17-12-2024, 10:54 PM
পর্ব: ২৬
একুশ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর বাইশতম বছরে বিচ্ছেদপত্রে সই করতে করতে জয়ন্তের বারবার মনে আসছিল উক্তিটি। কে বলেছে, কোথায় বলেছে যদিও মনে পড়ছে না তার।
আজ এক হপ্তা হল সুচিত্রা গোবিন্দপুরে চলে গেছে। ওখান থেকে সে এসেছে সরাসরি কলকাতায়। উকিলের চেম্বারে নির্বিবাদে সই স্বাক্ষরিত হল। সই করবার আগে পূর্ণাঙ্গ ডিভোর্স পেপার পড়বার জন্য উকিল সমরেশ গুপ্ত জয়ন্তকে বললে। জয়ন্তের কোনো ইচ্ছে নেই কি লেখা আছে তাতে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়বার।
অংশু কাছেই ছিল। বাবা-মায়ের দাম্পত্য ভাঙনের স্বাক্ষী সে। এক বুক অভিমান তার নীরবে রয়ে গেল। কেউ টের পেল না। যদিও সে নিজেকে পাথরের মত প্রস্তুত করেছে।
জয়ন্ত দাশগুপ্ত কিংবা সুচিত্রা দাশগুপ্ত তাদের বাইশ বছরের দাম্পত্যকে ভেঙে দিল অতি সহজে। মাত্র একমাসেই সব ওলটপালট হয়ে গেল।
জয়ন্ত যদি মিউচুয়াল ডিভোর্সে না যেত তাহলে হয়ত এত সহজে সুচি ডিভোর্স পেত না। তিনমাসের ন্যূনতম পিটিশন তারপর কোর্ট কেস এসবে উভয়কেই ছোটাছুটি করতে হত। কিন্তু সুচির ইচ্ছের কাছে জয়ন্ত অবনত হয়েছে। যার সাথে তার সংসার, সন্তান-সন্ততি, সেই যখন তাকে এত কঠিন সাজা দিতে চায়, সেই যখন চায় গফুরের মত একটা নিকৃষ্ট মানুষই তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হোক, তখন জয়ন্তের আর সম্পর্ককে বেঁধে রেখে কি লাভ।
সুচি আর জয়ন্ত পাশাপাশি বসে। সুচি একটা কমলা রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। মানানসই ছোপছোপ বাদামি ব্লাউজ। একটা সাড়ম্বরতা নজরে আসছে এই শাড়িতে। সুচি কি তাদের এই বিচ্ছেদ কে উপভোগ করতেই এমন বর্ণজ্জ্বল গর্জিয়াস শাড়ি পরেছে! নাকি নিজের ভবঘুরে নেশাখোর প্রেমিকের কাছে চলে যাবার স্বাধীনতায় সুচির এই আড়ম্বরপূর্ণতা? জয়ন্ত সদ্য প্রাক্তন হওয়া স্ত্রীয়ের দিকে তাকিয়ে এখনো মূল্যায়ন করছে নানাবিধ প্রশ্নের।
কিন্তু সেসব মূল্যায়ন নিছকই। ডিভোর্সের পর সুচিত্রা তার কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বলল---অংশু, যখনই মন খারাপ করবে চলে আসিস বাবা। আমার ওপর রাগ করিসনে।
মায়ের হাত অংশুর গালে। সে বলল---তুমি আজ বাড়ি আসবে না?
