01-11-2024, 07:52 AM
(This post was last modified: 01-11-2024, 07:59 AM by বহুরূপী. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পর্ব ৩১
মেয়ে মজলিসে আজ একজন নতুন ছিল।তিনি মাসখানেক বাপেরবাড়ি ঘুরে আজ সকালে এসে পৌঁছেছে।তাই নয়নতারার সাথে কৃষক পল্লী কয়েকজন দল বেধে যাচ্ছে দামিনীর সাথে তার পরিচয় করাতে। যদিও দলবেঁধে যাবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সে নিজে একা গিয়েই উঠতে পারতো সঞ্জয়ের বাড়িতে। ইনি এই গ্রামেরই লোক অচেনা কেউ ত নন।
— মেয়েটার বয়েস কত?
– ওই ত আমাদের নয়ন'দির মতোই।
আগে আগে নয়ন ও আরও কয়েকজন মেয়ে বউ হাটছে।তার একটু পেছনেই আরো কয়েকজন।বোধকরি এমন আলোচনা নয়নতারা সমুখে করার উপায় নেই বলেই দলের এমন ভগ্ন দসা।
একজনের কথা শেষ হতেই তাদের সকলে সমস্বরে আবার একটা বিস্ময়ের রোল তুললো,যদিও একথা অনেকেরই ইতিমধ্যে জানা। তাদের মধ্যে অনেকের ভাবনাই এমনটি যে;এমন ধারি মেয়ে আইবুড়ো থাকে ঘরে! এ আবার কোথাকার জাত? রামোঃ..ছিঃ,
— তাহলে আর মেয়ে কোন মুখে, মাগী বল! পাঁড় শসা বাপ-মা বুঝি ঘরে বীজ রেখেছিল!
অল্পক্ষণের জন্যে দলের সবার মাঝে হাসির রোল উঠলো। হাসি খানিক থিতলেই একটি কমবয়সী বধূ বলে উঠলো,
– যাই বল কাকিমা! মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ।
তার কথার রেশ টেনে আর একজন বলল,
– তা আর বলতে,এক্কেবারে মায়াবতী। কথা তো নয় যেন মুখ থেকে মুক্ত ঝরছে সারাক্ষণ।
যাকে উদেশ্য করা কথাগুলো বলা হইল,সে হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,
– তা সেই দেখতে ভালো হবে না ত কি তোরা হবি? ও মাগী কি আর পাড়াগাঁয়ের,সে হল শহরের মেয়ে, দিনরাত সাবান-পাউডার ঘষছে, আমাদের মতো রাঁধতে হতো, বাসন মাজতে হতো, তো দেখতাম চেহারার কত জলুস বজায় রাখে।
যিনি কথা গুলো বলছিলেন,তার এই বয়স ত দূর, বিগত যৌবন দিনেও অজস্র পাউডার সাবান ঘষলেও যে কখনো তিনি দামিনীর পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারতেন, এই কথা কারোরই ঠিক বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া আমাদের নয়নতারা ত প্রতিদিন এই করছে। তাই বলে তার রূপের ওপড়ে কোন মন্দ প্রভাব ত কে পরিতে দেখে নাই। তবে কিনা একথা বলিলে হিতে বিপরী হতে পারে, তাই সবাই চুপ মেরে হাটাহাটিতেই মনোনিবেশ করল।তবে নয়নের পেছন পেছন বৈঠক ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতর উঠনে পা দেবার সাথে সাথে সবাইকেই অবাক হতে দেখাগেল।
বারান্দায় হেমলতা আজ সকালে আনা মাছ কুটতে বসে। তবে এটি অবাক করা বিষয় নয়।সবার দৃষ্টি তখন কলঘরের দিকে। যেখানে কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে কলিকাতার মেয়ে সৌদামিনী একরাশ বাসন নিয়ে বসে। বলা ব্যাহুল পথে যার এই বিষয়ে আলোচনা করিতেছিল,এই দৃশ্য দেখার পর তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজেদের মনেই সন্দেহের উদয় হল। কলঘরে কলিকাতার রূপসী ছাই দিয়ে নিটোল সুগৌর হাতে বাসন মাজছে,এ দৃশ্যটা ঠিক যেন খাপ খায় না। বলতে গেলে শহরের মেয়েদের সম্পর্কে তাদের ধারণা যা ছিল তার সাথে এই দৃশ্যের বিশেষ মিল নেই বললেই চলে।সুতরাং সকলের কাছেই এটা খাপছাড়া বলে মন হলো। তবে তাদের মধ্যে নয়নতারা রিতিমত চটে গিয়েছে। সে বাবুকে উঠনে নামিয়ে এগিয়ে গিয় দামিনীর ডান হাতটি চেপেধরে বলল,
– কি হচ্ছে কি এসব? ওঠো বলছি!
দামিনী উঠলো ঠিকই তবে নয়নতারাকে সরিয়ে আনার জন্যে। এদিকে দুজনের রেশারেশিতে বেখেয়ালে নয়নতারার কাধের আঁচল খানিকটা গেল সরে।ভাগ্যক্রমে দামিনীর দৃষ্টি সেখানেই আটকে গেল।নয়নের কাঁধে তখনও গতরাতের মিলনের চিহ্ন চিহ্নিত আছে। এতখন যা আঁচলের আঁড়ালে ছিল। এখন বেখেয়ালে তা দামিনীর চোখে পরতেই নয়ন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যাপারখানা বুঝে নিয়ে, চটজলদি আঁচল টেনে সেটা আঁড়াল করল। দামিনীর মুখভঙ্গি দেখে নয়নতারা বুঝলো কিছু একটা বলা দরকার, কিন্ত তার আগেই ভেতর বারান্দার দিক থেকে তার স্বামীর ডাক ভেসে এল।
– নয়ন!
সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে তারা দু'জনেই দেখলো সোহম আজ বিছানা ছেড়ে একাই হেটেই বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। সোহম বেচারা মার কম খায়নি, তার ওপড়ে রোগাটে দেহের গঠন হওয়াতে মারের আঘাত সামলে উঠতে বেশ সময় লেগেছে তার। স্বামীকে একা বেরুতে দেখে নয়নতারা ব্যস্ত হয়ে ছুটলো সে দিকে,
– একি! তুমি উঠে এলে যে, একবারটি ডাকলে হতো না?
নয়নতারার যাবার পথে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল দামিনী। মনে মনে কি ভাবলো তা বোঝা গেল না।
সোহম বারান্দায় সিঁড়ির ধাপে বসেছিল। তবে মেয়ে মজলিসের সামনে শুধু হাতে বসে থাকা যায় না। বিশেষ করে যখন প্রায় সবারই আকর্ষণ তার ওপরই কেন্দ্রীভূত। সঞ্জয় খবরের কাগজ পড়ে না। তাই মেয়েদের নজর এরিয়ে যেতে বিশেষ কিছু হাতে না পেয়ে নয়নতারার একখানা বই চেয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সে। এমন সময় নয়নতারা বিছানা ঝেড়ে শয়নকক্ষের বাইরে পা দিয়েছে। তাকে দেখেই একজন বয়স্ক মহিলা সরাসরিই বলে বসলো,
– বলি কার ঘরের সিধ কাটতে গিয়েছিল'রে তোর সোয়ামি! ইসস্.. মেরে এক্কেবারে হাড়মাস গুড়িয়ে দিয়েছে...
