23-06-2019, 11:46 PM
পার্টঃঃ ০২
ভরা পুকুরে অনেকক্ষণ স্নান করলাম। শরীরটা জুড়িয়ে গেলো। এর আগের বার যখন এসেছিলাম। ঘন্টা খানেক ছিলাম। তারপর চলে গেছিলাম। তার আগে বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়ে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোতা দিয়ে ফুরুত করে চলে গেলো। শেষবার এসেছিলাম এমএ পরীক্ষার ফিজ নিতে। সেই শেষ আসা। মনে হয়ে শেষ চিঠি লিখেছিলাম। কাগজে চাকরিটা পাওয়ার পর। তারপর কাকা চিঠি দিলেও আমি তার কোন উত্তর দিই নি।
খেতে খেতে একে একে সবার খবর নিলাম। কাকীমা কখনো কাঁদেন কখনো গম্ভীর হয়ে যান। সুরমাসি নীপা বসে বসে সব শুনছে।
কাকার চোখে ছানি পরেছে। তাই চোখে কম দেখেন। বলতে গেলে দেখতেই পান না। এখানে এক ডাক্তার আছে। সে নাকি বলেছে অনেক টাকা লাগবে। তাই কাকা ছানি কাটাতে চান নি। নীপারা আপাতত এখন এখানেই থাকবে। নীপা এখান থেকেই কলেজে পরবে। আমার বন্ধু অনাদি নাকি গ্রাম পঞ্চায়েত হয়েছে। আমাদের বাড়িতে লাইট এসেছে। কিন্তু ভোল্টেজ কম। কেরোসিনের খরচ কিছুটা বেঁচেছে। আরো সব খবরা খবর নিলাম। সবচেয়ে আনন্দ পেলাম এখানে নাকি মোবাইল টাওয়ার বসেছে অনেকের কাছে মোবাইলও আছে।
এই অজ গ্রামে মোবাইল টাওয়ার। ব্যাপারটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে। এই কিছুক্ষণের মধ্যে নীপার সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে ফেললাম। নিজের তাগিদে। এখানে দিন কয়েক যদি থাকতেই হয়, তাহলে আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হবে। এই বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে কত কথা বলবো। বন্ধু-বান্ধব তাদের খুঁজে বার করতেই সময় চলে যাবে। তারপর তারা কে কিরকম অবস্থায় আছে কি জানি। কারুর সঙ্গেই তো পাঁচ বছর কোনো যোগাযোগ নেই। আমি খোঁজ খবর রাখলে তবে তারা খোঁজ খবর রাখবে। আমি রেখেছি কি ?
খাওয়া শেষ হতে আমি আমার বাড়িতে এলাম। নিচটা না ব্যবহারে নোংরা হয়ে আছে। চারিদিক অগোছালো। নিচের ঘর গুলো তালা দেওয়া। আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে এলাম। পরিপাটি করে ঘরটা সাজানো। যেমনটি দেখে গেছিলাম। ঠিক তেমনি। আমার বাবা নাকি এই ঘরটা করেছিলেন তার ছেলের জন্য। নিজেরা বুড়ো-বুড়ি হয়ে নিচে থাকবেন। আর আমি বউ নিয়ে দোতোলার এই ঘরে থাকব। নিজের মনেই নিজে হাসলাম। মনাকাকা সব কিছুই যত্নের সঙ্গে রেখেছেন। আমার কন্ট্রিবিউসন বলতে মাসে মাসে হাজার টাকা। অমিতাভদা প্রত্যেক মাসে আমার মাইনে থেকে হাজার টাকা করে কেটে নিয়ে মানিঅর্ডার করে এখানে পাঠিয়ে দিতেন। বাকিটা বড়মার হাতে। আমি আমার প্রয়োজন মতো বড়মার কাছে নিয়ে নিতাম। এখনো এই অবস্থা বর্তমান।
মোবাইলটা অন করতেই অনেক গুলো মিশ কলের ম্যাসেজ এলো। প্রত্যেকটা নম্বর দেখলাম। এর মধ্যে মিত্রার ফোন আছে। বড়মার আছে। আর ফোন নম্বর গুলো বুঝতে পারলাম না। বড়মাকে ফোন করে শেষ পরিস্থিতি জানালাম। বড়মার গলায় অভিমানের সুর। বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে গেছিস। বড়মাকে সব বোঝালাম। আমাদের এখানের ব্যাপারটা। উনি জানেন আমি গ্রামে থাকি। কিন্তু সেই গ্রামটা যে এত অজ গ্রাম তা তিনি এখন সবিশেষ জানলেন। শেষ কথা, সাবধানে থাকিস।
একটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলো। আসার সময় এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনে এনেছি। তাও জীবনের প্রথম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। বেশ ভাল লাগছে খেতে। দুটো টান দিয়ে পুকুর ধারের জানলাটা খুললাম। বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে পুকুরটা পুরো পুরি দেখা যাচ্ছে। নীপাকে দেখলাম। পুকুর ঘাটে। হাতে মুখে সাবান দিচ্ছে। মেয়েটাকে দেখতে খুব একটা ভাল নয়। একবার দেখলে চোখে পরে যাবে এমন নয়। কিন্তু অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ওকে বেশ ভাল লাগে। ওর মুখে একটা গ্রাম্য সরলতা। গোলগাল শরীরের মধ্যে বার বার বুকটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। আমি জানলার ধার থেকে সরে এলাম। খাটে উপুর হয়ে শুয়ে পূবদিকের জানলায় মুখ রাখলাম। দূরে পালের বাড়ির টংটা দেখা যাচ্ছে। তারপাশের মেঠোরাস্তাটা ধানগাছের আড়ালে ঢাকা পরে গেছে। আমি যেন কোথায় হারিয়ে গালাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। আজ অফিসে একটা জরুরি কাজ আছে। অমিতাভদা বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি আসিস, তোকে একটা জায়গায় পাঠাব। দূর চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আজ নির্ঘাত অমিতাভদার কাছে ঝাড় আছে। মোবাইলটা বার করে বড়মাকে একবার ফোন করলাম। বড়মা ফোন ধরে বলল।
কিরে এত বেলায় ! ঘুমচ্ছিলি নাকি ?
হ্যাঁ রাতে শুতে একটু দেরি হয়ে গেল।
হায় হায়।
কি হয়েছে ?
তোর দাদাতো সেই সাত সকালে চলে গেছে।
কপালে আজ দুঃখ আছে।
তোর নাকি কোথায় যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ।
তোকে ফোন করে নি।
করেছিল হয়তো। আমি তো ফোন বন্ধ করে রাখি।
ভাল করেছিস। তুই যা, আমি ফোন করে দিচ্ছি।
এই জন্যই তো তোমাকে ফোন করা।
সেকি আমি জানিনা।
যা তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিস। আমি দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দেবো।
ঠিক আছে।
যত তাড়াতারি সম্ভব ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম ১১ টা বেজে গেছে। আমার সাড়েনটার মধ্যে অফিসে পৌঁছনর কথা। কি আর করা যাবে। অফিসে ঢুকতেই রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন, আমিও হাসলাম। লিফটের সামনে দাঁড়াতেই আমাদের ফটোগ্রাফার অশোকদা বললেন, এই অনি তোকে অমিতাভদা খুঁজছিলেন। আমি হুঁ বলে লিফটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেলাম। হু হু করে লিফ্ট ওপরে উঠে এলো।
নিউজরুমে ঢুকতেই মল্লিকদা বললেন, কি হে বৎস আজ মনে হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যান আপনার জন্য সমন অপেক্ষা করে আছে। আগে গিয়ে একটু মুখটা দেখিয়ে আসুন। তারপর না হয় মুখে চোখে জল দেবেন।
মল্লিকদা আজ একটু বাঁচিয়ে দাও।
হ তা ঠিক। ফাঁনদে পরলে মল্লিকদা। আর কচিগুলানরে নিয়ে যখন ঘোরা ঘুরি কর। তখন মল্লিকদার কথা মনে পরে না।
আচ্ছা আচ্ছা এরপর তোমায় ভাগ দেবো। তবে ছোটমার পারমিশন নিয়ে।
এই তো আবার ঘুটি বসালি ।
ঠিক আছে ছোটমাকে বলবনা তুমি একটা ফোন করে দাও। আমি এসে গেছি।
মল্লিকদা ফোন থেকে মুখ তুলে বললেন যে কাজে তোমার যাওয়ার কথা ছিল তা হয়ে গেছে। তুমি এখন যেতে পার। আর একটি গুরু দায়িত্ব তোমার প্রতি অর্পন করা হবে। তুমি এখন এডিটর রুমে যেতে পার।
আবার কি গো।
গেলেই জানতে পারবে।
ঠিক আছে।
অমিতাভদা থাকেন ট্রাঙ্গুলার পার্কে আর আমি থাকি গড়িয়াহাটার কাছে অফিসের ফ্ল্যাটে। মল্লিকদা থাকেন যাদবপুরে। আমার প্রত্যেক দিন ডিউটি অফিস থেকে ফেরার পর কিংবা আগে একবার বড়মার সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। নাহলে বিপদ আছে। আমি বিগত ১০ বছর ধরে এই অভ্যাস পালন করে আসছি।
মল্লিকদা মল্লিকদার স্ত্রী প্রায় সময়েই অমিতাভদার বাড়িতেই থাকেন। অমিতাভদার স্ত্রী য়েমন আমার বড়মা ঠিক তেমনি মল্লিকদার স্ত্রী আমার ছোটমা।
ইউনিভার্সিটিতে পড়া চলাকীলীন, এই অফিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর একদিন অমিতাভদার আনুকূল্যে তার বাড়িতে স্থান পাই। তারপর আবার একা। তবে বড়মার কড়া হুকুম। এখনো তাই মনে চলি।
হরিদা অমিতভদার খাস বেয়ারা। গেটের সামনে বসে ঝিমুচ্ছিলেন আমি একটা ঠেলামারতেই চোখ খুলে বললেন কি হল আবার ?
সাহেব ভেতরে।
হ্যাঁ। তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষন ?
কেন!
তোমার আজ পিট্টি হবে।
এই হাউসে আমি হচ্ছি বখাটে সাংবাদিক। কেউ কেউ আবার বলেন এডিটরের কোলের ছেলে। আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার সাংবাদিক থাকা সত্বেও অমিতাভদা আমাকে একটু বেসি ট্রাস্ট করেন। সেই কারণে স্বভাবতই আমার খুঁটির জোর একটু বেশি তাই আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না। সবাই জানে অমিতাভদা মল্লিকদার আমি পেয়ারের লোক। তাদের বাড়িতেই থাকা খাওয়া। তবে আমি আমার দায়িত্ব থেকে ভীষণ ভাবে সচেতন। সেখানে কেউ দাঁত ফোটাতে পারে না। আমার কাছে অফিস মানে আর একটা ঘর।
আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
তোর খুব মজা তাই না ?
হাসি।
যা ভেতরে যা।
দরজা খুলে ভেতরে এলাম। একরাস ঠান্ডা হাওয়া আমায় গ্রাস করে বসলো। দেখলাম একটা চেয়ার দখল করে বসে আছেন আমাদের এ্যাডচিফ চম্পকদা। আর একটিতে চিফরিপোর্টার সুনিতদা। আমাকে ভেতরে আসতে দেখেই বলে উঠলেন, এইতো ছোটসাহেব চলে এসেছেন। কি বাবা ঘুমিয়ে পরেছিলে। এমন ভাবে কথা বললেন আমার মাথা নত হয়ে গেল।
কথাগুল কানে খুব লাগলো। আমার জন্য অমিতাভদাকে এরা এই ভাবে টিজ করে কথা বলে। তবে দাদা কোনোদিন গায়ে মাখেন না। এই হাউসের উনি সবচেয়ে সিনিয়ার ব্যক্তি। সেই কারণে সকলে সম্মান সমীহ দুই করে। যার যা সমস্যা উনি ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে দেন। সুনিতদা আবার একটু বেশি ফট ফট করে। শোনা কতা উনি নাকি খাস ম্যানেজমেন্টের লোক। পলিটিকস এই হাউসে আছে। চূড়ান্ত। তবে কেউ বুঝতে পারে না। এক এক মালিকের এক একটা লবি। আমি সব জানি কিন্তু বোবা। মনে মনে জানি আমার ভগবান দাদা। দাদার চাকরি নট আমারও নট। তবে কলমের জোরে একটা চাকরি কলকাতা শহরে জোগাড় করে নিতে পারবো।
অমিতাভদা এবার ওর একটা বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। অনেক নামডাক হয়েছে। টাকা পয়সাও তো খুব একটা কম পায় না হাউস থেকে। দেখবেন বিয়ের পিঁড়িতে চরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
অমিতাভদা মুচকি হসে বললেন, হ্যাঁ ওর মাকে কয়েকদিন আগে বলছিলাম সেই কথা। তা বাবু বলে এসেছেন বিয়ের নাম ধরলেই ওই বাড়িতে আর পদার্পন করবেন না। উনি সন্ন্যাস নেবেন।
সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
আয় বোস।
আমি একটা চেয়ারে বসলাম।
তোর মা ফোন করেছিল ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছিস, কিছু খাওয়া দাওয়া করেছিস।
না।
সঙ্গে সঙ্গে বেলের দিকে হাত চলে গেলো।
এখন একটু চা আর টোস্ট খেয়ে নে। তারপর কয়েকটা কপি লিখে দিয়ে বাড়ি চলে যা। তোর মাকে বলা আছে। আজ তোকে ভাইজ্যাক যেতে হবে ইলেকসন কভারেজ। দিন পনেরো থাকতে হবে। সেরকম ভাবে গোছগাছ করে নিস। ওখানে তোর সমস্ত ব্যবস্থা করা থাকবে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন।
মাথায় রাখিস। ঘুমিয়ে পরিসনা। চম্পকদা বললেন।
সকলে হেসে উঠল।
ঘুমটা একটু কমা। অতো রাত জেগে পড়াশুনো করতে তোকে কে বলে। যতদিন আমার বাড়িতে ছিলি ঠিক ছিলি। যে দিন থেকে ওই ফ্ল্যাটে গেছিস বিশৃঙ্খল হয়ে গেছিস।
চা টোস্ট খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দাদার ঘড়ের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা বেজে গেছে। মোবাইলটা বেজে উঠল।
তনুর ফোন। কানে ধোরতেই খিল খিল করে হেসে উঠল কি সাহেব, টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
কিসের টিকিট।
ভাইজ্যাকের।
না। ধরাবে।
তুমি কি এখন অফিসে না বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছ।
এই মাত্র অমিতাভদার ঘর থেকে বেরোলাম।
আমি এখন কালীঘাটে আছি। ফ্ল্যাটে গিয়ে একটা মিস কল মেরো তুমিতো আর ফোন করবেনা।
আমার যাবার ব্যাপার তুমি জানলে কি করে।
আরে বাবা তুমি হচ্ছ সুপার বসের পোষ্যপুত্র তোমার প্রতি কতজনের বাঁকা নজর আছে তা জান। হাঁদারাম।
ঠিক আছে।
তনু আমার জীবনের একটা মাইলস্টোন। এই অফিসে আমার প্রথম ঘনিষ্ট বন্ধু। অফিসায়াল এটিকেট ওর কাছ থেকে অনেক শিখেছি। অফিসে কারুর সঙ্গে আমার সবিশেষ সেরকম একটা সম্পর্ক নেই। যে দুচারজনের সঙ্গে আছে, তার মধ্যে তনু একজন।
বড়মাকে ফোন করলাম।
হ্যাঁ বল। সব শুনেছি। তোকে একেবারে খাটিয়ে খাটিয়ে মারলে। দাঁড়া আজ আসুক। দেখাচ্ছি মজা। তোদের অফিসে তুই ছাড়া কি আর কেউ নেই।
তুমি বলো।
তুই কখন আসছিস।
আমি পাঁচটার সময় যাবো অফিসে কিছু কাজ আছে। একটু ফ্ল্যাটে যাব তারপর তোমার কাছে যেতে যেতে ৫টা হবে।
কি খাবি।
তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি গিয়ে তোমার কাছে ভাত খাব।
ঠিক আছে।
নিউজ রুমে আসতেই মল্লিকদা বলল, হল সব কথা ?
হ্যাঁ।
মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচ কেন।
ভাল লাগে বলো। এই দু’দিন আগে ফিরলাম। আজই বলে তোকে যেতে হবে।
হক কথার এক কথা। আমি একটা কথা বলি।
আমি মল্লিকদার মুখের দিকে তাকালাম। নিশ্চই কোন বদ বুদ্ধি আছে।
দুই একটা আর্টিকেল খারাপ কইরা লেইখা দে। বেশ কেল্লা ফতে।
তোমার সব তোলা থাকছে ঠিক জায়গায় নালিশ হবে মনে রেখো।
এই দেখো গরম খাইলি।
কি আছে দাও তাড়াতারি লিখে দিয়ে কেটে পরি।
ঐ মায়াটার লগে.....।
আবার....।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমি এখন আইতে পার।
আমিতাভদা বলল কি কাজ আছে।
ছিল ডিস্ট্রিবিউট হয়ে গেছে।
বাঃ বেশ বেশ।
কবে আসা হচ্ছে।
দিন পনেরোর জন্য যেতে হবে।
ও।
আসি।
যাও বিকেলে দেখা হবে।
ঠিক আছে।
নিউজরুম থেকে বেরোতেই হরিদার সঙ্গে দেখা।
কোথায় যাচ্ছ ?
কেন!
বাবু একবার ডাকছেন।
আবার কি হল ?
আমি কেমন করে জানবো।
এডিটর রুমে ঢুকতেই দেখলাম অমিতাভদা একা একা বসে আমাদের হাউসের আজকের কাগজটা পড়ছেন। আমাকে দেখেই মুখটা তুললেন। একটু আগে যারা ছিল তারা সবাই বেরিয়ে গেছে। আমাকে বললেন তুই বোস তোর সঙ্গে একটু দরকার আছে।
আমি একটু অবাক হলাম। আমার সঙ্গে আবার কিসের গোপন বৈঠক! সরাসরি মুখের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন একটু চা খাবি ?
মুডটা খুব একটা ভাল বুঝলাম না। দাদাকে এরকম দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্ষমতা যদি কোনোদিন পাই যাদের জন্য দাদার আজ এই চাপ তাদের একবার বুঝিয়ে দেবো। তারপর ভাবলাম আমার ধারনা হয়তো ভুলও হতে পারে।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম।
হরিদা দু’কাপ চা দিয়ে গেলো। তোর কোন তাড়াহুরো নেই তো।
তার মানে দাদা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে চান। তাহলেকি তানিয়ার ব্যাপার নিয়ে। মনে মনে ভাবলাম আজ কপালে আমার দুঃখ আছে। দাদা নিশ্চই তানিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভুল ভেবেছে, অথবা দাদাকে কেউ রং ইনফর্মেসন দিয়েছে। কে জানাল ব্যাপারটা ? তানিয়া নিশ্চই নয়। তাহলে! আবার ভাবলাম, গতকাল যে লেখাটা জমা দিলাম সেই লেখার ব্যাপারে কিছু।
চায়ের কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আমাকে বললেন, তুই সংঘমিত্রা ব্যানার্জ্জীকে চিনিস ?
কেউ যেন আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পর কষালো। এই নামটা দাদা জানল কি করে। মিত্রার কথা ছোটমা ছাড়া কারুর জানার কথা নয়। এইসব ব্যাপারে ছোটমা আমার বন্ধু। দাদা বড়মা মল্লিকদার সাথে কোনোদিন এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয় নি। ছোটমাকি তাহলে দাদাকে কোন কথা বলেছে।
আমি অমিতাভদার চোখে চোখ রেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম চিনি। কেনো ?
সেদিন ফোন করে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তখন তুই শিলিগুড়িতে ছিলি। আমাকে তোর ফোন নম্বর জিজ্ঞাসা করলো। আমি বলতে পারলাম না। সত্যি তোর ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল না। তোর বড়মার কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারতাম। দিই নি।
আর কি বললো ?
না আর কিছু নয়। অমিতাভদা কথাটা বলে আমার চোখে চোখ রেখে একটু থেমে গেলেন।
তোর বড়মা জানে ?
না।
ওর সঙ্গে যে তোর পরিচয় আছে আগে তো কখনো বলিস নি।
ও কে! ওর কথা তোমাদের বলতে হবে ?
আরি বাবা বলিস কিরে, ওর জন্যই তো আমরা দুটো খেয়ে পরে বেঁচে আছি ?
তার মানে!
আরে পাগল ও আমাদের এই কাগজ কোম্পানীর অনেকটা শেয়ার হোল্ড করে আছে। আমার মালিক। তোরও মালিক।
মাথাটা বারুদের মতো গরম হয়ে গেলো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি সরাসরি অমিতাভদার চোখে চোখ রাখলাম।
আর কি বলেছে ?
ভরা পুকুরে অনেকক্ষণ স্নান করলাম। শরীরটা জুড়িয়ে গেলো। এর আগের বার যখন এসেছিলাম। ঘন্টা খানেক ছিলাম। তারপর চলে গেছিলাম। তার আগে বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়ে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোতা দিয়ে ফুরুত করে চলে গেলো। শেষবার এসেছিলাম এমএ পরীক্ষার ফিজ নিতে। সেই শেষ আসা। মনে হয়ে শেষ চিঠি লিখেছিলাম। কাগজে চাকরিটা পাওয়ার পর। তারপর কাকা চিঠি দিলেও আমি তার কোন উত্তর দিই নি।
খেতে খেতে একে একে সবার খবর নিলাম। কাকীমা কখনো কাঁদেন কখনো গম্ভীর হয়ে যান। সুরমাসি নীপা বসে বসে সব শুনছে।
কাকার চোখে ছানি পরেছে। তাই চোখে কম দেখেন। বলতে গেলে দেখতেই পান না। এখানে এক ডাক্তার আছে। সে নাকি বলেছে অনেক টাকা লাগবে। তাই কাকা ছানি কাটাতে চান নি। নীপারা আপাতত এখন এখানেই থাকবে। নীপা এখান থেকেই কলেজে পরবে। আমার বন্ধু অনাদি নাকি গ্রাম পঞ্চায়েত হয়েছে। আমাদের বাড়িতে লাইট এসেছে। কিন্তু ভোল্টেজ কম। কেরোসিনের খরচ কিছুটা বেঁচেছে। আরো সব খবরা খবর নিলাম। সবচেয়ে আনন্দ পেলাম এখানে নাকি মোবাইল টাওয়ার বসেছে অনেকের কাছে মোবাইলও আছে।
এই অজ গ্রামে মোবাইল টাওয়ার। ব্যাপারটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে। এই কিছুক্ষণের মধ্যে নীপার সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে ফেললাম। নিজের তাগিদে। এখানে দিন কয়েক যদি থাকতেই হয়, তাহলে আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হবে। এই বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে কত কথা বলবো। বন্ধু-বান্ধব তাদের খুঁজে বার করতেই সময় চলে যাবে। তারপর তারা কে কিরকম অবস্থায় আছে কি জানি। কারুর সঙ্গেই তো পাঁচ বছর কোনো যোগাযোগ নেই। আমি খোঁজ খবর রাখলে তবে তারা খোঁজ খবর রাখবে। আমি রেখেছি কি ?
খাওয়া শেষ হতে আমি আমার বাড়িতে এলাম। নিচটা না ব্যবহারে নোংরা হয়ে আছে। চারিদিক অগোছালো। নিচের ঘর গুলো তালা দেওয়া। আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে এলাম। পরিপাটি করে ঘরটা সাজানো। যেমনটি দেখে গেছিলাম। ঠিক তেমনি। আমার বাবা নাকি এই ঘরটা করেছিলেন তার ছেলের জন্য। নিজেরা বুড়ো-বুড়ি হয়ে নিচে থাকবেন। আর আমি বউ নিয়ে দোতোলার এই ঘরে থাকব। নিজের মনেই নিজে হাসলাম। মনাকাকা সব কিছুই যত্নের সঙ্গে রেখেছেন। আমার কন্ট্রিবিউসন বলতে মাসে মাসে হাজার টাকা। অমিতাভদা প্রত্যেক মাসে আমার মাইনে থেকে হাজার টাকা করে কেটে নিয়ে মানিঅর্ডার করে এখানে পাঠিয়ে দিতেন। বাকিটা বড়মার হাতে। আমি আমার প্রয়োজন মতো বড়মার কাছে নিয়ে নিতাম। এখনো এই অবস্থা বর্তমান।
মোবাইলটা অন করতেই অনেক গুলো মিশ কলের ম্যাসেজ এলো। প্রত্যেকটা নম্বর দেখলাম। এর মধ্যে মিত্রার ফোন আছে। বড়মার আছে। আর ফোন নম্বর গুলো বুঝতে পারলাম না। বড়মাকে ফোন করে শেষ পরিস্থিতি জানালাম। বড়মার গলায় অভিমানের সুর। বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে গেছিস। বড়মাকে সব বোঝালাম। আমাদের এখানের ব্যাপারটা। উনি জানেন আমি গ্রামে থাকি। কিন্তু সেই গ্রামটা যে এত অজ গ্রাম তা তিনি এখন সবিশেষ জানলেন। শেষ কথা, সাবধানে থাকিস।
একটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলো। আসার সময় এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনে এনেছি। তাও জীবনের প্রথম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। বেশ ভাল লাগছে খেতে। দুটো টান দিয়ে পুকুর ধারের জানলাটা খুললাম। বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে পুকুরটা পুরো পুরি দেখা যাচ্ছে। নীপাকে দেখলাম। পুকুর ঘাটে। হাতে মুখে সাবান দিচ্ছে। মেয়েটাকে দেখতে খুব একটা ভাল নয়। একবার দেখলে চোখে পরে যাবে এমন নয়। কিন্তু অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ওকে বেশ ভাল লাগে। ওর মুখে একটা গ্রাম্য সরলতা। গোলগাল শরীরের মধ্যে বার বার বুকটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। আমি জানলার ধার থেকে সরে এলাম। খাটে উপুর হয়ে শুয়ে পূবদিকের জানলায় মুখ রাখলাম। দূরে পালের বাড়ির টংটা দেখা যাচ্ছে। তারপাশের মেঠোরাস্তাটা ধানগাছের আড়ালে ঢাকা পরে গেছে। আমি যেন কোথায় হারিয়ে গালাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। আজ অফিসে একটা জরুরি কাজ আছে। অমিতাভদা বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি আসিস, তোকে একটা জায়গায় পাঠাব। দূর চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আজ নির্ঘাত অমিতাভদার কাছে ঝাড় আছে। মোবাইলটা বার করে বড়মাকে একবার ফোন করলাম। বড়মা ফোন ধরে বলল।
কিরে এত বেলায় ! ঘুমচ্ছিলি নাকি ?
হ্যাঁ রাতে শুতে একটু দেরি হয়ে গেল।
হায় হায়।
কি হয়েছে ?
তোর দাদাতো সেই সাত সকালে চলে গেছে।
কপালে আজ দুঃখ আছে।
তোর নাকি কোথায় যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ।
তোকে ফোন করে নি।
করেছিল হয়তো। আমি তো ফোন বন্ধ করে রাখি।
ভাল করেছিস। তুই যা, আমি ফোন করে দিচ্ছি।
এই জন্যই তো তোমাকে ফোন করা।
সেকি আমি জানিনা।
যা তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিস। আমি দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দেবো।
ঠিক আছে।
যত তাড়াতারি সম্ভব ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম ১১ টা বেজে গেছে। আমার সাড়েনটার মধ্যে অফিসে পৌঁছনর কথা। কি আর করা যাবে। অফিসে ঢুকতেই রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন, আমিও হাসলাম। লিফটের সামনে দাঁড়াতেই আমাদের ফটোগ্রাফার অশোকদা বললেন, এই অনি তোকে অমিতাভদা খুঁজছিলেন। আমি হুঁ বলে লিফটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেলাম। হু হু করে লিফ্ট ওপরে উঠে এলো।
নিউজরুমে ঢুকতেই মল্লিকদা বললেন, কি হে বৎস আজ মনে হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যান আপনার জন্য সমন অপেক্ষা করে আছে। আগে গিয়ে একটু মুখটা দেখিয়ে আসুন। তারপর না হয় মুখে চোখে জল দেবেন।
মল্লিকদা আজ একটু বাঁচিয়ে দাও।
হ তা ঠিক। ফাঁনদে পরলে মল্লিকদা। আর কচিগুলানরে নিয়ে যখন ঘোরা ঘুরি কর। তখন মল্লিকদার কথা মনে পরে না।
আচ্ছা আচ্ছা এরপর তোমায় ভাগ দেবো। তবে ছোটমার পারমিশন নিয়ে।
এই তো আবার ঘুটি বসালি ।
ঠিক আছে ছোটমাকে বলবনা তুমি একটা ফোন করে দাও। আমি এসে গেছি।
মল্লিকদা ফোন থেকে মুখ তুলে বললেন যে কাজে তোমার যাওয়ার কথা ছিল তা হয়ে গেছে। তুমি এখন যেতে পার। আর একটি গুরু দায়িত্ব তোমার প্রতি অর্পন করা হবে। তুমি এখন এডিটর রুমে যেতে পার।
আবার কি গো।
গেলেই জানতে পারবে।
ঠিক আছে।
অমিতাভদা থাকেন ট্রাঙ্গুলার পার্কে আর আমি থাকি গড়িয়াহাটার কাছে অফিসের ফ্ল্যাটে। মল্লিকদা থাকেন যাদবপুরে। আমার প্রত্যেক দিন ডিউটি অফিস থেকে ফেরার পর কিংবা আগে একবার বড়মার সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। নাহলে বিপদ আছে। আমি বিগত ১০ বছর ধরে এই অভ্যাস পালন করে আসছি।
মল্লিকদা মল্লিকদার স্ত্রী প্রায় সময়েই অমিতাভদার বাড়িতেই থাকেন। অমিতাভদার স্ত্রী য়েমন আমার বড়মা ঠিক তেমনি মল্লিকদার স্ত্রী আমার ছোটমা।
ইউনিভার্সিটিতে পড়া চলাকীলীন, এই অফিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর একদিন অমিতাভদার আনুকূল্যে তার বাড়িতে স্থান পাই। তারপর আবার একা। তবে বড়মার কড়া হুকুম। এখনো তাই মনে চলি।
হরিদা অমিতভদার খাস বেয়ারা। গেটের সামনে বসে ঝিমুচ্ছিলেন আমি একটা ঠেলামারতেই চোখ খুলে বললেন কি হল আবার ?
সাহেব ভেতরে।
হ্যাঁ। তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষন ?
কেন!
তোমার আজ পিট্টি হবে।
এই হাউসে আমি হচ্ছি বখাটে সাংবাদিক। কেউ কেউ আবার বলেন এডিটরের কোলের ছেলে। আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার সাংবাদিক থাকা সত্বেও অমিতাভদা আমাকে একটু বেসি ট্রাস্ট করেন। সেই কারণে স্বভাবতই আমার খুঁটির জোর একটু বেশি তাই আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না। সবাই জানে অমিতাভদা মল্লিকদার আমি পেয়ারের লোক। তাদের বাড়িতেই থাকা খাওয়া। তবে আমি আমার দায়িত্ব থেকে ভীষণ ভাবে সচেতন। সেখানে কেউ দাঁত ফোটাতে পারে না। আমার কাছে অফিস মানে আর একটা ঘর।
আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
তোর খুব মজা তাই না ?
হাসি।
যা ভেতরে যা।
দরজা খুলে ভেতরে এলাম। একরাস ঠান্ডা হাওয়া আমায় গ্রাস করে বসলো। দেখলাম একটা চেয়ার দখল করে বসে আছেন আমাদের এ্যাডচিফ চম্পকদা। আর একটিতে চিফরিপোর্টার সুনিতদা। আমাকে ভেতরে আসতে দেখেই বলে উঠলেন, এইতো ছোটসাহেব চলে এসেছেন। কি বাবা ঘুমিয়ে পরেছিলে। এমন ভাবে কথা বললেন আমার মাথা নত হয়ে গেল।
কথাগুল কানে খুব লাগলো। আমার জন্য অমিতাভদাকে এরা এই ভাবে টিজ করে কথা বলে। তবে দাদা কোনোদিন গায়ে মাখেন না। এই হাউসের উনি সবচেয়ে সিনিয়ার ব্যক্তি। সেই কারণে সকলে সম্মান সমীহ দুই করে। যার যা সমস্যা উনি ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে দেন। সুনিতদা আবার একটু বেশি ফট ফট করে। শোনা কতা উনি নাকি খাস ম্যানেজমেন্টের লোক। পলিটিকস এই হাউসে আছে। চূড়ান্ত। তবে কেউ বুঝতে পারে না। এক এক মালিকের এক একটা লবি। আমি সব জানি কিন্তু বোবা। মনে মনে জানি আমার ভগবান দাদা। দাদার চাকরি নট আমারও নট। তবে কলমের জোরে একটা চাকরি কলকাতা শহরে জোগাড় করে নিতে পারবো।
অমিতাভদা এবার ওর একটা বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। অনেক নামডাক হয়েছে। টাকা পয়সাও তো খুব একটা কম পায় না হাউস থেকে। দেখবেন বিয়ের পিঁড়িতে চরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
অমিতাভদা মুচকি হসে বললেন, হ্যাঁ ওর মাকে কয়েকদিন আগে বলছিলাম সেই কথা। তা বাবু বলে এসেছেন বিয়ের নাম ধরলেই ওই বাড়িতে আর পদার্পন করবেন না। উনি সন্ন্যাস নেবেন।
সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
আয় বোস।
আমি একটা চেয়ারে বসলাম।
তোর মা ফোন করেছিল ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছিস, কিছু খাওয়া দাওয়া করেছিস।
না।
সঙ্গে সঙ্গে বেলের দিকে হাত চলে গেলো।
এখন একটু চা আর টোস্ট খেয়ে নে। তারপর কয়েকটা কপি লিখে দিয়ে বাড়ি চলে যা। তোর মাকে বলা আছে। আজ তোকে ভাইজ্যাক যেতে হবে ইলেকসন কভারেজ। দিন পনেরো থাকতে হবে। সেরকম ভাবে গোছগাছ করে নিস। ওখানে তোর সমস্ত ব্যবস্থা করা থাকবে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন।
মাথায় রাখিস। ঘুমিয়ে পরিসনা। চম্পকদা বললেন।
সকলে হেসে উঠল।
ঘুমটা একটু কমা। অতো রাত জেগে পড়াশুনো করতে তোকে কে বলে। যতদিন আমার বাড়িতে ছিলি ঠিক ছিলি। যে দিন থেকে ওই ফ্ল্যাটে গেছিস বিশৃঙ্খল হয়ে গেছিস।
চা টোস্ট খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দাদার ঘড়ের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা বেজে গেছে। মোবাইলটা বেজে উঠল।
তনুর ফোন। কানে ধোরতেই খিল খিল করে হেসে উঠল কি সাহেব, টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
কিসের টিকিট।
ভাইজ্যাকের।
না। ধরাবে।
তুমি কি এখন অফিসে না বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছ।
এই মাত্র অমিতাভদার ঘর থেকে বেরোলাম।
আমি এখন কালীঘাটে আছি। ফ্ল্যাটে গিয়ে একটা মিস কল মেরো তুমিতো আর ফোন করবেনা।
আমার যাবার ব্যাপার তুমি জানলে কি করে।
আরে বাবা তুমি হচ্ছ সুপার বসের পোষ্যপুত্র তোমার প্রতি কতজনের বাঁকা নজর আছে তা জান। হাঁদারাম।
ঠিক আছে।
তনু আমার জীবনের একটা মাইলস্টোন। এই অফিসে আমার প্রথম ঘনিষ্ট বন্ধু। অফিসায়াল এটিকেট ওর কাছ থেকে অনেক শিখেছি। অফিসে কারুর সঙ্গে আমার সবিশেষ সেরকম একটা সম্পর্ক নেই। যে দুচারজনের সঙ্গে আছে, তার মধ্যে তনু একজন।
বড়মাকে ফোন করলাম।
হ্যাঁ বল। সব শুনেছি। তোকে একেবারে খাটিয়ে খাটিয়ে মারলে। দাঁড়া আজ আসুক। দেখাচ্ছি মজা। তোদের অফিসে তুই ছাড়া কি আর কেউ নেই।
তুমি বলো।
তুই কখন আসছিস।
আমি পাঁচটার সময় যাবো অফিসে কিছু কাজ আছে। একটু ফ্ল্যাটে যাব তারপর তোমার কাছে যেতে যেতে ৫টা হবে।
কি খাবি।
তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি গিয়ে তোমার কাছে ভাত খাব।
ঠিক আছে।
নিউজ রুমে আসতেই মল্লিকদা বলল, হল সব কথা ?
হ্যাঁ।
মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচ কেন।
ভাল লাগে বলো। এই দু’দিন আগে ফিরলাম। আজই বলে তোকে যেতে হবে।
হক কথার এক কথা। আমি একটা কথা বলি।
আমি মল্লিকদার মুখের দিকে তাকালাম। নিশ্চই কোন বদ বুদ্ধি আছে।
দুই একটা আর্টিকেল খারাপ কইরা লেইখা দে। বেশ কেল্লা ফতে।
তোমার সব তোলা থাকছে ঠিক জায়গায় নালিশ হবে মনে রেখো।
এই দেখো গরম খাইলি।
কি আছে দাও তাড়াতারি লিখে দিয়ে কেটে পরি।
ঐ মায়াটার লগে.....।
আবার....।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমি এখন আইতে পার।
আমিতাভদা বলল কি কাজ আছে।
ছিল ডিস্ট্রিবিউট হয়ে গেছে।
বাঃ বেশ বেশ।
কবে আসা হচ্ছে।
দিন পনেরোর জন্য যেতে হবে।
ও।
আসি।
যাও বিকেলে দেখা হবে।
ঠিক আছে।
নিউজরুম থেকে বেরোতেই হরিদার সঙ্গে দেখা।
কোথায় যাচ্ছ ?
কেন!
বাবু একবার ডাকছেন।
আবার কি হল ?
আমি কেমন করে জানবো।
এডিটর রুমে ঢুকতেই দেখলাম অমিতাভদা একা একা বসে আমাদের হাউসের আজকের কাগজটা পড়ছেন। আমাকে দেখেই মুখটা তুললেন। একটু আগে যারা ছিল তারা সবাই বেরিয়ে গেছে। আমাকে বললেন তুই বোস তোর সঙ্গে একটু দরকার আছে।
আমি একটু অবাক হলাম। আমার সঙ্গে আবার কিসের গোপন বৈঠক! সরাসরি মুখের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন একটু চা খাবি ?
মুডটা খুব একটা ভাল বুঝলাম না। দাদাকে এরকম দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্ষমতা যদি কোনোদিন পাই যাদের জন্য দাদার আজ এই চাপ তাদের একবার বুঝিয়ে দেবো। তারপর ভাবলাম আমার ধারনা হয়তো ভুলও হতে পারে।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম।
হরিদা দু’কাপ চা দিয়ে গেলো। তোর কোন তাড়াহুরো নেই তো।
তার মানে দাদা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে চান। তাহলেকি তানিয়ার ব্যাপার নিয়ে। মনে মনে ভাবলাম আজ কপালে আমার দুঃখ আছে। দাদা নিশ্চই তানিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভুল ভেবেছে, অথবা দাদাকে কেউ রং ইনফর্মেসন দিয়েছে। কে জানাল ব্যাপারটা ? তানিয়া নিশ্চই নয়। তাহলে! আবার ভাবলাম, গতকাল যে লেখাটা জমা দিলাম সেই লেখার ব্যাপারে কিছু।
চায়ের কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আমাকে বললেন, তুই সংঘমিত্রা ব্যানার্জ্জীকে চিনিস ?
কেউ যেন আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পর কষালো। এই নামটা দাদা জানল কি করে। মিত্রার কথা ছোটমা ছাড়া কারুর জানার কথা নয়। এইসব ব্যাপারে ছোটমা আমার বন্ধু। দাদা বড়মা মল্লিকদার সাথে কোনোদিন এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয় নি। ছোটমাকি তাহলে দাদাকে কোন কথা বলেছে।
আমি অমিতাভদার চোখে চোখ রেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম চিনি। কেনো ?
সেদিন ফোন করে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তখন তুই শিলিগুড়িতে ছিলি। আমাকে তোর ফোন নম্বর জিজ্ঞাসা করলো। আমি বলতে পারলাম না। সত্যি তোর ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল না। তোর বড়মার কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারতাম। দিই নি।
আর কি বললো ?
না আর কিছু নয়। অমিতাভদা কথাটা বলে আমার চোখে চোখ রেখে একটু থেমে গেলেন।
তোর বড়মা জানে ?
না।
ওর সঙ্গে যে তোর পরিচয় আছে আগে তো কখনো বলিস নি।
ও কে! ওর কথা তোমাদের বলতে হবে ?
আরি বাবা বলিস কিরে, ওর জন্যই তো আমরা দুটো খেয়ে পরে বেঁচে আছি ?
তার মানে!
আরে পাগল ও আমাদের এই কাগজ কোম্পানীর অনেকটা শেয়ার হোল্ড করে আছে। আমার মালিক। তোরও মালিক।
মাথাটা বারুদের মতো গরম হয়ে গেলো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি সরাসরি অমিতাভদার চোখে চোখ রাখলাম।
আর কি বলেছে ?