24-09-2024, 12:59 PM
পরের দিন নানী নিজেই ঘরের সব কাজ করতে লাগলো। মাকে বিরক্ত করা ঠিক মনে করলোনা। তাকে কিছু সময়ের জন্য একা থাকতে দিলেন। দুপুরের খাওয়ার সময় নানী আবার মাকে ডাকলো। কিন্তু মা দরজা খুলে বাইরে আসলো না। তাই তারা দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে তাদের ঘরে গেল। নানা-নানী তাদের ঘরে গেলে মা রান্নাঘরে এসে একাই খেয়ে নিলো। নানা-নানী এবিষয়ে জানলেও ঘরের বাইরে এসে মাকে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইলো না। এভাবে ৩ দিন কেটে গেল। পরের দিন বৃহস্পতিবার।সকালে নানী নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ মা রান্নাঘরে এসে নানীকে বললো।
মা: আমি রান্না করছি।
একথা বলে মা নিজেই কাজ করতে লাগলো। তবে মাকে দেখে নানী আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। সে চুপচাপ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। মা একেবারে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছিলো। নানী সেখান থেকে চুপচাপ চলে গেলো। মা কারো সাথে কথা বলছিলো না। মা তার কাজ শেষ করে তার ঘরে গেলো। আর ঘরের দরজা লক করে ভিতরে থাকলো। রাতে ঘুমানোর সময় নানা-নানী বলতে লাগলো হয়তো তাদের কথায় মা মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে নানী রান্নাঘরে এসে মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো। মা প্রথমে নানীর কথার কোন জবাব না দিলেও, নানী যাই করতে বলতো সে তা নীরবে করতে লাগলো। এতে নানী ভাবলো, হয়তো মায়ের রাগ একটু কমেছে। সকালের নাস্তা খেয়ে নানা-নানী যখন টিভিতে খবর দেখছিলো, তখন তারা দেখলো মা আগের মতো টেবিলে একা বসে নাস্তা খাচ্ছিলো। নানী দুপুরের খাবার তৈরিতে মাকে সাহায্য করতে লাগলো আর মায়ের কথা বলতে লাগলো। আজ মা নানীর স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিল। কিন্তু আজও দুপুরের খাবর মা একাই খেলো। তবে আজ নানা-নানী খুশি ছিল, কারণ যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার কালো মেঘ এখন এই বাড়ি থেকে সরে গেছে। সন্ধ্যায় নানী রান্নাঘরে গেলো। তখন মা একা চুপচাপ রান্নাঘরের স্ল্যাবে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে চা ফুটতে দেখছিল। মা কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলো, নাহলে নানীর রান্নাঘরে ঢোকার শব্দেও সে একটুও নড়লো না। নানী কাজ করতে করতে মায়ের দিকে তাকালো। তারপর মায়ের কাছে এসে স্ল্যাবের ওপর একহাত দিয়ে দাঁড়াল। নানীই নীরবতা ভেঙে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল।
নানী: নাজমা! প্রত্যেক বাবা-মাই তাদের সন্তানদের সুখের কথা ভাবে। কিন্তু আমরা হয়তো একটু বেশিই ভেবেছি।
নানীর কথা শুনে মা হঠাৎ বলল।
মা: আমি চলে গেলে তোমরা একা একা কি করে থাকবে?
মায়ের হঠাৎ একথা শুনে নানী মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। এতে মা লজ্জায় মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বিষয়টা বুঝতে নানীর কিছুটা সময় লাগল। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নানীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে মুখে খুশির রেখা দেখা গেল। তারপর সে আস্তে আস্তে মায়ের কাছে এসে তার চিবুক ধরে উপরের দিকে তুললো। এতে মায়ের মুখ নানীর মুখোমুখি হয়ে গেল। তবে মা তার চোখগুলো নিচু করেই রাখলো। শতচেষ্টা করেও মা তার মুখে লজ্জার ছাপ লুকাতে পারল না। ননী এটা বুঝতে পারল। কিন্তু তবুও সে ফিসফিস করে মা জিজ্ঞেস করলো।
নানী: সত্যি?
