Thread Rating:
  • 9 Vote(s) - 2.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান)
#46
Photo 
পর্ব-৩০

  

মৌসুম পাল্টাতে দেরি লাগে না। সময়ের স্রোতে এক ঋতুর বিদায় হতে না হতেই আরেক ঋতুর আগমন হয়। হেমন্তের পরে শীত চলে এলো। বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ মাস। গাছের আদ্র পাতা থেকে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ শিশিরের শব্দ অবচেতনে মন জুড়ায়। চারপাশটা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় জড়ানো। তার সাথে হিম লাগানো অনুভূতি তো আছেই। সকালের নরম রোদ গায়ে লাগিয়ে চুমকি, ধারা, শুদ্ধ বসে আছে উঠোনের রান্নাঘরের সামনে। মাটির তপ্ত আগুনের চুলোয় চালের গুঁড়ো, নারকেল আর খেজুর গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে খোদেজা। একটার পর একটা ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা তুলে দিচ্ছে একেকজনের পাতে। ধারা এতক্ষণ খোদেজাকে সব সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছিল। খোদেজার কথায় এখন সবার সাথে সেও খেতে বসেছে। শীতের সকালে চুলোর পাশে সদ্য জেগে উঠা রোদের মধ্যে বসে বসে গরম গরম পিঠা খেতে ভালোই লাগছে। চুমকি সাধারণত এতো সকালে উঠে না। আর যদি তা হয় শীতের সকাল তাহলে তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আজ পিঠার নাম শুনতে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছে। একটার পর একটা পিঠা গোগ্রাসে গিলে চলেছে সে। শুদ্ধ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল,
'আস্তে আস্তে খা চুমকি। তোর পিঠা পালিয়ে যাচ্ছে না। একবার গলায় আটকালে তখন বুঝবি!'
শুদ্ধ'র কথায় চুমকি ফিচেল করে হাসে। শুদ্ধ পিঠা খেতে খেতে হঠাৎ ঘরের দিকে তাকিয়ে খোদেজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
'আম্মা, ঘরের তো দেখি বেহাল অবস্থা! এদিক ওদিকে খুলে পড়ছে।'
খোদেজা বলল, 'তাইলে আমি তোরে কি কই! ঘরের অবস্থা পুরাই খারাপ হইয়া যাইতাছে। আর কতদিনই বা ভালো থাকবো! সেই আমার শ্বশুর আমলের বাড়ি। এতদিন যে টিকছে তাই বেশি। ঘরের এখনই কিছু একটা করা দরকার। নইলে কবে জানি ঘর মাথার উপর ভাইঙ্গা পড়বো।'

'ঘর ঠিক করতে হলে তো একেবারে পুরো ভেঙে নতুন করে গাঁথুনি দিয়েই বানাতে হবে। যেই পুরনো ঘর! এর উপর দিয়ে নতুন কোন কাজ করলেও টিকবে না। এখন এই সময় নতুন করে ঘর উঠাতে হলেও তো একটা বড় বাজেট থাকতে হবে। কিভাবে কি করি! আচ্ছা ঠিকাছে, আমি দেখবো নে কি করা যায়।'

শুদ্ধ সবে একটা পিঠা খেয়েছে। চুলো থেকে সদ্য নামানো আরেকটা ভাপা পিঠা খোদেজা শুদ্ধ'র বাটিতে দিতে চাইলেই শুদ্ধ মানা করে উঠে। বলে,
'আম্মা আর দিয়ো না। আমার সময় নেই। এখন খেতে পারবো না। ক্ষেতে যেতে হবে।'

খোদেজা খানিক বিরক্ত হয়। শুদ্ধ'র বারণ না শুনে পিঠাটা তার বাটিতে রেখে বলে,
'চুপচাপ খা তো! একটা পিঠায় কি হয়? এই সাত সকালে তোর ক্ষেতে যাবার কারণডা কি শুনি!'

শুদ্ধ দ্রুত পিঠা মুখে নিতে নিতে বলে,
'কি বল আম্মা! কত কাজ এখন! নতুন বোরো ধান লাগিয়েছি। সেগুলো দেখতে হবে না!'

শুদ্ধ পিঠা অর্ধেক খেয়ে রেখে ভেতরে তৈরি হতে চলে যায়। শুদ্ধ চলে গেলে খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
'দেখছো বউ মাহতাবের কান্ড কারখানা? কি দরকার এইসব কাজ ও'র করার? খায়া না খায়া এগুলার পেছনে পইরা রইছে। এতো কষ্ট কইরা পড়ালেখা করলি কই একটা ভালো দেইখা চাকরি কর। আরামে থাক। তা না এই কাজ নিয়া লাইগা আছে। তাও নইলে বুঝলাম করছোস যখন ফলের খামারই খালি করতি, এই ধান টান লাগানির কি দরকার ছিলো? কতো পরিশ্রমের কাজ! আমরা তো চাল কিননাই খাই। তবুও এগুলা করা কি প্রয়োজন বলো তো! তুমিও তো কিছু বলতে পারো বউ।'

