06-03-2025, 01:26 PM
অন্ধকার ছায়া
পশ্চিমবঙ্গের এক ছোট গ্রাম। সময়টা সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই, চারপাশে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে। সরু, ধুলোমাখা রাস্তার একপাশে একটি পুরনো, জরাজীর্ণ বাড়ি। ইটের দেওয়াল থেকে কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে, বারান্দার বাঁশের ফ্রেম নড়বড়ে হয়ে আছে। উঠোনে আগাছা জন্মেছে, আর সামনের গেটটি মরচে ধরা, যেন বহুদিন তাতে কোনো তেল দেওয়া হয়নি।
এখানেই থাকে রামপ্রসাদ, তার স্ত্রী কল্পনা, আর তাদের একমাত্র ছেলে সুমন।
রামপ্রসাদ—একজন পরিশ্রমী মানুষ। সকাল ৭টায় বেরিয়ে যান অটো নিয়ে, কখনো ফেরেন রাত ১০টায়, কখনো ১২টা বাজিয়ে দেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, যাতে সংসার চলে। তবে পরিশ্রম করলেও অর্থের টান চিরকালীন। অভাব যেন তার পিছু ছাড়ে না। কিন্তু এই অভাবের মধ্যেও তার একটা গর্ব আছে—তার স্ত্রী।
কল্পনা—গায়ের রং গমের মতো, চেহারায় একটা স্বর্গীয় মায়াবী সৌন্দর্য। তার মুখে সবসময় একটা শান্ত ভাব লেগে থাকে, যেন হাজার কষ্টের মাঝেও সে স্থির। কপালে সিঁদুর, পরনে সাধারণ শাড়ি, কিন্তু তার শরীরের ভাঁজগুলো যেন শাড়ির গাম্ভীর্যকে ভেদ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। কল্পনা অত্যন্ত ধার্মিক। নিয়ম করে সকালে গঙ্গাজল ছিটিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করে, প্রতিদিন ঠাকুরঘরে ঘণ্টার শব্দ তুলে পুজো দেয়। সে যেন এই সংসারের একমাত্র পবিত্র আলো, যে দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে রাখে।
কিন্তু তাদের ছেলে সুমন সম্পূর্ণ বিপরীত। বয়স ১৯, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তবে লেখাপড়ার প্রতি কোনো টান নেই। তার বন্ধুদের দল খারাপ, নেশা করে না ঠিকই, কিন্তু সস্তা চটি বই পড়ে, রাতে লুকিয়ে ফোনে নিষিদ্ধ জিনিস দেখে। বাবার মতো কষ্ট করে জীবনে কিছু করার আগ্রহ তার নেই, বরং শরীরী সুখের প্রতি তার দুর্বলতা প্রবল।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ২)
রোদ তখন ম্লান হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। গ্রামের রাস্তার ধুলো মিশে আছে গরম বাতাসের সাথে। রামপ্রসাদ তখনও ফেরেনি, আর সুমন কলেজ থেকে ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। কল্পনা একটু বাজার করতে বেরিয়েছে।
সাদা-নীল পাড়ের একটা সাধারণ শাড়ি পরে সে গলির মোড়ে একটা গোলদারি দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানটা খুবই পুরনো, কাঠের তাক ভর্তি বিভিন্ন জিনিস—গুঁড়ো মশলা, বিস্কুটের টিন, তেল, সাবান, আলতা, সিঁদুর। এক কোণে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা ঝুলছে।
“একটা নারকেল তেল আর ধনেপাতা দিন কাকু,” কল্পনা ভেতরে হাত বাড়িয়ে দোকানদারকে বলল।
ঠিক তখনই রাস্তায় একটা কালো Fortuner গাড়ি এসে থামল। গাড়ির সামনে ছোট্ট একটা জাতীয় পতাকা লাগানো, বোঝাই যাচ্ছে, কোনো ক্ষমতাবান লোকের গাড়ি।
গাড়ির জানালা নামতেই রশিদ খান-এর মুখ দেখা গেল।
সাধারণ কুর্তা-পাজামা, কালো চশমা, কানে হীরের টপ, আর হাতে দামি সোনার ব্রেসলেট। গায়ের রঙ চাপা, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হিংস্রতা। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু তার শরীরের গঠন এখনো শক্তপোক্ত। চোখ দুটো এমনভাবে কল্পনার দিকে আটকে গেল, যেন সে পুরো শরীরের প্রতিটা ভাঁজ গিলে খাচ্ছে চোখ দিয়েই।
কল্পনা একবার তাকিয়ে আবার দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। তার মন কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠল। কিন্তু রশিদ খান নিজের নীচু স্বভাবের পরিচয় দেয়ার জন্য কোনো তাড়াহুড়ো করে না—সে জানে, ধৈর্য ধরতে হয়, সময় নিয়ে শিকার ধরতে হয়।
সে চোখ সরিয়ে নিলো না, বরং নিজের গাড়ির সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,
“এই গ্রামেও দেখি এমন মাল আছে!”
গাড়ির মধ্যে থাকা দুজন লোক—তার দলবাজ গুন্ডারা—সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল।
দোকানদার মুহূর্তেই মুখ শুকিয়ে ফেলল, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু-একজন লোকও দ্রুত নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল, যেন কিছু শোনেনি। এই গ্রামে MLA রশিদ খানের নাম ভয়াবহ এক আতঙ্ক। সে যা চায়, তা পায়—যদি না পায়, জোর করে নেয়। পুলিশের কাছেও তার ব্যাপারে অভিযোগ করা মানে নিজেই বিপদ ডেকে আনা।
কল্পনা দ্রুত টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে হাঁটা দিলো। পেছনে তাকানোর সাহস হলো না, কিন্তু সে অনুভব করছিল, সেই চোখ দুটি আজও তাকে অনুসরণ করছে।
গাড়ির ভেতরে বসে রশিদ খান ঠোঁট চাটল।
“বউটা আমার চাই। সময় লাগুক, কিন্তু পাবই।”
তারপর গাড়ির জানালা বন্ধ হয়ে গেল, গাড়িটি আবার গর্জন করে এগিয়ে গেল রাস্তার ধুলো উড়িয়ে।
কল্পনা দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো, কিন্তু কেমন যেন একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করছিল। পায়ের নিচে মাটি নরম হয়ে আসছিল। কেউ যেন তার সুখের ছোট্ট সংসারটাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে, আর ধীরে ধীরে একটা বিষাক্ত ছায়া ঢুকে পড়ছে তার জীবনে।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩)
বাড়িতে ফিরে কল্পনার মন ভালো লাগছিল না। রান্নার উপকরণগুলো বারান্দার এক পাশে রেখে সে ঘরের ভেতরে গেল। ঠাকুরের সামনে গিয়ে হাত জোড় করল।
“ভগবান, কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছে! কিসের যেন একটা ভয় করছে। তুমি আমার পরিবারকে রক্ষা করো…”
সে চোখ বন্ধ করেই বসে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু মনের অস্থিরতা কমল না। বুকের ভেতর কোথাও যেন ধুকপুকানি চলছিল।
ঠিক তখনই বাইরে গেটের কাছে একটা আওয়াজ হল। কল্পনা চমকে উঠল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এত রাতে কে?
“সুমন!” ডাক দিলো সে, ছেলেকে খুঁজে পেতে। কিন্তু কোনো উত্তর এল না।
গেটের দিক থেকে এবার একটু মোটা গলার আওয়াজ শোনা গেল।
“কল্পনাদি, আছেন?”
গলার স্বর শুনেই চিনতে পারল, পাশের গ্রামের হোটেল মালিক হরিহর ঘোষ। বেশ ভালো মানুষ, কল্পনার স্বামীর সাথেও ভালো সম্পর্ক।
কল্পনা দ্রুত বাইরে এল।
“আরে দাদা! আপনি এত রাতে?”
হরিহর ঘোষ একটু ইতস্তত করল। কাঁধে একটা গামছা, মুখে চিন্তার ছাপ।
“শুনলাম, আজ তোমার সাথে… মানে, ওখানে… রাস্তার মোড়ে…”
সে নামটা মুখে আনতে চাইল না, কিন্তু কল্পনা বুঝে গেল সে কাকে ইঙ্গিত করছে।
সে একটু নরম স্বরে বলল, “হ্যাঁ দাদা, আমি জানি। কিন্তু আমি কিছু করিনি, শুধু দোকান থেকে বাজার এনেছি।”
হরিহর ঘোষ চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“কল্পনা, সাবধানে থাকো। রশিদ খান একবার যার দিকে চোখ দেয়, তাকে ছাড়ে না…”
কল্পনার গলা শুকিয়ে এল।
“তাহলে কী করব দাদা?”
হরিহর ঘোষ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল,
“তোমার স্বামীর সাথে কথা বলো। আর আমার মনে হয়, কিছুদিন বাইরে চলে যাওয়াই ভালো…”
কল্পনার মাথা ঘুরে গেল। কোথায় যাবে সে? এই ঘর, এই উঠোনই তো তার শেষ সম্বল!
তার মনে একটা ভয়ানক আশঙ্কা দানা বাঁধছিল।
তখনই ভেতর থেকে সুমন বেরিয়ে এল।
“মা, কী হয়েছে?”
কল্পনা দ্রুত বলল, “কিছু না, তুই ভেতরে যা!”
কিন্তু সুমন তখনো জানত না, তার পরিবারের চারপাশে ঘনিয়ে আসছে এক অভিশপ্ত ছায়া।
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রাত তখন প্রায় ১১টা। গ্রামের বাতাসে হালকা শীতলতা। কল্পনা বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিল। রান্না করা শেষ, ছেলেও খেয়ে নিয়েছে, কিন্তু সে নিজে কিছু মুখে তোলেনি। মনটা অস্থির। ভেতরে এক ভয় ঢুকে বসে আছে, কিন্তু সেটা কাউকে বলতে পারছে না।
হঠাৎ দূর থেকে অটোর শব্দ শোনা গেল। রামপ্রসাদ ফিরেছে!
“মা, বাবা চলে এসেছে,” সুমন বলে উঠল।
কল্পনা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। গেটের কাছে গিয়ে দেখল, রামপ্রসাদ অটোটা রাস্তার পাশে রেখে আসছে। সারাদিনের ক্লান্তি স্পষ্ট তার চোখে-মুখে। গায়ের শার্টটা ঘামে ভেজা, হাতের তালুগুলোও কালো হয়ে গেছে।
সে একগাল হেসে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে রে, কল্পনা! কী রান্না করেছ?”