মা কোন কথা না বলে নানীর কাঁধে মুখ লুকালো। আর মা নানীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। এতে নানী হেসে একহাত দিয়ে মার চুল আর পিঠে আদর করতে লাগলো। নানী আবার বললো।
নানী: আরে পাগলী! এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমরা কী তোর পর নাকি? আর তুই তো অন্য কারও বাড়িতে যাচ্ছিস না। আমরা তো সবাই তোর আপনজনই।
একথা শুনে মা আরও বেশী লজ্জা পেয়ে নানীর বুকে মুখ লুকালো। বৃহস্পতিবার আমি যখন রংপুরে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। প্রতিবারের মতো এবারও আমার নানা-নানী আমাকে হাসিমুখে স্বাগত জানালো। কিন্তু এবার সেখানে মাকে দেখতে পেলাম না। বাড়ির ভিতরে এসে ব্যাগ রাখলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না যে নানা-নানীকে আজ এতো খুশি দেখাচ্ছিল কেন। বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? তাই যদি না হবে তাহলে মা আমার সাথে এমন করছে কেন? আমার কোন ভুলের জন্য মা আমার উপর রেগে আছে? আমি কি অজান্তে মাকে কোন কষ্ট দিয়ে দিয়েছি? মা সাধারণত বাড়ির বাইরে বেশি যায় না। আর আজ তো আমার আসার কথা। আজতো সে বাড়ির বাইরে যাবেই না। তাহলে সে আমার সাথে দেখা করতে এলো না কেন? আমি যখন এসব কথা ভাবছিলাম তখন নানা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি: নাজমুল তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আমি: বলো নানা।
নানা একবার নানী দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল।
নানা: এটা অতোটাও জরুরী না। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরাম করে বসে বলা যাবে।
নানার কথা শুনে আমি আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম না জানি নানা আমার সাথে কী এমন জরুরী কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি মাকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলাম। মনে অনেক দুশ্চিন্তা খেলতে লাগলো। কিছুই ভালো লাগছিল না। আমার মন বলছে দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করি যে আমার অপরাধটা কি? আমি ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসার সাথে সাথে নানী আমাকে ডিনারের জন্য ডাকলো। আমি জানতাম আজকের দিনটা আর আগের মত নেই। আজ নানী খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। কিন্তু আমি রান্নাঘরে মাকে দেখলাম। এমনকি তাকে নানীর সাথে কথা বলতে শুনলাম। এতে আমার রাগ হতে লাগলো। ভাবলাম সবই তো ঠিক আছে। তাহলে কি আমিই অপরাধী। আর নানা-নানীও নিশ্চয়ই আমার প্রতি মায়ের এমন আচরণ লক্ষ্য করছে। তারপরও তাকে কেউ কিছুই বলছে না। রাতের খাওয়া শেষ করে নানা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলো। এখন গরমকাল চলছিল। তাই ছাদে এসে একটু ভালো লাগছিলো। মাঝে মাঝে একটু বাতাসও আসছিলো। নানা ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আর ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট মুখে দিয়ে বলল।
নানা: তোর নানী এখন এখানে নেই। তাই একটা সিগারেট খেয়ে নেই।
একথা বলে সে হাসতে লাগলো আর পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে সিগারেটা জ্বালালো। এটা দেখে আমি বললাম।
আমি: নানা ডাক্তার তোমাকে ধূমপান করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে।
নানা সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো।
নানা: একটা দুইটা খেলে কিছু হবে না।
