20-11-2024, 05:22 AM
(This post was last modified: 21-11-2024, 06:09 AM by বহুরূপী. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
পর্ব ৩৩
তালদীঘির মন্দির থেকে বাড়ি ফিরেতেই আজ বাড়ির পরিবেশ হলো একটু ভিন্ন। বিগত কিছুদিন যাবত নয়নতারার হাতের কাজ সৌদামিনী দ্বিধাহীন ভাবে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তবে আজ কিন্তু তা হলো না। নয়নতারা আজ হেম ও মঙ্গলাকে কাজ বুঝিয়ে দিল। তারপর বাড়ির ছাদে গেল দামিনীকে সাথে নিয়ে । সৌদামিনী এত্তখনে নিজেকে সামাল দিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কি হয়! মন্দিরে সন্ন্যাসী বাবার সমুখে তার ওমন ভাবে ভেঙে পরা ত সকলেই দেখেছে। ইসস্... কি লজ্জা! কি লজ্জা! সে কথা ভাবতেই দামিনীর সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে উঠছে এখন। কেন যে ওমনটা হলো সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সন্ন্যাসীকে দেখতে গিয়ে এ কেমন কান্ড! তবে দামিনীর মনে পরে এক মুহূর্তের জন্যে সন্ন্যাসীর গলাটা যেন তার বাবার গলার মতোই ঠেকলো। আর পরক্ষণেই কি য হলো সে নিজেও জানে না।
যাহোক, দামিনী মুখে হাসি এনে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু নয়নতারা যখন গাঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
– মাথা খা বোন, আর লুকিয়ে রাখিস নে! সত্য করে বল তো তুই কেন এসেছিস এই পাঁড়াগায়ে?
সৌদামিনী তখন আর নিজের সামলাতে পারলো কই। হৃদয়ের গহীন কোন স্থান থেকে বোবা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। শব্দ হলো না বটে,তবে পর মুহূর্তে দামিনী নয়নকে জড়িয়ে দুচোখ জলে ভাসিয়ে দিল তার গাল দুখানি।
সৌদামিনী যে কাঁদতে পারে এই কথা নয়নতারা আগেই বুঝেছে । সে সৌদামিনীর মাথা থেকে পিঠ অবধি হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করবার খানিক চেষ্টা চালালো। তবে অবশেষে বুঝলো মেয়েটাকে কাঁদতে দেওয়াই ভালো। সব সময় বুকের ভেতরে কান্না জড়িত ব্যাথা লুকিয়ে রাখা মোটেও লাভজনক কিছু নয়। এক সময় দামিনী নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলো তার অতীত জীবনের খানিকটা অংশ।
ঘটনা এক দুদিন আগের নয়, সঞ্জয়ের কাঁচা বয়সের প্রথম প্রেম। কলিকাতায় দামিনী সঙ্গে সঞ্জয়ের বিবাহে বয়সের একটা ছোটখাটো বাঁধা ছিল। তবে সে বাঁধা লোকের কাছে মাত্র, সঞ্জয়ের কাছে কিন্তু নয়। কিন্তু এর বাইরেও যে আর একটি বড় বাঁধা ছিল, তার খবর সঞ্জয় বা দামিনী কেউই রাখে নাই। দিনের শেষে সে বাঁধাই কাল হয়ে দাড়ালো দামিনী ও সঞ্জয়ের মিলনে।