বাড়ি বলতেই বুকটা কেমন হাহাকারে মোচড় দিয়ে উঠল অংশুমানের। মায়ের বাড়ি তো এখন গোবিন্দপুর। সুচিত্রা ছেলেকে বললে---না রে, বিট্টু-লাট্টু একা আছে। ডালিয়া তেমন লক্ষ্য নজর করে না।
জয়ন্ত নীরব রইল। ফেরার সময় বাপ-ছেলে একসাথে ফিরল। সুচি উকিলের চেম্বারের অদূরে মৌলালির দিকে যাওয়া বড় রাস্তায় হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল সুচিত্রা। জয়ন্তের জীবনের মোড় এখন অন্যদিকে, সুচিত্রার পথ ভিন্ন। সুচি হয়ত চাইবে গফুরকে সভ্য করে তুলতে। যে কাজ অসম্ভব বলে মনে করে জয়ন্ত। সুচির পাগলামি ছাড়া এ কাজ আর কিচ্ছু নয়। সুচি যে কেন গফুরের মত একটা নেশাখোর মাতাল ফুটপাতবাসীকে নিজের জীবনের অঙ্গ করে নিতে চায় জয়ন্ত এখনো বুঝে উঠতে পারল না। আসলে এই অসম সম্পর্কটা সামাজিক অভ্যাস বহির্ভুত, যাকে মেনে নেওয়া বা বিশ্বাস করা বড্ড কঠিন। জয়ন্তের মনে পড়ে চন্দননগরে থাকাকালীন শিউলি দিদির কথা। ইংরেজিতে মাস্টার্স করা শিউলিদিদি ছিল অবনী ডাক্তারের মেয়ে। অবনী ডাক্তারকে জয়ন্ত ছোটবেলা থেকে জেঠু বলত। সেই শিউলি দিদি পালিয়ে বিয়ে করেছিল একটা লোফার মূর্খ ছেলেকে। ছেলেটা কাজকম্ম বলতে ইলেক্ট্রিকের লাইন সারাতো। কত সমালোচনা হয়েছিল পাড়ায়। আর তাতেই মুখ ঢাকতে অবনী ডাক্তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি বিক্রি করে চলে যান।
রফিকুলের কথা মনে পড়ে জয়ন্তের। নিপাট মূর্খ একটা ছেলে, জয়ন্তের বয়সী। জয়ন্তের ক্লাসমেট ছিল। কলেজ কমপ্লিট না করেই পড়া ছাড়লো। শিল্পাঞ্চলের এক নেতার চামচাগিরি করতে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছে, সেই একদিন বিয়ে করল নিজের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় এক মহিলার সাথে। মহিলা নাকি কোনো এক কলেজমাস্টারের স্ত্রী। ভাগিয়ে এনেছিল তাকে।
এই সম্পর্কগুলো অসম শ্রেণী, অসম মর্যাদা কিংবা অসম শিক্ষার। জয়ন্ত শুনত ইতিউতি; এসবের পেছনে ছিল নাকি আসলে মহিলাদের প্রচণ্ড লিবিডো। শুধুমাত্র যৌন তাড়নায় অতৃপ্ত নারীরা ভালোমন্দ বিচার না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এসব সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে অসুখী হয় মহিলারা। কিন্তু সুচিত্রা? গফুর একটা থার্ডক্লাস ভিখিরি ছাড়া কিছু নয়। ওর নোংরা কুচ্ছিত দেহ, ঘৃণিত স্নান না করা বহুদিনের দুর্গন্ধ কোনো নারীর মধ্যে যৌন চাহিদা তৈরি করতে পারবে না, তবে সুচির মত শুচিবাই শিক্ষিতা নারী কেনই বা ওকেই বেছে নিয়েছে বাকি জীবনের জন্য? শুধু কি বিট্টু-লাট্টুকে পূর্ন পরিবার দেওয়ার জন্য? এটা হতে পারে না। বিট্টু-লাট্টু কে তো এ বাড়িতে জয়ন্ত কখনো খাটো চোখে দেখেনি। বরং সুচির মত না হোক, সন্তান স্নেহ সেও দেখিয়েছে। কি দরকার আছে এমন মাতাল বদ চরিত্রের নেশাগ্রস্ত পিতার? তাছাড়া যদি সুচির তীব্র দেহ চাহিদা থেকে থাকে, জয়ন্ত এতদিন কি তার বিন্দু মাত্র বুঝতে পারলো না? এই তেতাল্লিশ বছরে সুচির দেহজ চাহিদা কতখানি হতে পারে যে তার সম্ভোগ তৃপ্তির দরকার থাকতে পারে?
