23-11-2024, 10:41 PM
সকাল থেকেই ব্যাস্ত শিউলি। অনেক রান্না বান্না। তার উপর দুই ভাই আর ভাইয়ের বউরাও এসেছে। রান্না শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো বিরতি পায় নি শিউলি। রান্না বান্না শেষ। মেহমানরাও আসতেছে। উঠানেই একটা ছোট শামিয়ানা করে টেবিল পাতা হয়েছে। খাবার বন্টন অন্য পুরুষরাই করবে। ইমাম সাহেব দোয়া শুরু করতেছেন। একটা রুমে শাওন কে পাশে বসিয়ে দোয়া করার জন্য বসলেন শিউলি। রত্না ভাবিও আছে। দোয়া শেষ, নিরবে সবটুকু সময় স্বামীর মুক্তি আর নিজের পাপের ক্ষমা চেয়ে অশ্রু ঝড়িয়েছেন শিউলি। চোখ মুছার সময় রত্না বললো,
শাওন, বাবা একটু বাইরে যাও। দেখো গিয়ে সবাই খাচ্ছে কিনা। ভাবি, চলুন আমাদের ঘরে…..
কেন?
খলিল চৌধুরী এসেছে, আপনার সাথে কথা বলতে চায়…..
ভাবি, উনার সাথে আর আমার কোনো কথা নেই, আমি শুধু আমার জীবনে সুমন কে ফেরত চাই……
ভাবি, আমি বুঝতেছি। কিন্তু ওই লোকটাও অনেক অনুশোচনায় ভুগতেছে। আর এই সব কিছুর জন্য যখন উনি দায়ী তখন উনি তো সবকিছু থেকে এভাবে দায় সরিয়ে নিতে পারেন না……
আপনাকে কি বলেছে খলিল……
রত্না খেয়াল করলো খলিল চৌধুরী কে নাম ধরে ডাকেন শিউলি। রত্না বললেন, তেমন কিছু না। উনি আপনার দায়িত্ব নিতে চায়……
চলুন দেখা করবো আমি……
বাড়ির পিছন দিয়ে বের হয়ে রত্না ভাবির বাড়িতে গেলেন দুজন। ঘরে ঢুকে শিউলি দেখলেন, খলিল চৌধুরী বসে আছেন। ঐ মানুষ টা বসে আছে যার কারণে তিনি স্বামী সন্তান সব হারিয়েছেন। রত্না তাদের কে একান্তে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন।
কেমন আছো শিউলি……
ভালো…….
আমাকে ক্ষমা করতে পারবা শিউলি?
হুম, মানুষের জীবনে অনেক ভুল থাকে। অনেক খারাপ সময় থাকে। আপনি ভাবতে পারেন আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা এখন যাচ্ছে। কিন্তু না, আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময়টা হলো যখন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা ওই সময়টা। ভুল আমারও আছে। কিন্তু দোষ আপনার। আমি আপনার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আবার এসে আমাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেন…….
শিউলি, আমি জানি, সব স্বীকার ও করছি। তুমি চাইলে এই চেহারা টা আমি আর তোমাকে দেখাবো না। কিন্তু দয়া করে তোমাকে কিছুটা সাহায্য করার সুযোগ দাও। আমি দূর থেকে হলেও যেন কিছু করতে পারি……
ভুলেও আর এই কথা ভাববেন না। আপনার দয়া দক্ষিনা আরো নিলে সুমনের বাবার আত্মাও কষ্ট পাবে। কোনো ভাবেই আর আমার আর সন্তানদের মাঝে আসবেন না…..
পাপের প্রায়শ্চিত্ত টুকুও করতে দিবে না…….
টাকা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলবেন! ঠিকই বলেছেন, এই টাকা ছিল না বলেই হয়তো এত কিছু ঘটে গেল…..
শিউলি, আমাদের সম্পর্ক টা কিন্তু টাকার ছিল না। তুমি এটা অস্বীকার করতে পারবে না…….
কিছুই অস্বীকার করছি না খলিল। এত কিছু ঘটার পরও তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাতেই বুঝে নিও সব। যা হারিয়েছি এর বেশি আর কিছু হারালে আমি মরেই যাব…….
খলিল চৌধুরীর ভালো লাগলো, তাকে তুমি করে বলছে শিউলি। শিউলি কাঁদতেছে। তাকে কিভাবে শান্তনা দিতে পারেন তিনি। ভয় নিয়েই শিউলির দিকে এগিয়ে গেলেন খলিল চৌধুরী। সাথে সাথে পিছিয়ে গিয়ে শিউলি বললেন, আমি গেলাম, সব ভুলে যান। আমাদের কাছাকাছি আর কখনো আসবেন না প্লিজ……..
