30-09-2024, 02:57 PM
তমাল গার্গীর রসিকতার কোনো উত্তর দিলো না। সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। বললো, চলো ফেরা যাক। অদিতি বললো, এখানে লাঞ্চ করে নিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিয়েও যেতে পারি আমরা। তমাল বললো, না, লাঞ্চ তোমাদের বাড়িতে গিয়েই করবো। তোমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে একবার একটু রাজীবের সাথে দেখা করতে যাবো। বেশি দেরী হবার আগেই।
অদিতি বললো, কিসের দেরি তমালদা? তমাল বললো, কিছু না, চলো যাওয়া যাক্।
অদিতি আর গার্গীকে বাড়িতে নামিয়ে বিনোদকে নিয়ে তমাল চলে এলো রাজীবের আত্মীয়ের বাড়িতে। বেল বাজাতেই মাঝ বয়সী একজন মহিলা দরজা খুললো।
রাজীবের সাথে দেখা করতে এসেছে শুনে তাকে রাজীবের ঘরে পৌঁছে দিলেন তিনি। বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলো রাজীব বালিশে হেলান দিয়ে। তমাল ঘরে ঢুকিতেই জিজ্ঞাসা নিয়ে তার দিকে তাকালো রাজীব। তমাল নিজের পরিচয় দিলো। তমালের ধারণা হয়েছিলো রিনি এতোক্ষণে তার সাথে তমালের কি কথা হয়েছে তা ফোনে রাজীবকে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজীবের মুখ দেখে মনে হলো তমাল সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। হয় সে সত্যিই জানে না, অথবা দারুণ অভিনেতা।
একটা টুল টেনে নিয়ে তমাল রাজীবের পাশে বসলো। বললো, দেখুন মধুছন্দা দেবী আপনার কেসটা সমাধানের জন্য আমাকে নিয়োগ করেছেন। কিন্তু আপনার সাথে কথা না বলে তো শুরুই করতে পারছি না আমি।
রাজীব উঠে বসে বললো, বেশ বলুন কি জানতে চান?
অদিতি ভুল কিছু বলেনি। রমণীমোহন চেহারা রাজীবের। ব্যায়াম করা শরীর। যদিও মুখে একটা শিশুসুলভ সারল্য আছে। সেটা যে মুখোশ তাও তার জ-লাইনের কাঠিন্য দেখে অনুমান করা যায়। কিন্তু এই দুই বৈপরীত্য মেয়েদের কাছে তার আকর্ষণকে দুর্বার করে তুলেছে। তমালের ভিতরেই এই গুন গুলো আছে বলে তমাল সহজেই বুঝতে পারলো তা।
তমাল হেসে বললো, প্রথমেই বলুন, কেমন আছেন আপনি?
শারীরিক কুশল জিজ্ঞাসা করলে মানুষ সহজেই সহজ হয়ে যায়। রাজীবও ম্লান হেসে বললো, ওই আছি আর কি। দ্বিতীয় জন্ম উপভোগ করছি। মৃত্যুকে দু ইঞ্চির জন্য পাশ কাটিয়েছি।
তমালের মনে পড়লো, এই দু ইঞ্চি কথাটা অদিতিও বলেছিলো। সে জিজ্ঞেস করলো, কিভাবে ঘটেছিলো ব্যাপারটা আমাকে একটু ডিটেইলস এ বলবেন প্লিজ?
এমন সময় সেই ভদ্রমহিলা চা আর বিস্কুট নিয়ে ঢুকলেন। রাজীব তাকে বললো, মামীমা, আমরা একটু জরুরী কথা আলোচনা করবো, এখন আর কেউ যেন না আসে। ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে চলে গেলেন।
তমাল চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, আপনাকে এই জব এ অ্যাপয়েন্ট কে করেছিলো? মধুছন্দা দেবী, নাকি রাহুল বাবু?
- অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে পার্মানেন্টলি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন রাহুল বাবু। কিন্তু তার আগেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলাম মধুছন্দা দেবীর কাছে।
- একটু খুলে বলুন প্লিজ!