সঞ্জয়ের কলিকাতার বন্ধু পিতাটি উকিল। সেই দামিনীর দেখভালের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। একথা অনেক আগেই বলা হয়েছে তাই আর কথা না বাড়াই। যেহেতু সৌদামিনীর দেখভাল তিনিই করতেন, সুতরাং বিবাহের ব্যাপারে তার মতামত অতি আবশ্যক। কারণ একমাত্র তিনিই সৌদামিনীর প্রকৃত অভিভাবক। এর বাইরে দামিনীর বিশাল প্রাসাদে অভিভাবকদের কমতি ছিল না। তবে কি না তাদের কোন বিশেষ ঠিক-ঠিকানা ছিল না।
তবে থাক সে কথা। এদিকে দামিনীর বিবাহ যখন মুখে মুখে প্রায় ঠিকঠাক, তখন উকিল বাবু কলিকাতার বাইরে। তবে সঞ্জয় যেদিন ফিরলো তালদীঘিতে, সেদিন উকিল বাবু দামিনীর বাড়ি হয়ে ফিরলেন তার বাড়িতে। নিজের ও সৌদামিনীর বাড়িতে বিবাহের খবর তার কানে পৌঁছুল একটু ভিন্ন ভাবে। আগেই বলেছি দামিনীর বাড়িতে ঠিক-ঠিকানা হীন অভিভাবকদের অভাব ছিল না। উকিল বাবু সেদিন দামিনীর বাড়িতে পা রাখতে ঘটনাটি অন্যরূপ ভাবে তার কানে লাগলো।
সৌদামিনীর বাবার টাকাকড়ি উকিল বাবু মেরে দেবার ধান্দায় আছে। আর নয়তো অমন শিক্ষিত মেয়ের সাথে পাড়াগাঁয়ের মূর্খ চাষা চামার মার্কা ছেলের কেন অত মাখামাখি? সাধে কি আর সৌদামিনীর ওবাড়িতে অত ঘনঘন আনাগোনা। সরল মেয়েটাকে উকিলবাবু ও তার স্ত্রী মিলে কি মন্ত্র পড়িয়েছে কে জানে তার খবর!বাপ-মা মরা মেয়েটার অসহায়ত্বের সুযোগে তাকে জলে বাসিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তি বাগিয়ে নেবার ধান্দা উকিল বাবুর― একথা কি আর লোকে বোঝে না। তাও মানা যেত যদি তার নিজের ছেলের সাথে বিবাহ হতো। তখন না হয় আত্মীয় সজনের চোখে চোখে থাকতো মেয়েটা। বিপদে-আপদে দেখভাল করতো,, তাওতো নয়। আহা..! না জানি কতদূর দূরান্তে মেয়েটাকে নির্বাসন দেবেন তিনি। এই কাজ উকিল বাবুর পাকা মাথা ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব?
লোকের আলোচনা যখন এই রূপ, তখন উকিল বাবুর সম্মানে আঘাত লাগতে কতখন। শুধুমাত্র সৌদামিনীর দূর থেকে দূর সম্পর্কের আত্নীয় দের মুখেই নয়,উকিল বাবুর দূই একজন কলকাতার বন্ধুরাও খোচা দিয়ে বলতে লাগলো। সৌদামিনীর মতো মেয়েকে উকিল বাবু সত্যিই জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তার নিজের ছেলে থাকতে কেন শুধু শুধু একটা পাড়াগাঁয়ের; ইত্যাদি কথা চারদিকে থেকে ঘিরে ধরলো তাকে।
যাহোক ,আগেই বলেছি দামিনীর পিতা তাঁর বন্ধু ছিলেন এবং দামিনী বিশেষ কোন আত্নীয় না থাকার দরুণ তিনিই দামিনীর সব দেখভালের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে এমন অপবাদ তিনি নিজের কাঁধে নিতে রাজি ছিলেন না। তাছাড়া তিনি দামিনীকে কখনো নিজের মেয়ের থেকে আলাদা করে দেখেনি। তাই তো তাঁর বাড়িতে দামিনীর অবাধে আনাগোনা সব সময়। সেখানে তার ছেলের সাথে দামিনীর বিবাহের খোচাটায় তার বুকে ভালো ভাবেই বিধলো। কারণ তার ছেলের সাথে দামিনী যে আপন ভাই বোনের মতো সম্পর্ক, সেটি তার অজানা ছিল না। সুতরাং চারপাশে চাপে এক শান্ত সকালে দামিনীর প্রাসাদের বাগানে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
