23-06-2019, 11:53 PM
পার্টঃঃ০৩
না আর কিছু নয়। বললো তুই এখানে কার সোর্সে এসেছিস। তোকে কে রিক্রুট করেছে। কতদিন আছিস। এই সব।
তুমি কি বললে ?
আমি বললাম তুই শুভঙ্করের থ্রু দিয়ে এসেছিস। শুভঙ্কর আমার বন্ধু। তা দেখলাম ও শুভঙ্করকেও চেনে ।
আর কি বললো ?
বাবাঃ তুই আমাকে এ ভাবে জেরা করছিস কেনো ? আমি তো তোকে খালি জিজ্ঞাসা করলাম মাত্র।
ব্যাপারটা যখন আমাকে নিয়ে তখন আমাকে ভাল করে জানতে হবে, তাই।
অমিতাভদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। জানে আমি ভীষণ হুইমজিক্যাল আমাকে এই পৃথিবীতে একমাত্র কন্ট্রোল করতে পারে বড়মা। বড়মা ছারা আমি কাউকে এই পৃথিবীতে পাত্তা দিই না। এরকম একবার হয়েছিল। একটা লেখা নিয়ে আমার সঙ্গে অমিতাভদার মনো মালিন্য হয়েছিল। আমি অমিতাভদার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এমনকি রিজাইন দেবারও মনস্থির করেছিলাম। সে যাত্রায় বড়মা শিখন্ডী হয়ে সব সামাল দিয়েছিলেন। অমিতাভদা ঐ ব্যাপারটা জানেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সংঘমিত্রা আমার ক্লাশমেট। কলেজের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। শুভঙ্করবাবুর কাছেও এক সঙ্গে পরেছি। এরবেশি কিছু জানতে চাইবে না।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছন ফিরে তাকাই নি। সোজা লিফ্টের কাছে চলে এলাম। দেখলাম লিফ্ট এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নীচে নেমে এলাম।
মনটা ভীষণ খারাপ লাগল। মিত্রা শেষ পর্যন্ত এখানে ফোন করল কেন। ও এই হাউসের মালিক এইটা বোঝাতেই কি অমিতাভদাকে ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলো। না অন্য কোন অনুসন্ধিতসা।
পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম ভীষণ খিদে পেয়েছে। পেটে ছুঁচো ডন-বৈঠকি মারছে। ফ্যাটমামির চাউমিন কারখানাতে ঢুকলাম। অফিসের পাশে বলে প্রায়ই এখানে আসা হয়। আমাদের অফিসের অনেকে এখানে আসে না।
আমরা কলেজ লাইফে বন্ধুরা সবাই মিলে এখানে আসতাম। ফ্যাটমামি চাউমিনটা দারুন বানায়। ঘন ঘন ঘন আসা হয় বলে সবাই চেনে জানে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১টা বাজে। তনু বলেছিলো একবার ফোন করতে। বয়টা কাছে এসে দাঁড়াল। বললাম একপ্লেট চাউমিন আনতে। ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বার করে দেখলাম বড়মার নম্বর। তারমানে আমার বেগতিক অবস্থার খবর এরি মধ্যে পৌঁছে গেছে। একবার ভাবলাম ধরবনা। তারপর ভাবলাম না থাক।
হ্যাঁ বলো কি হয়েছে। তোমায় তো বললাম ৫ টার সময় যাবো।
তুই এখন কোথায় ?
চাউমিন খাচ্ছি।
ঠিক আছে। পারলে একটু তাড়াতারি আসিস কথা আছে।
কি কথা ?