- মুখার্জি হাউসে আগে যিনি অ্যাকাউন্টস সামলাতেন, তার নাম সুরেশ চাকলাদার। বয়স্ক মানুষ। মধুছন্দা দেবীর বাবার আমলের লোক। ওনার বয়স হয়ে গেছে বলে উনি আর ঠিক মতো কাজ করতে পারছিলেন না। এছাড়া ওনার কাজে বেশ অখুশি ছিলেন মধুছন্দা দেবী। তাই ওনাকে ছাড়িয়ে নতুন অ্যাকাউন্টেন্ট খুঁজছিলেন তিনি। তখন আমার সাথে যোগাযোগ হয়। সদ্য পাশ করে ব্যাঙ্গালোর থেকে আসানসোলে ফিরি আমি। নিজের একটা ফার্ম খুলবো এই ইচ্ছা ছিলো।
ওনাদের এক কর্মচারী আমার খুব পরিচিত, তার মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়। মধুছন্দা দেবী আমাকে তাদের খাতাপত্র দেখতে দেন। আমার চোখে বেশ কিছু গড়মিল ধরা পরে। মধুছন্দা দেবী আমার কাজে খুশি হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এও বলেন যে আমাকে পার্মানেন্ট করে নেওয়া হবে।
কিছুদিন পরে রাহুল বাবু এমবিএ করে এসে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব নেন। মধুছন্দা দেবী তাকে বলে আমার চাকরিটা পাকা করেন।
-কি ধরনের গড়মিল দেখতে পান আপনি?
- বেশ বড় অংকের টাকা ব্যালান্স শিটে মেলানো যাচ্ছিলো না। প্রচুর টাকা সরানো হয়েছে, কিন্তু তার কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি।
-কোন সনয়ের গরমিল এগুলো?
- মধুছন্দা দেবীর দাদা মারা যাবার পরের।
- হুম, বুঝলাম। আপনার সাথে রাহুল বাবুর সম্পর্ক কেমন?
- দেখুন উনি একটু রগচটা। হঠাৎ রেগে গিয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যখন রেগে যান, ওনার কান্ডজ্ঞান লোপ পায়। সবার সামনেই বকাঝকা করেন। এমনিতে বস্ হিসাবে ভালোই।
- বেশ,এবারে সেদিনের ঘটনাটা বলুন।
- সেদিন রাত একটা বা দেড়টা নাগাদ আমি সিঁড়িতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পাই। তাই দেখতে নামছিলাম কিসের শব্দ। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যখন নীচে নামছি তখনই হঠাৎ পিঠের বা দিকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি। কিছুক্ষণের ভিতর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি। তারপরে আর আমার কিছু মনে নেই, জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে।
- আমি যতোদূর জানি, আপনি মুখার্জি হাউসের চারতলায় থাকেন। কিন্তু এতো রাতে আপনি একতলার সিঁড়িতে হওয়া শব্দ শুনতে পান?
- হ্যাঁ। আমি জেগেই ছিলাম। আর রাতের বেলা বলেই হয়তো শব্দ কানে আসে।
- তাহলে বেশ জোরেই শব্দ হয়েছে বলতে হবে,আপনি কি রাতে দরজা খোলা রাখেন?
- না তো! বন্ধই রাখি।
- বন্ধ দরজার পিছনে রাতের বেলা হলেও আপনি একতলার শব্দ শুনতে পেলেন? অদ্ভুত তো? আচ্ছা দোতলায় বা তিনতলার কেউ সেই শব্দ শুনে বাইরে আসেনি?
কিছুক্ষণ ভেবে রাজীব বলে না, কাউকে বের হতে দেখিনি।
- হুম, রাহুল বাবুর ঘরের দরজা কি খোলা ছিলো?
- না বন্ধই ছিলো।
- আচ্ছা জ্ঞান হারাবার আগে আপনি কাউকে দেখতে পাননি?
- সিঁড়িটা অন্ধকার ছিলো, ভালো করে দেখতে পাইনি। এক ঝলকের জন্য কাউকে একটা দেখেছিলাম। তারপরে আর কিছু মনে নেই।
- মনে করতে পারেন সে মহিলা না পুরুষ?
