Thread Rating:
  • 47 Vote(s) - 3.17 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
এক মুঠো খোলা আকাশ
#51

নন্দিনীর বাপেরবাড়ি কাঁচড়াপাড়ায়। মফস্সল এলাকায় থাকলেও তার পরিবার অনিকেতের শহুরে পরিবারের থেকে অনেক বেশি উদার ছিল। নন্দিনীর পড়াশুনা, বেড়ে ওঠা সেখানেই। কাঁচড়াপাড়া কলেজ থেকে স্নাতক, এবং কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ ইংরেজিতে। দ্বাদশ শ্রেণী অবধি সে গার্লস স্কু'লে পড়েছে, কিন্তু কলেজ জীবনের ফ্রেন্ড সার্কেলে ছেলে মেয়ে উভয়েরই উপস্থিতি ছিল, তবুও কখনো বেপরোয়া লাইফস্টাইল নিজের জন্য বেছে নেয়নি সে।

কলেজ জীবনে নন্দিনী অনেক স্মার্ট চটপটে ছিল। ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলতো। বাকি মেয়েদের মতোই জিন্স টপ পড়তো। কিন্তু বিয়ের পর সব বন্ধ হয়েগেলো। শাশুড়ি মা-র্ নির্দেশে শাড়ি পড়া শুরু হলো। তারপর আর জিন্স টপ পড়া হয়নি, কলেজ জীবন ফিরে দেখা হয়নি। শাড়ি ব্যাতিত অন্য কিছু পড়া বারণ ছিল অনিকেতের বাড়ির বউয়ের।

মা বাবা যখন বিয়ের সম্বন্ধ দেখছিলো তখন সে স্কু'ল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বসে। পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো চাকরি পরীক্ষার ফলাফল বেড়োতে বছর পার হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। বিয়ের পর সে চাকরিটা পায়। কলকাতার মধ্যে এবং স্কু'ল টিচারের চাকরি বলে শশুড়বাড়ির কেউ আর বাধা দেয়নি।

তবে চাকরি পেয়েই তার জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। কর্মক্ষেত্রেও তাকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। স্কু'লটা বাংলা মিডিয়াম হলেও কো-এডুকেশন। ফলে টিচিং ফ্যাকাল্টি-তে শিক্ষক-শিক্ষিকা উভয়েরই নিয়োগ রয়েছে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, তারপর স্কু'ল যেখানে সে শিক্ষকতা করে, সবজায়গায় কেউ না কেউ থাকতোই লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে। ছলে বলে কৌশলে কাছে আসার প্রচেষ্টা চলতো এবং এখনো চলে।
 কলেজেও এরকম ভাবেই নন্দিনী একটি ছেলেকে কষিয়ে চড় মেরেছিলো তার সাথে অসভ্যতা করতে চাওয়ার জন্য। তাই জাহাঙ্গীর-কে প্রশ্রয় না দিয়ে উল্টে চড় মারাটা তার কাছে নতুন কিছু ছিলোনা। সে আগেও এভাবে সকলের নিষিদ্ধ কামনা-কে প্রতিহত করে নিজেকে পবিত্র করে রেখেছে।

--------------------------------------------------------

জাহাঙ্গীর-কে চড় মেরে টিচার্স রুম থেকে বেড়োলো নন্দিনী। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা পাশের রুমে পৌঁছে সুস্মিতা যেখানে বসেছিলো সেখানে গিয়ে তার পাশে বসলো।

"কিরে, তোর প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গেছিলিস?", মুচকি হেসে সুস্মিতা জিজ্ঞেস করলো।

নন্দিনী তখন মজা করার বা সওয়ার মুডে ছিলোনা। তবু সে অতো রিএক্ট করলো না, পাছে চারিপাশে থাকা মানুষজনের কেউ যদি সঠিক আন্দাজ করে ফেলে তার আর জাহাঙ্গীরের মধ্যে ঘটে যাওয়া শীতল যুদ্ধের ব্যাপারে! তাই সে শুধু বিরক্তির স্বরে তুচ্ছতাচ্ছিলো করে উত্তর দিলো, "ধুড়ড়ঃ!! তোর যত্তসব বাজে কথা"