কেন তুই জানিস না।
আচ্ছা।
ফ্ল্যাটে এসে জামাকাপড় খুললাম। পাখাটা হাল্কা করে খুলে নেংটো হয়ে পাখার তলায় দাঁড়ালাম। আঃ কি আরাম। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে অমিতাভদার সঙ্গে ঐরকম ব্যবহার করার উচিত হয়নি। যত রাগ গিয়ে পরছে মিত্রার ওপর। কেউ আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করলে আমি যে স্থির থাকতে পারি না। কি আর করা যাবে। মিত্রার সঙ্গে দেখো হলে ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেনো ও অমিতাভদাকে এই ভাবে ক্রস করেছে। ও কি মালকিন গিরি দেখাতে চেয়েছে।
কলকাতায় এখন শীত পরেনি। বেশিক্ষণ পাখার হাওয়া ভাল লাগে না। একটুতেই শীত শীত করে। বেলটা বেজে উঠল। তাড়াতারি বিছানা থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিলাম।
দরজা খুলতেই একটা মিষ্টি গন্ধ আমার ঘ্রাণ শক্তিকে আক্রমন করল। সমনে তনু দাঁড়িয়ে। আজকে ও খুব একটা বেশি সাজেনি। হাল্কা মেকআপ। কপালে ছোট্ট একটা বিন্দির টিপ। চোখের কোলে হাল্কা কাজলের রেখা। চেখ দুটো শ্বেত করবীর ওপর যেন কালো বোলতা বসে আছে। আমি একদৃষ্টে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ও মিটি মিটি হাসছে।
কি হলো, ভেতরে যেতে বলবে না, এখানে দাঁড়িয়ে কি....।
সরি।
ও ভেতরে এলো। ওর পরনে আজ টাইট জিনস। কোমরবন্ধনীর একটু ওপরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। ওপরে একটা শর্ট গেঞ্জি পরেছে। তনুকে আজ দারুন দেখতে লাগছে। কাগজের অফিসের মেয়েরা এরকমই সাজগোজ করে।
এই তনুই একদিন মল্লিকদাকে নালিশ করেছিল। অনির সঙ্গে আমাকে কভারেজে পাঠাবেন না। ওকে কেউ সাংবাদিক হিসাবে পাত্তাই দেয় না। এক কোনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কারুর সঙ্গে আলাপ করতে চায় না। বলে কি হবে। ওর জন্য আমার প্রেস্টিজ চলে যায়।
মল্লিকদা হাসতে হাসতে বলেছিল। যাই করুক ওর লেখাটা দেখেছিস, ওই লেকাটার সঙ্গে তোর ছবি। মাইলেজটা কোথায় বুঝতে পারছিস।
তনু পরে ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছিলো। যখন অনেকেই আমার লেখার এ্যাসাইনমেন্ট পাওয়ার জন্য মল্লিকদার কাছে হত্যে দিয়ে পরে থাকতো।
তারপর ও আমার বন্ধু হয়ে গেলো।
কি ভাবছো ? সেন্টার টেবিলে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
আমি চুপচাপ।
কিছু খেয়েছো ?
মাথা দুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ চাউমিন।
ও পায়ে পায়ে ভেতরের ঘরে চলে এলো। এই ফ্ল্যাটে ওর অবারিত দ্বার। ও ছাড়া এই ফ্ল্যাটে আমার অফিসের দ্বিতীয় ব্যক্তির কোন প্রবেশাধিকার হয় নি। বিছানা অগোছালো।
সত্যি তোমার দ্বারা আর কিছু হবে না।
কেনো।
একটু বিছানাটা পরিষ্কার করতে পারো না।
সময় কোথায়।
ঘুম থেকে উঠে করবে।
আমার দ্বারা হয় না। একটা মাসি ছিল। তা আমারই থাকার ঠিক নেই। মাসিকে রেখে কি করব। বারন করে দিয়েছি।
বড়মা কখনো এবাড়িতে এসেছেন ?
না।
সেইজন্য।
এ বাড়িতে কেউ আসে নি তুমি ছাড়া।
সত্যি!
আমি খুব লাকি বলো।
বলতে পারো।
তুমি অফিসের কাউকে নিয়ে আসো নি!
না। তোমার এ্যাসাইনমেন্ট হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। কয়েকটা ছবি তুলতে দিয়েছিল। তুলে দিলাম।
জমা দিয়ে দিয়েছো।
দিলেই তো আবার পাঠাবে।
তারমানে তুমি কাজে ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে।
ভাললাগছে না। তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
আমি জানি তনু কেন আমার কাছে বারে বারে আসে। কিন্তু আমি ওর ডাকে সারা দিইনা। আমাদের হাউসে লুটেপুটে খাওয়ার লোক প্রচুর আছে। সব হাউসেই আছে। খালি একটু চোখ মেলে তাকালেই হলো। তনু আমার হাতের একবারে কাছে। চাইলেই ও আমার ডাকে সারা দেবে। আমি পারি না। কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অনেকঘাটে জল খেয়েছি। তার চেয়ে বেশ আছি।
একটা জিনিষ বারবার লক্ষ করেছি। আমি কোন মেয়ের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছি। সে আমাকে সেক্স পার্টনারের অফার দিয়েছে। বেশ সন্তর্পনে সরে এসেছি। জানিনা ঈশ্বর আমার শরীরটায় কি মধু মাখিয়ে রেখেছে।
কি ভাবছো।
কিছু না।
তুমি আমার সেই কথার উত্তর এখনো দিলে না।
কোন কথা।
দুজনে প্রথম যখন এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে গেলাম। সেই সময় একটা কথা বলেছিলাম।
সত্যি বলবো তনু।
বলো।
একটা ভুল করেছিলাম। ক্ষণিকের জন্য। এরজন্য তোমার থেকেও আমি নিজেকে অনেকটা বেশি দায়ী করি।
না। আমি তোমাকে একটু বেশি চেয়েছিলাম সেদিন।
তুমি চেয়েছিলে আমি সায় দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ।
তারপর আমার ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
হ্যাঁ।
যার বাপ-মার ঠিকানা নেই তাকে তুমি ভালবেসে করবে কি ?