আকাশের কাছে সুমনের খোঁজ পেয়েছেন শিউলি। কিন্তু আকাশের সাথেই নাকি কথা বলে না সুমন। শিউলি আশায় আছেন সুমনের রাগ একদিন ভাঙবে। শিউলি নিজেই ধীরে ধীরে সংসার গোছানোর কাজ শুরু করলেন। সংসার তো তিনিই সারাজীবন গুছিয়ে এসেছেন, টাকা টা দিতেন মজুমদার সাহেব। এই ক্ষেত্রে শিউলি বুঝতে পারলেন টাকা টাই সব। সকাল বেলা ক্ষেতে সার দেয়ার জন্য লোক এসেছিলো সেই টাকাটাও দিতে পারেন নি তিনি। রত্না ভাবির আসার কথা এখনো আসছে না কেন। অবশেষে রত্না ভাবি আসলো। এসেই বললো তাড়াতাড়ি চলেন, পরে আবার মেম্বার সাহেব থাকবেন না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় শিউলি ভাবছেন কখনো কি তিনি ভেবেছিলেন, বিধভা ভাতার কার্ড বানানোর জন্য তাকে ধর্না দিতে হবে!
রত্না ভাবি ভিতরে গেলেন না, শুধু শিউলি ঢুকলেন। ওয়ার্ড মেম্বার শিউলিকে টেবিলের পাশের চেয়ারে বসতে বললেন। শিউলি সামনের চেয়ারে বসার পর মেম্বার সাহেব বললেন, কাগজে সই করতে হবে এই চেয়ারে বসুন। শিউলি উঠে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসার একটি পরই মেম্বার সাহেবের হাটুর সাথে তার হাটু লাগলো। মেম্বার এমন ভাব করলেন যেন ভুলে লেগে গিয়েছে। শিউলি সই করার পর কলম ফেরত দেয়ার সময় শিউলির হাতটা ধরে ফেললেন মেম্বার। ধরেই বললেন, এই ভাতা দিয়ে কি আর জীবন চলবে? কিছু লাগলে আমি তো আছিই। আমাকে বইলেন……
শিউলি রাগে গজগজ করতে করতে ইউনিয়ন পরিষদের থেকে বের হয়ে গেলেন। রত্না বললো, ভাবি কি বলছে? কার্ড কবে দিবে?
লাগবে না এই কার্ড আমার……
কি হলো ভাবি…….
কিছু না……
অসভ্যতা করেছে উনি?
শিউলি কিছু না বলে হাঁটতে থাকলেন। বাড়ি যাওয়ার পর রত্না বললো ভাবি, বিধবাদের সাথে এমন আচরণ এই সমাজে হরহামেশাই হয়। মধু থাকলে কিন্তু ভাবি মৌমাছি ভনভন করবেই। আরো কিছুদিন গেলে আরো নোংরা প্রস্তাব ও আপনি পাবেন। দেখবেন চারিদিকে কত শকুন……
কি করবো ভাবি আমি……
ভাবি, আপনার কিন্তু এভাবে থাকা ঠিক হচ্ছে না। আপনি কিভাবে কি করবেন বলেন তো……
তাহলে আমার কি করার আছে বলেন তো…..
খলিল চৌধুরীর সাহায্য আপনি কেন নিচ্ছেন না……
এই সাহায্য আমার লাগবে না ভাবি। ৪০ দিন হয়ে গেল সুমন আমার সাথে কথা বলে না। বাড়িও আসে না। শাওন এর ও মন খারাপ থাকে। এরপর এমন কিছু জানলে সুমন কখনো মাফ করবে না আমায়…….
সাহায্য না নিলেন, কিন্তু অধিকার তো নিতে পারেন……
মানে?
আপনি অনেক দিন ধরে খলিল চৌধুরীর সাথে একটা সম্পর্কে ছিলেন। সেই অবৈধ সম্পর্ক টা কে বৈধ করে নিন। এটাতে সবার জন্যই ভালো…..
ছি ছি ভাবি, এসব কি বলছেন! আপনাকে আমাকে এসব বলার জন্য খলিল বলেছে তাই না?
ভাবি, এমন কিছুই না। হ্যাঁ, খলিল চৌধুরী আমাকে বলেছে আপনাকে বিয়ে করতে চায় উনি। আর এটা উনার কর্তব্যের মধ্যেই পরে। ভাবি, বিধবা হিসেবে থাকলে কত অপমান, সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এটা বুঝতেছেন ও না। জানেন তো, আমার স্বামী ঘটকালি করে, শখের ঘটকালি। ও বলছে অনেক জন আপনাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চেয়েছে……
দেখেন ভাবি, এইসব আমাকে আর বইলেন না। আমি স্বামীর ভিটায় মরতে চাই। আর কিছুই না……
খলিল চৌধুরীর ভিটাও কিন্তু আপনার জন্য স্বামীর ভিটাই হবে…….
এবার রেগে গেলেন শিউলি। কি আজে বাজে বকছেন ভাবি, এমন ভাবে বলছেন যেন আর কেউ স্বামী ছাড়া থাকছে না। নিজের রাস্তা আমি নিজেই মাপতে পারব। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গেলেন শিউলি।
শাওন এসে ডাকলো, আম্মু…..