- সম্ভবত পুরুষ!
- কিভাবে এতো শিওর হচ্ছেন যে আততায়ী পুরুষই ছিলো?
- শিওর নই, তবে সে শার্ট পরা ছিলো। তার হাতটাই শুধু এক বারের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। একটা মেরুন কালারের শার্ট পরা ছিলো।
- এরকম শার্ট কার কার আছে ওই বাড়িতে?
- ঠিক জানিনা। মনে নেই আমার।
- পুলিশ কিন্তু রাহুল বাবুকেই সন্দেহ করছে। আপনার কি মনে হয়? তিনি হতে পারেন?
- পুলিশ আমাকেও জিজ্ঞাসা করেছিলো। আমি সঠিক বলতে পারিনি। তবে পুরুষ বলতে তো সে আর আমি ছিলাম ওই বাড়িতে?
- কেন? ঘনশ্যাম বাবু ছিলেন, বিনোদ ছিলো, দারোয়ান গণেশ ছিলো, আরও দুজন চাকর আছে বাড়িতে,নাম জানি না অবশ্য, তারা হতে পারে না?
- হ্যাঁ, রাজু আর ভজা। কিন্তু তারা কেন আমাকে ছুরি মারতে যাবে?
- রাহুল বাবুই বা কেন ছুরি মারতে যাবেন? কোনো কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?
চিন্তায় পড়ে গেলো রাজীব। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপরে একটাই শব্দ উচ্চারণ করলো, "না"!
রিনি প্রসঙ্গ ইচ্ছা করেই তুললো না তমাল। আর রাজীবও এড়িয়ে গেলো। অথচ রিনির সাথে রাজীবের সম্পর্ক রাহুলের কানে গেলে তার রগচটা মেজাজের মাত্রা হারানো অসম্ভব কিছু না। তাহলে কি রাজীব চায়না যে রিনির সাথে তার আগেই পরিচয় ছিলো একথা প্রকাশ পায়? কিন্তু কেন? যদি কারণটা শুধুই বন্ধুকে চাকরি পেতে সাহায্য করা হয়, তাহলে সেটা জানাতে আপত্তি কিসের?
তমাল বললো, বেশ, আমি আজ আসি। তবে দরকার পড়লে আবার আসবো। জরুরী কিছু মনে পড়লে যাতে তমালকে জানাতে পারে, তাই দুজনে নিজেদের মোবাইল নাম্বার বিনিময় করলো। তারপর বাইরে বেরিয়ে এলো তমাল।
গাড়িতে বসে একটা ফোন করলো তমাল।
... সুদর্শন, আমি তমাল বলছি রে.... এই চলছে, তোর কি খবর... হা হা হা... না না, সেরকম কিছু নয়, যাবো একদিন সময় করে... শোন না, একটা কাজ করে দিতে হবে ভাই, আমি কতোগুলো, নাম্বার পাঠাচ্ছি, তাদের গত দু মাসের কল ডিটেইলস আমার দরকার... হ্যাঁ জানি অসুবিধার, কিন্তু প্লিজ একটু দেখ না... খুব জরুরী না হলে তোকে বলতাম?... আচ্ছা, আচ্ছা, তোর আর সায়নীর একটা ট্রিট পাওনা রইলো, ফিরেই দেবো... ও.কে... থ্যাকস্ ব্রো... আমাকে ফোনে বা মেইল এ পাঠিয়ে দিস... বাই!
ফোন রেখে তমাল বিনোদকে বললো, রাজীব বাবুর অ্যাক্সিডেন্টটা যেদিন ঘটে, তুমি কোথায় ছিলে বিনোদ?
- আমি আমার রুমে ঘুমাচ্ছিলাম দাদা। অদিতি ম্যাডাম ফোন করে আমাকে জাগালেন।
- রাত তখন ক'টা হবে?
