Thread Rating:
  • 47 Vote(s) - 3.17 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
এক মুঠো খোলা আকাশ
পর্ব ৯

নন্দিনী নিজের ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো। অবসর সময়ে কিই বা করবে সে। তখনও সে ঠিকমতো খেয়াল করেনি যে স্কু'ল প্রেমিসেস থেকে অলমোস্ট সবাই চলে গেছে। শুধু রিংকু ছিল, রাতে নন্দিনীর শোয়ার জন্য টেবিল ফ্যান, গদি, তোষক, চাদর, বালিশ এসব নিয়ে এসেছিলো। নন্দিনী ম্যাডামের জন্য স্কু'লেরই একটি ক্লাস রুম ফাঁকা করে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলো সে।

নন্দিনীর জন্য যে রুমটা ধার্য করা হয়েছিল সেখানে তার আর সুস্মিতার থাকার কথা ছিল। কিন্তু সুস্মিতা তো স্বাধীন পাখি, তাকে কি আর নন্দিনীর মতো খাঁচায় বন্দী করে রাখা যায়। বাইকে করে উড়ে গ্যাছে নিজের প্রেমিকের সাথে। এখন নন্দিনীকে এই গোটা রুমে একাই থাকতে হবে রাতে। ভাগ্গিস রিংকু ঘরে টেবিল ফ্যান সেট করে দিয়েছে। নাহলে এই গরমে ওই একটা সিলিং ফ্যান যা আবার এতই আস্তে ঘোরে যে রীতিমতো ফ্যানের ব্লেডের নিজ অক্ষের প্রদক্ষিণ মিনিটে কতবার হচ্ছে তা লিট্র্যালি গোনা যায়, সেরকম একটা আদিম জামানার ফ্যান দিয়ে নন্দিনীর গরম মিটতো না। বিকেল থেকেই আবহাওয়া গুমোট হয়ে আছে। একটুও বাতাস দেয়নি প্রকৃতি। সাধারণত ঝড়ের আগে এমন গুমোট অবস্থা সৃষ্টি করে প্রকৃতি জানান দেয় ঝড় আসন্ন। কিন্তু নন্দিনীর জীবনেও কি সেরকম কোনো ঝড় অপেক্ষা করেছিল? তা সময়ই বলবে।

রিংকু, ম্যাডামের শোয়ার ঘর গুছিয়ে দিয়ে বেড়োনোর তোড়জোড় করছিলো। তখন নন্দিনীর রিয়েলাইজেশন হলো যে রিংকুর বিদায়ের পর গোটা কলেজে শুধু সে আর জাহাঙ্গীরই থাকবে, আর কেউ না! এটা ভেবেই কেন জানি তার হৃদস্পন্দন উর্দ্ধগামী হলো। পুলিশগুলোও তো অনেক দূরে ছাউনি করে রয়েছে। ডাকলেও হয়তো সারা পাওয়া যাবেনা। এমনিতেও গ্রামের পুলিশ রাতের বেলা ডিউটি করার নামে এক বোতল রঙিন জল পেটে ঢেলে হয় মাতলামো করে নাহলে উল্টে পড়ে থাকে কোথাও। তাদের সাহায্য চাইলেও পাওয়া যাবেনা এই ব্যাপারে নন্দিনী নিশ্চিত। তবে শুধু জাহাঙ্গীরের সাথেই এই এত বড়ো বিল্ডিং-এ রাত কাটানো-টা কি ঠিক হবে? তাই সে ভাবলো একবার রিংকু কে বলে দেখবে যদি সেও থেকে যায়, তাহলে কেমন হয়!

"রিংকু, তুমি কি এখন বাড়ি যাচ্ছ?"

"হ দিদিমণি! এইখানকার কাইজ সব শ্যাষ হোয়েগ্যাসে...."

"তা তোমার বাড়ি কি কাছেই?"

"হ তো। স্বরূপদাহ বাজারের কাসে। ওইখান থাইক্যা তো সব নিয়া ইলাম। রমেন দার বাড়িও সেইক্ষাণে।...."

"রমেন দা মানে এই স্কু'লের যিনি পিয়ন? যিনি দুপুরে সবাইকে লাঞ্চ সার্ভ করে দিয়েছিলেন?"

"হঃ হঃ, সেই।.... চিন্তা কইরবেন না, রাতের খাবারও চলে আসতিসে। জাহাঙ্গীর ভাইজান গ্যাসেন আপনার জইন্যা খাবার আইনতে।"

"জাহাঙ্গীর নেই এখন এখানে?"