"তাহলে কি করতে গেছিলি আবার?", সুস্মিতা প্রশ্ন করে খোঁচা দিলো।

"আমি তো........" প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে পড়লো, যে কাজের জন্য সে গেছিলো সেটাই তো হয়নি! তার ফোন! সেটা তো খুঁজে পেলোনা! তাহলে কি সে আবার যাবে একবার? নাহঃ নাহঃ, আবার গেলে যদি জাহাঙ্গীর ধরে। সে ভাবতেই পারে তার টানে ফিরে এসছি। উৎসাহ পেয়ে যাবে তখন। .....

নন্দিনী-কে চিন্তামগ্ন দেখে সুস্মিতা আবার জিজ্ঞেস করলো, "কিরে? বললিনা তো, তাহলে কেন গেছিলিস?"

"কি..... ক্কি.. কিছুনা.. ওই কয়েকটা সই-সাবুত বাকি ছিল সেটা ভুলে গেছিলাম করতে, তাই যেতে হলো আবার"

ফোনের কথাটা ইচ্ছে করে বললো না, নাহলে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করতো। ফোনটা পেয়েছিস কিনা? পাসনি যখন তখন কোথায় গেলো? এতক্ষণ সময় কেন লাগলো ওখানে? জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞেস করেছিলিস কিনা ফোনের ব্যাপারে? কেন সাহায্য চাসনি ওর কাছ থেকে? সে (সুস্মিতা) কি সাহায্য করতে যাবে খোঁজার জন্য? ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ফোন খুঁজতে যদি নন্দিনী সুস্মিতাকে নিয়ে যায় তাহলে না জানি জাহাঙ্গীর কি না কি বলে বসবে। সবই তো আনপ্রেডিক্টবেল লাগছিলো অনুরিমার এই হাকিমপুর গ্রামে এসে। ধুর!! বিরক্ত হয়ে গেলো মনে মনে নন্দিনী! ......

"হুমঃ!! বুঝি বুঝি, সব বুঝি! সই সাবুত কি পরে করা যেতোনা? আসলে তুই জাহাঙ্গীরকে ডাকতে গিয়েছিলিস খাওয়ার জন্য, এটা বললেই হয়। নাহ আমি এটা বলছি না যে তুই অন্য কোনো বিশেষ টানে গেছিলিস, আসলে প্রিসাইডিং অফিসার ম্যামের তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি, এটা দেখার যে তার সকল সহকর্মী ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, আরো কত কি.... হি হি হি হি!...."

সুস্মিতা ক্রমাগত নিজের বান্ধবীর লেগ পুল করছিলো। নন্দিনীর তাতে একেবারেই ভালো লাগছিলো না। অন্য সময় হলে তাও হালকা মেজাজে সয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু সে-ই জানে কিছুক্ষণ আগে টিচার্স রুমে তার সাথে ঠিক কি হতে যাচ্ছিলো! তাই সে না পারতে অবশেষে সুস্মিতাকে হালকা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। সুস্মিতা নিজের বান্ধবীকে ভালো মতো চেনে। অনেকদিন ধরে একসাথে দুজনে শিক্ষকতা করছে। তাই নন্দিনী কখন খোঁচে যায়, আর কখন সত্যিই সে রাগ করে বসে সেই মেজাজের ফারাকটা নন্দিনীর রিঅ্যাকশনে বোঝে সুস্মিতা।

নন্দিনী যে কোনো একটা ব্যাপারে খুব আপসেট হয়ে আছে সেটা নন্দিনীর থেকে ধমক খাওয়ার পর সুস্মিতা তখন বুঝতে পারলো। আর সেই আপসেটটা যে দ্বিতীয়বার টিচার্স রুমে গিয়ে ফেরৎ আসার পর হয়েছে সেটাও সে বুঝেছে। সুস্মিতা ভাবলো ওই রুমে তো জাহাঙ্গীর ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। তবে সে কি কিছু করেছে? এক গভীর রহস্য দানা বাঁধলো সুস্মিতার মনে। 

তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করে নন্দিনী ফের দৌড় লাগালো টিচার্স রুমের দিকে। সবার অলক্ষ্যে সুস্মিতাও ওর পিছু নিলো, বিষয়টা খতিয়ে দেখতে। টিচার্স রুমে ঢুকে নন্দিনী দেখলো সেই একইভাবে জাহাঙ্গীর ঠাঁয় বসে রয়েছে তখন থেকে, না খেয়ে না দেয়ে। নন্দিনী গম্ভীরভাবে জাহাঙ্গীর কে জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি আমার ফোনটা দেখেছেন?"