শুনে কয়েকজন প্রকাশে ও কয়েকজন মুখে আঁচল চেপে হাসতে লাগলো। আলোচনা হয়তো আরো এগুতে পারতো। কারণ গোপন বিষয়ে আলোচনায় রসবোধ ও আগ্রহ দুই সহজেই মনে আসে। কিন্তু সুযোগ মিলল না। মোক্ষম সময়ে গ্রামের গণমান ব্যক্তি চরণ ঘোষের আগমনে মেয়ে মজলিসের সকলেই একটু নড়েচড়ে বসলো। বিশেষ করে কম বয়সী মেয়ে বউদের কেউ কেউ সোজা রান্নাঘরে ভেতরে ঢুকে দুয়ারের আঁড়ালে লুকালো।
চরণ ঘোষ বসতে পারতেন, তবে বসলেন না। সোহম এ কদিনে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিল।চরণ ঘোষ সোহমের সাথে কথা আছে বলে ও দেবুকেও যদি বা প্রয়োজন পরে তাই সঙ্গে করে শন্তুর চায়ের দোকানে রওনা দিলেন। এদিকে নয়নতারা কাজে হাত লাগাতে গেলে সৌদামিনী তাকে বাধা দেয়।তখন নয়নতারা দোতলা থেকে ঘুরে এসে নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে শুয়ে পড়লো। বোধকরি ক্লান্ত দেহে ঘুমও এল সঙ্গে সঙ্গেই।
নয়নতারা ঘুম ভাঙলো দূপুর গড়িয়ে গেলে। বারান্দায় পা দিয়েই সে দেখলো, হেমলতা সবে রান্না সেরে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। এটি দেখে নয়ন অস্থির হয়ে ওটে। নয়নতারা নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না দুজন রান্নাঘরে থাকার পরেও রান্না এতো দেরি কি করে হয়! অবশ্য কারণ জানবার পর নয়নতারা রীতিমতো শিহরিত।
দুপুরে রান্না করবার সময় বেখেয়ালে গরম ডালের পাত্র উল্টে সৌদামিনীর পা'য়ে লেগেছে। হেম ও সৌদামিনী আজ বাড়ির দায়িত্ব নেওয়াতে নয়ন একটু চোখ বুঝিয়ে ছিল রাতে ঘুম হয়নি বলে। উঠতে উঠতে দুপুর গড়িয়ে গেল,আর তার মধ্যেই এমন কান্ড। হায় ভগবান!
সৌদামিনীর বড় উৎসাহ ছিল আজকে রান্নাবান্না নিয়ে। তবে উৎসাহ নিমিষেই মাটি হলো কয়েকটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনায়। সকালে নয়নতারার ঘাড়ে সেই দাগ গুলো হঠাৎ কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিল তার। তবে পরক্ষনেই সঞ্জয়ের দাদা ঘর থেকে নিজে হেটে বেরিয়ে আসায় বিষয়টি বুঝতে দেরি হয়নি তার। তাই সে নিঃসন্দেহে আবারও কাজে লাগে এবং মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করে। এমনিতে বাড়ির সব কাজ সেরে নয়নতারা রান্নাঘরে ঢোকে।তবে আজ নয়নকে ওভাবে ঘুমাতে দেখে সৌদামিনী নিজ হাতেই সব কাজের দায়িত্ব তুলে নিল। সব কাজ শেষে সৌদামিনী গেল সঞ্জয়ের ঘর গুছাতে,অবশ্য এই কাজটি হেম নিজেই করতে চাইছিল। তবে সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে তালা দেওয়া,চাবি নয়নতারার আঁচলে। যদিও নয়ন তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তবুও হেমলতা মন দিদির আঁচল থেকে চাবি গোছা খুলতে সায় দিল না। তবে দুয়ারে তালা ঝূলছে দেখে দামিনীর আগ্রহ বেড়ে গেল। সে খুব সহজ ভাবেই নয়নতারার শয়নকক্ষে ঢুকে আঁচল থেকে চাবি গোছা খুলে উঠে গেল দোতলায়।
এই পর্যন্ত সৌদামিনীর মন ছিল চঞ্চল,আনন্দময়। সঞ্জয়ের ঘরে আজ সে নিজ হাতের ছোঁয়া লাগাবে। পছন্দের মানুষটির ঘর সাজানোর সুযোগ পেলে খুশি হবারই কথা। তবে দুয়ার খুলে সে যখন সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে ঢুকলো,তখনও দামিনীর জানা ছিল না তার জন্যে ঠিক কি অপেক্ষা করছে।
নয়নতারা ঠিক ভেবে উঠতে পারেনি তার আঁচল থেকে কেউ চাবি নিয়ে সঞ্জয়ের ঘরের তালা খুলতে পারে। এদিকে গতরাতের স্মৃতি সরূপ সঞ্জয়ের বালিশে ও এলোমেলো শয্যায় যা ছিল, তা আঁড়াল করতে সঞ্জয়ের ঘর গুছিয়ে চাদর ও বালিশের কভার পাল্টে দিয়েছিল সে। তবে আগেই বলেছি,নয়ন ভাবেনি চাবি নিয়ে কেউ তালা খুলতে পারে।তাই সব কিছু একত্রিত করে শয্যায় নিচের দিকে মেঝেতে দলা পাকিয়ে রেখে দিয়েছিল সে।তারপর মন কেমন করায় সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে সে তালা দেয়।কারণ আজ সকল কাজ তার ছোট্ট বোনটি ও দামিনী করছে।সুতরাং এই ঘরে তাদের আনাগোনা যেন ঘটে তাই এই ব্যবস্থা। তবে ভাগ্যদেব নয়নতারা সহাই ছিল না এইবারে,তাই এই দৃশ্য দামিনীর নজর এড়িয়ে গেল না। গোছানো ঘরে দলা পাকানো চাদর মেঝেতে পরে আছে এই দৃশ্য তাকে বিশেষ করে আকর্ষণ খরলো। তারপর ওগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সঞ্জয়ের বালিশে লাল সিঁদুরের দাগ জানালার দিয়ে আসা রোদের আলোয় অতি স্পষ্ট ভাবেই দেখা গেল।
//////
আজ সকল দোকানপাট খুলেছে আগে আগে। সঞ্জয়েরও তাই। আজ কোন কারণ বসতো তার বন্ধুটি আসে নি।লোক পাঠিয়ে খবর নেওয়া চলত যদি না আজ হাটবার হতো।
দুপুরের দিকে বাজারে পরিবেশে একটু শান্ত হলে সঞ্জয় তার অন্য দোকানটায় গেল খেতে। এই ব্যবস্থা নতুন চালু করা হয়েছে। আগে ভাত রাধবার ব্যবস্থা তাদের ছিল না। এখন বোধহয় ওটিকে আর মিষ্টির দোকান বলা চলে না,হোটেল বলতে হয়। সঞ্জয়ের হোটেলটি ঘাটের কাছাকাছি। অবশ্য এতটা তার যাবার দরকার ছিল না। সেখানে লোক আছে,কেউকে দিয়ে খবর দিলেই পাঠিয়ে দিত। কিন্তু সঞ্জয়ের একটু হাটাহাটি করার প্রয়োজন ছিল। সেই ফাঁকে হোটেলের হাল অবস্থায় দেখে আসবে এই তার উদ্দেশ্য।
দোকান ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে যেতেই ডান পাশের এক হোটেল থেকে অতুল চক্রবর্তীর ডাক পরলো।
– আরে কী ব্যাপার! বাড়ি যাও নি আজ?এদিকে এসো কথা আছে!
হোটেল ওয়ালা সঞ্জয়ের চেনা। বৌদিমণি আসার আগে প্রতিদিন দুপুর ও রাত্রিতে সঞ্জয়ের এই হোটেলের এক রকম বাধা খদ্দের ছিল। ডাক শুনে সঞ্জয় এগিয়ে গেল। হোটেলের সমুখে আসতেই সঞ্জয় বুঝলো হাট ঠান্ডা হলেও হোটেলের অবস্থা সরগরম। বেলা দুপুরে প্রায় সকলেই খেতে বসেছে। হোটেল মালিকের গদিতে বসে সঞ্জয় বলল,
– কিছু বলবে অতুল কাকা? আগেই বলে রাখি আমি বেশিক্ষণ বসবো না। এমনিতেই হাট বার, তার ওপড়ে পুলকটাও এল না। এখন এমন অবস্থায় গল্প করির সময় নেই আমার।
– বুঝেছি বুঝেছি আর বলতে হবে না। অ্যায় গদাই এদিকে..!
– আরে না! না! কি করছো আমি..
– আরে বসো বসো, এতো উতলা হলে চলে?