সুচির সাথে গফুরের সম্পর্কটা জয়ন্তের কাছে বড্ড স্ট্রেঞ্জ একটা বিষয় ঠেকছে বারবার। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তা নাহলে সুচির মত নারীর মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা ঐ মাতালের নেই। সেটা যে কি জয়ন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
বাবার ড্রাইভিং সিটের পাশে অংশু বসেছিল। মায়ের চিন্তার বদল কোনোভাবেই হল না। অংশু ভেবেছিল বাবা যে অপরাধ করে মাকে ঠকিয়েছে, সেই অপরাধ মাও করেছে, কাজেই মা কে সে যেভাবে চেনে, মা দীর্ঘ দিন রাগ পোষন করে রাখতে পারার কথা নয়। বিশেষ করে তাদের জন্য, ছেলে-মেয়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে মা এমন সাহসী হতে পারে না। যদিও মা খুব দৃঢ়চেতা, একটা প্রত্যয় রাখে অন্তরে সর্বদা, সেটা ছোটো থেকেই অংশু টের পেয়েছে। কিন্তু সেই দৃঢ়তা মায়ের বড্ড ভালো, বড্ড সদয়, স্নেহ ও ভালোবাসার। যা হয়ত বিট্টু-লাট্টুর জন্য বর্তায়। কিন্তু গফুরের সাথে মায়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় অংশুও বাবার মত সন্দিহান। কি করে সম্ভব হল? অংশু জানে মা মদ্যপান একেবারেই পছন্দ করে না। মায়ের এই প্রভাবে অংশুও মাতালদের একেবারে পছন্দ করে না। তাদের বাড়িতে কেউ কোনোদিন মদ্যপান করেনি। বাবাকে ডাক্তারদের বড় বড় পার্টি থেকে রাত করে ফিরলেও কোনোদিন ড্রিংক করতে দেখেনি অংশু। তাহলে ঐ গফুরের মত প্রবল মাতাল একটা ফুটপাতে পড়ে থাকা লোকের সাথে ঘনিষ্টতা কিংবা বাকি জীবনের সিদ্ধান্ত নেয় কি করে মা? তাছাড়া গফুর একটা রাস্তায় ঘোরা পাগলা ভিখিরি ছাড়া কিছু নয়। ওর জঘন্য স্নান না করা গায়ের দুর্গন্ধ, ময়লা, ঘিনঘিনে মুখ এসবকে কি করে মায়ের মত ঘর-সংসার টিক টিক করে গুছিয়ে রাখা, এক ঘন্টা সাবান শ্যাম্পু স্নানে শুচিবাই মা বরদাস্ত করল কি ভাবে? অংশু নিজে দেখেছে গফুর বাড়িতে এলে মাকে ওর থেকে দূরে নাকে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, কোনোদিন কাগজের থালা ছাড়া ও'কে খেতে দেয়নি। এমনকি নীচতলার মেঝেতেই ও'কে খেতে দিত, কলতলায় মুখ ধুয়ে ওকে নীচ থেকেই ভাগিয়ে দেয়। সেই গফুর সোজা দোতলায় মায়ের বেডরুমে নগ্ন গায়ে ঘনিষ্ট অবস্থায়!
অংশুর অকস্মাৎ মনে পড়ল মায়ের ডায়েরির কথা। মা ডায়েরিতে তার অতীত জীবনের কিছু কথা লিখেছিল। যেখানে ঝুমুর মাসির মৃত্যুর জন্য মা নিজেকে দায়ী করে, গফুরের প্রতি কি এই সহমর্মিতায় মা ওর সঙ্গ দিল? শুধু এটুকু? না, কারণটা অসঙ্গত মনে হল অংশুর। মা ডায়েরিটা যে পুনর্বার লিখেছে সেটাও খেয়াল হল অংশুর। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল ও'। ঐ ডায়েরি কি বাড়িতে আছে? মা কি নিয়ে যায়নি? যদি না নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বাকি লেখা পড়েই কেবল জানা সম্ভব, তারপরে হঠাৎ কি হল যে মা গফুরের মত নোংরা লোকের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠল?
জয়ন্ত ছেলেকে বলল---তোকে মেইন রোডে নামিয়ে দিলে চলবে? আমাকে ডিউটি যেতে হবে।
এতক্ষণ পর বাপ-ছেলের কথা হল। অংশু বললে---বাবা, তুমি লাঞ্চ করবে না?
---নাঃ। সকালে বড় করে টিফিন করেছি। এখন খিদে নেই।
আসলেই জয়ন্তের বিষন্ন হৃদয়ে এখন একটা নিভৃতি দরকার। কাজের মধ্যে থাকলে পরে বরং ভালো। খিদেটাও তেমন পাচ্ছে না।
***
"Divorce is not a tragedy. Divorce is the end result of an unhappy marriage. There may be love, there may be affection, but there is no happiness. Divorce is still not a tragedy, but also opens up many new possibilities; Good and evil."
