01-11-2024, 04:50 PM
Update : 16(A)
রবিবার সকাল;
অজয় বসে বেড়ার বাতা তৈরী করছে।চওড়া করে ফাঁটানো বাঁশের লম্বা বাতাগুলোর দুপাশ খুব ধারালো, সঠিক ভাবে দা দিয়ে না চাঁচলে হাত কাটার ভয় থাকে।তাই অজয় নিখুঁত ভাবে আস্তেধীরে বাতাগুলো চাঁচছে।
রান্না ঘরের পেছন থেকে কিছুটা দূরে পরিস্কার একটা জায়গায় বসে সে কাজ করছে আর অমর বসে আছে সামনে।অমরের হাতে সরু একখণ্ড কঞ্চি, মাথা নিচু করে সেই কঞ্চি দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ কেটে চলেছে মাটিতে।ছেলের দিকে মুখ তুলে তাঁকাতে মুচকি হাসি পেল অজয়ের। বাড়িতে আসার পর থেকে একমুহূর্তও ছেলে তার পিছু ছাড়েনি, কিন্তু এর আগে এমন হয়নি কোনদিন। ছেলে তাকেও ভালোবাসে তবে ভালোবাসার পাল্লাটা মায়ের দিকেই ভারী সবসময়।গতকাল মায়ের কাছে বকা খেয়ে বাপের দিকে একটু ঝুঁকে পরেছে এই আর কি।নয়ত ছেলে তার 'মা' পাগলা।
অজয় হাসি মুখেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল-- ' পাগলা রে , যা তো দেইহা আয় তোর মায়ের রান্না কতদূর, বেলা অনেক হইল বাজার যাইতে দেরি হইয়া যাইতেচে।'
বাবার কথা শুনে অমরের হাতের কঞ্চি থেমে গেল, হা করে তাকিয়ে রইল বাপের দিকে।ছেলের হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে সেই হাসি মুখ নিয়েই অজয় বলল- ' মায়ের ওপর এহনো রাগ কইরা রইচাস, তাই না?'
অমর হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই অজয় একটু গম্ভীর হয়ে বলল- 'সোনা রে মায়ের ওপর রাগ করিস না.......দেহস না তোর মায় আমাগো জইন্যে কত কষ্ট করে.....।যা পাগলা যা...।'
বাবার কথায় অমরের প্রানটাও কেঁদে উঠল ভেতরে ভেতরে। সত্যিই তার জন্য তার পরিবারের জন্য তার মা অনেক কিছু করে।নিজে না খেয়ে তার মা তাকে খাওয়ায়, নিজে ছেঁড়া শাড়ি পড়ে কিন্তু তার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনে, হোক না তা কম দামি। দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে...আর সেই আমিই কিনা মায়ের ওপর..…...।অমর উঠে পরল আর বসে থাকতে পারল না, সকল দ্বিধা- দ্বন্দ্ব পেছনে ফেলে হাঁটা দিল মায়ের কাছে।
এদিকে ঊষার রান্না প্রায় শেষের দিকে।ভাতের হাঁড়ি নামিয়েছে বহুক্ষণ আগে, ঝুঁড়িঝুঁড়ি করে আলুভাঁজি করেছে,সুন্দর করে ভাতের হাঁড়ির ঢাকনার ওপর সাজিয়ে রেখেছে। শুধু তরকারিটা উনানে এখনো,সেটাও সুম্ভার দিলেই প্রায় রান্না শেষ।কড়াইয়ে তেল দিয়ে হাতে কিছু গোটা জিরা নিয়ে ছেড়ে দিল সেই তপ্ত ফুটন্ত তেলে,খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে তরকারির গামলা হাতে তুলে নিয়ে যেই কড়াইতে ঢালবে ঠিক সেই মুহূর্তেই কানে এলো
- 'মাআআআ....।'
'ছ্যাঁৎ' করে উঠল তপ্ত তেলের কড়াইতে ঝোলের ছোঁয়া পেয়ে।ঊষা ঘাড় কাত করে দেখল ছেলে ঘরের সম্মুখের খুঁটিতে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে 'মা' বলে ডাকছে, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ঊষা,কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে , হাতের গামলা সেই কড়াইয়ের ওপরেই,অনেকক্ষণ অনেক্ষন ধরে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল , ততক্ষণে কড়াইয়ের মধ্যে টগবগ করছে তরকারি।
-- 'মা, রান্না হইচে নাকি? বাবা জিজ্ঞাস করবার কইল।'
ছেলের কথা পুনরায় কানে যেতেই হুশ ফিরল ঊষার।
- 'এএএএইইই তো সোনা হইইইইইয়া গেছে প্রায়, আসপার ক...।'
-আইচ্ছা।' বলেই অমর চলে গেল।সামান্য কিছু কথা তবু মন অনেকটা হাল্কা লাগছে অমরের আর ঊষার তো খুশির সীমা নেই। জীবনে প্রথম বোধয় 'মা' ডাক শুনল।অন্তর জুড়িয়ে গেছে তার।
