান্ত লাগছে।
বুক দুরু দুরু করছে। তুলিরা ঠিক মত পৌছেছে তো? নাহঃ এখনো সময় হয়নি আরেকটু পরে ফোন করে দেখবো।
জীবনে এই প্রথম আমি ভয় পাচ্ছি। সেটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার। অন্য কারো ব্যাপার হলে অনেক মাথা খাটাতে পারতাম, কিছু একটা উপায় বের করতাম। কিন্তু নিজে যেখানে ফেঁসেছি সেখানে কোন মাথা কাজ করছে না। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা আর তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই এই মুহুর্তে।
বারে বারে ওপরে গিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তুলি আর তুলির বাবা আবার ভিসিটিং আওয়ারে ফিরে এলো।
এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটেনি। রনির ওয়ার্ডের বাইরে পুলিশ পাহাড়া বসেছে, যাতে পালিয়ে না যেতে পারে।
তুলিকে দেখে তুলির মা খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললো। উর্ধবাহুর অনেকটা মাংস নিয়ে গুলিটা বের করতে হয়েছে। হাত নড়াতে পারছেনা। অনেক সময় লাগবে সুস্থ হোতে।
ভিসিটিং আওয়ার শেষে আমি আবার তুলিদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। সেও অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে। আশেপাশের লোকের অনেক কৌতুহল, গুলি লাগার কেস তো তাই। আমার আর তুলির সামনেই কারা যেন আলোচনা করছে যে বাড়িতে ডাকাত পরেছিলো, তুলির মা রুখে দাড়িয়েছে বলে গুলি করেছে। গুজব কি ভাবে যে রটে!!
তুলিরা চলে যেতেই আমি তুলির মার কাছে গিয়ে বেডের ওপরেই বসলাম। আমার হাঁত আঁকড়ে ধরলো। অনেক ভরসা করছে আমার ওপর বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমাকে এখন জরুরি কিছু কথা বলতে হবে।
প্রায় ফিসফিস করেই ওকে অনেক কথা বললাম।
ঝর্না ভয় পাচ্ছে, সেই হুমকির ভয়। রনিদের শাস্তি দিতে ভয় পাচ্ছে, পাছে তুলি আর আমার ক্ষতি হয়।
আমি ওকে অনেক বোঝাচ্ছি, যে পুলিশকে বিশ্বাসযোগ্য কারন দেখাতে না পারলে পুলিশও সহজে ছারবেনা। খুজে খুজে ঠিক বের করবে। তখন একদম ঢি ঢি পরে যাবে। এর থেকে ও কথা না বলে আমি কথা বললেই ভালো, কারন আমি ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শি এবং সক্রিয় সাক্ষী।
কাল রাতে পুলিশকে বলা হয়েছে যে এরা আমাদের পরিচিত, হঠাত করেই এরকম আক্রমন করে। আজকে পুলিশ নিশ্চয় গুলি চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলবে।
আমার আশঙ্কা সঠিক প্রমান করে কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির।
তুলির মাকে শিখিয়ে দিয়েছি যে বেশি কথা না বলতে, যাতে আমার থেকে পুলিশ জানতে চায় যে আসল ঘটনাটা কি?
পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, যে ওরা জামিনের আবেদন করেছিলো, কিন্তু আমাদের উকিল তা বিরোধিতা করায় সেটা নাকচ হয়ে যায়। আপাতত গুলিচালনা, অবৈধ অস্ত্র রাখা, হামলা, খুনের চেষ্টা এসব কেস দেওয়া হয়েছে। ১৪ দিনের পুলিশ হেপাজতে থাকবে এখন।
আমি পুলিশকে যে গল্পটা দিলাম সেটা হোলো, এরা তুলিদের বাড়িতে ঘুর ঘুর করছে ওদের বাড়িটা প্রোমোটিং করবে বলে। তুলিরা রাজী না তাই শেষমেশ এই পথ অবলম্বন করেছে। পুলিশও মনে হয় খেলো ব্যাপারটা। ভালো করে জিজ্ঞাসা করলো আমাকে কিরকম দাম হতে পারে জমির কতটা জমি আছে এসব, শুনে নিজেরাই বলাবলি করলো এরকম একটা যায়গা হাতছারা হলে তো যে কেউই ক্ষেপে যাবে, কোটি কোটি টাকার লেনদেন হোত এই সম্পত্তিতে।