জাহাঙ্গীর কে আবার নিজের চেয়ার থেকে উঠতে দেখে নন্দিনী ঘাবড়ে গেলো। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবেনা তো এই লোকটা? ভেবে আঁতকে উঠলো! কিন্তু তারপরই নিজেকে সামলে নিলো মনে মনে রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলির কবিতা স্মরণ করে --

"বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।"

নন্দিনী এবার আগের থেকে অনেক বেশি দৃপ্ত ও প্রস্তুত ছিল, সকল অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য। তবে জাহাঙ্গীরের মুড ততোক্ষণে বদলে গেছিলো। সে বুঝেছিলো এভাবে নন্দিনীকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বাগে আনা যাবেনা। অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। তাই সে নম্রভাবে নন্দিনীর কাছে এলো, প্রথমে ক্ষমা চাইলো পূর্বের ঘটনার জন্য। তারপর পকেট থেকে নন্দিনীর ফোনটা বের করে তার হাতে তুলে দিয়ে বললো, এটা নন্দিনী প্রথমবার টিচার্স রুম থেকে বেড়োনোর সময়ে টেবিলেই ভুলে রেখে গেছিলো। জাহাঙ্গীর তখন ফোনটা নিজের জিম্মায় নিয়েছিলো যাতে এরকম জায়গায় কোনো অচেনা অজানা কারোর হাতে এটা না পরে।

জাহাঙ্গীরের খিদে ছিলোনা বলে সে লাঞ্চ করতে যায়নি। তবে সে নন্দিনীকে পরে সময় সুযোগ পেয়ে ফোনটা ঠিক হ্যান্ডওভার করে দিতো। তার আগেই নন্দিনী ম্যাডাম টিচার্স রুমে ফেরৎ আসেন ফোনটা খুঁজতে। কিন্তু তখন হঠাৎ জাহাঙ্গীরের মাথায় দুস্টু বুদ্ধি খেলে এবং সে সেই বোকামিটা করে ফেলে। অতিথি সমান প্রিসাইডিং অফিসার ম্যাডামের সাথে ফ্লার্ট। নন্দিনী ম্যাডাম সেটাকে ভালোভাবে না নিয়ে তাকে চড় কষিয়ে চলে যায়। তারপর আর ফোনটা দেওয়া হয়না।

জাহাঙ্গীর এভাবে নন্দিনীর কাছে পুরো ঘটনাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে বিবরণ দিতে লাগলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য। বারবার নিজের কৃতকর্মের জন্য নন্দিনীর কাছে ক্ষমা চাইছিলো। বোঝাতে চেষ্টা করছিলো যে ওর কোনো ডেভিল ইনটেনশন ছিলোনা। সে জাস্ট একটু মজা করছিলো। জাহাঙ্গীরের পীড়াপীড়িতে অবশেষে নন্দিনী তার কথা মেনে নেয় এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়। সাথে এটাও বলে যে এরকম মজা জাহাঙ্গীর পূনরায় যেন না করে তার সাথে।

এই নির্দেশ দিয়েই নন্দিনী নিজের ফোনটা নিয়ে টিচার্স রুম থেকে বেড়োতে যাচ্ছিলো। কিন্তু একবার ফিরে সে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো সে লাঞ্চ করবে না? জাহাঙ্গীর উত্তর দিলো যে প্রথমে তার খিদে ছিলোনা তাই সে বাকি সকলের সাথে পাশের রুমে যায়নি। তার উপর নন্দিনী ম্যাডামের কাছ থেকে চড় খেয়েও তার যথেষ্ট পেট ভরে গেছিলো..... এই কথা শুনে নন্দিনী হেসে ফেললো। মজা করে বললো, "তা শুকনো চড়ে কি চিঁড়ে ভিজলো, নাকি গামছা ভিজিয়ে উত্তম মদ্ধম দিতে হবে??"

