07-12-2024, 11:36 PM
স্বাভাবিক কারণেই ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হলো তমালের। ভোরের দিকে মদনের ফোন কলে ঘুম একবার ভেঙেছিলো বটে, তবে তাকে চিত্তরঞ্জনে চলে যেতে বলে আবারও একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। ধকল কম তো যায়নি কাল! সোয়া আটটা নাগাদ উঠে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চায়ের জন্য প্রাণটা আনচান করছিলো। সোজা ডাইনিংয়ে চলে এলো তমাল।
সেখানে পুরো দস্তুর বাইরে যাবার পোশাক পরে অদিতি ব্রেকফাস্ট করছিলো। তমালকে দেখেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, এসো, এসো তমালদা। সরি কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গো। এক্সট্রিমলি সরি!
তমাল হেসে বললো, আরে এতো সরি হবার কি হলো? ফিরতে তো রাত হয়ে গেছিলো আমার, ঘুমিয়ে পড়া তো স্বাভাবিক। তবে মৌপিয়া জেগে ছিলো। তোমার হয়ে নাইটটা গুড, আই মিন, গুডনাইট উইশটা সে ই করে দিয়েছিলো।
হ্যাঁ, আমি জেগেই থাকতে চেয়েছিলাম, দিদি জোর করে আমাকে শুতে পাঠিয়ে দিলো। আসলে আজ আমার কয়েকটা জরুরী কাজ আছে। একবার ফ্যাক্টরি যাবো, তারপর একটা ইন্টারভিউ আছে রাণীগঞ্জে। জলদি বেরোতে হবে, তাই আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম... অজুহাত দেবার সুরে বললো অদিতি।
কিসের ইন্টারভিউ? প্রশ্ন করলো তমাল।
একটা চাকরির ইন্টারভিউ। টোস্ট চিবোতে চিবোতে জবাব দিলো অদিতি।
তমালের চা এসে গেছিলো ততোক্ষণে। একটা চুমুক দিয়ে সে বললো, বড়লোকের আদুরে মেয়ের আবার চাকরির কি দরকার? বিয়ে থা করে রাজত্বের এক তৃতীয়াংশ নিয়ে পঙ্খিরাজে করে উড়াল দিলেই তো হতো?
না তমালদা, লেখাপড়া শিখলাম কি বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তিতে জীবন কাটাবো বলে? নিজের যোগ্যতায় নিজের পরিচয় লিখতে চাই আমি। তাছাড়া এক তৃতীয়াংশ বলছো কেন? সম্পত্তিতে তো পিসিরও ভাগ আছে? বললো অদিতি।
ও হ্যাঁ তাই তো, ভুলেই গেছিলাম। তবে তোমার পিসির তো ছেলে মেয়ে নেই, তাই তার অবর্তমানে তো তোমরাই পাবে সব? বোঝাতে চাইলো তমাল।
অদিতি কোনো জবাব দিলো না। ততোক্ষনে একটি কাজের মেয়ে ফলের রস এনে দিলো। মেয়েটির বয়স মৌপিয়ার মতোই। সে চলে যেতেই তমাল বললো, আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে সব কর্মচারীরাই দেখছি অল্পবয়সী। পুরানো চাকরবাকর কেউ নেই?
অদিতি বললো, পুরানো বলতে শুধু সুলতাপিসিই আছে। ভজাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে টুকটাক, তবে বিশেষ কাজ নেই তার। বাকী সবাই প্রায় নতুন। আমাদের বাড়িতে খুব পুরানো লোকজন রাখার রেওয়াজ নেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি। একটু বয়স হয়ে গেলেই তাকে কিছু টাকাপয়সা এককালীন দিয়ে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তমাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, অদ্ভুত তো? কে করেছে এই অদ্ভুতুড়ে নিয়ম? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত পুরাতন ভৃত্যের গুনগান করে গেছেন আর তোমরা তাদেরই ছাড়িয়ে দাও? বিশ্বস্ততা অর্জন করতে সময় লাগে অদিতি।
তমালের কথার ধরনে হেসে ফেললো সে। বললো, না না নিয়ম কেউ বানায়নি।আসলে খুব ছোট বেলার কথা মনে নেই, কিন্তু একটু বড় হয়েই দেখছি অনেক চাকরবাকরকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর হোস্টেল থেকে বাড়ি এসে প্রতিবার দেখতাম নতুন কেউ না কেউ বহাল হয়েছে।
তেমন দু একজনের নাম বলোতো? জিজ্ঞাসা করলো তমাল।
একটু ভেবে অদিতি বললো, সুরেশ কাকা, ত্রিলোকদা, মানদা পিসি, রামহরি কাকা এদের কথাই মনে পড়ছে।
এদের সাথে আর যোগাযোগ নেই, তাই না?...জানতে চাইলো তমাল।
নাহ্! অন্তত আমি আর কখনো এদের দেখিনি। সুলতাপিসি বলতে পারবে। উনিই তো চিনতেন সবাইকে?
