07-12-2024, 11:40 PM
তমাল মধুছন্দা দেবীর ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে জলখাবার সেরে নিলো। হাত ঘড়ি দেখে হিসাব করে নিলো মৌপিয়াকে নিয়ে ঘনশ্যাম বাবুর ফিরতে এখনো প্রায় আধঘন্টা দেরি হবে। বাড়ি এখন একদম ফাঁকা, তমাল একটু ভেবে চারতলায় উঠে এলো। তারপর রাজীবের ঘরে ঢুকে পড়লো।
এ ঘরটাও লক্ করা নেই। বিস্তর কাগজ পত্র ছড়ানো রয়েছে। টেবিলের উপরে একটা কম্পিউটার ও রাখা আছে। তমাল এগিয়ে এসে কম্পিউটার অন করলো।কিন্তু সেটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড। তমাল কম্পিউটার ছেড়ে কাগজপত্রে মন দিলো। এখনো পর্যন্ত রাজীবের উপর আঘাতটা প্রেম জনিত কারণেই মনে হলেও তমালের মনে হয়েছে অন্য অ্যাঙ্গেল গুলোও খুঁজে দেখা উচিৎ। এই বাড়িতে শুধু রাজীব হত্যার চেষ্টা নয়, অন্য কোনো খেলাও চলছে পর্দার আড়ালে।
প্রায় মিনিট কুড়ি ঘাঁটাঘাঁটির পরেও কিছুই পাওয়া গেলোনা। সবই সাধারণ ব্যবসায়িক কাগজপত্র। হিসাব সংক্রান্ত কোনো ফাইল পাওয়া গেলো না। উঠতে যাবে, তখনি খুট্ করে একটা আওয়াজ হলো দরজায়। পিছনে ফিরে দেখলো বন্দনা দাঁড়িয়ে আছে। তমাল বললো, এসো, তবে ঘরে ঢোকার আগে নক্ করতে হয় বন্দনা।
বন্দনা মুচকি হেসে বললো, আপনার ঘরেতো ঢুকিনি? এটাতো রাজীবদার ঘর, এই ঘরে আমি যখন খুশি আসতাম। আপনি এখানে কি করছেন?
মনে মনে চমকে উঠলো তমাল। যতোটা ভেবেছিলো, বন্দনা তার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। সে বললো, কিছুনা, এমনি হাতে সময় ছিলো, ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবো, কিন্তু তার তো আসতে দেরি আছে, তাই ঘুরতে ঘুরতে চারতলায় এসে এই ঘরে ঢুকলাম। আমি তো ল্যাপটপ আনিনি, এখানে কম্পিউটার দেখে ভাবলাম একটা জরুরি ইমেইল করবো। কিন্তু কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দেওয়া, তাই আর করা হলো না। বলো তুমি কেন এসেছো?
ঘনশ্যাম কাকা এসে গেছেন, বুড়িটা আপনাকে বলতে বললো সে কথা। আপনার ঘরে পেলাম না আপনাকে, তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলাম।
তমাল বললো, ওহ, এসে গেছেন? ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি এই ঘরে তাহলে খুব আসতে, তাই না?
কথাটা শুনেই ঘরে রাখা খাটের দিকে চোখ চলে গেলো বন্দনার। মুখে দেখা দিলো সেই ফিচেল হাসিটা। বললো, খুউউব!
-তোমার রাগ হয়নি রাজীবকে অদিতির সাথে দেখে?
- সে তো আমি আগেই জানতাম। কতোবার লুকিয়ে ওদের দেখেছি! সেরকমই একবার লুকিয়ে দেখছিলাম, তখন আমাকে দেখে ফেলে রাজীবদা। সন্ধ্যে বেলা চা দিতে এলে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে। বললো সে আমাকেই ভালোবাসে, কিন্তু চাকরি রাখতে গেলে মনিবকে খুশি তো করতেই হয়? অদিতিদি নাকি তাকে এসব করতে জোর করতো।
- আর মৌপিয়ার সাথেও কি চাকরি বাঁচাতেই এসব করতো?
মৌপিয়ার নাম শুনেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখটা থমথমে হয়ে উঠলো বন্দনার। বললো-
- ওই বুড়ি মাগীর কথা বারবার তোলেন কেন? ওই মাগীর আমাকে রাজীবদার সাথে দেখেই কুটকুটানি জেগে ওঠে। তারপর জোর করে রাজীবদাকে জড়িয়ে ফেলে। মনিবের ভাইজি বলে কথা?
- তুমিও তো মনিবের মেয়ে?
- হুহ্! সে তো নামেই মেয়ে, আসল মেয়ে তো আর না?
- তোমাকে এসব কথা কে বলেছে? নিজেই ভেবে নিয়েছো? নাকি রাজীব বলেছে?
- রাজীবদা বলেছে আমাকে।
- তাহলে মৌপিয়ার উপরে তোমার রাগ সেই কারণেই, তাই তো?
- এছাড়াও বুড়ি মাগীটা আমাকে সহ্য করতে পারে না, যখন তখন অপমান করে আর অযথা খাটায়।
- খুন করতে ইচ্ছা করে না মৌপিয়া কে?
- করে না আবার? একটা ডান্ডা দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো।
- অথবা সিঁড়িতে শ্যাম্পু ফেলে আছাড় খাইয়ে মাথা ফাটিয়ে, কি বলো?
বন্দনার মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলো নিমেষে। বললো, আমি যাই, আপনাকে নীচে ডাকছে।
বলেই পিছন ঘুরে চলে যাচ্ছিলো বন্দনা। তমাল তার একটা হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলো। সে টাল সামলাতে না পেরে এসে পড়লো সোজা তমালের কোলের উপর। তমাল সাথে সাথে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো বন্দনা, কিন্তু সে চেষ্টায় সদিচ্ছা তেমন নেই। তমাল দেরি না করে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো বন্দনার ঠোঁটে। তারপর তমালের বিখ্যাত মেয়েদের ঘায়েল করা চুমু খেতে শুরু করলো।
তমালের বুকের ভিতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে বন্দনা। তামালের একটা হাত তার কোমর জড়িয়ে রেখেছে, অন্য হাতটা অসভ্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বন্দনার কচি ডাঁসা মাইয়ের উপরে।
দীর্ঘ দু মিনিট ধরে চললো সেই চুম্বন। তারপরে তমাল ঠোঁট সরিয়ে নিলো। বন্দনা রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে। হাতের উলটো দিক দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বললো, অসভ্য!
তমাল ছেড়ে দিতেই উঠে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। তমাল বললো, এখন একটু বাইরে যাবো। দুপুর বেলায় আমার কোনো কাজ নেই, তোমার আছে কি?
ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটলো বন্দনার। বললো, কাজের ফাঁকও আছে। তারপরেই দরজার দিকে এগোলো। বাইরে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, পাসওয়ার্ড চাই?
তমাল প্রথমে বুঝতে পারলো না বন্দনার কথা। বললো, মানে?
সে আবার বললো, কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড চাই?
অবাক হয়ে গেলো তমাল। বললো, তুমি জানো পাসওয়ার্ড?
বন্দনা ফিরে এসে কলম তুলে নিয়ে একটা কাগজে খসখস করে লিখে দিলো একটা জটিল পাসওয়ার্ড। তারপর একমুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
হতভম্বের মতো সেদিকে চেয়ে রইলো তমাল। মেয়েদের অনেক রূপ সে দেখেছে। কিন্তু প্রতিবারই তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েরা নতুন নতুন রূপ নিজে হাজির হয় তার সামনে। এটা রাজীবের অফিসিয়াল কম্পিউটার। একটা অত্যন্ত গোপন বিষয় সে জানতে পেরেছে। সুতরাং স্ট্রং পাসওয়ার্ড দিয়ে কম্পিউটার প্রোটেক্ট করবে সে, এটাই স্বাভাবিক। বন্দনার লেখা পাসওয়ার্ডটা দেখে তমাল বুঝেছিলো সে চেষ্টাও সে করেছে। যতোটা জটিল করা সম্ভব করেছিলো রাজীব। কিন্তু বন্দনার মতো মেয়ে সেটা কিভাবে জানলো! শুধু জানেনি, মনেও রেখেছে। অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত! তাহলে কি রাজীব যথেষ্ট সতর্ক নয়? তার কাজকর্মের খবর কি অনেকেই জানে? সেভাবেই কি রিনা অরোরা জানতে পেরেছিলো কিছু? তাই তার অফিসে আর অনুপস্থিতিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলো? নাকি বন্দনা অস্বাভাবিক বুদ্ধিমতি বা স্মৃতিধর?