প্রায় সকলেরই খাওয়া দাওয়া শেষ, বাকি শুধু ঊষা আর গুরুদেব।অজয় ডাকতে গিয়েছিল গুরুদেবকে কিন্তু শরীরটা ভালো নেই এই অজুহাতে গুরুদেব খেতে আসে না, শুয়েই রইলেন। অনাচারে ভরে গেছে গুরুদেবের জীবন - সকালের সেই স্নান সেরে পূজার্চনা নেই আগের মতো, গতকাল একাদশী গেছে তা খেয়াল নেই। একাদশীর দিন যে উনি অন্ন গ্রহণ করেন না সেটাও ভুলে গেছেন।
অজয় বাজারে যাওয়ার আগে ঊষাকে বলে গেল- গুরুদেবের দিকে নজর রাইহ,ডাকডা খাওয়াইও কয়ডা...।'
যাওয়ার সময় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেল অজয়, জিনিস টিনিস কিনতে সুবিধা হবে, আর ছেলেকে একজোড়া চটি কিনে দেবে, আগের চটিটা খয়ে গেছে গোড়ালির দিকে, কলেজ যেতে অসুবিধা হয়।তাই ছেলেকে সঙ্গে করেই নিয়ে গেল।রাস্তা অবধি স্বামী ও ছেলেকে এগিয়ে দিয়ে এসে ঊষা রান্না ঘরে প্রবেশ করল। এটোঁ থালাবাসন কলের পাড়ে রেখে বারান্দায় শ্বশুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
- 'বাবা আপনে ওই রাস্তায় যাইয়া অল্প বসেন গা তো...।'
সবে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল বুড়ো, সাথে একটু তামাক ধরাবে,বউমার হটাৎ এই রাস্তায় যাওয়ার নির্দেশ শুনে অবাক হলো।
- 'কিসের জইন্যে বউমা রাস্তায় যামু?'
- কিসের জইন্যে আবার গরুডার দিকে নজর দিচেন? হাড় বাইরাই গেচে, ঘাস দেইহা একটু নাড়াচাড়া করবারও তো পারেন..আমারে তো একদন্ডও সময় দেন না, সংসারের জঞ্জাল সারতেই দিন শ্যাষ ....। '
হঠাৎ কেন যে বউমার এই রুক্ষমূর্তি বুঝে উঠতে পারে না বিনোদ, একটু আগেও তো কত ভালোবেসে খেতে ডাকল এর মধ্যে কি এমন ঘটল!আর কথা বলতে সাহস হয়না বিনোদের তবু বিনয় করে বউমাকে বলল-
- 'আইচ্ছা বউমা যাইতেচি, এই হুকায় দুইডা টান মাইরা নই।'
-' হুকা সাথে কইরা নিয়া যান, রাস্তায় বইসাই টানবেন, যান তাড়াতাড়ি..।'
নিরুপায় বিনোদ শুকনো মুখে টায় টায় উঠে চলে গেল রাস্তার দিকে।বুড়ো মানুষ বোঝার মতো সংসারে।ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে।কানাকড়িও দাম নেই, তবু ভগবান কেন যে ফেলে রাখে!
ঊষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বশুরের চলে যাওয়া দেখতে লাগল।নিজের ব্যবহারে নিজেই পুড়ে যেতে লাগল ভেতরে ভেতরে কিন্তু উপায় নেই একটা সুযোগ চাইছিল সে। শ্বশুর থাকলে তা কোন ভাবেই সম্ভব হতো না,পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষকে চলতে হয় - কখনো নরম কখনো গরম।
শ্বশুর চোখের অদৃশ্য হতেই ভেজানো দরজাটা ফটাস করে এক ধাক্কায় খুলে ঘরে ঢুকে গেল। সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালো গুরুদেবের বিছানার সামনে। গুরুদেব উল্টো দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে।বড়ো বড়ো চোখে আস্ত গিলে খেতে লাগল গুরুদেবকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।ফণা তুলে শুধু ফুস্ ফুস্ করতে লাগল। যেন বিষ দাঁতে বিষ ভরার সময় নিচ্ছে ঊষা, উপযুক্ত সময় এলেই ছোঁবল মেরে বসবে।
--কই আপনের চোহে কি ভগবান একটুও লজ্জা দেয় নাই?... না আপনের জন্মের ঠিক নাই?...বেহায়া বজ্জাত শয়তান বুইড়া,স্বামী স্ত্রীর মিলন লুকায় দেহা আপনের মায় শিখাইচে তাই না।ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাববারই পারি না এমন বেজন্মা মানুষও জগতে আচে, ছিঃ....। '
একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল-
--' পষ্ট কথা কইতেচি আমার বাড়ি আর একমুহূর্তও থাহা চলব না, টুপলা টুপলি নিয়া আজই চইলা যাইবেন, আপনের মতো মাইনষের মুখ দেহাও পাপ.....।'