খোদেজা যে শুদ্ধ'র জন্য খুব বেশি চিন্তা করে তা ধারা বোঝে। কিন্তু ধারা এটাও বোঝে, শুদ্ধ'র নিজস্ব একটা ভাবনা আছে৷ বিস্তৃত একটা পরিকল্পনা আছে৷ নিগূঢ় কিছু চিন্তা আছে৷ যার অনেককিছুই হয়তো ধারা বোঝে না। কিন্তু ধারা এটা জানে, এই ধান শুদ্ধ'র জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ধান নিয়ে তার বিশেষ গুরুতর একটা পরিকল্পনা আছে। তাই খোদেজার কথায় স্মিত হেসে ধারা বলল,
'যে যেটা করে শান্তি পায় তাকে সেটা আমরা করতে দেই মা। ফলের বাগানটা তো আছেই। আপনার ছেলে সংসার তো ভালো মতোই চালাচ্ছে। যদি না পারতো তাহলে না হয় আমরা বলতে পারতাম। এখন যখন সব ঠিকঠাক মতোই চলছে তখন সে করুক যা সে করতে চায়। আপনার ছেলেকে তো আমরা চিনিই মা৷ সে ভুল কিছু কখনো করবে না। যাই করবে সফল হবেই।'

ধারার শেষের কথায় খোদেজা একটু আশস্ত হয়। ধারা পাশে তাকিয়ে দেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ তার মুখের মিষ্টি হাসিই বলে দিচ্ছে এতক্ষণ ধারার সব কথাই শুনেছে সে। ধারাও মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে শুদ্ধকে আশস্ত করে। ভরসা পেয়ে শুদ্ধ নিজের কাজে যাবার জন্য পা বাড়ায়।

শুদ্ধ যাওয়ার একটু পরই পাশের বাড়ি থেকে আবুলের মা হন্তদন্ত হয়ে খোদেজাকে ডাকতে আসে। খোদেজার তখন পিঠা বানানো প্রায় শেষের দিকেই। আবুলের মায়ের তোতলানো কথা আর দূর থেকে গরুর গগনবিদারী চিৎকার থেকে খোদেজা বুঝতে পারে আবুলদের গাভির বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। বাড়িতে আর কেউ নেই। আবুলের মা একা একা ঘাবড়াচ্ছে বলেই দ্রুত খোদেজাকে ডাকতে এসেছে। খোদেজা তড়িঘড়ি করে আবুলের মায়ের সাথে গেলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাদের। আবুলদের গোয়াল ঘরে গিয়ে ধারা দেখলো তাদের লাল গাভিটি মোটা পেট নিয়ে অস্থির হয়ে ছটফট করছে আর একটু পর পর গলা চরিয়ে ডেকে উঠছে। খোদেজা আর আবুলের মা কিছু ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ধারা স্তম্ভের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপলক দৃষ্টিতে গাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাভির অস্থিরতা ধারার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে এক ধরণের কম্পন সৃষ্টি করে। গাভির বাচ্চা প্রসবের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি ধারা দেখলো।  
ধারার জীবনে এই প্রথম। এর আগে সে আর কখনো দেখেনি। তাই বলেই হয়তো এতো অদ্ভুত অনুভুতি তার হচ্ছে। খোদেজা আর আবুলের মায়ের কাছে এটা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবার ছোট বাছুরটির দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসিও ফুটে উঠলো। দেখলো একটুপরই মা গাভিটি ক্লান্ত শরীর নিয়ে সদ্য জন্মানো বাচ্চাটির শরীর জিভ দিয়ে চেটে আদর করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি ধারার মনে অদ্ভুত সুখানুভূতির সৃষ্টি করলো। সে আস্তে করে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো। সোফায় বসে শুদ্ধকে ফোন লাগালো। ফোন অনেকক্ষণ বাজার পরও ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ধারা আর ফোন দিলো না। রেখে দিলো। নিশ্চয়ই শুদ্ধ ফোন টং ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে বাইরে কাজ করছে। নয়তো ধারার কল দেখলে ঠিকই ধরতো। শুদ্ধ আজকাল সত্যিই বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিনটায় আর দেখাই পাওয়া যায় না। ধারা ভীষণ মিস করে তাকে। ফোনে শুদ্ধ'র একটা ছবি বের করে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এতো ব্যস্ততার পরও কি শুদ্ধ তার খেয়াল রাখছে না? রাখছে। আরও বেশি রাখছে। যেখানে নিজের জন্য একমুহুর্ত দম ফেলবারও সময় পাচ্ছে না সেখানে ধারার পড়ালেখা, প্রয়োজনীয়তা, সবকিছুর খুব বেশি করেই খেয়াল রাখে শুদ্ধ। ধারাকে নানা জিনিস শেখায়। নানা বই পড়ায়, নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করায়। জীবনে সফল হতে কি প্রয়োজন না প্রয়োজন সব খুঁটিনাটির বিষয়ে বিজ্ঞ করে তুলে ধারাকে। এই তো কয়েকমাস আগেই ধারাকে একটা ইংলিশ স্পোকেন কোর্সে ভর্তি করিয়ে ইংরেজি বলায় তুখোড় করেছে ধারাকে। ইংরেজি ভালো মতো বুঝতে না পারা ধারাই এখন কতো দ্রুত স্মুথলি ইংরেজি বলতে পারে। তার উপর ধারার চর্চায় আরো দক্ষ করতে সেসময় টায় কিভাবে শুদ্ধ তার সাথে রোজ নিয়ম করে পুরো এক ঘন্টা ইংরেজিতে কথা বলতো তা মনে করে ধারা এক দমক হাসে। শুদ্ধ'র সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তই ধারার কাছে তার জীবনের শুদ্ধতম মুহুর্ত বলে অনুভূত হয়।
__________________________________________

