29-11-2024, 06:46 AM
(This post was last modified: 29-11-2024, 06:46 AM by বহুরূপী. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পর্ব ৩৪
আজ আর শেষে নয় আগেই বলে রাখি– আজকের আপডেট খানিকটা তেতো। তবে যতটা সম্ভব সহজ ও হালকা মেজাজে লেখার চেষ্টা করেছি।তাই আশা করি বিশেষ খারাপ লাগবে না।
“প্রথমে ভেবেছিলাম তার কাছে লিখবো। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, সে একথা হয়তো বিশ্বাস করবে না। সত্য বলছি দিদি মন্দ অভিপ্রায়ে আমি তার গৃহে আগমণ করিনি। কিন্তু এসেই যখন দেখলাম ইতিমধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে, তখন আমার কি হলে সে কথা আমি নিজেও বলতে পারি না। তবে থাক সে কথা, ও কথা লজ্জার । কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, এমন মন্দ চিন্তা এর আগে আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। তোমার কাছে কিছু চাওয়ার সাহস নেই আমার। তাই শুধু দুটি অনুরোধ করবো। তোমায় যা বলেছিলাম, কোন একদিন সৎ সুযোগে তাকে তুমি তা বলো। এই কথাটুকু শুধু বলে যে― আমি অপরাধী বটে, তবে ওই অপরাধ করা ছাড়া আমার দ্বিতীয় উপায় ছিল না। সে হয়তো বিশ্বাস করবে না,তা না করুক। তবুও তুমি বলো। এই বোঝে আর সয় না। আমার আর একটি অনুরোধ এই যে,পিসিকে তোমার চরণে ঠাই দিও। সে বেচারীর আর যাবার দ্বিতীয় স্থান নাই। যে সম্পদের কল্যাণে আমার যিনি প্রাণাধিক তাকেই হারিয়েছি, আমার সেই স্থাবর অস্থাবর সম্পদ সম্পত্তি আমি দানে বিলিয়ে এসেছি। শুধু তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এত দূর আসা। আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবকিছুর উপর কর্তৃত্ব শুধু তার। সে আমার প্রসারিত বাহুডোরে না আসুক, তবু আমার সব কিছুই তার। সেদিন হেমকে দেখেই আমি গৃহত্যাগ করতাম। কিন্তু তখন উপায় ছিল না,তাকে সেই অবস্থায় ফেলে যেতে মন সায় দেয়নি। তার পর আমার কি দুর্বুদ্ধি হইল সে কথা আর মুখে আনবো না। এখন তোমাদের কাছে আমার এই ভিক্ষা যে, তোমরা আমার সন্ধান করার চেষ্টা করো না।”
ভেতর বারান্দায় বোধকরি শোকে পাথর হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে দাসী মঙ্গলা। সৌদামিনীর ফেলে যাওয়া চিঠির পাঠ শুনিবার পর থেকেই তার এই অবস্থা। দাসী মঙ্গলা সৌদামিনীর বাড়িতে বহুকাল ধরে বাস করে এসেছে । সে যেদিন প্রথম ওবাড়ি কাজে যোগদান করে,তখন দামিনী বছর ছয়ের ফুটফুটে এক বালিকা। তাই তার চোখের কোণ আদ্র হলে তা মানানসই। কিন্তু সৌদামিনী বাড়ি ছাড়ার খবরে সবচেয়ে বেশি যে কাঁদছে সে হেমলতা। দাসী মঙ্গলার ক্রোড়ে মাথা ঠেকিয়ে হেম সেই সকাল থেকে কান্না আরম্ভ করেছে। কিন্তু সে কাঁদে কেন? এমন তো নয় যে সৌদামিনীর সম্পর্কে তার আর কিছু জানার বাকি আছে। এতদিন দামিনীর মুখে যা শুনে সে ক্ষনে ক্ষনে ভীত ও ক্ষনে ক্ষনে রাগিত হইতো,এখন সেই সতিন বাক্যটি সত্য হিসেবে ধরলেও হেমের অপরাধ হয় না। তবে বোধকরি সে বেচারী সতিন হিসেবে সৌদামিনীকে এখন কল্পনায় আনে নাই।