নানা হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। কিন্তু আমার মন তখনও অস্থির ছিল। আমি বারবার চিন্তা করতে লাগলাম যে নানা আমাকে কী বলতে চায়। এই সব ভাবছিলাম, হঠাৎ নানী ডাক দিল। আমরা নীচে নেমে গেলাম। আমি মাকে খুজতে লাগলাম। রান্নাঘরের লাইট বন্ধ। তার মানে মা রাতের খাবার খেয়ে তার রুমে চলে গেছে। আমার মায়ের উপর খুব রাগ হল। আমি কি ভুল করেছি যে সে আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে? নানা আমাকে তার ঘরে আসতে বললো। সাথে নানী আসলো। আমি তাদের রুমে যেতেই নানা দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি তাদের বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। নানা-নানী বিছানায় বসলো। আমার খুবই চিন্তা হতে লাগলো। আসলে তারা আমাকে কী বলতে চায়? আর একথার সাথে মায়ের সম্পর্ক কি? এসব হাজারো দুশ্চিন্তা তখন আমার মাথায় ভিড় করতে লাগলো। তখন নানা বলতে লাগলো।
নানা: নাজমুল। তোর লালন-পালনে আমরা কোন কমতি রাখিনি। ছোটবেলা থেকে আমরা তোকে সবই দিয়ে আসছি এবং আজ অবধি আমরা তোর যত্ন করছি। কিন্তু এখন তুই বড় হয়েছিস। তুই চাকরি করছিস। আমাদের ছেড়ে একা থাকিস। আমরা জানি সেখানে থাকতে তোর অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তবুও আমরা খুশি যে তুই তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিস। তুই তোর নিজের জীবনে উপভোগ করতে শিখে গেছিস। আমরা হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না। আমরা মরে যাওয়ার পরও তোর জীবন সুন্দরভাবে কাটুক এটাই আমরা চাই। তোর পরিবার হোক। তাই আমরা এখন চাই তোর বিয়ে দিতে।
একথা বলে নানা চুপ হয়ে গেলো। হয়তো সে আমার জবাব জানতে চাইছে। কিন্তু আমি মনে মনে অন্য কথা ভাবছিলাম। আমার মনে হতে লাগলো মা হয়তো এবিষয় নিয়ে কষ্ট পেয়েছে। তাই আমার সাথে কথা বলছে না। তাই মনে মনে ভাবলাম মায়ের সুখের জন্য যদি আমাকে বিয়ে নাও করতে হয়, তবুও আমার কোন আফসোস থাকবে না। কারণ আমি তাকে সারাজীবন খুশি রাখতে চাই। নানা আবার বললো।
নানা: দেখ নাজমুল। আমরা চাই কেউ যেন তোর জীবনে এসে তোর পাশে থাকে। তোর প্রতিটা আবেগ বুঝে। তোর জীবনের প্রতিটা উত্থান-পতনে তোর পাশে থাকে। আর তোর জীবনের চলার পথকে সহজ করে তোলে। তাইতো পুরুষের জীবনে একজন স্ত্রীর প্রয়োজন। আজ পর্যন্ত আমরা তোর জীবনের সকল ভালো-মন্দের কথা চিন্তা করে তোর সব করেছি। এখন যদি এই শেষ দায়িত্বটা আমরা ঠিকঠাক সম্পন্ন করতে পারি তাহলে আমরা শান্তিতে মরতে পারব।
আমি মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বললাম।
আমি: নানা তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু.....
বলতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম। আমি প্রথমে মায়ের কাছে জানতে চাই যে সে কি এবিষয়টা নিয়ে দুঃখি? একারণে কি সে আমার কাছ থেকে দূরে থাকছে? কিন্তু নানা মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই সে আবার বললো।
নানা: নাজমুল আমি যা বলছি তা আগে শোন। তারপর তুই ভালো করে ভেবে আমাকে তোর উত্তর দিস। তোর যদি মনে হয় এটা আমাদের সকলের ভালোর জন্য, তাহলে ভেবে চিন্তে আমাকে বল। নইলে তুই আমাদের যা সিদ্ধান্ত দিবি আমরা তাই করব।
একথা বলে নানা নানীর দিকে তাকাল। নানীও এতে রাজি হয়ে তার মাথা নেড়ে সায় দিলেন। নানা আবার বলতে শুরু করলো।
নানা: আমরা তোকে সবই দিয়েছি, যা প্রতিটি শিশু চায়। কিন্তু আমরা তোকে একটি জিনিস দিতে পারিনি। প্রত্যেকটা শিশু একজনকে বাবা বলে ডাকার আনন্দ পায়। কিন্তু আমরা কখনোই তোকে সেটা পাওয়ার সুযোগ দিতে পারিনি। আর এখন যদি তুই বিয়ে করিস তাহলে তুই নতুন মা-বাবা পাবি।
তারপর নানা এক মিনিটের মতো চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল।
নানা: আমি এপ্রস্তাবটা আমাদের সকলের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখেই বলছি। তুই কি আমাকে 'বাবা' বলে ডাকবি?