নন্দিনীর কথায় জাহাঙ্গীরও হেসে ফেললো। বললো, "না না, চিঁড়ে ভিজলেও হজম হয়নি। খিদে এখন রয়েছে তবে সেটা খাবারের। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ পাবো, কখন আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো। তারপর লাঞ্চ করবো। নাহলে গলা দিয়ে খাবার নামবে না।"

জাহাঙ্গীরের কথা শুনে নন্দিনী আপ্লুত হলো। ভাবলো এতটা গিল্ট ফিলিং কাজ করছিলো ওর মধ্যে! তার মানে লোকটা অতটাও খারাপ নয় যতটা ভেবেছিলাম। সুন্দরী মেয়ে দেখে পা পিছলে গেছিলো আর কি। তার অনেক পুরুষ সহকর্মী তথা সহ-শিক্ষক এনিয়ে বিনিয়ে অনেক টিস্ করে কথা বলে তার সাথে। তারা শহুরে বলে কথার মার্ প্যাঁচ ভালো জানে। তাই কোনটা তাদের ইভ টিজিং, কোনটা ফ্লার্ট সত্যিই সেটা বোঝা দায়। কিন্তু জাহাঙ্গীর ছা পোষা একটা গ্রামের লোক। সে কথার উপর কথা বুঁনে সাজিয়ে বলতে পারে না। মনের উত্তেজনা বেড়ে গেলে এবং হাতের নাগালে সেই পছন্দের মানুষটাকে পেয়ে গেলে অজান্তেই তারা নিজেকে সামলাতে না পেরে কুপ্রস্তাব দিয়ে ফেলে সরাসরি। এটাই শুধু পার্থক্য শহর ও গ্রামের "প্রেমিকদের"। তাই এটা জাহাঙ্গীরের লঘু পাপই বটে। সেই কারণে তাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে লাভ নেই।

নন্দিনী যাওয়ার আগে শুধু সাবধান করে দিয়ে জানালো, সে কিন্তু খুব কড়া প্রিসাডিং অফিসার তাই তাকে যেন সবাই সমঝে চলে, সেটা লোকাল লোক বলে জাহাঙ্গীরকেই নিশ্চিত করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত এবার যেন জাহাঙ্গীর লাঞ্চটা সেরে নেয়। নাহলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। বলে নন্দিনী রুম থেকে বেড়োতে লাগলো। নন্দিনীকে রুম থেকে বেড়োতে দেখে সুস্মিতা, যে এতক্ষণ আড়িপেতে জাহাঙ্গীর ও নন্দিনীর সবকথা শোনার চেষ্টা করছিলো, সে সজাগ হয়েগেলো। চটজলদি সে দরজার পাশ থেকে সরে দূরে চলে গেলো যাতে নন্দিনী বেড়োনোর সময় বুঝতে না পারে তার বান্ধবী সুস্মিতা কাছে পিঠেই ছিল এবং তার কথা লুকিয়ে চুড়িয়ে শোনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো।

ব্যর্থ চেষ্টা কারণ সুস্মিতা সেই অর্থে কিছু ঠাহর-ই করতে পারলো না ঠিক কি হয়েছিল ওদের মধ্যে। শুধু এইটুকু বুঝলো যে কোনো একটা কারণে তার বান্ধবী জাহাঙ্গীরকে কষিয়ে চড় মেরেছিলো, আর জাহাঙ্গীর নন্দিনীর কাছে অনবরত ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিলো। তবে কি তার অনুমানই ঠিক? জাহাঙ্গীর কোনোপ্রকার অসভ্যতামো করেছে নন্দিনীর সাথে? করলেও ঠিক কতোটা? এতটা দুঃসাহস সেই লোকটার! যতোই হোক নন্দিনী তার বেস্ট ফ্রেন্ড! হালকা ফুলকা ফ্লার্টিং করা ঠিক আছে কিন্তু তা বলে একেবারে মোলেশটেশন! নাহঃ! এটা তো মেয়ে হিসেবে সেও কিছুতে মানতে পারবে না। নন্দিনীকে এই বিষয় নিয়ে ডাইরেক্ট কথা বলতে হবে, জানতে হবে এক্সাক্টলি তখন টিচার্স রুমে হয়েছিলটা কি?? মানছি এটা জাহাঙ্গীরের এলাকা। তাই বলে সে যা ইচ্ছা তাই করে পার পেয়ে যাবে? তাও একটা মেয়ের সাথে! সেটা ভাবলে সে ভুল করবে! মারাত্মক ভুল!

