25-06-2019, 11:50 AM
পার্টঃঃ০৬
আমিতো ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে এলাম এপাশ দিয়ে আসার জন্য তুই এবার বল।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি বলছে ঠিক মাথায় ঢুকছে না। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমরা এখন বাঁশ বনের ভেতরে। চারিদিকে বাঁশ গাছ ছাড়াও অনেক গাছ আছে। তাল তমাল শিরিষ সেগুন বট অশ্বত্থ আরো কত কি।
ওই কোনের ঢেকটাতে একটা বড় জামরুল গাছ আছে। আমরা দঙ্গল বেঁধে জামরুল খেতে আসি। হাওয়ার স্পর্শে বাঁশ গাছগুলো একপাশ থেকে আর এক পাশে হেলে যাচ্ছে। ঘসা লেগে কেঁচর কেঁচর করে একটা আওয়াজ। আমি প্রায়ই একা থাকলে এরকম নির্জনে চলে আসি। ঘন্টার পর ঘন্টা একলা বসে থাকি। ভীষণ ভাল লাগে।
এই আওয়াজ শুনতে শুনতে মনে হয় বাঁশ গাছ গুলো যেন একে অপরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছে। আমরা কেউই ওদের শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ বুঝি না। কিন্তু ওরা ওদের ভাষা বোঝে। আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একফালি সূর্যের আলো ফাঁক ফোকর দিয়ে নিচে আসার জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে। কিন্তু আর একটা গাছ তাকে কিছুতেই নিচে আসতে দেবে না। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। আমি নিজের মধ্যে নিজে যেন হারিয়ে গেলাম।
অনি।
সৌমিলির গলা শুনে চোখ নামাতেই দেখি দুজনের কেউ নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
অনি।
এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই।
অনি।
এবার বুঝতে পারলাম। ঐ বাঁশ ঝারটার পেছন থেকে আওয়াজ আসছে।
কি হলো তোরা ওখানে কি করছিস ? যাবি না। আমার কিন্তু ভীষন দেরি হয়ে যাচ্ছে। মনাকাকা বকবে।
একবার এদিকে আয় একটা জিনিষ দেখাবো।
আমি একটা হেলে পরা বাঁশের তলা দিয়ে মাথাটা নীচু করে ওপাশে গেলাম।
কোথায়!
এইতো এখানে আয়।
আমি কাছে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম। পুনি সৌমি দুজনেই উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
করবি।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেই যে ওখান থেকে দৌড় লাগালাম সোজা চলে এলাম দীঘাআড়ি। দীঘির পারে বইখাতা রেখে ঝিলের জলে চোখ মুখ ধুলাম। পেট ভর্তি করে জল খেলাম। তারপর আমার পরিচিত সেই ঝোপটার কাছে গিয়ে বসলাম। সরাল পাখি গুলো একবার দীঘির জলে ডুব মারছে আবার ভেসে উঠছে। সামনেই কোথাও একটা ঘু ঘু পাখি ডাকছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ। আমি আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
মা-বাবা থাকলে হয়তো আমার জীবনটা একটু অন্য ভাবে কাটতো কিন্তু কি করা যাবে। সবার ভাগ্যে সব কিছু জোটেনা আমারও তাই।
হঠাৎ একটা মেয়ের খিল খিল শব্দে চমকে উঠলাম। এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই। তারপর ভানুর গলার শব্দ।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম । ঝোপের আরালে ভানু আর কালীচরনের ঝি।
কালীচরন আমাদের বাড়ির খামারের ওপারে একটা টং করে রয়েছে। এই সময় ওরা আসে মাঠে কাজ করার জন্য। আবার মাঠের কাজ শেষ হলে চলে যায়।
কালীচরন সাঁওতাল। ওর মেয়ের নাম ময়না। ময়না ভানুর কাছ ঘেঁয়ে বসে আছে। উদম গায়ে একটা বারো হাত কাপর কোন প্রকারে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরে আছে। কতো বয়স হবে আমাদেরি মতো। সতেরো আঠারো শরীরটা যেন পাথরে কুঁদে তৈরি করা। যেমন মিশ কালো তেমনি তার গ্লেজ। আমার যে ময়নাকে ভাল লাগত না তা নয়। তবে ভাল লাগলেও বা করব কি। আমি চেষ্টা করেও কখনো ভানুর মতো হতে পারবনা। তাছাড়া আমার মনামাস্টার আছে। আমার গার্জেন। আমি বাপ-মা মরা ছেলে। আমাকে শাসন করার প্রচুর লোক। আমার অনেক প্রতিবন্ধকতা। তাই সব ইচ্ছে গুলো বুকের মধ্যে গলা টিপে মরে ফেলতাম। মনে পরে গেল সৌমি আর পুনির ব্যাপারটা। ওরা ওই ভাবে নেংটো হয়ে আমার সামনে এলো। আর আমি দৌড়ে চলে এলাম।
তুই এতো জোরে চাপিস কেনো।
ভালো লাগে।
আবার ওদের দিকে চোখ পরে গেলো।
ভানুর শরীরে শরীর ঠেকিয়ে ময়না বসে আছে। বুক থেকে কাপরটা খসে পরেছে।
ময়না বলে উঠল, বুদতি পালিছি বুদতি পালিছি.....।
ভানু হাসল, তুই বুঝতে পেরেছিস।
হ।
তাহলে কাপরটা....।
না।
কেন।
কি দিবি।
বিকেলে হাটে তোকে ছোলার পাটালি কিনে দেব। আর মনিহারির দোকান থেকে একটা লাল ফিতে কিনে দেবো।
দিবি তো।
হ্যাঁ।
আগের বার দিলিনি।
এবার তোকে ঠিক দেবো।
আমাকে তাড়াতারি যেতে হবে। ভাত নিয়ে মাঠে আস্তে হবে।
ভানু ময়নার কানের লতিতে জিভ দিল। ময়না নড়ে চড়ে উঠল।
কেউ যদি এসে পরে।
কে আসবে এখন।
তোর ওই বন্ধুটা।
অনি।
হ।
ওতো পড়তে গেছে।
তুই যাস নাই।
না।
কেনো।
তোকে আজ খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। তাই ওইখানে গিয়ে বসেছিলাম। জানি তুই আসবি।
তোর খালি নষ্টামি। এসব করা ভাল লয়।
কে বলল তোকে।
মা বলছে।
তোকে আমার ভাল লাগে।
ভানু ময়নার গালে একটা চুমু খেলো। তারপর....আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি প্রায় আধঘন্টা ধরে সব দেখলাম। এটাই তবে সেক্স। বন্ধুরা অনেক গল্প করতো। কিন্তু আমি ঠিক আমল দিতাম না। মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে উলঙ্গ হয়ে ছোট আয়নাটা নিয়ে নিজেই নিজেকে দেখতাম। ভাল লাগত।
আমি বহু দিন ওদের দীঘাআড়ির এই জায়গাটায় দেখেছি। কিন্তু কোন দিন ওরা আমাকে দেখতে পায় নি। তারপর একদিন ভানুকে ব্ল্যাকমেল করলাম। ভানু আমার হাতে-পায়ে ধরে। আমি খালি ওকে বলেছিলাম, আমি যা বলবো তোকে তাই করতে হবে। ও রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকে ভানু দাদা। তবে আমি ওর দাদা।
দেখতে দেখতে ১৫টা দিন যে কোথা দিয় কেটে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না। বড়মা এর মধ্যে দু’তিনবার ফোন করেছিলেন। ছোটমাও। অমিতাভদা রেগুলার সকালে একবার বিকেলে একবার ফোন করতেন। মল্লিকদাও। তনু মাঝে কয়েকবার ফোন করেছিল ঠিক, তবে ওর কথাবার্তা শুনে কেমন যেন একটু খটকা লাগলো। বললাম ঠিক আছে কলকাতায় গিয়ে সব শুনবো।
আসার সময় আমাকে প্লেনের টিকিট ধরানো হলো। কলকাতর অফিসে আমার জরুরি দরকার আছে তাই। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে বড়মার ফোন পেলাম। কন্ঠে উতকন্ঠা। আমাকে বললেন, তুই এখন কোথায়।
আমি বললাম এই নামবো মিনিট পনেরর মধ্যে।
ঠিক আছে। প্রথমে একবার এ বাড়িতে আসিস।
একটু ভয় পেয় গেলাম, বললাম কেনো!
আয়না এলে জানতে পারবি।
তুমি আগে বলো, দাদার কিছু হয়েছে!
নারে না।
তাহলে!
তোর জন্য আমি ছোট সকাল থেকে রান্না চাপিয়েছি। তুই এলে একসঙ্গে খাওয়া হবে।
সত্যিকথা বলো, তাহলে যাবো। নাহলে যাবো না। যেমন বিকেল বেলা যাই তেমন যাবো।
না তুই এখুনি আসবি।
ঠিক আছে।
বুঝলাম গুরুতর একটা কিছু হয়েছে। যার জন্য বড়মার তলব। এয়ারপোর্টে নেমে অনেক পরিচিত মুখের দেখা পেলাম। কাজের তাগিদে এখানে প্রায় আসতে হয়। তাছাড়া সাংবাদিক মানুষ তাই একটু আধটু খাতির আছেই। তাছাড় কলকাতা মার্কেটে আমার পরিচিতি খুব একটা খারাপ নয়। সমীরনদা কলকাতারই একটা অন্য কাগজের এয়ারপোর্ট সংবাদদাতা। আমাকে দেখে বললো, কোথায় ছিলে বাপ কদিন দেখা সাক্ষাত হয় নি। বললাম কোথায় গেছিলাম, একটু অবাক হয়ে বললেন করেছিস কি, সম্পূর্ণটা তুই একলা করেছিস!
হ্যাঁ।
চল একটু ক্যান্টিনে যাই কফি খাব। তোর কোন তড়াহুরো নেই তো ?
এই তো সবে কলকাতায় নামলাম।
সমীরনদা হাসল। আমি তোর সমস্ত নিউজগুলো পরেছি। দারুন লিখেছিস। তোর স্পেকুলেসন সব মিলে গেছে।
হ্যাঁ, আজকে রেজাল্ট। আমি তো সকালের ফ্লাইটে বেরিয়েছিলাম, দিল্লী হয়ে আসছি। সকাল থেকে কাগজটা দেখা হয় নি।
তাই।
সমীরনদা ব্যাগথেকে ওদের হাউসের কাগজ আর আমাদের হাউসের কাগজটা বার করলেন। আমি ওপর ওপর একবার চোখ বোলালাম। কফি আর চিকেন পকোরা এলো। সকাল থেকে কিছু পেটে পরে নি। খিদেও পেয়েছিল। কয়েকটা চিকেন পাকোরা গলধোকরণ করে, কফি মুখে দিলাম। অমৃতের মতো লাগলো। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তারপর কলকাতার হাল হকিকত বলো।
যেমন ছিল তেমনি আছে।
তাপস এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
তুমি এখানে। তাপস আমাদের হাউসের একজন গাড়ির ড্রাইভার।
হ্যাঁ।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলাম।
কেনো তুই আসবি আমাকে কেউ বলে নি।
আমার কি আসার ঠিক ছিলো। এইতো ঘন্টা খানেক আগে বললো।
ও।
কেনো কি হয়েছে।
তোমাকে অফিসে ফেলেই আবার রাইটার্সে যেতে হবে।
আমি তো এখন অফিসে যাব না।
যা বাবা! সুনিতদা বললো তোমাকে নিয়ে অফিসে যেতে।
দাদা কোথায়।
দাদাতো কয়েকদিন হল অফিসে আসছেন না।
মল্লিকদা।
মল্লিকদাও আসছেন না।
আমি তাপসের দিকে তাকালাম। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু পরার চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে, তুমি কফি খাবে।
না।
গাড়ি কোথায় রেখেছো।
পার্কিংয়ে।
ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আসছি। বুঝলাম কিছু একটা গড়বর হয়েছে। নাহলে কাগজের দুই স্তম্ভ নেই। কাগজ বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার একটু অবাক লাগলো। ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করতে নেই। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। সমীরনদা ওর হাউসে একটা ভাল জায়গায় আছে।
কিরে কি ভাবছিস।
না তেমন কিছু নয়। পনেরো দিন ছিলাম না।
হ্যাঁ তোদের হাউসে বেশ গন্ডগোল চলছে।
তাই। সে তো আমাদের হাউসে লবিবাজি আছেই। ঠিক আছে দাদা, আজ আসি কাল দেখা হবে।
সমীরনদার কাছে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জপেরিয়ে গেটের বাইরে এলাম। তাপস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কি ঠিক করলে।
আরে অফিস গাড়ি পাঠিয়ছে। আগে অফিসে যাই তারপর দেখা যাবে।
মনে হচ্ছে ঝড়ের একটা পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। তাপস আমাকে অফিসে লিফ্ট করেই ওর কাজে চলে গেল। আমি আমার লাগেজটা রিসেপসন কাউন্টারে রেখে সোজা লিফ্টের কাছে চলে এলাম। সবাই কেমন ইতি উতি তাকাচ্ছে। ভারি অবাক লাগল। আমি ওপরে এসে সোজা নিউজরুমে চলে গেলাম। সন্দীপনের সঙ্গে দেখা হল।
কখন এলি।
এইতো এই মাত্র।
শুনেছিস কিছু।
কি বলতো।
অফিসের হাল চাল।
না।
কথা বলতে বলতে নিজের টেবিলে এলাম। মল্লিকদার চেয়ারটা ফাঁকা পরে আছে। অপরজিটের চেয়ারে কয়েকজন নতুন ছেলে মেয়েকে দেখলাম। দু’একটা ভাল চামকিও চোখে পরলো। আমি আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সন্দীপ আমার পাশে বসলো। টেবিলের ওপর রাশিকৃত চিঠি। নিউজরুম এখন বেশ হাল্কা। অনেকে এসে এখনো পৌঁছয় নি। সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমি চিঠি গুলো একবার দেখলাম। কয়েকটা চিঠি পরিচিত জনের। বাকি আমার লেখার ওপর। এগুলো চিঠিপত্র বিভাগে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম। সন্দীপ বললো চল একটু ক্যান্টিনে যাই।
চল।
আমি আর সন্দীপ ক্যান্টিনে এলাম।
বটাদাকে ডেকে ডিমটোস্ট আর চায়ের কথা বললাম। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, বল কি বলছিলি।
আমার চাকরিটা মনে হয় গেলো।
কেনো।
তুই কিছুই জানিস না।
না।
দাদা তোকে কিছু বলে নি।
না।
তুই কলকাতায় কবে এসেছিস।
কতবার বলবো। ঘন্টাখানেক হবে। তাপস গেছিল আনতে, বললো সুনিতদা অফিসে আসতে বলেছে।
ও।
কেনোরে ?
যা তাহলে সব জানতে পারবি।
কেন কি হয়েছে বলনা।
ফোনটা বেজে উঠলো। বড়মার ফোন।
হ্যালো বলতেই অমিতাভদার গলা পেলাম। মাথা ঠান্ডা রাখিস।
তুমি! বড়মা কোথায় ?
বড়মা রান্নাঘরে।
তোমার ফোন কোথায়।
ব্যবহার করছি না।
ও।
তা হঠাত মাথা ঠান্ডা রাখব কেন।
সন্দীপ আছে শুনে নে।
অফিসে আসনি কেনো।
সে অনেক কথা।
আমি এখানে এটা কে বললো।
খবর এলো।
বাবাঃ নেট-ওয়ার্ক তো বেশ স্ট্রং, তাহলে এই অবস্থা কেনো।
কপাল।
সাংবাদিকতা করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললে। এখন এই কথা বললে হবে।
সে তুই যা বলিস।
মল্লিকদা কোথায়।
বাড়িতে। তুই কখন আসছিস।
দেখি। কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। হ্যাঁ কি বলছিলি।
আমিতো ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে এলাম এপাশ দিয়ে আসার জন্য তুই এবার বল।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি বলছে ঠিক মাথায় ঢুকছে না। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমরা এখন বাঁশ বনের ভেতরে। চারিদিকে বাঁশ গাছ ছাড়াও অনেক গাছ আছে। তাল তমাল শিরিষ সেগুন বট অশ্বত্থ আরো কত কি।
ওই কোনের ঢেকটাতে একটা বড় জামরুল গাছ আছে। আমরা দঙ্গল বেঁধে জামরুল খেতে আসি। হাওয়ার স্পর্শে বাঁশ গাছগুলো একপাশ থেকে আর এক পাশে হেলে যাচ্ছে। ঘসা লেগে কেঁচর কেঁচর করে একটা আওয়াজ। আমি প্রায়ই একা থাকলে এরকম নির্জনে চলে আসি। ঘন্টার পর ঘন্টা একলা বসে থাকি। ভীষণ ভাল লাগে।
এই আওয়াজ শুনতে শুনতে মনে হয় বাঁশ গাছ গুলো যেন একে অপরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছে। আমরা কেউই ওদের শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ বুঝি না। কিন্তু ওরা ওদের ভাষা বোঝে। আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একফালি সূর্যের আলো ফাঁক ফোকর দিয়ে নিচে আসার জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে। কিন্তু আর একটা গাছ তাকে কিছুতেই নিচে আসতে দেবে না। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। আমি নিজের মধ্যে নিজে যেন হারিয়ে গেলাম।
অনি।
সৌমিলির গলা শুনে চোখ নামাতেই দেখি দুজনের কেউ নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
অনি।
এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই।
অনি।
এবার বুঝতে পারলাম। ঐ বাঁশ ঝারটার পেছন থেকে আওয়াজ আসছে।
কি হলো তোরা ওখানে কি করছিস ? যাবি না। আমার কিন্তু ভীষন দেরি হয়ে যাচ্ছে। মনাকাকা বকবে।
একবার এদিকে আয় একটা জিনিষ দেখাবো।
আমি একটা হেলে পরা বাঁশের তলা দিয়ে মাথাটা নীচু করে ওপাশে গেলাম।
কোথায়!
এইতো এখানে আয়।
আমি কাছে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম। পুনি সৌমি দুজনেই উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
করবি।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেই যে ওখান থেকে দৌড় লাগালাম সোজা চলে এলাম দীঘাআড়ি। দীঘির পারে বইখাতা রেখে ঝিলের জলে চোখ মুখ ধুলাম। পেট ভর্তি করে জল খেলাম। তারপর আমার পরিচিত সেই ঝোপটার কাছে গিয়ে বসলাম। সরাল পাখি গুলো একবার দীঘির জলে ডুব মারছে আবার ভেসে উঠছে। সামনেই কোথাও একটা ঘু ঘু পাখি ডাকছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ। আমি আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
মা-বাবা থাকলে হয়তো আমার জীবনটা একটু অন্য ভাবে কাটতো কিন্তু কি করা যাবে। সবার ভাগ্যে সব কিছু জোটেনা আমারও তাই।
হঠাৎ একটা মেয়ের খিল খিল শব্দে চমকে উঠলাম। এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই। তারপর ভানুর গলার শব্দ।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম । ঝোপের আরালে ভানু আর কালীচরনের ঝি।
কালীচরন আমাদের বাড়ির খামারের ওপারে একটা টং করে রয়েছে। এই সময় ওরা আসে মাঠে কাজ করার জন্য। আবার মাঠের কাজ শেষ হলে চলে যায়।
কালীচরন সাঁওতাল। ওর মেয়ের নাম ময়না। ময়না ভানুর কাছ ঘেঁয়ে বসে আছে। উদম গায়ে একটা বারো হাত কাপর কোন প্রকারে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরে আছে। কতো বয়স হবে আমাদেরি মতো। সতেরো আঠারো শরীরটা যেন পাথরে কুঁদে তৈরি করা। যেমন মিশ কালো তেমনি তার গ্লেজ। আমার যে ময়নাকে ভাল লাগত না তা নয়। তবে ভাল লাগলেও বা করব কি। আমি চেষ্টা করেও কখনো ভানুর মতো হতে পারবনা। তাছাড়া আমার মনামাস্টার আছে। আমার গার্জেন। আমি বাপ-মা মরা ছেলে। আমাকে শাসন করার প্রচুর লোক। আমার অনেক প্রতিবন্ধকতা। তাই সব ইচ্ছে গুলো বুকের মধ্যে গলা টিপে মরে ফেলতাম। মনে পরে গেল সৌমি আর পুনির ব্যাপারটা। ওরা ওই ভাবে নেংটো হয়ে আমার সামনে এলো। আর আমি দৌড়ে চলে এলাম।
তুই এতো জোরে চাপিস কেনো।
ভালো লাগে।
আবার ওদের দিকে চোখ পরে গেলো।
ভানুর শরীরে শরীর ঠেকিয়ে ময়না বসে আছে। বুক থেকে কাপরটা খসে পরেছে।
ময়না বলে উঠল, বুদতি পালিছি বুদতি পালিছি.....।
ভানু হাসল, তুই বুঝতে পেরেছিস।
হ।
তাহলে কাপরটা....।
না।
কেন।
কি দিবি।
বিকেলে হাটে তোকে ছোলার পাটালি কিনে দেব। আর মনিহারির দোকান থেকে একটা লাল ফিতে কিনে দেবো।
দিবি তো।
হ্যাঁ।
আগের বার দিলিনি।
এবার তোকে ঠিক দেবো।
আমাকে তাড়াতারি যেতে হবে। ভাত নিয়ে মাঠে আস্তে হবে।
ভানু ময়নার কানের লতিতে জিভ দিল। ময়না নড়ে চড়ে উঠল।
কেউ যদি এসে পরে।
কে আসবে এখন।
তোর ওই বন্ধুটা।
অনি।
হ।
ওতো পড়তে গেছে।
তুই যাস নাই।
না।
কেনো।
তোকে আজ খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। তাই ওইখানে গিয়ে বসেছিলাম। জানি তুই আসবি।
তোর খালি নষ্টামি। এসব করা ভাল লয়।
কে বলল তোকে।
মা বলছে।
তোকে আমার ভাল লাগে।
ভানু ময়নার গালে একটা চুমু খেলো। তারপর....আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি প্রায় আধঘন্টা ধরে সব দেখলাম। এটাই তবে সেক্স। বন্ধুরা অনেক গল্প করতো। কিন্তু আমি ঠিক আমল দিতাম না। মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে উলঙ্গ হয়ে ছোট আয়নাটা নিয়ে নিজেই নিজেকে দেখতাম। ভাল লাগত।
আমি বহু দিন ওদের দীঘাআড়ির এই জায়গাটায় দেখেছি। কিন্তু কোন দিন ওরা আমাকে দেখতে পায় নি। তারপর একদিন ভানুকে ব্ল্যাকমেল করলাম। ভানু আমার হাতে-পায়ে ধরে। আমি খালি ওকে বলেছিলাম, আমি যা বলবো তোকে তাই করতে হবে। ও রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকে ভানু দাদা। তবে আমি ওর দাদা।
দেখতে দেখতে ১৫টা দিন যে কোথা দিয় কেটে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না। বড়মা এর মধ্যে দু’তিনবার ফোন করেছিলেন। ছোটমাও। অমিতাভদা রেগুলার সকালে একবার বিকেলে একবার ফোন করতেন। মল্লিকদাও। তনু মাঝে কয়েকবার ফোন করেছিল ঠিক, তবে ওর কথাবার্তা শুনে কেমন যেন একটু খটকা লাগলো। বললাম ঠিক আছে কলকাতায় গিয়ে সব শুনবো।
আসার সময় আমাকে প্লেনের টিকিট ধরানো হলো। কলকাতর অফিসে আমার জরুরি দরকার আছে তাই। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে বড়মার ফোন পেলাম। কন্ঠে উতকন্ঠা। আমাকে বললেন, তুই এখন কোথায়।
আমি বললাম এই নামবো মিনিট পনেরর মধ্যে।
ঠিক আছে। প্রথমে একবার এ বাড়িতে আসিস।
একটু ভয় পেয় গেলাম, বললাম কেনো!
আয়না এলে জানতে পারবি।
তুমি আগে বলো, দাদার কিছু হয়েছে!
নারে না।
তাহলে!
তোর জন্য আমি ছোট সকাল থেকে রান্না চাপিয়েছি। তুই এলে একসঙ্গে খাওয়া হবে।
সত্যিকথা বলো, তাহলে যাবো। নাহলে যাবো না। যেমন বিকেল বেলা যাই তেমন যাবো।
না তুই এখুনি আসবি।
ঠিক আছে।
বুঝলাম গুরুতর একটা কিছু হয়েছে। যার জন্য বড়মার তলব। এয়ারপোর্টে নেমে অনেক পরিচিত মুখের দেখা পেলাম। কাজের তাগিদে এখানে প্রায় আসতে হয়। তাছাড়া সাংবাদিক মানুষ তাই একটু আধটু খাতির আছেই। তাছাড় কলকাতা মার্কেটে আমার পরিচিতি খুব একটা খারাপ নয়। সমীরনদা কলকাতারই একটা অন্য কাগজের এয়ারপোর্ট সংবাদদাতা। আমাকে দেখে বললো, কোথায় ছিলে বাপ কদিন দেখা সাক্ষাত হয় নি। বললাম কোথায় গেছিলাম, একটু অবাক হয়ে বললেন করেছিস কি, সম্পূর্ণটা তুই একলা করেছিস!
হ্যাঁ।
চল একটু ক্যান্টিনে যাই কফি খাব। তোর কোন তড়াহুরো নেই তো ?
এই তো সবে কলকাতায় নামলাম।
সমীরনদা হাসল। আমি তোর সমস্ত নিউজগুলো পরেছি। দারুন লিখেছিস। তোর স্পেকুলেসন সব মিলে গেছে।
হ্যাঁ, আজকে রেজাল্ট। আমি তো সকালের ফ্লাইটে বেরিয়েছিলাম, দিল্লী হয়ে আসছি। সকাল থেকে কাগজটা দেখা হয় নি।
তাই।
সমীরনদা ব্যাগথেকে ওদের হাউসের কাগজ আর আমাদের হাউসের কাগজটা বার করলেন। আমি ওপর ওপর একবার চোখ বোলালাম। কফি আর চিকেন পকোরা এলো। সকাল থেকে কিছু পেটে পরে নি। খিদেও পেয়েছিল। কয়েকটা চিকেন পাকোরা গলধোকরণ করে, কফি মুখে দিলাম। অমৃতের মতো লাগলো। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তারপর কলকাতার হাল হকিকত বলো।
যেমন ছিল তেমনি আছে।
তাপস এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
তুমি এখানে। তাপস আমাদের হাউসের একজন গাড়ির ড্রাইভার।
হ্যাঁ।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলাম।
কেনো তুই আসবি আমাকে কেউ বলে নি।
আমার কি আসার ঠিক ছিলো। এইতো ঘন্টা খানেক আগে বললো।
ও।
কেনো কি হয়েছে।
তোমাকে অফিসে ফেলেই আবার রাইটার্সে যেতে হবে।
আমি তো এখন অফিসে যাব না।
যা বাবা! সুনিতদা বললো তোমাকে নিয়ে অফিসে যেতে।
দাদা কোথায়।
দাদাতো কয়েকদিন হল অফিসে আসছেন না।
মল্লিকদা।
মল্লিকদাও আসছেন না।
আমি তাপসের দিকে তাকালাম। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু পরার চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে, তুমি কফি খাবে।
না।
গাড়ি কোথায় রেখেছো।
পার্কিংয়ে।
ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আসছি। বুঝলাম কিছু একটা গড়বর হয়েছে। নাহলে কাগজের দুই স্তম্ভ নেই। কাগজ বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার একটু অবাক লাগলো। ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করতে নেই। সমীরনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। সমীরনদা ওর হাউসে একটা ভাল জায়গায় আছে।
কিরে কি ভাবছিস।
না তেমন কিছু নয়। পনেরো দিন ছিলাম না।
হ্যাঁ তোদের হাউসে বেশ গন্ডগোল চলছে।
তাই। সে তো আমাদের হাউসে লবিবাজি আছেই। ঠিক আছে দাদা, আজ আসি কাল দেখা হবে।
সমীরনদার কাছে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জপেরিয়ে গেটের বাইরে এলাম। তাপস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কি ঠিক করলে।
আরে অফিস গাড়ি পাঠিয়ছে। আগে অফিসে যাই তারপর দেখা যাবে।
মনে হচ্ছে ঝড়ের একটা পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। তাপস আমাকে অফিসে লিফ্ট করেই ওর কাজে চলে গেল। আমি আমার লাগেজটা রিসেপসন কাউন্টারে রেখে সোজা লিফ্টের কাছে চলে এলাম। সবাই কেমন ইতি উতি তাকাচ্ছে। ভারি অবাক লাগল। আমি ওপরে এসে সোজা নিউজরুমে চলে গেলাম। সন্দীপনের সঙ্গে দেখা হল।
কখন এলি।
এইতো এই মাত্র।
শুনেছিস কিছু।
কি বলতো।
অফিসের হাল চাল।
না।
কথা বলতে বলতে নিজের টেবিলে এলাম। মল্লিকদার চেয়ারটা ফাঁকা পরে আছে। অপরজিটের চেয়ারে কয়েকজন নতুন ছেলে মেয়েকে দেখলাম। দু’একটা ভাল চামকিও চোখে পরলো। আমি আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সন্দীপ আমার পাশে বসলো। টেবিলের ওপর রাশিকৃত চিঠি। নিউজরুম এখন বেশ হাল্কা। অনেকে এসে এখনো পৌঁছয় নি। সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমি চিঠি গুলো একবার দেখলাম। কয়েকটা চিঠি পরিচিত জনের। বাকি আমার লেখার ওপর। এগুলো চিঠিপত্র বিভাগে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম। সন্দীপ বললো চল একটু ক্যান্টিনে যাই।
চল।
আমি আর সন্দীপ ক্যান্টিনে এলাম।
বটাদাকে ডেকে ডিমটোস্ট আর চায়ের কথা বললাম। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, বল কি বলছিলি।
আমার চাকরিটা মনে হয় গেলো।
কেনো।
তুই কিছুই জানিস না।
না।
দাদা তোকে কিছু বলে নি।
না।
তুই কলকাতায় কবে এসেছিস।
কতবার বলবো। ঘন্টাখানেক হবে। তাপস গেছিল আনতে, বললো সুনিতদা অফিসে আসতে বলেছে।
ও।
কেনোরে ?
যা তাহলে সব জানতে পারবি।
কেন কি হয়েছে বলনা।
ফোনটা বেজে উঠলো। বড়মার ফোন।
হ্যালো বলতেই অমিতাভদার গলা পেলাম। মাথা ঠান্ডা রাখিস।
তুমি! বড়মা কোথায় ?
বড়মা রান্নাঘরে।
তোমার ফোন কোথায়।
ব্যবহার করছি না।
ও।
তা হঠাত মাথা ঠান্ডা রাখব কেন।
সন্দীপ আছে শুনে নে।
অফিসে আসনি কেনো।
সে অনেক কথা।
আমি এখানে এটা কে বললো।
খবর এলো।
বাবাঃ নেট-ওয়ার্ক তো বেশ স্ট্রং, তাহলে এই অবস্থা কেনো।
কপাল।
সাংবাদিকতা করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললে। এখন এই কথা বললে হবে।
সে তুই যা বলিস।
মল্লিকদা কোথায়।
বাড়িতে। তুই কখন আসছিস।
দেখি। কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। হ্যাঁ কি বলছিলি।