নয়নতারা গৃহদ্বারে মাথা ঠেকিয়ে মুঠিতে সৌদামিনীর চিঠি ধরে পথের পানে ব্যাকুলতা পূর্ণ চোখে চেয়ে ছিল। সঞ্জয় বেরিয়েছে সকালে, এখন প্রায় দুপুর হয় হয়। নয়নতারার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। গতরাতেই দামিনীর সাথে তার কথা হয়েছিল। নয়ন এত করে বলার পরেও দামিনী আর এবাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি। তাই বলে কেউকে না বলে এই রূপ হঠাৎ মেয়েটা উধাও হবে কে জানতো! মেয়েটার হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই। খানিকক্ষণ পরে নয়নতারা ভেতর বারান্দায় এসে বসলো দাসী ও তার বোনের পাশে। ক্রন্দনরত হেমলতার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল কন্ঠে বললে,
– ছি! লক্ষ্মীটি ওভাবে কাঁদতে আছে, দেখে মুখটি তোল দেখি।
হেমলতা মুখ তুললেও কান্না তার থামলো কই। অবশ্য নয়নতারাও কম চিন্তিত নয়। পাগলী মেয়েটা না জানি হুট করে কি করে বসবে। তাছাড়া শহড়ের মেয়ে,এই সব পাড়াগাঁয়ের ভাবসাব সে কিই বা জানে? কিন্তু নয়ন অবাক হয় তার বোনকে দেখে। চিরকাল দেখে এসেছে এই অভিমানী মেয়েটাকে। হেমের সম্পর্কে এখনো কি আছে তার জানবার বাকি! তবুও আজ সৌদামিনীর জন্যে হেমকে কাঁদতে দেখে নয়নতারা হেমের এক নতুন রূপ আবিষ্কার করলো। এই হেম পরের দুঃখে মর্মাহত হয়।
হেমের হাতের মুঠোয় সৌদামিনীর মাথার কাটাটি ধরাছিল । এটি সবসময় দামিনীর মাথায় স্থান পেত। পাবারই কথা,হাজার হোক মায়ের একমাত্র স্মৃতি বলে কথা। কিন্তু যাবার আগে এটি হেমের কাছে কেন রেখে গেল? নয়ন তা কিছুতে বুঝে উঠতে পারে না। তবে সে সব নিয়ে অত ভাবনায় কাজ নেই এখন। হেমকে শান্ত রাখা চাই আগে।
নয়নতারা বোনকে খানিকক্ষণ বুঝিয়ে কান্না থামিয়ে একটু স্বাভাবিক করে তুলেছে। এমন সময় বৌমণি ডাক ছেড়ে দেবু এলো ছুটতে ছুটতে। দরজা খোলাই ছিল। দেবু বৈঠকঘর পেরিয়ে সোজা ভেতর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে,
– নদী তীরে একটা মেয়ের দেহ ভেসে উঠেছে......
///////////
দিন ফুরিয়ে গেলে যেমন একটু একটু করে আলো হারাতে শুরু করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তেমনি সৌদামিনী দেহের শক্তি হারাতে লাগলো। হবারই কথা, সেই সকাল থেকে বেচারী হাটছে। সে যখন সঞ্জয়ের বাড়ি ছাড়ে তখন এই ধরণীর বৃক্ষে বাসরত পাখিরাও ঘুমিয়ে। সূর্যদেবের পাঠে বসতে তখনও অনেক দেরি। রাতের অন্ধকার প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে দামিনী আজ তার মনের মানুষটিকে অন্যের বুকে সপে এসেছে। এতে করে বুক যে তার ফেটে যায়নি তা নয়, তবে সেই ফাটল কাহার দৃষ্টি গোছর হবার নয়। সেই ব্যাথার অনুভূতি টুকু শুধুমাত্র এই পোড়াকপালির একার। অন্তত এতে কেহই ভাগ্য বসাতে আসবে না। তবে এই ব্যথায় সৌদামিনী হয় তো মারাত্মক রকম কাতর নয়। আর হবেই বা কেন! মনে মনে এতো দিন যাকে স্বামী ভেবে ভালোবেসে এসেছে তার সুখে সে কেনোই বা কাতর হবে। সঞ্জয়কে যে ভাবে সে ভালবাসে, ঠিক তেমনি হেমকে ভালবাসা তার পক্ষে কি এমন অসাধ্য হবে! তবে ভালোবাসা দূরে থাক,আপাতত সে বাঁচলে হয়।