– দেখো মা দামিনী! আমি ভেবে দেখলাম। আমার বয়স হয়েছে, এ যাত্রায় তোমার পিতার যা কিছু আছে তোমার বুঝে নেওয়া উচিৎ।
এই কথা শুনে দামিনী অবাক হয়নি এমনটা বলা যায় না। তবে এমন কথার উঠলো কেন তার কারণ শুনে বেচারীর চোখে অশ্রু বাধ ভেঙ্গে অঝরে কান্না নেমে এল দুই গাল বেয়ে। তবে মুখ ফুটে প্রতিবাদ জানাবার সাহস সে আকাশ পাতাল হাতরেও পেল না। কারণ পিতার মৃত্যুর পর পিতার এই বন্ধুটিকে সে পিতা রূপেই গ্রহণ করেছিল । এখন একথা উঠতে পারে যে― তবে তার এতো অনুরোধের পরে সৌদামিনী বিবাহ কেন করলো না, কিংবা এত পাত্র ছেড়ে সঞ্জয়কেই তার মনে কেন ধরলো। এই প্রশ্ন যাদের মনে উদয় হয়েছে তাদের জন্যে বলে রাখি, এই আলোচনাও অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। তবুও সংক্ষিপ্ত রূপে এটুকুই বলবো যে― লক্ষ্মীচ্ছাড়া মনের অনুভূতি গুলো কখন যে কি করে বসে, তার কি কোন ঠিক আছে?
যাহোক দামিনীর নিজের বলতে পিতার এই উকিল বন্ধুটির পরিবার ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিল না। সুতরাং যৌবনের আবেগে অল্প তর্ক করতে গিয়ে এই পরিবারটিকে হারানো প্রবৃত্তি বা সাহস কোনটাই তাঁর হয়ে উঠলো না। বলা বাহুল্য এমন আকর্ষিক আঘাতে দামিনী মনটা ফাটা ফুটবলের মতো চুপসে গেল। তাই নিজে অবাধ্য মনকে সামাল দিতে সঞ্জয় কলিকাতা ছাড়বার মাসখানেক মধ্যে নিজেকে সবলে বিলেতে নির্বাসন করলো সে।
এদিকে যথাযথ সময়ে সঞ্জয় যখন কলকাতা ফিরলো, তখন সে জেনেছিল― দামিনীর এই বিবাহে মত নাই। কেন বা কি কারণে হঠাৎ এই মত পরিবর্তন এই প্রশ্নে কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর সে কারো কাছেই পেল না। সুতরাং একথা সঞ্জয় যে খুব সহজেই বিশ্বাস করিয়া ছিল তা নয়। এমনকি সঞ্জয়ের বন্ধু মাতারও এ কথা ঠিক মনে ধরে নাই। তবে সে পোড়াকপালিও স্বামীর আদেশের ওপরে কোন কথা বলিতে সাহস করে নাই। সন্দেহ করা তো বহু দূরের কথা।
তবে সে বেলা সঞ্জয় তালদীঘিতে ফিরলেও তার মাস ছয়েক পর সে গোপনে সৌদামিনীর প্রাসাদে উপস্থিত হয়েছিল এক গোধুলীতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে― সেদিন উকিল বাবুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দামিনী এক আইনের ছাত্রের সহিত আলোচনা করতে বসেছিল বাগানে। দামিনীর বাড়িতে দাস-দাসীর অভাব ছিল না। এবং তাহারা সকলেই সঞ্জয়ের সাথে মোটামুটি পরিচিত। এই অবস্থায় সঞ্জয়ের প্রাসাদের বাগানে ঢোকা আটকায় কে? সুতরাং সঞ্জয় দামিনীর বাগানে অবাধে ঢুকে পরলো।