আমিও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে বললাম, আমি কে, কেন এবং কি পরিস্থিতিতে আমি গিয়ে পৌছেছি আর কি দেখেছি। তারপর কি কি হয়েছে। সুধু রনির গুলিটা যে অনিচ্ছাকৃত সেটা বাদ দিয়ে সব সত্যি বললাম। বুঝলাম আমার বয়ানটা খুব গুরুত্বপুর্ন পুলিশের কাছে।
হুমকির ব্যাপারটা বলতেই পুলিশ ওখানে একজন কনস্টেবল পোস্টিং করে দেবে জানিয়ে চলে গেলো।
শালা দুনিয়ায় এত ঘটনা ঘটছে, আর খবরের কাগজের লোকগুলো আর কোন খবর পেলো না? একটা পেপার কিনে নিয়ে পড়তে শুরু করতেই দেখি এককোনে তুলিদের বাড়িতে গুলি চালোনার ঘটনা ছাপিয়ে দিয়েছে। লিখেছে, নিকটাত্মিয়রা মধ্যবয়েসি মহিলার ওপরে প্রানঘাতি হামলা করেছে। ভুলভাল সব তথ্য কোথা থেকে পেলো কে জানে।
ঝর্নার চোখে চরম কৃতজ্ঞতা। আস্তে আস্তে ওর আতঙ্ক কাটছে।
আমিও তুলিকে ফোন করে ওর খোজ খবর নিলাম আর ওর মার খোঁজ খবর জানালাম। আমাকে বলছে যে কাল থেকে অফিসে যেতে, ও ওর বন্ধুদের নিয়ে থাকবে বিকেল পর্যন্ত।
আমার কবিরদার সাথে দেখা করা খুব দরকার, অনেক কথা বলতে হবে। কিন্তু এদের ফেলে কি করে যাই? এতটা সময় তুলি আর ওর বাবাকে রেখে যাওয়া মানে কোন বিপদ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। রনির লোকজন নিশ্চয় প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
বিকেল হয়ে এলো ৫টার সময়ই মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। হাল্কা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমি তুলি আর তুলির বাবাকে ওর মার কাছে রেখে বাইরে চা খেতে এলাম।
কিছুক্ষন পরে ফিরে গিয়ে দেখি রাজুস্যার এসেছে তুলির মাকে দেখতে। পেপারে পরে জানতে পেরেছে। মুখে একটা রুমাল চাপা দেওয়া। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলোধনা করছে।
তুলিকে রাজুস্যার বললো ওর মাকে প্রাইভেট হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সেখানে পরিবেশও ভালো, আর চিকিৎসাও ভালো হবে।
তুলি আমার মুখের দিকে একবার তাকালো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি যে তুলি নিজেও সেটাই চাইছে। তুলির ইতস্তত করছে দেখে রাজু প্রায় জোড়াজুড়ি শুরু করলো। তুলির বাবার কোন মন্তব্য নেই। অগত্যা আমিই বললাম যে এরকম পুলিশ কেসের ব্যাপার, পুলিশের আনাগোনা কি অন্য বেসরকারি হাসপাতালে মেনে নেবে?
আমার কথা প্রায় ফুতকারে উড়িয়ে দিলো ও। আমাকে বললো ‘ওসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি বুঝে নেবো।’
তুলিও এই রকম পরিবেশ থেকে মাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। আমি তুলির দিকে তাকিয়ে আমার মনোভাব বুঝিয়ে দিতে চাইলাম। বলতে চাইলাম দরকার হলে আমরা নিজেরা এসব করবো ওর এত নাক গলানোর কি দরকার। কিন্তু তুলি সেরকম একটা বোঝার চেষ্টা করলো না। হয়তো ও বুঝতে পারেনি আমার মন কি চাইছে।
রাজু এই সুজোগে বেশ হেক্কা নিয়েই বললো ‘কালকে সব ট্রান্সফার হয়ে যাবে, কোন চিন্তা করার কিছু নেই।’ আমার দিকে ঘুরে বললো ‘আপনার আপত্তি নেই তো?’