সুলতা পিসি কি তোমার বাবার আমলের? জানতে চাইলো তমাল।
তার ও আগের, ঠাকুরদার আমলের, সুলতা পিসি বহুদিনের পুরানো,জবাবে বললো অদিতি।
ততোক্ষণে দুজনেরই খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তমাল জানালো একটু পরে ব্রেকফাস্ট করবে। তারপর সে আর অদিতি উঠে এলো তিনতলায়। সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেলো মৌপিয়া আর শিখার সঙ্গে। শিখা কলেজ ড্রেস পরা, কিন্তু মৌপিয়ার ফোলা ফোলা চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে বেশিক্ষণ হলো ওঠেনি।
তমালকে দেখেই মৌপিয়ার মুখটা ঝলমল করে উঠেছিলো, কিন্তু পাশে অদিতিকে দেখেই মুখ নীচু করে নিলো সে। আস্তে করে বললো, গুড মর্নিং তমাল, ঘুম হয়েছিলো তো ভালো?
তমাল শিখার গালটা একটু টিপে দিয়ে বললো, গুড মর্নিং, হুম দারুণ ঘুম হয়েছে। মৌপিয়া শিখার হাত ধরে পাশ কাটিয়ে নীচে নেমে গেলো। বোধহয় কলেজে যাবার আগে শিখাকে জলখাবার খাওয়াতে। কালকের রাতের ঘটনার পরে মৌপিয়া আর তমালের সামনে স্বাভাবিক হতে পারছে না। একটা লজ্জাবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে। অদিতির নজরে সেটা পড়েছে কি না, অনুমান করতে পারলো না।
অদিতি তমালকে নিজের ঘরে ডাকলো। রুমে ঢুকে তমাল বিছানায় বসলো, আর অদিতি টুকটাক জিনিসপত্র ভ্যানিটি ব্যাগে গুছিয়ে নিতে লাগলো। মোবাইলটা চার্জার থেকে খুলে ব্যাগে রাখলো, তারপর আলমারিটা খুলে একটা ফাইল বের করে নিলো। চাকরির ইন্টারভিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আছে নিশ্চয়ই সেখানে।
কিন্তু এই অল্প সময়ের ভিতরেই তমাল যা দেখার দেখে নিয়েছে। একটা গাঢ় লাল রঙের জামা ঝুলছে হ্যাঙ্গার থেকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তমালের ভুরু কুঁচকে উঠেই আবার সমান হয়ে গেলো। তারপর এক চিলতে হাসি ফুটলো তার ঠোঁটের পাশে, যা কেউ জানতে পারলো না।
অদিতি ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো, কাল কখন ফিরলে? তমাল বললো, রাত একটা নাগাদ। দিদি কি জেগে ছিলো, নাকি ডাকতে হলো? আবার জানতে চাইলো অদিতি।
ডাকতে হলে তো তোমাকেই ডাকতাম, মৌপিয়াকে কেন ডাকবো? তমাল হেসে বললো। খুব খুশি হলো অদিতি এই কথা শুনে, তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো। তারপর বললো, তুমি কি আজ কোথাও বেরোবে?
তমাল বললো, হ্যাঁ একটু বেরোতাম, কিন্তু হবে না মনে হয়। গার্গীর গাড়িটা নিয়ে মদনকে একটা জায়গায় পাঠিয়েছি কাজে। তুমিও বোধহয় বিনোদকে নিয়ে বের হবে?
