Yesterday, 05:20 AM
দাসী কমলিনী: পর্ব ২
সেনানিবাসে ক্রমে ক্রমে প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেল। কমলিনী এই কদিনে সেনানিবাসের নানাবিধ কাজকর্মে নিজেকে জড়িয়ে অনেকের সাথেই সখী সুলভ সম্পর্ক স্থাপন করে নিয়েছে। তাদের সাথে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে সে ইতিমধ্যে জেনেছে যে― সেনানিবাসের ওপড় তলার এই অংশে কুমারের সেবার জন্যে মোট ১৮ জন্য দাসী মহারাণী প্রভা দেবী নিজে বাছাই করে নিযুক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু দাসীকে আনা হয়েছে দূর দেশ থেকে। এদের প্রতেকেই সাধারণ গৃহকর্ম থেকে শুরু করে সঙ্গীত চর্চা, নৃত্য পরিবেশন এবং কেউ কেউ কুমারের সহিত চিত্র অংকন ও অসিবিদ্যার অনুশীলনেও যোগদান করে থাকে।
তবে মূলত এই লাস্যময়ী দাসিগণের প্রধান উদ্দেশ্য হল কুমারের সকল প্রয়োজনে আশেপাশে থাকা এবং সার্বক্ষণিক কুমারকে সঙ্গ দিয়ে তার মনোরঞ্জন করা। তাই কুমারের মনোরঞ্জনের জন্যে যে কোন কিছু করতেই তারা সর্বদা প্রস্তুত। এছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ যদিও এদের ছিল না। তথাপি, দাসী দেবসেনার আওতাধীনে সকলে মিলে মিশে সেনানিবাসের এই অংশের রান্নাবান্না ও পরিচর্যা করে থাকে। মহারাণী আদেশে দেওয়াল তুলে মূল সেনানিবাসের থেকে এই অংশ আগেই আলাদা করা হয়েছিল। এরপর এই অংশ দেবসেনার আওতাধীন হবার পর বাহিরে সকল কর্মিদের সে বিদায় করে। তবে এর জন্যে এখানকার বাসরত কারোরই আপত্তি দেখে দেয় নি। বরং তার দেবসেনার এইরূপ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সুখী হয়েছিল বলেই শোনা যায়।
কিন্তু সবদিক দেখে কমলিনী ভেবেছিল― এতোগুলি দাসীর কুমারের প্রয়োজন কি? সে তো আসছে থেকেই দেখেছে অধিকাংশ সময় কুমার নিজের কাজ নিজেই করে। আর যখন সে নিজে করে না, তখন হয়তো কুমারী উল্কা বা দাসী দেবসেনা বাকিদের নিয়ে সেই কাজে হাত লাগায়। কিন্তু তাতেও ত অত লোকের আবশ্যক হয় না।তার ওপড়ে মাঝে মধ্যে কুমারের একান্ত নিজস্ব কাজে দাসী সকলে এমন বারাবারি করে থাকে; যা দেখে কমলিনী নিজেই ভয়ে শিউরে ওঠে।
এই তো যে দিন সে প্রথম এল, সেদিন খানিক পর দুজন পরিচারিকার সাথে সে যখন কুমারের সমুখে গেল। তখন দেবসেনার সাথে আরো চার জন্য পরিচারিকা একরকম জোড় পূর্বক কুমারের দেহাবরণ খুলে তাকে স্নানের জন্যে তৈরি করছিল,এবং নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। তখন দেবসেনা ব্যতীত বাকি চার জন্য পরিচারিকারাই অর্ধনগ্ন। এছাড়া তাদের কোমড়ের নিচে যা আছে! তাও না থাকারই সমান।
তবে তাতে তখধ কমলিনীর কি বা যায় আসতো! কিন্তু এমন বিশাল দেহে লোকটিকে কজন দাসী মিলে জোরপূর্বক স্নানে নিয়ে যাচ্ছে দেখে, কমলিনী অবাক তো হলোই, সেই সাথে ভয়ও পেল খুব। তবে দেখাগেল কুমার কিন্তু এতে বিচলিতও হলো না আবার তাদের বাঁধাও দিল না। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে, কুমার একবারের জন্যেও তার দুই পাশের দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী রমণীদের প্রতি দৃষ্টিও ফেলল না। শুধুমাত্র একটিবার শান্ত দৃষ্টিতে দেবসেনার মুখপানে চেয়ে অল্প হাসি মাখা কণ্ঠস্বরে বললে,
– সখী! এ তোমার বারাবারি। আগে কুমারীর সাথে দে.....
– তা হলেই না হয় বারাবারি! কিন্তু আমার কর্তব্য যে আমায় করতেই হবে কুমার। তাছাড়া আপনার বোনটি কোথাও পালিয়ে তো যাচ্ছে ন...একি! এখন ওকে নিয়ে এখানে কেন?
এর বেশী কমলিনীর শোনা হয়নি,তার আগেই দেবসেনা এগিয়ে এসে কমলিনী সহ তার পাশের দুজনকেউ বেড়িয়ে যাবার আদেশ করলো। এই ঘটনার পর কমলিনী বহুবার দাসীদের কে
এইরূপ জোরপূর্বক ভাবে কুমারের নানান কাজে হাত লাগাতে দেখেছে। যদিও সকলেই জানে কুমারের সঙ্গ বা সাহায্যের কোনটারই কোন প্রয়োজনই নেই। কিন্তু এরপরেও সব দাসীরাই সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রাখে কুমারের প্রতি। সেই সাথে এইসব লাস্যময়ী দেহের অধিকারীণি পরিচারিকাগণের অবসর সময় কাটে মিষ্টি মধুর কথাবার্তার দ্বারা কুমারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায়। তাদের সকলই মনে মনে সর্বক্ষণ কামনা করে কুমারের সঙ্গ। দৈনিক কাজকর্মের মাঝেও তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু অধিকাংশ সময়েই শুরু ও শেষ হয় কুমারকে কেন্দ্র করে। বোধকরি তাদের এই রূপ একনিষ্ঠ ভাবের জন্যেই ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হওয়াতে হঠাৎ হঠাৎ কেউ কেউ সত্যই কুমারের সঙ্গ লাভ করে। তবে এই সঙ্গটি শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে নয়,একটু অন্য রকমের।
কুমার বিজয় প্রতাব চিত্রকলাখুবই পছন্দ করে। এবং সে নিজেও এই কার্যে অস্ত্রবিদ্যার মতোই পারদর্শী। তবে তার চিত্রকলায় অধিকাংশ সময়েই ফুটে উঠতো পুশু-পাখি,ফুল এবং সেনানিবাসের দাসীগণের দৈহিক সৌন্দর্য। কেন না, তাদের দেহে অধিকাংশ সময়ই কাপড় থাকতো অল্প এবং অলঙ্কার থাকে অতিরিক্ত। বলা বাহুল্য এহেন অল্প দেহাবরণে এই অসামান্যা সুন্দরী রমণীদের লাবন্যময়ী দেহের সৌন্দর্য কিঞ্চিৎ ঢাকা পরে মাত্র, কিন্তু নানাবিধ সোনা,রুপা ও মনিমানিক্যের অলঙ্কারে থাকে শোভিত। অবশ্য এতে কারোরই লজ্জা বা দ্বিধা বোধ দেখা যায় না। কারণ,তারা সকলেই জানে যে সেনানিবাসের এই অংশে সর্বক্ষণ নিজেদের লাস্যময়ী দেহের সৌন্দর্য উদ্ভাসিত করে ঘুরে বেরালেও কুমার ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার উপায় নেই। তাছাড়া নিজের সৌন্দর্য্য দ্বারা কুমারকে কিঞ্চিৎ মুগ্ধ করতে পারলে বা কুমারের সংস্পর্শে থেকে তাকে খানিক আনন্দিত করতে পারলেই মহারাণীর পক্ষ থেকে আসে উপহার। এই বিষয়ে যে যতটা কুমারের ঘনিষ্ঠ, তার উপহারটিও ততই পরিমাণে ও দামী হয়ে থাকে। যদিও আজ পর্যন্ত একথা জানা যায় নি মহারাণী সেনানিবাসের ভেতরের সকল সংবাদ কি করে জানতে পারেন। তবুও মাঝে মধ্যেই প্রাসাদে তাদের ডাক পরে।
কিন্তু তারপরও, কুমারের সাথে এমন আচরণ দাসীদের পক্ষে কি বেয়াদপী নয়? তাছাড়া সেনানিবাসের এতো পুরুষের মাঝে অধিকাংশ সময়ই তাদের এমন অর্ধনগ্ন সাজসজ্জা করতে কি ভয় করে না? হাজারর হোক, সে কোনো সময়েই দ্বিতীয় কোন পুরুষের আগমণ ত কুমারে সাথে আলোচনার জন্যে হতেই পারে,তাই নয় কি?