সুস্মিতা মনে মনে এসব ভেবে রাগান্বিত হচ্ছিলো, কি ঠিক সেই সময়ে সুস্মিতার ফোনে কল এলো। তড়িঘড়ি সে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে কল-টা রিসিভ করলো। কল-টা ছিল তার প্রেমিক অঙ্কিতের, স্বামী সুমনের নয়। দূর থেকে নন্দিনী তার বান্ধবীকে দেখলো, ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। একবার ভাবলো জাহাঙ্গীরের ব্যাপারটা সে শেয়ার করবে কিনা সুস্মিতার সাথে। এখানে আপন বলতে এখন সেই শুধু। জাহাঙ্গীর যদিও বা নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে তবু ভরসা নেই, আবার যদি তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়! তাই সুস্মিতার সাথে এই ঘটনা শেয়ার করাটাই ভালো। এই ভেবে নন্দিনী সুস্মিতার দিকে এগোতে থাকলো। 

নন্দিনী খেয়াল করেছিলো তার বান্ধবী এত রোদেও স্কু'ল প্রাঙ্গনে সবার অলক্ষ্যে দূরত্ব বজায় রেখে ফোনে কথা বলছে। সুস্মিতার কথোপকথনের ভঙ্গিমা দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো ফোনের ওপারে যিনি রয়েছেন সেটা ওর স্বামী নয়। সুমনের সাথে হেসে এত ভালো করে কখনো কথা বলেনা সুস্মিতা। নন্দিনী তার বান্ধবীকে চেনে। এ নির্ঘাত সেই লোফার অঙ্কিত টাই, যার সাথে সুস্মিতা কথা বলছে।

"উফ্ফ্ফ্হঃ!! এই মেয়েটা দেখছি নিজের সংসারটা ভেঙেই ছাড়বে", মনে মনে ভেবে সুস্মিতার দিকে যাচ্ছিলো নন্দিনী। নন্দিনীকে আসতে দেখা মাত্রই সুস্মিতা চট করে ফোনটা কেটে দিলো। নন্দিনী বান্ধবীর কাছে গিয়ে বললো, "কিরে, এত রোদে সবার থেকে আলাদা হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? অঙ্কিতের সাথে কথা বলছিলিস বুঝি?"

"সবই তো জানেন প্রিসাইডিং অফিসার ম্যাডাম, তাও কেন জিজ্ঞেস করছেন?"

"করছি কারণ তোকে সাবধান করার জন্য। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমি তোর খারাপ কখনোই চাইবো না নিশ্চই!"

"সত্যি তুই আমাকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবিস?"

"হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ আছে?"

"ওকে, তাহলে বল ওই জাহাঙ্গীরের সাথে তোর এক্সাক্টলি কি হয়েছে? তুই প্রথমে লাঞ্চ করতে এলি, তারপর হঠাৎ উঠে গিয়ে টিচার্স রুমে চলে গেলি। ওখান থেকে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলি। সারাক্ষণ তোর মুড অফ ছিল। আমাকে বেকার ধমক দিলি! প্রথমে বললি কিছু সই-সাবুত করতে গেছিলিস। ঠিকমতো লাঞ্চ করলি না। তাই একটু চেপে ধরায় বললি, ফোন ফেলে এসে ছিলিস তাই খুঁজতে গেছিলিস। কিন্তু খুঁজে পাসনি। তাই আবার লাঞ্চ শেষে টিচার্স রুমে যাবি। আমি চাইলাম যেতে তোর সাথে তুই সঙ্গ নিলিনা। এখন দেখছি তোর হাতে ফোন অর্থাৎ পেয়েছিস অবশেষে। কিন্তু এই গোটা সময়টা জুড়ে জাহাঙ্গীর টিচার্স রুমেই ছিল। প্রথমবার ফোন খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে ফেরার পর তোকে কিছু একটা নিয়ে খুব আপসেট হয়ে থাকতে দেখেছিলাম! এখন অবশ্য ঠিক লাগছে তোকে, কিন্তু তখন কি হয়েছিল? বল না রে!.... কি হয়েছে তোর আর জাহাঙ্গীরের মধ্যে?.... হ্যাঁ রে, জাহাঙ্গীর কি তোর কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে? প্লিজ বল! দেখ আমি কিন্তু তোকে সব কথা শেয়ার করি, তুই করবি না ?"