অদিতি একটু ভাবলো। তারপর বললো, হ্যাঁ আমার তো সারাদিনের কাজ আজকে, বিনোদ ছাড়া হবে না, কারণ ঘনশ্যাম কাকাকে সারাদিন আটকাতে পারবো না, পিসির কখন প্রয়োজন হয় তো জানিনা? তবে তোমার শহরের ভিতরে কাজ হলে আমি ঘনশ্যাম কাকাকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে নিয়ে যাবে।
তমাল বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আসানসোলেই থাকবো। বাইরে যাবার দরকার হবে না। ঘনশ্যাম বাবু হলেই হবে।
এগিয়ে এসে তমালের গালে একটা আলতো চুমু দিয়ে অদিতি বললো, চললাম তমালদা, রাতে কথা হবে ভালো করে। ততোক্ষণ লক্ষ্মী হয়ে থেকে, বেশি দুষ্টুমি কোরোনা, কেমন? তারপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
এই বাড়িতে একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করেছে তমাল। এখানে কেউ ঘরের দরজা লক্ করেনা বাইরে যাবার আগে। হয়তো নীচের সিকিউরিটি জোরদার বলেই। এটা তমালের জন্য একটা সুবিধা। চাইলেই সে এখন অদিতির ঘর সার্চ করতে পারতো, কিন্তু তার খুব একটা দরকার নেই, যা দেখার তা দেখা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। অদিতির পিছন পিছন সেও বেরিয়ে এলো।
নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো তমাল। তারপর বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়েই আবার দেখা হয়ে গেলো মৌপিয়ার সাথে। মেয়েকে কলেজে নিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ তমালের মনে পড়লো শিখাকে কলেজে নিয়ে যায় ঘনশ্যাম বাবুই। সুতরাং সে কলেজে তাকে নামিয়ে দিয়ে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তমালকে।
এবারে কিন্তু অদিতির অনুপস্থিতিতে কান এঁটো করা হাসি দিলো মৌপিয়া। গলা নীচু করে বললো, সারা গায়ে ব্যাথা হয়ে আছে তমাল। আর সেখানের কথা তো না বলাই ভালো, দেখছো না খুঁড়িয়ে হাঁটছি। উফফফফ্ কি জিনিস একখানা! আমি তো যতোবার ভাবছি ততোবারই ভিজে যাচ্ছি। অন্তত দুদিন ওখানে হাত লাগাতে পারবোনা মনে হয়!
তমাল চোখ বড় করে ইশারায় শিখাকে দেখালো। তারপর বললো, ওষুধ আছে আমার কাছে, দেবো নাকি?
মৌপিয়া মুচকি হাসি দিয়ে চোখ মেরে বললো, বিষের ব্যাথা ওষুধে না, আবার বিষেই কমে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, বেরোচ্ছো নাকি কোথাও?
তমাল জানালো তারা ফিরলে ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবে। একথা শুনে মৌপিয়া জানালো শিখাকে নামিয়ে দিয়ে ঘন্টাখানেকের ভিতরে ফিরবে।
তমালেরও ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। সে ডাইনিংয়ে ঢোকার আগে দেখা হলো বন্দনার সাথে। সে কিছু বলার আগেই তমাল জিজ্ঞেস করলো, মধুছন্দা দেবী কি ব্যস্ত আছেন? বন্দনা বললো, না না, মায়ের এখন কোনো কাজ নেই। তমাল বললো, একবার জিজ্ঞেস করে দেখোতো একটু কথা বলা যাবে কি না? বন্দনা মধুছন্দা দেবীর ঘরে ঢুকে একটু পরেই বেরিয়ে এসে বললো, আসুন মা ডাকছেন আপনাকে।
তমাল ভিতরে ঢুকে দেখলো সেই একই ভঙ্গীতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। তমাল নমস্কার করলে তিনি বললেন, এসো তমাল, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো তোমার? তমাল বললো, একদম না, বেশ রাজার হালেই আছি। আপনাকে দুটো কথা বলতে এলাম, আর আপনি কেমন আছেন একটু খোঁজ নিতেও এলাম।