নিজে মনের অন্তরালে জাগা এই প্রশ্নের গুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কমলিনী জানলো যে―তাদের ভয় না থাকার কারণ সেনানিবাসের এই অংশে প্রয়োজন ছাড়া কুমার ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পুরুষের আগমন নিষিদ্ধ। আর প্রয়োজন হলেও তার জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা আছে। তাছাড়া, সেনানিবাসের এই অংশ যেমনি বাকি সেনানিবাসের থেকে পাচিল দ্বারা আলাদা। তেমনই এখানকার রান্নাবান্না সহ সকল কাজকর্ম আলাদাভাবে এখানকার বাসরত এই পরিচারিকারাই করে থাকে নিয়মিত। তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদির জোগানের ব্যবস্থা এবং তারা সকলেই মহারাণীর অধীনে। সুতরাং সেনানিবাসের নেতৃত্বে কুমার বিজয় প্রতাব বহাল থাকলেও,সেনানিবাসের এই অংশটি মহারাণী প্রভাদেবী ও রাজকুমারী উল্কার কথাতেই চলে, কুমারের নয়। মহারাণীর অনুমতি ছাড়া সেনানিবাসের এই অংশে কারোই থাকার অধিকারও নেই। কুমার নিজেও মাতার এই নিয়মের অধীনে। সে এখানে থাকে বটে,তবে এখানকার কোন কাজে বাধা সৃষ্টি বা মহারাণীর সিদ্ধান্তকে অমান্য করার দুঃসাহস সে দেখায় না। কেন না ,কুমার নিজেও জানে তার জন্যে রাণী মায়ের চিন্তার শেষ নেই। মোট কথা কুমারের নীরবতায় এখানকা শাসন ভার মহারাণীর হাতে। তাই এই অবস্থায় কমলিনীর ডাক যে রাজ প্রাসাদে অতি শীঘ্রই পড়বে এতে কোন সন্দেহ ছিল না।
তবে কমলিনীর কঙ্কনপুরের আগমনের সময় মহারাণী কঙ্কনপুরে ছিলেন না। কদিন আগেই তিনি নিজের পিত্রালয়ে গমণ করেছেন এবং যাওয়ার আগে এখানকার দুজন দাসীকে সাথে নিয়ে গেছেন। এদিকে মহারাণীর অনুপস্থিতিতে কমলিনী আপাতত সেনানিবাসের প্রধান দাসী দেবসেনার অধীনে রান্নার কাজে বহাল হয়েছে। স্থায়ী হবার পর পরই কমলিনী অল্পদিনেই দাসী দেবসেনার সুনজরে পরেছে এবং সেই সুবাদে কুমারী উল্কার সাথেও তার পরিচয় ঘটে মাস ঘুরতেই।
কিন্ত এতকিছু জানার পরেও কমলিনী এই সব দেখে প্রথমটায় একটু অবাকই হয়েছিল। মনে কয়েকবার রানীমায়ের এইরূপ ব্যবস্থা দেখে প্রশ্নও তার জেগেছে বৈ কি! তবে সম্পূর্ণ সত্য জানার পর রাণী মায়ের প্রতি অসম্মান নয় বরং কমলিনীর করুণা হয়েছে অনেক বেশী। একজন নারী কতটুকু নিরুপায় হলে এমনটি করতে পারে সেটি ভেবেই কমলিনীর মন কেঁপে ওঠে।
কুমার বিজয় প্রতাবের নারীদের প্রতি যে কোন আকর্ষণ নেই, এই কথা কমলিনী আগেই শুনেছে। কিন্তু কুমারের নারী আকর্ষণ না থাকায় মহারাণীর কপলা যে কত কলঙ্ক লেগেছে! সেটি তার জানা ছিল না। বিশেষ করে রাজপুরীতে অনেকেরই ধারণা প্রভাদেবী কখনোই কুমারকে রাজপ্রাসাদে ফেরানোর চেষ্টাই করেননি। কারণ, মহারাজের অন্তরালে মহারাণী নিজে রাজ্য শাসন চালাতে ও নিজের সন্তানকে রাজ্যসিংহাশনে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে রাখেন। কেন না, এর আগেও রাজার আঁড়ালে থেকে আগের রাণী এবং প্রভা দেবী বোন যে রাজ্য শাসন করতেন, এই কথা এখন আর কারোরই অজানা নয়। তাছাড়া বিজয় প্রতাব যে কুমারী উল্কাকে রাজসিংহাসনে বসানো চিন্তা ভাবনা করছে এই কথা রটনা হবার পর থেকে তাদের ধারণা এর পেছনেও মহারাণী প্রভাদেবীর কুট অভিসন্ধি বিদ্যমান।
যদিও এই কথা সত নয়, কিন্তু কুমারী উল্কাকে নিয়ে রাজকুমারের মনভাব প্রকাশিত হবার পর থেকেই এই বিষয়ে আর কারোই কোন সন্দেহ থাকে না। কেন না ,প্রভাদেবীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না।তাই এই অবস্থায় কুমারের বিবাহ অবশ্যই প্রভাদেবীর হিসেবে সমস্যা সৃষ্টির প্রদান কারণ। সবাই এই কথায় এটাই ভেবে নেয় যে রাজকুমারের নারীদের প্রতি এমন অনিহার পেছনেও নিশ্চিতরূপে বর্তমান মহারাণীর বিশেষ ভুমিকা থাকবে। তিনি কুমারকে ছলনার দ্বারা প্রভাবিত করে আজীবন রাজ্য রক্ষার ভারে তার কাঁধে তুলে দিয়েছেন।