তনু মাথা নীচু করে রইল। বুঝতে পারছি। ওর চোখ দুটো খুব ভারি ভারি।
তনু।
উঁ।
আচ্ছা আমি তোমার খুব ভাল বন্ধু হতে পারি না।
তনু আমার দিকে তাকালো।
তুমি অন্য কারুর এটা বলছোনা কেনো।
বিশ্বাস করো। আমি কারুর নই। আমি একা। কারুর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াতে চাই না। আমাকে অফিসে দেখেছো তো। আমার কোনো ভাল বন্ধু নেই। একমাত্র সন্দীপ ছাড়া।
সন্দীপদার কাছে তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি।
জানিনা সন্দীপ তোমায় কি বলেছে। যে টুকু বলেছে, আশা রাখি আমার সম্বন্ধে তোমার জানার চাহিদা মিটে গেছে।
তুমি এত ভালছেলে আমাদের হাউসে পরে আছ কেনো।
এখনো ভাল সুযোগ পাইনি বলে। তাছাড়া দাদা মল্লিকদাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তোমায় আমি খুব বিরক্ত করি।
একবারে না। তুমি এলে বরং ভাল লাগে। আমার কথা বলার কেউ নেই জান।
তনু আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার কাছে এগিয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে বলল। আমি খুব হ্যাংলা তাই না।
মটেই না।
তনু ঘন্টা খানেক আমার কাছে থাকলো। তারপর চলে গেলো। যাওয়ার সময় ওর চোখের আর্তি আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেলো। একবার ভাবলাম মিত্রা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই জায়গায় তনুকে স্থান দিলে ক্ষতি কি। কিন্তু আমি যে মিত্রার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। ওকে ছাড়া আমি পৃথিবীতে কাউকে আমার জীবনে স্থান দেব না।
জামা কাপর পরে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই টুকু রাস্তা ইচ্ছে করলনা বাসে যেতে। হাঁটতে হাঁটতে অমিতাভদার বাড়িতে পৌঁছলাম। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। গেটের মুখ থেকেই দেখলাম সকলে বাইরের লবিতে পায়চারি করছে। বড়মাকে দেখলাম না। ছোটমা আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে শ্রীমান এলেন এতোক্ষণে। অমিতাভদা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, কিরে শরীর খারাপ নাকি ? আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, না। মল্লিকদা বললেন, কি বাবা আবার ঘুম।
আমি মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছোটমাকে বলব নাকি সকালের ব্যাপারটা।
এই তো আমাদের দুই কলিগের কথা। সে তো অফিসেই হয়ে গেছে। আবার বাড়িতে কেন ?
কিরে অনি কি হয়েছে। ছোটমা চেঁচিয়ে উঠলেন।
আমি হেসে ফেললাম। অফিসে এই ভদ্রলোকদ্বয়ের দাপট দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আর বাড়িতে ছোটমা কিংবা বড়মার কাছে অমিতাভদা মল্লিকদা যেন কেঁদ বাঘ।
বড়মা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। কিরে তোর কি হয়েছে। এত দেরি কেন ?
কোথায় দেরি হয়েছে। তোমাকে বললাম পাঁচটা নাগাদ আসব, এসেছি সাড়ে পাঁচটা।
চল ভেতরে চল। সব গোছ গাছ করে নিয়েছিস। ছোট একবার ওর ব্যাগ খুলে দেখে নে। সব ঠিক ঠাক নিয়েছে কিনা।
আমি ভেতরে এসে খাবার টেবিলে বসলাম। দেখলাম তিনজনের জায়গা হয়েছে।
বড়মার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে তিনজনের জায়গা দেখছি। আর দুজনের ?
খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি তুই আর তোর ছোট খাব।
তুমি কি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছ ?
বড়মার চোখ ছল ছল করে উঠল। তুই খেতে চাইলি তোকে না খাইয়ে খাই কি করে বল।
ছোটমা ?
তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।
শিগগির ডাক আমার ব্যাগ দেখতে হবে না। আমি ঠিক ঠিক গুছিয়ে নিয়েছি।
বড়মা চেঁচিয়ে উঠল ছোট আয় চলে আয়। আগে খেয়ে নিই তারপর না হয় ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিস ।
একসঙ্গে তিনজন খেতে বসলাম। বড়মা আজ দারুন দারুন সব পদ রান্না করেছে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি। ট্যাংরা মাছের ঝোল। ভাপা ইলিশ। নিঃশব্দে তিনজন খাচ্ছিলাম। আমি একটা ট্যাংরা মাছ বড়মার পাতে তুলে দিলাম। বড়মা হেই হেই করে উঠল। আর একটা ইলিশ মাছ ছোটমার পাতে তুলে দিলাম। ছোটমা কপট গম্ভীর হয়ে বলল, অনি এটা কি হল। সারাটা দুপুর ধরে আমরা দু’বনে তোরজন্য রান্না করলাম আর তুই যদি...।
আমার যতটা খাওয়ার আমি ঠিক নিয়ে নিয়েছি। বারতিটা তোমাদের দিলাম।
বড়মা খেতে খেতেই বলল, হ্যাঁরে অনি দুপুরে কি হয়েছিল। তুই নাকি তোর বসের সঙ্গে রাগারাগি করেছিস।
তোমায় এ কথা আবার কে বলল ?