আসলে সুস্মিতা বাইরে থেকে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলেও সেরকম কিছু শুনতে পায়নি। শুধু শুনতে পেয়েছে যে নন্দিনী নাকি জাহাঙ্গীরকে কষিয়ে একটা চড় মেরেছিলো! আর জাহাঙ্গীর ওকে ওর হারিয়ে যাওয়া ফোনটা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলো। কিন্তু নন্দিনী জাহাঙ্গীরকে চড় মারলোই বা কেন ? সামান্য ফোন খোঁয়া যাওয়ার জন্য তো মারবেনা! কি এমন করেছিলো ওই জাহাঙ্গীর যার জন্য চড় মারার সিচুয়েশন এসে পড়লো? সুস্মিতার মনে বারবার একই খটকা লাগছিলো। সেই জন্যই সুস্মিতা অত্যুৎসাহী হয়ে উঠলো সবটা জানার জন্য!

এদিকে নন্দিনীও বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো। বুঝতে পারছিলোনা সে আদেও এসব কথা সুস্মিতাকে বলবে কিনা? সুস্মিতা যা চালাক চতুর মেয়ে, ওর কাছ থেকে কিছু লুকোনোও তো মুশকিল! পাছে কৌতূহলের বশে যদি সে ডাইরেক্ট জাহাঙ্গীরকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে বসে?? নন্দিনীর তা ভাবলেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। কারণ খবর চাউর হতে গ্রামে বেশি সময় লাগেনা। যতই হোক নন্দিনী একজন মেয়ে। আর গ্রামবাংলার দিকে খাপ পঞ্চায়েত বসে, শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই কারণে-অকারণে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য। "যেন যত দোষ নন্দিনী ঘোষ!"..

নাহঃ! সুস্মিতাকে এসব নিয়ে রায়েতা ফেলানোর আগেই নন্দিনীকে সামলাতে হবে সবকিছু। কিন্তু কিভাবে? সত্যিটা বলে? নাকি বানিয়ে গল্প দেবে কমপ্লিকেশন এড়াতে। তাছাড়া জাহাঙ্গীর তো ক্ষমা চেয়েই নিয়েছে। তাহলে এত জলঘোলা করে কি লাভ? মনে মনে ভাবলো নন্দিনী।

"ওহঃ, কিছুনা। তেমন সিরিয়াস কিছু হলে আমি তোকে নিশ্চই জানাবো, ডোন্ট ওয়ারী! যতক্ষণ আমি সব সামলে নিতে পারছি ততোক্ষণ আমাকেই সামলাতে দে, নাহলে তো তুই আছিস, আমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য।"

নন্দিনীর এই কথা শুনে সুস্মিতা একটু ইমোশনাল হয়ে গেলো। তার বান্ধবী তাকে যতটা ভরসাযোগ্য বলে মনে করে ততোটা আর কেউ মনে করেনা। তার স্বামীও নয়। তাই জন্যই তো সে এই ভুল পথটা ভুল জেনেও বেছে নিয়েছে, পরকীয়ার পথ। নাহলে কোনো বিবাহিতা মেয়ে কি ইচ্ছে করে নিজের বিবাহিত জীবন বাজি রাখতে চায়? একজন পুরুষের জন্য পরকীয়া যৌনলালসার জন্য হয়, তবে স্ত্রী পরকীয়া করে মানসিক সুখ না পেলে।