মা: আমি রান্না করছি।
একথা বলে মা নিজেই কাজ করতে লাগলো। তবে মাকে দেখে নানী আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। সে চুপচাপ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। মা একেবারে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছিলো। নানী সেখান থেকে চুপচাপ চলে গেলো। মা কারো সাথে কথা বলছিলো না। মা তার কাজ শেষ করে তার ঘরে গেলো। আর ঘরের দরজা লক করে ভিতরে থাকলো। রাতে ঘুমানোর সময় নানা-নানী বলতে লাগলো হয়তো তাদের কথায় মা মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে নানী রান্নাঘরে এসে মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো। মা প্রথমে নানীর কথার কোন জবাব না দিলেও, নানী যাই করতে বলতো সে তা নীরবে করতে লাগলো। এতে নানী ভাবলো, হয়তো মায়ের রাগ একটু কমেছে। সকালের নাস্তা খেয়ে নানা-নানী যখন টিভিতে খবর দেখছিলো, তখন তারা দেখলো মা আগের মতো টেবিলে একা বসে নাস্তা খাচ্ছিলো। নানী দুপুরের খাবার তৈরিতে মাকে সাহায্য করতে লাগলো আর মায়ের কথা বলতে লাগলো। আজ মা নানীর স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিল। কিন্তু আজও দুপুরের খাবর মা একাই খেলো। তবে আজ নানা-নানী খুশি ছিল, কারণ যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার কালো মেঘ এখন এই বাড়ি থেকে সরে গেছে। সন্ধ্যায় নানী রান্নাঘরে গেলো। তখন মা একা চুপচাপ রান্নাঘরের স্ল্যাবে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে চা ফুটতে দেখছিল। মা কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলো, নাহলে নানীর রান্নাঘরে ঢোকার শব্দেও সে একটুও নড়লো না। নানী কাজ করতে করতে মায়ের দিকে তাকালো। তারপর মায়ের কাছে এসে স্ল্যাবের ওপর একহাত দিয়ে দাঁড়াল। নানীই নীরবতা ভেঙে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল।
নানী: নাজমা! প্রত্যেক বাবা-মাই তাদের সন্তানদের সুখের কথা ভাবে। কিন্তু আমরা হয়তো একটু বেশিই ভেবেছি।
নানীর কথা শুনে মা হঠাৎ বলল।
মা: আমি চলে গেলে তোমরা একা একা কি করে থাকবে?
মায়ের হঠাৎ একথা শুনে নানী মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। এতে মা লজ্জায় মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বিষয়টা বুঝতে নানীর কিছুটা সময় লাগল। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নানীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে মুখে খুশির রেখা দেখা গেল। তারপর সে আস্তে আস্তে মায়ের কাছে এসে তার চিবুক ধরে উপরের দিকে তুললো। এতে মায়ের মুখ নানীর মুখোমুখি হয়ে গেল। তবে মা তার চোখগুলো নিচু করেই রাখলো। শতচেষ্টা করেও মা তার মুখে লজ্জার ছাপ লুকাতে পারল না। ননী এটা বুঝতে পারল। কিন্তু তবুও সে ফিসফিস করে মা জিজ্ঞেস করলো।
নানী: সত্যি?