কিন্তু সেই সময়েই সৌদামিনীর বাগানে বাহারী গাছ গাছালী ও রঙিন অর্কিডের আবাদের মধ্যে আলোচনা করছিল দুজন। আলোচনার শেষ মুহূর্তে উকিল বাবুর নির্ধারিত পাত্রটির হাতে একখানা হীরে আংটি দেখা গেল। এটি যে দামিনীর জন্যেই আনা একথা বুঝতে দামিনীর বোধহয় অল্প দেরি হয়েছিল। আর সেই অবকাশে দামিনীর হাত খানা তার পাশে দাঁড়ানো পুরুষটির হাতে যখন উঠেছিল, তখন সশরীরে সঞ্জয় সেখানে উপস্থিত।
এমন অবস্থায় অন্য কেউ কি করত তা বলা একটু কঠিন। শুধু সংক্ষিপ্ত ভাবে বলিতেছি; এই দৃশ্য সচোখে দেখার পর সেদিন দামিনীর হাত ধরার অপরাধের, উকিল বাবুর নির্ধারিত আইনের ছাত্রটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে কলিকাতার পাত্রটির দেহবল এতোটাই সীমিত যে, সেদিন দামিনী আগাইয়া না আসিলে সঞ্জয়ের হাতে তার ক্ষুদ্র প্রাণটি যায় যায় অবস্থা।
এরপর যা হয়েছিল সে কথা বলতে বলতে দামিনীর দু'চোখ আবারও অশ্রুসিক্ত।
– সইতে যখন পাড়লি না, তখন ওই আংটি সেদিন আঙ্গুলে পড়লি কেন বোন?
এই প্রশ্নের উত্তর এতকিছুর পর আরে দেবার দরকার হয় না। দামিনী নতমস্তকে নয়নতারার সমুখে দাড়িয়ে রইল। নয়নতারাও আর কিছু না বলে সস্নেহে দামিনীর দুচোখের অশ্রু তার শাড়ির আঁচলে মুছিয়ে দিতে লাগলো। এমন সময় দাসী এসে বললে― নয়নতারার ডাক পরেছে নিচে। নয়নতারার ইচ্ছে ছিল না এই মুহুর্তে সৌদামিনীকে একা ছেড়ে যেতে । তবে স্বামীর ডাকে সারা না দিলেও চলে না, কারণ সে বেচারা এখনো খানিকটা দুর্বল। তাই দামিনীকে বুঝিয়ে তার কান্নাকাটি থামিয়ে নয়ন যেই এক পা বারিয়েছে― পেছন থেকে সৌদামিনী নয়নতারার একখানা হাত ধরে বেশ শান্ত স্বরেই বলল,
– দিদি!! কেন করলে এমন.....
কথা মাঝ পথেই আটকে গেল। নয়নতারার শান্ত চোখে দৃষ্টি তখন দামিনীর মুখপানে। সৌদামিনী কোনমতে গলার জোড় ফিরিয়ে এনে বললে,
– দিদি তোমার পেটে সন্তানটি যে কার সে কথা আমি জানি।
নয়নতারার মুখের ভাবভঙ্গির কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে শুধু দামিনীর কাছে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরেই বলল,
– তুই যে জানিস এই কথা আমিও জানি বোন।
– এমনটা কেন করলে দিদি? আমি তোমার কেউ নই, কিন্তু হেমের কি কোন অপরাধ ছিল?
– কেন করেছি একথা আমি না বললেও তোর অজানা নয় ভাই। হেমের কোন অপরাধ নেই সে কথা যেনে তুমিই বা কেন পরে আছো এখানে! এই প্রশ্নের কি কোন উত্তর হয় ভাই?
সৌদামিনীর চোখে আবারও অশ্রু বিন্দু ভিড় করছে । এই দৃশ্য দেখা মাত্র নয়নতারা সস্নেহে দামিনীকে বুকে টেনে বলল,
– তোর লজ্জা কি বোন? তবে তাঁরও ভুল হয়েচে। এই আমি সময় মতো ঠিক বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, হেমের কোন অনিষ্ট তোর দ্বারা হবে না.......