যাই হোক সুস্মিতা ভাবলো এখন আর চড় মারার প্রসঙ্গটা না তোলাই ভালো। সে যে জানে নন্দিনী জাহাঙ্গীরকে চড় মেরেছিলো সেটা গোপন করে গেলো। ভাবলো নন্দিনী যখন বলছে এই বিষয়টা সে একাই দেখে নিতে পারবে তাহলে নিশ্চই সেই সাহসটা ওর মধ্যে রয়েছে। এমনি এমনি তো সরকার ওকে একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসার করে পাঠায়নি! নিশ্চই কোনো গুণ দেখেছে, নাহলে তো সেও হতে পারতো অফিসার। একই বছরে জয়েনিং, একইসাথে দুজনে শিক্ষকতা করে, তাও! মনে মনে হালকা হলেও সুস্মিতার সেই নিয়ে নন্দিনীর উপর ঈর্ষা রয়েছে বৈকি!

এছাড়া সুস্মিতা আরো ভাবলো, সে দরজার আড়াল থেকে একটা বিষয় খেয়াল করেছিল যে জাহাঙ্গীর ক্রমাগত কোনো একটা বিষয় নিয়ে নন্দিনীর কাছে ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিলো। তার মানে জাহাঙ্গীর যাই করে থাকুক না কেন তা নিয়ে সে অনুশোচিত। তাই বিষয়টা নিয়ে অতো পর্যালোচনার দরকার এখনই আছে বলে আর মনে করলো না সুস্মিতা।

নন্দিনী কথা ঘোরানোর জন্য অঙ্কিতের প্রসঙ্গটা তুললো, "বাই দা ওয়ে, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তুই কেন আমার সাথে হাকিমপুরে আসার প্ল্যানটা ক্যানসেল করলি? ওই অঙ্কিতের জন্য?"

সুস্মিতা তখন নন্দিনীর হাত ধরে স্কু'ল বিল্ডিংয়ের একটা কোণে ছায়ার তলায় নিয়ে গেলো যাতে তাদের প্রাইভেট টক্ পাঁচ-কান না হয়। নন্দিনীকে একটু নিরিবিলিতে নিয়ে এসে তারপর সুস্মিতা বললো, "নন্দিনী, তুই তো জানিস অঙ্কিত কতোটা আমাকে চায়, আই মিন সময় কাটাতে, একসাথে। .... ও চাইছিলো আমাকে বাইকে করে ড্রপ করে দিয়ে যাবে। তাই কাল রাতে ম্যাসেজ করলো, আর আমি তক্ষুনি রাজি হয়েগেলাম। সুমন আর ওর বাড়ির লোক জানতো আমি তোর সাথে যাবো। সেই বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম। সকাল থাকতে একটু আগেই বেড়িয়েছিলাম। ট্যাক্সি নিয়ে মেট্রো সিনেমার সামনে এলাম। সেখানে অঙ্কিত বাইক নিয়ে আমার জন্য ওয়েট করছিলো। ব্যাস! আমি ওর সাথে চলে এলাম।....."

"সুস্মিতা তুই বুঝতে পারছিস তুই কি করছিস? আগুন নিয়ে খেলছিস তুই? যেদিন সুমন জানতে পারবে সেদিন যে কি হবে সেটা ভেবেই আমি বারবার শিউরে উঠি!"

"ডোন্ট ওয়ারী ডার্লিং! ঠিকমতো বুদ্ধি খাটিয়ে পরকীয়া করলে স্বামীরা কখনোই জানতে পারেনা। হাসবেন্ড ডাসেন্ট নোও (Husband doesn't know)!"

"husband doesn't know!"