কল্পনা জোর করে একটু হাসল, “তোমার জন্য গরম ভাত আর আলুভর্তা করেছি। আগে আসো, হাত-মুখ ধুয়ে নাও।”
রামপ্রসাদ সুমনের মাথায় হাত রেখে বলল, “কী রে, পড়াশোনা ঠিকঠাক করছিস তো?”
সুমন বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবা, এখন এসব বাদ দাও তো! মা সারাদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করে, আগে খেয়ে নাও।”
রামপ্রসাদ হাসল, তারপর টিউবওয়েলের দিকে গেল হাত-মুখ ধুতে।
কিন্তু কল্পনার মন অস্থির। সে ভাবছিল—রশিদ খানের ব্যাপারটা বলবে কি?
হরিহর কাকা যা বলল, তা কি সত্যিই অত ভয় পাওয়ার মতো? নাকি উনি একটু বেশি ভয় দেখিয়ে দিলেন?
কিন্তু এ-ও তো ঠিক, রশিদ খান কারও কথা শোনে না। সে যা চায়, সেটা নিয়ে নেয়।
কল্পনা চোখ বন্ধ করল।
“না, এখন বলব না… সারাদিন ও এত পরিশ্রম করে, এত রাত অবধি খাটে, তারপর বাড়ি ফিরে যদি এসব বলি, তাহলে ও আরও চিন্তায় পড়ে যাবে। আর এই টেনশনে যদি কাজে ভুল হয়, যদি কিছু হয়ে যায়…”
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এখন কিছু বলা ঠিক হবে না।
রামপ্রসাদ খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সুমনও নিজের ঘরে চলে গেল।
কিন্তু কল্পনার চোখে ঘুম নেই। মনে হচ্ছে, বাইরের অন্ধকারের মাঝে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ঘরের দিকে।
সে জানে না, এই নীরব অন্ধকারের মধ্যেই এক ভয়ংকর ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে…
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩)
সকালটা বেশ নীরব ছিল। রামপ্রসাদ প্রতিদিনের মতো ভোরবেলা বেরিয়ে গেছে অটো নিয়ে। কল্পনা বারান্দায় রান্না করছে—আজ খুব সাধারণ খাবার, ডাল-ভাত আর একটু আলুভাজা। সকালে খাওয়ার পর সে মন্দিরে যাবে, গত রাতের অস্বস্তি এখনো তার মনে রয়ে গেছে।
সুমন বারান্দায় এসে বসল, একমনে মায়ের রান্না করা দেখছিল। সূর্যের আলো তার মায়ের শাড়ির উপর পড়েছে, পাতলা কাপড়ের নিচে শরীরের রেখাগুলো যেন একটু বেশিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কল্পনার খেয়াল নেই, সে নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সুমন কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
তার মনের মধ্যে যে পরিবর্তন আসছে, সেটা সে নিজেও বোঝে না। মা তো মা-ই, কিন্তু কেন জানি আজকাল তার দিকে তাকালে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। ছোটবেলায় যেমন সে মাকে আঁকড়ে ধরে থাকত, এখন সেরকম কিছু মনে হয় না। বরং এক অদ্ভুত আকর্ষণ তার মধ্যে বাসা বাঁধছে।
রাতের পর রাত সে তার ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে চটি পড়ে। শুরুতে সেগুলো ছিল অচেনা নারীদের নিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেগুলো বদলে যেতে থাকে—মাসি, কাকিমা, অবশেষে ‘মা’! প্রথম প্রথম নিজেকে বুঝিয়েছে যে এসব কেবল কল্পনা, এসবের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কিন্তু যতবার সে এসব পড়েছে, ততবার কল্পনার মুখটাই ভেসে উঠেছে তার চোখের সামনে।
সে কেমন যেন উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে, আর ঠিক তখনই কল্পনা পিছন ফিরে তাকাল।
“কী রে, এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
সুমন হকচকিয়ে গেল। সে তো ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল, মা হঠাৎ কথা বলায় কেমন যেন গুলিয়ে গেল তার ভেতরটা।
“ক..কিছু না, এমনি।”
কল্পনা হাসল, কিন্তু সুমনের হাসি কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে গেল।
সে দ্রুত বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বুক ধুকপুক করছে, যেন কেউ তার গোপন চিন্তাগুলো ধরে ফেলেছে।
“আমি এভাবে ভাবছি কেন?”
নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।
“এটা তো ভুল… কিন্তু কেন মনে হচ্ছে ঠিক?”
সে জানে, মা তাকে জন্ম দিয়েছে, লালন-পালন করেছে। কিন্তু চটি বইয়ের নেশা তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে সে ফিরতে পারছে না। গতকাল রাতেও সে ঠিক এমনই একটা গল্প পড়েছে—মায়ের প্রতি ছেলের গোপন আকর্ষণ নিয়ে লেখা এক বিকৃত উপন্যাস। আজ সকালে সে যখন মাকে দেখছিল, তার মাথার মধ্যে সেই গল্পের চরিত্রগুলোই খেলা করছিল।
নিজের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরল সুমন।
“আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?”
কিন্তু তার অন্তরের গভীরে এক ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে—এই অনুভূতি সে আর চাপা দিতে পারবে না।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রবিবার সকাল। সুমনের জন্য এটা একটা বিশেষ দিন—আজ কলেজ নেই, তাই সে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠল। উঠেই বারান্দায় গিয়ে দেখল, মা রান্না করছে। আজকের সকালে কেমন একটা প্রশান্ত পরিবেশ আছে, যেন কালকের সব দুশ্চিন্তা কোথাও মিলিয়ে গেছে।
কল্পনা ছেলের ঘুম থেকে ওঠার শব্দ পেয়ে পিছনে তাকাল।
“ওঠে গেছিস? চল, আগে মুখ ধুয়ে নে, তারপর খেয়ে নিস।”
সুমন মাথা নেড়ে স্নানঘরের দিকে চলে গেল। মুখ ধোয়ার সময় আয়নায় নিজের চেহারা দেখল—সাধারণ একটা ছেলের মতোই তো দেখতে, কিন্তু তার ভেতরে একটা গোপন দানব বাসা বাঁধছে, যা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
সে মাথা ঝাঁকিয়ে এসব ভাবনা সরিয়ে দিল।
আজকের দিনটা ভালো কাটাতে হবে।
নাস্তা করে সে পড়ার টেবিলে বসলো। আসলে পড়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মায়ের সামনে ভালো ছেলে হওয়ার একটা চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাইল।
কল্পনা একবার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল ছেলেকে। মুখে হাসি ফুটল তার।
“আজ পড়তে বসেছিস? বাহ, খুব ভালো!”
সুমন মিথ্যে হাসল। “হ্যাঁ মা, ভাবলাম একটু পড়া হয়ে যাক।”
কল্পনা আনন্দিত হল, মা তো এমনটাই চায়, ছেলে ভালো করে পড়াশোনা করুক। সে রান্নায় মন দিল, আর সুমন বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই সে বুঝতে পারল, তার মনোযোগ কোথাও আটকে আছে।
কাল রাতে সে আবারও সেই চটি বইগুলো পড়েছে, আর এখন পড়ার সময়ও সেইসব চরিত্রের চেহারাগুলো তার মনের মধ্যে ঘুরছে।
মা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত, বাতাসে তরকারির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সুমন চোখ সরিয়ে নিলো বই থেকে, চুপচাপ একবার মায়ের দিকে তাকাল।
“না, না, এসব বাদ দিতে হবে…”
সে মাথা ঝাঁকাল।
বাইরে মাঠে খেলা চলছে। বন্ধুদের ডাকাডাকির আওয়াজ আসছে। সে ভাবল, আর বসে থেকে লাভ নেই, বাইরে গিয়ে খেললেই হয়তো মনটা ঠিক হয়ে যাবে।
সে উঠে দাঁড়াল,
“মা, আমি মাঠে যাচ্ছি!”
কল্পনা হেসে বলল, “যা, কিন্তু দুপুরের আগে চলে আসিস।”
সুমন মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল।
রশিদ খানের অন্ধকার বাসনা
রশিদ খান আজ গ্রামের পাশ দিয়ে ফিরছিল। MLA হিসেবে তার কাজের জন্য গ্রামে ঘোরা-ফেরা লেগেই থাকে, কিন্তু আজ যেন তার গন্তব্যটা নিজের অজান্তেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক তখনই, রাস্তার ধারে কল্পনাকে দেখে তার চোখ স্থির হয়ে গেল।
সে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের গেটের সামনে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে, তার চেহারায় এক অপার্থিব প্রশান্তি, চোখে এক আধ্যাত্মিক দীপ্তি। লাল টিপের নিচে কপালের সামান্য ঘাম জমেছে, শাড়ির আঁচল বুকের ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, আর হাওয়ায় উড়ছে তার চুলের কিছু অংশ।
রশিদ খান যেন মুহূর্তেই একটা অন্যরকম নেশায় পড়ে গেল।
“হায় রে! এই বউটা তো আগুন! এই রূপ তো আমার ঘরে থাকার কথা!”
তার শরীর গরম হয়ে উঠল। সে নিজের ঠোঁট চাটল। এই শরীর, এই মসৃণ কোমর, এই ভারী বুক—এসব কারও ঘরের সুখের জন্য নয়, এসব রাজাদের জন্য, ক্ষমতাবানদের জন্য!
গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে জানালাটা নামাল। এবার আর সে গোপন দৃষ্টিতে দেখছিল না, বরং একেবারে ঠাণ্ডা চোখে কল্পনাকে গিলে ফেলছিল দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
কল্পনা হাঁটতে শুরু করল। সে অনুভব করল, কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল, কিন্তু ভেতরে একটা ভয় বাড়তে লাগল।
রশিদ খান গাড়ি থেকে নামল না, কিন্তু তার চোখ বলছিল—“তুই আমার হাত থেকে বেশি দূরে যেতে পারবি না, কল্পনা… খুব শিগগিরই তোর এই পবিত্রতার ওপর আমার হাত পড়বে।”
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রাত তখন গভীর। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোনো কুকুর ডেকে উঠছে। রামপ্রসাদ তখন গভীর ঘুমে, সারাদিনের ক্লান্তির পর তার নিস্তব্ধ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু সুমনের ঘুম আসছে না।
সে বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই একটা মুখ ভেসে উঠছে—তার মায়ের মুখ। আজ সকালে সে ঠিকমতো খেয়াল করেনি, কিন্তু মন্দির থেকে ফেরার পর যখন মা ঘরে ঢুকলেন, তখন যেন তাকে নতুন করে দেখলো।
সাদা-লালের শাড়িতে মোড়া মা’কে ঠিক যেন কোনো দেবীর মতো লাগছিল। মাথায় ঘোমটা টানা, কপালে লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র—সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত মোহময়ী আভা। মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যখন বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়েছিল, তখনই তার গলা থেকে কোমরের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল সুমনের। সেই দৃশ্যটা তার মাথা থেকে সরছে না।
সে জানে, এটা অন্যায়… কিন্তু তবু সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না।
হঠাৎ করেই সে উঠে বসল।
তার বুকের মধ্যে অস্বস্তি, যেন কিছু একটা না দেখে থাকলে মন শান্ত হবে না।
না ভেবেই ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে এল। বাবার ঘরের দিকে একবার তাকাল, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দরজার সামনে।
ঘরের মধ্যে আলো নেই, শুধু জানালার বাইরে থেকে চাঁদের ম্লান আলো এসে পড়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সুমন দেখল—তার মা বিছানায় শুয়ে আছেন, পাশেই বাবা ঘুমিয়ে।
কল্পনার শরীরটা চাঁদের আলোয় রহস্যময় লাগছে। শাড়ির পাতলা আঁচল তার শরীরের কিছু অংশ ঢেকেছে, কিছু অংশ উন্মুক্ত।
সুমনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
সে আর একটু এগিয়ে গেল…
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৬)
রশিদ খান সারা রাত ঘুমোতে পারেনি।
বিছানায় শুয়ে থাকলেও চোখের সামনে বারবার সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে—সাদা-লালের মিশেলে মোহময়ী এক নারী, মাথায় ঘোমটা, কপালে লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র।
হাজারের বেশি নারী সে ভোগ করেছে, কিন্তু আজ… আজ যেন ভেতরের পশুটি তৃপ্ত নয়। এই নারীকে না পেলে যেন শান্তি নেই!
রশিদ খান ধপ করে উঠে বসল। একটা বিড়ি ধরিয়ে দম দিতে দিতে ডানদিকে রাখা মোবাইলটা তুলল। মোবাইল হাতে নিয়েই একটা নম্বরে ডায়াল করল।
“হ্যালো, শাকিল, শুন!”
ওপাশ থেকে ভোরের ঘুমজড়ানো গলা ভেসে এলো।
“জি ভাই, কিসের এত তাড়া?”
“একটা কাজ আছে তোর জন্য… জরুরি।”
শাকিল সতর্ক হয়ে গেল, কারণ MLA রশিদ খান যখন ‘জরুরি’ বলে, তখন সেটা সাধারণত কারও জন্য ভয়ানক কিছু হতে চলেছে।
“বলো ভাই, কী করতে হবে?”
রশিদ খান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“কাল সন্ধ্যায়, ঐ গ্রামের মন্দিরের রাস্তার ধারে একটা গোলদারি দোকানের সামনে আমি একটা রত্ন দেখেছি… একেবারে খাঁটি রত্ন। সাদা-লাল শাড়ি, ঘোমটা টানা, কপালে লাল টিপ… একেবারে অপ্সরী।”
তার গলা ভারী হয়ে এল।
“আমি এই মেয়েটাকে চাই! যেকোনো মূল্যে।”
শাকিল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“ভাই, নাম জানো?”
“নাহ। জানবো কী করে? তবে বেশি দূরে না। ঐ গলির মধ্যেই থাকে, এতটুকু নিশ্চিত। কালকে দোকান থেকে বাজার করছিল। তার মানে সংসারি মেয়ে, আর বেশ দেখতে ভালো। নিশ্চয়ই বিবাহিতা।”
রশিদ খান চোখ বন্ধ করল। মনে মনে আবার সেই দৃশ্যটা এঁকে নিলো।
“তোর কাজ হলো, খোঁজ নিয়ে বের করা—ওই মাগীর নাম কী, কোথায় থাকে, আর কেমন তার সংসার।”
শাকিল একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল,
“ভাই, মেয়েটা যদি কারও বউ হয়?”
রশিদ খান এবার কটমট করে তাকাল, যেন শাকিলের এই প্রশ্নই তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।
“বউ হলে কী হয়েছে? আমি MLA, আমি যা চাই, তা পাবোই। আইন আমার জন্য নয়, বুঝছিস?”
তারপর একটু থেমে বলল,
“কাল রাতের মধ্যে খোঁজ চাই আমার সামনে।”
শাকিল মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে ভাই, আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।”
কল কেটে দিল রশিদ খান।
তার ঠোঁটে একটা বিকৃত হাসি ফুটে উঠল।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে সে জানালার বাইরে তাকাল।
এই রাতের আঁধারেই জন্ম নিচ্ছে এক অন্ধকার ছায়া, যা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চলেছে কল্পনার শান্ত জীবনকে…
(চলবে…)
অন্যদিকে, কল্পনার বাড়ি
সকালবেলা কল্পনা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠোনে গিয়েছিল। দুধ গরম দিচ্ছিল চুলায়।
পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন।
সে কিছু বলছিল না, শুধু তাকিয়েই ছিল।
তার মায়ের শরীরের প্রতিটা ভাঁজ যেন আজকাল তার কাছে অদ্ভুত কিছু মনে হয়। কিছুদিন আগেও এটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন…
মা যখন ঘোমটা সরিয়ে মাথার চুল ঠিক করে, যখন শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে পিছলে পড়ে… সুমনের বুকের ভেতরে কেমন একটা চাপ চাপ ব্যথা হয়।
সে বোঝে না, এটা কেন হচ্ছে।
সে জানে, এটা অন্যায়।
কিন্তু শরীর তো অন্য কথা বলে!
বিছানায় শুয়ে সে রাতে নিজেকেই প্রশ্ন করে—“আমি কী দানব হয়ে যাচ্ছি?”
কিন্তু উত্তর মেলে না।
সে শুধু অনুভব করে, তার রক্ত গরম হয়ে উঠছে।
একদিকে সুমন নিজের সঙ্গে লড়াই করছে, আর অন্যদিকে রশিদ খান নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।
কল্পনা জানেই না, তার চারপাশে কতটা ভয়ংকর ছায়া ঘনিয়ে আসছে…
(চলবে…)অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩) – ছায়ার চোখ
রশিদ খানের লোক সাকিল সন্ধ্যায় ফিরে এলো, মুখে এক অদ্ভুত হাসি।
“বড় সাহেব, খোঁজ পেয়েছি!”
রশিদ খান তখন বিশাল সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল, সোনার চেন হাতে ঘুরাচ্ছিল। খবর শুনেই সে একটু সোজা হয়ে বসল।
“বলি তো, কে এই রূপবতী?”
সাকিল কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, “মহিলার নাম কল্পনা। স্বামী অটো চালায়, সারাদিন রাস্তায় থাকে। একটা ছেলে আছে, নাম সুমন, কলেজে পড়ে।”
রশিদ খান একটু ভেবে নিয়ে ঠোঁট চাটল।
“মানে বলতে গেলে, একেবারে নিখুঁত সেটআপ! স্বামী বাড়িতে নেই, ছেলে কলেজে, আর বউটা… একা!”
তার ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটে উঠল।
“সাকিল, এবার ওর উপর একটু নজর রাখ। কোথায় যায়, কখন একা থাকে, সব খবর চাই।”
সাকিল মাথা ঝাঁকাল, “হবে বড় সাহেব। আপনি জানেন, আমি কাজ করলে পুরো কাজ করি।”
অন্যদিকে কল্পনা কিছুই টের পাচ্ছে না…
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে স্বামী রামপ্রসাদ বাইরে বারান্দায় বসে পান চিবোচ্ছিল, আর কল্পনা চুপচাপ উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আজকের ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মন্দির থেকে ফেরার সময় রশিদ খানের চোখের সেই চাহনি তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি করেছিল।
সে বুঝতে পারছিল না—এটা কি শুধুই তার কল্পনা, নাকি সত্যিই তার পেছনে কিছু ঘটছে?
সুমনের পরিবর্তন
অন্যদিকে, সুমনের মধ্যেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছিল।
সেই রাতেই, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, সুমন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়ল। অন্ধকার ঘরে বসে সে অনুভব করল—তার মাথার মধ্যে কিছু চলছে, কিছু একটার আকর্ষণ যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে সে মায়ের ঘরের দিকে তাকাল…
অন্ধকার ঘরে তার মা শুয়ে আছে, ঘরের ছোট্ট মাটির প্রদীপের আলোয় কল্পনার ঘুমন্ত মুখ এক আশ্চর্য নরম আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তার সাদা-লাল শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
সুমনের শ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
তার মাথায় একটা দ্বন্দ্ব চলতে লাগল। “আমি কি ভুল করছি? এটা কি আমার মস্তিষ্কের বিভ্রম? কেন আমি এমনটা ভাবছি?”
কিন্তু সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
সে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে গেল, দরজা আটকে দিল। বুক ধুকপুক করছে।
সুমন বুঝতে পারছে না—সে কেন আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে পরিবর্তন টের পাচ্ছে। কেমন যেন এক অন্ধকার তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে…
এদিকে রশিদ খান তার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেছে।
সে জানে, কল্পনাকে সরাসরি ধরার চেষ্টা করলে ঝামেলা বাড়তে পারে। তাই সে ধৈর্য ধরে ছায়ার মতো তার জীবনে প্রবেশ করতে চায়।
আগামী কয়েকদিনে তার পা রাখা হবে কল্পনার বাড়ির খুব কাছাকাছি…
(পরবর্তী পর্বে: রশিদ খানের নতুন চাল, কল্পনার মনের অশান্তি, এবং সুমনের আরও গভীর পরিবর্তন!)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪) – ষড়যন্ত্রের জাল
কয়েকদিন কেটে গেছে। কল্পনা এখন আগের চেয়েও বেশি ধার্মিক হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সকালে সে মন্দিরে যায়, সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের সামনে বসে থাকে।
এই পরিবর্তন যেন তার সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। কল্পনার লাল-সাদা শাড়ির পরত, কপালের লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র—সবকিছু মিলিয়ে সে যেন আরও মোহময়ী হয়ে উঠেছে।
রশিদ খানের নতুন ফন্দি
রশিদ খান কল্পনাকে পাওয়ার জন্য এখন আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
একদিন বিকেলে তার বিশ্বস্ত লোক সাকিল কাছে এসে বলল,
“বড় সাহেব, যদি ওর স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই তো রাস্তা পরিষ্কার! মেয়েছেলেরা তখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন যা খুশি করা যায়।”
রশিদ খান চোখ ছোট করে তাকাল, “কী বলছিস তুই? কেমন করে সরাবি ওকে?”