তালদীঘির মন্দির থেকে বাড়ি ফিরেতেই আজ বাড়ির পরিবেশ হলো একটু ভিন্ন। বিগত কিছুদিন যাবত নয়নতারার হাতের কাজ সৌদামিনী দ্বিধাহীন ভাবে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তবে আজ কিন্তু তা হলো না। নয়নতারা আজ হেম ও মঙ্গলাকে কাজ বুঝিয়ে দিল। তারপর বাড়ির ছাদে গেল দামিনীকে সাথে নিয়ে । সৌদামিনী এত্তখনে নিজেকে সামাল দিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কি হয়! মন্দিরে সন্ন্যাসী বাবার সমুখে তার ওমন ভাবে ভেঙে পরা ত সকলেই দেখেছে। ইসস্... কি লজ্জা! কি লজ্জা! সে কথা ভাবতেই দামিনীর সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে উঠছে এখন। কেন যে ওমনটা হলো সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সন্ন্যাসীকে দেখতে গিয়ে এ কেমন কান্ড! তবে দামিনীর মনে পরে এক মুহূর্তের জন্যে সন্ন্যাসীর গলাটা যেন তার বাবার গলার মতোই ঠেকলো। আর পরক্ষণেই কি য হলো সে নিজেও জানে না।
যাহোক, দামিনী মুখে হাসি এনে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু নয়নতারা যখন গাঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
– মাথা খা বোন, আর লুকিয়ে রাখিস নে! সত্য করে বল তো তুই কেন এসেছিস এই পাঁড়াগায়ে?
সৌদামিনী তখন আর নিজের সামলাতে পারলো কই। হৃদয়ের গহীন কোন স্থান থেকে বোবা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। শব্দ হলো না বটে,তবে পর মুহূর্তে দামিনী নয়নকে জড়িয়ে দুচোখ জলে ভাসিয়ে দিল তার গাল দুখানি।
সৌদামিনী যে কাঁদতে পারে এই কথা নয়নতারা আগেই বুঝেছে । সে সৌদামিনীর মাথা থেকে পিঠ অবধি হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করবার খানিক চেষ্টা চালালো। তবে অবশেষে বুঝলো মেয়েটাকে কাঁদতে দেওয়াই ভালো। সব সময় বুকের ভেতরে কান্না জড়িত ব্যাথা লুকিয়ে রাখা মোটেও লাভজনক কিছু নয়। এক সময় দামিনী নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলো তার অতীত জীবনের খানিকটা অংশ।
ঘটনা এক দুদিন আগের নয়, সঞ্জয়ের কাঁচা বয়সের প্রথম প্রেম। কলিকাতায় দামিনী সঙ্গে সঞ্জয়ের বিবাহে বয়সের একটা ছোটখাটো বাঁধা ছিল। তবে সে বাঁধা লোকের কাছে মাত্র, সঞ্জয়ের কাছে কিন্তু নয়। কিন্তু এর বাইরেও যে আর একটি বড় বাঁধা ছিল, তার খবর সঞ্জয় বা দামিনী কেউই রাখে নাই। দিনের শেষে সে বাঁধাই কাল হয়ে দাড়ালো দামিনী ও সঞ্জয়ের মিলনে।
সঞ্জয়ের কলিকাতার বন্ধু পিতাটি উকিল। সেই দামিনীর দেখভালের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। একথা অনেক আগেই বলা হয়েছে তাই আর কথা না বাড়াই। যেহেতু সৌদামিনীর দেখভাল তিনিই করতেন, সুতরাং বিবাহের ব্যাপারে তার মতামত অতি আবশ্যক। কারণ একমাত্র তিনিই সৌদামিনীর প্রকৃত অভিভাবক। এর বাইরে দামিনীর বিশাল প্রাসাদে অভিভাবকদের কমতি ছিল না। তবে কি না তাদের কোন বিশেষ ঠিক-ঠিকানা ছিল না।