"ইয়েস বেবি! তাই জন্যই তো তোকে বলছি জাহাঙ্গীর যদি সেরকম কিছু না করে থাকে তাহলে তুইও একটা চান্স নিতে পারিস।"

জাহাঙ্গীরকে নন্দিনীর সামনে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কাকুতিমিনতি করে ক্ষমা চাইতে দেখেছিল সুস্মিতা। তাই পরে সে ভাবলো যে মানুষটা এইভাবে নন্দিনীর লিট্রেয়ালি পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইছে, সে পূর্বে আর যাই করে থাকুক না কেন ভবিষ্যতে নন্দিনীর কোনো ক্ষতি করার কথা ভাববেনা। অন্য কোনো কারণে নাহলেও, শুধু ভালো লাগার তাগিদেই গুন্ডার মতো দেখতে লোকটা নন্দিনীর প্রতি সদাই তুলোর মতো নরম থাকবে। আর নন্দিনী থাকবে ডোমিনেন্ট পজিসনে। সেই কারণেই সুস্মিতা এত কিছু হওয়ার পরেও নন্দিনীকে আবার উস্কাতে শুরু করলো এসব নিষিদ্ধ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য।

"আমার কোনো দরকার নেই এসব চান্স নেওয়ার। আমি অনিকেতের বউ হয়েই সুখে আছি।"

"আমিও তো সুখে থাকতে চেয়েছিলাম নন্দিনী। আজ যদি সুমন আমার দিকে নজর দিতো আমি কি ওই অঙ্কিতকে পাত্তা দিতাম! সুমন সবদিক থেকে ওর থেকে অনেক বেটার। কিন্তু স্বামীদের টাইম-ই হয়না নিজেদের স্ত্রীয়ের দিকে নজর দেওয়ার। তোকেই দেখ না, তোর অবস্থাও কিন্তু একইরকম। আমি যতদূর দেখেছি অনিকেতও তোর দিকে খুব একটা নজর দেয়না। সবসময়ে মায়ের কথায় ওঠে ও বসে। কিন্তু তুই একটা মিথ্যে অবয়ব তৈরী করে রেখেছিস তাই। আমি এরকম কম্প্রোমাইস করে সুখে থাকতে চাইনা।"

অনিকেত কে নিয়ে সুস্মিতা যে কথা গুলো বললো সেগুলো একেবারে ফেলে দেওয়া যায়না। তবু করারই বা কি আছে নন্দিনীর? সে সুস্মিতার মতো অতো ডেয়ারিং হতে পারবেনা। সুস্মিতা তাকে জানায় যে অঙ্কিত তাকে আজ বিকেলে নিয়ে যাবে। ওর নাকি বশিরহাটেই মামারবাড়ি। তাই জায়গাটা ওর ভালোমতো চেনা। সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মামার বাড়ি যাবে বলে। কিন্তু আসল মতলব সুস্মিতার সাথে থাকার। তাই মামারবাড়িতে স্টে করেছে। সেখান থেকে এসে সুস্মিতাকে নিয়ে কোথাও একটা যাবে। নন্দিনী প্রিসাইডিং অফিসার, তাই তার পারমিশন লাগবে।

নন্দিনী কিছুতেই রাজি নয় এই বিষয়ে পারমিশন দিতে। বারবার নিজের বান্ধবীকে বোঝাতে লাগলো এই ইলেকশনটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। এটা কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়। কিন্তু সুস্মিতা ছিল অনড়। সে বললো ভোটিং প্রক্রিয়ার কাজ শুরুর আগেই সে ফিরে আসবে। এরকম হাজার রকমের কথা বলে অবশেষে সে নন্দিনীকে রাজি করিয়ে ফেললো অঙ্কিতের সাথে ঘুরতে যাওয়ার পারমিশন দিতে।

আসলে অঙ্কিত আর সুস্মিতা প্ল্যান করেছিল বাড়ি থেকে দূরে এসে এই অছিলায় তারা শারীরিক ভাবে মিলিত হবে। কলকাতায় থাকতে সেই স্কোপ নেই। সুস্মিতা শশুরবাড়িতে থাকে, অঙ্কিত বেকার। যতটুকু সময় পায় তারা তাতে সবার অগোচরে রাস্তা ঘাটে পার্কে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারে, শুধু গল্প করে সময় কাটাতে পারে। কিন্তু শারীরিক চাহিদা কারোরই মেটেনা। বাড়ি থেকে দূরে এসে এবার এই খড়া হয়তো মিটবে। .....
Like Reply


Messages In This Thread
RE: এক মুঠো খোলা আকাশ - by Manali Basu - 03-02-2025, 06:25 PM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)