- দেড়টা থেকে দুটোর ভিতরে। আমিই তো ডাক্তার চৌধুরী কে নিয়ে এলাম। যখন ডাক্তার বাবুর বাড়ি পৌঁছাই, তখন ঠিক দুটো বাজে, মনে আছে। ঘটনা তার একটু আগেই হবে।
- তোমাকে তো পরেও ডাকা হতে পারে? ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তোমাকে ডাকা হয়েছে, জানলে কিভাবে?
চোয়াল ঝুলে পড়লো বিনোদের। সে অবাক হয়ে চুপ করে রইলো। তারপর বললো-
- যেমন রক্ত পড়ছিলো তাতে কেউ দেরী করে কেন ডাকবে দাদা?
- তমাল বললো, তা ঠিক। আমি বুঝতে চাইছিলাম তুমি সময়টা সম্পর্কে এক'শ ভাগ নিশ্চিত কি না?
- তুমি তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে কোয়ার্টারে থাকো, ভালো করে মনে করে দেখোতো বিনোদ, অদিতি তোমাকে ডাকার আগে তুমি নীচের তলার সিঁড়িতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনেছিলে কি?
- কই, তেমন তো কোনো শব্দ শুনিনি দাদা?
- হুম, আর কেউ শুনেছিলো কি না জানো?
- নাহ্! কেউ তো কিছু বলেনি?
-আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী কি এনাদের ফ্যামিলি ডাক্তার?
- হ্যাঁ দাদা। সব ব্যাপারেই ডাক্তার চৌধুরীকেই ডাকা হয়। বহুদিন ধরেই এই পরিবারের ডাক্তার তিনি।
- তোমার সাথে আলাপ আছে ডাক্তার বাবুর?
- কেন থাকবে না? আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমিই তো নিতে আসি বেশিরভাগ সময়।
- আমাকে একবার নিয়ে চলোতো তার কাছে? কাল থেকে পেটে একটা চিন চিনে ব্যাথা হচ্ছে!
- বেশ তো, চলুন! ওনার একটা ট্যাবলেট পড়লেই ঠিক হয়ে যাবেন।
সময়টা একদম পারফেক্ট ছিলো ডাক্তারের কাছে যাবার। বিনোদ যখন তমাল কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, তখন ডাক্তারের চেম্বারে রুগীর ভিড় শেষ হয়ে এসেছে। বিনোধ চেম্বারে উঁকি দিয়ে বলে এলো তমালের কথা। ডাক্তার তাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন।
অদিতি বললো, কিসের দেরি তমালদা? তমাল বললো, কিছু না, চলো যাওয়া যাক্।
অদিতি আর গার্গীকে বাড়িতে নামিয়ে বিনোদকে নিয়ে তমাল চলে এলো রাজীবের আত্মীয়ের বাড়িতে। বেল বাজাতেই মাঝ বয়সী একজন মহিলা দরজা খুললো।
রাজীবের সাথে দেখা করতে এসেছে শুনে তাকে রাজীবের ঘরে পৌঁছে দিলেন তিনি। বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলো রাজীব বালিশে হেলান দিয়ে। তমাল ঘরে ঢুকিতেই জিজ্ঞাসা নিয়ে তার দিকে তাকালো রাজীব। তমাল নিজের পরিচয় দিলো। তমালের ধারণা হয়েছিলো রিনি এতোক্ষণে তার সাথে তমালের কি কথা হয়েছে তা ফোনে রাজীবকে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজীবের মুখ দেখে মনে হলো তমাল সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। হয় সে সত্যিই জানে না, অথবা দারুণ অভিনেতা।
একটা টুল টেনে নিয়ে তমাল রাজীবের পাশে বসলো। বললো, দেখুন মধুছন্দা দেবী আপনার কেসটা সমাধানের জন্য আমাকে নিয়োগ করেছেন। কিন্তু আপনার সাথে কথা না বলে তো শুরুই করতে পারছি না আমি।
রাজীব উঠে বসে বললো, বেশ বলুন কি জানতে চান?