অন্ধকার রাত্রি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সে যে কত দূর এসেছে তা কেই বা জানে! এদিকে অস্বাভাবিক হাঁটাহাঁটির ফলে মচকানো পা খানা যেন ব্যাথায় ছিড়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। আর শুধু কি তাই! সেই সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ জমে আছে। বাতাসে জোলো ভাব। মৃদুমন্দ হাওয়া কোন এক কোণ থেকে এসে গায়ে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। পথের ধারে তালবৃক্ষের পাতায় হাওয়া লেগে “খর খর” শব্দের তৈরী করছে। এ যেন অভাগী দামিনীর করুণ অবস্থায় প্রকৃতির অট্টহাসি। তার ওপড়ে একটু আগেই প্রবল বৃষ্টিপাত হবে হবে করেও অল্প গা ভিজিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর থেকে আকাশটা থম মেরে আছে। এখন যদিও বৃষ্টি পড়ছে না, তবু সম্ভাবনা আছে । হয়ত মেঘের বুকে জল ফুরিয়ে গেছে। যেমনটি মানুষ কাঁদলে হয়। কান্না থেমে যায় কিন্তু চোখের নিচে কালো দাগ অনেক খন ভেসে থাকে।
কাদা বাঁচিয়ে পা টিপে টিপে দামিনী আরও এগিয়ে যায়। গন্তব্য? থাক, সে পরের ব্যপার। আপাতত এই মেঘ-জমা, আপাত-আঁধার প্রকৃতি হারিয়ে যাওয়ার আগে তাকে পুরোপুরি উপভোগ করাই তার ইচ্ছে। তবু, পিঠের ব্যাগটা দেখলে, যে কেউ বুঝে যাবে, একটা গন্তব্য তার আছে। আচ্ছা, বোঝা কি ফুরিয়ে যায় না? কেন সারা জীবন একটা মানুষকে বোঝা বয়ে চলতে হবে? জীবনের একেকটা সময় একেকটা বোঝা। সময় ফুরিয়ে গেলে, জীবনের বোঝাটা বয়ে বেড়ানো। অবশ্য দামিনীর তো বয়স ফুরায় নি, যে জীবনের বোঝা নিয়ে ভাবতে হবে তাকে। তারচেয়ে বরং কাঁধের বোঝাটা ফেলে দেওয়াই ভালো। একটু নির্ভার হওয়াই যে এবেলার ইচ্ছে। কথাটা মনে হতেই কাঁধের ব্যাগ টা মাটিতে লুটালো। আর দামিনী! সে এগুছে আপন পথে ।গন্তব্য আপাতত পথের ও আমাদের অজানা।
//////////
দেবুর আনা সংবাদ শুনে নয়ন কাঠ হইয়া গিয়া কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারলো না। ওদিকে দাসী মঙ্গলা এতখন যাও সামলে ছিল এই কথা শোনা পর সে তৎক্ষণাৎ মেঝেতে লুটিয়ে পরলো। তারপর সেকি টানাটানি কান্ড। অবশেষে মাথায় জল ঢেলে যেই সে উঠেছে, তখনই নয়নতারার স্বামী এসে হাজির।
সোহম নদী তীর হয়ে এসেছে বাড়িতে,তার সাথে এসেছে সঞ্জয়ের বন্ধু । বাড়িতে এসেই এই অবস্থা দেখে সোহম দেবুকে আগে এক চোট বকাঝকা করে তবে আসল খবর দিল। নদীতীরে যে মেয়েটির দেহে পাওয়া গেছে সেটি দামিনী নয়। কিন্তু মেয়েটা কে তাও জানা যায়নি,বোধহয় নৌকা ডুবি হয়েছে হয় তো।
তা না হয় হলো, কিন্তু দামিনীর কি খবর? না, তা এখনো জানা যায়নি। তবে সঞ্জয় উত্তর দিকের পথে বেরিয়েছে তাকে খুঁজতে আর সোহম ও সঞ্জয়ের বন্ধুটি এসেছে মোটরসাইকেল টি নিতে। এতে খোঁজ সহজ হয়। মচকানো পা নিয়ে দামিনী আর কত দূরেই বা যাবে?
খোঁজাখুঁজির ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি বা কমতি নেই ,এখন শুধু মেয়েটা কোন পাগলামি না করলেই হয়। তবে সে তো হলো,কিন্তু এতো কিছু শুনে বাকিরা যখন খানিকটা স্বাভাবিক তখন নয়নতারার চোখমুখে ভয়ের চাপ কি কারণে? তার মনে মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে চক্রাকারে“ মেয়েটা কোন পাগলামি না করে বসে”
আজ আর শেষে নয় আগেই বলে রাখি– আজকের আপডেট খানিকটা তেতো। তবে যতটা সম্ভব সহজ ও হালকা মেজাজে লেখার চেষ্টা করেছি।তাই আশা করি বিশেষ খারাপ লাগবে না।
“প্রথমে ভেবেছিলাম তার কাছে লিখবো। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, সে একথা হয়তো বিশ্বাস করবে না। সত্য বলছি দিদি মন্দ অভিপ্রায়ে আমি তার গৃহে আগমণ করিনি। কিন্তু এসেই যখন দেখলাম ইতিমধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে, তখন আমার কি হলে সে কথা আমি নিজেও বলতে পারি না। তবে থাক সে কথা, ও কথা লজ্জার । কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, এমন মন্দ চিন্তা এর আগে আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। তোমার কাছে কিছু চাওয়ার সাহস নেই আমার। তাই শুধু দুটি অনুরোধ করবো। তোমায় যা বলেছিলাম, কোন একদিন সৎ সুযোগে তাকে তুমি তা বলো। এই কথাটুকু শুধু বলে যে― আমি অপরাধী বটে, তবে ওই অপরাধ করা ছাড়া আমার দ্বিতীয় উপায় ছিল না। সে হয়তো বিশ্বাস করবে না,তা না করুক। তবুও তুমি বলো। এই বোঝে আর সয় না। আমার আর একটি অনুরোধ এই যে,পিসিকে তোমার চরণে ঠাই দিও। সে বেচারীর আর যাবার দ্বিতীয় স্থান নাই। যে সম্পদের কল্যাণে আমার যিনি প্রাণাধিক তাকেই হারিয়েছি, আমার সেই স্থাবর অস্থাবর সম্পদ সম্পত্তি আমি দানে বিলিয়ে এসেছি। শুধু তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এত দূর আসা। আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবকিছুর উপর কর্তৃত্ব শুধু তার। সে আমার প্রসারিত বাহুডোরে না আসুক, তবু আমার সব কিছুই তার। সেদিন হেমকে দেখেই আমি গৃহত্যাগ করতাম। কিন্তু তখন উপায় ছিল না,তাকে সেই অবস্থায় ফেলে যেতে মন সায় দেয়নি। তার পর আমার কি দুর্বুদ্ধি হইল সে কথা আর মুখে আনবো না। এখন তোমাদের কাছে আমার এই ভিক্ষা যে, তোমরা আমার সন্ধান করার চেষ্টা করো না।”
ভেতর বারান্দায় বোধকরি শোকে পাথর হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে দাসী মঙ্গলা। সৌদামিনীর ফেলে যাওয়া চিঠির পাঠ শুনিবার পর থেকেই তার এই অবস্থা। দাসী মঙ্গলা সৌদামিনীর বাড়িতে বহুকাল ধরে বাস করে এসেছে । সে যেদিন প্রথম ওবাড়ি কাজে যোগদান করে,তখন দামিনী বছর ছয়ের ফুটফুটে এক বালিকা। তাই তার চোখের কোণ আদ্র হলে তা মানানসই। কিন্তু সৌদামিনী বাড়ি ছাড়ার খবরে সবচেয়ে বেশি যে কাঁদছে সে হেমলতা। দাসী মঙ্গলার ক্রোড়ে মাথা ঠেকিয়ে হেম সেই সকাল থেকে কান্না আরম্ভ করেছে। কিন্তু সে কাঁদে কেন? এমন তো নয় যে সৌদামিনীর সম্পর্কে তার আর কিছু জানার বাকি আছে। এতদিন দামিনীর মুখে যা শুনে সে ক্ষনে ক্ষনে ভীত ও ক্ষনে ক্ষনে রাগিত হইতো,এখন সেই সতিন বাক্যটি সত্য হিসেবে ধরলেও হেমের অপরাধ হয় না। তবে বোধকরি সে বেচারী সতিন হিসেবে সৌদামিনীকে এখন কল্পনায় আনে নাই।