"নাঃ। উনি বইল্লেন যথক্ষণ না উনি আইসতেসেন ততক্ষইন জ্যেন আমি এইক্ক্যানে থাকি, আপনাকে পাহাড়া দেওয়ার যন্যে। তাই যাব যাব কইরাও যাইতে পারতাসিনা।"

"বাহঃ বাহঃ জাহাঙ্গীর লোকটা এতটা কেয়ারিং?", মনে মনে নন্দিনী ভাবলো। একটা হালকা অ্যাডমিরেশন জন্মালো নন্দিনীর মনে জাহাঙ্গীর-কে নিয়ে। আবার পরক্ষণে সেইসব অ্যাডমিরেশন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নন্দিনী রিংকু-কে প্রস্তাব দিলো স্কু'লে থেকে যাওয়ার।

"তা তুমি এখানেই তো আজকে থেকে যেতে পারো!"

নন্দিনী ম্যাডামের দেওয়া প্রস্তাব শুনে রিংকু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, "দিদিমণি, বাড়িতে ফুলমণি অপেক্ষা করসে। ওকে কিসু বইল্যা আসিনি জে। আপনার সিন্তা কি, ভাইজান তো থাইকবে বইলাসে আপনার সাইত্থে আজঃ।"

"হ্যাঁ, তো তুমিও থেকে যাও, অসুবিধা কি তাতে?"

"বইল্যাম না আপনারে, ফুলমণি আমার পথ চেঁয়ে রয়েসে। ওইক্যে একা ফেইল্যা রয়ে জ্যাই কি কইরা?"

"ফুলমণিটা কে? যাকে তুমি এত মেনে চলো!"

"হামার বউ হয় গো!"

"বউ!"

"হ দিদিমণি! কাল ভোট দিতা আইলে আপনার সাথে আলাপ কইরাবো।"

"তা তোমাদের বিয়ে বুঝি এই সবে হয়েছে, যার জন্য এত বউ পাগল হয়ে উঠেছো। একদন্ডও ওকে ছাড়া থাকতে চাইছো না দেখছি।.... বুঝি বুঝি, সব বুঝি। প্রথম প্রথম এসব হয়, সব স্বামীরাই প্রথম দিকে নিজের বউকে চোখে হারায়, পরে বিয়ের সব রং ফিকে হয়ে যায় আস্তে আস্তে।"

এই কথা বলে নন্দিনী কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েগেলো। তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো, অনিকেতের সাথে তার দাম্পত্য জীবনের কথা ভেবে। সেও তো প্রথমদিকে এতটাই বউ পাগল ছিল রিংকুর মতো।

"কি হইলো দিদিমণি, আপনি কি কাঁদসেন?"

নন্দিনী নিজের গালের উপর একবার হাত ঘুরিয়ে চোখের জলটাকে মুছে রিংকুর থেকে আড়াল করে বললো, "না না.... কই..... তা তুমি বললে না তো বিয়ের কতবছর হলো?"

"তা.... না না কইরা দস বসর।"

"দশ বছর?? তুমি তো আমার থেকেও ছোট!"

"হামাদের এইখ্যানে বিহা যলদি হয়া যায়। মাধ্যমিক দিতে না দিত্তে পড়াসুনা লাটে তুইল্যা সংসারের হাল ধইরতে হইলো। তারপর বাড়ি থাইক্যা বিহা দিয়া দিলো পাশের বিথারি গেরামের চাঁদ সর্দার এর মাইয়্যা ফুলমণি সর্দারের সইত! সেই থেইক্যা আমি আর ফুলমণি রয়েসি সুখে সংসার বাইধ্যে।"

"তোমাদের কোনো সন্তান নেই?"

"হ, আসে তো। তিনটা। রানি, নন্টে, ফটিক। এক মিয়্যা, দুই ছিলা।"

"মেয়ের নামটা খুব গুছিয়ে রেখেছো তো, রানী।"

"হ, রাইখবো না! উঃ হামার পত্থম সন্তান। মিয়্যা হইসে তো কি, উঃ হামার সবচে আদূরের। তাই আমি হামার নামের সব্দের সাথে মিলিয়া বেটি-টার নাম রাইখ্যাসি। র তে রিংকু, র তে রানি। উঃ কে আমি অনেক বড় কইরবু, মানুষের মতো মানুষ কইরবু। লেখাপইড়া শিখিয়া আপনার মতো দিদিমণি কইরবো। সত্যিই আপনাকে দেইখ্যা মনে বড়ো ভক্তি আসে। দেবীর মতো আপনি। ফুলমণিটা-রে বলি তুইও লেইখ্যা পড়া ফের সুরু কর। জুগ পাল্টাইসে, এখন ছিলা মিয়্যা সব সমান। সরকার কি একটা প্রকল্প বাইর করিসে য্যানো, বড়ো দের লেখা পইড়ার যন্য........." 

"উল্লাস স্কিম?"

"হ হ, ঠিক। ওই প্রকল্পে তো বড়রাও পইড়তে পারে সুনেসি!"