আর আমার থাকা! বয়স হচ্ছে, চোখের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হয়ে আসছে। সময় থাকতে থাকতে ছেলে মেয়ে গুলোকে উপযুক্ত করে দিতে পারলেই আমার ছুটি।
তমাল পাশের চেয়ারে বসে বললো, কি আর এমন বয়স হয়েছে আপনার? এখনো এই সাম্রাজ্য তো আপনাকেই আগলে রাখতে হবে? ওরা তো এতো বড় বিজনেস সামলানোর পক্ষে এখনো অনেক ছোট। আর ডাক্তার চৌধুরী তো বললেন আপনার চোখ এখন অনেকটা ভালো।
ডঃ চৌধুরীর সাথে দেখা হয়েছে নাকি তোমার? প্রশ্ন করলেন মধুছন্দা দেবী।
হ্যাঁ, একটু পেটে ব্যাথা হচ্ছিলো কাল, বিনোদ নিয়ে গেছিলো ওনার কাছে। অনেক কথা হলো।
তা বেশ! আমার কথা বাদ দাও, বলো কি বলবে। তদন্ত কতো দূর এগোলো তোমার? একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন মধুছন্দা দেবী।
এগোচ্ছে মোটামুটি। জানতে এলাম আপনি যদি কোনো কাজে না যান তাহলে ঘন্টা কয়েকের জন্য আমি ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবো। আমার ড্রাইভারকে একটা কাজে একটু বাইরে পাঠিয়েছি।
বেশ তো, নিয়ে যাও ঘনশ্যাম কে, আমি আজ বাইরে যাবো না। জানালেন মধুছন্দা দেবী।
-আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিলো। আপনাদের এখানে আগে কাজ করতেন সুরেশ চাকলাদার, হিসাবপত্র তিনিই রাখতেন শুনলাম। তিনি এখন কোথায় থাকেন?
- এখান থেকে চলে যাবার পরে কিছুদিন মেয়ের কাছে রাণীগঞ্জে ছিলেন। কিন্তু বছর খানেক হলো তিনি কোথাও চলে গেছেন। বিপত্নীক মানুষ, কখন কোথায় থাকেন, মেয়েও নাকি জানে না।
- কাজ ছাড়ার পরে তাহলে তার সাথে যোগাযোগ ছিলো আপনার?
- না ঠিক যোগাযোগ ছিলো না, তবে রাজীবের একটা কি ইনফরমেশন দরকার ছিলো, তাই যোগাযোগ করেছিলো ওর মেয়ের বাড়িতে। তখনই মেয়ে বললো, বছর খানেক হলো সে আর মেয়ের কাছে থাকেন না।
- ও আচ্ছা। কিন্তু তার জায়গায় রাজীবকে রাখতে হলো কেন?
- সুরেশ বাবুর বয়স হয়ে গেছিলো। ঠিক মতো হিসাব রাখতে পারছিলেন না। হিসাবে গরমিল হচ্ছিলো খুব।
- সেটা কে জানালো আপনাকে? আপনি কি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন সেটা?
- অনুমান করেছিলাম। তাই রাজীবকে পার্ট-টাইম নিয়োগ করেছিলাম। সেই জানালো।
- কি মনে হয়? সুরেশ বাবু টাকা সরাচ্ছিলেন অ্যাকাউন্ট থেকে?
- ঠিক জানিনা। হতেও পারে। অথবা অমনোযোগের কারণে ভুল হয়ে থাকতে পারে।
- এই বিষয়ে সুরেশ বাবুর যুক্তি কি ছিলো?
- তিনি বলেছিলেন কেউ টাকা সরাচ্ছে, কিভাবে তা তিনি জানেন না।
- নিজেই টাকা সরিয়ে আবার নিজেই সে কথা আপনাকে জানালেন? ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না?
- হয়তো ধরা পড়ে যাবেন বুঝে আগেভাগে নিজের পক্ষে সাফাই দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।
- হুম, আপনাদের অ্যাকাউন্ট কোন ব্যাংকে?
- দুটো ব্যাঙ্কে আমাদের অ্যাকাউন্ট, স্টেট ব্যাংক আর এলাহাবাদ ব্যাংকে।
- আপনাদের পরিবারের পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট কোন ব্যাংকে?
- আমার, মৌপিয়ার আর অদিতির এলাহাবাদ ব্যাংকে, রাহুলের স্টেট ব্যাংকে।
- সাংসারিক খরচাপাতি কে হ্যান্ডেল করে?
- আমি আর রাহুল দুজনেই করি। বেশির ভাগ আমিই করি।
- ধন্যবাদ। আপাতত আর কিছু জানার নেই। আপনি বিশ্রাম নিন, পরে আবার কথা হবে।
সেখানে পুরো দস্তুর বাইরে যাবার পোশাক পরে অদিতি ব্রেকফাস্ট করছিলো। তমালকে দেখেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, এসো, এসো তমালদা। সরি কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গো। এক্সট্রিমলি সরি!
তমাল হেসে বললো, আরে এতো সরি হবার কি হলো? ফিরতে তো রাত হয়ে গেছিলো আমার, ঘুমিয়ে পড়া তো স্বাভাবিক। তবে মৌপিয়া জেগে ছিলো। তোমার হয়ে নাইটটা গুড, আই মিন, গুডনাইট উইশটা সে ই করে দিয়েছিলো।
হ্যাঁ, আমি জেগেই থাকতে চেয়েছিলাম, দিদি জোর করে আমাকে শুতে পাঠিয়ে দিলো। আসলে আজ আমার কয়েকটা জরুরী কাজ আছে। একবার ফ্যাক্টরি যাবো, তারপর একটা ইন্টারভিউ আছে রাণীগঞ্জে। জলদি বেরোতে হবে, তাই আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম... অজুহাত দেবার সুরে বললো অদিতি।
কিসের ইন্টারভিউ? প্রশ্ন করলো তমাল।
একটা চাকরির ইন্টারভিউ। টোস্ট চিবোতে চিবোতে জবাব দিলো অদিতি।
তমালের চা এসে গেছিলো ততোক্ষণে। একটা চুমুক দিয়ে সে বললো, বড়লোকের আদুরে মেয়ের আবার চাকরির কি দরকার? বিয়ে থা করে রাজত্বের এক তৃতীয়াংশ নিয়ে পঙ্খিরাজে করে উড়াল দিলেই তো হতো?
না তমালদা, লেখাপড়া শিখলাম কি বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তিতে জীবন কাটাবো বলে? নিজের যোগ্যতায় নিজের পরিচয় লিখতে চাই আমি। তাছাড়া এক তৃতীয়াংশ বলছো কেন? সম্পত্তিতে তো পিসিরও ভাগ আছে? বললো অদিতি।
ও হ্যাঁ তাই তো, ভুলেই গেছিলাম। তবে তোমার পিসির তো ছেলে মেয়ে নেই, তাই তার অবর্তমানে তো তোমরাই পাবে সব? বোঝাতে চাইলো তমাল।
অদিতি কোনো জবাব দিলো না। ততোক্ষনে একটি কাজের মেয়ে ফলের রস এনে দিলো। মেয়েটির বয়স মৌপিয়ার মতোই। সে চলে যেতেই তমাল বললো, আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে সব কর্মচারীরাই দেখছি অল্পবয়সী। পুরানো চাকরবাকর কেউ নেই?
অদিতি বললো, পুরানো বলতে শুধু সুলতাপিসিই আছে। ভজাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে টুকটাক, তবে বিশেষ কাজ নেই তার। বাকী সবাই প্রায় নতুন। আমাদের বাড়িতে খুব পুরানো লোকজন রাখার রেওয়াজ নেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি। একটু বয়স হয়ে গেলেই তাকে কিছু টাকাপয়সা এককালীন দিয়ে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তমাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, অদ্ভুত তো? কে করেছে এই অদ্ভুতুড়ে নিয়ম? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত পুরাতন ভৃত্যের গুনগান করে গেছেন আর তোমরা তাদেরই ছাড়িয়ে দাও? বিশ্বস্ততা অর্জন করতে সময় লাগে অদিতি।
তমালের কথার ধরনে হেসে ফেললো সে। বললো, না না নিয়ম কেউ বানায়নি।আসলে খুব ছোট বেলার কথা মনে নেই, কিন্তু একটু বড় হয়েই দেখছি অনেক চাকরবাকরকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর হোস্টেল থেকে বাড়ি এসে প্রতিবার দেখতাম নতুন কেউ না কেউ বহাল হয়েছে।
তেমন দু একজনের নাম বলোতো? জিজ্ঞাসা করলো তমাল।
একটু ভেবে অদিতি বললো, সুরেশ কাকা, ত্রিলোকদা, মানদা পিসি, রামহরি কাকা এদের কথাই মনে পড়ছে।
এদের সাথে আর যোগাযোগ নেই, তাই না?...জানতে চাইলো তমাল।
নাহ্! অন্তত আমি আর কখনো এদের দেখিনি। সুলতাপিসি বলতে পারবে। উনিই তো চিনতেন সবাইকে?
সুলতা পিসি কি তোমার বাবার আমলের? জানতে চাইলো তমাল।
তার ও আগের, ঠাকুরদার আমলের, সুলতা পিসি বহুদিনের পুরানো,জবাবে বললো অদিতি।
ততোক্ষণে দুজনেরই খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তমাল জানালো একটু পরে ব্রেকফাস্ট করবে। তারপর সে আর অদিতি উঠে এলো তিনতলায়। সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেলো মৌপিয়া আর শিখার সঙ্গে। শিখা কলেজ ড্রেস পরা, কিন্তু মৌপিয়ার ফোলা ফোলা চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে বেশিক্ষণ হলো ওঠেনি।
তমালকে দেখেই মৌপিয়ার মুখটা ঝলমল করে উঠেছিলো, কিন্তু পাশে অদিতিকে দেখেই মুখ নীচু করে নিলো সে। আস্তে করে বললো, গুড মর্নিং তমাল, ঘুম হয়েছিলো তো ভালো?
তমাল শিখার গালটা একটু টিপে দিয়ে বললো, গুড মর্নিং, হুম দারুণ ঘুম হয়েছে। মৌপিয়া শিখার হাত ধরে পাশ কাটিয়ে নীচে নেমে গেলো। বোধহয় কলেজে যাবার আগে শিখাকে জলখাবার খাওয়াতে। কালকের রাতের ঘটনার পরে মৌপিয়া আর তমালের সামনে স্বাভাবিক হতে পারছে না। একটা লজ্জাবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে। অদিতির নজরে সেটা পড়েছে কি না, অনুমান করতে পারলো না।
অদিতি তমালকে নিজের ঘরে ডাকলো। রুমে ঢুকে তমাল বিছানায় বসলো, আর অদিতি টুকটাক জিনিসপত্র ভ্যানিটি ব্যাগে গুছিয়ে নিতে লাগলো। মোবাইলটা চার্জার থেকে খুলে ব্যাগে রাখলো, তারপর আলমারিটা খুলে একটা ফাইল বের করে নিলো। চাকরির ইন্টারভিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আছে নিশ্চয়ই সেখানে।
কিন্তু এই অল্প সময়ের ভিতরেই তমাল যা দেখার দেখে নিয়েছে। একটা গাঢ় লাল রঙের জামা ঝুলছে হ্যাঙ্গার থেকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তমালের ভুরু কুঁচকে উঠেই আবার সমান হয়ে গেলো। তারপর এক চিলতে হাসি ফুটলো তার ঠোঁটের পাশে, যা কেউ জানতে পারলো না।
অদিতি ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো, কাল কখন ফিরলে? তমাল বললো, রাত একটা নাগাদ। দিদি কি জেগে ছিলো, নাকি ডাকতে হলো? আবার জানতে চাইলো অদিতি।
ডাকতে হলে তো তোমাকেই ডাকতাম, মৌপিয়াকে কেন ডাকবো? তমাল হেসে বললো। খুব খুশি হলো অদিতি এই কথা শুনে, তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো। তারপর বললো, তুমি কি আজ কোথাও বেরোবে?
তমাল বললো, হ্যাঁ একটু বেরোতাম, কিন্তু হবে না মনে হয়। গার্গীর গাড়িটা নিয়ে মদনকে একটা জায়গায় পাঠিয়েছি কাজে। তুমিও বোধহয় বিনোদকে নিয়ে বের হবে?
অদিতি একটু ভাবলো। তারপর বললো, হ্যাঁ আমার তো সারাদিনের কাজ আজকে, বিনোদ ছাড়া হবে না, কারণ ঘনশ্যাম কাকাকে সারাদিন আটকাতে পারবো না, পিসির কখন প্রয়োজন হয় তো জানিনা? তবে তোমার শহরের ভিতরে কাজ হলে আমি ঘনশ্যাম কাকাকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে নিয়ে যাবে।
তমাল বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আসানসোলেই থাকবো। বাইরে যাবার দরকার হবে না। ঘনশ্যাম বাবু হলেই হবে।
এগিয়ে এসে তমালের গালে একটা আলতো চুমু দিয়ে অদিতি বললো, চললাম তমালদা, রাতে কথা হবে ভালো করে। ততোক্ষণ লক্ষ্মী হয়ে থেকে, বেশি দুষ্টুমি কোরোনা, কেমন? তারপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
এই বাড়িতে একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করেছে তমাল। এখানে কেউ ঘরের দরজা লক্ করেনা বাইরে যাবার আগে। হয়তো নীচের সিকিউরিটি জোরদার বলেই। এটা তমালের জন্য একটা সুবিধা। চাইলেই সে এখন অদিতির ঘর সার্চ করতে পারতো, কিন্তু তার খুব একটা দরকার নেই, যা দেখার তা দেখা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। অদিতির পিছন পিছন সেও বেরিয়ে এলো।
নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো তমাল। তারপর বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়েই আবার দেখা হয়ে গেলো মৌপিয়ার সাথে। মেয়েকে কলেজে নিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ তমালের মনে পড়লো শিখাকে কলেজে নিয়ে যায় ঘনশ্যাম বাবুই। সুতরাং সে কলেজে তাকে নামিয়ে দিয়ে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তমালকে।
এবারে কিন্তু অদিতির অনুপস্থিতিতে কান এঁটো করা হাসি দিলো মৌপিয়া। গলা নীচু করে বললো, সারা গায়ে ব্যাথা হয়ে আছে তমাল। আর সেখানের কথা তো না বলাই ভালো, দেখছো না খুঁড়িয়ে হাঁটছি। উফফফফ্ কি জিনিস একখানা! আমি তো যতোবার ভাবছি ততোবারই ভিজে যাচ্ছি। অন্তত দুদিন ওখানে হাত লাগাতে পারবোনা মনে হয়!
তমাল চোখ বড় করে ইশারায় শিখাকে দেখালো। তারপর বললো, ওষুধ আছে আমার কাছে, দেবো নাকি?
মৌপিয়া মুচকি হাসি দিয়ে চোখ মেরে বললো, বিষের ব্যাথা ওষুধে না, আবার বিষেই কমে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, বেরোচ্ছো নাকি কোথাও?
তমাল জানালো তারা ফিরলে ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবে। একথা শুনে মৌপিয়া জানালো শিখাকে নামিয়ে দিয়ে ঘন্টাখানেকের ভিতরে ফিরবে।
তমালেরও ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। সে ডাইনিংয়ে ঢোকার আগে দেখা হলো বন্দনার সাথে। সে কিছু বলার আগেই তমাল জিজ্ঞেস করলো, মধুছন্দা দেবী কি ব্যস্ত আছেন? বন্দনা বললো, না না, মায়ের এখন কোনো কাজ নেই। তমাল বললো, একবার জিজ্ঞেস করে দেখোতো একটু কথা বলা যাবে কি না? বন্দনা মধুছন্দা দেবীর ঘরে ঢুকে একটু পরেই বেরিয়ে এসে বললো, আসুন মা ডাকছেন আপনাকে।
তমাল ভিতরে ঢুকে দেখলো সেই একই ভঙ্গীতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। তমাল নমস্কার করলে তিনি বললেন, এসো তমাল, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো তোমার? তমাল বললো, একদম না, বেশ রাজার হালেই আছি। আপনাকে দুটো কথা বলতে এলাম, আর আপনি কেমন আছেন একটু খোঁজ নিতেও এলাম।
আর আমার থাকা! বয়স হচ্ছে, চোখের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হয়ে আসছে। সময় থাকতে থাকতে ছেলে মেয়ে গুলোকে উপযুক্ত করে দিতে পারলেই আমার ছুটি।
তমাল পাশের চেয়ারে বসে বললো, কি আর এমন বয়স হয়েছে আপনার? এখনো এই সাম্রাজ্য তো আপনাকেই আগলে রাখতে হবে? ওরা তো এতো বড় বিজনেস সামলানোর পক্ষে এখনো অনেক ছোট। আর ডাক্তার চৌধুরী তো বললেন আপনার চোখ এখন অনেকটা ভালো।
ডঃ চৌধুরীর সাথে দেখা হয়েছে নাকি তোমার? প্রশ্ন করলেন মধুছন্দা দেবী।
হ্যাঁ, একটু পেটে ব্যাথা হচ্ছিলো কাল, বিনোদ নিয়ে গেছিলো ওনার কাছে। অনেক কথা হলো।
তা বেশ! আমার কথা বাদ দাও, বলো কি বলবে। তদন্ত কতো দূর এগোলো তোমার? একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন মধুছন্দা দেবী।
এগোচ্ছে মোটামুটি। জানতে এলাম আপনি যদি কোনো কাজে না যান তাহলে ঘন্টা কয়েকের জন্য আমি ঘনশ্যাম বাবুকে নিয়ে একটু বের হবো। আমার ড্রাইভারকে একটা কাজে একটু বাইরে পাঠিয়েছি।
বেশ তো, নিয়ে যাও ঘনশ্যাম কে, আমি আজ বাইরে যাবো না। জানালেন মধুছন্দা দেবী।
-আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিলো। আপনাদের এখানে আগে কাজ করতেন সুরেশ চাকলাদার, হিসাবপত্র তিনিই রাখতেন শুনলাম। তিনি এখন কোথায় থাকেন?
- এখান থেকে চলে যাবার পরে কিছুদিন মেয়ের কাছে রাণীগঞ্জে ছিলেন। কিন্তু বছর খানেক হলো তিনি কোথাও চলে গেছেন। বিপত্নীক মানুষ, কখন কোথায় থাকেন, মেয়েও নাকি জানে না।
- কাজ ছাড়ার পরে তাহলে তার সাথে যোগাযোগ ছিলো আপনার?
- না ঠিক যোগাযোগ ছিলো না, তবে রাজীবের একটা কি ইনফরমেশন দরকার ছিলো, তাই যোগাযোগ করেছিলো ওর মেয়ের বাড়িতে। তখনই মেয়ে বললো, বছর খানেক হলো সে আর মেয়ের কাছে থাকেন না।
- ও আচ্ছা। কিন্তু তার জায়গায় রাজীবকে রাখতে হলো কেন?
- সুরেশ বাবুর বয়স হয়ে গেছিলো। ঠিক মতো হিসাব রাখতে পারছিলেন না। হিসাবে গরমিল হচ্ছিলো খুব।
- সেটা কে জানালো আপনাকে? আপনি কি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন সেটা?
- অনুমান করেছিলাম। তাই রাজীবকে পার্ট-টাইম নিয়োগ করেছিলাম। সেই জানালো।
- কি মনে হয়? সুরেশ বাবু টাকা সরাচ্ছিলেন অ্যাকাউন্ট থেকে?
- ঠিক জানিনা। হতেও পারে। অথবা অমনোযোগের কারণে ভুল হয়ে থাকতে পারে।
- এই বিষয়ে সুরেশ বাবুর যুক্তি কি ছিলো?
- তিনি বলেছিলেন কেউ টাকা সরাচ্ছে, কিভাবে তা তিনি জানেন না।
- নিজেই টাকা সরিয়ে আবার নিজেই সে কথা আপনাকে জানালেন? ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না?
- হয়তো ধরা পড়ে যাবেন বুঝে আগেভাগে নিজের পক্ষে সাফাই দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।
- হুম, আপনাদের অ্যাকাউন্ট কোন ব্যাংকে?
- দুটো ব্যাঙ্কে আমাদের অ্যাকাউন্ট, স্টেট ব্যাংক আর এলাহাবাদ ব্যাংকে।
- আপনাদের পরিবারের পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট কোন ব্যাংকে?
- আমার, মৌপিয়ার আর অদিতির এলাহাবাদ ব্যাংকে, রাহুলের স্টেট ব্যাংকে।
- সাংসারিক খরচাপাতি কে হ্যান্ডেল করে?
- আমি আর রাহুল দুজনেই করি। বেশির ভাগ আমিই করি।
- ধন্যবাদ। আপাতত আর কিছু জানার নেই। আপনি বিশ্রাম নিন, পরে আবার কথা হবে।