তবে থাক সে কথা। এদিকে দামিনীর বিবাহ যখন মুখে মুখে প্রায় ঠিকঠাক, তখন উকিল বাবু কলিকাতার বাইরে। তবে সঞ্জয় যেদিন ফিরলো তালদীঘিতে, সেদিন উকিল বাবু দামিনীর বাড়ি হয়ে ফিরলেন তার বাড়িতে। নিজের ও সৌদামিনীর বাড়িতে বিবাহের খবর তার কানে পৌঁছুল একটু ভিন্ন ভাবে। আগেই বলেছি দামিনীর বাড়িতে ঠিক-ঠিকানা হীন অভিভাবকদের অভাব ছিল না। উকিল বাবু সেদিন দামিনীর বাড়িতে পা রাখতে ঘটনাটি অন্যরূপ ভাবে তার কানে লাগলো।
সৌদামিনীর বাবার টাকাকড়ি উকিল বাবু মেরে দেবার ধান্দায় আছে। আর নয়তো অমন শিক্ষিত মেয়ের সাথে পাড়াগাঁয়ের মূর্খ চাষা চামার মার্কা ছেলের কেন অত মাখামাখি? সাধে কি আর সৌদামিনীর ওবাড়িতে অত ঘনঘন আনাগোনা। সরল মেয়েটাকে উকিলবাবু ও তার স্ত্রী মিলে কি মন্ত্র পড়িয়েছে কে জানে তার খবর!বাপ-মা মরা মেয়েটার অসহায়ত্বের সুযোগে তাকে জলে বাসিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তি বাগিয়ে নেবার ধান্দা উকিল বাবুর― একথা কি আর লোকে বোঝে না। তাও মানা যেত যদি তার নিজের ছেলের সাথে বিবাহ হতো। তখন না হয় আত্মীয় সজনের চোখে চোখে থাকতো মেয়েটা। বিপদে-আপদে দেখভাল করতো,, তাওতো নয়। আহা..! না জানি কতদূর দূরান্তে মেয়েটাকে নির্বাসন দেবেন তিনি। এই কাজ উকিল বাবুর পাকা মাথা ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব?
লোকের আলোচনা যখন এই রূপ, তখন উকিল বাবুর সম্মানে আঘাত লাগতে কতখন। শুধুমাত্র সৌদামিনীর দূর থেকে দূর সম্পর্কের আত্নীয় দের মুখেই নয়,উকিল বাবুর দূই একজন কলকাতার বন্ধুরাও খোচা দিয়ে বলতে লাগলো। সৌদামিনীর মতো মেয়েকে উকিল বাবু সত্যিই জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তার নিজের ছেলে থাকতে কেন শুধু শুধু একটা পাড়াগাঁয়ের; ইত্যাদি কথা চারদিকে থেকে ঘিরে ধরলো তাকে।
যাহোক ,আগেই বলেছি দামিনীর পিতা তাঁর বন্ধু ছিলেন এবং দামিনী বিশেষ কোন আত্নীয় না থাকার দরুণ তিনিই দামিনীর সব দেখভালের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে এমন অপবাদ তিনি নিজের কাঁধে নিতে রাজি ছিলেন না। তাছাড়া তিনি দামিনীকে কখনো নিজের মেয়ের থেকে আলাদা করে দেখেনি। তাই তো তাঁর বাড়িতে দামিনীর অবাধে আনাগোনা সব সময়। সেখানে তার ছেলের সাথে দামিনীর বিবাহের খোচাটায় তার বুকে ভালো ভাবেই বিধলো। কারণ তার ছেলের সাথে দামিনী যে আপন ভাই বোনের মতো সম্পর্ক, সেটি তার অজানা ছিল না। সুতরাং চারপাশে চাপে এক শান্ত সকালে দামিনীর প্রাসাদের বাগানে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