অতুল চক্রবর্তী সঞ্জয়ের কোন কথা না শুনে তাকে একরকম জোর করেই খেতে বসিয়ে দিল। প্রতিদিন বৌদিমণির হাতের যাদু মেশানো সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে আজ হঠাৎ সঞ্জয়ের হোটেলের খাবার বিশেষ ভালো লাগলো না। কিন্তু উপায় কি? সঞ্জয় অনেকখন দেবুর জন্যে অপেক্ষা করে তবেই হোটেলে এসেছে খেতে। দেবুটাও আজ এল না।দেবু এলে সে বাড়িতে পাঠাতৈ খাবার আনতে। যাক সে কথা,খাবার পর্ব চুকিয়ে একটুখন জিরিয়ে নিয়ে সঞ্জয় বেরুলো ঘাটের উদেশ্যে। যেতে যেতেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। দেখবার মতো যদিও নতুন কিছুই নেই। হা নতুন মানুষজন অনেক আছে। তবে কি না এদের সবার পরিচয়ে সেই চির চেনা ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া আপাতত অন্য কিছু বলা চলে না। কারণ এখানকার সবাই মূলত একজন কিনতে ও অন্যজন বেচতে এসেছে।
তবে নিত্যকার বাজার হোক্ বা সপ্তাহে একদিনের হাট হোক্ বিক্রেতা ও ক্রেতা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একে ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ন। তাই তো সকাল হতেই বিক্রেতা তার পসরা সাজিয়ে বসে অপেক্ষায় থাকে!তেমনি ক্রেতাদেরও অপেক্ষা থাকে বৈকি কতক্ষনে দোকান বাজার হাট চালু হবে! তবে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যে শুধুমাত্র বিকিকিনির সম্পর্ক থাকে সবসময় তাও কিন্তু নয়!প্রতিদিনের বাজারে বা সপ্তাহের একদিনের হাটের দেখাশোনাতে অনেকের সাথেই বেশ একটা অম্লমধুর সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়!মনে পরে সেই দেবীপুর থেকে রতন জেলে আসে চুনো মাছের ঝাঁপি নিয়ে।অমুল্যদা বসে বড় মাছ নিয়ে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পরে গত হাটবারে রতন জেলে বলেছিল তার ছেলের জ্বরের কথা। একবার মাছের বাজারে একটা চক্কর না দিলেই নয়।
হোটেলের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ মাঝিপাড়ার এক জনের সাথে দেখা। সঞ্জয়কে দেখেই সে সম্মানের সহিত তাকে আমন্ত্রণ ছানিয়ে ঢুকলো একটা চায়ের দোকানে। দোকানে আরোও দু একজন যারা ছিল,তারা সঞ্জয়কে পেয়েই গতরাতের আলোচনার রেস টানলো।এতে সঞ্জয়ের বিরক্ত হাওয়া ছাড়া উপায় কি! আজ এমনিতেই খাওয়া দাওয়া ভালো না হয়াতে তার একটু মেজাজ বিগড়ে আছে। এখন সকালের কথা মনে হতেই সঞ্জয়ের রাগ বেরেগেল। তার দাদাকে ও তাকে কে বা কারা মেরেছে এটি সঞ্জয়ের বোঝার বাকি ছিল না। দাদাকে কেন মেরেছে এটি সঞ্জয়ের ভালো বুঝতে পারলো না।হেমকে নিয়ে পালানোর জন্যেইকি রাগের মাথা এই কির কোরে বসেছে খোড়া গোবিন্দ লাল!
যা হোক তার দাদা এখন সুস্থ, তাই দাদার ব্যাপারটা বাদ দিলেও সঞ্জয়ের ব্যাপারটা আপাতত গুরুতর। যদিও তার দাদা মার খেয়েছে বেশি তবুও! কারণ সঞ্জয়ের ব্যাপারটা সম্মানের।কেউ তালদীঘিতে এসে তাকে মেরে চলে যাবে এবং আক্রমণকারীদের চিনেও সঞ্জয় চুপ করে বসে থাকবে! এতে সঞ্জয়ের সম্মান ঠিক কতটুকু কমে নয়নতারা সে বিষয়ে জানে না। তা নাহলে ওমন দিব্যি কে দেয় কা কে!
///////
সন্ধ্যায় নয়নতারা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে সৌদামিনীর খোঁজ নিতে ভেতর ঘরের দুয়ারের সমুখে দাঁড়ায়। মেয়েটার ডান পা'টা খানিক পুরেছে,হাতেও লেগেছে একটু। তবে পায়ের পোড়াটাই বেশী।আপাতত বেশ কিছুদিন ও পা নিয়ে হাটাচলায় বেশ কষ্ট হবে তা বোঝা যায়।
ভেতর ঘরে শয্যার পাশে মেঝেতে হেমলতা কি যেন সেলাই করছিল। নয়নতারার মেয়ে মন্দিরা ও কৃষক পল্লীর একটি বালিকা সৌদামিনীর পাশে বসে গল্প শুনছে। সৌদামিনীকে আবারও হাসিখুশী দেখে বেশ ভালো লাগলো নয়নতারার। দুপুরে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। তবে অনেক গুলো বিষয়ে আলোচনা অতি শীগ্রই সৌদামিনীর সাথে করা জরুরি। তবে সবার সামনে সেই আলোচনা সম্ভব নয়। তাই এখন ভেতরের অবস্থা দেখে নয়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সরে পরে।
সঞ্জয় ফেরে একটু রাত করে। দোতলায় খাবার নিয়ে গিয়ে নয়নতারা বসে সঞ্জয়ের সমুখে।
– তোমার দাদার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবলে?
– আমি ভেবে দেখেছি বৌদিমণি,তবে দাদাকে কাজে বসাতে ভয় হয়। কোন কাজই তো তার বেশিদিন সয় না।
– তা বলে কি আজীবন ঘরে বসে থাকবে,এই কি চাও তুমি?
– আহা বৌদিমণি! রাগ করছো কেন? তুমি চাইলে কদিনের ভেতরে দোকান খুলে দাদাকে বসিয়ে দেওয়া চলে। তবে দাদার ইতিহাস তো তোমার অজানা নয় বৌদিমণি! জুটমিলের কাজ কিভাবে হাত ছাড়া করলো সে কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। তারপর তোমার বাবার ব্যবসাটার কি হাল হলো দেখলে তো।
নয়নতারা সঞ্জয়ের কথা শোনে আর ভাবে। কিন্তু শুধু ভাবলে কি হয়! তার স্বামীর স্বভাব সে ভালোই জানে। তবে তাই বলে এভাবে ছোট ভাইয়ের সংসারে অকর্মণ্য হয়ে পরে থাকবে তার স্বামী? না না তা কি করে হয়!
– সেই যাই বল তুমি ঠাকুরপো,তোমার দাদার একটা ব্যবস্থা তোমায় করতেই হবে।
সঞ্জয় খাওয়া সেরে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়।নয়নতারারও উঠে দাঁড়ায় তার সঙ্গে সঙ্গেই। সঞ্জয় তার বৌদিমণিকে কাছে টেনে শাড়ির আঁচলে মুখ হাত মুছে নেয়। তারপর নয়নতারার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– সে না হয় করলাম, কিন্তু দাদাকে কে রাজি করাবে শুনি?
– কেন! আমি করাবো, এছাড়া আর কে আছে বল?
সঞ্জয় নয়নকে তার বুকে চেপেধরে ডানহাতে গাল টিপে দিয়ে বলে,
– কি উপায়ে রাজি করাবে শুনি? আমাকেও একটু দেখায় না, নইলে ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না।
নয়নতারা ইশারা বুঝে নিয়ে ঠাকুরপোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।তবে সঞ্জয় এত সহজে ছাড়বে কেন! সে নয়নকে ঠেলে নিয়ে একদম দুয়ারের কাজে দেয়ালে ঠেসে ধরে।
– ইসস্.. ঠাকুরপো ছাড়ো এখনো! ওমন ছেলেমানুষী কোর ন...“অম্ম্ম্ম…”
নয়নের মুখের কথা মুখেই থেকে যায়।তার বদলে সঞ্জয়ের ঠোঁট দুটো নয়নতারার পাতলা পাতলা ঠোঁট দুটিকে বন্দী করে চুষতে থাকে। সেই সাথে দুহাতে কাঁচুলির ওপর দিয়ে টিপতে থাকে নয়নতারার দুধেল দুধগুলো।
রাতে খাওয়া দাওয়া পরে হেমলতাকে সাজাতে বসল সৌদামিনী। তবে সাজটা খুব অসাধারণ কিছু নয়। খুবই সাধারণ একটি ডুরে শাড়ি,কোমরে বিছা সেই সাথে খোঁপা করা চুলে একটি সোনার কাটা ও দু'পায়ে মল। অবশেষে কি একটা সুগন্ধি শরীরের মাখিয়ে দামিনী হেমলতার গলা জড়িয়ে ধরে শয্যায় একপাশে বসে বলল,
– আচ্ছা ভাই সত্য করে বলতো গতকাল কিছু হয়েছে তোদের মাঝে?
প্রথমটায় দামিনীর এই প্রশ্ন হেম বুঝে উঠতে পারলো না। সে অবাক হয়ে দামিনীর মুখপানে চেয়ে রইল। হেমলতার অবাক দৃষ্টি দেখে সৌদামিনী এবার আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা শুরু করল,
– আচ্ছা মেয়ে ত তুই হেম! বলি গতকাল সোয়ামি তোর গুদে গাদন দিয়েছে কি নি বল?
হেমলতা এমন প্রশ্ন আশা করেনি। যদিও সে দামিনীর সহিত তার সম্পর্ক এখন অনেক খোলামেলা। তবুও হেমলতার অস্থির অস্থির লাগে এমন প্রশ্নে। তার মুখে তৎক্ষণাৎ কোন জবাব আসে না। উত্তর দিতে দেরি হওয়াতে সৌদামিনী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
– কি হল! বল, কিছু হয়েছে তোদের মাঝে?
সৌদামিনীর উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরের সাথে গম্ভীর মুখভঙ্গি হেমের মনে ভয়ের আবির্ভাব ঘটে। ঠিক কি কারণে হঠাৎ এমন প্রশ্নের দ্বারা তাকে আক্রমণ হেমলতা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ভয়ে ভয়ে সে শুধু দু'দিকে মাথা নেড়ে বলে না।
সৌদামিনী খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হেমলতার মুখপানে চেয়ে থাকে। তারপর একরকম জোর করেই হেমকে শয়নকক্ষের বাইরে বের করে আনে সে। বাইরে এসে ভারাক্রান্ত হেমলতার দিকে কড়া চোখে তাকিয় কঠিন গলায় বলে,
– সোজাসুজি দোতলা স্বামীর ঘরে যাবি।
– কি-কিন্তু....
কথা শেষ হয় না, তার আগেই দামিনী হেমলতার চিবুকখানা ডানহাতে তুলে ধরে আগের মতোই দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– স্বামীর সাথে একঘরে নাইবা থাকলি। তাই বলে তার সাথে খানিকক্ষণ গল্প করেসময় কাটানোতে কি ক্ষতি আছে শুনি? তোর ভালোর জন্যে বলছি হেম,কথা শোন।
কথা শেষ হতেই হেমের মন হয়,সৌদামিনী পোড়া পা নিয়ে যেমন ছোটাছুটি করছে! হয়তো আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালে দামিনী নিজেই বুঝে তাকে টেনে নিয়ে দোতলায় উঠবে এখনি। হেম একটু চাপা স্বভাবের বলে দামিনী তাকে নিয়ে মজার করে।এটি হেম নিজেও বোঝে। কিন্তু তাই বলে সে রেগে যায় না। কারণ সে দামিনীকে পছন্দ করে। অনেকটা তার দিদির মতই মনে করে তাকে।
হেম আর দাঁড়ায় না,ধীর পদক্ষেপে বৈঠক ঘর পেরিয়ে ভেতর বারান্দায় পা রাখে সে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার সময় মনে মনে ভাবে এতো সাজসজ্জার কি দরকার!কেনই বা এই রাতে তাকে স্বামী ঘরে পাঠানো? এমন ত নয় যে দামিনী তার মনের কথা জানে না। সে ত সবকিছুই বলে তাকে। তবে কেন এমন ব্যবহার? আবার বলে কি না সে নাকি তার সতীন। তার কিছ থেকে তার স্বামীকে সে ছিনিয়ে নিতে এসেছে। যদিও একথা বিশ্বাস করা শক্ত। কারণ একটু দেরিতে হলেও হেম বুঝছিল দামিনী সবাইকে চমকে দিয়ে মজা উপভোগ করতে বেশ পছন্দ করে। সুতরাং তার কথা কতটা বিশ্বাসজনক এই নিয়ে তির মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবুও মাঝেমধ্যে ভয় হয় বৈকি! কিন্তু এ বিষয়ে সঞ্জয়ের সাথে আলোচনা করতে হেমের সাহসে কুলায় না।কারণ সৌদামিনী কথা বা তাকে দেখলেই সঞ্জয়ের মুখভঙ্গি এমন ভীষণ রূপ ধারণা করে যে দেখলেই হেমলতার হৃদস্পন্দন বেরে যায়। তবে সে ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছে দিদি সহিত কথা বলে এই
ব্যাপারে নিশ্চিত হবে।
দোতলায় উঠতেই দাসী মঙ্গলার ঘরের খোলা দুয়ার দিয়ে চোখে পরে মন্দিরা কোলে বসে গল্প শুনছে। টানা বারান্দার শেষে সঞ্জয়ের শয়নকক্ষের দুয়ারটাও খোলা। সেখানে হলদেটে আলো পরেছে। আলোর কাছাকাছি পৌছুতেই হঠাৎ তার দিদিকে খাবারের পাত্র হাতে বেরুতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পরে হেম। এটি অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয় কিন্তু। কারণ হেম বেশ ভালো ভাবেই জানে তার স্বামীর খাবার মাঝে মধ্যেই দোতলায় আসে,আর বেশিরভাগ সময়েই তা আসে তার দিদির হাতে। তবে নিজের এমন সাজসজ্জা কারণে দিদিকে দেখে হেম লজ্জায় মাতা নত করে সেখানেই দাঁড়িয়ে পরে।
– ওমা! এমন সাজগোজ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? তবে যে খুব বললি,বাবা মায়ের..
হেমলতার মাথা যেন আরও নিচু হয়ে যায় লজ্জায়।মনে মনে সে নিজের এমন দসার জন্যে সৌদামিনীকে দোষারোপ করতে থাকে। নয়নতারা হেমের অবস্থা দেখে হেসে উঠে বলে,
– হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না,যা ভেতরে যা।আর শোন আমি কালকেই বাবার ওখান খবর পাঠিয়ে....
– ধাৎ.. ভালো হবে না দিদি! আমি কী বলেছি তোমায় খবর পাঠাতে?
– যাহ্... আমি ত ভালোর জনেই বলাম। স্বামীর ঘর করতে হবে না বুঝি?
হেমলতা দিদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি খরতে করতে নিচে নেমে আসে। যদিও নয়নতারা তাকে সঞ্জয়ের ঘরে যেতে বলে কয়েকবার। কিন্তু বেচারী হেম প্রথমেই এমন লজ্জায় পরেছে যে আর তার স্বামীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করার ইচ্ছে হয় না এখন।
ওদিকে হেমলতা যাবার পরপরই বিছানায় ছড়ানো শাড়ি গহনা গুলো গুছিয়ে তুলতে থাকে দামিনী। এমন হময় হঠাৎ হেমের একটি শাড়ির ভেতর থেকে কিছু কাগজপত্র খসে পরে মেঝেতে। হাতে তুলে পড়ে দেখার পর দামিনীর অবার হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না। কাগজপত্র গুলো জমিজমা সম্পর্কিত। তবে অবাক বিষয় এই যে; হেমলতার শাড়ির ভেতরে সঞ্জয়ের বাড়ির দলিলপত্র কি করে এল!
//////
মেয়ে মজলিসে আজ একজন নতুন ছিল।তিনি মাসখানেক বাপেরবাড়ি ঘুরে আজ সকালে এসে পৌঁছেছে।তাই নয়নতারার সাথে কৃষক পল্লী কয়েকজন দল বেধে যাচ্ছে দামিনীর সাথে তার পরিচয় করাতে। যদিও দলবেঁধে যাবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সে নিজে একা গিয়েই উঠতে পারতো সঞ্জয়ের বাড়িতে। ইনি এই গ্রামেরই লোক অচেনা কেউ ত নন।
— মেয়েটার বয়েস কত?
– ওই ত আমাদের নয়ন'দির মতোই।
আগে আগে নয়ন ও আরও কয়েকজন মেয়ে বউ হাটছে।তার একটু পেছনেই আরো কয়েকজন।বোধকরি এমন আলোচনা নয়নতারা সমুখে করার উপায় নেই বলেই দলের এমন ভগ্ন দসা।
একজনের কথা শেষ হতেই তাদের সকলে সমস্বরে আবার একটা বিস্ময়ের রোল তুললো,যদিও একথা অনেকেরই ইতিমধ্যে জানা। তাদের মধ্যে অনেকের ভাবনাই এমনটি যে;এমন ধারি মেয়ে আইবুড়ো থাকে ঘরে! এ আবার কোথাকার জাত? রামোঃ..ছিঃ,
— তাহলে আর মেয়ে কোন মুখে, মাগী বল! পাঁড় শসা বাপ-মা বুঝি ঘরে বীজ রেখেছিল!
অল্পক্ষণের জন্যে দলের সবার মাঝে হাসির রোল উঠলো। হাসি খানিক থিতলেই একটি কমবয়সী বধূ বলে উঠলো,
– যাই বল কাকিমা! মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ।
তার কথার রেশ টেনে আর একজন বলল,
– তা আর বলতে,এক্কেবারে মায়াবতী। কথা তো নয় যেন মুখ থেকে মুক্ত ঝরছে সারাক্ষণ।
যাকে উদেশ্য করা কথাগুলো বলা হইল,সে হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,
– তা সেই দেখতে ভালো হবে না ত কি তোরা হবি? ও মাগী কি আর পাড়াগাঁয়ের,সে হল শহরের মেয়ে, দিনরাত সাবান-পাউডার ঘষছে, আমাদের মতো রাঁধতে হতো, বাসন মাজতে হতো, তো দেখতাম চেহারার কত জলুস বজায় রাখে।
যিনি কথা গুলো বলছিলেন,তার এই বয়স ত দূর, বিগত যৌবন দিনেও অজস্র পাউডার সাবান ঘষলেও যে কখনো তিনি দামিনীর পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারতেন, এই কথা কারোরই ঠিক বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া আমাদের নয়নতারা ত প্রতিদিন এই করছে। তাই বলে তার রূপের ওপড়ে কোন মন্দ প্রভাব ত কে পরিতে দেখে নাই। তবে কিনা একথা বলিলে হিতে বিপরী হতে পারে, তাই সবাই চুপ মেরে হাটাহাটিতেই মনোনিবেশ করল।তবে নয়নের পেছন পেছন বৈঠক ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতর উঠনে পা দেবার সাথে সাথে সবাইকেই অবাক হতে দেখাগেল।
বারান্দায় হেমলতা আজ সকালে আনা মাছ কুটতে বসে। তবে এটি অবাক করা বিষয় নয়।সবার দৃষ্টি তখন কলঘরের দিকে। যেখানে কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে কলিকাতার মেয়ে সৌদামিনী একরাশ বাসন নিয়ে বসে। বলা ব্যাহুল পথে যার এই বিষয়ে আলোচনা করিতেছিল,এই দৃশ্য দেখার পর তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজেদের মনেই সন্দেহের উদয় হল। কলঘরে কলিকাতার রূপসী ছাই দিয়ে নিটোল সুগৌর হাতে বাসন মাজছে,এ দৃশ্যটা ঠিক যেন খাপ খায় না। বলতে গেলে শহরের মেয়েদের সম্পর্কে তাদের ধারণা যা ছিল তার সাথে এই দৃশ্যের বিশেষ মিল নেই বললেই চলে।সুতরাং সকলের কাছেই এটা খাপছাড়া বলে মন হলো। তবে তাদের মধ্যে নয়নতারা রিতিমত চটে গিয়েছে। সে বাবুকে উঠনে নামিয়ে এগিয়ে গিয় দামিনীর ডান হাতটি চেপেধরে বলল,
– কি হচ্ছে কি এসব? ওঠো বলছি!
দামিনী উঠলো ঠিকই তবে নয়নতারাকে সরিয়ে আনার জন্যে। এদিকে দুজনের রেশারেশিতে বেখেয়ালে নয়নতারার কাধের আঁচল খানিকটা গেল সরে।ভাগ্যক্রমে দামিনীর দৃষ্টি সেখানেই আটকে গেল।নয়নের কাঁধে তখনও গতরাতের মিলনের চিহ্ন চিহ্নিত আছে। এতখন যা আঁচলের আঁড়ালে ছিল। এখন বেখেয়ালে তা দামিনীর চোখে পরতেই নয়ন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যাপারখানা বুঝে নিয়ে, চটজলদি আঁচল টেনে সেটা আঁড়াল করল। দামিনীর মুখভঙ্গি দেখে নয়নতারা বুঝলো কিছু একটা বলা দরকার, কিন্ত তার আগেই ভেতর বারান্দার দিক থেকে তার স্বামীর ডাক ভেসে এল।
– নয়ন!
সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে তারা দু'জনেই দেখলো সোহম আজ বিছানা ছেড়ে একাই হেটেই বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। সোহম বেচারা মার কম খায়নি, তার ওপড়ে রোগাটে দেহের গঠন হওয়াতে মারের আঘাত সামলে উঠতে বেশ সময় লেগেছে তার। স্বামীকে একা বেরুতে দেখে নয়নতারা ব্যস্ত হয়ে ছুটলো সে দিকে,
– একি! তুমি উঠে এলে যে, একবারটি ডাকলে হতো না?
নয়নতারার যাবার পথে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল দামিনী। মনে মনে কি ভাবলো তা বোঝা গেল না।
সোহম বারান্দায় সিঁড়ির ধাপে বসেছিল। তবে মেয়ে মজলিসের সামনে শুধু হাতে বসে থাকা যায় না। বিশেষ করে যখন প্রায় সবারই আকর্ষণ তার ওপরই কেন্দ্রীভূত। সঞ্জয় খবরের কাগজ পড়ে না। তাই মেয়েদের নজর এরিয়ে যেতে বিশেষ কিছু হাতে না পেয়ে নয়নতারার একখানা বই চেয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সে। এমন সময় নয়নতারা বিছানা ঝেড়ে শয়নকক্ষের বাইরে পা দিয়েছে। তাকে দেখেই একজন বয়স্ক মহিলা সরাসরিই বলে বসলো,
– বলি কার ঘরের সিধ কাটতে গিয়েছিল'রে তোর সোয়ামি! ইসস্.. মেরে এক্কেবারে হাড়মাস গুড়িয়ে দিয়েছে...
শুনে কয়েকজন প্রকাশে ও কয়েকজন মুখে আঁচল চেপে হাসতে লাগলো। আলোচনা হয়তো আরো এগুতে পারতো। কারণ গোপন বিষয়ে আলোচনায় রসবোধ ও আগ্রহ দুই সহজেই মনে আসে। কিন্তু সুযোগ মিলল না। মোক্ষম সময়ে গ্রামের গণমান ব্যক্তি চরণ ঘোষের আগমনে মেয়ে মজলিসের সকলেই একটু নড়েচড়ে বসলো। বিশেষ করে কম বয়সী মেয়ে বউদের কেউ কেউ সোজা রান্নাঘরে ভেতরে ঢুকে দুয়ারের আঁড়ালে লুকালো।
চরণ ঘোষ বসতে পারতেন, তবে বসলেন না। সোহম এ কদিনে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিল।চরণ ঘোষ সোহমের সাথে কথা আছে বলে ও দেবুকেও যদি বা প্রয়োজন পরে তাই সঙ্গে করে শন্তুর চায়ের দোকানে রওনা দিলেন। এদিকে নয়নতারা কাজে হাত লাগাতে গেলে সৌদামিনী তাকে বাধা দেয়।তখন নয়নতারা দোতলা থেকে ঘুরে এসে নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে শুয়ে পড়লো। বোধকরি ক্লান্ত দেহে ঘুমও এল সঙ্গে সঙ্গেই।
নয়নতারা ঘুম ভাঙলো দূপুর গড়িয়ে গেলে। বারান্দায় পা দিয়েই সে দেখলো, হেমলতা সবে রান্না সেরে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। এটি দেখে নয়ন অস্থির হয়ে ওটে। নয়নতারা নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না দুজন রান্নাঘরে থাকার পরেও রান্না এতো দেরি কি করে হয়! অবশ্য কারণ জানবার পর নয়নতারা রীতিমতো শিহরিত।
দুপুরে রান্না করবার সময় বেখেয়ালে গরম ডালের পাত্র উল্টে সৌদামিনীর পা'য়ে লেগেছে। হেম ও সৌদামিনী আজ বাড়ির দায়িত্ব নেওয়াতে নয়ন একটু চোখ বুঝিয়ে ছিল রাতে ঘুম হয়নি বলে। উঠতে উঠতে দুপুর গড়িয়ে গেল,আর তার মধ্যেই এমন কান্ড। হায় ভগবান!
সৌদামিনীর বড় উৎসাহ ছিল আজকে রান্নাবান্না নিয়ে। তবে উৎসাহ নিমিষেই মাটি হলো কয়েকটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনায়। সকালে নয়নতারার ঘাড়ে সেই দাগ গুলো হঠাৎ কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিল তার। তবে পরক্ষনেই সঞ্জয়ের দাদা ঘর থেকে নিজে হেটে বেরিয়ে আসায় বিষয়টি বুঝতে দেরি হয়নি তার। তাই সে নিঃসন্দেহে আবারও কাজে লাগে এবং মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করে। এমনিতে বাড়ির সব কাজ সেরে নয়নতারা রান্নাঘরে ঢোকে।তবে আজ নয়নকে ওভাবে ঘুমাতে দেখে সৌদামিনী নিজ হাতেই সব কাজের দায়িত্ব তুলে নিল। সব কাজ শেষে সৌদামিনী গেল সঞ্জয়ের ঘর গুছাতে,অবশ্য এই কাজটি হেম নিজেই করতে চাইছিল। তবে সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে তালা দেওয়া,চাবি নয়নতারার আঁচলে। যদিও নয়ন তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তবুও হেমলতা মন দিদির আঁচল থেকে চাবি গোছা খুলতে সায় দিল না। তবে দুয়ারে তালা ঝূলছে দেখে দামিনীর আগ্রহ বেড়ে গেল। সে খুব সহজ ভাবেই নয়নতারার শয়নকক্ষে ঢুকে আঁচল থেকে চাবি গোছা খুলে উঠে গেল দোতলায়।
এই পর্যন্ত সৌদামিনীর মন ছিল চঞ্চল,আনন্দময়। সঞ্জয়ের ঘরে আজ সে নিজ হাতের ছোঁয়া লাগাবে। পছন্দের মানুষটির ঘর সাজানোর সুযোগ পেলে খুশি হবারই কথা। তবে দুয়ার খুলে সে যখন সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে ঢুকলো,তখনও দামিনীর জানা ছিল না তার জন্যে ঠিক কি অপেক্ষা করছে।
নয়নতারা ঠিক ভেবে উঠতে পারেনি তার আঁচল থেকে কেউ চাবি নিয়ে সঞ্জয়ের ঘরের তালা খুলতে পারে। এদিকে গতরাতের স্মৃতি সরূপ সঞ্জয়ের বালিশে ও এলোমেলো শয্যায় যা ছিল, তা আঁড়াল করতে সঞ্জয়ের ঘর গুছিয়ে চাদর ও বালিশের কভার পাল্টে দিয়েছিল সে। তবে আগেই বলেছি,নয়ন ভাবেনি চাবি নিয়ে কেউ তালা খুলতে পারে।তাই সব কিছু একত্রিত করে শয্যায় নিচের দিকে মেঝেতে দলা পাকিয়ে রেখে দিয়েছিল সে।তারপর মন কেমন করায় সঞ্জয়ের শয়নকক্ষে সে তালা দেয়।কারণ আজ সকল কাজ তার ছোট্ট বোনটি ও দামিনী করছে।সুতরাং এই ঘরে তাদের আনাগোনা যেন ঘটে তাই এই ব্যবস্থা। তবে ভাগ্যদেব নয়নতারা সহাই ছিল না এইবারে,তাই এই দৃশ্য দামিনীর নজর এড়িয়ে গেল না। গোছানো ঘরে দলা পাকানো চাদর মেঝেতে পরে আছে এই দৃশ্য তাকে বিশেষ করে আকর্ষণ খরলো। তারপর ওগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সঞ্জয়ের বালিশে লাল সিঁদুরের দাগ জানালার দিয়ে আসা রোদের আলোয় অতি স্পষ্ট ভাবেই দেখা গেল।
//////
আজ সকল দোকানপাট খুলেছে আগে আগে। সঞ্জয়েরও তাই। আজ কোন কারণ বসতো তার বন্ধুটি আসে নি।লোক পাঠিয়ে খবর নেওয়া চলত যদি না আজ হাটবার হতো।
দুপুরের দিকে বাজারে পরিবেশে একটু শান্ত হলে সঞ্জয় তার অন্য দোকানটায় গেল খেতে। এই ব্যবস্থা নতুন চালু করা হয়েছে। আগে ভাত রাধবার ব্যবস্থা তাদের ছিল না। এখন বোধহয় ওটিকে আর মিষ্টির দোকান বলা চলে না,হোটেল বলতে হয়। সঞ্জয়ের হোটেলটি ঘাটের কাছাকাছি। অবশ্য এতটা তার যাবার দরকার ছিল না। সেখানে লোক আছে,কেউকে দিয়ে খবর দিলেই পাঠিয়ে দিত। কিন্তু সঞ্জয়ের একটু হাটাহাটি করার প্রয়োজন ছিল। সেই ফাঁকে হোটেলের হাল অবস্থায় দেখে আসবে এই তার উদ্দেশ্য।
দোকান ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে যেতেই ডান পাশের এক হোটেল থেকে অতুল চক্রবর্তীর ডাক পরলো।
– আরে কী ব্যাপার! বাড়ি যাও নি আজ?এদিকে এসো কথা আছে!
হোটেল ওয়ালা সঞ্জয়ের চেনা। বৌদিমণি আসার আগে প্রতিদিন দুপুর ও রাত্রিতে সঞ্জয়ের এই হোটেলের এক রকম বাধা খদ্দের ছিল। ডাক শুনে সঞ্জয় এগিয়ে গেল। হোটেলের সমুখে আসতেই সঞ্জয় বুঝলো হাট ঠান্ডা হলেও হোটেলের অবস্থা সরগরম। বেলা দুপুরে প্রায় সকলেই খেতে বসেছে। হোটেল মালিকের গদিতে বসে সঞ্জয় বলল,
– কিছু বলবে অতুল কাকা? আগেই বলে রাখি আমি বেশিক্ষণ বসবো না। এমনিতেই হাট বার, তার ওপড়ে পুলকটাও এল না। এখন এমন অবস্থায় গল্প করির সময় নেই আমার।
– বুঝেছি বুঝেছি আর বলতে হবে না। অ্যায় গদাই এদিকে..!
– আরে না! না! কি করছো আমি..
– আরে বসো বসো, এতো উতলা হলে চলে?
অতুল চক্রবর্তী সঞ্জয়ের কোন কথা না শুনে তাকে একরকম জোর করেই খেতে বসিয়ে দিল। প্রতিদিন বৌদিমণির হাতের যাদু মেশানো সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে আজ হঠাৎ সঞ্জয়ের হোটেলের খাবার বিশেষ ভালো লাগলো না। কিন্তু উপায় কি? সঞ্জয় অনেকখন দেবুর জন্যে অপেক্ষা করে তবেই হোটেলে এসেছে খেতে। দেবুটাও আজ এল না।দেবু এলে সে বাড়িতে পাঠাতৈ খাবার আনতে। যাক সে কথা,খাবার পর্ব চুকিয়ে একটুখন জিরিয়ে নিয়ে সঞ্জয় বেরুলো ঘাটের উদেশ্যে। যেতে যেতেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। দেখবার মতো যদিও নতুন কিছুই নেই। হা নতুন মানুষজন অনেক আছে। তবে কি না এদের সবার পরিচয়ে সেই চির চেনা ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া আপাতত অন্য কিছু বলা চলে না। কারণ এখানকার সবাই মূলত একজন কিনতে ও অন্যজন বেচতে এসেছে।
তবে নিত্যকার বাজার হোক্ বা সপ্তাহে একদিনের হাট হোক্ বিক্রেতা ও ক্রেতা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একে ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ন। তাই তো সকাল হতেই বিক্রেতা তার পসরা সাজিয়ে বসে অপেক্ষায় থাকে!তেমনি ক্রেতাদেরও অপেক্ষা থাকে বৈকি কতক্ষনে দোকান বাজার হাট চালু হবে! তবে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যে শুধুমাত্র বিকিকিনির সম্পর্ক থাকে সবসময় তাও কিন্তু নয়!প্রতিদিনের বাজারে বা সপ্তাহের একদিনের হাটের দেখাশোনাতে অনেকের সাথেই বেশ একটা অম্লমধুর সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়!মনে পরে সেই দেবীপুর থেকে রতন জেলে আসে চুনো মাছের ঝাঁপি নিয়ে।অমুল্যদা বসে বড় মাছ নিয়ে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পরে গত হাটবারে রতন জেলে বলেছিল তার ছেলের জ্বরের কথা। একবার মাছের বাজারে একটা চক্কর না দিলেই নয়।
হোটেলের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ মাঝিপাড়ার এক জনের সাথে দেখা। সঞ্জয়কে দেখেই সে সম্মানের সহিত তাকে আমন্ত্রণ ছানিয়ে ঢুকলো একটা চায়ের দোকানে। দোকানে আরোও দু একজন যারা ছিল,তারা সঞ্জয়কে পেয়েই গতরাতের আলোচনার রেস টানলো।এতে সঞ্জয়ের বিরক্ত হাওয়া ছাড়া উপায় কি! আজ এমনিতেই খাওয়া দাওয়া ভালো না হয়াতে তার একটু মেজাজ বিগড়ে আছে। এখন সকালের কথা মনে হতেই সঞ্জয়ের রাগ বেরেগেল। তার দাদাকে ও তাকে কে বা কারা মেরেছে এটি সঞ্জয়ের বোঝার বাকি ছিল না। দাদাকে কেন মেরেছে এটি সঞ্জয়ের ভালো বুঝতে পারলো না।হেমকে নিয়ে পালানোর জন্যেইকি রাগের মাথা এই কির কোরে বসেছে খোড়া গোবিন্দ লাল!
যা হোক তার দাদা এখন সুস্থ, তাই দাদার ব্যাপারটা বাদ দিলেও সঞ্জয়ের ব্যাপারটা আপাতত গুরুতর। যদিও তার দাদা মার খেয়েছে বেশি তবুও! কারণ সঞ্জয়ের ব্যাপারটা সম্মানের।কেউ তালদীঘিতে এসে তাকে মেরে চলে যাবে এবং আক্রমণকারীদের চিনেও সঞ্জয় চুপ করে বসে থাকবে! এতে সঞ্জয়ের সম্মান ঠিক কতটুকু কমে নয়নতারা সে বিষয়ে জানে না। তা নাহলে ওমন দিব্যি কে দেয় কা কে!
///////
সন্ধ্যায় নয়নতারা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে সৌদামিনীর খোঁজ নিতে ভেতর ঘরের দুয়ারের সমুখে দাঁড়ায়। মেয়েটার ডান পা'টা খানিক পুরেছে,হাতেও লেগেছে একটু। তবে পায়ের পোড়াটাই বেশী।আপাতত বেশ কিছুদিন ও পা নিয়ে হাটাচলায় বেশ কষ্ট হবে তা বোঝা যায়।
ভেতর ঘরে শয্যার পাশে মেঝেতে হেমলতা কি যেন সেলাই করছিল। নয়নতারার মেয়ে মন্দিরা ও কৃষক পল্লীর একটি বালিকা সৌদামিনীর পাশে বসে গল্প শুনছে। সৌদামিনীকে আবারও হাসিখুশী দেখে বেশ ভালো লাগলো নয়নতারার। দুপুরে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। তবে অনেক গুলো বিষয়ে আলোচনা অতি শীগ্রই সৌদামিনীর সাথে করা জরুরি। তবে সবার সামনে সেই আলোচনা সম্ভব নয়। তাই এখন ভেতরের অবস্থা দেখে নয়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সরে পরে।
সঞ্জয় ফেরে একটু রাত করে। দোতলায় খাবার নিয়ে গিয়ে নয়নতারা বসে সঞ্জয়ের সমুখে।
– তোমার দাদার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবলে?
– আমি ভেবে দেখেছি বৌদিমণি,তবে দাদাকে কাজে বসাতে ভয় হয়। কোন কাজই তো তার বেশিদিন সয় না।
– তা বলে কি আজীবন ঘরে বসে থাকবে,এই কি চাও তুমি?
– আহা বৌদিমণি! রাগ করছো কেন? তুমি চাইলে কদিনের ভেতরে দোকান খুলে দাদাকে বসিয়ে দেওয়া চলে। তবে দাদার ইতিহাস তো তোমার অজানা নয় বৌদিমণি! জুটমিলের কাজ কিভাবে হাত ছাড়া করলো সে কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। তারপর তোমার বাবার ব্যবসাটার কি হাল হলো দেখলে তো।
নয়নতারা সঞ্জয়ের কথা শোনে আর ভাবে। কিন্তু শুধু ভাবলে কি হয়! তার স্বামীর স্বভাব সে ভালোই জানে। তবে তাই বলে এভাবে ছোট ভাইয়ের সংসারে অকর্মণ্য হয়ে পরে থাকবে তার স্বামী? না না তা কি করে হয়!
– সেই যাই বল তুমি ঠাকুরপো,তোমার দাদার একটা ব্যবস্থা তোমায় করতেই হবে।
সঞ্জয় খাওয়া সেরে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়।নয়নতারারও উঠে দাঁড়ায় তার সঙ্গে সঙ্গেই। সঞ্জয় তার বৌদিমণিকে কাছে টেনে শাড়ির আঁচলে মুখ হাত মুছে নেয়। তারপর নয়নতারার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– সে না হয় করলাম, কিন্তু দাদাকে কে রাজি করাবে শুনি?
– কেন! আমি করাবো, এছাড়া আর কে আছে বল?
সঞ্জয় নয়নকে তার বুকে চেপেধরে ডানহাতে গাল টিপে দিয়ে বলে,
– কি উপায়ে রাজি করাবে শুনি? আমাকেও একটু দেখায় না, নইলে ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না।
নয়নতারা ইশারা বুঝে নিয়ে ঠাকুরপোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।তবে সঞ্জয় এত সহজে ছাড়বে কেন! সে নয়নকে ঠেলে নিয়ে একদম দুয়ারের কাজে দেয়ালে ঠেসে ধরে।
– ইসস্.. ঠাকুরপো ছাড়ো এখনো! ওমন ছেলেমানুষী কোর ন...“অম্ম্ম্ম…”
নয়নের মুখের কথা মুখেই থেকে যায়।তার বদলে সঞ্জয়ের ঠোঁট দুটো নয়নতারার পাতলা পাতলা ঠোঁট দুটিকে বন্দী করে চুষতে থাকে। সেই সাথে দুহাতে কাঁচুলির ওপর দিয়ে টিপতে থাকে নয়নতারার দুধেল দুধগুলো।
রাতে খাওয়া দাওয়া পরে হেমলতাকে সাজাতে বসল সৌদামিনী। তবে সাজটা খুব অসাধারণ কিছু নয়। খুবই সাধারণ একটি ডুরে শাড়ি,কোমরে বিছা সেই সাথে খোঁপা করা চুলে একটি সোনার কাটা ও দু'পায়ে মল। অবশেষে কি একটা সুগন্ধি শরীরের মাখিয়ে দামিনী হেমলতার গলা জড়িয়ে ধরে শয্যায় একপাশে বসে বলল,
– আচ্ছা ভাই সত্য করে বলতো গতকাল কিছু হয়েছে তোদের মাঝে?
প্রথমটায় দামিনীর এই প্রশ্ন হেম বুঝে উঠতে পারলো না। সে অবাক হয়ে দামিনীর মুখপানে চেয়ে রইল। হেমলতার অবাক দৃষ্টি দেখে সৌদামিনী এবার আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা শুরু করল,
– আচ্ছা মেয়ে ত তুই হেম! বলি গতকাল সোয়ামি তোর গুদে গাদন দিয়েছে কি নি বল?
হেমলতা এমন প্রশ্ন আশা করেনি। যদিও সে দামিনীর সহিত তার সম্পর্ক এখন অনেক খোলামেলা। তবুও হেমলতার অস্থির অস্থির লাগে এমন প্রশ্নে। তার মুখে তৎক্ষণাৎ কোন জবাব আসে না। উত্তর দিতে দেরি হওয়াতে সৌদামিনী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
– কি হল! বল, কিছু হয়েছে তোদের মাঝে?
সৌদামিনীর উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরের সাথে গম্ভীর মুখভঙ্গি হেমের মনে ভয়ের আবির্ভাব ঘটে। ঠিক কি কারণে হঠাৎ এমন প্রশ্নের দ্বারা তাকে আক্রমণ হেমলতা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ভয়ে ভয়ে সে শুধু দু'দিকে মাথা নেড়ে বলে না।
সৌদামিনী খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হেমলতার মুখপানে চেয়ে থাকে। তারপর একরকম জোর করেই হেমকে শয়নকক্ষের বাইরে বের করে আনে সে। বাইরে এসে ভারাক্রান্ত হেমলতার দিকে কড়া চোখে তাকিয় কঠিন গলায় বলে,
– সোজাসুজি দোতলা স্বামীর ঘরে যাবি।
– কি-কিন্তু....
কথা শেষ হয় না, তার আগেই দামিনী হেমলতার চিবুকখানা ডানহাতে তুলে ধরে আগের মতোই দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– স্বামীর সাথে একঘরে নাইবা থাকলি। তাই বলে তার সাথে খানিকক্ষণ গল্প করেসময় কাটানোতে কি ক্ষতি আছে শুনি? তোর ভালোর জন্যে বলছি হেম,কথা শোন।
কথা শেষ হতেই হেমের মন হয়,সৌদামিনী পোড়া পা নিয়ে যেমন ছোটাছুটি করছে! হয়তো আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালে দামিনী নিজেই বুঝে তাকে টেনে নিয়ে দোতলায় উঠবে এখনি। হেম একটু চাপা স্বভাবের বলে দামিনী তাকে নিয়ে মজার করে।এটি হেম নিজেও বোঝে। কিন্তু তাই বলে সে রেগে যায় না। কারণ সে দামিনীকে পছন্দ করে। অনেকটা তার দিদির মতই মনে করে তাকে।
হেম আর দাঁড়ায় না,ধীর পদক্ষেপে বৈঠক ঘর পেরিয়ে ভেতর বারান্দায় পা রাখে সে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার সময় মনে মনে ভাবে এতো সাজসজ্জার কি দরকার!কেনই বা এই রাতে তাকে স্বামী ঘরে পাঠানো? এমন ত নয় যে দামিনী তার মনের কথা জানে না। সে ত সবকিছুই বলে তাকে। তবে কেন এমন ব্যবহার? আবার বলে কি না সে নাকি তার সতীন। তার কিছ থেকে তার স্বামীকে সে ছিনিয়ে নিতে এসেছে। যদিও একথা বিশ্বাস করা শক্ত। কারণ একটু দেরিতে হলেও হেম বুঝছিল দামিনী সবাইকে চমকে দিয়ে মজা উপভোগ করতে বেশ পছন্দ করে। সুতরাং তার কথা কতটা বিশ্বাসজনক এই নিয়ে তির মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবুও মাঝেমধ্যে ভয় হয় বৈকি! কিন্তু এ বিষয়ে সঞ্জয়ের সাথে আলোচনা করতে হেমের সাহসে কুলায় না।কারণ সৌদামিনী কথা বা তাকে দেখলেই সঞ্জয়ের মুখভঙ্গি এমন ভীষণ রূপ ধারণা করে যে দেখলেই হেমলতার হৃদস্পন্দন বেরে যায়। তবে সে ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছে দিদি সহিত কথা বলে এই
ব্যাপারে নিশ্চিত হবে।
দোতলায় উঠতেই দাসী মঙ্গলার ঘরের খোলা দুয়ার দিয়ে চোখে পরে মন্দিরা কোলে বসে গল্প শুনছে। টানা বারান্দার শেষে সঞ্জয়ের শয়নকক্ষের দুয়ারটাও খোলা। সেখানে হলদেটে আলো পরেছে। আলোর কাছাকাছি পৌছুতেই হঠাৎ তার দিদিকে খাবারের পাত্র হাতে বেরুতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পরে হেম। এটি অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয় কিন্তু। কারণ হেম বেশ ভালো ভাবেই জানে তার স্বামীর খাবার মাঝে মধ্যেই দোতলায় আসে,আর বেশিরভাগ সময়েই তা আসে তার দিদির হাতে। তবে নিজের এমন সাজসজ্জা কারণে দিদিকে দেখে হেম লজ্জায় মাতা নত করে সেখানেই দাঁড়িয়ে পরে।
– ওমা! এমন সাজগোজ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? তবে যে খুব বললি,বাবা মায়ের..
হেমলতার মাথা যেন আরও নিচু হয়ে যায় লজ্জায়।মনে মনে সে নিজের এমন দসার জন্যে সৌদামিনীকে দোষারোপ করতে থাকে। নয়নতারা হেমের অবস্থা দেখে হেসে উঠে বলে,
– হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না,যা ভেতরে যা।আর শোন আমি কালকেই বাবার ওখান খবর পাঠিয়ে....
– ধাৎ.. ভালো হবে না দিদি! আমি কী বলেছি তোমায় খবর পাঠাতে?
– যাহ্... আমি ত ভালোর জনেই বলাম। স্বামীর ঘর করতে হবে না বুঝি?
হেমলতা দিদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি খরতে করতে নিচে নেমে আসে। যদিও নয়নতারা তাকে সঞ্জয়ের ঘরে যেতে বলে কয়েকবার। কিন্তু বেচারী হেম প্রথমেই এমন লজ্জায় পরেছে যে আর তার স্বামীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করার ইচ্ছে হয় না এখন।
ওদিকে হেমলতা যাবার পরপরই বিছানায় ছড়ানো শাড়ি গহনা গুলো গুছিয়ে তুলতে থাকে দামিনী। এমন হময় হঠাৎ হেমের একটি শাড়ির ভেতর থেকে কিছু কাগজপত্র খসে পরে মেঝেতে। হাতে তুলে পড়ে দেখার পর দামিনীর অবার হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না। কাগজপত্র গুলো জমিজমা সম্পর্কিত। তবে অবাক বিষয় এই যে; হেমলতার শাড়ির ভেতরে সঞ্জয়ের বাড়ির দলিলপত্র কি করে এল!
//////