সাকিল ঠোঁটের কোণে একটা শয়তানি হাসি ফুটিয়ে তুলল।
“তার অটোকে ব্যবহার করেই!”
ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
পরিকল্পনা খুব সহজ, কিন্তু মারাত্মক:
• রামপ্রসাদের অটোর সামনে গিয়ে রশিদ খানের লোক এমনভাবে ধাক্কা খাবে যেন গুরুতর চোট লাগে।
• তারপর পুলিশ এসে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে কেস দায়ের করবে, এবং প্রমাণ সাজানো হবে যেন সে ইচ্ছাকৃতভাবে এক লোককে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে।
• পুলিশ তো রশিদ খানের পোষা কুকুর, তারা কেসটাকে এমনভাবে সাজাবে যেন রামপ্রসাদ দোষী হয় এবং তাকে জেলে পাঠানো যায়।
• রামপ্রসাদকে একবার সরিয়ে দিলে কল্পনা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে—তখন তাকে বশে আনা সহজ হবে!
রশিদ খান গ্লাসে এক চুমুক পানীয় নিয়ে বলল,
“ভালোই তো! এক ঢিলে দুই পাখি মারব। স্বামী সরবে, আর বউ হবে আমার!”
সাকিল হেসে বলল, “সাহেব, কিছুদিনের মধ্যে দেখবেন কল্পনা আপনার সামনে কান্নাকাটি করছে। তখন আপনি যা চাইবেন তাই হবে!”
অন্যদিকে কল্পনার জীবনে অশান্তির ছায়া
সেদিন রাতে, কল্পনা উঠোনে বসে ছিল। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, কিন্তু তার মনে একটা অজানা অস্বস্তি কাজ করছিল।
সে অনুভব করছিল, কিছু একটা খুব খারাপ হতে চলেছে…
এদিকে, সুমনের মধ্যেও পরিবর্তন বাড়ছে। সে এখন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কল্পনার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বোঝার চেষ্টা করে।
সে বুঝতে পারছে না—কেন সে এমন অদ্ভুত অনুভূতি পাচ্ছে!
কিন্তু এসব কিছুই কল্পনার জানা নেই। সে জানে না যে তার স্বামীর জন্য একটা চক্রান্ত তৈরি হচ্ছে।
পরবর্তী পর্ব: ষড়যন্ত্রের জাল
রশিদ খানের নির্দেশে তার ডানহাত শাকিল পুরো প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেছে। পরিকল্পনাটা খুবই ঠান্ডা মাথার—কল্পনার স্বামী রামপ্রসাদকে এমনভাবে ফাঁসাতে হবে, যাতে কেউ তার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে না পারে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
একদিন গভীর রাতে, রামপ্রসাদ যখন তার অটো নিয়ে যাত্রী নামিয়ে ফিরছিল, তখন রাস্তার ধারে রশিদ খানের লোকেরা ইচ্ছা করে এক ভবঘুরেকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটা এমনভাবে দেওয়া হয়, যেন মনে হয় রামপ্রসাদের অটোর ধাক্কায় লোকটা গুরুতর আহত হয়েছে।
রাস্তার আশেপাশে রশিদ খানের গুন্ডারা তখনই চিৎকার করে উঠল—
“ধরে নে! ওই অটোওয়ালা লোকটাকে মেরে পালাচ্ছে!”
আশেপাশে কিছু স্থানীয় লোক ছুটে আসে, কিন্তু পুলিশের দল ইতিমধ্যেই তৈরি ছিল। রশিদ খানের লোকেরা আগে থেকেই পুলিশকে বলে রেখেছিল, যেন তারা এসে সরাসরি রামপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়।
রাতের গভীরে পুলিশ এল, আর কোনো কথা না শুনেই রামপ্রসাদকে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে গেল।
কল্পনার জীবনের নতুন ভয়াবহ অধ্যায়
রাত তখন গভীর। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কল্পনার।
“কল্পনা দেবী, আপনার স্বামী খুব বড় অপরাধ করেছেন। দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছে। তিনি এখন থানায় আছেন।”
পুলিশের কথা শুনে কল্পনার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল।
রশিদ খানের পরবর্তী চাল
শাকিল এসে রশিদ খানের কানে কানে বলল—
“বউটা একা হয়ে গেল স্যার, এখন ওকে ভাঙতে সময় লাগবে না। একটু ভয় দেখালেই কেল্লাফতে!”
রশিদ খান একটা সিগারেট ধরিয়ে হাসল, চোখেমুখে শিকার ধরার আনন্দ।
“এবার কল্পনা আমার হবেই।”
(পরবর্তী পর্ব: কল্পনার সামনে দুটো রাস্তা—লড়াই নাকি আত্মসমর্পণ?)
পরবর্তী পর্ব: কল্পনার সংগ্রাম শুরু
সকাল হতেই কল্পনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, রামপ্রসাদ খুনের মতো কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে!
কল্পনা সোজা হরি হর কাকার কাছে ছুটে যায়। তিনি গ্রামের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, অনেক পুলিশের সাথেই তার ভালো সম্পর্ক আছে।
কল্পনা (কাঁদতে কাঁদতে): “কাকা, আমার রামপ্রসাদকে ফাঁসানো হয়েছে! পুলিশ কিছু শুনতেই চাইছে না!”
হরি হর কাকা (গম্ভীর গলায়): “এই ব্যাপারটা তো সহজ নয়। রশিদ খানের মতো মানুষ যদি পিছনে থাকে, তবে পুলিশও টাকা খেয়ে গেছে। তবু চল থানায় গিয়ে দেখি, কী করা যায়।”
থানায় তিক্ত অভিজ্ঞতা
কল্পনা আর হরি হর কাকা থানায় গিয়ে দেখে রামপ্রসাদ হাতকড়া পরে বসে আছে, চোখে ভয় আর হতাশার ছাপ।
কল্পনা (কান্নাভেজা গলায়): “ওকে ছাড়ুন! ও নির্দোষ!”
ডিউটি অফিসার ঠান্ডা চোখে তাকায়, যেন সব আগেই ঠিক হয়ে আছে।
পুলিশ: “তোমার স্বামী খুন করে পালাতে চেয়েছিল, সাক্ষী-প্রমাণ সব আছে। কেস কোর্টে যাবে, জামিন পাবার সম্ভাবনাও নেই।”
হরি হর কাকা: “তদন্ত ঠিকঠাক হয়নি, আমরা বড় সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।”
পুলিশ (হাসতে হাসতে): “বড় সাহেব তো আজ ছুটিতে, কাল আসুন। আর এইসব বেশি কথা বলার দরকার নেই, না হলে তোমাদেরও ভিতরে ঢুকিয়ে দেব!”
কল্পনার মনে একটাই প্রশ্ন—“এখন কী করব?”
অন্যদিকে রশিদ খানের ছক
শাকিল এসে রশিদ খানের কানে কানে বলল—
“মহিলাটা থানায় গেছে, কিন্তু লাভ কিছুই হবে না। পুলিশ আমাদের লোক।”
রশিদ খান মুচকি হাসে, “বউটা একা হয়ে গেছে। এবার একটু ভয় দেখিয়ে, একটু বুঝিয়ে… সময় লাগবে না।”
শাকিল জিজ্ঞেস করল, “আপনার কথার মানে?”
রশিদ খান ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কাল সন্ধ্যায় ওর বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি নিজে কথা বলব কল্পনার সাথে।”
(পরবর্তী পর্ব: রশিদ খানের চাল, কল্পনার লড়াই, আর হরি হর কাকার নতুন পরিকল্পনা!)
ঠিক আছে, আমি গল্পটিকে একটি ডার্ক থ্রিলার হিসেবে গড়ে তুলছি, যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র, এবং দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচারের চিত্র থাকবে। কল্পনার পরিবারকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচিত হবে, আর এর মধ্যে থাকবে টানটান উত্তেজনা।
আমি পরবর্তী অংশটি লিখে দিচ্ছি:
পরবর্তী পর্ব:
রাত গভীর। কল্পনা ঘরের এক কোণে বসে আছে, মাথা নিচু, চোখ দুটো যেন শুকিয়ে গেছে সারাদিনের কান্নায়। হরি হর কাকা সব চেষ্টা করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। পুলিশের হাতে রামপ্রসাদ ধরা পড়েছে, আর তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে MLA রসিদ খানের পরিকল্পনা সফলভাবে এগোচ্ছে। তার লোকেরা নিশ্চিত করেছে যে, পুলিশের রেকর্ডে ঘটনাটি ‘হিট অ্যান্ড রান কেস’ হিসেবেই নথিভুক্ত হয়েছে, আর কল্পনার স্বামীর কোনো উপায় নেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
কিন্তু এখন রসিদ খানের মাথায় নতুন চিন্তা। শুধু কল্পনার স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া তার লক্ষ্য নয়, সে কল্পনাকে পুরোপুরি নিজের দখলে আনতে চায়। তাই রাতে, সে নিজেই এল কল্পনার বাড়ির সামনে।
কল্পনা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎই বাইরের গাড়ির আলো চোখে লাগল। একটা কালো SUV এসে থামল গেটের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে নামল রসিদ খান, সঙ্গে তার দুইজন দেহরক্ষী। কল্পনার বুক ধক করে উঠল।
সে কিছু বোঝার আগেই দরজায় শক্ত করে কড়া নাড়ল কেউ।
— “খুলুন, কল্পনাদেবী… আমি রসিদ খান। কথা আছে আপনার সঙ্গে।”
বাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। কল্পনার কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরা… কী করবে এখন?