মল্লিক বলল।
আমি ছোটমার মুখের দিকে একবার তাকালাম। ছোটমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো দুজনকেই আমি ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু বড়মাকে আমি শ্রদ্ধাকরি। তাই বড়মার কোন কথায় আমি চট করে না করতে পারি না। অনেক ভেবে চিন্তে আমায় উত্তর দিতে হয়।
তুমি বড়মাকে বলেছ নাকি ?
কি!
তোমাকে একদিন গল্পের ছলে বলেছিলাম।
মিত্রার ব্যাপারটা।
হ্যাঁ।
তোর গুণের কথা দিদিকে বলব না।
আজ ঐ ব্যাপারটা নিয়েই একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে।
খেতে খেতে মাথা নীচু করেই কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ সবাই নিঃশব্দ। খালি খাবার থালায় হাপুস হুপুস শব্দ।
তুই জানিস না ও তোদের মালকিন।
জানতাম না। আজ জানলাম। কয়েক মাস আগে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেঙ্গল ক্লাবে। বড় সাহেব পাঠিয়েছিল।
কি জন্য।
একটা এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ওখানে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা হল। ওর হাসবেন্ডের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিল। তারপর জোর করে ওর বাড়িতে টেনে নিয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত ওর বাড়িতে ছিলাম। সেদিন তোমার এখানে আসার কথা ছিল। আসা হয় নি। কেন ছোটমাকে আমি তো সব বলেছিলাম।
হ্যাঁ ছোট বলেছিল। বয়স হয়েছে এখন আর খেয়াল থাকে না।
কিরে হোল সাড়ে সাতটায় ট্রেন। এতটা পথ যেতে হবে। অমিতাভদার গলায় অভিযোগের সুর।
নিজেরা তো চব্বচষ্য গিলেছ আমাদের কি একটু শান্তিতে খেতেও দেবেনা। কি হিংসুটে ব্যাটাছেলেরে বাবা।
তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মারল।
নে নে তোর কাগজপত্র সব বুঝে নে। আমায় আবার অফিসে যেতে হবে। আমি আমার ট্রেনের টিকিট। হোটেলের বুকিংয়ের কাগজপত্র। অফিসিয়াল কিছু কাগজপত্র। সব বুঝে নিলাম। সবাইকে একে একে প্রণাম করলাম বড়মার চোখ ছলছল। আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, সঙ্গে রাখ। জানি তোর কাছে আছে। লাগলে খরচ করিস। না লাগলে এসে ফেরত দিস।
আমি হাসলাম। আজ পর্যন্ত বড়মা আমার কাছে থেকে কিছু ফেরত নেন নি। খালি দিয়ে গেছেন। আমি মুখের দিকে তাকালাম।
বেরিয়ে এলাম। অফিসের গাড়ি রেডি আছে। অমিতাভদা বলল, শোন আমাদের এক কোরেসপন্ডেন্স আছে ওখানে বালচন্দ্রন নাম ও কাল তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। তবে আজ তোর জন্য স্টেশনে আমাদের অফিসের গাড়ি থাকবে। অফিসিয়াল ফাইলের ওপরে যে চিঠিটা আছে দেখবি ওতে গাড়ির নম্বর লেখা আছে। তাছাড়া আমি ওখানকার অফিসে বলে দিয়েছি। তোর কোচ নং টিকিটের নম্বর ওদের দিয়ে দিয়েছি।
তারমানে মোদ্দা কথা হোল আমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সমস্ত বন্দ বস্তই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা হয়ে গেছে।
স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ছাড়তে আর দশ মিনিট বাকি। আমার টিকিট এসি টু টায়ার। টিকিটের সঙ্গে কোচ মিলিয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। দেখলাম আমার জন্য একটি কুপ বুক করা হয়েছে। মাত্র দুটি সিট। সেখানে আর একজন যাত্রীকে দেখতে পেলাম না। যাই হোক আমার একটা মাত্র ব্যাগ। সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে একটু বাইরে বেরিয়ে এলাম। বহু মানুষের দৌড়াদৌড়ি। চেঁচামেচি। গাড়ির ড্রাইভার কাছে এগিয়ে এসে বলল অনিদা আমি এবার যাই। আমি বললাম, হ্যাঁ যা। গিয়ে একবার বলে দিস আমি ঠিক ঠিক ট্রেনে উঠেছি। ছেলেটি হেসে ফেলল। আমি ভেতরে চলে এলাম। ট্রেনটা একটু দুলে উঠেই চলতে শুরু করল।
আমি আমার জায়গায় এসে বসলাম। কুপের দরজাটা খোলাই রেখেছি। একটু পরেই টিটি আসবে। রাত্রি বেলা। অতএব ঠেসে ঘুম। খাওয়া দাওয়া বেশ ভালই হয়েছে। তবে এককাপ গরম কফি পেলে বেশ ভাল হতো। কপাল ভাল থাকলে হয়তো এরা দেবে। না হলে নয়।
না আর কিছু নয়। বললো তুই এখানে কার সোর্সে এসেছিস। তোকে কে রিক্রুট করেছে। কতদিন আছিস। এই সব।
তুমি কি বললে ?
আমি বললাম তুই শুভঙ্করের থ্রু দিয়ে এসেছিস। শুভঙ্কর আমার বন্ধু। তা দেখলাম ও শুভঙ্করকেও চেনে ।
আর কি বললো ?
বাবাঃ তুই আমাকে এ ভাবে জেরা করছিস কেনো ? আমি তো তোকে খালি জিজ্ঞাসা করলাম মাত্র।
ব্যাপারটা যখন আমাকে নিয়ে তখন আমাকে ভাল করে জানতে হবে, তাই।
অমিতাভদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। জানে আমি ভীষণ হুইমজিক্যাল আমাকে এই পৃথিবীতে একমাত্র কন্ট্রোল করতে পারে বড়মা। বড়মা ছারা আমি কাউকে এই পৃথিবীতে পাত্তা দিই না। এরকম একবার হয়েছিল। একটা লেখা নিয়ে আমার সঙ্গে অমিতাভদার মনো মালিন্য হয়েছিল। আমি অমিতাভদার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এমনকি রিজাইন দেবারও মনস্থির করেছিলাম। সে যাত্রায় বড়মা শিখন্ডী হয়ে সব সামাল দিয়েছিলেন। অমিতাভদা ঐ ব্যাপারটা জানেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সংঘমিত্রা আমার ক্লাশমেট। কলেজের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। শুভঙ্করবাবুর কাছেও এক সঙ্গে পরেছি। এরবেশি কিছু জানতে চাইবে না।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছন ফিরে তাকাই নি। সোজা লিফ্টের কাছে চলে এলাম। দেখলাম লিফ্ট এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নীচে নেমে এলাম।
মনটা ভীষণ খারাপ লাগল। মিত্রা শেষ পর্যন্ত এখানে ফোন করল কেন। ও এই হাউসের মালিক এইটা বোঝাতেই কি অমিতাভদাকে ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলো। না অন্য কোন অনুসন্ধিতসা।
পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম ভীষণ খিদে পেয়েছে। পেটে ছুঁচো ডন-বৈঠকি মারছে। ফ্যাটমামির চাউমিন কারখানাতে ঢুকলাম। অফিসের পাশে বলে প্রায়ই এখানে আসা হয়। আমাদের অফিসের অনেকে এখানে আসে না।
আমরা কলেজ লাইফে বন্ধুরা সবাই মিলে এখানে আসতাম। ফ্যাটমামি চাউমিনটা দারুন বানায়। ঘন ঘন ঘন আসা হয় বলে সবাই চেনে জানে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১টা বাজে। তনু বলেছিলো একবার ফোন করতে। বয়টা কাছে এসে দাঁড়াল। বললাম একপ্লেট চাউমিন আনতে। ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বার করে দেখলাম বড়মার নম্বর। তারমানে আমার বেগতিক অবস্থার খবর এরি মধ্যে পৌঁছে গেছে। একবার ভাবলাম ধরবনা। তারপর ভাবলাম না থাক।
হ্যাঁ বলো কি হয়েছে। তোমায় তো বললাম ৫ টার সময় যাবো।
তুই এখন কোথায় ?
চাউমিন খাচ্ছি।
ঠিক আছে। পারলে একটু তাড়াতারি আসিস কথা আছে।
কি কথা ?