অদিতি ভুল কিছু বলেনি। রমণীমোহন চেহারা রাজীবের। ব্যায়াম করা শরীর। যদিও মুখে একটা শিশুসুলভ সারল্য আছে। সেটা যে মুখোশ তাও তার জ-লাইনের কাঠিন্য দেখে অনুমান করা যায়। কিন্তু এই দুই বৈপরীত্য মেয়েদের কাছে তার আকর্ষণকে দুর্বার করে তুলেছে। তমালের ভিতরেই এই গুন গুলো আছে বলে তমাল সহজেই বুঝতে পারলো তা।
তমাল হেসে বললো, প্রথমেই বলুন, কেমন আছেন আপনি?
শারীরিক কুশল জিজ্ঞাসা করলে মানুষ সহজেই সহজ হয়ে যায়। রাজীবও ম্লান হেসে বললো, ওই আছি আর কি। দ্বিতীয় জন্ম উপভোগ করছি। মৃত্যুকে দু ইঞ্চির জন্য পাশ কাটিয়েছি।
তমালের মনে পড়লো, এই দু ইঞ্চি কথাটা অদিতিও বলেছিলো। সে জিজ্ঞেস করলো, কিভাবে ঘটেছিলো ব্যাপারটা আমাকে একটু ডিটেইলস এ বলবেন প্লিজ?
এমন সময় সেই ভদ্রমহিলা চা আর বিস্কুট নিয়ে ঢুকলেন। রাজীব তাকে বললো, মামীমা, আমরা একটু জরুরী কথা আলোচনা করবো, এখন আর কেউ যেন না আসে। ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে চলে গেলেন।
তমাল চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, আপনাকে এই জব এ অ্যাপয়েন্ট কে করেছিলো? মধুছন্দা দেবী, নাকি রাহুল বাবু?
- অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে পার্মানেন্টলি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন রাহুল বাবু। কিন্তু তার আগেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলাম মধুছন্দা দেবীর কাছে।
- একটু খুলে বলুন প্লিজ!
- মুখার্জি হাউসে আগে যিনি অ্যাকাউন্টস সামলাতেন, তার নাম সুরেশ চাকলাদার। বয়স্ক মানুষ। মধুছন্দা দেবীর বাবার আমলের লোক। ওনার বয়স হয়ে গেছে বলে উনি আর ঠিক মতো কাজ করতে পারছিলেন না। এছাড়া ওনার কাজে বেশ অখুশি ছিলেন মধুছন্দা দেবী। তাই ওনাকে ছাড়িয়ে নতুন অ্যাকাউন্টেন্ট খুঁজছিলেন তিনি। তখন আমার সাথে যোগাযোগ হয়। সদ্য পাশ করে ব্যাঙ্গালোর থেকে আসানসোলে ফিরি আমি। নিজের একটা ফার্ম খুলবো এই ইচ্ছা ছিলো।
ওনাদের এক কর্মচারী আমার খুব পরিচিত, তার মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়। মধুছন্দা দেবী আমাকে তাদের খাতাপত্র দেখতে দেন। আমার চোখে বেশ কিছু গড়মিল ধরা পরে। মধুছন্দা দেবী আমার কাজে খুশি হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এও বলেন যে আমাকে পার্মানেন্ট করে নেওয়া হবে।
কিছুদিন পরে রাহুল বাবু এমবিএ করে এসে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব নেন। মধুছন্দা দেবী তাকে বলে আমার চাকরিটা পাকা করেন।
-কি ধরনের গড়মিল দেখতে পান আপনি?
- বেশ বড় অংকের টাকা ব্যালান্স শিটে মেলানো যাচ্ছিলো না। প্রচুর টাকা সরানো হয়েছে, কিন্তু তার কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি।
-কোন সনয়ের গরমিল এগুলো?
- মধুছন্দা দেবীর দাদা মারা যাবার পরের।
- হুম, বুঝলাম। আপনার সাথে রাহুল বাবুর সম্পর্ক কেমন?
- দেখুন উনি একটু রগচটা। হঠাৎ রেগে গিয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যখন রেগে যান, ওনার কান্ডজ্ঞান লোপ পায়। সবার সামনেই বকাঝকা করেন। এমনিতে বস্ হিসাবে ভালোই।
- বেশ,এবারে সেদিনের ঘটনাটা বলুন।
- সেদিন রাত একটা বা দেড়টা নাগাদ আমি সিঁড়িতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পাই। তাই দেখতে নামছিলাম কিসের শব্দ। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যখন নীচে নামছি তখনই হঠাৎ পিঠের বা দিকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি। কিছুক্ষণের ভিতর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি। তারপরে আর আমার কিছু মনে নেই, জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে।
- আমি যতোদূর জানি, আপনি মুখার্জি হাউসের চারতলায় থাকেন। কিন্তু এতো রাতে আপনি একতলার সিঁড়িতে হওয়া শব্দ শুনতে পান?
- হ্যাঁ। আমি জেগেই ছিলাম। আর রাতের বেলা বলেই হয়তো শব্দ কানে আসে।
- তাহলে বেশ জোরেই শব্দ হয়েছে বলতে হবে,আপনি কি রাতে দরজা খোলা রাখেন?
- না তো! বন্ধই রাখি।
- বন্ধ দরজার পিছনে রাতের বেলা হলেও আপনি একতলার শব্দ শুনতে পেলেন? অদ্ভুত তো? আচ্ছা দোতলায় বা তিনতলার কেউ সেই শব্দ শুনে বাইরে আসেনি?
কিছুক্ষণ ভেবে রাজীব বলে না, কাউকে বের হতে দেখিনি।
- হুম, রাহুল বাবুর ঘরের দরজা কি খোলা ছিলো?
- না বন্ধই ছিলো।
- আচ্ছা জ্ঞান হারাবার আগে আপনি কাউকে দেখতে পাননি?
- সিঁড়িটা অন্ধকার ছিলো, ভালো করে দেখতে পাইনি। এক ঝলকের জন্য কাউকে একটা দেখেছিলাম। তারপরে আর কিছু মনে নেই।
- মনে করতে পারেন সে মহিলা না পুরুষ?
- সম্ভবত পুরুষ!
- কিভাবে এতো শিওর হচ্ছেন যে আততায়ী পুরুষই ছিলো?
- শিওর নই, তবে সে শার্ট পরা ছিলো। তার হাতটাই শুধু এক বারের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। একটা মেরুন কালারের শার্ট পরা ছিলো।
- এরকম শার্ট কার কার আছে ওই বাড়িতে?
- ঠিক জানিনা। মনে নেই আমার।
- পুলিশ কিন্তু রাহুল বাবুকেই সন্দেহ করছে। আপনার কি মনে হয়? তিনি হতে পারেন?
- পুলিশ আমাকেও জিজ্ঞাসা করেছিলো। আমি সঠিক বলতে পারিনি। তবে পুরুষ বলতে তো সে আর আমি ছিলাম ওই বাড়িতে?
- কেন? ঘনশ্যাম বাবু ছিলেন, বিনোদ ছিলো, দারোয়ান গণেশ ছিলো, আরও দুজন চাকর আছে বাড়িতে,নাম জানি না অবশ্য, তারা হতে পারে না?
- হ্যাঁ, রাজু আর ভজা। কিন্তু তারা কেন আমাকে ছুরি মারতে যাবে?
- রাহুল বাবুই বা কেন ছুরি মারতে যাবেন? কোনো কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?
চিন্তায় পড়ে গেলো রাজীব। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপরে একটাই শব্দ উচ্চারণ করলো, "না"!
রিনি প্রসঙ্গ ইচ্ছা করেই তুললো না তমাল। আর রাজীবও এড়িয়ে গেলো। অথচ রিনির সাথে রাজীবের সম্পর্ক রাহুলের কানে গেলে তার রগচটা মেজাজের মাত্রা হারানো অসম্ভব কিছু না। তাহলে কি রাজীব চায়না যে রিনির সাথে তার আগেই পরিচয় ছিলো একথা প্রকাশ পায়? কিন্তু কেন? যদি কারণটা শুধুই বন্ধুকে চাকরি পেতে সাহায্য করা হয়, তাহলে সেটা জানাতে আপত্তি কিসের?