গুরুদেবের কোন হেলদোঁল নেই, এতকিছু বলে গেল ঊষা কিন্তু দেখো কেমন নির্লজ্জের মতো পরে আছে এখনো ।ঊষার মাথায় রক্ত উঠতে লাগল গুরুদেবের হেলদোঁল না দেখে।এই রাগের সময় কেউ প্রতিত্তোর না দিলে রাগ আরও বাড়ে।ঊষার অবস্থাও তাই, থাকতে না পরে দু'হাতে গুরুদেবকে এক ঝটকায় এদিকে ঘুরিয়ে দিল। পারলে বোধয় বুকের উপর উঠে কিল-ঘুষি মারা শুরু করে।
-- 'ওই ওওওওওওওই তোর কি কানে ডুকে না আমি কি কইলাম, তুই এহনি বাইর হইয়া যা আমার বাড়ি থিকা, নইলে ঝাটা আইনা ঝাটা পিটাই বাইর কইরা দিমু...।'
ঊষা আরও এমন সব ভাষা বলছিল যে তা ভাষা প্রকাশ না করাই ভালো , খেদ উঠে গেছে, মুখে ফেনা উঠার জো কিন্তু গুরুদেব চৌকি থেকে নেমে ঊষাকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল দুহাতে।বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন গুরুদেব। চোখের জল ঝর্ণার মতো বেয়ে পরতে লাগল ঊষার গলার কাছে।গুরুদেবের শরীর আগুনের মতো পুড়ে যাচ্ছে আর চোখে শ্রাবণ। ঊষাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই ভেজা সুরে গুরুদেব বললেন-
- আ আ আ আমি এহনি চইইইলা যাইতেচি।'
ঊষাকে ছেড়ে দিয়ে সেই অশ্রুপূর্ণ নয়নে নিজের ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে গেলেন।
গুরুদেবের অমনভাবে জড়িয়ে ধরা এবং চোখের জলে ঊষা হতভম্ব হয়ে গেছে।কি হলো এটা! এত গালাগালির পরেও অমন করে জড়িয়ে ধরতে পারলেন?ঊষা যতটা রাগ নিয়ে ঘরে এসেছিল তার সিকিও এখন তার মধ্যে নেই। কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুরুদেবকে তার নিজের কাজ করতে দিয়ে কখন যে এসে এরুমে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে এসব ভাবছে ঊষা কিছুই জানে না।
ভাবনার জগতে ছেদ পরল বাইরে শ্বশুর ও আর একজনের গলার আওয়াজ পেয়ে।বাইরে বেরিয়ে ঊষা দেখল -
মন্টু এসেছে।ঊষার দিকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল- বউমা গুরুদেব কি করতেচে? ডাক দাও তো দেহি একটু দরকার আচে।
ঊষা থতমত খেয়ে গেল এখন উপায়, গুরুদেব যে.......।ঊষা দাঁড়িয়েই আছে দেখে বিনোদ বলল - মন্টু বইসো বারান্দায় উইঠা..বউমা গুরুদেব উঠচে নাকি ডাক দাও....।
- উম্ম, হ বসেন।
মন্টুর দিকে তাকিয়ে ঊষা ছুঁটে গেল ঘরে, দেখল গুরুদেব ব্যাগ বুকের কাছে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো মন্টুর গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে যেতে সাহস পাননি।ঊষা ফিসফিস করে বলল- 'মন্টু কাকা আইচে,আপনেরে ডাকে..।'
বলেই ঊষা বাইরে বেরিয়ে এলো।মন্টুকে উদ্দেশ্য করে বলল-
- আপনে বসেন উনি আসতেচে..।
একদম স্বাভাবিক ঊষার গলা। কেউ বুঝতেই পারবে না একটু আগে কি ঘটেছে। কিন্তু গুরুদেব পরলেন বিপদে।এখানে যে আর একমুহূর্তও থাকা চলে না।তবুও চোখের জল মুছে লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।মন্টু প্রণাম করে একটু হাসি মুখে বলল--
- কেমন আচেন গুরুদেব,আপনে তো আর ওদিকে যাওয়ার সময়ই পান না।
- আছি ভালোই,ওই শরীরডা হাল্কা ম্যাচম্যাচ করতেচে..।
- সামনে পুন্নিমা না শরীল ব্যথা অল্পটল্প
হইবই।
বলেই মন্টু ঊষার দিকে তাকালো।বলল-
- 'তা বউমা অজয় রে দেহি না বাড়ি..।'
-- বাজারে গেচে উনি, টিন কিনবার.।
বলেই ঊষা সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল।
মন্টু ঊষাকে থামিয়ে বলল।
- একটু দাঁড়াও বউমা, অজয় যেহেতু বাড়ি নাই তোমারেই কইয়া যাই...।
এবার গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল-- 'গুরুদেব ম্যায়ার বিয়া তা তো আপনেরে কইচিই।'
- 'হুম'
-- তা বিয়ায় কি কেমন লাইগব এর জন্য আইজ সন্ধ্যায় গিরামের সবাইরে ডাকচি আলোচনার জইন্যে।তা আপনের যাওয়া নাইগব।
ঊষার দিকে ফিরে - বউমা অজয়রেও যাইবার কইও।
গুরুদেব একটু চিন্তা করে বললেন- -বুঝচাও মন্টু শরীলডা তো খুব একখান ভালো না, তাই তোমরা তোমরাই কাজডা সাইরা নিও।
- তা কি কইরা হয়, ও শরীল ঠিক হইয়া যাইব,আমি ওষুধ আইনা দিমুনে ভোম্বল ডাক্তারের থিকা, দুই ডোজ খাইলেই দেখপেন সব ঠিক...।
এতক্ষণ পরে বিনোদ বলল-' তা আর কইতে ভোম্বলের হাতের গুণ ভালো বুঝচেন গুরুদেব, কিন্তু বেটায় টাহা নেয় বেশি , এক কাশের সিরাব আনচিলাম ৩০ডা টাহা গুইনা গুইনা নিল চামারে, আর যাই না, না কইমল অমন কাশ......।
বলেই খক্ খক্ করে দুবার কেশে নিল বুড়ো। ঊষার পিন্ডি চটকে যাচ্ছে শ্বশুরের কথাবার্তায়।মন্টু একটু ধমকের সুরে বলল- - আরে রাহো তোমার খক্ খক্, বিনি পয়সায় তুমারে সব দিবেনে।'
এবার গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে একটু জোর দিয়েই মন্টু বলল-- - তা ওই কথাই রইল গুরুদেব, আপনে যাইয়া খালি বইসা থাইকপেন বুঝচেন, তাও যাইবেন কইয়া দিলাম।
......আইচ্ছা উটি আমি আরও দুই-এক বাড়ি কওয়া লাইগব... বউমা অজয় আইলে কইও কিন্তু.......আসি গুরুদেব।'
বলে আবার প্রণাম করে মন্টু চলে গেল।
বিনোদ বুড়োও মন্টুর পেছন পেছন চলে গেল রাস্তায়।
গুরুদেব ঊষার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে রুমে গিয়ে ব্যাগটা সেই আগের মতো বুকে জাপটে ধরে বেরিয়ে এলো মাথানিচু করে।বেরিয়েই যাচ্ছিলেন প্রায় তখনই ঊষা হাত টেনে ধরল।ধমকে উঠল ঊষা
- 'কই যান?উনি কি কইয়া গেল শুনেন নাই?.... তাছাড়া উনি(অজয়) বাড়ি ফিরলে কি জবাব দিমু,উম্মম?
গুরুদেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ঊষার মুখের দিকে।ঊষা সেই আগের মতোই বলতে লাগল,কিন্তু এবার একটু নরম স্বরে
-'যান ব্যাগ ঘরে রাইখা আসেন,তারপর খাইয়া নেন।'
গুরুদেব নড়ছেন না দেখে জোর করেই ঊষা ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ঘরে রেখে এসে গুরুদেবের হাত টেনে নিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করল।
ভাত বেড়ে নিল নিজের জন্য এবং গুরুদেবর জন্যও।ভাতের থালা সামনে দেখে এতক্ষণে গুরুদেবের চোখে জল চলে এলো।মনে যতটা জ্বালা, পেটেও সেই পরিমাণ জ্বালা।পেটের জ্বালা হয়ত ভাত খেলেই নাই হবে কিন্তু মনের জ্বালা?গুরুদেবের চোখে জল দেখে ঊষার মনটাও কেঁদে উঠল। কত কিই যে বলে ফেলেছে তখন । দুনিয়ার কত লোক উনাকে শ্রদ্ধা করে আর এ বাড়িতে এসে!মন্টুর জন্য যে শুধু গুরুদেবকে আটকেছে যেতে দেয়নি ঊষা তা কিন্তু নয়।ঊষার কোথাও যেন একটা অনুশোচনা, দরদ কাজ করছিল গুরুদেবের জন্য।কারণ এ কদিন যা কিছু ঘটেছে হয়ত প্রথম দিকে গুরুদেবই সবকিছুর জন্য দায়ী কিন্তু গতকালের ঘটনায় উনার সেই অর্থে কোন দোষ ছিল না, দোষ ধরতে গেলে তার, এবং কিছুটা তার ছেলের।গুরুদেবে ভাতের থালা সামনে নিয়ে কাঁদছেন,ইসসস।
- 'আপনে কান্দেন ক্যা? খুব কষ্ট পাইচেন আমার কথায়? আমারে ক্ষমা কইরা দেন।'
এবার যেন গুরুদেব আরও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।দুঃখের সময় ভরসা পেলে মানুষ মন খুলে কাঁদে।ঊষা উঠে এসে গুরুদেবকে জড়িয়ে ধরল।গুরুদেব ঊষার গলায় মাথা রেখে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন-
-- তুই আমারে যাইতে দিলি না ক্যান? আমি যে আর সইতে পারি না, আমারে যাইতে দে.....।
-- 'আহহ খাইতে বইসা কান্দে না, আসেন আমি খাওয়াই দিই।'
ঊষা নিজে হাতে গুরুদেবকে খাইয়ে দিতে লাগল।গুরুদেবেও আস্তে আস্তে ভাতের দলা মুখে নিয়ে চিবতে লাগল।এভাবেই সমস্ত মান অভিমান, রাগ-ক্ষোভ কর্পূরের মতো উবে গেল মুহুর্তে।হয়ত কিছুটা নিজগুণে একে অপরকে ক্ষমা করে দিল অথবা সম্পূর্ণ কোন দৈবগুণে একে অপরের দোষগুণ ভুলে কাছে চলে এলো।
রবিবার সকাল;
অজয় বসে বেড়ার বাতা তৈরী করছে।চওড়া করে ফাঁটানো বাঁশের লম্বা বাতাগুলোর দুপাশ খুব ধারালো, সঠিক ভাবে দা দিয়ে না চাঁচলে হাত কাটার ভয় থাকে।তাই অজয় নিখুঁত ভাবে আস্তেধীরে বাতাগুলো চাঁচছে।
রান্না ঘরের পেছন থেকে কিছুটা দূরে পরিস্কার একটা জায়গায় বসে সে কাজ করছে আর অমর বসে আছে সামনে।অমরের হাতে সরু একখণ্ড কঞ্চি, মাথা নিচু করে সেই কঞ্চি দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ কেটে চলেছে মাটিতে।ছেলের দিকে মুখ তুলে তাঁকাতে মুচকি হাসি পেল অজয়ের। বাড়িতে আসার পর থেকে একমুহূর্তও ছেলে তার পিছু ছাড়েনি, কিন্তু এর আগে এমন হয়নি কোনদিন। ছেলে তাকেও ভালোবাসে তবে ভালোবাসার পাল্লাটা মায়ের দিকেই ভারী সবসময়।গতকাল মায়ের কাছে বকা খেয়ে বাপের দিকে একটু ঝুঁকে পরেছে এই আর কি।নয়ত ছেলে তার 'মা' পাগলা।
অজয় হাসি মুখেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল-- ' পাগলা রে , যা তো দেইহা আয় তোর মায়ের রান্না কতদূর, বেলা অনেক হইল বাজার যাইতে দেরি হইয়া যাইতেচে।'
বাবার কথা শুনে অমরের হাতের কঞ্চি থেমে গেল, হা করে তাকিয়ে রইল বাপের দিকে।ছেলের হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে সেই হাসি মুখ নিয়েই অজয় বলল- ' মায়ের ওপর এহনো রাগ কইরা রইচাস, তাই না?'
অমর হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই অজয় একটু গম্ভীর হয়ে বলল- 'সোনা রে মায়ের ওপর রাগ করিস না.......দেহস না তোর মায় আমাগো জইন্যে কত কষ্ট করে.....।যা পাগলা যা...।'
বাবার কথায় অমরের প্রানটাও কেঁদে উঠল ভেতরে ভেতরে। সত্যিই তার জন্য তার পরিবারের জন্য তার মা অনেক কিছু করে।নিজে না খেয়ে তার মা তাকে খাওয়ায়, নিজে ছেঁড়া শাড়ি পড়ে কিন্তু তার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনে, হোক না তা কম দামি। দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে...আর সেই আমিই কিনা মায়ের ওপর..…...।অমর উঠে পরল আর বসে থাকতে পারল না, সকল দ্বিধা- দ্বন্দ্ব পেছনে ফেলে হাঁটা দিল মায়ের কাছে।
এদিকে ঊষার রান্না প্রায় শেষের দিকে।ভাতের হাঁড়ি নামিয়েছে বহুক্ষণ আগে, ঝুঁড়িঝুঁড়ি করে আলুভাঁজি করেছে,সুন্দর করে ভাতের হাঁড়ির ঢাকনার ওপর সাজিয়ে রেখেছে। শুধু তরকারিটা উনানে এখনো,সেটাও সুম্ভার দিলেই প্রায় রান্না শেষ।কড়াইয়ে তেল দিয়ে হাতে কিছু গোটা জিরা নিয়ে ছেড়ে দিল সেই তপ্ত ফুটন্ত তেলে,খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে তরকারির গামলা হাতে তুলে নিয়ে যেই কড়াইতে ঢালবে ঠিক সেই মুহূর্তেই কানে এলো
- 'মাআআআ....।'
'ছ্যাঁৎ' করে উঠল তপ্ত তেলের কড়াইতে ঝোলের ছোঁয়া পেয়ে।ঊষা ঘাড় কাত করে দেখল ছেলে ঘরের সম্মুখের খুঁটিতে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে 'মা' বলে ডাকছে, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ঊষা,কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে , হাতের গামলা সেই কড়াইয়ের ওপরেই,অনেকক্ষণ অনেক্ষন ধরে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল , ততক্ষণে কড়াইয়ের মধ্যে টগবগ করছে তরকারি।
-- 'মা, রান্না হইচে নাকি? বাবা জিজ্ঞাস করবার কইল।'
ছেলের কথা পুনরায় কানে যেতেই হুশ ফিরল ঊষার।
- 'এএএএইইই তো সোনা হইইইইইয়া গেছে প্রায়, আসপার ক...।'
-আইচ্ছা।' বলেই অমর চলে গেল।সামান্য কিছু কথা তবু মন অনেকটা হাল্কা লাগছে অমরের আর ঊষার তো খুশির সীমা নেই। জীবনে প্রথম বোধয় 'মা' ডাক শুনল।অন্তর জুড়িয়ে গেছে তার।