হুম বাবা, আয়……
আম্মু, ভাইয়া আসবে না আর। কল ও করে না আমাকে…..
আসবে বাবা, একদিন ঠিকই আসবে…..
আম্মু তুমি এত কাঁদো কেন? আমাকেও আগের মত আদর করো না…..
বুকটা ফেটে যায় শিউলির। আসলেই শাওনের প্রতি যত্ন কমে গিয়েছে। শাওনের কপালে চুমু খেয়ে শিউলি বললেন, কে বলেছে বাবা আদর করি না। এখন কি খাবা? মুরগি রান্না করি….
হ্যাঁ, মুরগী খাবো…… আম্মু ফোনে এমবি নাই, গেম খেলতে পারি না…..
আচ্ছা আব্বু, আমি এমবি কিনে দিবো। চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দিকে গেলেন শিউলি।
দুপুরে শাওন কে খাওয়ানোর সময় থেকে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে শিউলির। প্লেট ধুতে গিয়ে মুখ ভরে বমিও করলেন। মাথাটাও কেমন ঘুরাচ্ছে। রুমে আসার সময় মাথা ঘুরিয়ে পরেই গেলেন শিউলি। শাওন দৌড়ে গিয়ে রত্না ভাবি কে ডেকে আনলো।
ভাবি এখন কেমন লাগছে……
ভালো, কেন যে এমন হলো…..
বমিও করেছেন?
হ্যাঁ। বমিও হলো…….
ভাবি, আপনার মাসিক হয়েছে কবে শেষ?
কথা টা শুনেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল শিউলির। এত ঝামেলার মাঝে কিছুই মনে ছিল না। এখন মনে পরছে খলিল চৌধুরীর বাচ্চা নেয়ার জন্য উর্বর সময়ে অরক্ষিত মিলনের কথা। এটাই যদি হয় তাহলে কি করবেন তিনি। সমাজে মুখ দেখাবেন কিভাবে?
ভাবি, আপনি কি এটাই ধারণা করছেন?
জানি না ভাবি আমি কিছুই। আমার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ নাই……
ভাবি, কালকে চলেন ক্লিনিকে যাই। পরে যা হওয়ার হবে। একটা ব্যাবস্থা হবেই…….
দুইদিন পর মহিলা ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন শিউলি। সাথে রত্না আর শাওন। ডাক্তার এর মুখের কথা গুলো যেন একেকটা বাজ ফেলতেছে শিউলির মাথার উপর। হ্যাঁ, তিনি প্র্যাগ্নেন্ট। কিভাবে থাকতে হবে কি খেতে হবে একে একে বলে যাচ্ছেন ডাক্তার। কিছুই কানে ঢুকছে না শিউলির।
বাড়ি ফিরে রত্না ভাবি কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু শিউলি বললো, আমি এখন একটু শুয়ে থাকবো ভাবি। রত্না ভাবি চলে যেতেই শাওন কে কাছে টেনে বসালেন শিউলি। না, আর পাপ তিনি করতে পারবেন না। আরেকটা জীবন হত্যা করতে পারবেন না তিনি।
আব্বু, আমরা যদি এই বাড়ি থেকে চলে যাই তাহলে অনেক খারাপ লাগবে তোমার?
কোথায় যাবো আম্মু……
রাস্তাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন তিনি। অনেককে ঠকিয়েছেন তিনি। সামনে যে আসবে তাকে মিথ্যা বাবার পরিচয় দিয়ে আর ঠকাতে চান না তিনি। সুমন এতে অনেক রাগ করলেও কিছুই করার নেই তার। একদিন সুমন বুঝবে ঠিকই।
যদি আমরা তোমার খলিল আঙ্কেলের বাসায় থাকি……
কেন আম্মু…..
তোমার যে আব্বু চলে গিয়েছে তাই, আঙ্কেল কে আব্বু বলে ডাকবা……
তুমি কি খলিল আঙ্কেল কে বিয়ে করবা আম্মু……
শাওন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শিউলি বললেন, বাবা আমার আর কিছু করার নেই। তোকে আমি অনেক আদর করব, সব খেয়াল রাখবো। এবার যদি তোর প্রতি কোনো অবহেলা করি তাহলে তোর বাবার কসম। আমি নিজেকে শেষ করে দিব……
রত্না ভাবির কাছে গেলেন শিউলি। গিয়ে বললেন ভাবি, আমি কালকে শাওন কে সহ ওর মামার বাড়ি যাচ্ছি। খলিল কে বইলেন প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমার ভাইয়ের কাছে……
ভাবি, এমন মন খারাপ করে আছেন কেন? দেখবেন সব ভালো হবে……
ভাবি, আমার ভালো খারাপের আর কোনো মুল্য নেই। আমি জানি, সুমন এটা জানার পর আর হয়তো কখনো আমার সামনে আসবে না। জানেন ভাবি, এত কিছুর পরও আমার সব চিন্তা সুমন কে ঘিরেই। জীবনটা নষ্ট করে দিলাম আমার ছেলেটার। দোয়া করবেন, ও যাতে বড় হয়। অনেক বড়।
মামার বাড়ি গিয়ে মামাতো ভাই বোন কে পেয়ে শাওন অনেক দিন পর হাসি খুশি হলো। নিজের ভাই আর ভাবিকে সব বলার পর তারা বললো, উনি বিয়েত প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন তুই রাজি হয়ে যা। জীবনে তো উত্থান পতন আসবেই, জীবন তো থেমে থাকবে না।
রাতে শাওন কে নিয়ে শুয়ে পরলেন শিউলি। বাড়তি এই একটাই রুম। রত্না ভাবির কল আসলো।
হ্যালো ভাবি, পরশু আসব আমরা?