একুশ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর বাইশতম বছরে বিচ্ছেদপত্রে সই করতে করতে জয়ন্তের বারবার মনে আসছিল উক্তিটি। কে বলেছে, কোথায় বলেছে যদিও মনে পড়ছে না তার।
আজ এক হপ্তা হল সুচিত্রা গোবিন্দপুরে চলে গেছে। ওখান থেকে সে এসেছে সরাসরি কলকাতায়। উকিলের চেম্বারে নির্বিবাদে সই স্বাক্ষরিত হল। সই করবার আগে পূর্ণাঙ্গ ডিভোর্স পেপার পড়বার জন্য উকিল সমরেশ গুপ্ত জয়ন্তকে বললে। জয়ন্তের কোনো ইচ্ছে নেই কি লেখা আছে তাতে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়বার।
অংশু কাছেই ছিল। বাবা-মায়ের দাম্পত্য ভাঙনের স্বাক্ষী সে। এক বুক অভিমান তার নীরবে রয়ে গেল। কেউ টের পেল না। যদিও সে নিজেকে পাথরের মত প্রস্তুত করেছে।
জয়ন্ত দাশগুপ্ত কিংবা সুচিত্রা দাশগুপ্ত তাদের বাইশ বছরের দাম্পত্যকে ভেঙে দিল অতি সহজে। মাত্র একমাসেই সব ওলটপালট হয়ে গেল।
জয়ন্ত যদি মিউচুয়াল ডিভোর্সে না যেত তাহলে হয়ত এত সহজে সুচি ডিভোর্স পেত না। তিনমাসের ন্যূনতম পিটিশন তারপর কোর্ট কেস এসবে উভয়কেই ছোটাছুটি করতে হত। কিন্তু সুচির ইচ্ছের কাছে জয়ন্ত অবনত হয়েছে। যার সাথে তার সংসার, সন্তান-সন্ততি, সেই যখন তাকে এত কঠিন সাজা দিতে চায়, সেই যখন চায় গফুরের মত একটা নিকৃষ্ট মানুষই তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হোক, তখন জয়ন্তের আর সম্পর্ককে বেঁধে রেখে কি লাভ।
সুচি আর জয়ন্ত পাশাপাশি বসে। সুচি একটা কমলা রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। মানানসই ছোপছোপ বাদামি ব্লাউজ। একটা সাড়ম্বরতা নজরে আসছে এই শাড়িতে। সুচি কি তাদের এই বিচ্ছেদ কে উপভোগ করতেই এমন বর্ণজ্জ্বল গর্জিয়াস শাড়ি পরেছে! নাকি নিজের ভবঘুরে নেশাখোর প্রেমিকের কাছে চলে যাবার স্বাধীনতায় সুচির এই আড়ম্বরপূর্ণতা? জয়ন্ত সদ্য প্রাক্তন হওয়া স্ত্রীয়ের দিকে তাকিয়ে এখনো মূল্যায়ন করছে নানাবিধ প্রশ্নের।
কিন্তু সেসব মূল্যায়ন নিছকই। ডিভোর্সের পর সুচিত্রা তার কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বলল---অংশু, যখনই মন খারাপ করবে চলে আসিস বাবা। আমার ওপর রাগ করিসনে।
মায়ের হাত অংশুর গালে। সে বলল---তুমি আজ বাড়ি আসবে না?