পশ্চিমবঙ্গের এক ছোট গ্রাম। সময়টা সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই, চারপাশে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে। সরু, ধুলোমাখা রাস্তার একপাশে একটি পুরনো, জরাজীর্ণ বাড়ি। ইটের দেওয়াল থেকে কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে, বারান্দার বাঁশের ফ্রেম নড়বড়ে হয়ে আছে। উঠোনে আগাছা জন্মেছে, আর সামনের গেটটি মরচে ধরা, যেন বহুদিন তাতে কোনো তেল দেওয়া হয়নি।
এখানেই থাকে রামপ্রসাদ, তার স্ত্রী কল্পনা, আর তাদের একমাত্র ছেলে সুমন।
রামপ্রসাদ—একজন পরিশ্রমী মানুষ। সকাল ৭টায় বেরিয়ে যান অটো নিয়ে, কখনো ফেরেন রাত ১০টায়, কখনো ১২টা বাজিয়ে দেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, যাতে সংসার চলে। তবে পরিশ্রম করলেও অর্থের টান চিরকালীন। অভাব যেন তার পিছু ছাড়ে না। কিন্তু এই অভাবের মধ্যেও তার একটা গর্ব আছে—তার স্ত্রী।
কল্পনা—গায়ের রং গমের মতো, চেহারায় একটা স্বর্গীয় মায়াবী সৌন্দর্য। তার মুখে সবসময় একটা শান্ত ভাব লেগে থাকে, যেন হাজার কষ্টের মাঝেও সে স্থির। কপালে সিঁদুর, পরনে সাধারণ শাড়ি, কিন্তু তার শরীরের ভাঁজগুলো যেন শাড়ির গাম্ভীর্যকে ভেদ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। কল্পনা অত্যন্ত ধার্মিক। নিয়ম করে সকালে গঙ্গাজল ছিটিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করে, প্রতিদিন ঠাকুরঘরে ঘণ্টার শব্দ তুলে পুজো দেয়। সে যেন এই সংসারের একমাত্র পবিত্র আলো, যে দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে রাখে।
কিন্তু তাদের ছেলে সুমন সম্পূর্ণ বিপরীত। বয়স ১৯, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তবে লেখাপড়ার প্রতি কোনো টান নেই। তার বন্ধুদের দল খারাপ, নেশা করে না ঠিকই, কিন্তু সস্তা চটি বই পড়ে, রাতে লুকিয়ে ফোনে নিষিদ্ধ জিনিস দেখে। বাবার মতো কষ্ট করে জীবনে কিছু করার আগ্রহ তার নেই, বরং শরীরী সুখের প্রতি তার দুর্বলতা প্রবল।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ২)
রোদ তখন ম্লান হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। গ্রামের রাস্তার ধুলো মিশে আছে গরম বাতাসের সাথে। রামপ্রসাদ তখনও ফেরেনি, আর সুমন কলেজ থেকে ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। কল্পনা একটু বাজার করতে বেরিয়েছে।
সাদা-নীল পাড়ের একটা সাধারণ শাড়ি পরে সে গলির মোড়ে একটা গোলদারি দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানটা খুবই পুরনো, কাঠের তাক ভর্তি বিভিন্ন জিনিস—গুঁড়ো মশলা, বিস্কুটের টিন, তেল, সাবান, আলতা, সিঁদুর। এক কোণে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা ঝুলছে।
“একটা নারকেল তেল আর ধনেপাতা দিন কাকু,” কল্পনা ভেতরে হাত বাড়িয়ে দোকানদারকে বলল।
ঠিক তখনই রাস্তায় একটা কালো Fortuner গাড়ি এসে থামল। গাড়ির সামনে ছোট্ট একটা জাতীয় পতাকা লাগানো, বোঝাই যাচ্ছে, কোনো ক্ষমতাবান লোকের গাড়ি।
গাড়ির জানালা নামতেই রশিদ খান-এর মুখ দেখা গেল।
সাধারণ কুর্তা-পাজামা, কালো চশমা, কানে হীরের টপ, আর হাতে দামি সোনার ব্রেসলেট। গায়ের রঙ চাপা, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হিংস্রতা। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু তার শরীরের গঠন এখনো শক্তপোক্ত। চোখ দুটো এমনভাবে কল্পনার দিকে আটকে গেল, যেন সে পুরো শরীরের প্রতিটা ভাঁজ গিলে খাচ্ছে চোখ দিয়েই।
কল্পনা একবার তাকিয়ে আবার দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। তার মন কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠল। কিন্তু রশিদ খান নিজের নীচু স্বভাবের পরিচয় দেয়ার জন্য কোনো তাড়াহুড়ো করে না—সে জানে, ধৈর্য ধরতে হয়, সময় নিয়ে শিকার ধরতে হয়।
সে চোখ সরিয়ে নিলো না, বরং নিজের গাড়ির সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,
“এই গ্রামেও দেখি এমন মাল আছে!”
গাড়ির মধ্যে থাকা দুজন লোক—তার দলবাজ গুন্ডারা—সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল।
দোকানদার মুহূর্তেই মুখ শুকিয়ে ফেলল, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু-একজন লোকও দ্রুত নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল, যেন কিছু শোনেনি। এই গ্রামে MLA রশিদ খানের নাম ভয়াবহ এক আতঙ্ক। সে যা চায়, তা পায়—যদি না পায়, জোর করে নেয়। পুলিশের কাছেও তার ব্যাপারে অভিযোগ করা মানে নিজেই বিপদ ডেকে আনা।
কল্পনা দ্রুত টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে হাঁটা দিলো। পেছনে তাকানোর সাহস হলো না, কিন্তু সে অনুভব করছিল, সেই চোখ দুটি আজও তাকে অনুসরণ করছে।
গাড়ির ভেতরে বসে রশিদ খান ঠোঁট চাটল।
“বউটা আমার চাই। সময় লাগুক, কিন্তু পাবই।”
তারপর গাড়ির জানালা বন্ধ হয়ে গেল, গাড়িটি আবার গর্জন করে এগিয়ে গেল রাস্তার ধুলো উড়িয়ে।
কল্পনা দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো, কিন্তু কেমন যেন একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করছিল। পায়ের নিচে মাটি নরম হয়ে আসছিল। কেউ যেন তার সুখের ছোট্ট সংসারটাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে, আর ধীরে ধীরে একটা বিষাক্ত ছায়া ঢুকে পড়ছে তার জীবনে।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩)
বাড়িতে ফিরে কল্পনার মন ভালো লাগছিল না। রান্নার উপকরণগুলো বারান্দার এক পাশে রেখে সে ঘরের ভেতরে গেল। ঠাকুরের সামনে গিয়ে হাত জোড় করল।
“ভগবান, কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছে! কিসের যেন একটা ভয় করছে। তুমি আমার পরিবারকে রক্ষা করো…”
সে চোখ বন্ধ করেই বসে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু মনের অস্থিরতা কমল না। বুকের ভেতর কোথাও যেন ধুকপুকানি চলছিল।
ঠিক তখনই বাইরে গেটের কাছে একটা আওয়াজ হল। কল্পনা চমকে উঠল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এত রাতে কে?
“সুমন!” ডাক দিলো সে, ছেলেকে খুঁজে পেতে। কিন্তু কোনো উত্তর এল না।
গেটের দিক থেকে এবার একটু মোটা গলার আওয়াজ শোনা গেল।
“কল্পনাদি, আছেন?”
গলার স্বর শুনেই চিনতে পারল, পাশের গ্রামের হোটেল মালিক হরিহর ঘোষ। বেশ ভালো মানুষ, কল্পনার স্বামীর সাথেও ভালো সম্পর্ক।
কল্পনা দ্রুত বাইরে এল।
“আরে দাদা! আপনি এত রাতে?”
হরিহর ঘোষ একটু ইতস্তত করল। কাঁধে একটা গামছা, মুখে চিন্তার ছাপ।
“শুনলাম, আজ তোমার সাথে… মানে, ওখানে… রাস্তার মোড়ে…”
সে নামটা মুখে আনতে চাইল না, কিন্তু কল্পনা বুঝে গেল সে কাকে ইঙ্গিত করছে।
সে একটু নরম স্বরে বলল, “হ্যাঁ দাদা, আমি জানি। কিন্তু আমি কিছু করিনি, শুধু দোকান থেকে বাজার এনেছি।”
হরিহর ঘোষ চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“কল্পনা, সাবধানে থাকো। রশিদ খান একবার যার দিকে চোখ দেয়, তাকে ছাড়ে না…”
কল্পনার গলা শুকিয়ে এল।
“তাহলে কী করব দাদা?”
হরিহর ঘোষ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল,
“তোমার স্বামীর সাথে কথা বলো। আর আমার মনে হয়, কিছুদিন বাইরে চলে যাওয়াই ভালো…”
কল্পনার মাথা ঘুরে গেল। কোথায় যাবে সে? এই ঘর, এই উঠোনই তো তার শেষ সম্বল!
তার মনে একটা ভয়ানক আশঙ্কা দানা বাঁধছিল।
তখনই ভেতর থেকে সুমন বেরিয়ে এল।
“মা, কী হয়েছে?”
কল্পনা দ্রুত বলল, “কিছু না, তুই ভেতরে যা!”
কিন্তু সুমন তখনো জানত না, তার পরিবারের চারপাশে ঘনিয়ে আসছে এক অভিশপ্ত ছায়া।
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রাত তখন প্রায় ১১টা। গ্রামের বাতাসে হালকা শীতলতা। কল্পনা বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিল। রান্না করা শেষ, ছেলেও খেয়ে নিয়েছে, কিন্তু সে নিজে কিছু মুখে তোলেনি। মনটা অস্থির। ভেতরে এক ভয় ঢুকে বসে আছে, কিন্তু সেটা কাউকে বলতে পারছে না।
হঠাৎ দূর থেকে অটোর শব্দ শোনা গেল। রামপ্রসাদ ফিরেছে!
“মা, বাবা চলে এসেছে,” সুমন বলে উঠল।
কল্পনা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। গেটের কাছে গিয়ে দেখল, রামপ্রসাদ অটোটা রাস্তার পাশে রেখে আসছে। সারাদিনের ক্লান্তি স্পষ্ট তার চোখে-মুখে। গায়ের শার্টটা ঘামে ভেজা, হাতের তালুগুলোও কালো হয়ে গেছে।
সে একগাল হেসে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে রে, কল্পনা! কী রান্না করেছ?”