কে কে আসবেন?
আমি, আপনার ভাই আর খলিল চৌধুরী। আর কেউ না….
খলিলের সাথে কথা হয়েছে?
হ্যাঁ উনি তো খুশিতে আটখানা। আপনি কিছু না বলেই চলে গেলেন। উনি আপনার নাম্বার চাচ্ছে দিব?
না ভাবি, দিয়েন না। আর কোনো পাপ করতে চাই না আমি…….
সকাল সকাল রান্নার তোরজোর পরে গেল। বড় ঘর থেকে সমন্ধ বলে কথা। শাওনের মামাতো ভাই বোনেরা নিজেদের ফুফুর বিয়ের কথা শুনে তাদের ভিতরেও একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। শিউলির ভাবি এসে বললো,
শিউলি রেডি হয়ে নাও, এসে পরবে তো…..
না ভাবি, এভাবেই ঠিক আছি…….
আরে মেয়ে, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছো তখন এমন গোমড়ামুখে থাকলে হবে। আমার আরেকটা বিয়ের সুযোগ হলে তো নায়িকা সেজে বসে থাকতাম…..
ঠিকই আছে ফুফু, চলো তোমায় সাজিয়ে দেই…….
শাওন পাশে বসে আছে। ওর মামাতো বোন ওর মাকে সাজাচ্ছে। শিউলির ভালো লাগছে না। যেই খলিল চৌধুরীর মুখ দেখার জন্য পাগল ছিলেন তিনি তার সাথে বিবাহ হতে যাচ্ছে তবুও মনে কোনো সুখ নেই। যা আছে সেটা হচ্ছে হতাশা।
ওরা আসার পর থেকে শিউলি অনুভব করলেন আগের অস্থিরতা টা এখন হচ্ছে না। কেমন যেন উত্তেজিত লাগছে ভিতরে ভিতরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ টা সোজা করে নিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে নিলেন। তারপরই মনে হলো, খলিল চৌধুরীর সামনে সুন্দর হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন তিনি!?
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন, যেন অষ্টাদশী তরুনী তিনি। রত্না ভাবির স্বামী শিউলির ভাইকে বলতেছে,দেখেন ভাই, জীবন মৃত্যু বিয়ে, এসবে তো কারো হাত নাই। মজুমদার সাহেব আমাদের সবার কাছে অনেক সম্মানিত লোক ছিলেন। তিনি হটাৎ এভাবে চলে যাবেন কেউ ভাবেও নি। আপনার বোন কে আমরা সবসময় গুনবতী, সংসারী জেনে এসেছি। খলিল ভাইও আমাদের এলাকায় গন্য মান্য লোকদের একজন। উনারও একজন সাথী দরকার। এখন জুড়ি যদি মিলে থাকে তাহলে তো মনে হয় সবার জন্য ভালোই হবে…..
হ্যাঁ ভাই, আমার বোন এমন একটা অবস্থায় পরে যাবে কখনো ভাবি নি। এখন উনারা দুইজন রাজি থাকলে আমরাও একটু স্বস্তি পাবো……..
আচ্ছা, তাহলে পাত্রীকে ডাকুন……
শিউলির পা কাঁপছে। কিছুদিন আগে তার স্বামী মারা গিয়েছে, বড় ছেলে উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে কিছুই মাথায় নেই এখন। খলিল চৌধুরীর সামনে এই সাজে কখনো যাবেন এটা তার চিন্তায়ও আসে নি। চায়ের ট্রে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। খলিল চৌধুরী শিউলি কে দেখেই একটা ঝটকা খেলেন। তার স্বপ্নের নারী তার স্ত্রী হতে যাচ্ছে। এটা কি বাস্তব নাকি মরিচিকা!
কিছুক্ষণ বসার পর রত্নার স্বামী বললো উনারা দুইজন একটু আলাদা কথা বলুক। শিউলির ভাই বললেন ওই রুমে চলে যান আপনারা। খলিল চৌধুরীর পিছনে পিছনে শিউলি পাশের রুমে ঢুকলো।
শিউলীর আপন ভাবি শিউলির ভাইকে ইশারায় ডাকলো। ভাই উঠে গেলে শিউলির ভাবি বললো, আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দাও। আজকে কত খরচ গেল। এখন যদি বিয়ের আরেক ডেট দাও তাহলে বর পক্ষের লোক আসবে, আমাদের আত্মীয় স্বজনও দাওয়াত দেয়া লাগবে। সব তো আমাদের খরচ হবে। এর থেকে বলো আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দিক।
কি বলো, আজকে বিয়ে হলে কখন ফিরবে বলো তো…..