নয়নতারা গৃহদ্বারে মাথা ঠেকিয়ে মুঠিতে সৌদামিনীর চিঠি ধরে পথের পানে ব্যাকুলতা পূর্ণ চোখে চেয়ে ছিল। সঞ্জয় বেরিয়েছে সকালে, এখন প্রায় দুপুর হয় হয়। নয়নতারার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। গতরাতেই দামিনীর সাথে তার কথা হয়েছিল। নয়ন এত করে বলার পরেও দামিনী আর এবাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি। তাই বলে কেউকে না বলে এই রূপ হঠাৎ মেয়েটা উধাও হবে কে জানতো! মেয়েটার হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই। খানিকক্ষণ পরে নয়নতারা ভেতর বারান্দায় এসে বসলো দাসী ও তার বোনের পাশে। ক্রন্দনরত হেমলতার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল কন্ঠে বললে,
– ছি! লক্ষ্মীটি ওভাবে কাঁদতে আছে, দেখে মুখটি তোল দেখি।
হেমলতা মুখ তুললেও কান্না তার থামলো কই। অবশ্য নয়নতারাও কম চিন্তিত নয়। পাগলী মেয়েটা না জানি হুট করে কি করে বসবে। তাছাড়া শহড়ের মেয়ে,এই সব পাড়াগাঁয়ের ভাবসাব সে কিই বা জানে? কিন্তু নয়ন অবাক হয় তার বোনকে দেখে। চিরকাল দেখে এসেছে এই অভিমানী মেয়েটাকে। হেমের সম্পর্কে এখনো কি আছে তার জানবার বাকি! তবুও আজ সৌদামিনীর জন্যে হেমকে কাঁদতে দেখে নয়নতারা হেমের এক নতুন রূপ আবিষ্কার করলো। এই হেম পরের দুঃখে মর্মাহত হয়।
হেমের হাতের মুঠোয় সৌদামিনীর মাথার কাটাটি ধরাছিল । এটি সবসময় দামিনীর মাথায় স্থান পেত। পাবারই কথা,হাজার হোক মায়ের একমাত্র স্মৃতি বলে কথা। কিন্তু যাবার আগে এটি হেমের কাছে কেন রেখে গেল? নয়ন তা কিছুতে বুঝে উঠতে পারে না। তবে সে সব নিয়ে অত ভাবনায় কাজ নেই এখন। হেমকে শান্ত রাখা চাই আগে।
নয়নতারা বোনকে খানিকক্ষণ বুঝিয়ে কান্না থামিয়ে একটু স্বাভাবিক করে তুলেছে। এমন সময় বৌমণি ডাক ছেড়ে দেবু এলো ছুটতে ছুটতে। দরজা খোলাই ছিল। দেবু বৈঠকঘর পেরিয়ে সোজা ভেতর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে,
– নদী তীরে একটা মেয়ের দেহ ভেসে উঠেছে......
///////////
দিন ফুরিয়ে গেলে যেমন একটু একটু করে আলো হারাতে শুরু করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তেমনি সৌদামিনী দেহের শক্তি হারাতে লাগলো। হবারই কথা, সেই সকাল থেকে বেচারী হাটছে। সে যখন সঞ্জয়ের বাড়ি ছাড়ে তখন এই ধরণীর বৃক্ষে বাসরত পাখিরাও ঘুমিয়ে। সূর্যদেবের পাঠে বসতে তখনও অনেক দেরি। রাতের অন্ধকার প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে দামিনী আজ তার মনের মানুষটিকে অন্যের বুকে সপে এসেছে। এতে করে বুক যে তার ফেটে যায়নি তা নয়, তবে সেই ফাটল কাহার দৃষ্টি গোছর হবার নয়। সেই ব্যাথার অনুভূতি টুকু শুধুমাত্র এই পোড়াকপালির একার। অন্তত এতে কেহই ভাগ্য বসাতে আসবে না। তবে এই ব্যথায় সৌদামিনী হয় তো মারাত্মক রকম কাতর নয়। আর হবেই বা কেন! মনে মনে এতো দিন যাকে স্বামী ভেবে ভালোবেসে এসেছে তার সুখে সে কেনোই বা কাতর হবে। সঞ্জয়কে যে ভাবে সে ভালবাসে, ঠিক তেমনি হেমকে ভালবাসা তার পক্ষে কি এমন অসাধ্য হবে! তবে ভালোবাসা দূরে থাক,আপাতত সে বাঁচলে হয়।