কল্পনা জোর করে একটু হাসল, “তোমার জন্য গরম ভাত আর আলুভর্তা করেছি। আগে আসো, হাত-মুখ ধুয়ে নাও।”
রামপ্রসাদ সুমনের মাথায় হাত রেখে বলল, “কী রে, পড়াশোনা ঠিকঠাক করছিস তো?”
সুমন বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবা, এখন এসব বাদ দাও তো! মা সারাদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করে, আগে খেয়ে নাও।”
রামপ্রসাদ হাসল, তারপর টিউবওয়েলের দিকে গেল হাত-মুখ ধুতে।
কিন্তু কল্পনার মন অস্থির। সে ভাবছিল—রশিদ খানের ব্যাপারটা বলবে কি?
হরিহর কাকা যা বলল, তা কি সত্যিই অত ভয় পাওয়ার মতো? নাকি উনি একটু বেশি ভয় দেখিয়ে দিলেন?
কিন্তু এ-ও তো ঠিক, রশিদ খান কারও কথা শোনে না। সে যা চায়, সেটা নিয়ে নেয়।
কল্পনা চোখ বন্ধ করল।
“না, এখন বলব না… সারাদিন ও এত পরিশ্রম করে, এত রাত অবধি খাটে, তারপর বাড়ি ফিরে যদি এসব বলি, তাহলে ও আরও চিন্তায় পড়ে যাবে। আর এই টেনশনে যদি কাজে ভুল হয়, যদি কিছু হয়ে যায়…”
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এখন কিছু বলা ঠিক হবে না।
রামপ্রসাদ খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সুমনও নিজের ঘরে চলে গেল।
কিন্তু কল্পনার চোখে ঘুম নেই। মনে হচ্ছে, বাইরের অন্ধকারের মাঝে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ঘরের দিকে।
সে জানে না, এই নীরব অন্ধকারের মধ্যেই এক ভয়ংকর ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে…
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩)
সকালটা বেশ নীরব ছিল। রামপ্রসাদ প্রতিদিনের মতো ভোরবেলা বেরিয়ে গেছে অটো নিয়ে। কল্পনা বারান্দায় রান্না করছে—আজ খুব সাধারণ খাবার, ডাল-ভাত আর একটু আলুভাজা। সকালে খাওয়ার পর সে মন্দিরে যাবে, গত রাতের অস্বস্তি এখনো তার মনে রয়ে গেছে।
সুমন বারান্দায় এসে বসল, একমনে মায়ের রান্না করা দেখছিল। সূর্যের আলো তার মায়ের শাড়ির উপর পড়েছে, পাতলা কাপড়ের নিচে শরীরের রেখাগুলো যেন একটু বেশিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কল্পনার খেয়াল নেই, সে নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সুমন কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
তার মনের মধ্যে যে পরিবর্তন আসছে, সেটা সে নিজেও বোঝে না। মা তো মা-ই, কিন্তু কেন জানি আজকাল তার দিকে তাকালে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। ছোটবেলায় যেমন সে মাকে আঁকড়ে ধরে থাকত, এখন সেরকম কিছু মনে হয় না। বরং এক অদ্ভুত আকর্ষণ তার মধ্যে বাসা বাঁধছে।
রাতের পর রাত সে তার ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে চটি পড়ে। শুরুতে সেগুলো ছিল অচেনা নারীদের নিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেগুলো বদলে যেতে থাকে—মাসি, কাকিমা, অবশেষে ‘মা’! প্রথম প্রথম নিজেকে বুঝিয়েছে যে এসব কেবল কল্পনা, এসবের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কিন্তু যতবার সে এসব পড়েছে, ততবার কল্পনার মুখটাই ভেসে উঠেছে তার চোখের সামনে।
সে কেমন যেন উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে, আর ঠিক তখনই কল্পনা পিছন ফিরে তাকাল।
“কী রে, এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
সুমন হকচকিয়ে গেল। সে তো ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল, মা হঠাৎ কথা বলায় কেমন যেন গুলিয়ে গেল তার ভেতরটা।
“ক..কিছু না, এমনি।”
কল্পনা হাসল, কিন্তু সুমনের হাসি কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে গেল।
সে দ্রুত বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বুক ধুকপুক করছে, যেন কেউ তার গোপন চিন্তাগুলো ধরে ফেলেছে।
“আমি এভাবে ভাবছি কেন?”
নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।
“এটা তো ভুল… কিন্তু কেন মনে হচ্ছে ঠিক?”
সে জানে, মা তাকে জন্ম দিয়েছে, লালন-পালন করেছে। কিন্তু চটি বইয়ের নেশা তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে সে ফিরতে পারছে না। গতকাল রাতেও সে ঠিক এমনই একটা গল্প পড়েছে—মায়ের প্রতি ছেলের গোপন আকর্ষণ নিয়ে লেখা এক বিকৃত উপন্যাস। আজ সকালে সে যখন মাকে দেখছিল, তার মাথার মধ্যে সেই গল্পের চরিত্রগুলোই খেলা করছিল।
নিজের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরল সুমন।
“আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?”
কিন্তু তার অন্তরের গভীরে এক ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে—এই অনুভূতি সে আর চাপা দিতে পারবে না।
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রবিবার সকাল। সুমনের জন্য এটা একটা বিশেষ দিন—আজ কলেজ নেই, তাই সে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠল। উঠেই বারান্দায় গিয়ে দেখল, মা রান্না করছে। আজকের সকালে কেমন একটা প্রশান্ত পরিবেশ আছে, যেন কালকের সব দুশ্চিন্তা কোথাও মিলিয়ে গেছে।
কল্পনা ছেলের ঘুম থেকে ওঠার শব্দ পেয়ে পিছনে তাকাল।
“ওঠে গেছিস? চল, আগে মুখ ধুয়ে নে, তারপর খেয়ে নিস।”
সুমন মাথা নেড়ে স্নানঘরের দিকে চলে গেল। মুখ ধোয়ার সময় আয়নায় নিজের চেহারা দেখল—সাধারণ একটা ছেলের মতোই তো দেখতে, কিন্তু তার ভেতরে একটা গোপন দানব বাসা বাঁধছে, যা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
সে মাথা ঝাঁকিয়ে এসব ভাবনা সরিয়ে দিল।
আজকের দিনটা ভালো কাটাতে হবে।
নাস্তা করে সে পড়ার টেবিলে বসলো। আসলে পড়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মায়ের সামনে ভালো ছেলে হওয়ার একটা চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাইল।
কল্পনা একবার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল ছেলেকে। মুখে হাসি ফুটল তার।
“আজ পড়তে বসেছিস? বাহ, খুব ভালো!”
সুমন মিথ্যে হাসল। “হ্যাঁ মা, ভাবলাম একটু পড়া হয়ে যাক।”
কল্পনা আনন্দিত হল, মা তো এমনটাই চায়, ছেলে ভালো করে পড়াশোনা করুক। সে রান্নায় মন দিল, আর সুমন বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই সে বুঝতে পারল, তার মনোযোগ কোথাও আটকে আছে।
কাল রাতে সে আবারও সেই চটি বইগুলো পড়েছে, আর এখন পড়ার সময়ও সেইসব চরিত্রের চেহারাগুলো তার মনের মধ্যে ঘুরছে।
মা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত, বাতাসে তরকারির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সুমন চোখ সরিয়ে নিলো বই থেকে, চুপচাপ একবার মায়ের দিকে তাকাল।
“না, না, এসব বাদ দিতে হবে…”
সে মাথা ঝাঁকাল।
বাইরে মাঠে খেলা চলছে। বন্ধুদের ডাকাডাকির আওয়াজ আসছে। সে ভাবল, আর বসে থেকে লাভ নেই, বাইরে গিয়ে খেললেই হয়তো মনটা ঠিক হয়ে যাবে।
সে উঠে দাঁড়াল,
“মা, আমি মাঠে যাচ্ছি!”
কল্পনা হেসে বলল, “যা, কিন্তু দুপুরের আগে চলে আসিস।”
সুমন মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল।
রশিদ খানের অন্ধকার বাসনা
রশিদ খান আজ গ্রামের পাশ দিয়ে ফিরছিল। MLA হিসেবে তার কাজের জন্য গ্রামে ঘোরা-ফেরা লেগেই থাকে, কিন্তু আজ যেন তার গন্তব্যটা নিজের অজান্তেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক তখনই, রাস্তার ধারে কল্পনাকে দেখে তার চোখ স্থির হয়ে গেল।
সে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের গেটের সামনে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে, তার চেহারায় এক অপার্থিব প্রশান্তি, চোখে এক আধ্যাত্মিক দীপ্তি। লাল টিপের নিচে কপালের সামান্য ঘাম জমেছে, শাড়ির আঁচল বুকের ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, আর হাওয়ায় উড়ছে তার চুলের কিছু অংশ।
রশিদ খান যেন মুহূর্তেই একটা অন্যরকম নেশায় পড়ে গেল।
“হায় রে! এই বউটা তো আগুন! এই রূপ তো আমার ঘরে থাকার কথা!”
তার শরীর গরম হয়ে উঠল। সে নিজের ঠোঁট চাটল। এই শরীর, এই মসৃণ কোমর, এই ভারী বুক—এসব কারও ঘরের সুখের জন্য নয়, এসব রাজাদের জন্য, ক্ষমতাবানদের জন্য!
গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে জানালাটা নামাল। এবার আর সে গোপন দৃষ্টিতে দেখছিল না, বরং একেবারে ঠাণ্ডা চোখে কল্পনাকে গিলে ফেলছিল দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
কল্পনা হাঁটতে শুরু করল। সে অনুভব করল, কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল, কিন্তু ভেতরে একটা ভয় বাড়তে লাগল।
রশিদ খান গাড়ি থেকে নামল না, কিন্তু তার চোখ বলছিল—“তুই আমার হাত থেকে বেশি দূরে যেতে পারবি না, কল্পনা… খুব শিগগিরই তোর এই পবিত্রতার ওপর আমার হাত পড়বে।”
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪)
রাত তখন গভীর। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোনো কুকুর ডেকে উঠছে। রামপ্রসাদ তখন গভীর ঘুমে, সারাদিনের ক্লান্তির পর তার নিস্তব্ধ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু সুমনের ঘুম আসছে না।
সে বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই একটা মুখ ভেসে উঠছে—তার মায়ের মুখ। আজ সকালে সে ঠিকমতো খেয়াল করেনি, কিন্তু মন্দির থেকে ফেরার পর যখন মা ঘরে ঢুকলেন, তখন যেন তাকে নতুন করে দেখলো।
সাদা-লালের শাড়িতে মোড়া মা’কে ঠিক যেন কোনো দেবীর মতো লাগছিল। মাথায় ঘোমটা টানা, কপালে লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র—সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত মোহময়ী আভা। মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যখন বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়েছিল, তখনই তার গলা থেকে কোমরের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল সুমনের। সেই দৃশ্যটা তার মাথা থেকে সরছে না।
সে জানে, এটা অন্যায়… কিন্তু তবু সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না।
হঠাৎ করেই সে উঠে বসল।
তার বুকের মধ্যে অস্বস্তি, যেন কিছু একটা না দেখে থাকলে মন শান্ত হবে না।
না ভেবেই ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে এল। বাবার ঘরের দিকে একবার তাকাল, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দরজার সামনে।
ঘরের মধ্যে আলো নেই, শুধু জানালার বাইরে থেকে চাঁদের ম্লান আলো এসে পড়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সুমন দেখল—তার মা বিছানায় শুয়ে আছেন, পাশেই বাবা ঘুমিয়ে।
কল্পনার শরীরটা চাঁদের আলোয় রহস্যময় লাগছে। শাড়ির পাতলা আঁচল তার শরীরের কিছু অংশ ঢেকেছে, কিছু অংশ উন্মুক্ত।
সুমনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
সে আর একটু এগিয়ে গেল…
(চলবে…)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৬)
রশিদ খান সারা রাত ঘুমোতে পারেনি।
বিছানায় শুয়ে থাকলেও চোখের সামনে বারবার সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে—সাদা-লালের মিশেলে মোহময়ী এক নারী, মাথায় ঘোমটা, কপালে লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র।
হাজারের বেশি নারী সে ভোগ করেছে, কিন্তু আজ… আজ যেন ভেতরের পশুটি তৃপ্ত নয়। এই নারীকে না পেলে যেন শান্তি নেই!
রশিদ খান ধপ করে উঠে বসল। একটা বিড়ি ধরিয়ে দম দিতে দিতে ডানদিকে রাখা মোবাইলটা তুলল। মোবাইল হাতে নিয়েই একটা নম্বরে ডায়াল করল।
“হ্যালো, শাকিল, শুন!”
ওপাশ থেকে ভোরের ঘুমজড়ানো গলা ভেসে এলো।
“জি ভাই, কিসের এত তাড়া?”
“একটা কাজ আছে তোর জন্য… জরুরি।”
শাকিল সতর্ক হয়ে গেল, কারণ MLA রশিদ খান যখন ‘জরুরি’ বলে, তখন সেটা সাধারণত কারও জন্য ভয়ানক কিছু হতে চলেছে।
“বলো ভাই, কী করতে হবে?”
রশিদ খান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“কাল সন্ধ্যায়, ঐ গ্রামের মন্দিরের রাস্তার ধারে একটা গোলদারি দোকানের সামনে আমি একটা রত্ন দেখেছি… একেবারে খাঁটি রত্ন। সাদা-লাল শাড়ি, ঘোমটা টানা, কপালে লাল টিপ… একেবারে অপ্সরী।”
তার গলা ভারী হয়ে এল।
“আমি এই মেয়েটাকে চাই! যেকোনো মূল্যে।”
শাকিল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“ভাই, নাম জানো?”
“নাহ। জানবো কী করে? তবে বেশি দূরে না। ঐ গলির মধ্যেই থাকে, এতটুকু নিশ্চিত। কালকে দোকান থেকে বাজার করছিল। তার মানে সংসারি মেয়ে, আর বেশ দেখতে ভালো। নিশ্চয়ই বিবাহিতা।”
রশিদ খান চোখ বন্ধ করল। মনে মনে আবার সেই দৃশ্যটা এঁকে নিলো।
“তোর কাজ হলো, খোঁজ নিয়ে বের করা—ওই মাগীর নাম কী, কোথায় থাকে, আর কেমন তার সংসার।”
শাকিল একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল,
“ভাই, মেয়েটা যদি কারও বউ হয়?”
রশিদ খান এবার কটমট করে তাকাল, যেন শাকিলের এই প্রশ্নই তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।
“বউ হলে কী হয়েছে? আমি MLA, আমি যা চাই, তা পাবোই। আইন আমার জন্য নয়, বুঝছিস?”
তারপর একটু থেমে বলল,
“কাল রাতের মধ্যে খোঁজ চাই আমার সামনে।”
শাকিল মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে ভাই, আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।”
কল কেটে দিল রশিদ খান।
তার ঠোঁটে একটা বিকৃত হাসি ফুটে উঠল।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে সে জানালার বাইরে তাকাল।
এই রাতের আঁধারেই জন্ম নিচ্ছে এক অন্ধকার ছায়া, যা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চলেছে কল্পনার শান্ত জীবনকে…
(চলবে…)
অন্যদিকে, কল্পনার বাড়ি
সকালবেলা কল্পনা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠোনে গিয়েছিল। দুধ গরম দিচ্ছিল চুলায়।
পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন।
সে কিছু বলছিল না, শুধু তাকিয়েই ছিল।
তার মায়ের শরীরের প্রতিটা ভাঁজ যেন আজকাল তার কাছে অদ্ভুত কিছু মনে হয়। কিছুদিন আগেও এটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন…
মা যখন ঘোমটা সরিয়ে মাথার চুল ঠিক করে, যখন শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে পিছলে পড়ে… সুমনের বুকের ভেতরে কেমন একটা চাপ চাপ ব্যথা হয়।
সে বোঝে না, এটা কেন হচ্ছে।
সে জানে, এটা অন্যায়।
কিন্তু শরীর তো অন্য কথা বলে!
বিছানায় শুয়ে সে রাতে নিজেকেই প্রশ্ন করে—“আমি কী দানব হয়ে যাচ্ছি?”
কিন্তু উত্তর মেলে না।
সে শুধু অনুভব করে, তার রক্ত গরম হয়ে উঠছে।
একদিকে সুমন নিজের সঙ্গে লড়াই করছে, আর অন্যদিকে রশিদ খান নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।
কল্পনা জানেই না, তার চারপাশে কতটা ভয়ংকর ছায়া ঘনিয়ে আসছে…
(চলবে…)অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৩) – ছায়ার চোখ
রশিদ খানের লোক সাকিল সন্ধ্যায় ফিরে এলো, মুখে এক অদ্ভুত হাসি।
“বড় সাহেব, খোঁজ পেয়েছি!”
রশিদ খান তখন বিশাল সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল, সোনার চেন হাতে ঘুরাচ্ছিল। খবর শুনেই সে একটু সোজা হয়ে বসল।
“বলি তো, কে এই রূপবতী?”
সাকিল কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, “মহিলার নাম কল্পনা। স্বামী অটো চালায়, সারাদিন রাস্তায় থাকে। একটা ছেলে আছে, নাম সুমন, কলেজে পড়ে।”
রশিদ খান একটু ভেবে নিয়ে ঠোঁট চাটল।
“মানে বলতে গেলে, একেবারে নিখুঁত সেটআপ! স্বামী বাড়িতে নেই, ছেলে কলেজে, আর বউটা… একা!”
তার ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটে উঠল।
“সাকিল, এবার ওর উপর একটু নজর রাখ। কোথায় যায়, কখন একা থাকে, সব খবর চাই।”
সাকিল মাথা ঝাঁকাল, “হবে বড় সাহেব। আপনি জানেন, আমি কাজ করলে পুরো কাজ করি।”
অন্যদিকে কল্পনা কিছুই টের পাচ্ছে না…
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে স্বামী রামপ্রসাদ বাইরে বারান্দায় বসে পান চিবোচ্ছিল, আর কল্পনা চুপচাপ উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আজকের ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মন্দির থেকে ফেরার সময় রশিদ খানের চোখের সেই চাহনি তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি করেছিল।
সে বুঝতে পারছিল না—এটা কি শুধুই তার কল্পনা, নাকি সত্যিই তার পেছনে কিছু ঘটছে?
সুমনের পরিবর্তন
অন্যদিকে, সুমনের মধ্যেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছিল।
সেই রাতেই, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, সুমন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়ল। অন্ধকার ঘরে বসে সে অনুভব করল—তার মাথার মধ্যে কিছু চলছে, কিছু একটার আকর্ষণ যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে সে মায়ের ঘরের দিকে তাকাল…
অন্ধকার ঘরে তার মা শুয়ে আছে, ঘরের ছোট্ট মাটির প্রদীপের আলোয় কল্পনার ঘুমন্ত মুখ এক আশ্চর্য নরম আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তার সাদা-লাল শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
সুমনের শ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
তার মাথায় একটা দ্বন্দ্ব চলতে লাগল। “আমি কি ভুল করছি? এটা কি আমার মস্তিষ্কের বিভ্রম? কেন আমি এমনটা ভাবছি?”
কিন্তু সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
সে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে গেল, দরজা আটকে দিল। বুক ধুকপুক করছে।
সুমন বুঝতে পারছে না—সে কেন আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে পরিবর্তন টের পাচ্ছে। কেমন যেন এক অন্ধকার তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে…
এদিকে রশিদ খান তার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেছে।
সে জানে, কল্পনাকে সরাসরি ধরার চেষ্টা করলে ঝামেলা বাড়তে পারে। তাই সে ধৈর্য ধরে ছায়ার মতো তার জীবনে প্রবেশ করতে চায়।
আগামী কয়েকদিনে তার পা রাখা হবে কল্পনার বাড়ির খুব কাছাকাছি…
(পরবর্তী পর্বে: রশিদ খানের নতুন চাল, কল্পনার মনের অশান্তি, এবং সুমনের আরও গভীর পরিবর্তন!)