ফিরতে হবে কেন? আজকে থেকে যাবে এখানে সমস্যা কি……
আচ্ছা বলে দেখি……
শাওন, বাবা একটু বাইরে যাও। দেখো গিয়ে সবাই খাচ্ছে কিনা। ভাবি, চলুন আমাদের ঘরে…..
কেন?
খলিল চৌধুরী এসেছে, আপনার সাথে কথা বলতে চায়…..
ভাবি, উনার সাথে আর আমার কোনো কথা নেই, আমি শুধু আমার জীবনে সুমন কে ফেরত চাই……
ভাবি, আমি বুঝতেছি। কিন্তু ওই লোকটাও অনেক অনুশোচনায় ভুগতেছে। আর এই সব কিছুর জন্য যখন উনি দায়ী তখন উনি তো সবকিছু থেকে এভাবে দায় সরিয়ে নিতে পারেন না……
আপনাকে কি বলেছে খলিল……
রত্না খেয়াল করলো খলিল চৌধুরী কে নাম ধরে ডাকেন শিউলি। রত্না বললেন, তেমন কিছু না। উনি আপনার দায়িত্ব নিতে চায়……
চলুন দেখা করবো আমি……
বাড়ির পিছন দিয়ে বের হয়ে রত্না ভাবির বাড়িতে গেলেন দুজন। ঘরে ঢুকে শিউলি দেখলেন, খলিল চৌধুরী বসে আছেন। ঐ মানুষ টা বসে আছে যার কারণে তিনি স্বামী সন্তান সব হারিয়েছেন। রত্না তাদের কে একান্তে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন।
কেমন আছো শিউলি……
ভালো…….
আমাকে ক্ষমা করতে পারবা শিউলি?
হুম, মানুষের জীবনে অনেক ভুল থাকে। অনেক খারাপ সময় থাকে। আপনি ভাবতে পারেন আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা এখন যাচ্ছে। কিন্তু না, আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময়টা হলো যখন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা ওই সময়টা। ভুল আমারও আছে। কিন্তু দোষ আপনার। আমি আপনার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আবার এসে আমাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেন…….
শিউলি, আমি জানি, সব স্বীকার ও করছি। তুমি চাইলে এই চেহারা টা আমি আর তোমাকে দেখাবো না। কিন্তু দয়া করে তোমাকে কিছুটা সাহায্য করার সুযোগ দাও। আমি দূর থেকে হলেও যেন কিছু করতে পারি……
ভুলেও আর এই কথা ভাববেন না। আপনার দয়া দক্ষিনা আরো নিলে সুমনের বাবার আত্মাও কষ্ট পাবে। কোনো ভাবেই আর আমার আর সন্তানদের মাঝে আসবেন না…..
পাপের প্রায়শ্চিত্ত টুকুও করতে দিবে না…….
টাকা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলবেন! ঠিকই বলেছেন, এই টাকা ছিল না বলেই হয়তো এত কিছু ঘটে গেল…..
শিউলি, আমাদের সম্পর্ক টা কিন্তু টাকার ছিল না। তুমি এটা অস্বীকার করতে পারবে না…….
কিছুই অস্বীকার করছি না খলিল। এত কিছু ঘটার পরও তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাতেই বুঝে নিও সব। যা হারিয়েছি এর বেশি আর কিছু হারালে আমি মরেই যাব…….
খলিল চৌধুরীর ভালো লাগলো, তাকে তুমি করে বলছে শিউলি। শিউলি কাঁদতেছে। তাকে কিভাবে শান্তনা দিতে পারেন তিনি। ভয় নিয়েই শিউলির দিকে এগিয়ে গেলেন খলিল চৌধুরী। সাথে সাথে পিছিয়ে গিয়ে শিউলি বললেন, আমি গেলাম, সব ভুলে যান। আমাদের কাছাকাছি আর কখনো আসবেন না প্লিজ……..
আকাশের কাছে সুমনের খোঁজ পেয়েছেন শিউলি। কিন্তু আকাশের সাথেই নাকি কথা বলে না সুমন। শিউলি আশায় আছেন সুমনের রাগ একদিন ভাঙবে। শিউলি নিজেই ধীরে ধীরে সংসার গোছানোর কাজ শুরু করলেন। সংসার তো তিনিই সারাজীবন গুছিয়ে এসেছেন, টাকা টা দিতেন মজুমদার সাহেব। এই ক্ষেত্রে শিউলি বুঝতে পারলেন টাকা টাই সব। সকাল বেলা ক্ষেতে সার দেয়ার জন্য লোক এসেছিলো সেই টাকাটাও দিতে পারেন নি তিনি। রত্না ভাবির আসার কথা এখনো আসছে না কেন। অবশেষে রত্না ভাবি আসলো। এসেই বললো তাড়াতাড়ি চলেন, পরে আবার মেম্বার সাহেব থাকবেন না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় শিউলি ভাবছেন কখনো কি তিনি ভেবেছিলেন, বিধভা ভাতার কার্ড বানানোর জন্য তাকে ধর্না দিতে হবে!