বাড়ি বলতেই বুকটা কেমন হাহাকারে মোচড় দিয়ে উঠল অংশুমানের। মায়ের বাড়ি তো এখন গোবিন্দপুর। সুচিত্রা ছেলেকে বললে---না রে, বিট্টু-লাট্টু একা আছে। ডালিয়া তেমন লক্ষ্য নজর করে না।
জয়ন্ত নীরব রইল। ফেরার সময় বাপ-ছেলে একসাথে ফিরল। সুচি উকিলের চেম্বারের অদূরে মৌলালির দিকে যাওয়া বড় রাস্তায় হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল সুচিত্রা। জয়ন্তের জীবনের মোড় এখন অন্যদিকে, সুচিত্রার পথ ভিন্ন। সুচি হয়ত চাইবে গফুরকে সভ্য করে তুলতে। যে কাজ অসম্ভব বলে মনে করে জয়ন্ত। সুচির পাগলামি ছাড়া এ কাজ আর কিচ্ছু নয়। সুচি যে কেন গফুরের মত একটা নেশাখোর মাতাল ফুটপাতবাসীকে নিজের জীবনের অঙ্গ করে নিতে চায় জয়ন্ত এখনো বুঝে উঠতে পারল না। আসলে এই অসম সম্পর্কটা সামাজিক অভ্যাস বহির্ভুত, যাকে মেনে নেওয়া বা বিশ্বাস করা বড্ড কঠিন। জয়ন্তের মনে পড়ে চন্দননগরে থাকাকালীন শিউলি দিদির কথা। ইংরেজিতে মাস্টার্স করা শিউলিদিদি ছিল অবনী ডাক্তারের মেয়ে। অবনী ডাক্তারকে জয়ন্ত ছোটবেলা থেকে জেঠু বলত। সেই শিউলি দিদি পালিয়ে বিয়ে করেছিল একটা লোফার মূর্খ ছেলেকে। ছেলেটা কাজকম্ম বলতে ইলেক্ট্রিকের লাইন সারাতো। কত সমালোচনা হয়েছিল পাড়ায়। আর তাতেই মুখ ঢাকতে অবনী ডাক্তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি বিক্রি করে চলে যান।
রফিকুলের কথা মনে পড়ে জয়ন্তের। নিপাট মূর্খ একটা ছেলে, জয়ন্তের বয়সী। জয়ন্তের ক্লাসমেট ছিল। কলেজ কমপ্লিট না করেই পড়া ছাড়লো। শিল্পাঞ্চলের এক নেতার চামচাগিরি করতে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছে, সেই একদিন বিয়ে করল নিজের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় এক মহিলার সাথে। মহিলা নাকি কোনো এক কলেজমাস্টারের স্ত্রী। ভাগিয়ে এনেছিল তাকে।
এই সম্পর্কগুলো অসম শ্রেণী, অসম মর্যাদা কিংবা অসম শিক্ষার। জয়ন্ত শুনত ইতিউতি; এসবের পেছনে ছিল নাকি আসলে মহিলাদের প্রচণ্ড লিবিডো। শুধুমাত্র যৌন তাড়নায় অতৃপ্ত নারীরা ভালোমন্দ বিচার না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এসব সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে অসুখী হয় মহিলারা। কিন্তু সুচিত্রা? গফুর একটা থার্ডক্লাস ভিখিরি ছাড়া কিছু নয়। ওর নোংরা কুচ্ছিত দেহ, ঘৃণিত স্নান না করা বহুদিনের দুর্গন্ধ কোনো নারীর মধ্যে যৌন চাহিদা তৈরি করতে পারবে না, তবে সুচির মত শুচিবাই শিক্ষিতা নারী কেনই বা ওকেই বেছে নিয়েছে বাকি জীবনের জন্য? শুধু কি বিট্টু-লাট্টুকে পূর্ন পরিবার দেওয়ার জন্য? এটা হতে পারে না। বিট্টু-লাট্টু কে তো এ বাড়িতে জয়ন্ত কখনো খাটো চোখে দেখেনি। বরং সুচির মত না হোক, সন্তান স্নেহ সেও দেখিয়েছে। কি দরকার আছে এমন মাতাল বদ চরিত্রের নেশাগ্রস্ত পিতার? তাছাড়া যদি সুচির তীব্র দেহ চাহিদা থেকে থাকে, জয়ন্ত এতদিন কি তার বিন্দু মাত্র বুঝতে পারলো না? এই তেতাল্লিশ বছরে সুচির দেহজ চাহিদা কতখানি হতে পারে যে তার সম্ভোগ তৃপ্তির দরকার থাকতে পারে?