অথচ যারা মহারাণীর নিকটবর্তী এবং বিশ্বাসভাজন। তাদের কারোই এই কথা অজানা নয় যে কুমারকে রাজন্তঃপুরে ফিরিয়ে নিতে প্রভা দেবী চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেনি। এমনকি তার আদেশেই সেনানিবাসের বিশেষ এই অংশে একেরপর এক সুন্দরী দাসীদের আগমন। যদিও এর উপলক্ষ কুমারকে নারীদের প্রতি দূর্বল করে তার মনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ জাগিয়ে তোলা। কিন্তু দূঃখের বিষয় এই যে– গত দশ বছরের মধ্যে এই কার্যে কোন দাসীই সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু এই উদ্যোগ নেওয়ার ফলে অভাগী রাণীর কলঙ্কের খাতায় আর একটি দাগ অল্প দিনেই আঁকা হয়ে গিয়েছে। যদিও মহারাণী প্রথমে বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে ছিলেন। কিন্তু এই রূপ কয়েকবার ব্যর্থ হয়ে তিনি বুঝেছিলেন কুমারের অন্তরের কঠিন জমিনটি নরম করে আগে নারীদের জন্যে অল্প হলেও দূর্বলতা আনা চাই। আর সেই জন্যেই কুমারকে এখন সর্বক্ষণ নারীদের সান্নিধ্যে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু রাজকুমাদের দিয়ে তা সম্ভব,তাই অবশেষে কুমারের সেনানিবাসের নিত্য নতুন দাসীদের এনে তিনি কুমারের মনটিতে নারীর জন্যে খানিক জায়গা করতে চাই ছিলেন।
তবে এতকিছুর পরেও মহারাণী আশা ভঙ্গ হয়ে পরেননি। কেন না ,এতদিন পর দাসী দেবসেনা কুমারের নিকটবর্তী হতে হতে সক্ষম হয়েছে। তা গত দুবছরে সেনানিবাসে নতুন কোন দাসীর আগমন ঘটেনি।মহারাণী দেবসেনার প্রতি বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে পরেছেন। অবশ্য দেবসেনার প্রতি মহারাণীর বিশ্বাস এমনি এমনি তৈরি হয় নি। দেবসেনা অসামান্যা সুন্দরী না হলে তার রূপের কমতি বুদ্ধির দ্বারা পরমেশ্বর পূর্ণ করে দিয়েছেন।যার শয়নকক্ষে আগে রাজ কুমারী উল্কা ছাড়া দ্বিতীয় কারোরই প্রবেশধিকার ছিল না! এখন দেবসেনার দৌলাতে সব দাসীরাই নিরদ্বিধায় কুমারের শয়নকক্ষে চলা ফেরা করছে। আর শুধুমাত্র চলাফেরাই নয়, গত দুবছর ধরে দেবসেনা কথা মেনে সকল পরিচারিকারাই কুমারের কাছে আরো কিছুটা নিকটবর্তী হয়েছে। এখন সেদিন আর দূরে নয় যখন এদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো কুমারের পাথরের মত কঠিন ঐ বুকের দেয়াল বেধ করে; তার নরম হৃদয়ে দোলা দেবে। মহারাণীর ও কুমারী উল্কার ধারণা সেই রমণীটি হয়তো দেবসেনা!
তবে বাকি সকলে যত যাই বলুক না কেন, কমলিনীর মনে হলো মহারাণী নিতান্তই নিরুপায় হয়েই এমন ব্যবস্থাপনা করেছেন। কেন না এতকিছুর পরেও মহারাণী তার এই পরিকল্পনার ভবিষ্যত নিয়ে কিছুই ভেবে রাখেননি। তাছাড়া কুমারের হৃদয়কে দোলা দিয়ে যদিওবা কোন দাসী তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়;তবে এতে লাভের কি হবে যদি কুমার এর পরেও বিবাহ করতে রাজী না হন তো! হাজার হোক তার শয়নকক্ষের বাহিরেই ত ১৮ জন্য সুন্দরী পরিচারিকার বাস। পরমেশ্বর না করুক ! কুমারের মন নরম হয়ে তিনি সত্য সত্যই নারীদের প্রতি যদি প্রত্যাশার চাইতেও বেশি দূর্বল হয়ে পরেন তবে!
এই সব ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে বাগানের ঘাসের ওপড়ে বসে ছিল কমলিনী। সেনানিবাসের পেছনদিকের এই বাগানটি শুধুমাত্র এখানকার পরিচারিকাদের জন্যে কুমারের আদেশেই তৈরি করা হয়েছে। কমলিনী মাঝে মধ্যেই সময় মিললে এখানটায় এসে বাগানের ফুল তুলে মালা গাথে। তারপর সেই ফুলের মালা লোক চক্ষুর আঁড়ালে রেখে আসে কুমারের শয়নকক্ষে।
না,সে মহারাণী কৃত কুমারের মনোরঞ্জনের জন্যে নিযুক্ত কোন দাসী নয়। যদি এমনটা হতো তবে এই ক্ষুদ্র কাজে গোপনীয়তা অবলম্বনের তার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, এই কাজটি প্রতিদিন সকালে অনেক পরিচারিকারাই করে থাকে। এবং তার পরিবর্তে মাঝে মধ্যে কুমারের মন ভালো থাকলে এক আধটা চুম্বন তাঁরা উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে। আমাদের কমলিনীর মনটি এই সব দেখে মাঝে মধ্যেই বড্ড অভিমানী হয়ে ওঠে। তবে বাকি পরিচারিকাদের মাথার ওপড়ে আছে রাণীমায়ের আদেশ ,আমাদের গল্পের নায়িকার তা নেই। কে জানে! তার মালাদানে অসন্তোষ হয়ে কুমার যদি রুষ্ট হন তবে! তখন অভাগী কমলিনীকে কে রক্ষা করবে বল? হাজার হোক! বিজয় প্রতাব এই রাজ্যে কুমার আর সে সাধারণ দাসী মাত্র। কিন্তু মনের মানুষটির শারীরিক অবস্থা যখন বিশেষ মন্দ এবং নিজ সংকোচে তার কাছে যেতে যখন কমলিনীর এতো ভয়! তখন এই অবস্থায় ফুলের মালা উপহার দিয়ে তার মনে খানিক আনন্দ আনার চেষ্টা থেকে সে বিরত থাকে কি করে? কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে এই প্রশ্নও জাগে যে― সেদিন অন্ধকার রাত্রিতে এই অভাগীনিকে অগ্নিদেবের তান্ডব থেকে বাঁচিয়ে সে যে অজ্ঞান হয়েছিল ,তা কি এখন আর কুমারের মনে পরে?
এই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় “না!”। তা না হলে, গত মাস কয়েক ধরে গোপনে সে যাকে মনের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত পূজো করে চলেছে ; তাকে কি একটি বার চোখের দেখাও দেখতে ইচ্ছে হয় না কুমারের? সে তো মাঝে মধ্যেই লক্ষ্য করে কুমার তার পরিচারিকাদের মনের অনুভূতি কেমন মুখে না আনতেই বুঝে নেয়। তবে তার বেলা এমন অবহেলা কেন? অবশ্য এও সত্য বোঝার জন্যে আগে তো নিকটে যাওয়া চাই,তাই নয় কি? কিন্তু তার নিকটবর্তী হতে কমলিনী বড্ড ভয় হয়। এতো এতো সুন্দরী পরিচারিকা দের মধ্যে কুমার কি আর তার পানে দৃষ্টি রাখবে?
এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগেই কমলিনীর মালাগাথা সম্পূর্ণ হলো। তারপর গত কদিনের মত সকলের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে সে এলো কুমারের শয়নকক্ষে। গত সপ্তাহ খানেক হল কুমারের সাস্থ্য ভালে নেই। রাজবৈদ্য রোগীর রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ। তবে চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা হলে কি হয়,এই কদিনেই কুমারের অবস্থা ক্ষণে ভালো ত পরক্ষণেই মন্দ হয়ে আসছে। কুমারের এইরূপ শারীরিক অবস্থা দেখে তার সকল পরিচারিকারাই তার প্রতি দ্বিগুণ যত্নশীল হয়ে উঠেছে। তবে একথা বলতেই হয় যে অমন কঠিন দেহখানির জন্যেই কুমার এখন নিজ পায় দাঁড়িয়ে চলাফেরা করতে পারছে। আর যেই কারণেই আমাদের কমলিনী পক্ষে মালাদান করাটাও সহজলভ্য হয়েছে। তবে আজ কি না ভাগ্যদেবী কমলিনীর প্রতি খানিক রুষ্ট ছিলেন। তাই তো মালা রেখে পেছন ফিরতেই সে পরলো কুমারী উল্কার সমুখে।
কুমারী উল্কার সৌন্দর্য্য রাজ্য আলোকিত করার মতো।সেই সাথে তার দেহের গঠনটিও খাটো গোছের নয়। কুমারের পাশে দাড়ালে উল্কার মস্তক প্রায় বিজয় প্রতাবের নাক স্পর্শ এমন। সেখানে আমাদের কমলিনী উল্কার কাঁধের চাইতেও অল্প নিচু। তার ওপড়ে আর এক বিপদ এই যে; কমলিনী উল্কার ওই বিদ্যুৎ ঝড়ানো আঁখিপানে তাকানোর সাহস এখনো মাঝে মাঝেই হারিয়ে বসে ,এবং এই কথাটি কুমারী নিজেও জানে বলে দেবসেনা ও তার মধ্যে কমলিনীকে নিয়ে কৌতুক হয় প্রায়শই। তাই এহেন পরিস্থিতিতে পরে ভয়ে কমলিনীর গলা শুকিয়ে গেল। অবশ্য তাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই উল্কা গম্ভীর সুরে বলতে লাগলো,
– মালা দেবার লোক পেলি না আর কমল! বলি এই সব কবে থেকে চলছে শুনি?
কুমারীর প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই দ্বিতীয় বিপদ উপস্থিত। এবার কুমার নিজে। কমলিনী কথা বলবে কি! তার সর্বাঙ্গ অজানা এক ভয় ও শিহরণের অনুভূতিতে ভয়ংকর রকম কাঁপতে লাগলো। সে বেচারী তৎক্ষণাৎ কিছু ভেবে উঠতে না পেরে রাজ কুমারীর পেছনে লুকালো। এমন কান্ড দেখে কুমারী হাসিতে ভেঙে পরলেও ; কুমার যখন এগিয়ে এসে কমলিনীর রাখা ফুলের মালাটি ঠোঁটের কাছাকাছি তুলে নিয়ে গাঢ় নিশ্বাস নিল !তখন বিনা কারণেই লজ্জায় কমলিনীর মুখখানি সিঁদুরের রঙে রঙিন হয়ে উঠলো। তবে কুমার কিন্তু কিছুই বললো না। বোধকরি কমলিনী রক্তিম মুখমন্ডল তার চোখে পরেছে। আর তা না হলে কুমারের শারীরিক অবস্থা আবারও মন্দ হতে শুরু করেছে।
কুমারের পরিচারিকাদের শয়নকক্ষে নানান রকম বিলাসবহুল আসবাবপত্র থাকলেও কুমারে শয়নকক্ষে প্রয়োজনীয় কয়েকটি আসবাব,একটি পালঙ্ক আর খান কয়ের বসার আসন ছাড়া আর তেমন বিশেষ কিছুই নেই। যেখানে কুমারের পরিচারিকারা জাঁকজমকপূর্ণ কক্ষে নরম গালিচা পা রেখে চলা ফেরা ও কোমল শয্যায় রাত্রি যাপন করে থাকে। সেখানে কুমারের শোবার ব্যবস্থা ছিল অতি সাধারণ। তাই বোধকরি এতো সব সাধারণ বস্তুর মধ্যে কমলিনীর চোখ দুটি বার বার শয়ন রত ঐ অসাধারণ ব্যক্তিটির ওপরেই পরছিল বার বার। যদিও তার লজ্জা এখনো কাটেনি, তবুও কুমারী তাকেই কুমারের সেবার দায়িত্ব দিয়ে প্রস্থান করলো।
কুমারী শয়নকক্ষে ত্যাগ করার পর কমলিনী তার কাঁপা কাঁপা হাত দুখানি কুমারের পায়ে রাখতেই সে চোখ মেলে চাইলো। কমলিনী তখন নত মস্তকে কুমারের পদসেবায় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ একত্রিত করার চেষ্টায় মগ্ন। কুমার হয়তো কিছু বলতো কিন্তু কমলিনীর ভীত মুখভঙ্গি দেখে সে অল্প হেসে আবারও চোখ বুঝলো।
কমলিনী কুমারের কাছে না এলেও তার শারীরিক অবস্থার খবর বাকীদের থেকে নিয়মিত মনোযোগ সহকারে শুনতো এবং দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতো। সুতরাং কুমারের রোগ বৃদ্ধির লক্ষণ গুলি কমলিনী নিজেও জানতো। তাই খানিকক্ষণ পরে যখন কুমারের দেহের উত্তাপ হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো,তখন সে বিচলিত হয়ে পরলো। সেই সাথে কমলিনী এও লক্ষ্য করলো যে খানিকক্ষণ আগে যে শান্ত ভাবে নিদ্রিত ছিল, এখন দেহের উত্তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই কুমারের দেহের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই খুব দ্রুত তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে দেখে কমলিনী উদ্বিগ্ন হয়ে পালঙ্ক থেকে নেমে শয়নকক্ষের দ্বার সমুখে এসে চিৎকার করে সকলকে ডাকতে লাগলো।
সেনানিবাসে ক্রমে ক্রমে প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেল। কমলিনী এই কদিনে সেনানিবাসের নানাবিধ কাজকর্মে নিজেকে জড়িয়ে অনেকের সাথেই সখী সুলভ সম্পর্ক স্থাপন করে নিয়েছে। তাদের সাথে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে সে ইতিমধ্যে জেনেছে যে― সেনানিবাসের ওপড় তলার এই অংশে কুমারের সেবার জন্যে মোট ১৮ জন্য দাসী মহারাণী প্রভা দেবী নিজে বাছাই করে নিযুক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু দাসীকে আনা হয়েছে দূর দেশ থেকে। এদের প্রতেকেই সাধারণ গৃহকর্ম থেকে শুরু করে সঙ্গীত চর্চা, নৃত্য পরিবেশন এবং কেউ কেউ কুমারের সহিত চিত্র অংকন ও অসিবিদ্যার অনুশীলনেও যোগদান করে থাকে।