রত্না ভাবি ভিতরে গেলেন না, শুধু শিউলি ঢুকলেন। ওয়ার্ড মেম্বার শিউলিকে টেবিলের পাশের চেয়ারে বসতে বললেন। শিউলি সামনের চেয়ারে বসার পর মেম্বার সাহেব বললেন, কাগজে সই করতে হবে এই চেয়ারে বসুন। শিউলি উঠে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসার একটি পরই মেম্বার সাহেবের হাটুর সাথে তার হাটু লাগলো। মেম্বার এমন ভাব করলেন যেন ভুলে লেগে গিয়েছে। শিউলি সই করার পর কলম ফেরত দেয়ার সময় শিউলির হাতটা ধরে ফেললেন মেম্বার। ধরেই বললেন, এই ভাতা দিয়ে কি আর জীবন চলবে? কিছু লাগলে আমি তো আছিই। আমাকে বইলেন……
শিউলি রাগে গজগজ করতে করতে ইউনিয়ন পরিষদের থেকে বের হয়ে গেলেন। রত্না বললো, ভাবি কি বলছে? কার্ড কবে দিবে?
লাগবে না এই কার্ড আমার……
কি হলো ভাবি…….
কিছু না……
অসভ্যতা করেছে উনি?
শিউলি কিছু না বলে হাঁটতে থাকলেন। বাড়ি যাওয়ার পর রত্না বললো ভাবি, বিধবাদের সাথে এমন আচরণ এই সমাজে হরহামেশাই হয়। মধু থাকলে কিন্তু ভাবি মৌমাছি ভনভন করবেই। আরো কিছুদিন গেলে আরো নোংরা প্রস্তাব ও আপনি পাবেন। দেখবেন চারিদিকে কত শকুন……
কি করবো ভাবি আমি……
ভাবি, আপনার কিন্তু এভাবে থাকা ঠিক হচ্ছে না। আপনি কিভাবে কি করবেন বলেন তো……
তাহলে আমার কি করার আছে বলেন তো…..
খলিল চৌধুরীর সাহায্য আপনি কেন নিচ্ছেন না……
এই সাহায্য আমার লাগবে না ভাবি। ৪০ দিন হয়ে গেল সুমন আমার সাথে কথা বলে না। বাড়িও আসে না। শাওন এর ও মন খারাপ থাকে। এরপর এমন কিছু জানলে সুমন কখনো মাফ করবে না আমায়…….
সাহায্য না নিলেন, কিন্তু অধিকার তো নিতে পারেন……
মানে?
আপনি অনেক দিন ধরে খলিল চৌধুরীর সাথে একটা সম্পর্কে ছিলেন। সেই অবৈধ সম্পর্ক টা কে বৈধ করে নিন। এটাতে সবার জন্যই ভালো…..
ছি ছি ভাবি, এসব কি বলছেন! আপনাকে আমাকে এসব বলার জন্য খলিল বলেছে তাই না?
ভাবি, এমন কিছুই না। হ্যাঁ, খলিল চৌধুরী আমাকে বলেছে আপনাকে বিয়ে করতে চায় উনি। আর এটা উনার কর্তব্যের মধ্যেই পরে। ভাবি, বিধবা হিসেবে থাকলে কত অপমান, সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এটা বুঝতেছেন ও না। জানেন তো, আমার স্বামী ঘটকালি করে, শখের ঘটকালি। ও বলছে অনেক জন আপনাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চেয়েছে……
দেখেন ভাবি, এইসব আমাকে আর বইলেন না। আমি স্বামীর ভিটায় মরতে চাই। আর কিছুই না……
খলিল চৌধুরীর ভিটাও কিন্তু আপনার জন্য স্বামীর ভিটাই হবে…….
এবার রেগে গেলেন শিউলি। কি আজে বাজে বকছেন ভাবি, এমন ভাবে বলছেন যেন আর কেউ স্বামী ছাড়া থাকছে না। নিজের রাস্তা আমি নিজেই মাপতে পারব। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গেলেন শিউলি।
শাওন এসে ডাকলো, আম্মু…..
হুম বাবা, আয়……
আম্মু, ভাইয়া আসবে না আর। কল ও করে না আমাকে…..
আসবে বাবা, একদিন ঠিকই আসবে…..
আম্মু তুমি এত কাঁদো কেন? আমাকেও আগের মত আদর করো না…..
বুকটা ফেটে যায় শিউলির। আসলেই শাওনের প্রতি যত্ন কমে গিয়েছে। শাওনের কপালে চুমু খেয়ে শিউলি বললেন, কে বলেছে বাবা আদর করি না। এখন কি খাবা? মুরগি রান্না করি….