কেন তুই জানিস না।
আচ্ছা।
ফ্ল্যাটে এসে জামাকাপড় খুললাম। পাখাটা হাল্কা করে খুলে নেংটো হয়ে পাখার তলায় দাঁড়ালাম। আঃ কি আরাম। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে অমিতাভদার সঙ্গে ঐরকম ব্যবহার করার উচিত হয়নি। যত রাগ গিয়ে পরছে মিত্রার ওপর। কেউ আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করলে আমি যে স্থির থাকতে পারি না। কি আর করা যাবে। মিত্রার সঙ্গে দেখো হলে ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেনো ও অমিতাভদাকে এই ভাবে ক্রস করেছে। ও কি মালকিন গিরি দেখাতে চেয়েছে।
কলকাতায় এখন শীত পরেনি। বেশিক্ষণ পাখার হাওয়া ভাল লাগে না। একটুতেই শীত শীত করে। বেলটা বেজে উঠল। তাড়াতারি বিছানা থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিলাম।
দরজা খুলতেই একটা মিষ্টি গন্ধ আমার ঘ্রাণ শক্তিকে আক্রমন করল। সমনে তনু দাঁড়িয়ে। আজকে ও খুব একটা বেশি সাজেনি। হাল্কা মেকআপ। কপালে ছোট্ট একটা বিন্দির টিপ। চোখের কোলে হাল্কা কাজলের রেখা। চেখ দুটো শ্বেত করবীর ওপর যেন কালো বোলতা বসে আছে। আমি একদৃষ্টে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ও মিটি মিটি হাসছে।
কি হলো, ভেতরে যেতে বলবে না, এখানে দাঁড়িয়ে কি....।
সরি।
ও ভেতরে এলো। ওর পরনে আজ টাইট জিনস। কোমরবন্ধনীর একটু ওপরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। ওপরে একটা শর্ট গেঞ্জি পরেছে। তনুকে আজ দারুন দেখতে লাগছে। কাগজের অফিসের মেয়েরা এরকমই সাজগোজ করে।
এই তনুই একদিন মল্লিকদাকে নালিশ করেছিল। অনির সঙ্গে আমাকে কভারেজে পাঠাবেন না। ওকে কেউ সাংবাদিক হিসাবে পাত্তাই দেয় না। এক কোনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কারুর সঙ্গে আলাপ করতে চায় না। বলে কি হবে। ওর জন্য আমার প্রেস্টিজ চলে যায়।
মল্লিকদা হাসতে হাসতে বলেছিল। যাই করুক ওর লেখাটা দেখেছিস, ওই লেকাটার সঙ্গে তোর ছবি। মাইলেজটা কোথায় বুঝতে পারছিস।
তনু পরে ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছিলো। যখন অনেকেই আমার লেখার এ্যাসাইনমেন্ট পাওয়ার জন্য মল্লিকদার কাছে হত্যে দিয়ে পরে থাকতো।
তারপর ও আমার বন্ধু হয়ে গেলো।
কি ভাবছো ? সেন্টার টেবিলে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
আমি চুপচাপ।
কিছু খেয়েছো ?
মাথা দুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ চাউমিন।
ও পায়ে পায়ে ভেতরের ঘরে চলে এলো। এই ফ্ল্যাটে ওর অবারিত দ্বার। ও ছাড়া এই ফ্ল্যাটে আমার অফিসের দ্বিতীয় ব্যক্তির কোন প্রবেশাধিকার হয় নি। বিছানা অগোছালো।
সত্যি তোমার দ্বারা আর কিছু হবে না।
কেনো।
একটু বিছানাটা পরিষ্কার করতে পারো না।
সময় কোথায়।
ঘুম থেকে উঠে করবে।
আমার দ্বারা হয় না। একটা মাসি ছিল। তা আমারই থাকার ঠিক নেই। মাসিকে রেখে কি করব। বারন করে দিয়েছি।
বড়মা কখনো এবাড়িতে এসেছেন ?
না।
সেইজন্য।
এ বাড়িতে কেউ আসে নি তুমি ছাড়া।
সত্যি!
আমি খুব লাকি বলো।
বলতে পারো।
তুমি অফিসের কাউকে নিয়ে আসো নি!
না। তোমার এ্যাসাইনমেন্ট হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। কয়েকটা ছবি তুলতে দিয়েছিল। তুলে দিলাম।
জমা দিয়ে দিয়েছো।
দিলেই তো আবার পাঠাবে।
তারমানে তুমি কাজে ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে।
ভাললাগছে না। তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
আমি জানি তনু কেন আমার কাছে বারে বারে আসে। কিন্তু আমি ওর ডাকে সারা দিইনা। আমাদের হাউসে লুটেপুটে খাওয়ার লোক প্রচুর আছে। সব হাউসেই আছে। খালি একটু চোখ মেলে তাকালেই হলো। তনু আমার হাতের একবারে কাছে। চাইলেই ও আমার ডাকে সারা দেবে। আমি পারি না। কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অনেকঘাটে জল খেয়েছি। তার চেয়ে বেশ আছি।
একটা জিনিষ বারবার লক্ষ করেছি। আমি কোন মেয়ের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছি। সে আমাকে সেক্স পার্টনারের অফার দিয়েছে। বেশ সন্তর্পনে সরে এসেছি। জানিনা ঈশ্বর আমার শরীরটায় কি মধু মাখিয়ে রেখেছে।
কি ভাবছো।
কিছু না।
তুমি আমার সেই কথার উত্তর এখনো দিলে না।
কোন কথা।
দুজনে প্রথম যখন এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে গেলাম। সেই সময় একটা কথা বলেছিলাম।
সত্যি বলবো তনু।
বলো।
একটা ভুল করেছিলাম। ক্ষণিকের জন্য। এরজন্য তোমার থেকেও আমি নিজেকে অনেকটা বেশি দায়ী করি।
না। আমি তোমাকে একটু বেশি চেয়েছিলাম সেদিন।
তুমি চেয়েছিলে আমি সায় দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ।
তারপর আমার ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
হ্যাঁ।
যার বাপ-মার ঠিকানা নেই তাকে তুমি ভালবেসে করবে কি ?