– দেখো মা দামিনী! আমি ভেবে দেখলাম। আমার বয়স হয়েছে, এ যাত্রায় তোমার পিতার যা কিছু আছে তোমার বুঝে নেওয়া উচিৎ।
এই কথা শুনে দামিনী অবাক হয়নি এমনটা বলা যায় না। তবে এমন কথার উঠলো কেন তার কারণ শুনে বেচারীর চোখে অশ্রু বাধ ভেঙ্গে অঝরে কান্না নেমে এল দুই গাল বেয়ে। তবে মুখ ফুটে প্রতিবাদ জানাবার সাহস সে আকাশ পাতাল হাতরেও পেল না। কারণ পিতার মৃত্যুর পর পিতার এই বন্ধুটিকে সে পিতা রূপেই গ্রহণ করেছিল । এখন একথা উঠতে পারে যে― তবে তার এতো অনুরোধের পরে সৌদামিনী বিবাহ কেন করলো না, কিংবা এত পাত্র ছেড়ে সঞ্জয়কেই তার মনে কেন ধরলো। এই প্রশ্ন যাদের মনে উদয় হয়েছে তাদের জন্যে বলে রাখি, এই আলোচনাও অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। তবুও সংক্ষিপ্ত রূপে এটুকুই বলবো যে― লক্ষ্মীচ্ছাড়া মনের অনুভূতি গুলো কখন যে কি করে বসে, তার কি কোন ঠিক আছে?
যাহোক দামিনীর নিজের বলতে পিতার এই উকিল বন্ধুটির পরিবার ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিল না। সুতরাং যৌবনের আবেগে অল্প তর্ক করতে গিয়ে এই পরিবারটিকে হারানো প্রবৃত্তি বা সাহস কোনটাই তাঁর হয়ে উঠলো না। বলা বাহুল্য এমন আকর্ষিক আঘাতে দামিনী মনটা ফাটা ফুটবলের মতো চুপসে গেল। তাই নিজে অবাধ্য মনকে সামাল দিতে সঞ্জয় কলিকাতা ছাড়বার মাসখানেক মধ্যে নিজেকে সবলে বিলেতে নির্বাসন করলো সে।
এদিকে যথাযথ সময়ে সঞ্জয় যখন কলকাতা ফিরলো, তখন সে জেনেছিল― দামিনীর এই বিবাহে মত নাই। কেন বা কি কারণে হঠাৎ এই মত পরিবর্তন এই প্রশ্নে কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর সে কারো কাছেই পেল না। সুতরাং একথা সঞ্জয় যে খুব সহজেই বিশ্বাস করিয়া ছিল তা নয়। এমনকি সঞ্জয়ের বন্ধু মাতারও এ কথা ঠিক মনে ধরে নাই। তবে সে পোড়াকপালিও স্বামীর আদেশের ওপরে কোন কথা বলিতে সাহস করে নাই। সন্দেহ করা তো বহু দূরের কথা।
তবে সে বেলা সঞ্জয় তালদীঘিতে ফিরলেও তার মাস ছয়েক পর সে গোপনে সৌদামিনীর প্রাসাদে উপস্থিত হয়েছিল এক গোধুলীতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে― সেদিন উকিল বাবুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দামিনী এক আইনের ছাত্রের সহিত আলোচনা করতে বসেছিল বাগানে। দামিনীর বাড়িতে দাস-দাসীর অভাব ছিল না। এবং তাহারা সকলেই সঞ্জয়ের সাথে মোটামুটি পরিচিত। এই অবস্থায় সঞ্জয়ের প্রাসাদের বাগানে ঢোকা আটকায় কে? সুতরাং সঞ্জয় দামিনীর বাগানে অবাধে ঢুকে পরলো।
কিন্তু সেই সময়েই সৌদামিনীর বাগানে বাহারী গাছ গাছালী ও রঙিন অর্কিডের আবাদের মধ্যে আলোচনা করছিল দুজন। আলোচনার শেষ মুহূর্তে উকিল বাবুর নির্ধারিত পাত্রটির হাতে একখানা হীরে আংটি দেখা গেল। এটি যে দামিনীর জন্যেই আনা একথা বুঝতে দামিনীর বোধহয় অল্প দেরি হয়েছিল। আর সেই অবকাশে দামিনীর হাত খানা তার পাশে দাঁড়ানো পুরুষটির হাতে যখন উঠেছিল, তখন সশরীরে সঞ্জয় সেখানে উপস্থিত।
এমন অবস্থায় অন্য কেউ কি করত তা বলা একটু কঠিন। শুধু সংক্ষিপ্ত ভাবে বলিতেছি; এই দৃশ্য সচোখে দেখার পর সেদিন দামিনীর হাত ধরার অপরাধের, উকিল বাবুর নির্ধারিত আইনের ছাত্রটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে কলিকাতার পাত্রটির দেহবল এতোটাই সীমিত যে, সেদিন দামিনী আগাইয়া না আসিলে সঞ্জয়ের হাতে তার ক্ষুদ্র প্রাণটি যায় যায় অবস্থা।
এরপর যা হয়েছিল সে কথা বলতে বলতে দামিনীর দু'চোখ আবারও অশ্রুসিক্ত।
– সইতে যখন পাড়লি না, তখন ওই আংটি সেদিন আঙ্গুলে পড়লি কেন বোন?
এই প্রশ্নের উত্তর এতকিছুর পর আরে দেবার দরকার হয় না। দামিনী নতমস্তকে নয়নতারার সমুখে দাড়িয়ে রইল। নয়নতারাও আর কিছু না বলে সস্নেহে দামিনীর দুচোখের অশ্রু তার শাড়ির আঁচলে মুছিয়ে দিতে লাগলো। এমন সময় দাসী এসে বললে― নয়নতারার ডাক পরেছে নিচে। নয়নতারার ইচ্ছে ছিল না এই মুহুর্তে সৌদামিনীকে একা ছেড়ে যেতে । তবে স্বামীর ডাকে সারা না দিলেও চলে না, কারণ সে বেচারা এখনো খানিকটা দুর্বল। তাই দামিনীকে বুঝিয়ে তার কান্নাকাটি থামিয়ে নয়ন যেই এক পা বারিয়েছে― পেছন থেকে সৌদামিনী নয়নতারার একখানা হাত ধরে বেশ শান্ত স্বরেই বলল,
– দিদি!! কেন করলে এমন.....
কথা মাঝ পথেই আটকে গেল। নয়নতারার শান্ত চোখে দৃষ্টি তখন দামিনীর মুখপানে। সৌদামিনী কোনমতে গলার জোড় ফিরিয়ে এনে বললে,
– দিদি তোমার পেটে সন্তানটি যে কার সে কথা আমি জানি।
নয়নতারার মুখের ভাবভঙ্গির কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে শুধু দামিনীর কাছে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরেই বলল,
– তুই যে জানিস এই কথা আমিও জানি বোন।
– এমনটা কেন করলে দিদি? আমি তোমার কেউ নই, কিন্তু হেমের কি কোন অপরাধ ছিল?
– কেন করেছি একথা আমি না বললেও তোর অজানা নয় ভাই। হেমের কোন অপরাধ নেই সে কথা যেনে তুমিই বা কেন পরে আছো এখানে! এই প্রশ্নের কি কোন উত্তর হয় ভাই?
সৌদামিনীর চোখে আবারও অশ্রু বিন্দু ভিড় করছে । এই দৃশ্য দেখা মাত্র নয়নতারা সস্নেহে দামিনীকে বুকে টেনে বলল,
– তোর লজ্জা কি বোন? তবে তাঁরও ভুল হয়েচে। এই আমি সময় মতো ঠিক বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, হেমের কোন অনিষ্ট তোর দ্বারা হবে না.......