হ্যাঁ, মুরগী খাবো…… আম্মু ফোনে এমবি নাই, গেম খেলতে পারি না…..
আচ্ছা আব্বু, আমি এমবি কিনে দিবো। চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দিকে গেলেন শিউলি।
দুপুরে শাওন কে খাওয়ানোর সময় থেকে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে শিউলির। প্লেট ধুতে গিয়ে মুখ ভরে বমিও করলেন। মাথাটাও কেমন ঘুরাচ্ছে। রুমে আসার সময় মাথা ঘুরিয়ে পরেই গেলেন শিউলি। শাওন দৌড়ে গিয়ে রত্না ভাবি কে ডেকে আনলো।
ভাবি এখন কেমন লাগছে……
ভালো, কেন যে এমন হলো…..
বমিও করেছেন?
হ্যাঁ। বমিও হলো…….
ভাবি, আপনার মাসিক হয়েছে কবে শেষ?
কথা টা শুনেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল শিউলির। এত ঝামেলার মাঝে কিছুই মনে ছিল না। এখন মনে পরছে খলিল চৌধুরীর বাচ্চা নেয়ার জন্য উর্বর সময়ে অরক্ষিত মিলনের কথা। এটাই যদি হয় তাহলে কি করবেন তিনি। সমাজে মুখ দেখাবেন কিভাবে?
ভাবি, আপনি কি এটাই ধারণা করছেন?
জানি না ভাবি আমি কিছুই। আমার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ নাই……
ভাবি, কালকে চলেন ক্লিনিকে যাই। পরে যা হওয়ার হবে। একটা ব্যাবস্থা হবেই…….
দুইদিন পর মহিলা ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন শিউলি। সাথে রত্না আর শাওন। ডাক্তার এর মুখের কথা গুলো যেন একেকটা বাজ ফেলতেছে শিউলির মাথার উপর। হ্যাঁ, তিনি প্র্যাগ্নেন্ট। কিভাবে থাকতে হবে কি খেতে হবে একে একে বলে যাচ্ছেন ডাক্তার। কিছুই কানে ঢুকছে না শিউলির।
বাড়ি ফিরে রত্না ভাবি কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু শিউলি বললো, আমি এখন একটু শুয়ে থাকবো ভাবি। রত্না ভাবি চলে যেতেই শাওন কে কাছে টেনে বসালেন শিউলি। না, আর পাপ তিনি করতে পারবেন না। আরেকটা জীবন হত্যা করতে পারবেন না তিনি।
আব্বু, আমরা যদি এই বাড়ি থেকে চলে যাই তাহলে অনেক খারাপ লাগবে তোমার?
কোথায় যাবো আম্মু……
রাস্তাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন তিনি। অনেককে ঠকিয়েছেন তিনি। সামনে যে আসবে তাকে মিথ্যা বাবার পরিচয় দিয়ে আর ঠকাতে চান না তিনি। সুমন এতে অনেক রাগ করলেও কিছুই করার নেই তার। একদিন সুমন বুঝবে ঠিকই।
যদি আমরা তোমার খলিল আঙ্কেলের বাসায় থাকি……
কেন আম্মু…..
তোমার যে আব্বু চলে গিয়েছে তাই, আঙ্কেল কে আব্বু বলে ডাকবা……
তুমি কি খলিল আঙ্কেল কে বিয়ে করবা আম্মু……
শাওন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শিউলি বললেন, বাবা আমার আর কিছু করার নেই। তোকে আমি অনেক আদর করব, সব খেয়াল রাখবো। এবার যদি তোর প্রতি কোনো অবহেলা করি তাহলে তোর বাবার কসম। আমি নিজেকে শেষ করে দিব……
রত্না ভাবির কাছে গেলেন শিউলি। গিয়ে বললেন ভাবি, আমি কালকে শাওন কে সহ ওর মামার বাড়ি যাচ্ছি। খলিল কে বইলেন প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমার ভাইয়ের কাছে……
ভাবি, এমন মন খারাপ করে আছেন কেন? দেখবেন সব ভালো হবে……
ভাবি, আমার ভালো খারাপের আর কোনো মুল্য নেই। আমি জানি, সুমন এটা জানার পর আর হয়তো কখনো আমার সামনে আসবে না। জানেন ভাবি, এত কিছুর পরও আমার সব চিন্তা সুমন কে ঘিরেই। জীবনটা নষ্ট করে দিলাম আমার ছেলেটার। দোয়া করবেন, ও যাতে বড় হয়। অনেক বড়।
মামার বাড়ি গিয়ে মামাতো ভাই বোন কে পেয়ে শাওন অনেক দিন পর হাসি খুশি হলো। নিজের ভাই আর ভাবিকে সব বলার পর তারা বললো, উনি বিয়েত প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন তুই রাজি হয়ে যা। জীবনে তো উত্থান পতন আসবেই, জীবন তো থেমে থাকবে না।
রাতে শাওন কে নিয়ে শুয়ে পরলেন শিউলি। বাড়তি এই একটাই রুম। রত্না ভাবির কল আসলো।
হ্যালো ভাবি, পরশু আসব আমরা?