ভাবতে ভাবতে নীচে নেমে এলো তমাল। ঘনশ্যাম তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। গাড়িতে উঠে তমাল বললো একবার থানায় চলুন তো। থ্রিলার সিনেমায় যেমন কিছু ড্রাইভার দেখা যায়, গম্ভীর মুখ করে রাখে, দশটা প্রশ্ন করলে আধখানা উত্তর দেয়। মুখ দেখলে মনে হয় সেই ভিলেন। ঘনশ্যাম বাবুর চেহারা অনেকটা সেই রকম। কথা বলতে শুরু করে তমাল বুঝলো, ব্যবহারও তথৈবচ।
আপনি কতোদিন কাজ করছেন এই বাড়িতে ঘনশ্যাম বাবু?.. প্রশ্ন করলো তমাল।
প্রথমে মনে হলো তমালের প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। তমাল আবার জিজ্ঞাসা করলে খুব সংক্ষেপে জবাব দিলো, দু বছর। দ্বিতীয় বার বহাল হবার সময়টা উল্লেখ করলো সে, বুঝতে পারলো তমাল।
সে তো মধুছন্দা দেবী আবার ডেকে আনার পর। আমি প্রথমবার ড্রাইভারি করার সময়টা জানতে চাইছি, বললো তমাল। উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না ঘনশ্যাম।
তমাল আবার জানতে চাইলো, আপনি মধুছন্দা দেবীর বাবার আমল থেকে কাজ করছেন, তাই না? এবার ও কোনো উত্তর নেই।
এবারে তমাল সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলো, আপনার চাকরি কেন গেছিলো ঘনশ্যাম বাবু? কোনো চুরি টুরির কেস নাকি? আত্মসম্মানে আঘাত করতে চাইলো তমাল।
এবারে কাজ হলো। জ্বলন্ত চোখে একবার শুধু পিছনে তাকিয়ে বললো, না। তমাল বললো, বন্দনা আপনার কে হয়? মেয়ে?
তমালের মনে হলো এবারে তমালকে চোখের আগুনে ছাই করে ফেলবে, এভাবে তাকিয়ে বললো, আমার কেউ হয় না। অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছি।
আরও তো অনেক মেয়ে ছিলো সেখানে, বন্দনাকেই কেন আনলেন? সাধারণত অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিলে ছোট বাচ্চাদেরই নেওয়া হয়, একজন যুবতি মেয়েকে কেউ দত্তক নেয় শুনিনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঘনশ্যাম বললো, মালকিনের পছন্দ হয়েছিলো মেয়েটাকে, তাই নিয়ে নিয়েছে। এতে অসুবিধার কি আছে?
না না, অসুবিধার আর কি থাকবে? কিন্তু মালকিন তো অন্য কাউকে দেখেননি। আপনি এই মেয়েটাকেই দেখিয়েছেন। কেন? আপনার এতো টান কেন মেয়েটার উপর? আবার মৌনব্রত অবলম্বন করলো ঘনশ্যাম।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, মধুছন্দা দেবী কি হোমে গিয়েই বন্দনাকে দেখেছিলেন? নাকি বন্দনাকে আপনি নিয়ে এসেছিলেন তার কাছে? ঘনশ্যাম তাড়াতাড়ি বললো, না উনি হোমে কখনো যাননি। আমিই বন্দনাকে নিয়ে এসেছিলাম।
আচ্ছা? কিন্তু একটা বেসরকারি হোম একটা যুবতি মেয়েকে তাদের ড্রাইভারের সাথে চিত্তরঞ্জন থেকে আসানসোল ছাড়বে কেন? যদি না সে তার স্থানীয় অভিভাবক হয়?
তমালের ভুল ও হতে পারে, কিন্তু রিয়ারভিউ মিররে যেন সে ঘনশ্যামের চোখে একটা ভয় দেখতে পেলো। সে একটু তুতলিয়ে বললো, ন.. না, এখানে না, অন্য জায়গায় দেখেছিলো মালকিন।
সাথে সাথে প্রশ্ন করলো তমাল, কোথায়? ঘনশ্যাম বললো, আমি এতো কথা বলতে পারবো না, আপনি মালকিনের কাছ থেকে শুনে নেবেন।
তমাল বললো, কেন? নিয়ে তো আপনি গিয়েছিলেন, তাহলে বলতে আপত্তি কিসের? কোনো গোপন কিছু আছে নাকি এর ভিতরে? ঘনশ্যাম বললো, না, গোপন আবার কি? তবু মালকিন এসব নিয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করেছেন। আপনি তার সাথেই কথা বলবেন।
আচমকা প্রসঙ্গ পালটে তমাল প্রশ্ন করলো, আপনার কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ঘনশ্যাম বাবু?
ইউকো ব্যাংকে, কিছু না ভাবেই উত্তর দিলো ঘনশ্যাম। তারপর থমথমে মুখে বললো, আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিয়ে কি করবেন?
তমাল বললো, কিছু না, আসলে বেশি টাকা পয়সা পেলে ব্যাংকে তো রাখতেই হয়, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। আপনি কিন্তু বললেন না, কেন চাকরি গিয়েছিলো আপনার?
থানা এসে গেছে বাবু। রুষ্ট ভঙ্গীতে বললো ঘনশ্যাম। তমাল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো, হুম, তাহলে থানার বড় বাবুকেই জিজ্ঞাস করে দেখি, উনি জানেন কি না? আপনি অপেক্ষা করুন, একটু সময় লাগবে আমার।
আসানসোলে বোধহয় ক্রাইম ট্রাইম কম হয়, থানা বেশ ফাঁকাই আছে। তমাল ঢুকতেই একজন সেপাই হেঁকে বললো, কি চাই? এখন হবে না, দুটোর পরে আসুন। তমাল বিনীত ভাবে বললো, বড়বাবুর সাথে একটু দেখা করতে চাই। সেপাই মেজবাবু বা ছোটবাবু টাইপের একজনকে দেখিয়ে দিলো।
তমাল তাকে আসার কারণ বলে নিজের কার্ডটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। কিছুদিন হলো এটা বানিয়েছে তমাল নিজের গোয়েন্দা পরিচয় জানিয়ে।
সেটা হাতে নিয়ে মাঝবয়সী পুলিশ ভদ্রলোক নাকের ডগা থেকে চশমাটা মাথায় তুলে দিলো। তারপর কার্ডটাকে প্রায় নাকে ঠেকিয়ে পড়তে লাগলো। হাসি পেলো তমালের। চশমা ছাড়াই যদি পড়বে তাহলে নাকে একটা চশমা ঝুলিয়ে রাখার কি দরকার?
অ.. টিকটিকি! সরকার যে কেন আমাদের মাইনে দেয় বুঝিনা, এদের দিয়েই কাজ করালে পারে? চারিদিকে শুধু ব্যাঙের ছাতার মতো টিকটিকি আর টিকটিকি। বৌয়ের সাথে রাতে বিছানায় ধস্তাধস্তির সময় কান থেকে পড়ে যাওয়া কানের দুল ব্লাউজের খাঁজ থেকে উদ্ধার করে দিয়েই সবাই নিজেকে গোয়েন্দা ভাবে। গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর অবজ্ঞা মেশানো সুরে বললেন, বসুন, বলছি বড়বাবুকে। তারপর উঠে একটা কেবিনের সুইং ডোর ঠেলে ঢুকে গেলেন ভিতরে।
তমাল বাইরেই অপেক্ষা করছিলো। এমন সময় বড়বাবুর কেবিন থেকে বেল এর আওয়াজ শুনতে পেলো। সেপাই ভিতরে ঢুকেই বেরিয়ে এসে তমালকে বললো, যান, বড়বাবু ডাকছেন আপনাকে।
তমাল ওসির ঘরে ঢুকলো। সেই মেজ বা ছোটবাবু তখনো সেখানেই ছিলো। তমাল ঢুকে দেখলো ওসির হাতে তার কার্ডটা তখনো ধরা।
কিংশুক মজুমদার... প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আচ্ছা বাই এনি চান্স আপনি কি বর্ধমানে বছর কয়েক আগে কোনো পুরানো জমিদার বাড়ির গুপ্তধন উদ্ধার করেছিলেন? তমাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বড়বাবু বললেন, আরে বসুন বসুন মিঃ মজুমদার। আপনি তো বিখ্যাত লোক মশাই। তখন আমার এক সিনিয়ার সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ছিলেন, বিপ্লব মুখার্জি। তিনি আপনার কথা আমাকে বলেছিলেন। মুখার্জিদা তো আপনার প্রশংসার পঞ্চমুখ। তা আসানসোল কি মনে করে? কোনো তদন্ত টদন্ত নাকি?
মেজবাবু ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র কেজি তিনেক চিরতা চিবিয়েছেন। একটু আগে বলা নিজের কথাগুলোর জন্য অল্প লজ্জাও বোধ করছেন। বড়বাবু তার দিকে ফিরে বললেন, আমাদের জন্য দুকাপ চা পাঠিয়ে দিতে বলুন তো মেজবাবু।
যাক্, ছোটো নন, ইনি মেজবাবুই। তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলে বড়বাবু আবার বললেন, বলুন কিংশুক বাবু, আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তমাল সামনে রাখা নেমপ্লেটে চোখ বুলিয়ে বললো, মিঃ ঘোষ, আমাকে তমাল বলেই ডাকবেন, আমার ডাকনাম ওটা। আমি আসলে মুখার্জি বাড়ির হত্যার চেষ্টা কেসটার জন্য এসেছি।
ও, আই সি! ওই কেসটা? তা আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করলো কে? রাহুল মুখার্জি? আপনিও কি তাকে বাঁচাতে পারবেন তমালবাবু? সব সাক্ষ্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষদর্শী অবশ্য কেউ নেই, তবে ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছানো সাক্ষী আছে জনা তিনেক। তারা ছুরি হাতে ধরা অবস্থায় তাকে দেখেছে। আঙুলের ছাপ তো আছেই, জামায় রক্তের দাগও আছে। তাছাড়া যা জানা গেছে, সে ভিকটিমকে বিশেষ পছন্দ করতো না।
তমাল ইনস্পেক্টর ঘোষের লম্বা বক্তব্য শুনলো। তারপর মৃদু হেসে বললো, না আমাকে রাহুল অ্যাপয়েন্ট করেনি। আমি আসলে ওই বাড়ির মেয়ে অদিতি মুখার্জির বন্ধুর বন্ধু। সেই বন্ধু হলো ওই পুরানো জমিদার বাড়ির মেয়ে, যে কেসটার কথা আপনাকে ইনস্পেক্টর মুখার্জি বলেছিলেন। বান্ধবীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সেই বান্ধবী গার্গী আমাকে কেসটার কথা বলে। আমি একটু কৌতুহলী হয়েই এখানে আসি। তখন মিসেস মুখার্জি, আই মিন মধুছন্দা মুখার্জী আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেন কেসটা ইনভেস্টিগেট করতে।
সব শুনে ইনস্পেক্টর ঘোষ বললেন, বুঝলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, কেসটা প্রায় ওপেন অ্যান্ড শাট্ কেস। বিশেষ সুবিধে হবে না মশাই।
কথার মাঝেই চা চলে এলো, সাথে বিস্কুট।চায়ে চুমুক দিয়ে তমাল বললো, মোটিভ কিছু পেলেন? মিঃ ঘোষ তখন চায়ে বিস্কুট ভেজানোর জটিল কেসে ব্যস্ত। ভেজা ল্যাতপেতে বিস্কুটকে অনেকটা উপরে তুলে মুখে ঢোকানো একটা জটিল কেসের চেয়ে কম কিছু না। টাইমিং সঠিক হওয়া চাই, নাহলে বিস্কুট দাগী আসামীর মতো চায়ের কাপের তলদেশে এমন ভাবে লুকাবে যে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিকে অখন্ড মনোযোগ রেখেই মিঃ ঘোষ বললেন, ওই যে বললাম, রাহুল মুখার্জি ভিকটিমকে পছন্দ করতো না?
তমাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো, মোটিভ হিসাবে এটা ভীষন খেলো হয়ে গেলো না? কোর্টে টিকবে এই মোটিভ? জজসাহেব যখন জিজ্ঞাসা করবে, কেন পছন্দ করতো না, কি বলবেন?
এই প্রথমবার একটু চিন্তিত দেখালো ইনস্পেক্টর ঘোষ কে। মাথা চুলকে বললো, হুম, এটা আমিও ভেবেছি। খুনের চেষ্টার মামলা হিসাবে মোটিভটা বড্ড কমজোরি। কিন্তু আর কোনো মোটিভ তো দেখছি না?
এর চেয়ে স্ট্রং মোটিভ আমি দিতে পারি আপনাকে, বললো তমাল। দপ্ করে জ্বলে উঠলো ইনস্পেক্টরের চোখ। উৎসাহ নিয়ে বললো, বটে, বটে! বলুনতো শুনি? কেসটা হাইপ্রোফাইল কেস। খুব বড়লোক বাড়ি, আসানসোলে নাম-ডাকও প্রচুর এদের। বেশ কিছুদিন হলো কেসটা থমকে আছে, সলভ করতে পারলে উপরমহলের নেক নজরে পড়ার সম্ভবনা আছে।
তমাল বললো, রাহুলের ফ্যাক্টরিতে একটি সেক্রেটারি আছে, মহিলা। নাম, রিনি অরোরা। তার সাথে একটা প্রনয়ের সম্পর্ক আছে রাহুলের। ওদিকে এই মেয়েটি আবার ভিকটিমের পূর্বপরিচিতা। আমার ধারণা তাদের ভিতরেও একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে। দুজন দুজনের সহপাঠী ছিলো। রাজীব এখানে চাকরি নিয়ে আসার পরে সে ই মেয়েটিকে বলে এখানে চাকরি নিতে। সেই মতো মেয়েটি রাহুলের সাথে ভাব জমায়, এবং চাকরি খুঁজছে সেটা বলে। রাহুলও টোপ গিলে তাকে নিজের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসে নিজের সেক্রেটারি করে। ধীরে ধীরে তার প্রেমেও পড়ে। বাড়ির সবাইও জানে তাদের এই প্রেমের কথা এতোটাই ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছে তাদের রিলেশন।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো, কিন্তু মজার কথা হলো, রাজীব আর রিনির পূর্বপরিচয়ের কথা এবং তাদের প্রেমের কথা দুজনেই বেমালুম চেপে গেছে রাহুলের কাছে। এখন রাহুল যদি কোনোভাবে এই পরিচয়ের কথা বা তাকে চিট্ করার কথা জেনে গিয়ে থাকে, তাহলে খুনের জন্য একটা জোরদার মোটিভ তৈরি হয় বইকি?
ইনস্পেক্টর ঘোষ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, বটেই তো, এ তো ভীষণ স্ট্রং মোটিভ। সেক্সুয়াল জেলাসির জন্য খুনের ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহরণ আছে। ঠিক আছে আমি রিনি আর রাজীবকে তুলে নিয়ে জেরা করে দেখি।
তমাল তাড়াতাড়ি বললো, মিঃ ঘোষ, আপনার কাছে আমার অনুরোধ এই কাজটা করবেন না। অন্তত এখনি নয়। আচ্ছা রাহুল যে খুন করার চেষ্টা করেছে এটার সপক্ষে তো যুক্তি আছে। এবার উলটোটা ভেবে দেখি। তার জামায় রক্তের দাগ ছিলো বলছেন। সেটা এলো কিভাবে?
ছুরি দিয়ে খুন করতে গেলে রক্ত ছিটকে জামায় লাগবে, এতে আর রহস্য কিছু আছে কি?
না,তা নেই, কিন্তু আমি যতোদূর শুনেছি তার জামা রক্তে ভিজে গিয়েছিলো। স্ট্যাব উন্ড থেকে ছিটকে রক্ত লাগে, এভাবে ভিজে যায় না। ভিজতে পারে যদি কেউ তাকে স্ট্যাবড হবার পরে কোলে তুলে নেয়। তাহলে রাহুল কি ছুরি গেঁথে দিয়ে, হায় আমি এ কি করলাম বলে তার মাথা কোলের উপর তুলে বিলাপ করছিলো? নাকি আগে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, তারপর তার পিঠে ছুরি মেরে সবাই এসে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো?
ইনস্পেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ বোকা নন মোটেই, বরং বেশ বুদ্ধিমান। তিনি তমালের তোলা প্রশ্নগুলোর যথার্থতা অনুধাবন করতে পারলেন। আবার তার বা হাতের মধ্যমাটা ব্রহ্মতালু চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একটু ভেবে বললেন, আচ্ছা হতেও তো পারে রাগের মাথায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে তার ভীষন অনুতাপ হয়, এবং আপনি যেমন বললেন, সেভাবে হায় আমি এ কি করলাম বলে কাঁদতে লাগলো। একেবারে অসম্ভব কি?
না মোটেই অসম্ভব না। অনুতাপ খুব ভালো জিনিস। মনকে শুদ্ধ করে। পাপী কে ধার্মিক বানিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদাতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে হাতে ছুরি ধরা থাকবে কেন? প্রথমেই তো সেটা ফেলে দিয়ে তারপর জড়িয়ে ধরবে, তাই না? যুক্তিজালে আটকে ফেললো তমাল।
মধ্যমা ততোক্ষণে ঝালা স্পিডে সেতার বাজাচ্ছে টাকে। ইনস্পেক্টর ঘোষ বললে, হুম, ঠিক বলেছেন তমাল বাবু। এতোটা তলিয়ে ভাবিনি তো। আসলে খুনের চেষ্টার রহস্য জলদি সমাধান করতে গিয়ে সামনে যা পেয়েছি, সেটাকেই অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কেসটা নিয়ে নতুন ভাবে ভাববো আমি।
তমাল বললো, ভাবুন মিঃ ঘোষ। আমিও সাহায্য করবো আপনাকে যথাসম্ভব। কেসের স্বীকৃতি আপনিই নেবেন,এ ব্যাপারে আমার কোনো লোভ নেই। শুধু আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেই হবে।
বলুন কি তথ্য চান? সব পাবেন। এ ছাড়া যখন যা দরকার বিনা দ্বিধায় জানাবেন আমাকে। আমার পার্সোনাল নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে, দরকার হলেই কল করবেন, আন্তরিক ভাবে বললেন ইনস্পেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ।
তমাল বললো, প্রথম যে ইনফরমেশনটা চাই, তা হলো একজন মানুষ সম্পর্কে। মুখার্জি বাড়ির পুরানো অ্যাকাউন্টেন্ট, মিঃ সুরেশ চাকলাদার এখন কোথায় আছেন এটা জানা দরকার। বছর খানেক আগে পর্যন্ত তিনি রাণীগঞ্জে তার মায়ের কাছে ছিলেন, এটুকু জানা গেছে।
ঠিক আছে, আমি খুঁজে বের করে ফেলবো চাকলাদারকে। আর কিছু? জিজ্ঞাসা করলেন ইনস্পেকটর ঘোষ।
হ্যাঁ, কয়েকজন মানুষের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দরকার গত আড়াই তিন বছরের, বলে তমাল কতোগুলো নাম আর ব্যাংকের নাম লিখে দিলো একটা কাগজে।
ইনস্পেকটর ঘোষ কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, হয়ে যাবে। আমি এখনি লোক পাঠাচ্ছি ব্যাংকে।
এরপরে তমাল বললো, মিঃ ঘোষ, অকুস্থল থেকে যে জিনিস গুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো একবার দেখতে পারি?
ইনস্পেকটর ঘোষ বললেন, দেখুন এখনো চার্জশিট তৈরি করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু ওগুলো এগজিবিট হিসাবে কোর্টে পেশ করতে হবে। তবুও আপনাকে দেখাতে পারি, যদি খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করেন।
তমাল বললো, আমি জানি মিঃ ঘোষ। নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি শুধু একবার দেখবো জিনিস গুলো।
ইনস্পেকটর বেল বাজালে একজন সেপাই ভিতরে এলে তিনি তাকে জিনিস গুলো আনতে বললেন। কিছুক্ষণের ভিতরে সেপাই একটা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে এলো। ইনস্পেকটর ঘোষ তার ভিতর থেকে কয়েকটা পলিথিন জিপার প্যাকেট বের করে সামনে রাখলো।
তমাল তার ভিতর থেকে শুধু ছুরির প্যাকেটটা তুলে নিলো। পলিথিন প্যাকেট থেকে বাইরে বের না করেই অনেক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। আঙুল দিয়ে সাইজটাও মেপে নিলো। অদিতির ড্রয়ারে যে ছুরিটা দেখেছিলো তমাল, এটা অবিকল একই রকম দেখতে, নিশ্চিত হলো সে। এরপরে রক্ত মাখা রাহুলের জামার প্যাকেটটা তুলে নিলো। শুকিয়ে কালো দাগ হয়ে গেছে রক্তের। তবে যেমন ভেবেছিলো, ছিটকে আসা রক্ত নয়, বরং বেরিয়ে আসা রক্তে সময় নিয়ে ভেজা জামা।
জিনিস গুলো ইন্সপেক্টর ঘোষের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালো তমাল। তারপর উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। বললো, সুরেশ বাবুর খোঁজটা যতো জলদি পাওয়া যাবে, আমার মনে হয় রহস্যের সমাধানও ততো তাড়াতাড়ি হবে। ইনস্পেকটর ঘোষ নিজের বুড়ো আঙুল তুলে থামস্ আপ দেখালেন। তমাল বেরিয়ে আসতে গিয়ে আবার ফিরে গিয়ে বললো, আচ্ছা মিঃ ঘোষ, মধুছন্দা দেবীর পার্সোনাল ড্রাইভার ঘনশ্যামের নামে আপনাদের খাতায় কোনো হিসাব নিকাশ আছে নাকি? ইনস্পেকটর একটু ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, তারপর বললেন, আমি যতোদিন আছি তার ভিতরে কিছু নেই, তবে আপনি চাইলে ঘেঁটে দেখতে পারি।
তমাল বললো, আপনার থানায় কিছু পাবেন বলে মনে হয়না। তবে চিত্তরঞ্জন টোয়েন্টি সিক্সথ্ রোড যে থানার আন্ডারে পড়ে, সেখানে কিছু পেলেও পেতে পারেন।
ইনস্পেকটর ঘোষ তমালের কথা শুনে আবার অবাক হলেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে খোঁজ নেবার আশ্বাস দিলেন।
গাড়ি চলছিলো বেশ জোরেই। তমাল কেসটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ রাস্তার পাশে অনেক দোকানের মাঝে একটা বড়সড় দোকানে চোখ পড়তেই ঘনশ্যামকে থামতে বললো।
দোকানটা একটা অ্যান্টিক কউরিও শপ, জিনিসত্রে ঠাসা। তমাল ঘনশ্যামকে অপেক্ষা করতে বলে দোকানে ঢুকলো। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে নানা জিনিসপত্র দেখলো। দোকানদার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো তমাল বিশেষ কিছু খুঁজছে কি না? তমাল বললো সে একজোড়া বিশেষ ধরনের নেপালি ছুরি খুঁজছে। তারপর যতোটা সম্ভব বিস্তারিত বিবরণ দিলো সেটার। দোকানদারের মুখ দেখে তমাল বুঝলো তার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে সে। দোকানদার বললো, কি ব্যাপার বলুনতো? হঠাৎ এই ছুরিটার কদর বেড়ে গেলো কেন? মাস দুয়েক আগেও একজন এসে এরকম জোড়া ছুরি কিনে নিয়ে গেলো।
এবারে তমালের অবাক হবার পালা। সে বললো কে নিতে এসেছিলো মনে আছে আপনার?
দোকানদার বেশ কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো। বললো ঠিক মনে করতে পারছি না, মাস দুয়েক আগের কথা তো?
তমাল জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের সিসিটিভি নেই? দোকানদার এবারও হতাশ করলো, বললো, আমরা এক মাসের বেশি ফুটেজ রাখি না। তমাল তবুও বললো, একটু মনে করার চেষ্টা করবেন প্লিজ, যদি কিছু মনে পড়ে এই নাম্বারে আমাকে একটা ফোন করবেন। নিজের একটা কার্ড ধরিয়ে দিলো তমাল দোকানদারের হাতে।
পোড় খাওয়া দোকানদার তমালের পরিচয় কার্ড থেকে জেনে ঝামেলা এড়াতে আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
তমাল কিছু না ভেবেই নিছক কৌতুহলে খোঁজ নিতে এসেছিলো। কিন্তু দোকানদার যা বললো তাতে ব্যাপারটা আর শুধু কৌতুহল নেই। কাকতালীয় বলেও মনে হচ্ছে না। সে জিজ্ঞাসা করলো, আছে নাকি এরকম ছুরি আর একজোড়া?
দোকানদার বললো, ছুরি গুলো নেপালের খুবই সাধারণ কিন্তু জনপ্রিয় ছুরি। গোর্খারা ভোজালির পরিবর্তে অনেকে এই ধরনের ছুরি কোমরে গুঁজে রাখে ফ্যাশন হিসাবে ছুরিটার সৌন্দর্যের কারণে। আমরা মাঝে মাঝেই আনাই। এখানে খুব যে বেশি চলে তা নয়। তবে স্টকে আর আছে কি না দেখতে হবে।
তমাল তাকে অনুরোধ করলো একটু খুঁজে দেখতে। দোকানদার তার কর্মচারীকে বুঝিয়ে দিলো কি খুঁজতে হবে। মিনিট পনেরো পরে কর্মচারী একটা বাক্স নিয়ে ফিরলো। বললো পুরানো স্টকে একজোড়া ছিলো।
বাক্স খুলতেই তমালের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। এ জিনিস সে আগেও দেখেছে দুবার। অদিতির ড্রয়ারে এবং একটু আগে থানায়। একটা জিনিস প্রমাণ হয়ে গেলো যে ছুরিগুলো দেখতে যতোই ইউনিক হোক, দুর্লভ কিছু না। সহজেই কিনতে পারা যায়। আর সেটাই যদি হয় তাহলে এই ছুরিকেই বেছে নেওয়া হলো কেন? যে কোনো ছুরি দিয়েই তো খুন করা যায়। বরং এই ধরনের "এস" এর মতো বাঁকানো ছুরি দিয়ে খুন করা একটু বেশি কঠিন, লক্ষ্যভেদ ঠিক মতো হয় না। কিন্তু বাঁকানো হবার জন্য জায়গা মতো লাগাতে পারলে ক্ষতি অনেক বেশি হয়।
তাহলে এই ছুরি বেছে নিলো কেন খুনি? এর দুটো কারণ হতে পারে। এক, খুন করা তার উদ্দেশ্য ছিলো না, সে আহত করতেই চেয়েছিলো। দুই, খুনের দায় কাউকে ফাঁসানো, যার কাছে এ ধরনের ছুরি আছে। তদন্তে যেন মনে হয় এই ছুরির মালিকই খুনটা বা খুনের চেষ্টা করেছে। তাহলে রাহুলকে কেউ কি ফাঁসানোর চেষ্টা করছে? কে সে?
দোকানদারের প্রশ্ন শুনে ভাবনার জগত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো তমাল। সে জিজ্ঞাসা করছে, দেবো ছুরিদুটো? তমাল বললো, দাম খুব বেশি না হলে নিতে পারি।
দোকানদার বোধহয় অনেকদিনের স্টক ক্লিয়ার হচ্ছে ভেবে বেশ সস্তায় দিয়ে দিলো সেগুলো। গাড়িতে উঠে তমাল বাক্সটা খুলে একটা ছুরি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। ছুরির বাটের নিচে একটা ধাতুর প্লেট লাগানো। তমাল সেখানে একটা নম্বর দেখতে পেলো, "এক'শ তেইশ"। তমাল এবার অন্য ছুরিটা তুলে দেখলো সেটার একই জায়গায় লেখা আছে "এক'শ বাইশ"। আরো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে সে ছুরি দুটো বাক্সে রেখে দিয়ে ইনস্পেকটর ঘোষের পারসোনাল নাম্বারে ফোন করলো।
এ ঘরটাও লক্ করা নেই। বিস্তর কাগজ পত্র ছড়ানো রয়েছে। টেবিলের উপরে একটা কম্পিউটার ও রাখা আছে। তমাল এগিয়ে এসে কম্পিউটার অন করলো।কিন্তু সেটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড। তমাল কম্পিউটার ছেড়ে কাগজপত্রে মন দিলো। এখনো পর্যন্ত রাজীবের উপর আঘাতটা প্রেম জনিত কারণেই মনে হলেও তমালের মনে হয়েছে অন্য অ্যাঙ্গেল গুলোও খুঁজে দেখা উচিৎ। এই বাড়িতে শুধু রাজীব হত্যার চেষ্টা নয়, অন্য কোনো খেলাও চলছে পর্দার আড়ালে।
প্রায় মিনিট কুড়ি ঘাঁটাঘাঁটির পরেও কিছুই পাওয়া গেলোনা। সবই সাধারণ ব্যবসায়িক কাগজপত্র। হিসাব সংক্রান্ত কোনো ফাইল পাওয়া গেলো না। উঠতে যাবে, তখনি খুট্ করে একটা আওয়াজ হলো দরজায়। পিছনে ফিরে দেখলো বন্দনা দাঁড়িয়ে আছে। তমাল বললো, এসো, তবে ঘরে ঢোকার আগে নক্ করতে হয় বন্দনা।
বন্দনা মুচকি হেসে বললো, আপনার ঘরেতো ঢুকিনি? এটাতো রাজীবদার ঘর, এই ঘরে আমি যখন খুশি আসতাম। আপনি এখানে কি করছেন?
মনে মনে চমকে উঠলো তমাল। যতোটা ভেবেছিলো, বন্দনা তার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। সে বললো, কিছুনা, এমনি হাতে সময় ছিলো, ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবো, কিন্তু তার তো আসতে দেরি আছে, তাই ঘুরতে ঘুরতে চারতলায় এসে এই ঘরে ঢুকলাম। আমি তো ল্যাপটপ আনিনি, এখানে কম্পিউটার দেখে ভাবলাম একটা জরুরি ইমেইল করবো। কিন্তু কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দেওয়া, তাই আর করা হলো না। বলো তুমি কেন এসেছো?
ঘনশ্যাম কাকা এসে গেছেন, বুড়িটা আপনাকে বলতে বললো সে কথা। আপনার ঘরে পেলাম না আপনাকে, তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলাম।
তমাল বললো, ওহ, এসে গেছেন? ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি এই ঘরে তাহলে খুব আসতে, তাই না?
কথাটা শুনেই ঘরে রাখা খাটের দিকে চোখ চলে গেলো বন্দনার। মুখে দেখা দিলো সেই ফিচেল হাসিটা। বললো, খুউউব!
-তোমার রাগ হয়নি রাজীবকে অদিতির সাথে দেখে?
- সে তো আমি আগেই জানতাম। কতোবার লুকিয়ে ওদের দেখেছি! সেরকমই একবার লুকিয়ে দেখছিলাম, তখন আমাকে দেখে ফেলে রাজীবদা। সন্ধ্যে বেলা চা দিতে এলে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে। বললো সে আমাকেই ভালোবাসে, কিন্তু চাকরি রাখতে গেলে মনিবকে খুশি তো করতেই হয়? অদিতিদি নাকি তাকে এসব করতে জোর করতো।
- আর মৌপিয়ার সাথেও কি চাকরি বাঁচাতেই এসব করতো?
মৌপিয়ার নাম শুনেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখটা থমথমে হয়ে উঠলো বন্দনার। বললো-
- ওই বুড়ি মাগীর কথা বারবার তোলেন কেন? ওই মাগীর আমাকে রাজীবদার সাথে দেখেই কুটকুটানি জেগে ওঠে। তারপর জোর করে রাজীবদাকে জড়িয়ে ফেলে। মনিবের ভাইজি বলে কথা?
- তুমিও তো মনিবের মেয়ে?
- হুহ্! সে তো নামেই মেয়ে, আসল মেয়ে তো আর না?
- তোমাকে এসব কথা কে বলেছে? নিজেই ভেবে নিয়েছো? নাকি রাজীব বলেছে?
- রাজীবদা বলেছে আমাকে।
- তাহলে মৌপিয়ার উপরে তোমার রাগ সেই কারণেই, তাই তো?
- এছাড়াও বুড়ি মাগীটা আমাকে সহ্য করতে পারে না, যখন তখন অপমান করে আর অযথা খাটায়।
- খুন করতে ইচ্ছা করে না মৌপিয়া কে?
- করে না আবার? একটা ডান্ডা দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো।
- অথবা সিঁড়িতে শ্যাম্পু ফেলে আছাড় খাইয়ে মাথা ফাটিয়ে, কি বলো?
বন্দনার মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলো নিমেষে। বললো, আমি যাই, আপনাকে নীচে ডাকছে।
বলেই পিছন ঘুরে চলে যাচ্ছিলো বন্দনা। তমাল তার একটা হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলো। সে টাল সামলাতে না পেরে এসে পড়লো সোজা তমালের কোলের উপর। তমাল সাথে সাথে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো বন্দনা, কিন্তু সে চেষ্টায় সদিচ্ছা তেমন নেই। তমাল দেরি না করে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো বন্দনার ঠোঁটে। তারপর তমালের বিখ্যাত মেয়েদের ঘায়েল করা চুমু খেতে শুরু করলো।
তমালের বুকের ভিতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে বন্দনা। তামালের একটা হাত তার কোমর জড়িয়ে রেখেছে, অন্য হাতটা অসভ্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বন্দনার কচি ডাঁসা মাইয়ের উপরে।
দীর্ঘ দু মিনিট ধরে চললো সেই চুম্বন। তারপরে তমাল ঠোঁট সরিয়ে নিলো। বন্দনা রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে। হাতের উলটো দিক দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বললো, অসভ্য!
তমাল ছেড়ে দিতেই উঠে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। তমাল বললো, এখন একটু বাইরে যাবো। দুপুর বেলায় আমার কোনো কাজ নেই, তোমার আছে কি?
ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটলো বন্দনার। বললো, কাজের ফাঁকও আছে। তারপরেই দরজার দিকে এগোলো। বাইরে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, পাসওয়ার্ড চাই?
তমাল প্রথমে বুঝতে পারলো না বন্দনার কথা। বললো, মানে?
সে আবার বললো, কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড চাই?
অবাক হয়ে গেলো তমাল। বললো, তুমি জানো পাসওয়ার্ড?
বন্দনা ফিরে এসে কলম তুলে নিয়ে একটা কাগজে খসখস করে লিখে দিলো একটা জটিল পাসওয়ার্ড। তারপর একমুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
হতভম্বের মতো সেদিকে চেয়ে রইলো তমাল। মেয়েদের অনেক রূপ সে দেখেছে। কিন্তু প্রতিবারই তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েরা নতুন নতুন রূপ নিজে হাজির হয় তার সামনে। এটা রাজীবের অফিসিয়াল কম্পিউটার। একটা অত্যন্ত গোপন বিষয় সে জানতে পেরেছে। সুতরাং স্ট্রং পাসওয়ার্ড দিয়ে কম্পিউটার প্রোটেক্ট করবে সে, এটাই স্বাভাবিক। বন্দনার লেখা পাসওয়ার্ডটা দেখে তমাল বুঝেছিলো সে চেষ্টাও সে করেছে। যতোটা জটিল করা সম্ভব করেছিলো রাজীব। কিন্তু বন্দনার মতো মেয়ে সেটা কিভাবে জানলো! শুধু জানেনি, মনেও রেখেছে। অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত! তাহলে কি রাজীব যথেষ্ট সতর্ক নয়? তার কাজকর্মের খবর কি অনেকেই জানে? সেভাবেই কি রিনা অরোরা জানতে পেরেছিলো কিছু? তাই তার অফিসে আর অনুপস্থিতিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলো? নাকি বন্দনা অস্বাভাবিক বুদ্ধিমতি বা স্মৃতিধর?
ভাবতে ভাবতে নীচে নেমে এলো তমাল। ঘনশ্যাম তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। গাড়িতে উঠে তমাল বললো একবার থানায় চলুন তো। থ্রিলার সিনেমায় যেমন কিছু ড্রাইভার দেখা যায়, গম্ভীর মুখ করে রাখে, দশটা প্রশ্ন করলে আধখানা উত্তর দেয়। মুখ দেখলে মনে হয় সেই ভিলেন। ঘনশ্যাম বাবুর চেহারা অনেকটা সেই রকম। কথা বলতে শুরু করে তমাল বুঝলো, ব্যবহারও তথৈবচ।
আপনি কতোদিন কাজ করছেন এই বাড়িতে ঘনশ্যাম বাবু?.. প্রশ্ন করলো তমাল।
প্রথমে মনে হলো তমালের প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। তমাল আবার জিজ্ঞাসা করলে খুব সংক্ষেপে জবাব দিলো, দু বছর। দ্বিতীয় বার বহাল হবার সময়টা উল্লেখ করলো সে, বুঝতে পারলো তমাল।
সে তো মধুছন্দা দেবী আবার ডেকে আনার পর। আমি প্রথমবার ড্রাইভারি করার সময়টা জানতে চাইছি, বললো তমাল। উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না ঘনশ্যাম।
তমাল আবার জানতে চাইলো, আপনি মধুছন্দা দেবীর বাবার আমল থেকে কাজ করছেন, তাই না? এবার ও কোনো উত্তর নেই।
এবারে তমাল সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলো, আপনার চাকরি কেন গেছিলো ঘনশ্যাম বাবু? কোনো চুরি টুরির কেস নাকি? আত্মসম্মানে আঘাত করতে চাইলো তমাল।
এবারে কাজ হলো। জ্বলন্ত চোখে একবার শুধু পিছনে তাকিয়ে বললো, না। তমাল বললো, বন্দনা আপনার কে হয়? মেয়ে?
তমালের মনে হলো এবারে তমালকে চোখের আগুনে ছাই করে ফেলবে, এভাবে তাকিয়ে বললো, আমার কেউ হয় না। অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছি।
আরও তো অনেক মেয়ে ছিলো সেখানে, বন্দনাকেই কেন আনলেন? সাধারণত অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিলে ছোট বাচ্চাদেরই নেওয়া হয়, একজন যুবতি মেয়েকে কেউ দত্তক নেয় শুনিনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঘনশ্যাম বললো, মালকিনের পছন্দ হয়েছিলো মেয়েটাকে, তাই নিয়ে নিয়েছে। এতে অসুবিধার কি আছে?
না না, অসুবিধার আর কি থাকবে? কিন্তু মালকিন তো অন্য কাউকে দেখেননি। আপনি এই মেয়েটাকেই দেখিয়েছেন। কেন? আপনার এতো টান কেন মেয়েটার উপর? আবার মৌনব্রত অবলম্বন করলো ঘনশ্যাম।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, মধুছন্দা দেবী কি হোমে গিয়েই বন্দনাকে দেখেছিলেন? নাকি বন্দনাকে আপনি নিয়ে এসেছিলেন তার কাছে? ঘনশ্যাম তাড়াতাড়ি বললো, না উনি হোমে কখনো যাননি। আমিই বন্দনাকে নিয়ে এসেছিলাম।
আচ্ছা? কিন্তু একটা বেসরকারি হোম একটা যুবতি মেয়েকে তাদের ড্রাইভারের সাথে চিত্তরঞ্জন থেকে আসানসোল ছাড়বে কেন? যদি না সে তার স্থানীয় অভিভাবক হয়?
তমালের ভুল ও হতে পারে, কিন্তু রিয়ারভিউ মিররে যেন সে ঘনশ্যামের চোখে একটা ভয় দেখতে পেলো। সে একটু তুতলিয়ে বললো, ন.. না, এখানে না, অন্য জায়গায় দেখেছিলো মালকিন।
সাথে সাথে প্রশ্ন করলো তমাল, কোথায়? ঘনশ্যাম বললো, আমি এতো কথা বলতে পারবো না, আপনি মালকিনের কাছ থেকে শুনে নেবেন।
তমাল বললো, কেন? নিয়ে তো আপনি গিয়েছিলেন, তাহলে বলতে আপত্তি কিসের? কোনো গোপন কিছু আছে নাকি এর ভিতরে? ঘনশ্যাম বললো, না, গোপন আবার কি? তবু মালকিন এসব নিয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করেছেন। আপনি তার সাথেই কথা বলবেন।
আচমকা প্রসঙ্গ পালটে তমাল প্রশ্ন করলো, আপনার কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ঘনশ্যাম বাবু?
ইউকো ব্যাংকে, কিছু না ভাবেই উত্তর দিলো ঘনশ্যাম। তারপর থমথমে মুখে বললো, আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিয়ে কি করবেন?
তমাল বললো, কিছু না, আসলে বেশি টাকা পয়সা পেলে ব্যাংকে তো রাখতেই হয়, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। আপনি কিন্তু বললেন না, কেন চাকরি গিয়েছিলো আপনার?
থানা এসে গেছে বাবু। রুষ্ট ভঙ্গীতে বললো ঘনশ্যাম। তমাল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো, হুম, তাহলে থানার বড় বাবুকেই জিজ্ঞাস করে দেখি, উনি জানেন কি না? আপনি অপেক্ষা করুন, একটু সময় লাগবে আমার।
আসানসোলে বোধহয় ক্রাইম ট্রাইম কম হয়, থানা বেশ ফাঁকাই আছে। তমাল ঢুকতেই একজন সেপাই হেঁকে বললো, কি চাই? এখন হবে না, দুটোর পরে আসুন। তমাল বিনীত ভাবে বললো, বড়বাবুর সাথে একটু দেখা করতে চাই। সেপাই মেজবাবু বা ছোটবাবু টাইপের একজনকে দেখিয়ে দিলো।
তমাল তাকে আসার কারণ বলে নিজের কার্ডটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। কিছুদিন হলো এটা বানিয়েছে তমাল নিজের গোয়েন্দা পরিচয় জানিয়ে।
সেটা হাতে নিয়ে মাঝবয়সী পুলিশ ভদ্রলোক নাকের ডগা থেকে চশমাটা মাথায় তুলে দিলো। তারপর কার্ডটাকে প্রায় নাকে ঠেকিয়ে পড়তে লাগলো। হাসি পেলো তমালের। চশমা ছাড়াই যদি পড়বে তাহলে নাকে একটা চশমা ঝুলিয়ে রাখার কি দরকার?
অ.. টিকটিকি! সরকার যে কেন আমাদের মাইনে দেয় বুঝিনা, এদের দিয়েই কাজ করালে পারে? চারিদিকে শুধু ব্যাঙের ছাতার মতো টিকটিকি আর টিকটিকি। বৌয়ের সাথে রাতে বিছানায় ধস্তাধস্তির সময় কান থেকে পড়ে যাওয়া কানের দুল ব্লাউজের খাঁজ থেকে উদ্ধার করে দিয়েই সবাই নিজেকে গোয়েন্দা ভাবে। গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর অবজ্ঞা মেশানো সুরে বললেন, বসুন, বলছি বড়বাবুকে। তারপর উঠে একটা কেবিনের সুইং ডোর ঠেলে ঢুকে গেলেন ভিতরে।
তমাল বাইরেই অপেক্ষা করছিলো। এমন সময় বড়বাবুর কেবিন থেকে বেল এর আওয়াজ শুনতে পেলো। সেপাই ভিতরে ঢুকেই বেরিয়ে এসে তমালকে বললো, যান, বড়বাবু ডাকছেন আপনাকে।
তমাল ওসির ঘরে ঢুকলো। সেই মেজ বা ছোটবাবু তখনো সেখানেই ছিলো। তমাল ঢুকে দেখলো ওসির হাতে তার কার্ডটা তখনো ধরা।
কিংশুক মজুমদার... প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আচ্ছা বাই এনি চান্স আপনি কি বর্ধমানে বছর কয়েক আগে কোনো পুরানো জমিদার বাড়ির গুপ্তধন উদ্ধার করেছিলেন? তমাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বড়বাবু বললেন, আরে বসুন বসুন মিঃ মজুমদার। আপনি তো বিখ্যাত লোক মশাই। তখন আমার এক সিনিয়ার সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ছিলেন, বিপ্লব মুখার্জি। তিনি আপনার কথা আমাকে বলেছিলেন। মুখার্জিদা তো আপনার প্রশংসার পঞ্চমুখ। তা আসানসোল কি মনে করে? কোনো তদন্ত টদন্ত নাকি?
মেজবাবু ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র কেজি তিনেক চিরতা চিবিয়েছেন। একটু আগে বলা নিজের কথাগুলোর জন্য অল্প লজ্জাও বোধ করছেন। বড়বাবু তার দিকে ফিরে বললেন, আমাদের জন্য দুকাপ চা পাঠিয়ে দিতে বলুন তো মেজবাবু।
যাক্, ছোটো নন, ইনি মেজবাবুই। তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলে বড়বাবু আবার বললেন, বলুন কিংশুক বাবু, আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তমাল সামনে রাখা নেমপ্লেটে চোখ বুলিয়ে বললো, মিঃ ঘোষ, আমাকে তমাল বলেই ডাকবেন, আমার ডাকনাম ওটা। আমি আসলে মুখার্জি বাড়ির হত্যার চেষ্টা কেসটার জন্য এসেছি।
ও, আই সি! ওই কেসটা? তা আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করলো কে? রাহুল মুখার্জি? আপনিও কি তাকে বাঁচাতে পারবেন তমালবাবু? সব সাক্ষ্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষদর্শী অবশ্য কেউ নেই, তবে ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছানো সাক্ষী আছে জনা তিনেক। তারা ছুরি হাতে ধরা অবস্থায় তাকে দেখেছে। আঙুলের ছাপ তো আছেই, জামায় রক্তের দাগও আছে। তাছাড়া যা জানা গেছে, সে ভিকটিমকে বিশেষ পছন্দ করতো না।
তমাল ইনস্পেক্টর ঘোষের লম্বা বক্তব্য শুনলো। তারপর মৃদু হেসে বললো, না আমাকে রাহুল অ্যাপয়েন্ট করেনি। আমি আসলে ওই বাড়ির মেয়ে অদিতি মুখার্জির বন্ধুর বন্ধু। সেই বন্ধু হলো ওই পুরানো জমিদার বাড়ির মেয়ে, যে কেসটার কথা আপনাকে ইনস্পেক্টর মুখার্জি বলেছিলেন। বান্ধবীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সেই বান্ধবী গার্গী আমাকে কেসটার কথা বলে। আমি একটু কৌতুহলী হয়েই এখানে আসি। তখন মিসেস মুখার্জি, আই মিন মধুছন্দা মুখার্জী আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেন কেসটা ইনভেস্টিগেট করতে।
সব শুনে ইনস্পেক্টর ঘোষ বললেন, বুঝলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, কেসটা প্রায় ওপেন অ্যান্ড শাট্ কেস। বিশেষ সুবিধে হবে না মশাই।
কথার মাঝেই চা চলে এলো, সাথে বিস্কুট।চায়ে চুমুক দিয়ে তমাল বললো, মোটিভ কিছু পেলেন? মিঃ ঘোষ তখন চায়ে বিস্কুট ভেজানোর জটিল কেসে ব্যস্ত। ভেজা ল্যাতপেতে বিস্কুটকে অনেকটা উপরে তুলে মুখে ঢোকানো একটা জটিল কেসের চেয়ে কম কিছু না। টাইমিং সঠিক হওয়া চাই, নাহলে বিস্কুট দাগী আসামীর মতো চায়ের কাপের তলদেশে এমন ভাবে লুকাবে যে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিকে অখন্ড মনোযোগ রেখেই মিঃ ঘোষ বললেন, ওই যে বললাম, রাহুল মুখার্জি ভিকটিমকে পছন্দ করতো না?
তমাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো, মোটিভ হিসাবে এটা ভীষন খেলো হয়ে গেলো না? কোর্টে টিকবে এই মোটিভ? জজসাহেব যখন জিজ্ঞাসা করবে, কেন পছন্দ করতো না, কি বলবেন?
এই প্রথমবার একটু চিন্তিত দেখালো ইনস্পেক্টর ঘোষ কে। মাথা চুলকে বললো, হুম, এটা আমিও ভেবেছি। খুনের চেষ্টার মামলা হিসাবে মোটিভটা বড্ড কমজোরি। কিন্তু আর কোনো মোটিভ তো দেখছি না?
এর চেয়ে স্ট্রং মোটিভ আমি দিতে পারি আপনাকে, বললো তমাল। দপ্ করে জ্বলে উঠলো ইনস্পেক্টরের চোখ। উৎসাহ নিয়ে বললো, বটে, বটে! বলুনতো শুনি? কেসটা হাইপ্রোফাইল কেস। খুব বড়লোক বাড়ি, আসানসোলে নাম-ডাকও প্রচুর এদের। বেশ কিছুদিন হলো কেসটা থমকে আছে, সলভ করতে পারলে উপরমহলের নেক নজরে পড়ার সম্ভবনা আছে।
তমাল বললো, রাহুলের ফ্যাক্টরিতে একটি সেক্রেটারি আছে, মহিলা। নাম, রিনি অরোরা। তার সাথে একটা প্রনয়ের সম্পর্ক আছে রাহুলের। ওদিকে এই মেয়েটি আবার ভিকটিমের পূর্বপরিচিতা। আমার ধারণা তাদের ভিতরেও একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে। দুজন দুজনের সহপাঠী ছিলো। রাজীব এখানে চাকরি নিয়ে আসার পরে সে ই মেয়েটিকে বলে এখানে চাকরি নিতে। সেই মতো মেয়েটি রাহুলের সাথে ভাব জমায়, এবং চাকরি খুঁজছে সেটা বলে। রাহুলও টোপ গিলে তাকে নিজের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসে নিজের সেক্রেটারি করে। ধীরে ধীরে তার প্রেমেও পড়ে। বাড়ির সবাইও জানে তাদের এই প্রেমের কথা এতোটাই ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছে তাদের রিলেশন।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো, কিন্তু মজার কথা হলো, রাজীব আর রিনির পূর্বপরিচয়ের কথা এবং তাদের প্রেমের কথা দুজনেই বেমালুম চেপে গেছে রাহুলের কাছে। এখন রাহুল যদি কোনোভাবে এই পরিচয়ের কথা বা তাকে চিট্ করার কথা জেনে গিয়ে থাকে, তাহলে খুনের জন্য একটা জোরদার মোটিভ তৈরি হয় বইকি?
ইনস্পেক্টর ঘোষ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, বটেই তো, এ তো ভীষণ স্ট্রং মোটিভ। সেক্সুয়াল জেলাসির জন্য খুনের ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহরণ আছে। ঠিক আছে আমি রিনি আর রাজীবকে তুলে নিয়ে জেরা করে দেখি।
তমাল তাড়াতাড়ি বললো, মিঃ ঘোষ, আপনার কাছে আমার অনুরোধ এই কাজটা করবেন না। অন্তত এখনি নয়। আচ্ছা রাহুল যে খুন করার চেষ্টা করেছে এটার সপক্ষে তো যুক্তি আছে। এবার উলটোটা ভেবে দেখি। তার জামায় রক্তের দাগ ছিলো বলছেন। সেটা এলো কিভাবে?
ছুরি দিয়ে খুন করতে গেলে রক্ত ছিটকে জামায় লাগবে, এতে আর রহস্য কিছু আছে কি?
না,তা নেই, কিন্তু আমি যতোদূর শুনেছি তার জামা রক্তে ভিজে গিয়েছিলো। স্ট্যাব উন্ড থেকে ছিটকে রক্ত লাগে, এভাবে ভিজে যায় না। ভিজতে পারে যদি কেউ তাকে স্ট্যাবড হবার পরে কোলে তুলে নেয়। তাহলে রাহুল কি ছুরি গেঁথে দিয়ে, হায় আমি এ কি করলাম বলে তার মাথা কোলের উপর তুলে বিলাপ করছিলো? নাকি আগে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, তারপর তার পিঠে ছুরি মেরে সবাই এসে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো?
ইনস্পেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ বোকা নন মোটেই, বরং বেশ বুদ্ধিমান। তিনি তমালের তোলা প্রশ্নগুলোর যথার্থতা অনুধাবন করতে পারলেন। আবার তার বা হাতের মধ্যমাটা ব্রহ্মতালু চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একটু ভেবে বললেন, আচ্ছা হতেও তো পারে রাগের মাথায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে তার ভীষন অনুতাপ হয়, এবং আপনি যেমন বললেন, সেভাবে হায় আমি এ কি করলাম বলে কাঁদতে লাগলো। একেবারে অসম্ভব কি?
না মোটেই অসম্ভব না। অনুতাপ খুব ভালো জিনিস। মনকে শুদ্ধ করে। পাপী কে ধার্মিক বানিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদাতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে হাতে ছুরি ধরা থাকবে কেন? প্রথমেই তো সেটা ফেলে দিয়ে তারপর জড়িয়ে ধরবে, তাই না? যুক্তিজালে আটকে ফেললো তমাল।
মধ্যমা ততোক্ষণে ঝালা স্পিডে সেতার বাজাচ্ছে টাকে। ইনস্পেক্টর ঘোষ বললে, হুম, ঠিক বলেছেন তমাল বাবু। এতোটা তলিয়ে ভাবিনি তো। আসলে খুনের চেষ্টার রহস্য জলদি সমাধান করতে গিয়ে সামনে যা পেয়েছি, সেটাকেই অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কেসটা নিয়ে নতুন ভাবে ভাববো আমি।
তমাল বললো, ভাবুন মিঃ ঘোষ। আমিও সাহায্য করবো আপনাকে যথাসম্ভব। কেসের স্বীকৃতি আপনিই নেবেন,এ ব্যাপারে আমার কোনো লোভ নেই। শুধু আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেই হবে।
বলুন কি তথ্য চান? সব পাবেন। এ ছাড়া যখন যা দরকার বিনা দ্বিধায় জানাবেন আমাকে। আমার পার্সোনাল নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে, দরকার হলেই কল করবেন, আন্তরিক ভাবে বললেন ইনস্পেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ।
তমাল বললো, প্রথম যে ইনফরমেশনটা চাই, তা হলো একজন মানুষ সম্পর্কে। মুখার্জি বাড়ির পুরানো অ্যাকাউন্টেন্ট, মিঃ সুরেশ চাকলাদার এখন কোথায় আছেন এটা জানা দরকার। বছর খানেক আগে পর্যন্ত তিনি রাণীগঞ্জে তার মায়ের কাছে ছিলেন, এটুকু জানা গেছে।
ঠিক আছে, আমি খুঁজে বের করে ফেলবো চাকলাদারকে। আর কিছু? জিজ্ঞাসা করলেন ইনস্পেকটর ঘোষ।
হ্যাঁ, কয়েকজন মানুষের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দরকার গত আড়াই তিন বছরের, বলে তমাল কতোগুলো নাম আর ব্যাংকের নাম লিখে দিলো একটা কাগজে।
ইনস্পেকটর ঘোষ কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, হয়ে যাবে। আমি এখনি লোক পাঠাচ্ছি ব্যাংকে।
এরপরে তমাল বললো, মিঃ ঘোষ, অকুস্থল থেকে যে জিনিস গুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো একবার দেখতে পারি?
ইনস্পেকটর ঘোষ বললেন, দেখুন এখনো চার্জশিট তৈরি করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু ওগুলো এগজিবিট হিসাবে কোর্টে পেশ করতে হবে। তবুও আপনাকে দেখাতে পারি, যদি খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করেন।
তমাল বললো, আমি জানি মিঃ ঘোষ। নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি শুধু একবার দেখবো জিনিস গুলো।
ইনস্পেকটর বেল বাজালে একজন সেপাই ভিতরে এলে তিনি তাকে জিনিস গুলো আনতে বললেন। কিছুক্ষণের ভিতরে সেপাই একটা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে এলো। ইনস্পেকটর ঘোষ তার ভিতর থেকে কয়েকটা পলিথিন জিপার প্যাকেট বের করে সামনে রাখলো।
তমাল তার ভিতর থেকে শুধু ছুরির প্যাকেটটা তুলে নিলো। পলিথিন প্যাকেট থেকে বাইরে বের না করেই অনেক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। আঙুল দিয়ে সাইজটাও মেপে নিলো। অদিতির ড্রয়ারে যে ছুরিটা দেখেছিলো তমাল, এটা অবিকল একই রকম দেখতে, নিশ্চিত হলো সে। এরপরে রক্ত মাখা রাহুলের জামার প্যাকেটটা তুলে নিলো। শুকিয়ে কালো দাগ হয়ে গেছে রক্তের। তবে যেমন ভেবেছিলো, ছিটকে আসা রক্ত নয়, বরং বেরিয়ে আসা রক্তে সময় নিয়ে ভেজা জামা।
জিনিস গুলো ইন্সপেক্টর ঘোষের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালো তমাল। তারপর উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। বললো, সুরেশ বাবুর খোঁজটা যতো জলদি পাওয়া যাবে, আমার মনে হয় রহস্যের সমাধানও ততো তাড়াতাড়ি হবে। ইনস্পেকটর ঘোষ নিজের বুড়ো আঙুল তুলে থামস্ আপ দেখালেন। তমাল বেরিয়ে আসতে গিয়ে আবার ফিরে গিয়ে বললো, আচ্ছা মিঃ ঘোষ, মধুছন্দা দেবীর পার্সোনাল ড্রাইভার ঘনশ্যামের নামে আপনাদের খাতায় কোনো হিসাব নিকাশ আছে নাকি? ইনস্পেকটর একটু ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, তারপর বললেন, আমি যতোদিন আছি তার ভিতরে কিছু নেই, তবে আপনি চাইলে ঘেঁটে দেখতে পারি।
তমাল বললো, আপনার থানায় কিছু পাবেন বলে মনে হয়না। তবে চিত্তরঞ্জন টোয়েন্টি সিক্সথ্ রোড যে থানার আন্ডারে পড়ে, সেখানে কিছু পেলেও পেতে পারেন।
ইনস্পেকটর ঘোষ তমালের কথা শুনে আবার অবাক হলেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে খোঁজ নেবার আশ্বাস দিলেন।
গাড়ি চলছিলো বেশ জোরেই। তমাল কেসটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ রাস্তার পাশে অনেক দোকানের মাঝে একটা বড়সড় দোকানে চোখ পড়তেই ঘনশ্যামকে থামতে বললো।
দোকানটা একটা অ্যান্টিক কউরিও শপ, জিনিসত্রে ঠাসা। তমাল ঘনশ্যামকে অপেক্ষা করতে বলে দোকানে ঢুকলো। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে নানা জিনিসপত্র দেখলো। দোকানদার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো তমাল বিশেষ কিছু খুঁজছে কি না? তমাল বললো সে একজোড়া বিশেষ ধরনের নেপালি ছুরি খুঁজছে। তারপর যতোটা সম্ভব বিস্তারিত বিবরণ দিলো সেটার। দোকানদারের মুখ দেখে তমাল বুঝলো তার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে সে। দোকানদার বললো, কি ব্যাপার বলুনতো? হঠাৎ এই ছুরিটার কদর বেড়ে গেলো কেন? মাস দুয়েক আগেও একজন এসে এরকম জোড়া ছুরি কিনে নিয়ে গেলো।
এবারে তমালের অবাক হবার পালা। সে বললো কে নিতে এসেছিলো মনে আছে আপনার?
দোকানদার বেশ কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো। বললো ঠিক মনে করতে পারছি না, মাস দুয়েক আগের কথা তো?
তমাল জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের সিসিটিভি নেই? দোকানদার এবারও হতাশ করলো, বললো, আমরা এক মাসের বেশি ফুটেজ রাখি না। তমাল তবুও বললো, একটু মনে করার চেষ্টা করবেন প্লিজ, যদি কিছু মনে পড়ে এই নাম্বারে আমাকে একটা ফোন করবেন। নিজের একটা কার্ড ধরিয়ে দিলো তমাল দোকানদারের হাতে।
পোড় খাওয়া দোকানদার তমালের পরিচয় কার্ড থেকে জেনে ঝামেলা এড়াতে আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
তমাল কিছু না ভেবেই নিছক কৌতুহলে খোঁজ নিতে এসেছিলো। কিন্তু দোকানদার যা বললো তাতে ব্যাপারটা আর শুধু কৌতুহল নেই। কাকতালীয় বলেও মনে হচ্ছে না। সে জিজ্ঞাসা করলো, আছে নাকি এরকম ছুরি আর একজোড়া?
দোকানদার বললো, ছুরি গুলো নেপালের খুবই সাধারণ কিন্তু জনপ্রিয় ছুরি। গোর্খারা ভোজালির পরিবর্তে অনেকে এই ধরনের ছুরি কোমরে গুঁজে রাখে ফ্যাশন হিসাবে ছুরিটার সৌন্দর্যের কারণে। আমরা মাঝে মাঝেই আনাই। এখানে খুব যে বেশি চলে তা নয়। তবে স্টকে আর আছে কি না দেখতে হবে।
তমাল তাকে অনুরোধ করলো একটু খুঁজে দেখতে। দোকানদার তার কর্মচারীকে বুঝিয়ে দিলো কি খুঁজতে হবে। মিনিট পনেরো পরে কর্মচারী একটা বাক্স নিয়ে ফিরলো। বললো পুরানো স্টকে একজোড়া ছিলো।
বাক্স খুলতেই তমালের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। এ জিনিস সে আগেও দেখেছে দুবার। অদিতির ড্রয়ারে এবং একটু আগে থানায়। একটা জিনিস প্রমাণ হয়ে গেলো যে ছুরিগুলো দেখতে যতোই ইউনিক হোক, দুর্লভ কিছু না। সহজেই কিনতে পারা যায়। আর সেটাই যদি হয় তাহলে এই ছুরিকেই বেছে নেওয়া হলো কেন? যে কোনো ছুরি দিয়েই তো খুন করা যায়। বরং এই ধরনের "এস" এর মতো বাঁকানো ছুরি দিয়ে খুন করা একটু বেশি কঠিন, লক্ষ্যভেদ ঠিক মতো হয় না। কিন্তু বাঁকানো হবার জন্য জায়গা মতো লাগাতে পারলে ক্ষতি অনেক বেশি হয়।
তাহলে এই ছুরি বেছে নিলো কেন খুনি? এর দুটো কারণ হতে পারে। এক, খুন করা তার উদ্দেশ্য ছিলো না, সে আহত করতেই চেয়েছিলো। দুই, খুনের দায় কাউকে ফাঁসানো, যার কাছে এ ধরনের ছুরি আছে। তদন্তে যেন মনে হয় এই ছুরির মালিকই খুনটা বা খুনের চেষ্টা করেছে। তাহলে রাহুলকে কেউ কি ফাঁসানোর চেষ্টা করছে? কে সে?
দোকানদারের প্রশ্ন শুনে ভাবনার জগত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো তমাল। সে জিজ্ঞাসা করছে, দেবো ছুরিদুটো? তমাল বললো, দাম খুব বেশি না হলে নিতে পারি।
দোকানদার বোধহয় অনেকদিনের স্টক ক্লিয়ার হচ্ছে ভেবে বেশ সস্তায় দিয়ে দিলো সেগুলো। গাড়িতে উঠে তমাল বাক্সটা খুলে একটা ছুরি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। ছুরির বাটের নিচে একটা ধাতুর প্লেট লাগানো। তমাল সেখানে একটা নম্বর দেখতে পেলো, "এক'শ তেইশ"। তমাল এবার অন্য ছুরিটা তুলে দেখলো সেটার একই জায়গায় লেখা আছে "এক'শ বাইশ"। আরো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে সে ছুরি দুটো বাক্সে রেখে দিয়ে ইনস্পেকটর ঘোষের পারসোনাল নাম্বারে ফোন করলো।