অন্ধকার ছায়া (পর্ব ৪) – ষড়যন্ত্রের জাল
কয়েকদিন কেটে গেছে। কল্পনা এখন আগের চেয়েও বেশি ধার্মিক হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সকালে সে মন্দিরে যায়, সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের সামনে বসে থাকে।
এই পরিবর্তন যেন তার সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। কল্পনার লাল-সাদা শাড়ির পরত, কপালের লাল টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র—সবকিছু মিলিয়ে সে যেন আরও মোহময়ী হয়ে উঠেছে।
রশিদ খানের নতুন ফন্দি
রশিদ খান কল্পনাকে পাওয়ার জন্য এখন আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
একদিন বিকেলে তার বিশ্বস্ত লোক সাকিল কাছে এসে বলল,
“বড় সাহেব, যদি ওর স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই তো রাস্তা পরিষ্কার! মেয়েছেলেরা তখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন যা খুশি করা যায়।”
রশিদ খান চোখ ছোট করে তাকাল, “কী বলছিস তুই? কেমন করে সরাবি ওকে?”
সাকিল ঠোঁটের কোণে একটা শয়তানি হাসি ফুটিয়ে তুলল।
“তার অটোকে ব্যবহার করেই!”
ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
পরিকল্পনা খুব সহজ, কিন্তু মারাত্মক:
• রামপ্রসাদের অটোর সামনে গিয়ে রশিদ খানের লোক এমনভাবে ধাক্কা খাবে যেন গুরুতর চোট লাগে।
• তারপর পুলিশ এসে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে কেস দায়ের করবে, এবং প্রমাণ সাজানো হবে যেন সে ইচ্ছাকৃতভাবে এক লোককে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে।
• পুলিশ তো রশিদ খানের পোষা কুকুর, তারা কেসটাকে এমনভাবে সাজাবে যেন রামপ্রসাদ দোষী হয় এবং তাকে জেলে পাঠানো যায়।
• রামপ্রসাদকে একবার সরিয়ে দিলে কল্পনা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে—তখন তাকে বশে আনা সহজ হবে!
রশিদ খান গ্লাসে এক চুমুক পানীয় নিয়ে বলল,
“ভালোই তো! এক ঢিলে দুই পাখি মারব। স্বামী সরবে, আর বউ হবে আমার!”
সাকিল হেসে বলল, “সাহেব, কিছুদিনের মধ্যে দেখবেন কল্পনা আপনার সামনে কান্নাকাটি করছে। তখন আপনি যা চাইবেন তাই হবে!”
অন্যদিকে কল্পনার জীবনে অশান্তির ছায়া
সেদিন রাতে, কল্পনা উঠোনে বসে ছিল। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, কিন্তু তার মনে একটা অজানা অস্বস্তি কাজ করছিল।
সে অনুভব করছিল, কিছু একটা খুব খারাপ হতে চলেছে…
এদিকে, সুমনের মধ্যেও পরিবর্তন বাড়ছে। সে এখন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কল্পনার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বোঝার চেষ্টা করে।
সে বুঝতে পারছে না—কেন সে এমন অদ্ভুত অনুভূতি পাচ্ছে!
কিন্তু এসব কিছুই কল্পনার জানা নেই। সে জানে না যে তার স্বামীর জন্য একটা চক্রান্ত তৈরি হচ্ছে।
পরবর্তী পর্ব: ষড়যন্ত্রের জাল
রশিদ খানের নির্দেশে তার ডানহাত শাকিল পুরো প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেছে। পরিকল্পনাটা খুবই ঠান্ডা মাথার—কল্পনার স্বামী রামপ্রসাদকে এমনভাবে ফাঁসাতে হবে, যাতে কেউ তার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে না পারে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
একদিন গভীর রাতে, রামপ্রসাদ যখন তার অটো নিয়ে যাত্রী নামিয়ে ফিরছিল, তখন রাস্তার ধারে রশিদ খানের লোকেরা ইচ্ছা করে এক ভবঘুরেকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটা এমনভাবে দেওয়া হয়, যেন মনে হয় রামপ্রসাদের অটোর ধাক্কায় লোকটা গুরুতর আহত হয়েছে।
রাস্তার আশেপাশে রশিদ খানের গুন্ডারা তখনই চিৎকার করে উঠল—
“ধরে নে! ওই অটোওয়ালা লোকটাকে মেরে পালাচ্ছে!”
আশেপাশে কিছু স্থানীয় লোক ছুটে আসে, কিন্তু পুলিশের দল ইতিমধ্যেই তৈরি ছিল। রশিদ খানের লোকেরা আগে থেকেই পুলিশকে বলে রেখেছিল, যেন তারা এসে সরাসরি রামপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়।
রাতের গভীরে পুলিশ এল, আর কোনো কথা না শুনেই রামপ্রসাদকে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে গেল।
কল্পনার জীবনের নতুন ভয়াবহ অধ্যায়
রাত তখন গভীর। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কল্পনার।
“কল্পনা দেবী, আপনার স্বামী খুব বড় অপরাধ করেছেন। দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছে। তিনি এখন থানায় আছেন।”
পুলিশের কথা শুনে কল্পনার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল।
রশিদ খানের পরবর্তী চাল
শাকিল এসে রশিদ খানের কানে কানে বলল—
“বউটা একা হয়ে গেল স্যার, এখন ওকে ভাঙতে সময় লাগবে না। একটু ভয় দেখালেই কেল্লাফতে!”
রশিদ খান একটা সিগারেট ধরিয়ে হাসল, চোখেমুখে শিকার ধরার আনন্দ।
“এবার কল্পনা আমার হবেই।”
(পরবর্তী পর্ব: কল্পনার সামনে দুটো রাস্তা—লড়াই নাকি আত্মসমর্পণ?)
পরবর্তী পর্ব: কল্পনার সংগ্রাম শুরু
সকাল হতেই কল্পনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, রামপ্রসাদ খুনের মতো কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে!
কল্পনা সোজা হরি হর কাকার কাছে ছুটে যায়। তিনি গ্রামের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, অনেক পুলিশের সাথেই তার ভালো সম্পর্ক আছে।
কল্পনা (কাঁদতে কাঁদতে): “কাকা, আমার রামপ্রসাদকে ফাঁসানো হয়েছে! পুলিশ কিছু শুনতেই চাইছে না!”
হরি হর কাকা (গম্ভীর গলায়): “এই ব্যাপারটা তো সহজ নয়। রশিদ খানের মতো মানুষ যদি পিছনে থাকে, তবে পুলিশও টাকা খেয়ে গেছে। তবু চল থানায় গিয়ে দেখি, কী করা যায়।”
থানায় তিক্ত অভিজ্ঞতা
কল্পনা আর হরি হর কাকা থানায় গিয়ে দেখে রামপ্রসাদ হাতকড়া পরে বসে আছে, চোখে ভয় আর হতাশার ছাপ।
কল্পনা (কান্নাভেজা গলায়): “ওকে ছাড়ুন! ও নির্দোষ!”
ডিউটি অফিসার ঠান্ডা চোখে তাকায়, যেন সব আগেই ঠিক হয়ে আছে।
পুলিশ: “তোমার স্বামী খুন করে পালাতে চেয়েছিল, সাক্ষী-প্রমাণ সব আছে। কেস কোর্টে যাবে, জামিন পাবার সম্ভাবনাও নেই।”
হরি হর কাকা: “তদন্ত ঠিকঠাক হয়নি, আমরা বড় সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।”
পুলিশ (হাসতে হাসতে): “বড় সাহেব তো আজ ছুটিতে, কাল আসুন। আর এইসব বেশি কথা বলার দরকার নেই, না হলে তোমাদেরও ভিতরে ঢুকিয়ে দেব!”
কল্পনার মনে একটাই প্রশ্ন—“এখন কী করব?”
অন্যদিকে রশিদ খানের ছক
শাকিল এসে রশিদ খানের কানে কানে বলল—
“মহিলাটা থানায় গেছে, কিন্তু লাভ কিছুই হবে না। পুলিশ আমাদের লোক।”
রশিদ খান মুচকি হাসে, “বউটা একা হয়ে গেছে। এবার একটু ভয় দেখিয়ে, একটু বুঝিয়ে… সময় লাগবে না।”
শাকিল জিজ্ঞেস করল, “আপনার কথার মানে?”
রশিদ খান ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কাল সন্ধ্যায় ওর বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি নিজে কথা বলব কল্পনার সাথে।”
(পরবর্তী পর্ব: রশিদ খানের চাল, কল্পনার লড়াই, আর হরি হর কাকার নতুন পরিকল্পনা!)
ঠিক আছে, আমি গল্পটিকে একটি ডার্ক থ্রিলার হিসেবে গড়ে তুলছি, যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র, এবং দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচারের চিত্র থাকবে। কল্পনার পরিবারকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচিত হবে, আর এর মধ্যে থাকবে টানটান উত্তেজনা।
আমি পরবর্তী অংশটি লিখে দিচ্ছি:
পরবর্তী পর্ব:
রাত গভীর। কল্পনা ঘরের এক কোণে বসে আছে, মাথা নিচু, চোখ দুটো যেন শুকিয়ে গেছে সারাদিনের কান্নায়। হরি হর কাকা সব চেষ্টা করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। পুলিশের হাতে রামপ্রসাদ ধরা পড়েছে, আর তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে MLA রসিদ খানের পরিকল্পনা সফলভাবে এগোচ্ছে। তার লোকেরা নিশ্চিত করেছে যে, পুলিশের রেকর্ডে ঘটনাটি ‘হিট অ্যান্ড রান কেস’ হিসেবেই নথিভুক্ত হয়েছে, আর কল্পনার স্বামীর কোনো উপায় নেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
কিন্তু এখন রসিদ খানের মাথায় নতুন চিন্তা। শুধু কল্পনার স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া তার লক্ষ্য নয়, সে কল্পনাকে পুরোপুরি নিজের দখলে আনতে চায়। তাই রাতে, সে নিজেই এল কল্পনার বাড়ির সামনে।
কল্পনা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎই বাইরের গাড়ির আলো চোখে লাগল। একটা কালো SUV এসে থামল গেটের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে নামল রসিদ খান, সঙ্গে তার দুইজন দেহরক্ষী। কল্পনার বুক ধক করে উঠল।
সে কিছু বোঝার আগেই দরজায় শক্ত করে কড়া নাড়ল কেউ।
— “খুলুন, কল্পনাদেবী… আমি রসিদ খান। কথা আছে আপনার সঙ্গে।”
বাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। কল্পনার কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরা… কী করবে এখন?