কে কে আসবেন?
আমি, আপনার ভাই আর খলিল চৌধুরী। আর কেউ না….
খলিলের সাথে কথা হয়েছে?
হ্যাঁ উনি তো খুশিতে আটখানা। আপনি কিছু না বলেই চলে গেলেন। উনি আপনার নাম্বার চাচ্ছে দিব?
না ভাবি, দিয়েন না। আর কোনো পাপ করতে চাই না আমি…….
সকাল সকাল রান্নার তোরজোর পরে গেল। বড় ঘর থেকে সমন্ধ বলে কথা। শাওনের মামাতো ভাই বোনেরা নিজেদের ফুফুর বিয়ের কথা শুনে তাদের ভিতরেও একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। শিউলির ভাবি এসে বললো,
শিউলি রেডি হয়ে নাও, এসে পরবে তো…..
না ভাবি, এভাবেই ঠিক আছি…….
আরে মেয়ে, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছো তখন এমন গোমড়ামুখে থাকলে হবে। আমার আরেকটা বিয়ের সুযোগ হলে তো নায়িকা সেজে বসে থাকতাম…..
ঠিকই আছে ফুফু, চলো তোমায় সাজিয়ে দেই…….
শাওন পাশে বসে আছে। ওর মামাতো বোন ওর মাকে সাজাচ্ছে। শিউলির ভালো লাগছে না। যেই খলিল চৌধুরীর মুখ দেখার জন্য পাগল ছিলেন তিনি তার সাথে বিবাহ হতে যাচ্ছে তবুও মনে কোনো সুখ নেই। যা আছে সেটা হচ্ছে হতাশা।
ওরা আসার পর থেকে শিউলি অনুভব করলেন আগের অস্থিরতা টা এখন হচ্ছে না। কেমন যেন উত্তেজিত লাগছে ভিতরে ভিতরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ টা সোজা করে নিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে নিলেন। তারপরই মনে হলো, খলিল চৌধুরীর সামনে সুন্দর হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন তিনি!?
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন, যেন অষ্টাদশী তরুনী তিনি। রত্না ভাবির স্বামী শিউলির ভাইকে বলতেছে,দেখেন ভাই, জীবন মৃত্যু বিয়ে, এসবে তো কারো হাত নাই। মজুমদার সাহেব আমাদের সবার কাছে অনেক সম্মানিত লোক ছিলেন। তিনি হটাৎ এভাবে চলে যাবেন কেউ ভাবেও নি। আপনার বোন কে আমরা সবসময় গুনবতী, সংসারী জেনে এসেছি। খলিল ভাইও আমাদের এলাকায় গন্য মান্য লোকদের একজন। উনারও একজন সাথী দরকার। এখন জুড়ি যদি মিলে থাকে তাহলে তো মনে হয় সবার জন্য ভালোই হবে…..
হ্যাঁ ভাই, আমার বোন এমন একটা অবস্থায় পরে যাবে কখনো ভাবি নি। এখন উনারা দুইজন রাজি থাকলে আমরাও একটু স্বস্তি পাবো……..
আচ্ছা, তাহলে পাত্রীকে ডাকুন……
শিউলির পা কাঁপছে। কিছুদিন আগে তার স্বামী মারা গিয়েছে, বড় ছেলে উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে কিছুই মাথায় নেই এখন। খলিল চৌধুরীর সামনে এই সাজে কখনো যাবেন এটা তার চিন্তায়ও আসে নি। চায়ের ট্রে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। খলিল চৌধুরী শিউলি কে দেখেই একটা ঝটকা খেলেন। তার স্বপ্নের নারী তার স্ত্রী হতে যাচ্ছে। এটা কি বাস্তব নাকি মরিচিকা!
কিছুক্ষণ বসার পর রত্নার স্বামী বললো উনারা দুইজন একটু আলাদা কথা বলুক। শিউলির ভাই বললেন ওই রুমে চলে যান আপনারা। খলিল চৌধুরীর পিছনে পিছনে শিউলি পাশের রুমে ঢুকলো।
শিউলীর আপন ভাবি শিউলির ভাইকে ইশারায় ডাকলো। ভাই উঠে গেলে শিউলির ভাবি বললো, আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দাও। আজকে কত খরচ গেল। এখন যদি বিয়ের আরেক ডেট দাও তাহলে বর পক্ষের লোক আসবে, আমাদের আত্মীয় স্বজনও দাওয়াত দেয়া লাগবে। সব তো আমাদের খরচ হবে। এর থেকে বলো আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দিক।
কি বলো, আজকে বিয়ে হলে কখন ফিরবে বলো তো…..
ফিরতে হবে কেন? আজকে থেকে যাবে এখানে সমস্যা কি……
আচ্ছা বলে দেখি……