তনু মাথা নীচু করে রইল। বুঝতে পারছি। ওর চোখ দুটো খুব ভারি ভারি।
তনু।
উঁ।
আচ্ছা আমি তোমার খুব ভাল বন্ধু হতে পারি না।
তনু আমার দিকে তাকালো।
তুমি অন্য কারুর এটা বলছোনা কেনো।
বিশ্বাস করো। আমি কারুর নই। আমি একা। কারুর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াতে চাই না। আমাকে অফিসে দেখেছো তো। আমার কোনো ভাল বন্ধু নেই। একমাত্র সন্দীপ ছাড়া।
সন্দীপদার কাছে তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি।
জানিনা সন্দীপ তোমায় কি বলেছে। যে টুকু বলেছে, আশা রাখি আমার সম্বন্ধে তোমার জানার চাহিদা মিটে গেছে।
তুমি এত ভালছেলে আমাদের হাউসে পরে আছ কেনো।
এখনো ভাল সুযোগ পাইনি বলে। তাছাড়া দাদা মল্লিকদাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তোমায় আমি খুব বিরক্ত করি।
একবারে না। তুমি এলে বরং ভাল লাগে। আমার কথা বলার কেউ নেই জান।
তনু আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার কাছে এগিয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে বলল। আমি খুব হ্যাংলা তাই না।
মটেই না।
তনু ঘন্টা খানেক আমার কাছে থাকলো। তারপর চলে গেলো। যাওয়ার সময় ওর চোখের আর্তি আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেলো। একবার ভাবলাম মিত্রা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই জায়গায় তনুকে স্থান দিলে ক্ষতি কি। কিন্তু আমি যে মিত্রার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। ওকে ছাড়া আমি পৃথিবীতে কাউকে আমার জীবনে স্থান দেব না।
জামা কাপর পরে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই টুকু রাস্তা ইচ্ছে করলনা বাসে যেতে। হাঁটতে হাঁটতে অমিতাভদার বাড়িতে পৌঁছলাম। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। গেটের মুখ থেকেই দেখলাম সকলে বাইরের লবিতে পায়চারি করছে। বড়মাকে দেখলাম না। ছোটমা আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে শ্রীমান এলেন এতোক্ষণে। অমিতাভদা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, কিরে শরীর খারাপ নাকি ? আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, না। মল্লিকদা বললেন, কি বাবা আবার ঘুম।
আমি মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছোটমাকে বলব নাকি সকালের ব্যাপারটা।
এই তো আমাদের দুই কলিগের কথা। সে তো অফিসেই হয়ে গেছে। আবার বাড়িতে কেন ?
কিরে অনি কি হয়েছে। ছোটমা চেঁচিয়ে উঠলেন।
আমি হেসে ফেললাম। অফিসে এই ভদ্রলোকদ্বয়ের দাপট দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আর বাড়িতে ছোটমা কিংবা বড়মার কাছে অমিতাভদা মল্লিকদা যেন কেঁদ বাঘ।
বড়মা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। কিরে তোর কি হয়েছে। এত দেরি কেন ?
কোথায় দেরি হয়েছে। তোমাকে বললাম পাঁচটা নাগাদ আসব, এসেছি সাড়ে পাঁচটা।
চল ভেতরে চল। সব গোছ গাছ করে নিয়েছিস। ছোট একবার ওর ব্যাগ খুলে দেখে নে। সব ঠিক ঠাক নিয়েছে কিনা।
আমি ভেতরে এসে খাবার টেবিলে বসলাম। দেখলাম তিনজনের জায়গা হয়েছে।
বড়মার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে তিনজনের জায়গা দেখছি। আর দুজনের ?
খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি তুই আর তোর ছোট খাব।
তুমি কি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছ ?
বড়মার চোখ ছল ছল করে উঠল। তুই খেতে চাইলি তোকে না খাইয়ে খাই কি করে বল।
ছোটমা ?
তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।
শিগগির ডাক আমার ব্যাগ দেখতে হবে না। আমি ঠিক ঠিক গুছিয়ে নিয়েছি।
বড়মা চেঁচিয়ে উঠল ছোট আয় চলে আয়। আগে খেয়ে নিই তারপর না হয় ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিস ।
একসঙ্গে তিনজন খেতে বসলাম। বড়মা আজ দারুন দারুন সব পদ রান্না করেছে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি। ট্যাংরা মাছের ঝোল। ভাপা ইলিশ। নিঃশব্দে তিনজন খাচ্ছিলাম। আমি একটা ট্যাংরা মাছ বড়মার পাতে তুলে দিলাম। বড়মা হেই হেই করে উঠল। আর একটা ইলিশ মাছ ছোটমার পাতে তুলে দিলাম। ছোটমা কপট গম্ভীর হয়ে বলল, অনি এটা কি হল। সারাটা দুপুর ধরে আমরা দু’বনে তোরজন্য রান্না করলাম আর তুই যদি...।
আমার যতটা খাওয়ার আমি ঠিক নিয়ে নিয়েছি। বারতিটা তোমাদের দিলাম।
বড়মা খেতে খেতেই বলল, হ্যাঁরে অনি দুপুরে কি হয়েছিল। তুই নাকি তোর বসের সঙ্গে রাগারাগি করেছিস।
তোমায় এ কথা আবার কে বলল ?
মল্লিক বলল।
আমি ছোটমার মুখের দিকে একবার তাকালাম। ছোটমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো দুজনকেই আমি ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু বড়মাকে আমি শ্রদ্ধাকরি। তাই বড়মার কোন কথায় আমি চট করে না করতে পারি না। অনেক ভেবে চিন্তে আমায় উত্তর দিতে হয়।
তুমি বড়মাকে বলেছ নাকি ?
কি!
তোমাকে একদিন গল্পের ছলে বলেছিলাম।
মিত্রার ব্যাপারটা।
হ্যাঁ।
তোর গুণের কথা দিদিকে বলব না।
আজ ঐ ব্যাপারটা নিয়েই একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে।
খেতে খেতে মাথা নীচু করেই কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ সবাই নিঃশব্দ। খালি খাবার থালায় হাপুস হুপুস শব্দ।
তুই জানিস না ও তোদের মালকিন।
জানতাম না। আজ জানলাম। কয়েক মাস আগে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেঙ্গল ক্লাবে। বড় সাহেব পাঠিয়েছিল।
কি জন্য।
একটা এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ওখানে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা হল। ওর হাসবেন্ডের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিল। তারপর জোর করে ওর বাড়িতে টেনে নিয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত ওর বাড়িতে ছিলাম। সেদিন তোমার এখানে আসার কথা ছিল। আসা হয় নি। কেন ছোটমাকে আমি তো সব বলেছিলাম।
হ্যাঁ ছোট বলেছিল। বয়স হয়েছে এখন আর খেয়াল থাকে না।
কিরে হোল সাড়ে সাতটায় ট্রেন। এতটা পথ যেতে হবে। অমিতাভদার গলায় অভিযোগের সুর।
নিজেরা তো চব্বচষ্য গিলেছ আমাদের কি একটু শান্তিতে খেতেও দেবেনা। কি হিংসুটে ব্যাটাছেলেরে বাবা।
তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মারল।
নে নে তোর কাগজপত্র সব বুঝে নে। আমায় আবার অফিসে যেতে হবে। আমি আমার ট্রেনের টিকিট। হোটেলের বুকিংয়ের কাগজপত্র। অফিসিয়াল কিছু কাগজপত্র। সব বুঝে নিলাম। সবাইকে একে একে প্রণাম করলাম বড়মার চোখ ছলছল। আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, সঙ্গে রাখ। জানি তোর কাছে আছে। লাগলে খরচ করিস। না লাগলে এসে ফেরত দিস।
আমি হাসলাম। আজ পর্যন্ত বড়মা আমার কাছে থেকে কিছু ফেরত নেন নি। খালি দিয়ে গেছেন। আমি মুখের দিকে তাকালাম।
বেরিয়ে এলাম। অফিসের গাড়ি রেডি আছে। অমিতাভদা বলল, শোন আমাদের এক কোরেসপন্ডেন্স আছে ওখানে বালচন্দ্রন নাম ও কাল তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। তবে আজ তোর জন্য স্টেশনে আমাদের অফিসের গাড়ি থাকবে। অফিসিয়াল ফাইলের ওপরে যে চিঠিটা আছে দেখবি ওতে গাড়ির নম্বর লেখা আছে। তাছাড়া আমি ওখানকার অফিসে বলে দিয়েছি। তোর কোচ নং টিকিটের নম্বর ওদের দিয়ে দিয়েছি।
তারমানে মোদ্দা কথা হোল আমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সমস্ত বন্দ বস্তই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা হয়ে গেছে।
স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ছাড়তে আর দশ মিনিট বাকি। আমার টিকিট এসি টু টায়ার। টিকিটের সঙ্গে কোচ মিলিয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। দেখলাম আমার জন্য একটি কুপ বুক করা হয়েছে। মাত্র দুটি সিট। সেখানে আর একজন যাত্রীকে দেখতে পেলাম না। যাই হোক আমার একটা মাত্র ব্যাগ। সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে একটু বাইরে বেরিয়ে এলাম। বহু মানুষের দৌড়াদৌড়ি। চেঁচামেচি। গাড়ির ড্রাইভার কাছে এগিয়ে এসে বলল অনিদা আমি এবার যাই। আমি বললাম, হ্যাঁ যা। গিয়ে একবার বলে দিস আমি ঠিক ঠিক ট্রেনে উঠেছি। ছেলেটি হেসে ফেলল। আমি ভেতরে চলে এলাম। ট্রেনটা একটু দুলে উঠেই চলতে শুরু করল।
আমি আমার জায়গায় এসে বসলাম। কুপের দরজাটা খোলাই রেখেছি। একটু পরেই টিটি আসবে। রাত্রি বেলা। অতএব ঠেসে ঘুম। খাওয়া দাওয়া বেশ ভালই হয়েছে। তবে এককাপ গরম কফি পেলে বেশ ভাল হতো। কপাল ভাল থাকলে হয়তো এরা দেবে। না হলে নয়।