মা কোন কথা না বলে নানীর কাঁধে মুখ লুকালো। আর মা নানীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। এতে নানী হেসে একহাত দিয়ে মার চুল আর পিঠে আদর করতে লাগলো। নানী আবার বললো।
নানী: আরে পাগলী! এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমরা কী তোর পর নাকি? আর তুই তো অন্য কারও বাড়িতে যাচ্ছিস না। আমরা তো সবাই তোর আপনজনই।
একথা শুনে মা আরও বেশী লজ্জা পেয়ে নানীর বুকে মুখ লুকালো। বৃহস্পতিবার আমি যখন রংপুরে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। প্রতিবারের মতো এবারও আমার নানা-নানী আমাকে হাসিমুখে স্বাগত জানালো। কিন্তু এবার সেখানে মাকে দেখতে পেলাম না। বাড়ির ভিতরে এসে ব্যাগ রাখলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না যে নানা-নানীকে আজ এতো খুশি দেখাচ্ছিল কেন। বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? তাই যদি না হবে তাহলে মা আমার সাথে এমন করছে কেন? আমার কোন ভুলের জন্য মা আমার উপর রেগে আছে? আমি কি অজান্তে মাকে কোন কষ্ট দিয়ে দিয়েছি? মা সাধারণত বাড়ির বাইরে বেশি যায় না। আর আজ তো আমার আসার কথা। আজতো সে বাড়ির বাইরে যাবেই না। তাহলে সে আমার সাথে দেখা করতে এলো না কেন? আমি যখন এসব কথা ভাবছিলাম তখন নানা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি: নাজমুল তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আমি: বলো নানা।
নানা একবার নানী দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল।
নানা: এটা অতোটাও জরুরী না। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরাম করে বসে বলা যাবে।
নানার কথা শুনে আমি আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম না জানি নানা আমার সাথে কী এমন জরুরী কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি মাকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলাম। মনে অনেক দুশ্চিন্তা খেলতে লাগলো। কিছুই ভালো লাগছিল না। আমার মন বলছে দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করি যে আমার অপরাধটা কি? আমি ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসার সাথে সাথে নানী আমাকে ডিনারের জন্য ডাকলো। আমি জানতাম আজকের দিনটা আর আগের মত নেই। আজ নানী খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। কিন্তু আমি রান্নাঘরে মাকে দেখলাম। এমনকি তাকে নানীর সাথে কথা বলতে শুনলাম। এতে আমার রাগ হতে লাগলো। ভাবলাম সবই তো ঠিক আছে। তাহলে কি আমিই অপরাধী। আর নানা-নানীও নিশ্চয়ই আমার প্রতি মায়ের এমন আচরণ লক্ষ্য করছে। তারপরও তাকে কেউ কিছুই বলছে না। রাতের খাওয়া শেষ করে নানা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলো। এখন গরমকাল চলছিল। তাই ছাদে এসে একটু ভালো লাগছিলো। মাঝে মাঝে একটু বাতাসও আসছিলো। নানা ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আর ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট মুখে দিয়ে বলল।
নানা: তোর নানী এখন এখানে নেই। তাই একটা সিগারেট খেয়ে নেই।
একথা বলে সে হাসতে লাগলো আর পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে সিগারেটা জ্বালালো। এটা দেখে আমি বললাম।
আমি: নানা ডাক্তার তোমাকে ধূমপান করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে।
নানা সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো।
নানা: একটা দুইটা খেলে কিছু হবে না।