রিংকু ঠিকই বলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন সাক্ষরতা অভিযানের অন্তর্গত একটি প্রকল্প হলো উল্লাস স্কিম! এই প্রকল্পে পনেরো বছরের উর্দ্ধে বিশেষত প্রাপ্তবয়স্ক-দের নতুন করে পড়াশুনা শুরু করার সহায়তা করা হয়। নন্দিনীর কলেজেও এই স্কিম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। নন্দিনী সমেত আরো কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে নিবেদন করা হয়েছে তারা যেন ভলিন্টিয়ারিলি এই স্কিমের সাথে যুক্ত হন, এবং গ্রামে গঞ্জে গিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে আসেন যেন তারা। বিষয়টা এখনও প্রধান শিক্ষকের বিবেচনার অধীনে রয়েছে, ইমপ্লিমেন্ট করেননি তিনি।

এই স্কিমটা তার স্কু'ল কর্তৃক ইমপ্লিমেন্ট করা হবে কিনা তা জানা নেই তবে রিংকুর তার বউকে এই স্কিমের আন্ডারে পড়ানোর তাগিদ দেখে নন্দিনীর সত্যিই খুব ভালো লাগলো। অনেক অভিজাত পরিবারে শিক্ষার আলো পৌঁছলেও স্ত্রী জাতিকে সমান অধিকার ও সম্মান দেওয়ার বোধটা হয়তো এখনও পুরোপুরি পৌঁছয়নি। উদাহরণ তার নিজের শশুড়বাড়িই। অথচ সুদূর বর্ডার সীমান্তে এই অঁজ গাঁয়ে এক রিকশাচালক নারী শিক্ষা ও অধিকারের মর্ম বুঝতে পেরেছে।

নন্দিনী মনে মনে ভাবলো কোনোদিনও যদি উল্লাস স্কিম ইমপ্লিমেন্ট করতে বা অন্য কোনো শিক্ষা-সম্বন্ধিত রাজ্যস্তরে প্রকল্পের অধীনে তাকে ফের হাকিমপুর গ্রামে আসতে হয়, তাহলে সে আবার আসবে। অন্য কোনো তাগিদে বা টানে নাহলেও, শুধু এই রিংকুর স্ত্রী ফুলমণি-কে লেখাপড়া শেখাতে সে নিশ্চই আসতে চাইবে বারংবার ফিরে ফিরে। 

রিংকুর সরলতা ও স্ত্রীয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে নন্দিনী এতটাই প্রভাবিত হয়েগেছিলো যে সে আর রিংকুকে জোর করলো না স্কু'লে থেকে যাওয়ার জন্য। শুধু নির্দেশ দিলো কাল যেন সস্ত্রীক তাড়াতাড়িই ভোটটা দিতে চলে আসে। সাথে স্বরূপদাহ বাজারের যত বাসিন্দা রয়েছে তাদেরকেও যেন দায়িত্ব নিয়ে রিংকু ভোট দেওয়াতে নিয়ে আসে। প্রিসাডিং অফিসার হিসেবে সে চায় এইবারের হাকিমপুর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেন হাইয়েস্ট ভোটার টার্নআউট হয়।

নন্দিনী রিংকু-কে ছুটি দিয়ে দিতে চাইছিলো কিন্তু সে বললো যতক্ষণ না ভাইজান আসছে ততোক্ষণ সে তার দিদিমণিকে একা ফেলে চলে যেতে চায়না। রিংকুর মুখে বারবার জাহাঙ্গীরকে ভাইজান বলে অভিবাদন করতে শুনে নন্দিনীর মনে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কৌতূহল জাগলো। কে এই জাহাঙ্গীর আসলে? যার এত মাননি গন্নি রয়েছে নিজের গ্রামে সামান্য এক ভূগোলের টিচার হয়েও! দাপট এমন যেন সে-ই পঞ্চায়েত ও গ্রামের প্রধান! তাই জাহাঙ্গীরের বিষয় খুঁটিনাটি জানতে নন্দিনী উদ্যত হচ্ছিলোই কি ঠিক তখুনি জাহাঙ্গীর রুবেল হাসানের আগমণ ঘটলো স্কু'ল চত্বরে। ব্যাস! আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা হলো না নন্দিনীর। আপাতত জাহাঙ্গীর নামক রহস্যময় এই লোকটা তার কাছে রহস্যই থাকলো। দেখা যাক পরবর্তী পর্বে এই রহস্যময় পার্সোনালিটির কোনো রহস্য উন্মোচন হয় কিনা!......
Like Reply


Messages In This Thread
RE: এক মুঠো খোলা আকাশ - by Manali Basu - 18-02-2025, 06:39 PM



Users browsing this thread: 5 Guest(s)