কি বলবো আমি? যে অন্য কেউ করলে আপত্তি ছিলো না, তুমি করছো বলেই আপত্তি, তোমার ধান্দা তো একটাই।
কি করবো যার জন্যে করছি, সেই যদি না বোঝে তো আমি আর কি করবো। ওকেও আর কি দোষ দেবো, মার ভালোবাসা তো ওকে অন্ধ করে রেখেছে। আর এরকম পরিবেশে কে থাকতে চায়।
‘না আপত্তি থাকবে কেন, এটা হলে তো ভালোই হয়, কিন্তু তার আগে তুলি আর তুলির বাবা আত্মিয়স্বজন মিলে বসে এটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, এই ভাবে দুম করে তো হয় না।’ আমি সময় কিনতে চাইছি যাতে তুলিকে ওর ধান্দাটা বোঝাতে পারি। রাগ উঠে যাচ্ছে তুলির বাবার ওপরে, এত ক্যালানে কি করে হয় মানুষ।
‘আরে উনারা তো এখানেই আছেন, আলোচনা যা করার এখানেই করে ফেললে, একদিন বাচানো যায়, আর এ আর এমন কি সিদ্ধান্ত যে গোলটেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বললো। যেন আমরা এই সহজ সিদ্ধান্ত নিতে কাঁপাকাপি করছি।
আমি তুলির দিকে তাকালাম, ও রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে। রাজু ওকে বিভিন্ন ব্যাপার স্যাপার বুঝিয়ে চলেছে যে এখানে রাখলে কি হোতে পারে না পারে।
আমি তুলিকে দেখে চলেছি। একবারের জন্যেও ও আমার মতামত জানতে চাইছেনা। এই কাজগুলো করার মধ্যে তো এমন কিছু কেতা নেওয়ার ব্যাপার নেই। আমারও সেই ক্ষমতা আছে, আমার কেন সবারই আছে। অথচ ও তুলির কাছে নিজেকে এমন ভাবে রিপ্রেজেন্ট করছে যে ও ওর ক্ষমতা প্রয়োগ করে সহজেই এসব করে দেবে।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম আমি তুলির জন্যে। তুলির মানসিক পরিস্থিতি আর ওর মার ওপর ওর অগাধ ভালোবাসার দরুন যে চিত্তদৌর্বল্যের সৃষ্টি হয়েছে ওর মধ্যে, তার পুর্ন সদব্যাবহার করে চলেছে রাজু। যা হাবভাব দেখাচ্ছে তাতে করে বোঝা যায় ও শুধু মাগিবাজই নয়, মানুষ হিসেবেও নিচু প্রকৃতির। আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি যে ও আমার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এইরকম পরিস্থিতিতে আমি তুলিকে না পারছি ডেকে আলাদা করে কথা বলতে, না পারছি উপযাচক উপকারির অপমান করতে। কি করে করবো, এখন যার সব থেকে শক্ত হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার কথা সেই নুঁইয়ে পরেছে। হ্যাঁ আমি তুলির বাবার কথা বলছি। কিসের গল্প করে এরা? এহাতে বোম ছুরেছি, পুলিশের মার খেয়েছি, ও হাতে পিস্তল চালিয়েছি, সেসব দিনগুলো কি কোটা বাঁধা ছিলো। এরকম পরিস্থিতিতেও কি ভিতরের পুরুষসিংহ জেগে ওঠেনা?
আমি আর সহ্য করতে না পেরে ওখান থেকে চলে এলাম। গেটের বাইরে এসে এক ভাঁর চা খেলাম। একটা সিগেরেট ধরালাম। ধোঁয়ার রিং ছেড়ে দেখছি, কত তাড়াতাড়ি সেগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফিরতে ফিরতে দেখলাম রাজু এখনো তুলির সাথে বকবক করে যাচ্ছে।
আমি তুলিকে ডাকলাম। রাজুও আসছিলো সঙ্গে সঙ্গে। আমি হেসে ওকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি তুলির সাথে একা কথা বলতে চাই।
‘তুমি কি বুঝতে পারছো ও কি করতে চাইছে?’
‘কে?’
‘এই তোমাদের রাজুস্যার?’
‘কেন তোমার সামনেই তো কথা হোলো।’
‘এগুলো কি আমরা করতে পারতাম না। আমাদের মা, আমরা কি খারাপ চাইতাম। ও যে ইচ্ছে করে নিজের ভাও বাড়াতে এসব করছে সেটা তুমি বুঝতে পারছো না?’
‘আরে ধুর তুমিও না একদম যা তা। হাসপাতালের রুগি দেখতে এসে কেউ এরকম ভাবে নাকি?’
‘ও তোমার জন্যে ওর দরদ উথলে পরলো যে? ওর কোম্পানির কত লোকের তো রোগভোগ হয়, ও কি দৌড়ে যায়?’
‘ওর এসব করে কি লাভ বলোতো? ও তো তোমাকে দেখছে। ও তো জানে যে আমার সাথে তোমার বিয়ে হবে।’
‘তুলি এই পরিস্থিতিতে আমি এসব কথা যদি তোমাকে বলতে হয় সেটা আমার কাছে নিজেকে চূড়ান্ত অপমান করা হবে।’
‘তুমি বড্ড বেশী চিন্তা করো।’ তুলির মুখটা কেমন যেন বিরক্তি ভরা লাগলো।
আমি হতাশ হয়ে তুলিকে একটা কথায় বলতে পারলাম ‘ভবিষ্যতে যেন এইদিনটার কথা আমাদের আর না মনে পরে।’
তুলির মাথার ওপর দিয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নিজেকে খুব ছোট মনে হোলো। এটা আমার কাছে নৈতিক পরাজয়।
আমি তুলিকে বললাম ‘ঠিক আছে তোমাদের মা, আমার তো কেউ না, তোমরা যা ভালো বুঝবে তাই করবে। এবার আমি বাড়ি যাবো দুদিন ধরে এখানে রয়েছি, আমারও মা আছে, সেও অসুস্থ।’
আমি হাঁটা শুরু করলাম ট্যাক্সি ধরবো বলে।
ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখলাম তুলি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখছে।
তুলির কান্না থামাতে আর পারছিনা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। পুলিশ কেস যেহেতু হয়েছে তুলির মাকে সরকারি হাসপাতালেই কাটাতে হবে। এখনোও তুলির মা অচৈতন্য হয়ে রয়েছে। প্রচুর রক্ত বয়ে গেছে শরীর থেকে। জানিনা বাঁচবে কিনা। নিজেকে খুব অপরাধি মনে হচ্ছে। শুধু শুধু এইরকম মাথা গরম না করলেই পারতাম। সত্যি আমার ইগো সবার ওপরে। রনিকে মালের বোতল নিয়ে বেপরোয়া হাবভাব করতে দেখে এমন মটকা গরম হোলো যে ওকে শিক্ষা দিয়েই ছারলাম, সাথে তুলির মার জীবন বিপন্ন করলাম।
কবিরদা আজকে ছিলো না। আমি তুলিদের ঘরের ছিটকিনি আটকে দিয়েই পুলিশে ফোন করি। অনেক পরে খুজে পেতে কবিরদার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম। পুলিশ এসে রনি আর স্বপনকে রিভলভারের সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো। তুলির মাকেও হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো। রনিও এই হাসপাতালেই ভর্তি।
তুলির মার অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রক্ত দেওয়ার দরকার ছিলো। সামান্য দেরিতে হলেও সেটা জোগার করতে বেশী অসুবিধে হয়নি।
এরকম একটা ব্যাপারে কারো সাহায্য নেবো বা কাউকে বলবো ভাবতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিলো। তাই একা একাই লড়ে যাচ্ছিলাম। যতই হোক না কেন সবকিছুর নেপথ্যে তো সেই আমি।
এখনো তুলির সাথে ঠিক করে কথা বলে উঠতে পারিনি। তুলির বাবাও প্রথমে হতভম্ব হয়ে পরেছিলো। আমার মনের মধ্যে খুব আশঙ্কা হচ্ছে, যে পুলিশি তদন্তে সব কিছু না বেরিয়ে। আমি জানি আমার আর ঝর্নার শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারটা ফাঁস হবেনা তবুও মনের মধ্যে ভীষণ টেনশান হচ্ছে। সেটা ফাঁস না হলেও পুলিশি তদন্তে এমন কিছু উঠে আসবে যেটাতে আমার হবু শ্বশুরবাড়ির বাকি ইজ্জতটা ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিন লোকে ফিসফিস করতো এখন তথ্যপ্রমান শুদ্ধু সব জানতে পারবে।
তুলি কেঁদেই চলেছে। ওদের সেই ম্যাডামকে আজকে ভালো করে ঠাপ(কথার ঠাপ, অন্য কিছু ভাববেন না) দিয়েছি, খানকী মাগি কোনকিছু না জানিয়ে হঠাত করেই সেই রাজুস্যারের বাড়িতে রিহার্সাল করাতে নিয়ে গেছিলো। আমি তুলির বাড়িতে কি হয়েছে অবশ্য জানাই নি। আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো যে আমি কে? কতবড় সাহস!! ভালো করে দিয়েছি, এমনিতেই এরকম দালাল চরিত্র আমার পছন্দ নয়, তারওপর এত কথা।
আর এই শালা রাজুচুদি, শালা মাগিবাজ! আমি তুলিকে বলে দেবো যে আর ফাংশান না করতে। এই রকম মানসিকতায় ও আদৌ ফাংশান করবে কিনা আমি জানিনা। আর ওর ফাংশানের আগে ওর মাও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে কিনা কি জানি।
সরকারি হাসপাতাল, সিকিউরিটির অষ্টরম্ভা। সকাল হতেই আমি তুলিকে নিয়ে ওর মায়ের বেডে গিয়ে পৌছুলাম। ওর মাকে দেখলাম ঘুমোচ্ছে, কিন্তু ঘুমের মধ্যেই আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। বেলার দিকে উনার সেন্স ফিরলো। ডাক্তার বলেছে যে জীবনের ভয় নেই, কিন্তু রক্তপাতের দরুন খুব দুর্বল। উর্ধবাহু ফুরে গিয়ে গুলিটা ঢুকেছিলো। বেরোতে পারেনি। অনেক মাংস কেটে বাঁদ দিতে হয়েছে গুলিটা কেটে বার করতে।
আমি বুঝতে পারছি যে তুলির সামনে ও কোন কথা বলতে চাইছে না ও। আমি তুলি আর তুলির বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে যাবো বলে থেকে গেলাম।
ওরা চলে যেতেই আমি আবার ঝর্নার কাছে চলে এলাম। সিকিউরিটিকে হাতে দশটাকার একটা নোট গুজে দিয়েছি, অন্তত এবেলা আর বাঁধা দেবেনা আশা করি।
ঘুমাচ্ছন্ন গলায় ঝর্না বললো ‘ওয়াসিম, আকবর, এসেছিলো?’
‘কে ওরা?’
‘রনির লোক ওরা।’
‘কেন এসেছিলো?’
‘বলছে মুখ খুললে তুলিকে তুলে নিয়ে যাবে, তোমাকেও শেষ করে দেবে।’
‘আর কেউ শোনেনি?’
‘না আস্তে আস্তে বলছিলো, বলছিলো তোমাকে আর তুলিকে ওরা বাইরে বসে থাকতে দেখেছে।
আমি চুপ করে রইলাম, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করিনা, কিন্তু আজকাল তো কতকিছু হয়, এই ক্ষেত্রে মনে হয় দুঃসাহসি হওয়া ঠিক হবে না। তুলিদের বাড়ির ভিতরে কোনোকিছু হয়ে গেলেও কেউ টের পাবেনা। পুলিশ আর কতক্ষন পাহাড়া দেবে। কালকেও তো প্রথমে কেউ টের পায়নি, পুলিশের গাড়ি আসার পরেই আস্তে আস্তে ভির জমতে শুরু করে, আমি তো তাও ডাকাতি করতে এসেছিলো বলে পাস কাটিয়েছি। সেই সময় আর কি করবো, আগে তুলির মাকে হসপিটালে ভর্তি করাটা জরুরি ছিলো।
আমি বললাম, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করছি।’
ঝর্না কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উঠলো ‘তুমি ওদের চেনো না তাই বলছো...।’
আমার খুব মায়া লাগলো। আমি ওর মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছি, মানুষের পক্ষে অত্যধিক যৌনতা সবথেকে সর্বনাশা। মানুষের জীবনে যে কিভাবে বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা আজ বুঝতে পারছি। সব থেকে বেশী চিন্তা হচ্ছে যে এই খেলায় আমিও এক মহারথি, যে কিনা ধোয়া তুলসি পাতা না।
আমার হাতের ছোয়া পেয়ে তুলির মা হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিলো। আমি অনেক স্বান্তনা দিলাম, ও শান্ত হলেও বুঝলাম আতঙ্ক কাটেনি।
এই অবস্থায় ওকে ফেলে যে বাড়ি যাবো সেটা সম্ভব না। আমার জন্যেই আমার কথায় ও রনির বিরগভজন হয়ে এই পরিনতি ভোগ করছে।
তাই অপারগ হয়েই সামনের একটা সুলভ কমপ্লেক্সে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। স্নানঘরে ঢুকে মাথায় একটু জল দিয়ে নিলাম। রাত জাগা আর মানসিক চাপের ফলে বেশ ক্লান্ত লাগছে।
বুক দুরু দুরু করছে। তুলিরা ঠিক মত পৌছেছে তো? নাহঃ এখনো সময় হয়নি আরেকটু পরে ফোন করে দেখবো।
জীবনে এই প্রথম আমি ভয় পাচ্ছি। সেটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার। অন্য কারো ব্যাপার হলে অনেক মাথা খাটাতে পারতাম, কিছু একটা উপায় বের করতাম। কিন্তু নিজে যেখানে ফেঁসেছি সেখানে কোন মাথা কাজ করছে না। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা আর তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই এই মুহুর্তে।
বারে বারে ওপরে গিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তুলি আর তুলির বাবা আবার ভিসিটিং আওয়ারে ফিরে এলো।
এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটেনি। রনির ওয়ার্ডের বাইরে পুলিশ পাহাড়া বসেছে, যাতে পালিয়ে না যেতে পারে।
তুলিকে দেখে তুলির মা খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললো। উর্ধবাহুর অনেকটা মাংস নিয়ে গুলিটা বের করতে হয়েছে। হাত নড়াতে পারছেনা। অনেক সময় লাগবে সুস্থ হোতে।
ভিসিটিং আওয়ার শেষে আমি আবার তুলিদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। সেও অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে। আশেপাশের লোকের অনেক কৌতুহল, গুলি লাগার কেস তো তাই। আমার আর তুলির সামনেই কারা যেন আলোচনা করছে যে বাড়িতে ডাকাত পরেছিলো, তুলির মা রুখে দাড়িয়েছে বলে গুলি করেছে। গুজব কি ভাবে যে রটে!!
তুলিরা চলে যেতেই আমি তুলির মার কাছে গিয়ে বেডের ওপরেই বসলাম। আমার হাঁত আঁকড়ে ধরলো। অনেক ভরসা করছে আমার ওপর বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমাকে এখন জরুরি কিছু কথা বলতে হবে।
প্রায় ফিসফিস করেই ওকে অনেক কথা বললাম।
ঝর্না ভয় পাচ্ছে, সেই হুমকির ভয়। রনিদের শাস্তি দিতে ভয় পাচ্ছে, পাছে তুলি আর আমার ক্ষতি হয়।
আমি ওকে অনেক বোঝাচ্ছি, যে পুলিশকে বিশ্বাসযোগ্য কারন দেখাতে না পারলে পুলিশও সহজে ছারবেনা। খুজে খুজে ঠিক বের করবে। তখন একদম ঢি ঢি পরে যাবে। এর থেকে ও কথা না বলে আমি কথা বললেই ভালো, কারন আমি ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শি এবং সক্রিয় সাক্ষী।
কাল রাতে পুলিশকে বলা হয়েছে যে এরা আমাদের পরিচিত, হঠাত করেই এরকম আক্রমন করে। আজকে পুলিশ নিশ্চয় গুলি চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলবে।
আমার আশঙ্কা সঠিক প্রমান করে কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির।
তুলির মাকে শিখিয়ে দিয়েছি যে বেশি কথা না বলতে, যাতে আমার থেকে পুলিশ জানতে চায় যে আসল ঘটনাটা কি?
পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, যে ওরা জামিনের আবেদন করেছিলো, কিন্তু আমাদের উকিল তা বিরোধিতা করায় সেটা নাকচ হয়ে যায়। আপাতত গুলিচালনা, অবৈধ অস্ত্র রাখা, হামলা, খুনের চেষ্টা এসব কেস দেওয়া হয়েছে। ১৪ দিনের পুলিশ হেপাজতে থাকবে এখন।
আমি পুলিশকে যে গল্পটা দিলাম সেটা হোলো, এরা তুলিদের বাড়িতে ঘুর ঘুর করছে ওদের বাড়িটা প্রোমোটিং করবে বলে। তুলিরা রাজী না তাই শেষমেশ এই পথ অবলম্বন করেছে। পুলিশও মনে হয় খেলো ব্যাপারটা। ভালো করে জিজ্ঞাসা করলো আমাকে কিরকম দাম হতে পারে জমির কতটা জমি আছে এসব, শুনে নিজেরাই বলাবলি করলো এরকম একটা যায়গা হাতছারা হলে তো যে কেউই ক্ষেপে যাবে, কোটি কোটি টাকার লেনদেন হোত এই সম্পত্তিতে।
আমিও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে বললাম, আমি কে, কেন এবং কি পরিস্থিতিতে আমি গিয়ে পৌছেছি আর কি দেখেছি। তারপর কি কি হয়েছে। সুধু রনির গুলিটা যে অনিচ্ছাকৃত সেটা বাদ দিয়ে সব সত্যি বললাম। বুঝলাম আমার বয়ানটা খুব গুরুত্বপুর্ন পুলিশের কাছে।
হুমকির ব্যাপারটা বলতেই পুলিশ ওখানে একজন কনস্টেবল পোস্টিং করে দেবে জানিয়ে চলে গেলো।
শালা দুনিয়ায় এত ঘটনা ঘটছে, আর খবরের কাগজের লোকগুলো আর কোন খবর পেলো না? একটা পেপার কিনে নিয়ে পড়তে শুরু করতেই দেখি এককোনে তুলিদের বাড়িতে গুলি চালোনার ঘটনা ছাপিয়ে দিয়েছে। লিখেছে, নিকটাত্মিয়রা মধ্যবয়েসি মহিলার ওপরে প্রানঘাতি হামলা করেছে। ভুলভাল সব তথ্য কোথা থেকে পেলো কে জানে।
ঝর্নার চোখে চরম কৃতজ্ঞতা। আস্তে আস্তে ওর আতঙ্ক কাটছে।
আমিও তুলিকে ফোন করে ওর খোজ খবর নিলাম আর ওর মার খোঁজ খবর জানালাম। আমাকে বলছে যে কাল থেকে অফিসে যেতে, ও ওর বন্ধুদের নিয়ে থাকবে বিকেল পর্যন্ত।
আমার কবিরদার সাথে দেখা করা খুব দরকার, অনেক কথা বলতে হবে। কিন্তু এদের ফেলে কি করে যাই? এতটা সময় তুলি আর ওর বাবাকে রেখে যাওয়া মানে কোন বিপদ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। রনির লোকজন নিশ্চয় প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
বিকেল হয়ে এলো ৫টার সময়ই মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। হাল্কা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমি তুলি আর তুলির বাবাকে ওর মার কাছে রেখে বাইরে চা খেতে এলাম।
কিছুক্ষন পরে ফিরে গিয়ে দেখি রাজুস্যার এসেছে তুলির মাকে দেখতে। পেপারে পরে জানতে পেরেছে। মুখে একটা রুমাল চাপা দেওয়া। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলোধনা করছে।
তুলিকে রাজুস্যার বললো ওর মাকে প্রাইভেট হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সেখানে পরিবেশও ভালো, আর চিকিৎসাও ভালো হবে।
তুলি আমার মুখের দিকে একবার তাকালো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি যে তুলি নিজেও সেটাই চাইছে। তুলির ইতস্তত করছে দেখে রাজু প্রায় জোড়াজুড়ি শুরু করলো। তুলির বাবার কোন মন্তব্য নেই। অগত্যা আমিই বললাম যে এরকম পুলিশ কেসের ব্যাপার, পুলিশের আনাগোনা কি অন্য বেসরকারি হাসপাতালে মেনে নেবে?
আমার কথা প্রায় ফুতকারে উড়িয়ে দিলো ও। আমাকে বললো ‘ওসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি বুঝে নেবো।’
তুলিও এই রকম পরিবেশ থেকে মাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। আমি তুলির দিকে তাকিয়ে আমার মনোভাব বুঝিয়ে দিতে চাইলাম। বলতে চাইলাম দরকার হলে আমরা নিজেরা এসব করবো ওর এত নাক গলানোর কি দরকার। কিন্তু তুলি সেরকম একটা বোঝার চেষ্টা করলো না। হয়তো ও বুঝতে পারেনি আমার মন কি চাইছে।
রাজু এই সুজোগে বেশ হেক্কা নিয়েই বললো ‘কালকে সব ট্রান্সফার হয়ে যাবে, কোন চিন্তা করার কিছু নেই।’ আমার দিকে ঘুরে বললো ‘আপনার আপত্তি নেই তো?’
কি বলবো আমি? যে অন্য কেউ করলে আপত্তি ছিলো না, তুমি করছো বলেই আপত্তি, তোমার ধান্দা তো একটাই।
কি করবো যার জন্যে করছি, সেই যদি না বোঝে তো আমি আর কি করবো। ওকেও আর কি দোষ দেবো, মার ভালোবাসা তো ওকে অন্ধ করে রেখেছে। আর এরকম পরিবেশে কে থাকতে চায়।
‘না আপত্তি থাকবে কেন, এটা হলে তো ভালোই হয়, কিন্তু তার আগে তুলি আর তুলির বাবা আত্মিয়স্বজন মিলে বসে এটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, এই ভাবে দুম করে তো হয় না।’ আমি সময় কিনতে চাইছি যাতে তুলিকে ওর ধান্দাটা বোঝাতে পারি। রাগ উঠে যাচ্ছে তুলির বাবার ওপরে, এত ক্যালানে কি করে হয় মানুষ।
‘আরে উনারা তো এখানেই আছেন, আলোচনা যা করার এখানেই করে ফেললে, একদিন বাচানো যায়, আর এ আর এমন কি সিদ্ধান্ত যে গোলটেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বললো। যেন আমরা এই সহজ সিদ্ধান্ত নিতে কাঁপাকাপি করছি।
আমি তুলির দিকে তাকালাম, ও রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে। রাজু ওকে বিভিন্ন ব্যাপার স্যাপার বুঝিয়ে চলেছে যে এখানে রাখলে কি হোতে পারে না পারে।
আমি তুলিকে দেখে চলেছি। একবারের জন্যেও ও আমার মতামত জানতে চাইছেনা। এই কাজগুলো করার মধ্যে তো এমন কিছু কেতা নেওয়ার ব্যাপার নেই। আমারও সেই ক্ষমতা আছে, আমার কেন সবারই আছে। অথচ ও তুলির কাছে নিজেকে এমন ভাবে রিপ্রেজেন্ট করছে যে ও ওর ক্ষমতা প্রয়োগ করে সহজেই এসব করে দেবে।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম আমি তুলির জন্যে। তুলির মানসিক পরিস্থিতি আর ওর মার ওপর ওর অগাধ ভালোবাসার দরুন যে চিত্তদৌর্বল্যের সৃষ্টি হয়েছে ওর মধ্যে, তার পুর্ন সদব্যাবহার করে চলেছে রাজু। যা হাবভাব দেখাচ্ছে তাতে করে বোঝা যায় ও শুধু মাগিবাজই নয়, মানুষ হিসেবেও নিচু প্রকৃতির। আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি যে ও আমার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এইরকম পরিস্থিতিতে আমি তুলিকে না পারছি ডেকে আলাদা করে কথা বলতে, না পারছি উপযাচক উপকারির অপমান করতে। কি করে করবো, এখন যার সব থেকে শক্ত হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার কথা সেই নুঁইয়ে পরেছে। হ্যাঁ আমি তুলির বাবার কথা বলছি। কিসের গল্প করে এরা? এহাতে বোম ছুরেছি, পুলিশের মার খেয়েছি, ও হাতে পিস্তল চালিয়েছি, সেসব দিনগুলো কি কোটা বাঁধা ছিলো। এরকম পরিস্থিতিতেও কি ভিতরের পুরুষসিংহ জেগে ওঠেনা?
আমি আর সহ্য করতে না পেরে ওখান থেকে চলে এলাম। গেটের বাইরে এসে এক ভাঁর চা খেলাম। একটা সিগেরেট ধরালাম। ধোঁয়ার রিং ছেড়ে দেখছি, কত তাড়াতাড়ি সেগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফিরতে ফিরতে দেখলাম রাজু এখনো তুলির সাথে বকবক করে যাচ্ছে।
আমি তুলিকে ডাকলাম। রাজুও আসছিলো সঙ্গে সঙ্গে। আমি হেসে ওকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি তুলির সাথে একা কথা বলতে চাই।
‘তুমি কি বুঝতে পারছো ও কি করতে চাইছে?’
‘কে?’
‘এই তোমাদের রাজুস্যার?’
‘কেন তোমার সামনেই তো কথা হোলো।’
‘এগুলো কি আমরা করতে পারতাম না। আমাদের মা, আমরা কি খারাপ চাইতাম। ও যে ইচ্ছে করে নিজের ভাও বাড়াতে এসব করছে সেটা তুমি বুঝতে পারছো না?’
‘আরে ধুর তুমিও না একদম যা তা। হাসপাতালের রুগি দেখতে এসে কেউ এরকম ভাবে নাকি?’
‘ও তোমার জন্যে ওর দরদ উথলে পরলো যে? ওর কোম্পানির কত লোকের তো রোগভোগ হয়, ও কি দৌড়ে যায়?’
‘ওর এসব করে কি লাভ বলোতো? ও তো তোমাকে দেখছে। ও তো জানে যে আমার সাথে তোমার বিয়ে হবে।’
‘তুলি এই পরিস্থিতিতে আমি এসব কথা যদি তোমাকে বলতে হয় সেটা আমার কাছে নিজেকে চূড়ান্ত অপমান করা হবে।’
‘তুমি বড্ড বেশী চিন্তা করো।’ তুলির মুখটা কেমন যেন বিরক্তি ভরা লাগলো।
আমি হতাশ হয়ে তুলিকে একটা কথায় বলতে পারলাম ‘ভবিষ্যতে যেন এইদিনটার কথা আমাদের আর না মনে পরে।’
তুলির মাথার ওপর দিয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নিজেকে খুব ছোট মনে হোলো। এটা আমার কাছে নৈতিক পরাজয়।
আমি তুলিকে বললাম ‘ঠিক আছে তোমাদের মা, আমার তো কেউ না, তোমরা যা ভালো বুঝবে তাই করবে। এবার আমি বাড়ি যাবো দুদিন ধরে এখানে রয়েছি, আমারও মা আছে, সেও অসুস্থ।’
আমি হাঁটা শুরু করলাম ট্যাক্সি ধরবো বলে।
ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখলাম তুলি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখছে।