29-09-2024, 07:42 PM
(This post was last modified: 29-09-2024, 07:48 PM by Mr.pkkk. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
Update:15(A)
বারান্দার এক খুঁটিতে কাঁধ ঠেকিয়ে অজয় বসে আছে। যে আনন্দ নিয়ে আজ বাড়ি এসেছে সে আনন্দ নিমেষে উধাও হয়ে গেছে।দু'হাতে বাবাকে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে অমর বসে আছে চোখ বুজে।আর স্বামীর মাথার কাছে ঊষা দাঁড়িয়ে আছে খুঁটিতে পিঠ ঠেঁকিয়ে।
বিনোদ বসে আছে নিজের খোপড়ার সামনে একটা বস্তা পেতে।গড়গড়ড়ড়ড় করে হুকো টানছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে খেয়ে ওপর দিকে উঠছে, তামাক পোড়ার ঝাঁঝালো কটু গন্ধ চারপাশে । হুকো টানছে আর খক্ খক্ করে কাশছে,ছেলেকে উদ্দেশ্য করে একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে, তাতে ছেলে শুনল কি না যায় আসে না।
এদিকে ত্রিমুখী চিন্তা তিনজনের মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
অজয়ের চিন্তা টাকা-পয়সা।যে কয়টা টাকা নিয়ে এসেছে তা দিয়ে ভেবেছিল পুজোটা করবে।পুজোর জন্যই আজ বাড়ি ফেরা, গতকাল আসতে চেয়েও ওই সম্পূর্ণ টাকা না পাওয়ায় আসতে পারেনি। আজ সক্কাল সক্কাল খুশি মনে বেরিয়ে পড়েছে, সপ্তাহে এই একটা-দুটো দিনই তো সে পায় পরিবারের সাথে সময় কাটাতে।পুজো বাবদ যা খরচা হবে তা বাদ দিয়ে গুরুদেবের সেবার
খাতিরে ঊষার হাতে দিবে বাকি টাকাটা কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই দেখল ঘর উলটে আছে।
এই সেদিন ঘরটা মেরামত করে গেল নিজের হাতে।ভেবে রেখেছিল হাতে কয়টা টাকা এলে নতুন করে বানাবে।গরুগুলোর কষ্ট যে তারও সহ্য হয় না।কিন্তু! কিন্তু! এখন কোনটা করব?যে কয়টা টাকা পকেটে আছে তা দিয়ে পুজো আর এ কদিনের খরচ চালানোই কষ্ট।এর মধ্যে থেকেই যদি ঘরটা খাড়া করতে হয়....আহহ। আসার পর থেকে একই চিন্তা করে যাচ্ছে, কি থেকে কি করব ভেবে পাচ্ছে না।
ঝড় কেন যে সারাজীবন গরীবের মাথার ওপর দিয়েই চলে?তার মতো দীন-দুঃখীদের সাথেই ভগবানের যত বোঝাপড়া।গ্রামে কত বড় বড় বাড়ি সেগুলো নজরে পড়ে না?
'গরীবের চাল দূব্বা বনে পড়ে।'-এটাই তো হয়ে আসছে চিরকাল।
ছেলের চিন্তা মা।আর মায়ের চিন্তা ছেলে।ছেলে আর স্বামীকে ফিরতে দেখে ঊষা থমকে দাঁড়িয়েছিল রাস্তার মোড়ে।অশ্রুসিক্ত চোখ, আলুথালু চুল, ব্লাউজের হুক খুলে দুধ বেরিয়ে গেছে, চোখ মুখের ফ্যাদা হাত দিয়ে পরিস্কার করলেও তখনও লেগে ছিল একটু আধটু চোখের জলের সাথে তা মিশে একাকার হয়ে গেছে।তখনই রাস্তা দিয়ে গ্রামেরই এক লোক সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল, ঊষার অমন রূপ দেখে সাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল -' কই যাও বউমা, কি হইচে তোমার? '
ঊষা উত্তর দেওয়ার সময় পায়নি।স্বামী আর ছেলেকে একসাথে ফিরতে দেখে জমে গেছিল সেখানেই। লোকটা ক্ষুধার্ত নয়নে তাকিয়ে থেকে যখন আবার বলল- 'কি চিন্তা করো, তোমার অমন অবস্থা ক্যা?'
'উঁউউউউ....।' লোকটার দিকে ভেজা চোখ পরতেই দেখল গ্রামের পরাণ কাকা।সবাই 'খোইলা' বলে ডাকে।গ্রামের একমাত্র খোলবাদক। কীর্তন বা হরিসভা হলে এই পরাণ ছাড়া উপায় নাই,লোকে সমাদরও করে উনাকে গ্রামে সভা হোক নালিশ হোক বা কোন অনুষ্ঠান পরাণ কাকা হাজির। সেদিন দীক্ষার দিনও এই পরাণ কাকা ঊষাদের বাড়ি এসেছিল।
উনার চোখের সাথে চোখ মিলতেই ঊষার হুশ ফিরল।কেমন তীক্ষ্ণ ফলার মতো চোখ গেঁথে আছে ঊষার বুকের মাঝে। ঊষা বুঝতে পেরেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে বুক ঢেকে নিল।ব্লাউজের হুক লাগানোর সময় নেই।
'আ আ আ আমি আসি কাকা' বলেই দৌঁড়ে পালালো, স্বামী আর ছেলে তখনও কিছুটা দূরে সেদিকেই ঊষা চলল আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছে আরও শক্ত করে বুকে টেনে নিল।
ঊষার উঁচু উঁচু ভরাট ধামার মতো পাছার থলথলানি পরাণের পরাণে গিয়ে লাগল।খোল বাজানোর তালে হাত নাচিয়ে মনে মনে বোল তুলল-
''ধা তি না গে ধিন না।''...........
ঘাড় অবধি লম্বা চুল তালে তালে এদিক-ওদিক উড়ছে।এবার দ্রুত তালে বোল উঠালেন।যেন সত্যিকারের খোল থাবড়ে থাবড়ে বাজাচ্ছেন -
"তে রে কা টা,তে রে কা টা | ধি রে কা টা ধি রে কা টা"
তে রে কা টা ... তে রে কা টা.............।
-'কেমন আচেন কাকা?কি করতেচেন অমন কইরা?' --- হাসি মুখে অজয় জিজ্ঞেস করল পরাণকে।পরাণ নিজের খোল বাজাতে এতটাই মত্ত ছিল যে কখন যে অজয় তার স্ত্রী ও ছেলে সামনে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি।অজয়ের কথায় হয়ত কিছুটা লজ্জা পেল। হেসে উত্তর দিল--'ওই খোল বাজাইতেছিলাম মনে মনে, মেলা দিন থিকা চর্চা নাই তো, পুরান খোলডা নষ্ট হইয়া যাওয়ার পর থিকা হাত নিসফিস করতেচে নতুন খোলের জইন্যে.....।
কথা গুলো ঊষার দিকে লক্ষ্য করে এমন ভাবে বলল যে ঘোমটার তলে থেকেও ঊষা লজ্জায় নত হয়ে গেল।অমন করুন ভেজা চোখের দিকে কি উনি একবারও তাকায়নি? হয়ত তাকায়নি নইলে উনি এই অসময়ে খোল বাজাতেন না।মানুষ শুধু নিজের ধান্দায় থাকে।অজয় আর পরাণের মাঝে আরও হাসিমাখা কিছু কথা হয়েছিল।
কিন্তু ঊষা সেসব নিয়ে চিন্তা করছে না।
ঊষার দুঃখ একটাই এবং এখনো ভেবে চলেছে - ছেলে তাকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয়নি, একটা কথা পর্যন্ত বলেনি সেই তখন থেকে এ অবধি।দৌঁড়ে গিয়ে বুকে জাপটে ধরতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,ভেবেছিল হাঁউ হাঁউ করে কাঁদবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু ছেলে তাকে ছুঁতে পর্যন্ত দিলনা।থু থু ফেলার ভঙ্গি করে বাবার পেছনে গিয়ে লুকালো!!!
আহহ এ কলঙ্ক আমি রাখব কোথায়?ছেলের চোখে সে নষ্টা,অস্পৃশ্য পতিতা।জড়িয়ে ধরতে না দিক,থু থু ছিটাক তাতে দুঃখ নেই কিন্তু ছেলের নীরবতা! এ নীরবতা তো কিছুতেই সহ্য করা যায় না।যেখানে বোবা সন্তানের মুখে ' মা' ডাক শুনতে মায়েরা পাগল হয়ে যায়,সেখানে সন্তান নীরব হলে মায়েদের অবস্থা কেমন হতে পারে?
ঊষা ভাবছে ছেলে তাকে 'মা' না ডাকুক গুরুদেবের মতো যদি 'মাআআআ......।'আহ আর ভাবতে পারল না।অমন কথা কোন মা ভাবতেও পারে না। শুধু থেকে থেকে বিনোদের হুকোর মাথায় কল্কেতে যেমন আগুন জ্বলছে ,তামাক গুলো পুড়ে ছাই হচ্ছে সেই আগুনে তেমনি ঊষার ভেতরটাও রয়ে রয়ে পুড়তে লাগল।মন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তামাক পোড়া গন্ধ দূর থেকেও নাকে আসে,কিন্তু মনপোড়ার গন্ধ এত কাছ থেকেও নাকে আসে না,কেউ বুঝতেও পারে না।
ঊষার মন শুধু বলে উঠল -মরতে হবে আমাকে মরতে হবে............. আমাকে মরতেইইইইইই হবে....। 'মরতে হবে' কথাটা মনে আসতেই যেন নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেল উষা।থরথর করে কাঁপছে, নাকের পাটা ফুলে উঠল, চোখ ধারালো অস্ত্রের মতো চকচক করেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ বাঁচার নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে ঊষা।
-এই তোমার কি হইচে,অমন করতেচে ক্যা? এই ঊষা, এইইইইইইই........।
অজয়ের হাতের ধাক্কায় জ্ঞান ফিরল-
- 'অ্যাঁ'
-'অমন কাঁপতেছ ক্যা? শরীর ভালো ঢেকতেছে না?'
ঊষা কিছু বলবে তার আগেই বিনোদ বলল--'আর ভালো থাহা, যে ঝুক্কি ওর মাথার উপর দিয়া গেচে কাইল,ভাইগ্য ভালো বাঁইচা আচে এহনো...........।
- কি হইচে কি হইচে.......। বাপের কথায় অজয় বিচলিত হয়ে উঠল।এতক্ষণ অনেক কথা বিনোদ বলেছে কিন্তু মনোযোগ দেয়নি,যেই বউয়ের ব্যাপারে বলল চট করে দাঁড়িয়ে পরল অজয়।জিজ্ঞাসার নজরে ঊষার দিকে তাকিয়ে রইল, হয়ত জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছিল তোমার। ঊষা কিছু বলল না।
বলল বিনোদ --'ওই কাইলকার ঝড়িতে তোর বউ ঘরের নিচে চাপা পরছিল।কোমর ভাইঙ্গা নুইচে.........।ভাইগ্য ভালো উড়াই নিয়া যায় নাই গুরুদেব বুইঝা শুইনা পাগা দিয়া খুঁটিতে বান্ধা রাখচিল, নইলে আইজ কি আর বাড়ি ফিরা বউরে খুঁইজা পাইতি........।
বিনোদের কথা শুনে চমকে উঠল তিনজনই।ঊষার চোখ কপালে উঠে গেছে, কি সব বলছেন উনি! ছেলে গেছে এখন কি স্বামীটাকেও কেড়ে নেবে সবাই?যাক সবাই ছেড়ে যাক, আমিও ছেড়ে যাবো সবাইকে জনমের মতো।
অমর কানাবুড়োর কথা শুনে হা করে আছে।এর কোন জ্ঞানকান্ড নেই,তালহীন মানুষ। কতবড় রাজ যার জন্য মনে লুকিয়ে রেখেছি আর শালা বুড়ো তার কাছেই বলে দিচ্ছে। মায়ের উপর রাগ আছে অভিমান আছে সবই আছে কিন্তু ঘৃনা নেই। অমর জানে তার মা গঙ্গার মতো পবিত্র।তাকে দূষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মনে কষ্ট আছে মা তাকে মেরেছে, বুক ফেটে যাচ্ছে একবার 'মা' বলে ডাকতে।কিন্তু কোথায় যে একটা খঁচখচানি বুঝতে পারছে না।
বাপের কথা শুনে অজয়ও থ হয়ে গেছে। কি বলছে! ঊষার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কালো হয়ে উঠেছে মুখের রঙ।অজয়ের মুখটাও কালো হয়ে উঠল।সবাই চুপ- অজয় কিছু বলবে বলবে করেও মুখে আনতে পারল না।
বিনোদ সত্যিই কানাওয়ালা নির্বোধ।সবাই চুপ দেখে আরও রসালো ভাবে ছেলের সামনে গতকালের দুঃখের পালা গাইতে লাগল--
' সেই কি টানাহ্যাঁচড়া সারাদিন।হেই মাঝ রাইত অবধি গুরুদেব কোমরে গরম ত্যাল মালিশ কইরা কইরা সে সুস্থ করাই তুইলল,নইলে কি আর বউরে খাড়া দেখতি.....খালি গুরুদেব সহায় বইলা রক্ষা এই যাত্রা...।' বলেই কপাল ঠুকে প্রণাম করতে লাগল বারবার।
স্তব্ধ পরিবেশ। শেষে অজয়ই স্বাভাবিক করে তুলল--
-তুমি ঠিক আচাও তো এহন?
বাড়ি ফিরে বউ কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে,যা অবস্থা বাড়ি ভোলারই কথা।
-হ, এহন ঠিক আছি।' ঊষাও নিচু মাথায় শান্ত ভাবে জবাব দিল।
গুরুদেবের প্রসঙ্গ উঠতেই অজয় বলল--
- 'বাবা কোনে?' গুরুদেবের খোঁজটাও নেওয়া হয়নি এতক্ষণ।
-' উনি ঘুমাইতেছে।' স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল ঊষা।কিন্তু মনে ঘৃনা ভরতি।
- 'ডাক দিবার পারবা? অল্প দরকার ছিল....।
--' হুম'
অনিচ্ছুক সত্ত্বেও ঊষা যাচ্ছিল, কি একটু ভেবে অজয়ই মানা করল, বলল-
--'থাইক পরে ডাক দাও, খাওয়া দাওয়া কইরা নেই, তারপর উনার সাথে কথা কওয়া যাইবেনে......চলো কয়ডা খাইবার দাও।'
ঊষা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় ছেলেকে দেখিয়ে বলল ওকেও নিয়ে চলো। মায়ের মন তো যত যাইহোক ছেলে না খেয়ে থাকবে এটা হয় নাকি।
- 'চল রে বেটা....।' অমর একটু বেঁকে বসল কিছুতেই যাবে না।ছেলেকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলতে তুলতে হেসে অজয় বলল- মায়ের ওপর এত রাগ ভালো না রে বেটা,মায় মারচে অন্য কেউ তো না.....।'
চটাস করে কেউ যেন গালে চড় বসিয়ে দিল ঊষার।এই কথাটায় অমর যতটা না ব্যথা পেল তার শতগুন পেল ঊষা। একা মারলে হয়ত এতটা ব্যথা ঊষা পেত না উহহহ মেরেছে যে ওই শয়তানটাও।নিজের হাত নিজে কামড়াতে মন চাইছে, চোখের সামনে কেমন টুঁটি চেপে ধরেছিল। তলপেটে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল, আহহহ খুব লেগেছে।আর আর আর আমি? আ আ..আমি..... ছেলের গালে চড় মারা হাতটা মুখের সামনে তুলে কেঁদে দিল ঝরঝর করে, আজ মেরেই ফেলত.........আজ সব হারাতে হতো ।চোখের জল লুকাতে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে নিয়ে দ্রুত চলে গেল রান্না ঘরে।
অজয় ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেছে।ঊষা গাল হাঁটুতে ঠেকিয়ে আনমনে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অজয়ের খাওয়া প্রায় শেষ কিন্তু অমরের গলা দিয়ে ভাত আর নামছে না।
- কি রে সোনা খাস না কিসের জইন্যে। ভাত নষ্ট করিস না রে বাপ....নষ্ট করিস না।
অজয় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল।অজয় জানে একমুঠো ভাতের মূল্য।ভাত মাটিতে পরলে খুটে খুটে তুলে নেয়।এই ভাতের জন্যই সবাইকে ছেড়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাইরে পরে থাকে।ঊষার দিকে তাকিয়ে বলল-- 'তুমি যাও এহন গুরুদেবরে কও গা একটু বাইরে আইসা বসুক, আমি হাত মুখ ধুইয়া আসতেচি।'
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঊষাকে যেতে হলো, উপায় নেই।ঘরে গিয়ে দেখল উল্টো দিকে মুখ ফিরে গুরুদেব শুয়ে আছে। বিছানার ওপর গুরুদেবের ব্যাগ এবং বাইরে যা জামাকাপড় ছিল একটাও নেই।তবে কি উনি.....। ঊষা ডাকল-
-'আপনেরে বাইরে যাইতে কইতেচে।'
কোন সাড়া নেই।ঊষা আবার বলল
- 'আপনের সাথে কি যেন দরকার আচে।'
তবুও সাড়া নেই। এবার ঊষা কাঁধে ধাক্কা দিয়ে যেই বলেছে--
'আপনেরে.........।'
- 'সর মাগিইইইইইইইইইই.......।'
ফালদে এলেন ঘুষি তুলে, চমকে উঠে পিছিয়ে দাঁড়ালো ঊষা।ঘুষিটা লাগতে লাগতেও ছুঁতে পারল না ঊষার থুতুনি।লাল চোখে ঊষার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যে ওই আগুনেই ঊষাকে পুড়ে মরতে হবে।
- 'তোর কোন কথাই শুনুম না মাগি.. তুই যা এহেন থিকা, আমি আজই চইলা যামু....।'
হতভম্ব ঊষা।মাগি বলে ডাকছে! বাইরে শ্বশুর, স্বামীও চলে আসতে পারে।সবে শুকানো চোখে আবার জল চলে এলো ।আজ কেউ এ চোখের জল শুকাতে দিবে না, কেউই না.......।
চোখে জল নিয়েই নাক টেনে টেনে ভেজা সুরে ফিসফিস করে বলল
- ক্ষতি যা করার করচেন.. এহন এইটুক আর বাকি রাইখপেন ক্যা? আমারে শ্যাষ কইরা যান.... যান চইলা বইসা রইচেন ক্যা?
মুখে আঁচল চেপে দৌঁড়ে চলে এল রুম থেকে। সটান নিজের বিছানায় উপুর হয়ে পরল..ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে লাগল।
গুরুদেব চৌকির নিচে পা ঝুলিয়ে দুই হাতে ঢেস দিয়ে পাথরের মতো বসে রইলেন, চোখ মাটির দিকে। রান্না ঘরের ঘটনার পরই গুরুদেব নিজের রুমে ফিরে আসেন, এসেই আর দেরি করেননি ধমাধম নিজের ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে লাগেন।বাইরে পা বাড়াবে ঠিক তখনই দেখে অজয় ছেলেকে নিয়ে বউকে নিয়ে ফিরে আসছে। গুরুদেব আর রাস্তা ধরতে পারলেন না। ফিরে গেলেন কিন্তু দাউদাউ করতে লাগল ভেতর।কি দোষ ছিল আমার?আমি তো কিছু নিজে থেকে করিনি,তুই চাইছিস আমি তার মান রেখেছি তাতেই আমার দোষ আমার ওপর বটি তুলে কঅঅঅঅত সাহস।তোর ছেলে যে আমায় মারল.....।ওই পাটকাঠির কথা মনে আসতেই থু থু ফেলেছিলেন একগাদা মেঝেতেই। গুরুদেবের মনে এসবই ঘোরপাক খাচ্ছিল।এখনো খাচ্ছে। চলেই যাবো থাকব না আর, এ অপমান আর নেওয়া যায় না।
স্থির ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন গুরুদেব।বাইরে থেকে আওয়াজ এলো- 'অমরের মা ও অমরের মা বাবা উঠচে নাকি, ডাক দাও আসপার কও।'
ঊষার কোন গলা না পেয়ে অজয় নিজেই ঘরে গেল।দেখল ঊষা উপুর হয়ে শুয়ে আছে।মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল- 'এই কি হইচে তোমার?'
ঊষা মুখ না তুলেই উত্তর দিল-' মাথাডা অল্প ধরচে, তুমি যাও আমি উঠতেচি।'
--'না না না তুমি শুয়াই থাকো বিশ্রাম নেও।' বলেই গুরুদেবের রুমে গেল।করজোরে প্রণাম করে বলল--'
- আপনের সাথে একটু দরকার ছিল বাবা, তা এইহানেই কমু না বাইরে আইসপেন?
আহ কি জ্বালা,তবু গুরুদেব বললেন
- তুমি যাও আমি আসতেচি।'
-'আইচ্ছা আসেন। '
গুরুদেব বাইরে গিয়ে দেখলেন কানাটা তার খোপড়ার বিছানায় বসে এদিকেই মুখ করে আছে।শালা তালহীন মানুষ কোথায় কি বলতে হয় জানে না- আজ সকালেও মাতব্বর আর বাদ বাকিদের সামনে পাগা দিয়ে বেঁধে রাখার কথা, কোমর মালিশের কথা গলগল করে বলে যাচ্ছিল।একটু আগেও ওই একই কথা বলছিল অজয়ের কাছে। তখনই মন চাচ্ছিল ঘাড়ে এসে লাথি বসিয়ে দেয়...। কি বিশ্রী ভাবে মন্টু তখন বলে উঠেছিল - তা বউমার কোমরে কি এহনও ব্যথা আচে...না মানে আমি ত্যাল দিয়া ভালো মালিশ জানি...। সবাই মুচকি মুচকি হাসছিল। এই হাঁদাটা তাও বুঝতে পারে না। শেষে গুরুদেব সামাল দিয়েছেন এদিক সেদিক বুঝিয়ে।কিন্তু কতটা তারা বুঝল কে জানে। যেতে যেতেও কেমন বাঁকা নজরে কাকে যেন খুঁজছিল।এসবের কিছুই তো ঊষাকে বলা হয়নি।
গুরুদেব ধীরে ধীরে অজয়ের সামনে বসলেন।অজয় আবারও সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।গুরুদেব বললেন-
- 'কি কইতে চাও কওউউউ..।'
- 'বাবা আইজ তো পুইজার কথা ছিল,সে জইন্যে বাড়িও ফিরলাম কিন্তু এহন দেহি সব উলটা-পালটা হইয়া রইচে।কি করুম বুঝবার পারতেচি না..।'
- 'তা কি করচে চাও খুইলা কওউ।'
অজয় সংকোচ করছে বলতে যে পকেটে টাকা কম।পুরুষ মানুষের পকেটে টাকা নেই একথাটা মুখ ফুটে অন্যকে বলা কতটা যে লজ্জার কতটা বেদনার কতটা যে অপমানের তা বলে বোঝানো যাবে না।অজয়ের সংকোচ বুঝে গুরুদেব নিজেই বললেন ।
- 'সংকোচ কইরো না যা বলার বলো।'
- 'আসলে বাবা আমার পকেটে যা আচে তা পুইজা আর বাড়ির খরচার জইন্যে রাখা,কিন্তু ঘরডা দেখচেন, ঠিক না করলেও তো হইতেচে না...।'
- 'হুম,............তুমি এক কাজ করো, আগে ঘরডা তুলো, পুইজা পরে কইরলেও হইব। আমি কয়েকমাস পরেই আবার আসুম,তহন না হয় সাইরা যামু...।'
অজয় ঠিক বুঝতে পারল না কয়েকমাস পরে মানে?এর মধ্যে সমস্যা কি এই সামনে শনিবারও তো আছে।অজয়ের মনভাব বুঝতে পেরে গুরুদেব বললেন
- 'আমি আইজ চইলা যাইতেচি, জরুরি এক কাজ আচে এমাসে মনেই ছিল না, আর পুইজা যেহেতু হইতেচে না........।
--- 'নাহ নাহ নাহ আপনে অমন কইরা ফালাই জায়েন না আমার পুলারে..মেলা আশা নিয়া বইসা রইচি সবাই।
বিনোদ গুরুদেবের কথা শুনে নেমে এসেছে, পায়ের ওপর মাথা ঠেঁকিয়ে গুরুদেবকে যেতে মানা করছে।
গলা বাড়িয়ে বউমার উদ্দেশ্য বলল-- ও বউমা শুনচাও গুরুদেব কি কয়, ও বউমা আসো তাড়াতাড়ি তুমি আটকাও.....।
বাপের এই অতিরিক্ত কথায় মাঝে মাঝে অজয়ও বিরক্ত হয়। একটু উচ্চস্বরে বলে উঠল- 'আহ বাবা আপনে চুপ করেন তো, আমারে কইবার দেন....।'
-- তুই কি কইবি,....... তুই কি পারবি গুরুদেবরে আটকাইতে? বউমা পাইরব... বউমা পাইরব...ও বউমাআ আ আ.....।
মর বুইড়া মর,যাইতে চাইতেচে যাইতে দে, তা বাদে আমারে ডাক পারতেচে, শয়তান বুইড়া........., মরেও না যমের অরুচি।
উত্তর তো ঊষা দিলই না মনে মনে শ্বশুরকে গালাগাল দিতে লাগল।অজয় গুরুদেব সকলেই বিরক্ত হয়ে উঠল।বিনোদের কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।
-' হ বাবা, আপনে আর কয়ডা দিন এই গরীবের বাড়ি থাকেন, কষ্ট কইরা হলেও থাকেন বাবা..।'
কি বিষমজ্বালা - এক দন্ড টেকা মুশকিল এখানে সেখানে আরও কিছুদিন। গুরুদেব জানে এই নির্বোধ প্রানি গুলো কোনমতেই ছাড়বে না,থাকতেই হবে।
- 'আইচ্ছা আইচ্ছা, রইলাম, এই সামনের মঙ্গলবার পূর্নিমা ভালো দিন সেদিন পুইজা সারা যাইব।....নে এহন আমারে যাইবার দে শরীর খুব একটা ভালো যাইতেচে না।'
সড়সড়িয়ে গুরুদেব উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন, যাওয়ার সময় ভুল করেও উষার দিকে ফিরে তাকালেন না।
যাক একটা চিন্তা দূর হলো। এখন একটাই চিন্তা ঘর।অজয় বাবাকে বলল-
-বাবা দাউ ডা বাইর কইরা দেন , কয়ডা বাঁশ কাইটা নই।খুঁটি আর বেড়ার বাতাবুইতা বানাই থুই, কাইল সক্কাল সক্কাল বাজার যাইয়া কয়ডা টিন আইনা ছাপড়া দিয়া দেই একবারে।
- হ তাই ভালো হইবেনে, বছর বছর আর ঘর ঠিক করা ভালো ঠেহে না।'
অজয় রওনা দিল বাঁশঝাড়ের দিকে, যাওয়ার সময় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেল, একা একা বাঁশ টেনে বের করা ভীষণ মুশকিল। বিনোদও গেল পিছে পিছে, শক্তপোক্ত পাকা বাঁশ দেখিয়ে দিতে হবে না।
অনেকক্ষণ কেটে গেছে।ঊষার চোখে কালঘুম কালঘুম এসেছে।একটু পরই গভীর ঘুমে ডুবে যাবে।সারাদিনের ঘটনায় সে ক্লান্ত হয়ে পরেছে শারীরিক ও মানসিক দু-ভাবেই। তাই বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমের ঝোঁক এসে পরেছে।হঠাৎ কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল--' কি রে, মরবি না তুই?'
- 'অ্যাঁ?....হ হ হ মরুম'
- তবে ঘুমাচ্ছিস কিসের জন্য? মর তুই..... এই তো উত্তম সময় চেয়ে দেখ কেউ নেই চারপাশে...।
-- ' কিন্তু গুরুদেব যে পাশের রুমে।'
-- গুরুদেবও ঘুমিয়ে গেছে... নে তুই উঠ... সময় পেরিয়ে গেলে আর সুযোগ পাবি না...।শেষ করে দে নিজেকে আর ঘুমিয়ে থাকিস না...।
- হ হ আমি উঠতেচি উঠতেচি..।
জোর করেও চোখ ছাড়াতে পারছে না এদিকে কে যেন তাড়া দিয়েই যাচ্ছে।
এর মাঝেই অন্য একটা ফিসফিসানি স্বর কানে এলো।
- না না না ঊষা তুই এটা করিস না, 'আ**** মহাপাপ' এ পাপ করিস না।কিসের জন্য মরবি, কার জন্য মরবি,তুই মরিস না ঊষা মরিস না।
- 'হ আমি মরুম না। কার জইন্যে মরুম,কিসের জইন্যে মরুম?'
- হা হা হা হা হা কার জন্য মরবি?ওই মুখে ছেলের সামনে রোজ দাঁড়াতে পারবি?..... হা হা হা মনে নাই ছেলে তোকে দেখে থু থু ফেলেছে।তোকে নষ্টা ভাবে......।
- 'হ মনে আচে, আমারে ছুঁইতে পর্যন্ত দেয় নাই..বুক ফাইটা যাইতে ছিল তাও জড়াই ধরতে দেয় নাই।মরুম আমি মরুম কার জইন্যে বাঁচুম?আ.. আ.. আ.. আ আ...আমারে মরতেই হইব..।'
চোখ খুলে গেছে ঊষার, দরদর করে ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। চোখ ওপর দিকে কাঠের চওড়া ধর্নায়। উঠে দাঁড়লো
তখনও কে যেন বলে চলেছে
---তাড়াতাড়ি কর, হ্যাঁ হ্যাঁ .... ওটা তুলে নে ,তারপর শেষ করে দে নিজেকে আর দেরি করিস না।
ঊষা তাই করছিল। আরেকজন প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বারবার অনুরোধ করছে-- তুই মরিস না উষা মরিস না, আমার একটু কথা শোন, তোর ছেলেকে কে দেখবে,একবার শুধু ছেলের কথা ভাব।
ঊষা নীরব।জীবন শেষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
- ওর কথায় কান দিস না- কোন ছেলের কথা বলছে -- যে ছেলে মায়ের মন বোঝে না, কষ্ট দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না সেই ছেলের চিন্তা?
-- ঊষা ও অবুঝ,তুই মা হয়ে এত বড় শাস্তি ওকে দিস না, দোহাই লাগে,, তুই সব ছেড়ে চলে যা.. বহুদূর কোথাও। এই সুন্দর মূল্যবান জীবনটা নষ্ট করিস না।
-- হা হা হা হা সুন্দর জীবন, হা হা হা হা......নষ্ট জীবন আর কি নষ্ট করবে।আর চলেই তো যাচ্ছে বহুদূরে সবাইকে ছেড়ে। কেউ লোভী নজরে তাকাবে না, মাগি বেশ্যা বলার কেউ থাকবে না, থু থু ছেটানোর কেউ নেই। আহহ পরম শান্তি।
-- আহহ শান্তি' -
ঊষার মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো ।
শক্ত কাঠ হয়ে গেছে শরীর, চকচক করে জ্বলছে চোখের মণি,গলা শুকিয়ে উঠেছে। একটু পর চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস টেনে নিল ' 'মুক্তবাতাস' এটাই হয়ত শেষ পাওনা পৃথিবীর কাছে।.... আস্তে আস্তে শেষ প্রস্তুতিটাও সেরে নিচ্ছে ।
হঠাৎ টুং টাং দোতরার মধুর সুরে গান ভেসে এলো কানে--
"ওরে মন রে, এত দুঃখে ডুবে কেন তুই,
জীবন তো একটাই পথ, পার করিস ধৈর্য্য ধরেএএ ।
আঁধার যতই গাঢ় হোক আলো আসে ভোরেএএএ।
মায়ার বাঁধন কাটিস না তুই দাঁড়ালে ওই পরাজয়ে।
সব কিছুই ফুরায় যায় রে, কষ্টও যাবে সরেএএএএএ।
ওরে মন রেএএএ....................।"
গানের প্রতিটা কথা ঊষার অন্তরে গিয়ে ফলার মতো বিঁধল, চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগল।চোখ বুজে ভেসে যাচ্ছিল গানের অর্থে।
গান শেষে মায়াবী এক গলা শোনা গেল
- মা গো এক মুষ্টি ভিক্ষা দাও গো মা.......।'
ফাঁকা বাড়ি কেউ কোথায় নেই। এদিক- ওদিক তাকিয়ে সেই আগুন্তক আবার বলল-- 'কেউ কি বাড়িতে নেই.... মা গো বাড়িতে থাকলে একমুঠো ভিক্ষা দাও গো দয়া করে।'
- এই কি ভাবছিস এত করে, যা যা দিয়ে আয় একমুঠো ভিক্ষা, যা তুই আর দেরি করিস না .....সুযোগ পেয়েছিস আবারও প্রান ভরে শ্বাস নেওয়ার, যা তুই...যা।
ঊষা হাঁউ হাঁঊ করে কাঁদতে লাগল।আমার মরণও নেই।
ঊষা থালা ভর্তি সিধা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। এক সাদা বসন পরিধেয় ব্যক্তি মিস্টি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। দেখে ভিখিরি মনে হয় না।টায় টায় এগিয়ে গেল ঊষা।ঝোলার মধ্যে সিধা ঢেলে প্রণাম করল পা ছুঁয়ে।
-' দীর্ঘায়ু হও মা....।'
আশির্বাদ করেই বেরিয়ে গেলেন,ভালো মন্দ আর একটা কথাও বললেন না,প্রয়োজন বোধও নেই। ফিরেও দেখলেন না একবারের জন্যও। তার পেছনে দাঁড়িয়ে এক অসহায় অবলা যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। যত দূর দেখা যায় ঊষা তাকিয়ে রইল।হঠাৎ মনে প্রশ্ন চাড়া দিল-'উনি কি সত্যিই ভিক্ষা নিতে এসেছিলেন না দিতে?'
বারান্দার এক খুঁটিতে কাঁধ ঠেকিয়ে অজয় বসে আছে। যে আনন্দ নিয়ে আজ বাড়ি এসেছে সে আনন্দ নিমেষে উধাও হয়ে গেছে।দু'হাতে বাবাকে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে অমর বসে আছে চোখ বুজে।আর স্বামীর মাথার কাছে ঊষা দাঁড়িয়ে আছে খুঁটিতে পিঠ ঠেঁকিয়ে।
বিনোদ বসে আছে নিজের খোপড়ার সামনে একটা বস্তা পেতে।গড়গড়ড়ড়ড় করে হুকো টানছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে খেয়ে ওপর দিকে উঠছে, তামাক পোড়ার ঝাঁঝালো কটু গন্ধ চারপাশে । হুকো টানছে আর খক্ খক্ করে কাশছে,ছেলেকে উদ্দেশ্য করে একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে, তাতে ছেলে শুনল কি না যায় আসে না।
এদিকে ত্রিমুখী চিন্তা তিনজনের মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
অজয়ের চিন্তা টাকা-পয়সা।যে কয়টা টাকা নিয়ে এসেছে তা দিয়ে ভেবেছিল পুজোটা করবে।পুজোর জন্যই আজ বাড়ি ফেরা, গতকাল আসতে চেয়েও ওই সম্পূর্ণ টাকা না পাওয়ায় আসতে পারেনি। আজ সক্কাল সক্কাল খুশি মনে বেরিয়ে পড়েছে, সপ্তাহে এই একটা-দুটো দিনই তো সে পায় পরিবারের সাথে সময় কাটাতে।পুজো বাবদ যা খরচা হবে তা বাদ দিয়ে গুরুদেবের সেবার
খাতিরে ঊষার হাতে দিবে বাকি টাকাটা কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই দেখল ঘর উলটে আছে।
এই সেদিন ঘরটা মেরামত করে গেল নিজের হাতে।ভেবে রেখেছিল হাতে কয়টা টাকা এলে নতুন করে বানাবে।গরুগুলোর কষ্ট যে তারও সহ্য হয় না।কিন্তু! কিন্তু! এখন কোনটা করব?যে কয়টা টাকা পকেটে আছে তা দিয়ে পুজো আর এ কদিনের খরচ চালানোই কষ্ট।এর মধ্যে থেকেই যদি ঘরটা খাড়া করতে হয়....আহহ। আসার পর থেকে একই চিন্তা করে যাচ্ছে, কি থেকে কি করব ভেবে পাচ্ছে না।
ঝড় কেন যে সারাজীবন গরীবের মাথার ওপর দিয়েই চলে?তার মতো দীন-দুঃখীদের সাথেই ভগবানের যত বোঝাপড়া।গ্রামে কত বড় বড় বাড়ি সেগুলো নজরে পড়ে না?
'গরীবের চাল দূব্বা বনে পড়ে।'-এটাই তো হয়ে আসছে চিরকাল।
ছেলের চিন্তা মা।আর মায়ের চিন্তা ছেলে।ছেলে আর স্বামীকে ফিরতে দেখে ঊষা থমকে দাঁড়িয়েছিল রাস্তার মোড়ে।অশ্রুসিক্ত চোখ, আলুথালু চুল, ব্লাউজের হুক খুলে দুধ বেরিয়ে গেছে, চোখ মুখের ফ্যাদা হাত দিয়ে পরিস্কার করলেও তখনও লেগে ছিল একটু আধটু চোখের জলের সাথে তা মিশে একাকার হয়ে গেছে।তখনই রাস্তা দিয়ে গ্রামেরই এক লোক সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল, ঊষার অমন রূপ দেখে সাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল -' কই যাও বউমা, কি হইচে তোমার? '
ঊষা উত্তর দেওয়ার সময় পায়নি।স্বামী আর ছেলেকে একসাথে ফিরতে দেখে জমে গেছিল সেখানেই। লোকটা ক্ষুধার্ত নয়নে তাকিয়ে থেকে যখন আবার বলল- 'কি চিন্তা করো, তোমার অমন অবস্থা ক্যা?'
'উঁউউউউ....।' লোকটার দিকে ভেজা চোখ পরতেই দেখল গ্রামের পরাণ কাকা।সবাই 'খোইলা' বলে ডাকে।গ্রামের একমাত্র খোলবাদক। কীর্তন বা হরিসভা হলে এই পরাণ ছাড়া উপায় নাই,লোকে সমাদরও করে উনাকে গ্রামে সভা হোক নালিশ হোক বা কোন অনুষ্ঠান পরাণ কাকা হাজির। সেদিন দীক্ষার দিনও এই পরাণ কাকা ঊষাদের বাড়ি এসেছিল।
উনার চোখের সাথে চোখ মিলতেই ঊষার হুশ ফিরল।কেমন তীক্ষ্ণ ফলার মতো চোখ গেঁথে আছে ঊষার বুকের মাঝে। ঊষা বুঝতে পেরেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে বুক ঢেকে নিল।ব্লাউজের হুক লাগানোর সময় নেই।
'আ আ আ আমি আসি কাকা' বলেই দৌঁড়ে পালালো, স্বামী আর ছেলে তখনও কিছুটা দূরে সেদিকেই ঊষা চলল আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছে আরও শক্ত করে বুকে টেনে নিল।
ঊষার উঁচু উঁচু ভরাট ধামার মতো পাছার থলথলানি পরাণের পরাণে গিয়ে লাগল।খোল বাজানোর তালে হাত নাচিয়ে মনে মনে বোল তুলল-
''ধা তি না গে ধিন না।''...........
ঘাড় অবধি লম্বা চুল তালে তালে এদিক-ওদিক উড়ছে।এবার দ্রুত তালে বোল উঠালেন।যেন সত্যিকারের খোল থাবড়ে থাবড়ে বাজাচ্ছেন -
"তে রে কা টা,তে রে কা টা | ধি রে কা টা ধি রে কা টা"
তে রে কা টা ... তে রে কা টা.............।
-'কেমন আচেন কাকা?কি করতেচেন অমন কইরা?' --- হাসি মুখে অজয় জিজ্ঞেস করল পরাণকে।পরাণ নিজের খোল বাজাতে এতটাই মত্ত ছিল যে কখন যে অজয় তার স্ত্রী ও ছেলে সামনে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি।অজয়ের কথায় হয়ত কিছুটা লজ্জা পেল। হেসে উত্তর দিল--'ওই খোল বাজাইতেছিলাম মনে মনে, মেলা দিন থিকা চর্চা নাই তো, পুরান খোলডা নষ্ট হইয়া যাওয়ার পর থিকা হাত নিসফিস করতেচে নতুন খোলের জইন্যে.....।
কথা গুলো ঊষার দিকে লক্ষ্য করে এমন ভাবে বলল যে ঘোমটার তলে থেকেও ঊষা লজ্জায় নত হয়ে গেল।অমন করুন ভেজা চোখের দিকে কি উনি একবারও তাকায়নি? হয়ত তাকায়নি নইলে উনি এই অসময়ে খোল বাজাতেন না।মানুষ শুধু নিজের ধান্দায় থাকে।অজয় আর পরাণের মাঝে আরও হাসিমাখা কিছু কথা হয়েছিল।
কিন্তু ঊষা সেসব নিয়ে চিন্তা করছে না।
ঊষার দুঃখ একটাই এবং এখনো ভেবে চলেছে - ছেলে তাকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয়নি, একটা কথা পর্যন্ত বলেনি সেই তখন থেকে এ অবধি।দৌঁড়ে গিয়ে বুকে জাপটে ধরতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,ভেবেছিল হাঁউ হাঁউ করে কাঁদবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু ছেলে তাকে ছুঁতে পর্যন্ত দিলনা।থু থু ফেলার ভঙ্গি করে বাবার পেছনে গিয়ে লুকালো!!!
আহহ এ কলঙ্ক আমি রাখব কোথায়?ছেলের চোখে সে নষ্টা,অস্পৃশ্য পতিতা।জড়িয়ে ধরতে না দিক,থু থু ছিটাক তাতে দুঃখ নেই কিন্তু ছেলের নীরবতা! এ নীরবতা তো কিছুতেই সহ্য করা যায় না।যেখানে বোবা সন্তানের মুখে ' মা' ডাক শুনতে মায়েরা পাগল হয়ে যায়,সেখানে সন্তান নীরব হলে মায়েদের অবস্থা কেমন হতে পারে?
ঊষা ভাবছে ছেলে তাকে 'মা' না ডাকুক গুরুদেবের মতো যদি 'মাআআআ......।'আহ আর ভাবতে পারল না।অমন কথা কোন মা ভাবতেও পারে না। শুধু থেকে থেকে বিনোদের হুকোর মাথায় কল্কেতে যেমন আগুন জ্বলছে ,তামাক গুলো পুড়ে ছাই হচ্ছে সেই আগুনে তেমনি ঊষার ভেতরটাও রয়ে রয়ে পুড়তে লাগল।মন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তামাক পোড়া গন্ধ দূর থেকেও নাকে আসে,কিন্তু মনপোড়ার গন্ধ এত কাছ থেকেও নাকে আসে না,কেউ বুঝতেও পারে না।
ঊষার মন শুধু বলে উঠল -মরতে হবে আমাকে মরতে হবে............. আমাকে মরতেইইইইইই হবে....। 'মরতে হবে' কথাটা মনে আসতেই যেন নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেল উষা।থরথর করে কাঁপছে, নাকের পাটা ফুলে উঠল, চোখ ধারালো অস্ত্রের মতো চকচক করেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ বাঁচার নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে ঊষা।
-এই তোমার কি হইচে,অমন করতেচে ক্যা? এই ঊষা, এইইইইইইই........।
অজয়ের হাতের ধাক্কায় জ্ঞান ফিরল-
- 'অ্যাঁ'
-'অমন কাঁপতেছ ক্যা? শরীর ভালো ঢেকতেছে না?'
ঊষা কিছু বলবে তার আগেই বিনোদ বলল--'আর ভালো থাহা, যে ঝুক্কি ওর মাথার উপর দিয়া গেচে কাইল,ভাইগ্য ভালো বাঁইচা আচে এহনো...........।
- কি হইচে কি হইচে.......। বাপের কথায় অজয় বিচলিত হয়ে উঠল।এতক্ষণ অনেক কথা বিনোদ বলেছে কিন্তু মনোযোগ দেয়নি,যেই বউয়ের ব্যাপারে বলল চট করে দাঁড়িয়ে পরল অজয়।জিজ্ঞাসার নজরে ঊষার দিকে তাকিয়ে রইল, হয়ত জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছিল তোমার। ঊষা কিছু বলল না।
বলল বিনোদ --'ওই কাইলকার ঝড়িতে তোর বউ ঘরের নিচে চাপা পরছিল।কোমর ভাইঙ্গা নুইচে.........।ভাইগ্য ভালো উড়াই নিয়া যায় নাই গুরুদেব বুইঝা শুইনা পাগা দিয়া খুঁটিতে বান্ধা রাখচিল, নইলে আইজ কি আর বাড়ি ফিরা বউরে খুঁইজা পাইতি........।
বিনোদের কথা শুনে চমকে উঠল তিনজনই।ঊষার চোখ কপালে উঠে গেছে, কি সব বলছেন উনি! ছেলে গেছে এখন কি স্বামীটাকেও কেড়ে নেবে সবাই?যাক সবাই ছেড়ে যাক, আমিও ছেড়ে যাবো সবাইকে জনমের মতো।
অমর কানাবুড়োর কথা শুনে হা করে আছে।এর কোন জ্ঞানকান্ড নেই,তালহীন মানুষ। কতবড় রাজ যার জন্য মনে লুকিয়ে রেখেছি আর শালা বুড়ো তার কাছেই বলে দিচ্ছে। মায়ের উপর রাগ আছে অভিমান আছে সবই আছে কিন্তু ঘৃনা নেই। অমর জানে তার মা গঙ্গার মতো পবিত্র।তাকে দূষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মনে কষ্ট আছে মা তাকে মেরেছে, বুক ফেটে যাচ্ছে একবার 'মা' বলে ডাকতে।কিন্তু কোথায় যে একটা খঁচখচানি বুঝতে পারছে না।
বাপের কথা শুনে অজয়ও থ হয়ে গেছে। কি বলছে! ঊষার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কালো হয়ে উঠেছে মুখের রঙ।অজয়ের মুখটাও কালো হয়ে উঠল।সবাই চুপ- অজয় কিছু বলবে বলবে করেও মুখে আনতে পারল না।
বিনোদ সত্যিই কানাওয়ালা নির্বোধ।সবাই চুপ দেখে আরও রসালো ভাবে ছেলের সামনে গতকালের দুঃখের পালা গাইতে লাগল--
' সেই কি টানাহ্যাঁচড়া সারাদিন।হেই মাঝ রাইত অবধি গুরুদেব কোমরে গরম ত্যাল মালিশ কইরা কইরা সে সুস্থ করাই তুইলল,নইলে কি আর বউরে খাড়া দেখতি.....খালি গুরুদেব সহায় বইলা রক্ষা এই যাত্রা...।' বলেই কপাল ঠুকে প্রণাম করতে লাগল বারবার।
স্তব্ধ পরিবেশ। শেষে অজয়ই স্বাভাবিক করে তুলল--
-তুমি ঠিক আচাও তো এহন?
বাড়ি ফিরে বউ কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে,যা অবস্থা বাড়ি ভোলারই কথা।
-হ, এহন ঠিক আছি।' ঊষাও নিচু মাথায় শান্ত ভাবে জবাব দিল।
গুরুদেবের প্রসঙ্গ উঠতেই অজয় বলল--
- 'বাবা কোনে?' গুরুদেবের খোঁজটাও নেওয়া হয়নি এতক্ষণ।
-' উনি ঘুমাইতেছে।' স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল ঊষা।কিন্তু মনে ঘৃনা ভরতি।
- 'ডাক দিবার পারবা? অল্প দরকার ছিল....।
--' হুম'
অনিচ্ছুক সত্ত্বেও ঊষা যাচ্ছিল, কি একটু ভেবে অজয়ই মানা করল, বলল-
--'থাইক পরে ডাক দাও, খাওয়া দাওয়া কইরা নেই, তারপর উনার সাথে কথা কওয়া যাইবেনে......চলো কয়ডা খাইবার দাও।'
ঊষা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় ছেলেকে দেখিয়ে বলল ওকেও নিয়ে চলো। মায়ের মন তো যত যাইহোক ছেলে না খেয়ে থাকবে এটা হয় নাকি।
- 'চল রে বেটা....।' অমর একটু বেঁকে বসল কিছুতেই যাবে না।ছেলেকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলতে তুলতে হেসে অজয় বলল- মায়ের ওপর এত রাগ ভালো না রে বেটা,মায় মারচে অন্য কেউ তো না.....।'
চটাস করে কেউ যেন গালে চড় বসিয়ে দিল ঊষার।এই কথাটায় অমর যতটা না ব্যথা পেল তার শতগুন পেল ঊষা। একা মারলে হয়ত এতটা ব্যথা ঊষা পেত না উহহহ মেরেছে যে ওই শয়তানটাও।নিজের হাত নিজে কামড়াতে মন চাইছে, চোখের সামনে কেমন টুঁটি চেপে ধরেছিল। তলপেটে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল, আহহহ খুব লেগেছে।আর আর আর আমি? আ আ..আমি..... ছেলের গালে চড় মারা হাতটা মুখের সামনে তুলে কেঁদে দিল ঝরঝর করে, আজ মেরেই ফেলত.........আজ সব হারাতে হতো ।চোখের জল লুকাতে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে নিয়ে দ্রুত চলে গেল রান্না ঘরে।
অজয় ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেছে।ঊষা গাল হাঁটুতে ঠেকিয়ে আনমনে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অজয়ের খাওয়া প্রায় শেষ কিন্তু অমরের গলা দিয়ে ভাত আর নামছে না।
- কি রে সোনা খাস না কিসের জইন্যে। ভাত নষ্ট করিস না রে বাপ....নষ্ট করিস না।
অজয় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল।অজয় জানে একমুঠো ভাতের মূল্য।ভাত মাটিতে পরলে খুটে খুটে তুলে নেয়।এই ভাতের জন্যই সবাইকে ছেড়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাইরে পরে থাকে।ঊষার দিকে তাকিয়ে বলল-- 'তুমি যাও এহন গুরুদেবরে কও গা একটু বাইরে আইসা বসুক, আমি হাত মুখ ধুইয়া আসতেচি।'
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঊষাকে যেতে হলো, উপায় নেই।ঘরে গিয়ে দেখল উল্টো দিকে মুখ ফিরে গুরুদেব শুয়ে আছে। বিছানার ওপর গুরুদেবের ব্যাগ এবং বাইরে যা জামাকাপড় ছিল একটাও নেই।তবে কি উনি.....। ঊষা ডাকল-
-'আপনেরে বাইরে যাইতে কইতেচে।'
কোন সাড়া নেই।ঊষা আবার বলল
- 'আপনের সাথে কি যেন দরকার আচে।'
তবুও সাড়া নেই। এবার ঊষা কাঁধে ধাক্কা দিয়ে যেই বলেছে--
'আপনেরে.........।'
- 'সর মাগিইইইইইইইইইই.......।'
ফালদে এলেন ঘুষি তুলে, চমকে উঠে পিছিয়ে দাঁড়ালো ঊষা।ঘুষিটা লাগতে লাগতেও ছুঁতে পারল না ঊষার থুতুনি।লাল চোখে ঊষার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যে ওই আগুনেই ঊষাকে পুড়ে মরতে হবে।
- 'তোর কোন কথাই শুনুম না মাগি.. তুই যা এহেন থিকা, আমি আজই চইলা যামু....।'
হতভম্ব ঊষা।মাগি বলে ডাকছে! বাইরে শ্বশুর, স্বামীও চলে আসতে পারে।সবে শুকানো চোখে আবার জল চলে এলো ।আজ কেউ এ চোখের জল শুকাতে দিবে না, কেউই না.......।
চোখে জল নিয়েই নাক টেনে টেনে ভেজা সুরে ফিসফিস করে বলল
- ক্ষতি যা করার করচেন.. এহন এইটুক আর বাকি রাইখপেন ক্যা? আমারে শ্যাষ কইরা যান.... যান চইলা বইসা রইচেন ক্যা?
মুখে আঁচল চেপে দৌঁড়ে চলে এল রুম থেকে। সটান নিজের বিছানায় উপুর হয়ে পরল..ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে লাগল।
গুরুদেব চৌকির নিচে পা ঝুলিয়ে দুই হাতে ঢেস দিয়ে পাথরের মতো বসে রইলেন, চোখ মাটির দিকে। রান্না ঘরের ঘটনার পরই গুরুদেব নিজের রুমে ফিরে আসেন, এসেই আর দেরি করেননি ধমাধম নিজের ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে লাগেন।বাইরে পা বাড়াবে ঠিক তখনই দেখে অজয় ছেলেকে নিয়ে বউকে নিয়ে ফিরে আসছে। গুরুদেব আর রাস্তা ধরতে পারলেন না। ফিরে গেলেন কিন্তু দাউদাউ করতে লাগল ভেতর।কি দোষ ছিল আমার?আমি তো কিছু নিজে থেকে করিনি,তুই চাইছিস আমি তার মান রেখেছি তাতেই আমার দোষ আমার ওপর বটি তুলে কঅঅঅঅত সাহস।তোর ছেলে যে আমায় মারল.....।ওই পাটকাঠির কথা মনে আসতেই থু থু ফেলেছিলেন একগাদা মেঝেতেই। গুরুদেবের মনে এসবই ঘোরপাক খাচ্ছিল।এখনো খাচ্ছে। চলেই যাবো থাকব না আর, এ অপমান আর নেওয়া যায় না।
স্থির ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন গুরুদেব।বাইরে থেকে আওয়াজ এলো- 'অমরের মা ও অমরের মা বাবা উঠচে নাকি, ডাক দাও আসপার কও।'
ঊষার কোন গলা না পেয়ে অজয় নিজেই ঘরে গেল।দেখল ঊষা উপুর হয়ে শুয়ে আছে।মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল- 'এই কি হইচে তোমার?'
ঊষা মুখ না তুলেই উত্তর দিল-' মাথাডা অল্প ধরচে, তুমি যাও আমি উঠতেচি।'
--'না না না তুমি শুয়াই থাকো বিশ্রাম নেও।' বলেই গুরুদেবের রুমে গেল।করজোরে প্রণাম করে বলল--'
- আপনের সাথে একটু দরকার ছিল বাবা, তা এইহানেই কমু না বাইরে আইসপেন?
আহ কি জ্বালা,তবু গুরুদেব বললেন
- তুমি যাও আমি আসতেচি।'
-'আইচ্ছা আসেন। '
গুরুদেব বাইরে গিয়ে দেখলেন কানাটা তার খোপড়ার বিছানায় বসে এদিকেই মুখ করে আছে।শালা তালহীন মানুষ কোথায় কি বলতে হয় জানে না- আজ সকালেও মাতব্বর আর বাদ বাকিদের সামনে পাগা দিয়ে বেঁধে রাখার কথা, কোমর মালিশের কথা গলগল করে বলে যাচ্ছিল।একটু আগেও ওই একই কথা বলছিল অজয়ের কাছে। তখনই মন চাচ্ছিল ঘাড়ে এসে লাথি বসিয়ে দেয়...। কি বিশ্রী ভাবে মন্টু তখন বলে উঠেছিল - তা বউমার কোমরে কি এহনও ব্যথা আচে...না মানে আমি ত্যাল দিয়া ভালো মালিশ জানি...। সবাই মুচকি মুচকি হাসছিল। এই হাঁদাটা তাও বুঝতে পারে না। শেষে গুরুদেব সামাল দিয়েছেন এদিক সেদিক বুঝিয়ে।কিন্তু কতটা তারা বুঝল কে জানে। যেতে যেতেও কেমন বাঁকা নজরে কাকে যেন খুঁজছিল।এসবের কিছুই তো ঊষাকে বলা হয়নি।
গুরুদেব ধীরে ধীরে অজয়ের সামনে বসলেন।অজয় আবারও সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।গুরুদেব বললেন-
- 'কি কইতে চাও কওউউউ..।'
- 'বাবা আইজ তো পুইজার কথা ছিল,সে জইন্যে বাড়িও ফিরলাম কিন্তু এহন দেহি সব উলটা-পালটা হইয়া রইচে।কি করুম বুঝবার পারতেচি না..।'
- 'তা কি করচে চাও খুইলা কওউ।'
অজয় সংকোচ করছে বলতে যে পকেটে টাকা কম।পুরুষ মানুষের পকেটে টাকা নেই একথাটা মুখ ফুটে অন্যকে বলা কতটা যে লজ্জার কতটা বেদনার কতটা যে অপমানের তা বলে বোঝানো যাবে না।অজয়ের সংকোচ বুঝে গুরুদেব নিজেই বললেন ।
- 'সংকোচ কইরো না যা বলার বলো।'
- 'আসলে বাবা আমার পকেটে যা আচে তা পুইজা আর বাড়ির খরচার জইন্যে রাখা,কিন্তু ঘরডা দেখচেন, ঠিক না করলেও তো হইতেচে না...।'
- 'হুম,............তুমি এক কাজ করো, আগে ঘরডা তুলো, পুইজা পরে কইরলেও হইব। আমি কয়েকমাস পরেই আবার আসুম,তহন না হয় সাইরা যামু...।'
অজয় ঠিক বুঝতে পারল না কয়েকমাস পরে মানে?এর মধ্যে সমস্যা কি এই সামনে শনিবারও তো আছে।অজয়ের মনভাব বুঝতে পেরে গুরুদেব বললেন
- 'আমি আইজ চইলা যাইতেচি, জরুরি এক কাজ আচে এমাসে মনেই ছিল না, আর পুইজা যেহেতু হইতেচে না........।
--- 'নাহ নাহ নাহ আপনে অমন কইরা ফালাই জায়েন না আমার পুলারে..মেলা আশা নিয়া বইসা রইচি সবাই।
বিনোদ গুরুদেবের কথা শুনে নেমে এসেছে, পায়ের ওপর মাথা ঠেঁকিয়ে গুরুদেবকে যেতে মানা করছে।
গলা বাড়িয়ে বউমার উদ্দেশ্য বলল-- ও বউমা শুনচাও গুরুদেব কি কয়, ও বউমা আসো তাড়াতাড়ি তুমি আটকাও.....।
বাপের এই অতিরিক্ত কথায় মাঝে মাঝে অজয়ও বিরক্ত হয়। একটু উচ্চস্বরে বলে উঠল- 'আহ বাবা আপনে চুপ করেন তো, আমারে কইবার দেন....।'
-- তুই কি কইবি,....... তুই কি পারবি গুরুদেবরে আটকাইতে? বউমা পাইরব... বউমা পাইরব...ও বউমাআ আ আ.....।
মর বুইড়া মর,যাইতে চাইতেচে যাইতে দে, তা বাদে আমারে ডাক পারতেচে, শয়তান বুইড়া........., মরেও না যমের অরুচি।
উত্তর তো ঊষা দিলই না মনে মনে শ্বশুরকে গালাগাল দিতে লাগল।অজয় গুরুদেব সকলেই বিরক্ত হয়ে উঠল।বিনোদের কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।
-' হ বাবা, আপনে আর কয়ডা দিন এই গরীবের বাড়ি থাকেন, কষ্ট কইরা হলেও থাকেন বাবা..।'
কি বিষমজ্বালা - এক দন্ড টেকা মুশকিল এখানে সেখানে আরও কিছুদিন। গুরুদেব জানে এই নির্বোধ প্রানি গুলো কোনমতেই ছাড়বে না,থাকতেই হবে।
- 'আইচ্ছা আইচ্ছা, রইলাম, এই সামনের মঙ্গলবার পূর্নিমা ভালো দিন সেদিন পুইজা সারা যাইব।....নে এহন আমারে যাইবার দে শরীর খুব একটা ভালো যাইতেচে না।'
সড়সড়িয়ে গুরুদেব উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন, যাওয়ার সময় ভুল করেও উষার দিকে ফিরে তাকালেন না।
যাক একটা চিন্তা দূর হলো। এখন একটাই চিন্তা ঘর।অজয় বাবাকে বলল-
-বাবা দাউ ডা বাইর কইরা দেন , কয়ডা বাঁশ কাইটা নই।খুঁটি আর বেড়ার বাতাবুইতা বানাই থুই, কাইল সক্কাল সক্কাল বাজার যাইয়া কয়ডা টিন আইনা ছাপড়া দিয়া দেই একবারে।
- হ তাই ভালো হইবেনে, বছর বছর আর ঘর ঠিক করা ভালো ঠেহে না।'
অজয় রওনা দিল বাঁশঝাড়ের দিকে, যাওয়ার সময় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেল, একা একা বাঁশ টেনে বের করা ভীষণ মুশকিল। বিনোদও গেল পিছে পিছে, শক্তপোক্ত পাকা বাঁশ দেখিয়ে দিতে হবে না।
অনেকক্ষণ কেটে গেছে।ঊষার চোখে কালঘুম কালঘুম এসেছে।একটু পরই গভীর ঘুমে ডুবে যাবে।সারাদিনের ঘটনায় সে ক্লান্ত হয়ে পরেছে শারীরিক ও মানসিক দু-ভাবেই। তাই বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমের ঝোঁক এসে পরেছে।হঠাৎ কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল--' কি রে, মরবি না তুই?'
- 'অ্যাঁ?....হ হ হ মরুম'
- তবে ঘুমাচ্ছিস কিসের জন্য? মর তুই..... এই তো উত্তম সময় চেয়ে দেখ কেউ নেই চারপাশে...।
-- ' কিন্তু গুরুদেব যে পাশের রুমে।'
-- গুরুদেবও ঘুমিয়ে গেছে... নে তুই উঠ... সময় পেরিয়ে গেলে আর সুযোগ পাবি না...।শেষ করে দে নিজেকে আর ঘুমিয়ে থাকিস না...।
- হ হ আমি উঠতেচি উঠতেচি..।
জোর করেও চোখ ছাড়াতে পারছে না এদিকে কে যেন তাড়া দিয়েই যাচ্ছে।
এর মাঝেই অন্য একটা ফিসফিসানি স্বর কানে এলো।
- না না না ঊষা তুই এটা করিস না, 'আ**** মহাপাপ' এ পাপ করিস না।কিসের জন্য মরবি, কার জন্য মরবি,তুই মরিস না ঊষা মরিস না।
- 'হ আমি মরুম না। কার জইন্যে মরুম,কিসের জইন্যে মরুম?'
- হা হা হা হা হা কার জন্য মরবি?ওই মুখে ছেলের সামনে রোজ দাঁড়াতে পারবি?..... হা হা হা মনে নাই ছেলে তোকে দেখে থু থু ফেলেছে।তোকে নষ্টা ভাবে......।
- 'হ মনে আচে, আমারে ছুঁইতে পর্যন্ত দেয় নাই..বুক ফাইটা যাইতে ছিল তাও জড়াই ধরতে দেয় নাই।মরুম আমি মরুম কার জইন্যে বাঁচুম?আ.. আ.. আ.. আ আ...আমারে মরতেই হইব..।'
চোখ খুলে গেছে ঊষার, দরদর করে ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। চোখ ওপর দিকে কাঠের চওড়া ধর্নায়। উঠে দাঁড়লো
তখনও কে যেন বলে চলেছে
---তাড়াতাড়ি কর, হ্যাঁ হ্যাঁ .... ওটা তুলে নে ,তারপর শেষ করে দে নিজেকে আর দেরি করিস না।
ঊষা তাই করছিল। আরেকজন প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বারবার অনুরোধ করছে-- তুই মরিস না উষা মরিস না, আমার একটু কথা শোন, তোর ছেলেকে কে দেখবে,একবার শুধু ছেলের কথা ভাব।
ঊষা নীরব।জীবন শেষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
- ওর কথায় কান দিস না- কোন ছেলের কথা বলছে -- যে ছেলে মায়ের মন বোঝে না, কষ্ট দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না সেই ছেলের চিন্তা?
-- ঊষা ও অবুঝ,তুই মা হয়ে এত বড় শাস্তি ওকে দিস না, দোহাই লাগে,, তুই সব ছেড়ে চলে যা.. বহুদূর কোথাও। এই সুন্দর মূল্যবান জীবনটা নষ্ট করিস না।
-- হা হা হা হা সুন্দর জীবন, হা হা হা হা......নষ্ট জীবন আর কি নষ্ট করবে।আর চলেই তো যাচ্ছে বহুদূরে সবাইকে ছেড়ে। কেউ লোভী নজরে তাকাবে না, মাগি বেশ্যা বলার কেউ থাকবে না, থু থু ছেটানোর কেউ নেই। আহহ পরম শান্তি।
-- আহহ শান্তি' -
ঊষার মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো ।
শক্ত কাঠ হয়ে গেছে শরীর, চকচক করে জ্বলছে চোখের মণি,গলা শুকিয়ে উঠেছে। একটু পর চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস টেনে নিল ' 'মুক্তবাতাস' এটাই হয়ত শেষ পাওনা পৃথিবীর কাছে।.... আস্তে আস্তে শেষ প্রস্তুতিটাও সেরে নিচ্ছে ।
হঠাৎ টুং টাং দোতরার মধুর সুরে গান ভেসে এলো কানে--
"ওরে মন রে, এত দুঃখে ডুবে কেন তুই,
জীবন তো একটাই পথ, পার করিস ধৈর্য্য ধরেএএ ।
আঁধার যতই গাঢ় হোক আলো আসে ভোরেএএএ।
মায়ার বাঁধন কাটিস না তুই দাঁড়ালে ওই পরাজয়ে।
সব কিছুই ফুরায় যায় রে, কষ্টও যাবে সরেএএএএএ।
ওরে মন রেএএএ....................।"
গানের প্রতিটা কথা ঊষার অন্তরে গিয়ে ফলার মতো বিঁধল, চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগল।চোখ বুজে ভেসে যাচ্ছিল গানের অর্থে।
গান শেষে মায়াবী এক গলা শোনা গেল
- মা গো এক মুষ্টি ভিক্ষা দাও গো মা.......।'
ফাঁকা বাড়ি কেউ কোথায় নেই। এদিক- ওদিক তাকিয়ে সেই আগুন্তক আবার বলল-- 'কেউ কি বাড়িতে নেই.... মা গো বাড়িতে থাকলে একমুঠো ভিক্ষা দাও গো দয়া করে।'
- এই কি ভাবছিস এত করে, যা যা দিয়ে আয় একমুঠো ভিক্ষা, যা তুই আর দেরি করিস না .....সুযোগ পেয়েছিস আবারও প্রান ভরে শ্বাস নেওয়ার, যা তুই...যা।
ঊষা হাঁউ হাঁঊ করে কাঁদতে লাগল।আমার মরণও নেই।
ঊষা থালা ভর্তি সিধা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। এক সাদা বসন পরিধেয় ব্যক্তি মিস্টি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। দেখে ভিখিরি মনে হয় না।টায় টায় এগিয়ে গেল ঊষা।ঝোলার মধ্যে সিধা ঢেলে প্রণাম করল পা ছুঁয়ে।
-' দীর্ঘায়ু হও মা....।'
আশির্বাদ করেই বেরিয়ে গেলেন,ভালো মন্দ আর একটা কথাও বললেন না,প্রয়োজন বোধও নেই। ফিরেও দেখলেন না একবারের জন্যও। তার পেছনে দাঁড়িয়ে এক অসহায় অবলা যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। যত দূর দেখা যায় ঊষা তাকিয়ে রইল।হঠাৎ মনে প্রশ্ন চাড়া দিল-'উনি কি সত্যিই ভিক্ষা নিতে এসেছিলেন না দিতে?'
Mrpkk