সুচির সাথে গফুরের সম্পর্কটা জয়ন্তের কাছে বড্ড স্ট্রেঞ্জ একটা বিষয় ঠেকছে বারবার। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তা নাহলে সুচির মত নারীর মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা ঐ মাতালের নেই। সেটা যে কি জয়ন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
বাবার ড্রাইভিং সিটের পাশে অংশু বসেছিল। মায়ের চিন্তার বদল কোনোভাবেই হল না। অংশু ভেবেছিল বাবা যে অপরাধ করে মাকে ঠকিয়েছে, সেই অপরাধ মাও করেছে, কাজেই মা কে সে যেভাবে চেনে, মা দীর্ঘ দিন রাগ পোষন করে রাখতে পারার কথা নয়। বিশেষ করে তাদের জন্য, ছেলে-মেয়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে মা এমন সাহসী হতে পারে না। যদিও মা খুব দৃঢ়চেতা, একটা প্রত্যয় রাখে অন্তরে সর্বদা, সেটা ছোটো থেকেই অংশু টের পেয়েছে। কিন্তু সেই দৃঢ়তা মায়ের বড্ড ভালো, বড্ড সদয়, স্নেহ ও ভালোবাসার। যা হয়ত বিট্টু-লাট্টুর জন্য বর্তায়। কিন্তু গফুরের সাথে মায়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় অংশুও বাবার মত সন্দিহান। কি করে সম্ভব হল? অংশু জানে মা মদ্যপান একেবারেই পছন্দ করে না। মায়ের এই প্রভাবে অংশুও মাতালদের একেবারে পছন্দ করে না। তাদের বাড়িতে কেউ কোনোদিন মদ্যপান করেনি। বাবাকে ডাক্তারদের বড় বড় পার্টি থেকে রাত করে ফিরলেও কোনোদিন ড্রিংক করতে দেখেনি অংশু। তাহলে ঐ গফুরের মত প্রবল মাতাল একটা ফুটপাতে পড়ে থাকা লোকের সাথে ঘনিষ্টতা কিংবা বাকি জীবনের সিদ্ধান্ত নেয় কি করে মা? তাছাড়া গফুর একটা রাস্তায় ঘোরা পাগলা ভিখিরি ছাড়া কিছু নয়। ওর জঘন্য স্নান না করা গায়ের দুর্গন্ধ, ময়লা, ঘিনঘিনে মুখ এসবকে কি করে মায়ের মত ঘর-সংসার টিক টিক করে গুছিয়ে রাখা, এক ঘন্টা সাবান শ্যাম্পু স্নানে শুচিবাই মা বরদাস্ত করল কি ভাবে? অংশু নিজে দেখেছে গফুর বাড়িতে এলে মাকে ওর থেকে দূরে নাকে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, কোনোদিন কাগজের থালা ছাড়া ও'কে খেতে দেয়নি। এমনকি নীচতলার মেঝেতেই ও'কে খেতে দিত, কলতলায় মুখ ধুয়ে ওকে নীচ থেকেই ভাগিয়ে দেয়। সেই গফুর সোজা দোতলায় মায়ের বেডরুমে নগ্ন গায়ে ঘনিষ্ট অবস্থায়!
অংশুর অকস্মাৎ মনে পড়ল মায়ের ডায়েরির কথা। মা ডায়েরিতে তার অতীত জীবনের কিছু কথা লিখেছিল। যেখানে ঝুমুর মাসির মৃত্যুর জন্য মা নিজেকে দায়ী করে, গফুরের প্রতি কি এই সহমর্মিতায় মা ওর সঙ্গ দিল? শুধু এটুকু? না, কারণটা অসঙ্গত মনে হল অংশুর। মা ডায়েরিটা যে পুনর্বার লিখেছে সেটাও খেয়াল হল অংশুর। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল ও'। ঐ ডায়েরি কি বাড়িতে আছে? মা কি নিয়ে যায়নি? যদি না নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বাকি লেখা পড়েই কেবল জানা সম্ভব, তারপরে হঠাৎ কি হল যে মা গফুরের মত নোংরা লোকের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠল?
জয়ন্ত ছেলেকে বলল---তোকে মেইন রোডে নামিয়ে দিলে চলবে? আমাকে ডিউটি যেতে হবে।
এতক্ষণ পর বাপ-ছেলের কথা হল। অংশু বললে---বাবা, তুমি লাঞ্চ করবে না?
---নাঃ। সকালে বড় করে টিফিন করেছি। এখন খিদে নেই।
আসলেই জয়ন্তের বিষন্ন হৃদয়ে এখন একটা নিভৃতি দরকার। কাজের মধ্যে থাকলে পরে বরং ভালো। খিদেটাও তেমন পাচ্ছে না।
***