তমাল বললো, বেশ, আমি আজ আসি। তবে দরকার পড়লে আবার আসবো। জরুরী কিছু মনে পড়লে যাতে তমালকে জানাতে পারে, তাই দুজনে নিজেদের মোবাইল নাম্বার বিনিময় করলো। তারপর বাইরে বেরিয়ে এলো তমাল।
গাড়িতে বসে একটা ফোন করলো তমাল।
... সুদর্শন, আমি তমাল বলছি রে.... এই চলছে, তোর কি খবর... হা হা হা... না না, সেরকম কিছু নয়, যাবো একদিন সময় করে... শোন না, একটা কাজ করে দিতে হবে ভাই, আমি কতোগুলো, নাম্বার পাঠাচ্ছি, তাদের গত দু মাসের কল ডিটেইলস আমার দরকার... হ্যাঁ জানি অসুবিধার, কিন্তু প্লিজ একটু দেখ না... খুব জরুরী না হলে তোকে বলতাম?... আচ্ছা, আচ্ছা, তোর আর সায়নীর একটা ট্রিট পাওনা রইলো, ফিরেই দেবো... ও.কে... থ্যাকস্ ব্রো... আমাকে ফোনে বা মেইল এ পাঠিয়ে দিস... বাই!
ফোন রেখে তমাল বিনোদকে বললো, রাজীব বাবুর অ্যাক্সিডেন্টটা যেদিন ঘটে, তুমি কোথায় ছিলে বিনোদ?
- আমি আমার রুমে ঘুমাচ্ছিলাম দাদা। অদিতি ম্যাডাম ফোন করে আমাকে জাগালেন।
- রাত তখন ক'টা হবে?
- দেড়টা থেকে দুটোর ভিতরে। আমিই তো ডাক্তার চৌধুরী কে নিয়ে এলাম। যখন ডাক্তার বাবুর বাড়ি পৌঁছাই, তখন ঠিক দুটো বাজে, মনে আছে। ঘটনা তার একটু আগেই হবে।
- তোমাকে তো পরেও ডাকা হতে পারে? ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তোমাকে ডাকা হয়েছে, জানলে কিভাবে?
চোয়াল ঝুলে পড়লো বিনোদের। সে অবাক হয়ে চুপ করে রইলো। তারপর বললো-
- যেমন রক্ত পড়ছিলো তাতে কেউ দেরী করে কেন ডাকবে দাদা?
- তমাল বললো, তা ঠিক। আমি বুঝতে চাইছিলাম তুমি সময়টা সম্পর্কে এক'শ ভাগ নিশ্চিত কি না?
- তুমি তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে কোয়ার্টারে থাকো, ভালো করে মনে করে দেখোতো বিনোদ, অদিতি তোমাকে ডাকার আগে তুমি নীচের তলার সিঁড়িতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনেছিলে কি?
- কই, তেমন তো কোনো শব্দ শুনিনি দাদা?
- হুম, আর কেউ শুনেছিলো কি না জানো?
- নাহ্! কেউ তো কিছু বলেনি?
-আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী কি এনাদের ফ্যামিলি ডাক্তার?
- হ্যাঁ দাদা। সব ব্যাপারেই ডাক্তার চৌধুরীকেই ডাকা হয়। বহুদিন ধরেই এই পরিবারের ডাক্তার তিনি।
- তোমার সাথে আলাপ আছে ডাক্তার বাবুর?
- কেন থাকবে না? আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমিই তো নিতে আসি বেশিরভাগ সময়।
- আমাকে একবার নিয়ে চলোতো তার কাছে? কাল থেকে পেটে একটা চিন চিনে ব্যাথা হচ্ছে!
- বেশ তো, চলুন! ওনার একটা ট্যাবলেট পড়লেই ঠিক হয়ে যাবেন।
সময়টা একদম পারফেক্ট ছিলো ডাক্তারের কাছে যাবার। বিনোদ যখন তমাল কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, তখন ডাক্তারের চেম্বারে রুগীর ভিড় শেষ হয়ে এসেছে। বিনোধ চেম্বারে উঁকি দিয়ে বলে এলো তমালের কথা। ডাক্তার তাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন।