31-12-2018, 04:24 PM
মাকে নিয়ে পৌছুনোর আগেই আমি পৌছে গেলাম হাসপাতালে। কি হয়েছে মার?
মার কিছু হয়েছে ভাবতেই আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সিগেরেটের পর সিগেরেট ফুঁকে চলেছি। বুকের ইঞ্জিনের তাও খিদে মিটছেনা যেন।
এক এক মিনিট যেন এক এক ঘন্টা মনে হচ্ছে।
অবশেষে মাকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স এসে পৌছুলো। এতটা আমি ভাবতেও পারিনি। ও মা মাগো কি হয়েছে তোমার আমি মার গায়ে হাত দিয়ে নড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে কেঁদে দিলাম। বাবা হাল্কা ধমক দিয়ে আমাকে বলল ‘অভি তুই কিন্তু আর বাচ্চা ছেলে না।’
সাথে ডাক্তার কাকু আর রিতু বৌদি এসেছে। তাড়াতাড়ি এমার্জেন্সি হয়ে ICU তে নিয়ে গেলাম মাকে।
রিতু বৌদি আমাকে সব ঘটনা খুলে বলল, মার বাথরুমে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডাক্তার কাকু বলছে যে সেরিব্রাল এটাক এটা। উনিও এই হসপিটালের সাথে জড়িত। এখানে অনেক সুযোগ সুবিধে বলে দ্দ্বিধা না করে একেবারে এখানে নিয়ে এসেছেন।
আমি বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছি, রিতু বৌদি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে নানা রকম সান্তনা দিয়ে চলেছে। আমি তো শুনেছি এরকম হলে কেউ বেঁচে ফেরেনা। তাহলে কি মাও? ভগবান তুমি এটা কি করলে। কোন পাঁপের সাস্তি দিচ্ছো আমাকে।
একটু পরে বাবা নেমে এলো। মুখে কাল মেঘের ছায়া। আমাকে দেখে বললো ‘কত বয়েস হয়েছে তোর এইরকম বাচ্চাদের মত কাঁদছিস কেন?’
‘বাবা মা...’
‘ডাক্তার কাকু দেখছে সুতরাং আমি আর তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারি যে সঠিক চিকিৎসাই হবে।’
আমি একটু মনে জোর পেলাম। শিরদাঁড়া সোজা করে বসলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘পাড়ার থেকে কেউ এলো না।’
‘কে থাকে এই সময়, আমি সুবিরদের বাড়িতে ফোন করতে পেরেছি মাত্র। তাই রিতু এলো।’
আধঘন্টা পরে ডাক্তার কাকু নেমে এলেন ওপর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ চল একটু কফি খেয়ে আসি।’ মুখে সেরকম চাপ নেই।
আমরা উনাকে ফলো করে একটা ক্যাণ্টিনে এসে ঢুকলাম। বেশ ঝকঝকে। কফির অর্ডার দিয়ে কাকু আমাকে দেখে বললেন ‘এই চুলের স্টাইলটা কার মত করেছিস?’
আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম ‘কারো মত না এমনি এমনি এরকম’
তারপর বাবার দিকে ঘুরে বললেন ‘বৌদির কি এর আগে এরকম কোন প্রবলেম ছিলো? মানে কোলেস্টরেল বা সুগার?’
বাবা অপরাধির মত মাথা নিচু করে উত্তর দিলো ‘ধুর চেক করিয়েছি নাকি এর আগে?’
‘ভয় নেই ওষূধ কাজ করছে উনিও রেস্পন্স করছেন’ ডাক্তার কাকু আমাকে বললেন।
রিতু বউদি আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।
‘তোরা কেউ থেকে যা এখন, রাতে থাকতে হলে আমি জানিয়ে দেবো। তুই একবার যা মাকে দেখে আয় আপনিও যান না ওর সাথে দেখে আসুন, ভয় নেই আমার নাম বললে সিকিওরিটি আটকাবেনা। আর ভাবিস না যে তোরা চলে গেলে আমি তোর বাবাকে অনেক ভয় দেখানো গল্প বলবো।’ ডাক্তার কাকু মুচকি হেসে আমাকে আর রিতু বউদি কে বললেন।
মাকে এরকম দেখে আমি বেশ ঘাবড়েই গেলাম মুখে নাকে নল ঢোকানো, অজ্ঞান, চারিদিকে নানারকম মেশিন। কেউ প্রেসার দেখাচ্ছে, কোনটা পালস্* রেট দিচ্ছে। সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পরবে। আমি মার গায়ে একটু হাত দিলাম। মা চোখ খুলে তাকালো আমার দিকে, চিন্তে পারছে কি? তন্দ্রাচ্ছন্ন। আবার চোখ বুজে ফেললো। মেট্রন এসে বললেন, আপনারা আর থাকবেন না। নিচে অপেক্ষা করুন। এখানে ফোন করে জেনে নেবেন কি রকম আছেন উনি।
আমি তাও কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন দেখছেন উনাকে?’
‘ডাক্তার সেন তো দেখছেন, পেসেণ্ট তো সিরিয়াস। এখন এক এক দিন গেলে বোঝা যাবে যে কিরকম হচ্ছেন উনি। মাথার মধ্যে হেমাটোমা হয়েছে সেটা দেখা যাক কিভাবে ট্যাকল করা যায়।’
আমি বুঝতে পারলাম যে ডাক্তার কাকু যতটা হাল্কা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে ততটা হাল্কা নয় ব্যাপারটা।
নিচে নেমে দেখলাম বাবারও মুখ কালো। আচ্ছা আমি কি এতটাই ছোটো যে আমাকে বলা গেলোনা। আমার মার কি হয়েছে সেটা বলতে এত সঙ্কোচ কেন ডাক্তারের।
ডাক্তার কাকু আবার ওপরে চলে গেলেন।
আমি বাবাকে বললাম ‘মার তো হেমাটোমা আছে মাথায়’
বাবা চিন্তিত ভাবে বলল ‘হ্যাঁ সেটা নিয়েই তো আলোচনা করছিলাম, সেন দেখছে যে ওষূধ দিয়ে কমানো যায় নাকি, নাহলে অপারেট করতে হবে, সেটা খুব সেফ না।’
আমিও গভীর চিন্তাতে ডুবে গেলাম।
রিতু বউদি আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল ‘শোন কাকিমা ঠিক হয়ে যাবে, এরকম আজকাল আখছার হচ্ছে। ভাল ভালো চিকিৎসাও বেরিয়ে গেছে। ভগবানকে ডাক সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ভাগ্যিস তুমি ছিলে নাহলে ...।’
‘আর সবাই আসবে কি করে। পাড়ায় তো আরেক গন্ডোগোল হয়েছে। তুই পরে খোঁজ নিস, আগে মাসিমাকে দেখ।’
আমি ভুরূ কুচকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ কি হয়েছে?’
‘আরে আমাদের পাপ্পু সুইসাইড এটেম্পট করেছে। ঘুমের ওষূধ খেয়েছে একগাদা। ওকে পিজিতে নিয়ে গেছে।’
আমি শুনে ধপ করে বসে পরলাম হাটু মুরে। শালা সব একসাথে! মার এই অবস্থা। তুলির শরীর খারাপ তারপর পাপ্পুও যোগ হোল। এরপর বাবা, সুবিরদা আর রিতু বাকি আছে। এদেরও না কিছু হয়। কিযে অত্যাচার চলছে।
আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখছি।
রিতু আমাকে অনেক কথা বলে চলেছে নিজেকে শক্ত করতে, বাবার পাশে থাকতে, বাবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা, এইসময় আমি ভেঙ্গে পরলে উনি নিজেও শক্তি হারিয়ে ফেলবে। এই ধরনের নানা কথা।
আমি মন শক্ত করে ফেলেছি। জানি এই সময়টা দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে। হয়তো এইভাবেই মানুষের খারাপ সময় আসে। যে লড়তে পারে সে টিকে যায়, যে পারেনা সে ভেসে যায়। এতদিন মা বাবার ছত্রছায়ায় জীবনের দায়িত্ব বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি যে আমার অনেক কিছু করার আছে। অনেক দায়িত্ব আছে আমার। সেগুলো আমি নিজের থেকে চেয়ে নেবো সেটাই সবাই আশা করে। সত্যি আমার উচিৎ নিজে ভেঙ্গে না পরে বাবাকে সঠিক সঙ্গ দেওয়া। যাতে বাবা নিজে না ভেঙ্গে পরে। এখন মনে হচ্ছে বন্ধুরা থাকলে আমি অনেক জোর পেতাম। অনেক সময় লোকবলেরও দরকার হয়। রিতু বৌদি আমার অনেক কাছের, কিন্তু সে শুধু সান্তনায় দিতে পারে। আমি এখন স্বান্তনা চাইনা। আমি চাই শক্তি। কিন্তু মোদ্দা কথা এই মুহুর্তে যাকে আমি সবথেকে আপন করে নিয়েছিলাম সে আমার থেকে অনেক দূরে। হ্যাঁ তুলির কথা বলছি। আর একজন ছিলো, পাপ্পু। কিন্তু সেও হয়তো এরকম হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। মানুষ কেন এরকম করে। কতটা সাহস, বিতৃষ্ণা জাগলে পরে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। পাপ্পুর কি অনুতাপে এরকম করেছে না ভয়ে। জানিনা। কিন্তু মার এরকম হোলো কেন? সকালে তুলির মার কথায় কি মার মনে কোন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো। কেন মা আমাকে সরাসরি উত্তর দিলোনা। ওরকম কথা বলে এড়িয়ে গেলো? নিশ্চয় তুলির মা কিছু অভদ্রতা করেছিলো। নাহলে মায়ের মুখ কালো হয়ে গেল কেন? কোথার থেকে জানতে পারবো?
আমি রিতুকে বসতে বাবাকে খুজতে গেলাম। দেখলাম গম্ভির মুখে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছে। মন দিয়ে পেসেন্ট কল শুনছে। হয়তো ভাবছে মার কল আসবে। সত্যি যার হয় সেই বোঝে। আমি তো পরে, মা তো বাবার জীবন সাথি। একদিনের জন্যে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখিনি, বরঞ্চ সারাক্ষন খুনশুটি চলতো দুজনের মধ্যে। বাবাকে এরকম দেখে আমার মন উথালপাথাল করছে। বুকে একটা চাঁপা যন্ত্রনা দুমরে মুচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার সেই যোগ্যতা আছে কি?
বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। আস্তে করে বাবার হাতের তালুর উপর চাঁপ দিলাম, বোঝাতে চাইলাম আমি আছি বাবা। বাবা শুন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। এরকম তো দেখিনি লোকটাকে এর আগে। বাবা কি কাঁদছিলো। বাবাও তো পুরুষমানুষ। কাঁদতে লজ্জা পায়।
আমি বাবাকে বললাম ‘ তুমি বাড়ি যাও রিতুদিকে নিয়ে আমি এখানে আছি। রেস্ট নিয়ে এসে, সন্ধ্যেবেলাটা থেকো তারপর আমি আবার চলে আসবো।
‘তুই যা বরঞ্চ, আমি থাকি তুই রাতের বেলা এসে থাকিস। এখন যা অফিসে কাজ থাকলে মিটিয়ে দিয়ে কয়েকদিনের ছুটি চেয়ে নে, নাহলে বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নে। আবার সন্ধ্যে নাগাদ চলে আসিস।’
বাবা যেতে চাইছেনা বুঝতে পারছি। কিন্তু এরকম চিন্তার মধ্যে সারাক্ষন থাকলে তো বাবারও শরীর খারাপ হয়ে যাবে। পারবো আমি দুজনকে একা সামলাতে। আর আমার মনের জোর নেই নতুন করে কিছু দুঃসংবাদ গ্রহন করার মত। কিন্তু আমি জানি যে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তা পাল্টাবে না।
আমি তাও বললাম ‘আমি অফিসে ফোন করে দিয়েছি, যাওয়ার কোন ব্যাপার নেই। আমার কাজগুলো জুনিয়ররা করে দেবে। ম্যানেজারের সাথে কথা হয়ে গেছে।’
ততক্ষনে রিতুও এসে আমাদের সামনে দারিয়েছে। বাবা ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বললো ‘ দেখো ছেলে বড় হয়ে গেছে। তুমি একটু ওকে বুঝিয়ে নিয়ে যাও বাড়িতে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘তুই যা দেরি করিস না, ডাক্তার কাকু আছে যখন তখন এত চিন্তার কিছু নেই।’
ট্যাক্সি ধরে ফিরতে ফিরতে রিতুবউদি অনেক কথা বললো। মা বাথরুমে সেন্সলেস হয়ে পরেছিলো। বাবা ভেবেছিলো যে মা কাজে ব্যাস্ত। কাজের লোক এসে আবিষ্কার করে মাকে। তারপর বাবা বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে মাকে বের করে। মার ওই অবস্থার জন্যে সুবিরদার বাড়িতে ফোন করে রিতু বউদিকে বলে ক্লাবে খবর দিতে। সেই সময় যারা ছিলো সবাই পাপ্পুকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। মার খবরটা কাউকে দেওয়া যায়নি। রিতুবৌদি তাই নিজেই একা চলে আসে। মাকে ঠিক করে ড্রেস করিয়ে আম্বুলেন্সে তুলতে সাহায্য করে তারপর নিজে আসে।
‘এত ভাবিসনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা মনে রাখিস ভগবান যা করে তা সবার ভালোর জন্যেই করে। হরবংস রাই বচ্চনের একটা কবিতা আছে ‘মন কা হো তো আচ্ছা, মন কা না হো তো অউর ভি আচ্ছা।’ মানে তোর ইচ্ছে পূরণ হলে ভালো, না হলে আরো ভালো কারন উপরওয়ালার ইচ্ছে কাজ করছে, সেটা আরো ভালো কিছুর জন্যে। উনি তো আমাদের সবার ভালোই চান।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠলো রিতুবৌদির এই সমব্যাথিতায়। কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে সেটা আড়াল করলাম।
‘তুই দুপুরবেলা আমার এখানে খেয়ে যাস।’
‘আরে না না আমার সেরকম খিদে নেই এখন। তুমি আর কষ্ট কোরোনা।’
‘শোন এরকম করিস না। তোদের বাড়িতে কোন রান্না বান্না হয়নি। তুই খাবি কি? রক্ত মাংসের শরীর প্রচুর দুঃখেও এই শরীর তার সব কিছু চায়। ঘুমও পায়, খিদেও পায়। একে অবজ্ঞা করলে এ বিগরে যাবে। তাই যা হোক দুটো খেয়ে যাস। আমি জানি তোর মন ভালো নেই। তবুও শরীর আগে।’
‘ঠিক আছে আসছি কিন্তু বেশী কিছু কোরোনা।’
‘আরে আমি না মা করে রেখেছে। নিরামিষ রান্না। তুই তো নিরামিষ খেতে পছন্দ করিস।’
বাড়ির তালা খুলে ঢুকে শুন্য বাড়িতে বুকের মোচড়টা একদ ধাক্কায় গলায়। তারপর চোখের জলে পরিনত হোলো। মা। আমার মা, এই সংসারের সর্বময় কর্তি, হাসি আনন্দে সুখে যে আমাদের দুই পুরুষের মন জুগিয়ে চলতো, সংসারটাকে তেল মাখানো মেশিনের মত চালনা করতো, সে এখন চূড়ান্ত শারীরিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। কত ঝরঝঞ্ঝাট চলছে এই শরীরের ঊপর দিয়ে। যম একদিকে আর একদিকে আমাদের আশা।
আমি আর উপরে গেলাম না। যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চিতে মার উপস্থিতি সারাক্ষন, সেখানে মার অনুপস্থিতি আমি মানিয়ে নিতে পারছিনা। নিজের ঘরের সোফায় বসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। দমকে দমকে উঠছে শরীর। হাতের বাধন ভেদ করে আমার নোনা জল বেয়ে চলেছে গাল বেয়ে। হে ভগবান আমার মাকে ফিরিয়ে দাও। আর কিছু চাই না আমার তোমার থেকে। আর কোনদিন কিছু চাইবোনা।
স্নান করাই ছিলো আমার সকালে। আন্দাজ করে নিলাম রিতুবৌদির রেডি হতে কতক্ষন লাগতে পারে সেইমত হিসেব করে রিতু বৌদির বাড়িতে পৌছুলাম।
মাসিমা ঘুমিয়ে পরেছে। প্রেসারের ওষূধ খায় তাই ঘুম আটকাতে পারেন না।
আমি আর রিতু বৌদি খেতে বসলাম। আমি একটু খুটে ঘেটে রিতু বৌদির দিকে লজ্জিত ভাবে তাকিয়ে বললাম ‘প্লিজ কিছু মনে কোরো না, একদম খেতে ইচ্ছে করছেনা।’
‘আচ্ছা তুই যা ভিতরের ঘরে বস আমি আসছি।’
আমি গিয়ে ভিতরের ঘরে বসলাম। একটু পরে রিতু বউদি এসে ঢুকলো। একটা হাউসকোট পরে আছে। বেশ সোভার দেখতে হাউসকোটটা। বিদেশি যে বোঝা যায়।
‘তোর বৌয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’
আমি হা করে ওর দিকে তাকালাম।
‘না, জানি ঝগড়া না হলে ও ঠিক ওখানে আসতো।’
‘হ্যাঁ হাল্কাপুল্কা হয়েছে, কিন্তু সে জন্যে নয়, ওর শরীর খারাপ, এজমার টান উঠেছে।’
‘দ্যাখ অভি, আমি জানিনা আমার বলা উচিৎ হবে কিনা তোকে আমি নিজের মনে করি তাই বলছি, ওর মা কিন্তু খুব জাঁদরেল মহিলা।’
‘তুমি কি করে জানলে?’