নানা হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। কিন্তু আমার মন তখনও অস্থির ছিল। আমি বারবার চিন্তা করতে লাগলাম যে নানা আমাকে কী বলতে চায়। এই সব ভাবছিলাম, হঠাৎ নানী ডাক দিল। আমরা নীচে নেমে গেলাম। আমি মাকে খুজতে লাগলাম। রান্নাঘরের লাইট বন্ধ। তার মানে মা রাতের খাবার খেয়ে তার রুমে চলে গেছে। আমার মায়ের উপর খুব রাগ হল। আমি কি ভুল করেছি যে সে আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে? নানা আমাকে তার ঘরে আসতে বললো। সাথে নানী আসলো। আমি তাদের রুমে যেতেই নানা দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি তাদের বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। নানা-নানী বিছানায় বসলো। আমার খুবই চিন্তা হতে লাগলো। আসলে তারা আমাকে কী বলতে চায়? আর একথার সাথে মায়ের সম্পর্ক কি? এসব হাজারো দুশ্চিন্তা তখন আমার মাথায় ভিড় করতে লাগলো। তখন নানা বলতে লাগলো।
নানা: নাজমুল। তোর লালন-পালনে আমরা কোন কমতি রাখিনি। ছোটবেলা থেকে আমরা তোকে সবই দিয়ে আসছি এবং আজ অবধি আমরা তোর যত্ন করছি। কিন্তু এখন তুই বড় হয়েছিস। তুই চাকরি করছিস। আমাদের ছেড়ে একা থাকিস। আমরা জানি সেখানে থাকতে তোর অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তবুও আমরা খুশি যে তুই তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিস। তুই তোর নিজের জীবনে উপভোগ করতে শিখে গেছিস। আমরা হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না। আমরা মরে যাওয়ার পরও তোর জীবন সুন্দরভাবে কাটুক এটাই আমরা চাই। তোর পরিবার হোক। তাই আমরা এখন চাই তোর বিয়ে দিতে।
একথা বলে নানা চুপ হয়ে গেলো। হয়তো সে আমার জবাব জানতে চাইছে। কিন্তু আমি মনে মনে অন্য কথা ভাবছিলাম। আমার মনে হতে লাগলো মা হয়তো এবিষয় নিয়ে কষ্ট পেয়েছে। তাই আমার সাথে কথা বলছে না। তাই মনে মনে ভাবলাম মায়ের সুখের জন্য যদি আমাকে বিয়ে নাও করতে হয়, তবুও আমার কোন আফসোস থাকবে না। কারণ আমি তাকে সারাজীবন খুশি রাখতে চাই। নানা আবার বললো।
নানা: দেখ নাজমুল। আমরা চাই কেউ যেন তোর জীবনে এসে তোর পাশে থাকে। তোর প্রতিটা আবেগ বুঝে। তোর জীবনের প্রতিটা উত্থান-পতনে তোর পাশে থাকে। আর তোর জীবনের চলার পথকে সহজ করে তোলে। তাইতো পুরুষের জীবনে একজন স্ত্রীর প্রয়োজন। আজ পর্যন্ত আমরা তোর জীবনের সকল ভালো-মন্দের কথা চিন্তা করে তোর সব করেছি। এখন যদি এই শেষ দায়িত্বটা আমরা ঠিকঠাক সম্পন্ন করতে পারি তাহলে আমরা শান্তিতে মরতে পারব।
আমি মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বললাম।
আমি: নানা তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু.....
বলতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম। আমি প্রথমে মায়ের কাছে জানতে চাই যে সে কি এবিষয়টা নিয়ে দুঃখি? একারণে কি সে আমার কাছ থেকে দূরে থাকছে? কিন্তু নানা মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই সে আবার বললো।
নানা: নাজমুল আমি যা বলছি তা আগে শোন। তারপর তুই ভালো করে ভেবে আমাকে তোর উত্তর দিস। তোর যদি মনে হয় এটা আমাদের সকলের ভালোর জন্য, তাহলে ভেবে চিন্তে আমাকে বল। নইলে তুই আমাদের যা সিদ্ধান্ত দিবি আমরা তাই করব।
একথা বলে নানা নানীর দিকে তাকাল। নানীও এতে রাজি হয়ে তার মাথা নেড়ে সায় দিলেন। নানা আবার বলতে শুরু করলো।
নানা: আমরা তোকে সবই দিয়েছি, যা প্রতিটি শিশু চায়। কিন্তু আমরা তোকে একটি জিনিস দিতে পারিনি। প্রত্যেকটা শিশু একজনকে বাবা বলে ডাকার আনন্দ পায়। কিন্তু আমরা কখনোই তোকে সেটা পাওয়ার সুযোগ দিতে পারিনি। আর এখন যদি তুই বিয়ে করিস তাহলে তুই নতুন মা-বাবা পাবি।
তারপর নানা এক মিনিটের মতো চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল।
নানা: আমি এপ্রস্তাবটা আমাদের সকলের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখেই বলছি। তুই কি আমাকে 'বাবা' বলে ডাকবি?