অন্ধকার রাত্রি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সে যে কত দূর এসেছে তা কেই বা জানে! এদিকে অস্বাভাবিক হাঁটাহাঁটির ফলে মচকানো পা খানা যেন ব্যাথায় ছিড়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। আর শুধু কি তাই! সেই সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ জমে আছে। বাতাসে জোলো ভাব। মৃদুমন্দ হাওয়া কোন এক কোণ থেকে এসে গায়ে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। পথের ধারে তালবৃক্ষের পাতায় হাওয়া লেগে “খর খর” শব্দের তৈরী করছে। এ যেন অভাগী দামিনীর করুণ অবস্থায় প্রকৃতির অট্টহাসি। তার ওপড়ে একটু আগেই প্রবল বৃষ্টিপাত হবে হবে করেও অল্প গা ভিজিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর থেকে আকাশটা থম মেরে আছে। এখন যদিও বৃষ্টি পড়ছে না, তবু সম্ভাবনা আছে । হয়ত মেঘের বুকে জল ফুরিয়ে গেছে। যেমনটি মানুষ কাঁদলে হয়। কান্না থেমে যায় কিন্তু চোখের নিচে কালো দাগ অনেক খন ভেসে থাকে।
কাদা বাঁচিয়ে পা টিপে টিপে দামিনী আরও এগিয়ে যায়। গন্তব্য? থাক, সে পরের ব্যপার। আপাতত এই মেঘ-জমা, আপাত-আঁধার প্রকৃতি হারিয়ে যাওয়ার আগে তাকে পুরোপুরি উপভোগ করাই তার ইচ্ছে। তবু, পিঠের ব্যাগটা দেখলে, যে কেউ বুঝে যাবে, একটা গন্তব্য তার আছে। আচ্ছা, বোঝা কি ফুরিয়ে যায় না? কেন সারা জীবন একটা মানুষকে বোঝা বয়ে চলতে হবে? জীবনের একেকটা সময় একেকটা বোঝা। সময় ফুরিয়ে গেলে, জীবনের বোঝাটা বয়ে বেড়ানো। অবশ্য দামিনীর তো বয়স ফুরায় নি, যে জীবনের বোঝা নিয়ে ভাবতে হবে তাকে। তারচেয়ে বরং কাঁধের বোঝাটা ফেলে দেওয়াই ভালো। একটু নির্ভার হওয়াই যে এবেলার ইচ্ছে। কথাটা মনে হতেই কাঁধের ব্যাগ টা মাটিতে লুটালো। আর দামিনী! সে এগুছে আপন পথে ।গন্তব্য আপাতত পথের ও আমাদের অজানা।
//////////
দেবুর আনা সংবাদ শুনে নয়ন কাঠ হইয়া গিয়া কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারলো না। ওদিকে দাসী মঙ্গলা এতখন যাও সামলে ছিল এই কথা শোনা পর সে তৎক্ষণাৎ মেঝেতে লুটিয়ে পরলো। তারপর সেকি টানাটানি কান্ড। অবশেষে মাথায় জল ঢেলে যেই সে উঠেছে, তখনই নয়নতারার স্বামী এসে হাজির।
সোহম নদী তীর হয়ে এসেছে বাড়িতে,তার সাথে এসেছে সঞ্জয়ের বন্ধু । বাড়িতে এসেই এই অবস্থা দেখে সোহম দেবুকে আগে এক চোট বকাঝকা করে তবে আসল খবর দিল। নদীতীরে যে মেয়েটির দেহে পাওয়া গেছে সেটি দামিনী নয়। কিন্তু মেয়েটা কে তাও জানা যায়নি,বোধহয় নৌকা ডুবি হয়েছে হয় তো।
তা না হয় হলো, কিন্তু দামিনীর কি খবর? না, তা এখনো জানা যায়নি। তবে সঞ্জয় উত্তর দিকের পথে বেরিয়েছে তাকে খুঁজতে আর সোহম ও সঞ্জয়ের বন্ধুটি এসেছে মোটরসাইকেল টি নিতে। এতে খোঁজ সহজ হয়। মচকানো পা নিয়ে দামিনী আর কত দূরেই বা যাবে?
খোঁজাখুঁজির ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি বা কমতি নেই ,এখন শুধু মেয়েটা কোন পাগলামি না করলেই হয়। তবে সে তো হলো,কিন্তু এতো কিছু শুনে বাকিরা যখন খানিকটা স্বাভাবিক তখন নয়নতারার চোখমুখে ভয়ের চাপ কি কারণে? তার মনে মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে চক্রাকারে“ মেয়েটা কোন পাগলামি না করে বসে”