‘সকালে আন্টিকে কি বলেছে তুই তো জানিস না...’
‘কি বলেছে? মাকেও দেখলাম মুখ কালো করে রেখেছে।’
রিতু বৌদি একটু চুপ করে থেকে বললো ‘অভি, ভালো মন্দ তুই আমার থেকে ভালো বুঝবি, তুই নিশ্চয় সব শুনে বুঝেই এগিয়েছিস। মেয়েটা ফুলের মত, কিন্তু ওর মার থেকে তুই সাবধানে থাকিস। আন্টির সাথে সকালে খুব খারাপ ভাবে কথা বলেছেন উনি।’
‘কি বলেছেন উনি?
‘আন্টি ফোন করে তুলির মাকে জিজ্ঞেস করছিলো যে তুলির শরীর কেমন আছে, তুইই বলেছিলি বোধহয়।’
‘হ্যাঁ আমিই বলেছিলাম।’
‘ওই মহিলা, সরি উনাকে এর থেকে ভালো নামে আমি ডাকতে পারবোনা। উনি বলেন যে আমার মেয়ে আমি বুঝবো আপনাদের নাক গলাতে হবেনা। এরকম কাজের সময় ফোন করবেন না তো।’
আমি থরথর কাঁপতে শুরু করলাম, রাগে, লজ্জায়, অসন্মানে।
‘তুই অফিসে চলে যাওয়ার পরে আন্টি মুখ কালো করে বসে ছিলো দেখে আঙ্কল খুব চাপাচাপি করে বের করেছে এই কথাটা। আম্বুলেন্সে আমাকে বলে এসব কথা। এই কথাটা আঙ্কলকে বলার পর থেকে টেনশানে পরে যায় যে তুই জানতে পারলে কি করবি। তুলির জন্যেও মন খারাপ করছিলো উনার, অনেক আশা নাকি আন্টির ওকে তোর বৌ হিসেবে দেখার।’
আমার রাগত প্রতিকৃয়া দেখে রিতু বৌদি বলে উঠলো ‘ অভি তুই কিন্তু উনাকে কিছু বলবি না, সবাই সবার ভুল বুঝতে পারে ঠিক সময়ে, কারো সময় লাগে বুঝতে, কেউ চট করে বুঝে যায়, তোকে কিন্তু সময় দিতে হবে উনাকে, তার আগে তুই কোন ভুল করিস না। তাহলে তোর আর উনার মধ্যে কোন তফাৎ থাকবেনা। প্লিজ অভি।
আমি নিজের মনে মনেই কালিপুজোর দিন ঘটে যাওয়া সব কথা বলতে শুরু করলাম রুবি বৌদিকে। এমন কি দুপুর বেলার ঘটনাও। সেদিন রাতে তুলির ওই আচরনের কথা বলতে গিয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম। আমার অভিব্যক্তিতে, রুবি বৌদি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মাথাটা ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। শরীর মন জুরিয়ে যাচ্ছে আমার। মনের সমস্ত ক্ষতে যেন স্নেহের প্রলেপ পরে সেগুলোর যন্ত্রনা কম বোধ হচ্ছে। এরকম ভাবে এক নাড়ি হয়তো, নিজের সন্তানকেই আগলে ধরতে পারে। নাড়ির কত ভুমিকা একটা পুরুষমানুষের জীবনে। একমাত্র নিজের মায়ের কাছেই পাওয়া যেতে পারে এই আশ্রয়।
কিন্তু জানিনা মৃদু মন্দ বাতাস কিভাবে প্রচন্ড ঝরে পরিনত হোলো। ঝরের দাপটে কিভাবে বয়ে গেলাম জানিনা। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন দেখলাম রিতু বৌদির উলঙ্গ দেহটা আমার শরীরের নিচে ঘুমিয়ে আছে।
ছিঃ এ কি ভুল করলাম আমি। কি ভাবে সম্ভব হোলো। যৌনতা কি সম্পর্কের বাঁধা মানে না। আমি মানুষ থেকে কুকুরে পরিনত হোলাম। যার বাহুবন্ধনে নিজেকে মনে হচ্ছিলো যে মাতৃক্রোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আছি তার শরীর কি করে ভোগ করলাম। এতো ভাদ্র মাসের কুকুরের থেকে অধম কাজ। ছিঃ। যার মা কিনা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। যার বাবা উৎকন্ঠা নিয়ে হাসপাতালে বসে আছে এই বোধ হয় কোনো চরম দুঃসংবাদ ভেসে এলো ঘোষিকার কন্ঠে, সে এখানে আদিম সুখে মত্ত। আর কত ভুল করবো। এই সুন্দর সম্পর্কটারও হত্যা হোল।
মার কিছু হয়েছে ভাবতেই আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সিগেরেটের পর সিগেরেট ফুঁকে চলেছি। বুকের ইঞ্জিনের তাও খিদে মিটছেনা যেন।
এক এক মিনিট যেন এক এক ঘন্টা মনে হচ্ছে।
অবশেষে মাকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স এসে পৌছুলো। এতটা আমি ভাবতেও পারিনি। ও মা মাগো কি হয়েছে তোমার আমি মার গায়ে হাত দিয়ে নড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে কেঁদে দিলাম। বাবা হাল্কা ধমক দিয়ে আমাকে বলল ‘অভি তুই কিন্তু আর বাচ্চা ছেলে না।’
সাথে ডাক্তার কাকু আর রিতু বৌদি এসেছে। তাড়াতাড়ি এমার্জেন্সি হয়ে ICU তে নিয়ে গেলাম মাকে।
রিতু বৌদি আমাকে সব ঘটনা খুলে বলল, মার বাথরুমে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডাক্তার কাকু বলছে যে সেরিব্রাল এটাক এটা। উনিও এই হসপিটালের সাথে জড়িত। এখানে অনেক সুযোগ সুবিধে বলে দ্দ্বিধা না করে একেবারে এখানে নিয়ে এসেছেন।
আমি বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছি, রিতু বৌদি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে নানা রকম সান্তনা দিয়ে চলেছে। আমি তো শুনেছি এরকম হলে কেউ বেঁচে ফেরেনা। তাহলে কি মাও? ভগবান তুমি এটা কি করলে। কোন পাঁপের সাস্তি দিচ্ছো আমাকে।
একটু পরে বাবা নেমে এলো। মুখে কাল মেঘের ছায়া। আমাকে দেখে বললো ‘কত বয়েস হয়েছে তোর এইরকম বাচ্চাদের মত কাঁদছিস কেন?’
‘বাবা মা...’
‘ডাক্তার কাকু দেখছে সুতরাং আমি আর তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারি যে সঠিক চিকিৎসাই হবে।’
আমি একটু মনে জোর পেলাম। শিরদাঁড়া সোজা করে বসলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘পাড়ার থেকে কেউ এলো না।’
‘কে থাকে এই সময়, আমি সুবিরদের বাড়িতে ফোন করতে পেরেছি মাত্র। তাই রিতু এলো।’
আধঘন্টা পরে ডাক্তার কাকু নেমে এলেন ওপর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ চল একটু কফি খেয়ে আসি।’ মুখে সেরকম চাপ নেই।
আমরা উনাকে ফলো করে একটা ক্যাণ্টিনে এসে ঢুকলাম। বেশ ঝকঝকে। কফির অর্ডার দিয়ে কাকু আমাকে দেখে বললেন ‘এই চুলের স্টাইলটা কার মত করেছিস?’
আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম ‘কারো মত না এমনি এমনি এরকম’
তারপর বাবার দিকে ঘুরে বললেন ‘বৌদির কি এর আগে এরকম কোন প্রবলেম ছিলো? মানে কোলেস্টরেল বা সুগার?’
বাবা অপরাধির মত মাথা নিচু করে উত্তর দিলো ‘ধুর চেক করিয়েছি নাকি এর আগে?’
‘ভয় নেই ওষূধ কাজ করছে উনিও রেস্পন্স করছেন’ ডাক্তার কাকু আমাকে বললেন।
রিতু বউদি আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।
‘তোরা কেউ থেকে যা এখন, রাতে থাকতে হলে আমি জানিয়ে দেবো। তুই একবার যা মাকে দেখে আয় আপনিও যান না ওর সাথে দেখে আসুন, ভয় নেই আমার নাম বললে সিকিওরিটি আটকাবেনা। আর ভাবিস না যে তোরা চলে গেলে আমি তোর বাবাকে অনেক ভয় দেখানো গল্প বলবো।’ ডাক্তার কাকু মুচকি হেসে আমাকে আর রিতু বউদি কে বললেন।
মাকে এরকম দেখে আমি বেশ ঘাবড়েই গেলাম মুখে নাকে নল ঢোকানো, অজ্ঞান, চারিদিকে নানারকম মেশিন। কেউ প্রেসার দেখাচ্ছে, কোনটা পালস্* রেট দিচ্ছে। সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পরবে। আমি মার গায়ে একটু হাত দিলাম। মা চোখ খুলে তাকালো আমার দিকে, চিন্তে পারছে কি? তন্দ্রাচ্ছন্ন। আবার চোখ বুজে ফেললো। মেট্রন এসে বললেন, আপনারা আর থাকবেন না। নিচে অপেক্ষা করুন। এখানে ফোন করে জেনে নেবেন কি রকম আছেন উনি।
আমি তাও কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন দেখছেন উনাকে?’
‘ডাক্তার সেন তো দেখছেন, পেসেণ্ট তো সিরিয়াস। এখন এক এক দিন গেলে বোঝা যাবে যে কিরকম হচ্ছেন উনি। মাথার মধ্যে হেমাটোমা হয়েছে সেটা দেখা যাক কিভাবে ট্যাকল করা যায়।’
আমি বুঝতে পারলাম যে ডাক্তার কাকু যতটা হাল্কা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে ততটা হাল্কা নয় ব্যাপারটা।
নিচে নেমে দেখলাম বাবারও মুখ কালো। আচ্ছা আমি কি এতটাই ছোটো যে আমাকে বলা গেলোনা। আমার মার কি হয়েছে সেটা বলতে এত সঙ্কোচ কেন ডাক্তারের।
ডাক্তার কাকু আবার ওপরে চলে গেলেন।
আমি বাবাকে বললাম ‘মার তো হেমাটোমা আছে মাথায়’
বাবা চিন্তিত ভাবে বলল ‘হ্যাঁ সেটা নিয়েই তো আলোচনা করছিলাম, সেন দেখছে যে ওষূধ দিয়ে কমানো যায় নাকি, নাহলে অপারেট করতে হবে, সেটা খুব সেফ না।’
আমিও গভীর চিন্তাতে ডুবে গেলাম।
রিতু বউদি আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল ‘শোন কাকিমা ঠিক হয়ে যাবে, এরকম আজকাল আখছার হচ্ছে। ভাল ভালো চিকিৎসাও বেরিয়ে গেছে। ভগবানকে ডাক সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ভাগ্যিস তুমি ছিলে নাহলে ...।’
‘আর সবাই আসবে কি করে। পাড়ায় তো আরেক গন্ডোগোল হয়েছে। তুই পরে খোঁজ নিস, আগে মাসিমাকে দেখ।’
আমি ভুরূ কুচকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ কি হয়েছে?’
‘আরে আমাদের পাপ্পু সুইসাইড এটেম্পট করেছে। ঘুমের ওষূধ খেয়েছে একগাদা। ওকে পিজিতে নিয়ে গেছে।’
আমি শুনে ধপ করে বসে পরলাম হাটু মুরে। শালা সব একসাথে! মার এই অবস্থা। তুলির শরীর খারাপ তারপর পাপ্পুও যোগ হোল। এরপর বাবা, সুবিরদা আর রিতু বাকি আছে। এদেরও না কিছু হয়। কিযে অত্যাচার চলছে।
আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখছি।
রিতু আমাকে অনেক কথা বলে চলেছে নিজেকে শক্ত করতে, বাবার পাশে থাকতে, বাবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা, এইসময় আমি ভেঙ্গে পরলে উনি নিজেও শক্তি হারিয়ে ফেলবে। এই ধরনের নানা কথা।
আমি মন শক্ত করে ফেলেছি। জানি এই সময়টা দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে। হয়তো এইভাবেই মানুষের খারাপ সময় আসে। যে লড়তে পারে সে টিকে যায়, যে পারেনা সে ভেসে যায়। এতদিন মা বাবার ছত্রছায়ায় জীবনের দায়িত্ব বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি যে আমার অনেক কিছু করার আছে। অনেক দায়িত্ব আছে আমার। সেগুলো আমি নিজের থেকে চেয়ে নেবো সেটাই সবাই আশা করে। সত্যি আমার উচিৎ নিজে ভেঙ্গে না পরে বাবাকে সঠিক সঙ্গ দেওয়া। যাতে বাবা নিজে না ভেঙ্গে পরে। এখন মনে হচ্ছে বন্ধুরা থাকলে আমি অনেক জোর পেতাম। অনেক সময় লোকবলেরও দরকার হয়। রিতু বৌদি আমার অনেক কাছের, কিন্তু সে শুধু সান্তনায় দিতে পারে। আমি এখন স্বান্তনা চাইনা। আমি চাই শক্তি। কিন্তু মোদ্দা কথা এই মুহুর্তে যাকে আমি সবথেকে আপন করে নিয়েছিলাম সে আমার থেকে অনেক দূরে। হ্যাঁ তুলির কথা বলছি। আর একজন ছিলো, পাপ্পু। কিন্তু সেও হয়তো এরকম হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। মানুষ কেন এরকম করে। কতটা সাহস, বিতৃষ্ণা জাগলে পরে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। পাপ্পুর কি অনুতাপে এরকম করেছে না ভয়ে। জানিনা। কিন্তু মার এরকম হোলো কেন? সকালে তুলির মার কথায় কি মার মনে কোন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো। কেন মা আমাকে সরাসরি উত্তর দিলোনা। ওরকম কথা বলে এড়িয়ে গেলো? নিশ্চয় তুলির মা কিছু অভদ্রতা করেছিলো। নাহলে মায়ের মুখ কালো হয়ে গেল কেন? কোথার থেকে জানতে পারবো?
আমি রিতুকে বসতে বাবাকে খুজতে গেলাম। দেখলাম গম্ভির মুখে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছে। মন দিয়ে পেসেন্ট কল শুনছে। হয়তো ভাবছে মার কল আসবে। সত্যি যার হয় সেই বোঝে। আমি তো পরে, মা তো বাবার জীবন সাথি। একদিনের জন্যে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখিনি, বরঞ্চ সারাক্ষন খুনশুটি চলতো দুজনের মধ্যে। বাবাকে এরকম দেখে আমার মন উথালপাথাল করছে। বুকে একটা চাঁপা যন্ত্রনা দুমরে মুচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার সেই যোগ্যতা আছে কি?
বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। আস্তে করে বাবার হাতের তালুর উপর চাঁপ দিলাম, বোঝাতে চাইলাম আমি আছি বাবা। বাবা শুন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। এরকম তো দেখিনি লোকটাকে এর আগে। বাবা কি কাঁদছিলো। বাবাও তো পুরুষমানুষ। কাঁদতে লজ্জা পায়।
আমি বাবাকে বললাম ‘ তুমি বাড়ি যাও রিতুদিকে নিয়ে আমি এখানে আছি। রেস্ট নিয়ে এসে, সন্ধ্যেবেলাটা থেকো তারপর আমি আবার চলে আসবো।
‘তুই যা বরঞ্চ, আমি থাকি তুই রাতের বেলা এসে থাকিস। এখন যা অফিসে কাজ থাকলে মিটিয়ে দিয়ে কয়েকদিনের ছুটি চেয়ে নে, নাহলে বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নে। আবার সন্ধ্যে নাগাদ চলে আসিস।’
বাবা যেতে চাইছেনা বুঝতে পারছি। কিন্তু এরকম চিন্তার মধ্যে সারাক্ষন থাকলে তো বাবারও শরীর খারাপ হয়ে যাবে। পারবো আমি দুজনকে একা সামলাতে। আর আমার মনের জোর নেই নতুন করে কিছু দুঃসংবাদ গ্রহন করার মত। কিন্তু আমি জানি যে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তা পাল্টাবে না।
আমি তাও বললাম ‘আমি অফিসে ফোন করে দিয়েছি, যাওয়ার কোন ব্যাপার নেই। আমার কাজগুলো জুনিয়ররা করে দেবে। ম্যানেজারের সাথে কথা হয়ে গেছে।’
ততক্ষনে রিতুও এসে আমাদের সামনে দারিয়েছে। বাবা ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বললো ‘ দেখো ছেলে বড় হয়ে গেছে। তুমি একটু ওকে বুঝিয়ে নিয়ে যাও বাড়িতে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘তুই যা দেরি করিস না, ডাক্তার কাকু আছে যখন তখন এত চিন্তার কিছু নেই।’
ট্যাক্সি ধরে ফিরতে ফিরতে রিতুবউদি অনেক কথা বললো। মা বাথরুমে সেন্সলেস হয়ে পরেছিলো। বাবা ভেবেছিলো যে মা কাজে ব্যাস্ত। কাজের লোক এসে আবিষ্কার করে মাকে। তারপর বাবা বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে মাকে বের করে। মার ওই অবস্থার জন্যে সুবিরদার বাড়িতে ফোন করে রিতু বউদিকে বলে ক্লাবে খবর দিতে। সেই সময় যারা ছিলো সবাই পাপ্পুকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। মার খবরটা কাউকে দেওয়া যায়নি। রিতুবৌদি তাই নিজেই একা চলে আসে। মাকে ঠিক করে ড্রেস করিয়ে আম্বুলেন্সে তুলতে সাহায্য করে তারপর নিজে আসে।
‘এত ভাবিসনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা মনে রাখিস ভগবান যা করে তা সবার ভালোর জন্যেই করে। হরবংস রাই বচ্চনের একটা কবিতা আছে ‘মন কা হো তো আচ্ছা, মন কা না হো তো অউর ভি আচ্ছা।’ মানে তোর ইচ্ছে পূরণ হলে ভালো, না হলে আরো ভালো কারন উপরওয়ালার ইচ্ছে কাজ করছে, সেটা আরো ভালো কিছুর জন্যে। উনি তো আমাদের সবার ভালোই চান।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠলো রিতুবৌদির এই সমব্যাথিতায়। কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে সেটা আড়াল করলাম।
‘তুই দুপুরবেলা আমার এখানে খেয়ে যাস।’
‘আরে না না আমার সেরকম খিদে নেই এখন। তুমি আর কষ্ট কোরোনা।’
‘শোন এরকম করিস না। তোদের বাড়িতে কোন রান্না বান্না হয়নি। তুই খাবি কি? রক্ত মাংসের শরীর প্রচুর দুঃখেও এই শরীর তার সব কিছু চায়। ঘুমও পায়, খিদেও পায়। একে অবজ্ঞা করলে এ বিগরে যাবে। তাই যা হোক দুটো খেয়ে যাস। আমি জানি তোর মন ভালো নেই। তবুও শরীর আগে।’
‘ঠিক আছে আসছি কিন্তু বেশী কিছু কোরোনা।’
‘আরে আমি না মা করে রেখেছে। নিরামিষ রান্না। তুই তো নিরামিষ খেতে পছন্দ করিস।’
বাড়ির তালা খুলে ঢুকে শুন্য বাড়িতে বুকের মোচড়টা একদ ধাক্কায় গলায়। তারপর চোখের জলে পরিনত হোলো। মা। আমার মা, এই সংসারের সর্বময় কর্তি, হাসি আনন্দে সুখে যে আমাদের দুই পুরুষের মন জুগিয়ে চলতো, সংসারটাকে তেল মাখানো মেশিনের মত চালনা করতো, সে এখন চূড়ান্ত শারীরিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। কত ঝরঝঞ্ঝাট চলছে এই শরীরের ঊপর দিয়ে। যম একদিকে আর একদিকে আমাদের আশা।
আমি আর উপরে গেলাম না। যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চিতে মার উপস্থিতি সারাক্ষন, সেখানে মার অনুপস্থিতি আমি মানিয়ে নিতে পারছিনা। নিজের ঘরের সোফায় বসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। দমকে দমকে উঠছে শরীর। হাতের বাধন ভেদ করে আমার নোনা জল বেয়ে চলেছে গাল বেয়ে। হে ভগবান আমার মাকে ফিরিয়ে দাও। আর কিছু চাই না আমার তোমার থেকে। আর কোনদিন কিছু চাইবোনা।
স্নান করাই ছিলো আমার সকালে। আন্দাজ করে নিলাম রিতুবৌদির রেডি হতে কতক্ষন লাগতে পারে সেইমত হিসেব করে রিতু বৌদির বাড়িতে পৌছুলাম।
মাসিমা ঘুমিয়ে পরেছে। প্রেসারের ওষূধ খায় তাই ঘুম আটকাতে পারেন না।
আমি আর রিতু বৌদি খেতে বসলাম। আমি একটু খুটে ঘেটে রিতু বৌদির দিকে লজ্জিত ভাবে তাকিয়ে বললাম ‘প্লিজ কিছু মনে কোরো না, একদম খেতে ইচ্ছে করছেনা।’
‘আচ্ছা তুই যা ভিতরের ঘরে বস আমি আসছি।’
আমি গিয়ে ভিতরের ঘরে বসলাম। একটু পরে রিতু বউদি এসে ঢুকলো। একটা হাউসকোট পরে আছে। বেশ সোভার দেখতে হাউসকোটটা। বিদেশি যে বোঝা যায়।
‘তোর বৌয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’
আমি হা করে ওর দিকে তাকালাম।
‘না, জানি ঝগড়া না হলে ও ঠিক ওখানে আসতো।’
‘হ্যাঁ হাল্কাপুল্কা হয়েছে, কিন্তু সে জন্যে নয়, ওর শরীর খারাপ, এজমার টান উঠেছে।’
‘দ্যাখ অভি, আমি জানিনা আমার বলা উচিৎ হবে কিনা তোকে আমি নিজের মনে করি তাই বলছি, ওর মা কিন্তু খুব জাঁদরেল মহিলা।’
‘তুমি কি করে জানলে?’
‘সকালে আন্টিকে কি বলেছে তুই তো জানিস না...’
‘কি বলেছে? মাকেও দেখলাম মুখ কালো করে রেখেছে।’
রিতু বৌদি একটু চুপ করে থেকে বললো ‘অভি, ভালো মন্দ তুই আমার থেকে ভালো বুঝবি, তুই নিশ্চয় সব শুনে বুঝেই এগিয়েছিস। মেয়েটা ফুলের মত, কিন্তু ওর মার থেকে তুই সাবধানে থাকিস। আন্টির সাথে সকালে খুব খারাপ ভাবে কথা বলেছেন উনি।’
‘কি বলেছেন উনি?
‘আন্টি ফোন করে তুলির মাকে জিজ্ঞেস করছিলো যে তুলির শরীর কেমন আছে, তুইই বলেছিলি বোধহয়।’
‘হ্যাঁ আমিই বলেছিলাম।’
‘ওই মহিলা, সরি উনাকে এর থেকে ভালো নামে আমি ডাকতে পারবোনা। উনি বলেন যে আমার মেয়ে আমি বুঝবো আপনাদের নাক গলাতে হবেনা। এরকম কাজের সময় ফোন করবেন না তো।’
আমি থরথর কাঁপতে শুরু করলাম, রাগে, লজ্জায়, অসন্মানে।
‘তুই অফিসে চলে যাওয়ার পরে আন্টি মুখ কালো করে বসে ছিলো দেখে আঙ্কল খুব চাপাচাপি করে বের করেছে এই কথাটা। আম্বুলেন্সে আমাকে বলে এসব কথা। এই কথাটা আঙ্কলকে বলার পর থেকে টেনশানে পরে যায় যে তুই জানতে পারলে কি করবি। তুলির জন্যেও মন খারাপ করছিলো উনার, অনেক আশা নাকি আন্টির ওকে তোর বৌ হিসেবে দেখার।’
আমার রাগত প্রতিকৃয়া দেখে রিতু বৌদি বলে উঠলো ‘ অভি তুই কিন্তু উনাকে কিছু বলবি না, সবাই সবার ভুল বুঝতে পারে ঠিক সময়ে, কারো সময় লাগে বুঝতে, কেউ চট করে বুঝে যায়, তোকে কিন্তু সময় দিতে হবে উনাকে, তার আগে তুই কোন ভুল করিস না। তাহলে তোর আর উনার মধ্যে কোন তফাৎ থাকবেনা। প্লিজ অভি।
আমি নিজের মনে মনেই কালিপুজোর দিন ঘটে যাওয়া সব কথা বলতে শুরু করলাম রুবি বৌদিকে। এমন কি দুপুর বেলার ঘটনাও। সেদিন রাতে তুলির ওই আচরনের কথা বলতে গিয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম। আমার অভিব্যক্তিতে, রুবি বৌদি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মাথাটা ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। শরীর মন জুরিয়ে যাচ্ছে আমার। মনের সমস্ত ক্ষতে যেন স্নেহের প্রলেপ পরে সেগুলোর যন্ত্রনা কম বোধ হচ্ছে। এরকম ভাবে এক নাড়ি হয়তো, নিজের সন্তানকেই আগলে ধরতে পারে। নাড়ির কত ভুমিকা একটা পুরুষমানুষের জীবনে। একমাত্র নিজের মায়ের কাছেই পাওয়া যেতে পারে এই আশ্রয়।
কিন্তু জানিনা মৃদু মন্দ বাতাস কিভাবে প্রচন্ড ঝরে পরিনত হোলো। ঝরের দাপটে কিভাবে বয়ে গেলাম জানিনা। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন দেখলাম রিতু বৌদির উলঙ্গ দেহটা আমার শরীরের নিচে ঘুমিয়ে আছে।
ছিঃ এ কি ভুল করলাম আমি। কি ভাবে সম্ভব হোলো। যৌনতা কি সম্পর্কের বাঁধা মানে না। আমি মানুষ থেকে কুকুরে পরিনত হোলাম। যার বাহুবন্ধনে নিজেকে মনে হচ্ছিলো যে মাতৃক্রোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আছি তার শরীর কি করে ভোগ করলাম। এতো ভাদ্র মাসের কুকুরের থেকে অধম কাজ। ছিঃ। যার মা কিনা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। যার বাবা উৎকন্ঠা নিয়ে হাসপাতালে বসে আছে এই বোধ হয় কোনো চরম দুঃসংবাদ ভেসে এলো ঘোষিকার কন্ঠে, সে এখানে আদিম সুখে মত্ত। আর কত ভুল করবো। এই সুন্দর সম্পর্কটারও হত্যা হোল।