তবে মূলত এই লাস্যময়ী দাসিগণের প্রধান উদ্দেশ্য হল কুমারের সকল প্রয়োজনে আশেপাশে থাকা এবং সার্বক্ষণিক কুমারকে সঙ্গ দিয়ে তার মনোরঞ্জন করা। তাই কুমারের মনোরঞ্জনের জন্যে যে কোন কিছু করতেই তারা সর্বদা প্রস্তুত। এছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ যদিও এদের ছিল না। তথাপি, দাসী দেবসেনার আওতাধীনে সকলে মিলে মিশে সেনানিবাসের এই অংশের রান্নাবান্না ও পরিচর্যা করে থাকে। মহারাণী আদেশে দেওয়াল তুলে মূল সেনানিবাসের থেকে এই অংশ আগেই আলাদা করা হয়েছিল। এরপর এই অংশ দেবসেনার আওতাধীন হবার পর বাহিরে সকল কর্মিদের সে বিদায় করে। তবে এর জন্যে এখানকার বাসরত কারোরই আপত্তি দেখে দেয় নি। বরং তার দেবসেনার এইরূপ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সুখী হয়েছিল বলেই শোনা যায়।
কিন্তু সবদিক দেখে কমলিনী ভেবেছিল― এতোগুলি দাসীর কুমারের প্রয়োজন কি? সে তো আসছে থেকেই দেখেছে অধিকাংশ সময় কুমার নিজের কাজ নিজেই করে। আর যখন সে নিজে করে না, তখন হয়তো কুমারী উল্কা বা দাসী দেবসেনা বাকিদের নিয়ে সেই কাজে হাত লাগায়। কিন্তু তাতেও ত অত লোকের আবশ্যক হয় না।তার ওপড়ে মাঝে মধ্যে কুমারের একান্ত নিজস্ব কাজে দাসী সকলে এমন বারাবারি করে থাকে; যা দেখে কমলিনী নিজেই ভয়ে শিউরে ওঠে।
এই তো যে দিন সে প্রথম এল, সেদিন খানিক পর দুজন পরিচারিকার সাথে সে যখন কুমারের সমুখে গেল। তখন দেবসেনার সাথে আরো চার জন্য পরিচারিকা একরকম জোড় পূর্বক কুমারের দেহাবরণ খুলে তাকে স্নানের জন্যে তৈরি করছিল,এবং নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। তখন দেবসেনা ব্যতীত বাকি চার জন্য পরিচারিকারাই অর্ধনগ্ন। এছাড়া তাদের কোমড়ের নিচে যা আছে! তাও না থাকারই সমান।
তবে তাতে তখধ কমলিনীর কি বা যায় আসতো! কিন্তু এমন বিশাল দেহে লোকটিকে কজন দাসী মিলে জোরপূর্বক স্নানে নিয়ে যাচ্ছে দেখে, কমলিনী অবাক তো হলোই, সেই সাথে ভয়ও পেল খুব। তবে দেখাগেল কুমার কিন্তু এতে বিচলিতও হলো না আবার তাদের বাঁধাও দিল না। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে, কুমার একবারের জন্যেও তার দুই পাশের দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী রমণীদের প্রতি দৃষ্টিও ফেলল না। শুধুমাত্র একটিবার শান্ত দৃষ্টিতে দেবসেনার মুখপানে চেয়ে অল্প হাসি মাখা কণ্ঠস্বরে বললে,
– সখী! এ তোমার বারাবারি। আগে কুমারীর সাথে দে.....
– তা হলেই না হয় বারাবারি! কিন্তু আমার কর্তব্য যে আমায় করতেই হবে কুমার। তাছাড়া আপনার বোনটি কোথাও পালিয়ে তো যাচ্ছে ন...একি! এখন ওকে নিয়ে এখানে কেন?
এর বেশী কমলিনীর শোনা হয়নি,তার আগেই দেবসেনা এগিয়ে এসে কমলিনী সহ তার পাশের দুজনকেউ বেড়িয়ে যাবার আদেশ করলো। এই ঘটনার পর কমলিনী বহুবার দাসীদের কে
এইরূপ জোরপূর্বক ভাবে কুমারের নানান কাজে হাত লাগাতে দেখেছে। যদিও সকলেই জানে কুমারের সঙ্গ বা সাহায্যের কোনটারই কোন প্রয়োজনই নেই। কিন্তু এরপরেও সব দাসীরাই সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রাখে কুমারের প্রতি। সেই সাথে এইসব লাস্যময়ী দেহের অধিকারীণি পরিচারিকাগণের অবসর সময় কাটে মিষ্টি মধুর কথাবার্তার দ্বারা কুমারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায়। তাদের সকলই মনে মনে সর্বক্ষণ কামনা করে কুমারের সঙ্গ। দৈনিক কাজকর্মের মাঝেও তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু অধিকাংশ সময়েই শুরু ও শেষ হয় কুমারকে কেন্দ্র করে। বোধকরি তাদের এই রূপ একনিষ্ঠ ভাবের জন্যেই ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হওয়াতে হঠাৎ হঠাৎ কেউ কেউ সত্যই কুমারের সঙ্গ লাভ করে। তবে এই সঙ্গটি শয্যা সঙ্গিনী হিসেবে নয়,একটু অন্য রকমের।
কুমার বিজয় প্রতাব চিত্রকলাখুবই পছন্দ করে। এবং সে নিজেও এই কার্যে অস্ত্রবিদ্যার মতোই পারদর্শী। তবে তার চিত্রকলায় অধিকাংশ সময়েই ফুটে উঠতো পুশু-পাখি,ফুল এবং সেনানিবাসের দাসীগণের দৈহিক সৌন্দর্য। কেন না, তাদের দেহে অধিকাংশ সময়ই কাপড় থাকতো অল্প এবং অলঙ্কার থাকে অতিরিক্ত। বলা বাহুল্য এহেন অল্প দেহাবরণে এই অসামান্যা সুন্দরী রমণীদের লাবন্যময়ী দেহের সৌন্দর্য কিঞ্চিৎ ঢাকা পরে মাত্র, কিন্তু নানাবিধ সোনা,রুপা ও মনিমানিক্যের অলঙ্কারে থাকে শোভিত। অবশ্য এতে কারোরই লজ্জা বা দ্বিধা বোধ দেখা যায় না। কারণ,তারা সকলেই জানে যে সেনানিবাসের এই অংশে সর্বক্ষণ নিজেদের লাস্যময়ী দেহের সৌন্দর্য উদ্ভাসিত করে ঘুরে বেরালেও কুমার ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার উপায় নেই। তাছাড়া নিজের সৌন্দর্য্য দ্বারা কুমারকে কিঞ্চিৎ মুগ্ধ করতে পারলে বা কুমারের সংস্পর্শে থেকে তাকে খানিক আনন্দিত করতে পারলেই মহারাণীর পক্ষ থেকে আসে উপহার। এই বিষয়ে যে যতটা কুমারের ঘনিষ্ঠ, তার উপহারটিও ততই পরিমাণে ও দামী হয়ে থাকে। যদিও আজ পর্যন্ত একথা জানা যায় নি মহারাণী সেনানিবাসের ভেতরের সকল সংবাদ কি করে জানতে পারেন। তবুও মাঝে মধ্যেই প্রাসাদে তাদের ডাক পরে।
কিন্তু তারপরও, কুমারের সাথে এমন আচরণ দাসীদের পক্ষে কি বেয়াদপী নয়? তাছাড়া সেনানিবাসের এতো পুরুষের মাঝে অধিকাংশ সময়ই তাদের এমন অর্ধনগ্ন সাজসজ্জা করতে কি ভয় করে না? হাজারর হোক, সে কোনো সময়েই দ্বিতীয় কোন পুরুষের আগমণ ত কুমারে সাথে আলোচনার জন্যে হতেই পারে,তাই নয় কি?
নিজে মনের অন্তরালে জাগা এই প্রশ্নের গুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কমলিনী জানলো যে―তাদের ভয় না থাকার কারণ সেনানিবাসের এই অংশে প্রয়োজন ছাড়া কুমার ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পুরুষের আগমন নিষিদ্ধ। আর প্রয়োজন হলেও তার জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা আছে। তাছাড়া, সেনানিবাসের এই অংশ যেমনি বাকি সেনানিবাসের থেকে পাচিল দ্বারা আলাদা। তেমনই এখানকার রান্নাবান্না সহ সকল কাজকর্ম আলাদাভাবে এখানকার বাসরত এই পরিচারিকারাই করে থাকে নিয়মিত। তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদির জোগানের ব্যবস্থা এবং তারা সকলেই মহারাণীর অধীনে। সুতরাং সেনানিবাসের নেতৃত্বে কুমার বিজয় প্রতাব বহাল থাকলেও,সেনানিবাসের এই অংশটি মহারাণী প্রভাদেবী ও রাজকুমারী উল্কার কথাতেই চলে, কুমারের নয়। মহারাণীর অনুমতি ছাড়া সেনানিবাসের এই অংশে কারোই থাকার অধিকারও নেই। কুমার নিজেও মাতার এই নিয়মের অধীনে। সে এখানে থাকে বটে,তবে এখানকার কোন কাজে বাধা সৃষ্টি বা মহারাণীর সিদ্ধান্তকে অমান্য করার দুঃসাহস সে দেখায় না। কেন না ,কুমার নিজেও জানে তার জন্যে রাণী মায়ের চিন্তার শেষ নেই। মোট কথা কুমারের নীরবতায় এখানকা শাসন ভার মহারাণীর হাতে। তাই এই অবস্থায় কমলিনীর ডাক যে রাজ প্রাসাদে অতি শীঘ্রই পড়বে এতে কোন সন্দেহ ছিল না।
তবে কমলিনীর কঙ্কনপুরের আগমনের সময় মহারাণী কঙ্কনপুরে ছিলেন না। কদিন আগেই তিনি নিজের পিত্রালয়ে গমণ করেছেন এবং যাওয়ার আগে এখানকার দুজন দাসীকে সাথে নিয়ে গেছেন। এদিকে মহারাণীর অনুপস্থিতিতে কমলিনী আপাতত সেনানিবাসের প্রধান দাসী দেবসেনার অধীনে রান্নার কাজে বহাল হয়েছে। স্থায়ী হবার পর পরই কমলিনী অল্পদিনেই দাসী দেবসেনার সুনজরে পরেছে এবং সেই সুবাদে কুমারী উল্কার সাথেও তার পরিচয় ঘটে মাস ঘুরতেই।
কিন্ত এতকিছু জানার পরেও কমলিনী এই সব দেখে প্রথমটায় একটু অবাকই হয়েছিল। মনে কয়েকবার রানীমায়ের এইরূপ ব্যবস্থা দেখে প্রশ্নও তার জেগেছে বৈ কি! তবে সম্পূর্ণ সত্য জানার পর রাণী মায়ের প্রতি অসম্মান নয় বরং কমলিনীর করুণা হয়েছে অনেক বেশী। একজন নারী কতটুকু নিরুপায় হলে এমনটি করতে পারে সেটি ভেবেই কমলিনীর মন কেঁপে ওঠে।
কুমার বিজয় প্রতাবের নারীদের প্রতি যে কোন আকর্ষণ নেই, এই কথা কমলিনী আগেই শুনেছে। কিন্তু কুমারের নারী আকর্ষণ না থাকায় মহারাণীর কপলা যে কত কলঙ্ক লেগেছে! সেটি তার জানা ছিল না। বিশেষ করে রাজপুরীতে অনেকেরই ধারণা প্রভাদেবী কখনোই কুমারকে রাজপ্রাসাদে ফেরানোর চেষ্টাই করেননি। কারণ, মহারাজের অন্তরালে মহারাণী নিজে রাজ্য শাসন চালাতে ও নিজের সন্তানকে রাজ্যসিংহাশনে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে রাখেন। কেন না, এর আগেও রাজার আঁড়ালে থেকে আগের রাণী এবং প্রভা দেবী বোন যে রাজ্য শাসন করতেন, এই কথা এখন আর কারোরই অজানা নয়। তাছাড়া বিজয় প্রতাব যে কুমারী উল্কাকে রাজসিংহাসনে বসানো চিন্তা ভাবনা করছে এই কথা রটনা হবার পর থেকে তাদের ধারণা এর পেছনেও মহারাণী প্রভাদেবীর কুট অভিসন্ধি বিদ্যমান।
যদিও এই কথা সত নয়, কিন্তু কুমারী উল্কাকে নিয়ে রাজকুমারের মনভাব প্রকাশিত হবার পর থেকেই এই বিষয়ে আর কারোই কোন সন্দেহ থাকে না। কেন না ,প্রভাদেবীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না।তাই এই অবস্থায় কুমারের বিবাহ অবশ্যই প্রভাদেবীর হিসেবে সমস্যা সৃষ্টির প্রদান কারণ। সবাই এই কথায় এটাই ভেবে নেয় যে রাজকুমারের নারীদের প্রতি এমন অনিহার পেছনেও নিশ্চিতরূপে বর্তমান মহারাণীর বিশেষ ভুমিকা থাকবে। তিনি কুমারকে ছলনার দ্বারা প্রভাবিত করে আজীবন রাজ্য রক্ষার ভারে তার কাঁধে তুলে দিয়েছেন।
অথচ যারা মহারাণীর নিকটবর্তী এবং বিশ্বাসভাজন। তাদের কারোই এই কথা অজানা নয় যে কুমারকে রাজন্তঃপুরে ফিরিয়ে নিতে প্রভা দেবী চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেনি। এমনকি তার আদেশেই সেনানিবাসের বিশেষ এই অংশে একেরপর এক সুন্দরী দাসীদের আগমন। যদিও এর উপলক্ষ কুমারকে নারীদের প্রতি দূর্বল করে তার মনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ জাগিয়ে তোলা। কিন্তু দূঃখের বিষয় এই যে– গত দশ বছরের মধ্যে এই কার্যে কোন দাসীই সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু এই উদ্যোগ নেওয়ার ফলে অভাগী রাণীর কলঙ্কের খাতায় আর একটি দাগ অল্প দিনেই আঁকা হয়ে গিয়েছে। যদিও মহারাণী প্রথমে বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে ছিলেন। কিন্তু এই রূপ কয়েকবার ব্যর্থ হয়ে তিনি বুঝেছিলেন কুমারের অন্তরের কঠিন জমিনটি নরম করে আগে নারীদের জন্যে অল্প হলেও দূর্বলতা আনা চাই। আর সেই জন্যেই কুমারকে এখন সর্বক্ষণ নারীদের সান্নিধ্যে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু রাজকুমাদের দিয়ে তা সম্ভব,তাই অবশেষে কুমারের সেনানিবাসের নিত্য নতুন দাসীদের এনে তিনি কুমারের মনটিতে নারীর জন্যে খানিক জায়গা করতে চাই ছিলেন।
তবে এতকিছুর পরেও মহারাণী আশা ভঙ্গ হয়ে পরেননি। কেন না ,এতদিন পর দাসী দেবসেনা কুমারের নিকটবর্তী হতে হতে সক্ষম হয়েছে। তা গত দুবছরে সেনানিবাসে নতুন কোন দাসীর আগমন ঘটেনি।মহারাণী দেবসেনার প্রতি বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে পরেছেন। অবশ্য দেবসেনার প্রতি মহারাণীর বিশ্বাস এমনি এমনি তৈরি হয় নি। দেবসেনা অসামান্যা সুন্দরী না হলে তার রূপের কমতি বুদ্ধির দ্বারা পরমেশ্বর পূর্ণ করে দিয়েছেন।যার শয়নকক্ষে আগে রাজ কুমারী উল্কা ছাড়া দ্বিতীয় কারোরই প্রবেশধিকার ছিল না! এখন দেবসেনার দৌলাতে সব দাসীরাই নিরদ্বিধায় কুমারের শয়নকক্ষে চলা ফেরা করছে। আর শুধুমাত্র চলাফেরাই নয়, গত দুবছর ধরে দেবসেনা কথা মেনে সকল পরিচারিকারাই কুমারের কাছে আরো কিছুটা নিকটবর্তী হয়েছে। এখন সেদিন আর দূরে নয় যখন এদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো কুমারের পাথরের মত কঠিন ঐ বুকের দেয়াল বেধ করে; তার নরম হৃদয়ে দোলা দেবে। মহারাণীর ও কুমারী উল্কার ধারণা সেই রমণীটি হয়তো দেবসেনা!
তবে বাকি সকলে যত যাই বলুক না কেন, কমলিনীর মনে হলো মহারাণী নিতান্তই নিরুপায় হয়েই এমন ব্যবস্থাপনা করেছেন। কেন না এতকিছুর পরেও মহারাণী তার এই পরিকল্পনার ভবিষ্যত নিয়ে কিছুই ভেবে রাখেননি। তাছাড়া কুমারের হৃদয়কে দোলা দিয়ে যদিওবা কোন দাসী তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়;তবে এতে লাভের কি হবে যদি কুমার এর পরেও বিবাহ করতে রাজী না হন তো! হাজার হোক তার শয়নকক্ষের বাহিরেই ত ১৮ জন্য সুন্দরী পরিচারিকার বাস। পরমেশ্বর না করুক ! কুমারের মন নরম হয়ে তিনি সত্য সত্যই নারীদের প্রতি যদি প্রত্যাশার চাইতেও বেশি দূর্বল হয়ে পরেন তবে!
এই সব ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে বাগানের ঘাসের ওপড়ে বসে ছিল কমলিনী। সেনানিবাসের পেছনদিকের এই বাগানটি শুধুমাত্র এখানকার পরিচারিকাদের জন্যে কুমারের আদেশেই তৈরি করা হয়েছে। কমলিনী মাঝে মধ্যেই সময় মিললে এখানটায় এসে বাগানের ফুল তুলে মালা গাথে। তারপর সেই ফুলের মালা লোক চক্ষুর আঁড়ালে রেখে আসে কুমারের শয়নকক্ষে।
না,সে মহারাণী কৃত কুমারের মনোরঞ্জনের জন্যে নিযুক্ত কোন দাসী নয়। যদি এমনটা হতো তবে এই ক্ষুদ্র কাজে গোপনীয়তা অবলম্বনের তার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, এই কাজটি প্রতিদিন সকালে অনেক পরিচারিকারাই করে থাকে। এবং তার পরিবর্তে মাঝে মধ্যে কুমারের মন ভালো থাকলে এক আধটা চুম্বন তাঁরা উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে। আমাদের কমলিনীর মনটি এই সব দেখে মাঝে মধ্যেই বড্ড অভিমানী হয়ে ওঠে। তবে বাকি পরিচারিকাদের মাথার ওপড়ে আছে রাণীমায়ের আদেশ ,আমাদের গল্পের নায়িকার তা নেই। কে জানে! তার মালাদানে অসন্তোষ হয়ে কুমার যদি রুষ্ট হন তবে! তখন অভাগী কমলিনীকে কে রক্ষা করবে বল? হাজার হোক! বিজয় প্রতাব এই রাজ্যে কুমার আর সে সাধারণ দাসী মাত্র। কিন্তু মনের মানুষটির শারীরিক অবস্থা যখন বিশেষ মন্দ এবং নিজ সংকোচে তার কাছে যেতে যখন কমলিনীর এতো ভয়! তখন এই অবস্থায় ফুলের মালা উপহার দিয়ে তার মনে খানিক আনন্দ আনার চেষ্টা থেকে সে বিরত থাকে কি করে? কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে এই প্রশ্নও জাগে যে― সেদিন অন্ধকার রাত্রিতে এই অভাগীনিকে অগ্নিদেবের তান্ডব থেকে বাঁচিয়ে সে যে অজ্ঞান হয়েছিল ,তা কি এখন আর কুমারের মনে পরে?
এই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় “না!”। তা না হলে, গত মাস কয়েক ধরে গোপনে সে যাকে মনের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত পূজো করে চলেছে ; তাকে কি একটি বার চোখের দেখাও দেখতে ইচ্ছে হয় না কুমারের? সে তো মাঝে মধ্যেই লক্ষ্য করে কুমার তার পরিচারিকাদের মনের অনুভূতি কেমন মুখে না আনতেই বুঝে নেয়। তবে তার বেলা এমন অবহেলা কেন? অবশ্য এও সত্য বোঝার জন্যে আগে তো নিকটে যাওয়া চাই,তাই নয় কি? কিন্তু তার নিকটবর্তী হতে কমলিনী বড্ড ভয় হয়। এতো এতো সুন্দরী পরিচারিকা দের মধ্যে কুমার কি আর তার পানে দৃষ্টি রাখবে?
এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগেই কমলিনীর মালাগাথা সম্পূর্ণ হলো। তারপর গত কদিনের মত সকলের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে সে এলো কুমারের শয়নকক্ষে। গত সপ্তাহ খানেক হল কুমারের সাস্থ্য ভালে নেই। রাজবৈদ্য রোগীর রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ। তবে চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা হলে কি হয়,এই কদিনেই কুমারের অবস্থা ক্ষণে ভালো ত পরক্ষণেই মন্দ হয়ে আসছে। কুমারের এইরূপ শারীরিক অবস্থা দেখে তার সকল পরিচারিকারাই তার প্রতি দ্বিগুণ যত্নশীল হয়ে উঠেছে। তবে একথা বলতেই হয় যে অমন কঠিন দেহখানির জন্যেই কুমার এখন নিজ পায় দাঁড়িয়ে চলাফেরা করতে পারছে। আর যেই কারণেই আমাদের কমলিনী পক্ষে মালাদান করাটাও সহজলভ্য হয়েছে। তবে আজ কি না ভাগ্যদেবী কমলিনীর প্রতি খানিক রুষ্ট ছিলেন। তাই তো মালা রেখে পেছন ফিরতেই সে পরলো কুমারী উল্কার সমুখে।
কুমারী উল্কার সৌন্দর্য্য রাজ্য আলোকিত করার মতো।সেই সাথে তার দেহের গঠনটিও খাটো গোছের নয়। কুমারের পাশে দাড়ালে উল্কার মস্তক প্রায় বিজয় প্রতাবের নাক স্পর্শ এমন। সেখানে আমাদের কমলিনী উল্কার কাঁধের চাইতেও অল্প নিচু। তার ওপড়ে আর এক বিপদ এই যে; কমলিনী উল্কার ওই বিদ্যুৎ ঝড়ানো আঁখিপানে তাকানোর সাহস এখনো মাঝে মাঝেই হারিয়ে বসে ,এবং এই কথাটি কুমারী নিজেও জানে বলে দেবসেনা ও তার মধ্যে কমলিনীকে নিয়ে কৌতুক হয় প্রায়শই। তাই এহেন পরিস্থিতিতে পরে ভয়ে কমলিনীর গলা শুকিয়ে গেল। অবশ্য তাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই উল্কা গম্ভীর সুরে বলতে লাগলো,
– মালা দেবার লোক পেলি না আর কমল! বলি এই সব কবে থেকে চলছে শুনি?
কুমারীর প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই দ্বিতীয় বিপদ উপস্থিত। এবার কুমার নিজে। কমলিনী কথা বলবে কি! তার সর্বাঙ্গ অজানা এক ভয় ও শিহরণের অনুভূতিতে ভয়ংকর রকম কাঁপতে লাগলো। সে বেচারী তৎক্ষণাৎ কিছু ভেবে উঠতে না পেরে রাজ কুমারীর পেছনে লুকালো। এমন কান্ড দেখে কুমারী হাসিতে ভেঙে পরলেও ; কুমার যখন এগিয়ে এসে কমলিনীর রাখা ফুলের মালাটি ঠোঁটের কাছাকাছি তুলে নিয়ে গাঢ় নিশ্বাস নিল !তখন বিনা কারণেই লজ্জায় কমলিনীর মুখখানি সিঁদুরের রঙে রঙিন হয়ে উঠলো। তবে কুমার কিন্তু কিছুই বললো না। বোধকরি কমলিনী রক্তিম মুখমন্ডল তার চোখে পরেছে। আর তা না হলে কুমারের শারীরিক অবস্থা আবারও মন্দ হতে শুরু করেছে।
কুমারের পরিচারিকাদের শয়নকক্ষে নানান রকম বিলাসবহুল আসবাবপত্র থাকলেও কুমারে শয়নকক্ষে প্রয়োজনীয় কয়েকটি আসবাব,একটি পালঙ্ক আর খান কয়ের বসার আসন ছাড়া আর তেমন বিশেষ কিছুই নেই। যেখানে কুমারের পরিচারিকারা জাঁকজমকপূর্ণ কক্ষে নরম গালিচা পা রেখে চলা ফেরা ও কোমল শয্যায় রাত্রি যাপন করে থাকে। সেখানে কুমারের শোবার ব্যবস্থা ছিল অতি সাধারণ। তাই বোধকরি এতো সব সাধারণ বস্তুর মধ্যে কমলিনীর চোখ দুটি বার বার শয়ন রত ঐ অসাধারণ ব্যক্তিটির ওপরেই পরছিল বার বার। যদিও তার লজ্জা এখনো কাটেনি, তবুও কুমারী তাকেই কুমারের সেবার দায়িত্ব দিয়ে প্রস্থান করলো।
কুমারী শয়নকক্ষে ত্যাগ করার পর কমলিনী তার কাঁপা কাঁপা হাত দুখানি কুমারের পায়ে রাখতেই সে চোখ মেলে চাইলো। কমলিনী তখন নত মস্তকে কুমারের পদসেবায় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ একত্রিত করার চেষ্টায় মগ্ন। কুমার হয়তো কিছু বলতো কিন্তু কমলিনীর ভীত মুখভঙ্গি দেখে সে অল্প হেসে আবারও চোখ বুঝলো।
কমলিনী কুমারের কাছে না এলেও তার শারীরিক অবস্থার খবর বাকীদের থেকে নিয়মিত মনোযোগ সহকারে শুনতো এবং দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতো। সুতরাং কুমারের রোগ বৃদ্ধির লক্ষণ গুলি কমলিনী নিজেও জানতো। তাই খানিকক্ষণ পরে যখন কুমারের দেহের উত্তাপ হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো,তখন সে বিচলিত হয়ে পরলো। সেই সাথে কমলিনী এও লক্ষ্য করলো যে খানিকক্ষণ আগে যে শান্ত ভাবে নিদ্রিত ছিল, এখন দেহের উত্তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই কুমারের দেহের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই খুব দ্রুত তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে দেখে কমলিনী উদ্বিগ্ন হয়ে পালঙ্ক থেকে নেমে শয়নকক্ষের দ্বার সমুখে এসে চিৎকার করে সকলকে ডাকতে লাগলো।