প্রায় সকলেরই খাওয়া দাওয়া শেষ, বাকি শুধু ঊষা আর গুরুদেব।অজয় ডাকতে গিয়েছিল গুরুদেবকে কিন্তু শরীরটা ভালো নেই এই অজুহাতে গুরুদেব খেতে আসে না, শুয়েই রইলেন। অনাচারে ভরে গেছে গুরুদেবের জীবন - সকালের সেই স্নান সেরে পূজার্চনা নেই আগের মতো, গতকাল একাদশী গেছে তা খেয়াল নেই। একাদশীর দিন যে উনি অন্ন গ্রহণ করেন না সেটাও ভুলে গেছেন।
অজয় বাজারে যাওয়ার আগে ঊষাকে বলে গেল- গুরুদেবের দিকে নজর রাইহ,ডাকডা খাওয়াইও কয়ডা...।'
যাওয়ার সময় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেল অজয়, জিনিস টিনিস কিনতে সুবিধা হবে, আর ছেলেকে একজোড়া চটি কিনে দেবে, আগের চটিটা খয়ে গেছে গোড়ালির দিকে, কলেজ যেতে অসুবিধা হয়।তাই ছেলেকে সঙ্গে করেই নিয়ে গেল।রাস্তা অবধি স্বামী ও ছেলেকে এগিয়ে দিয়ে এসে ঊষা রান্না ঘরে প্রবেশ করল। এটোঁ থালাবাসন কলের পাড়ে রেখে বারান্দায় শ্বশুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
- 'বাবা আপনে ওই রাস্তায় যাইয়া অল্প বসেন গা তো...।'
সবে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল বুড়ো, সাথে একটু তামাক ধরাবে,বউমার হটাৎ এই রাস্তায় যাওয়ার নির্দেশ শুনে অবাক হলো।
- 'কিসের জইন্যে বউমা রাস্তায় যামু?'
- কিসের জইন্যে আবার গরুডার দিকে নজর দিচেন? হাড় বাইরাই গেচে, ঘাস দেইহা একটু নাড়াচাড়া করবারও তো পারেন..আমারে তো একদন্ডও সময় দেন না, সংসারের জঞ্জাল সারতেই দিন শ্যাষ ....। '
হঠাৎ কেন যে বউমার এই রুক্ষমূর্তি বুঝে উঠতে পারে না বিনোদ, একটু আগেও তো কত ভালোবেসে খেতে ডাকল এর মধ্যে কি এমন ঘটল!আর কথা বলতে সাহস হয়না বিনোদের তবু বিনয় করে বউমাকে বলল-
- 'আইচ্ছা বউমা যাইতেচি, এই হুকায় দুইডা টান মাইরা নই।'
-' হুকা সাথে কইরা নিয়া যান, রাস্তায় বইসাই টানবেন, যান তাড়াতাড়ি..।'
নিরুপায় বিনোদ শুকনো মুখে টায় টায় উঠে চলে গেল রাস্তার দিকে।বুড়ো মানুষ বোঝার মতো সংসারে।ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে।কানাকড়িও দাম নেই, তবু ভগবান কেন যে ফেলে রাখে!
ঊষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বশুরের চলে যাওয়া দেখতে লাগল।নিজের ব্যবহারে নিজেই পুড়ে যেতে লাগল ভেতরে ভেতরে কিন্তু উপায় নেই একটা সুযোগ চাইছিল সে। শ্বশুর থাকলে তা কোন ভাবেই সম্ভব হতো না,পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষকে চলতে হয় - কখনো নরম কখনো গরম।
শ্বশুর চোখের অদৃশ্য হতেই ভেজানো দরজাটা ফটাস করে এক ধাক্কায় খুলে ঘরে ঢুকে গেল। সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালো গুরুদেবের বিছানার সামনে। গুরুদেব উল্টো দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে।বড়ো বড়ো চোখে আস্ত গিলে খেতে লাগল গুরুদেবকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।ফণা তুলে শুধু ফুস্ ফুস্ করতে লাগল। যেন বিষ দাঁতে বিষ ভরার সময় নিচ্ছে ঊষা, উপযুক্ত সময় এলেই ছোঁবল মেরে বসবে।
--কই আপনের চোহে কি ভগবান একটুও লজ্জা দেয় নাই?... না আপনের জন্মের ঠিক নাই?...বেহায়া বজ্জাত শয়তান বুইড়া,স্বামী স্ত্রীর মিলন লুকায় দেহা আপনের মায় শিখাইচে তাই না।ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাববারই পারি না এমন বেজন্মা মানুষও জগতে আচে, ছিঃ....। '
একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল-
--' পষ্ট কথা কইতেচি আমার বাড়ি আর একমুহূর্তও থাহা চলব না, টুপলা টুপলি নিয়া আজই চইলা যাইবেন, আপনের মতো মাইনষের মুখ দেহাও পাপ.....।'
গুরুদেবের কোন হেলদোঁল নেই, এতকিছু বলে গেল ঊষা কিন্তু দেখো কেমন নির্লজ্জের মতো পরে আছে এখনো ।ঊষার মাথায় রক্ত উঠতে লাগল গুরুদেবের হেলদোঁল না দেখে।এই রাগের সময় কেউ প্রতিত্তোর না দিলে রাগ আরও বাড়ে।ঊষার অবস্থাও তাই, থাকতে না পরে দু'হাতে গুরুদেবকে এক ঝটকায় এদিকে ঘুরিয়ে দিল। পারলে বোধয় বুকের উপর উঠে কিল-ঘুষি মারা শুরু করে।
-- 'ওই ওওওওওওওই তোর কি কানে ডুকে না আমি কি কইলাম, তুই এহনি বাইর হইয়া যা আমার বাড়ি থিকা, নইলে ঝাটা আইনা ঝাটা পিটাই বাইর কইরা দিমু...।'
ঊষা আরও এমন সব ভাষা বলছিল যে তা ভাষা প্রকাশ না করাই ভালো , খেদ উঠে গেছে, মুখে ফেনা উঠার জো কিন্তু গুরুদেব চৌকি থেকে নেমে ঊষাকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল দুহাতে।বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন গুরুদেব। চোখের জল ঝর্ণার মতো বেয়ে পরতে লাগল ঊষার গলার কাছে।গুরুদেবের শরীর আগুনের মতো পুড়ে যাচ্ছে আর চোখে শ্রাবণ। ঊষাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই ভেজা সুরে গুরুদেব বললেন-
- আ আ আ আমি এহনি চইইইলা যাইতেচি।'
ঊষাকে ছেড়ে দিয়ে সেই অশ্রুপূর্ণ নয়নে নিজের ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে গেলেন।
গুরুদেবের অমনভাবে জড়িয়ে ধরা এবং চোখের জলে ঊষা হতভম্ব হয়ে গেছে।কি হলো এটা! এত গালাগালির পরেও অমন করে জড়িয়ে ধরতে পারলেন?ঊষা যতটা রাগ নিয়ে ঘরে এসেছিল তার সিকিও এখন তার মধ্যে নেই। কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুরুদেবকে তার নিজের কাজ করতে দিয়ে কখন যে এসে এরুমে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে এসব ভাবছে ঊষা কিছুই জানে না।
ভাবনার জগতে ছেদ পরল বাইরে শ্বশুর ও আর একজনের গলার আওয়াজ পেয়ে।বাইরে বেরিয়ে ঊষা দেখল -
মন্টু এসেছে।ঊষার দিকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল- বউমা গুরুদেব কি করতেচে? ডাক দাও তো দেহি একটু দরকার আচে।
ঊষা থতমত খেয়ে গেল এখন উপায়, গুরুদেব যে.......।ঊষা দাঁড়িয়েই আছে দেখে বিনোদ বলল - মন্টু বইসো বারান্দায় উইঠা..বউমা গুরুদেব উঠচে নাকি ডাক দাও....।
- উম্ম, হ বসেন।
মন্টুর দিকে তাকিয়ে ঊষা ছুঁটে গেল ঘরে, দেখল গুরুদেব ব্যাগ বুকের কাছে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো মন্টুর গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে যেতে সাহস পাননি।ঊষা ফিসফিস করে বলল- 'মন্টু কাকা আইচে,আপনেরে ডাকে..।'
বলেই ঊষা বাইরে বেরিয়ে এলো।মন্টুকে উদ্দেশ্য করে বলল-
- আপনে বসেন উনি আসতেচে..।
একদম স্বাভাবিক ঊষার গলা। কেউ বুঝতেই পারবে না একটু আগে কি ঘটেছে। কিন্তু গুরুদেব পরলেন বিপদে।এখানে যে আর একমুহূর্তও থাকা চলে না।তবুও চোখের জল মুছে লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।মন্টু প্রণাম করে একটু হাসি মুখে বলল--
- কেমন আচেন গুরুদেব,আপনে তো আর ওদিকে যাওয়ার সময়ই পান না।
- আছি ভালোই,ওই শরীরডা হাল্কা ম্যাচম্যাচ করতেচে..।
- সামনে পুন্নিমা না শরীল ব্যথা অল্পটল্প
হইবই।
বলেই মন্টু ঊষার দিকে তাকালো।বলল-
- 'তা বউমা অজয় রে দেহি না বাড়ি..।'
-- বাজারে গেচে উনি, টিন কিনবার.।
বলেই ঊষা সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল।
মন্টু ঊষাকে থামিয়ে বলল।
- একটু দাঁড়াও বউমা, অজয় যেহেতু বাড়ি নাই তোমারেই কইয়া যাই...।
এবার গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল-- 'গুরুদেব ম্যায়ার বিয়া তা তো আপনেরে কইচিই।'
- 'হুম'
-- তা বিয়ায় কি কেমন লাইগব এর জন্য আইজ সন্ধ্যায় গিরামের সবাইরে ডাকচি আলোচনার জইন্যে।তা আপনের যাওয়া নাইগব।
ঊষার দিকে ফিরে - বউমা অজয়রেও যাইবার কইও।
গুরুদেব একটু চিন্তা করে বললেন- -বুঝচাও মন্টু শরীলডা তো খুব একখান ভালো না, তাই তোমরা তোমরাই কাজডা সাইরা নিও।
- তা কি কইরা হয়, ও শরীল ঠিক হইয়া যাইব,আমি ওষুধ আইনা দিমুনে ভোম্বল ডাক্তারের থিকা, দুই ডোজ খাইলেই দেখপেন সব ঠিক...।
এতক্ষণ পরে বিনোদ বলল-' তা আর কইতে ভোম্বলের হাতের গুণ ভালো বুঝচেন গুরুদেব, কিন্তু বেটায় টাহা নেয় বেশি , এক কাশের সিরাব আনচিলাম ৩০ডা টাহা গুইনা গুইনা নিল চামারে, আর যাই না, না কইমল অমন কাশ......।
বলেই খক্ খক্ করে দুবার কেশে নিল বুড়ো। ঊষার পিন্ডি চটকে যাচ্ছে শ্বশুরের কথাবার্তায়।মন্টু একটু ধমকের সুরে বলল- - আরে রাহো তোমার খক্ খক্, বিনি পয়সায় তুমারে সব দিবেনে।'
এবার গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে একটু জোর দিয়েই মন্টু বলল-- - তা ওই কথাই রইল গুরুদেব, আপনে যাইয়া খালি বইসা থাইকপেন বুঝচেন, তাও যাইবেন কইয়া দিলাম।
......আইচ্ছা উটি আমি আরও দুই-এক বাড়ি কওয়া লাইগব... বউমা অজয় আইলে কইও কিন্তু.......আসি গুরুদেব।'
বলে আবার প্রণাম করে মন্টু চলে গেল।
বিনোদ বুড়োও মন্টুর পেছন পেছন চলে গেল রাস্তায়।
গুরুদেব ঊষার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে রুমে গিয়ে ব্যাগটা সেই আগের মতো বুকে জাপটে ধরে বেরিয়ে এলো মাথানিচু করে।বেরিয়েই যাচ্ছিলেন প্রায় তখনই ঊষা হাত টেনে ধরল।ধমকে উঠল ঊষা
- 'কই যান?উনি কি কইয়া গেল শুনেন নাই?.... তাছাড়া উনি(অজয়) বাড়ি ফিরলে কি জবাব দিমু,উম্মম?
গুরুদেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ঊষার মুখের দিকে।ঊষা সেই আগের মতোই বলতে লাগল,কিন্তু এবার একটু নরম স্বরে
-'যান ব্যাগ ঘরে রাইখা আসেন,তারপর খাইয়া নেন।'
গুরুদেব নড়ছেন না দেখে জোর করেই ঊষা ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ঘরে রেখে এসে গুরুদেবের হাত টেনে নিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করল।
ভাত বেড়ে নিল নিজের জন্য এবং গুরুদেবর জন্যও।ভাতের থালা সামনে দেখে এতক্ষণে গুরুদেবের চোখে জল চলে এলো।মনে যতটা জ্বালা, পেটেও সেই পরিমাণ জ্বালা।পেটের জ্বালা হয়ত ভাত খেলেই নাই হবে কিন্তু মনের জ্বালা?গুরুদেবের চোখে জল দেখে ঊষার মনটাও কেঁদে উঠল। কত কিই যে বলে ফেলেছে তখন । দুনিয়ার কত লোক উনাকে শ্রদ্ধা করে আর এ বাড়িতে এসে!মন্টুর জন্য যে শুধু গুরুদেবকে আটকেছে যেতে দেয়নি ঊষা তা কিন্তু নয়।ঊষার কোথাও যেন একটা অনুশোচনা, দরদ কাজ করছিল গুরুদেবের জন্য।কারণ এ কদিন যা কিছু ঘটেছে হয়ত প্রথম দিকে গুরুদেবই সবকিছুর জন্য দায়ী কিন্তু গতকালের ঘটনায় উনার সেই অর্থে কোন দোষ ছিল না, দোষ ধরতে গেলে তার, এবং কিছুটা তার ছেলের।গুরুদেবে ভাতের থালা সামনে নিয়ে কাঁদছেন,ইসসস।
- 'আপনে কান্দেন ক্যা? খুব কষ্ট পাইচেন আমার কথায়? আমারে ক্ষমা কইরা দেন।'
এবার যেন গুরুদেব আরও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।দুঃখের সময় ভরসা পেলে মানুষ মন খুলে কাঁদে।ঊষা উঠে এসে গুরুদেবকে জড়িয়ে ধরল।গুরুদেব ঊষার গলায় মাথা রেখে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন-
-- তুই আমারে যাইতে দিলি না ক্যান? আমি যে আর সইতে পারি না, আমারে যাইতে দে.....।
-- 'আহহ খাইতে বইসা কান্দে না, আসেন আমি খাওয়াই দিই।'
ঊষা নিজে হাতে গুরুদেবকে খাইয়ে দিতে লাগল।গুরুদেবেও আস্তে আস্তে ভাতের দলা মুখে নিয়ে চিবতে লাগল।এভাবেই সমস্ত মান অভিমান, রাগ-ক্ষোভ কর্পূরের মতো উবে গেল মুহুর্তে।হয়ত কিছুটা নিজগুণে একে অপরকে ক্ষমা করে দিল অথবা সম্পূর্ণ কোন দৈবগুণে একে অপরের দোষগুণ ভুলে কাছে চলে এলো।
Mrpkk