সন্ধ্যের পর ধারা সোফায় বসে বসে শুদ্ধ'র ল্যাপটপে একটা রোমান্টিক মুভি দেখছিলো। সেসময় শুদ্ধ এলো রুমে। শুদ্ধকে দেখে আনন্দিত হয়ে ধারা যখনই বিগলিত হয়ে তার সাথে বসে শুদ্ধকে মুভি দেখার অফার করতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ বলে উঠলো,
'এটা কি ধারা? সন্ধ্যে হয়ে গেছে তুমি এখনও পড়তে বসোনি!'
ধারা শুদ্ধ'র কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, 
'একটুপরই বসবো। দাঁড়াও। খুব সুন্দর একটা মুভি দেখছি। এতো রোমান্টিক! আসো তুমিও দেখো। তোমারও ভালো লাগবে।'
ধারা উৎফুল্ল হয়ে আবারো ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধ ল্যাপটপ নামিয়ে দিয়ে বলল,
'না। এখন না। এখন পড়তে বসো ধারা।'
ধারা শুনলো না। আবারো ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো। শুদ্ধ এবার ধারার কোল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে বলল,
'আমিও আজকাল ব্যস্ত থাকি। আর তোমার পড়ারও কোন খেয়াল রাখতে পারি না। আর তুমিও একদমই সিরিয়াস থাকো না ধারা। কয়দিন পর না তোমার ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। কতটুকু প্রিপারেশন হয়েছে? দেখি।'
ধারা দেখাতে পারলো না। সত্যি বলতে কিছুদিন যাবৎ তার পড়া তেমন হয়নি। শুদ্ধ বুঝতে পেরে বলল,
'জানি, কিছুই হয়নি। হবেই বা কিভাবে! সারাদিন বসে বসে রোমান্টিক মুভি দেখো। আগে একটা রোমান্টিক মুভির নামও জানতে না। আর এখন রোমান্টিক মুভি ছাড়া আর কিছুই বোঝো না। পড়ালেখার আর কোন খবর নেই। বই নিয়ে আসো। তোমার প্রিপারেশন আজকে অর্ধেক করিয়ে দেবো।'

গালে হাত রেখে ধারা অলস ভঙ্গিতে বসে রইলো। এই মুহুর্তে পড়তে বসতে তার একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না বসেও উপায় নেই। শুদ্ধ যখন পড়ার নাম নিয়েছে তখন না পড়িয়ে ছাড়বে! শুদ্ধ আবারও তাগাদা দিলো ধারাকে। অনিচ্ছা নিয়েই ধারাকে উঠতে হলো। এক গাঁদা বই নিয়ে বসতে হলো শুদ্ধ'র সামনে। শুদ্ধ একটা একটা করে বই নিয়ে দেখতে লাগলো। কিছু অনুশীলন বের করে পড়তে বলল ধারাকে। তারপর আবার আরেকটা বই নিয়ে দেখতে লাগলো। এদিকে ধারার একেবারেই পড়ার মুড নেই। তার ইচ্ছে করছে শুদ্ধকে নিয়ে ঐ মুভিটা এখন সম্পূর্ণ দেখতে অথবা শুদ্ধ'র সাথে একান্তে কিছু গল্প করতে, সময় কাটাতে। আর ইচ্ছে করবেই বা না কেন! সারাদিন পর দেখা পেলো মানুষটার। কিন্তু না! মহাশয়ের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো বেশ একটা স্যার স্যার ভাব নিয়ে বসেছে ধারাকে পড়াতে। কিছুক্ষণ পড়ার পরই ধারা গড়িমসি করতে লাগলো। আর চাইলো না পড়তে। পৃথিবীর যাবতীয় ইনোসেন্ট ভাব মুখে এনে বলল,
'আজকে না হয় এতটুকুই থাক। কালকে থেকে পড়ি? কাল থেকে সত্যিই পড়বো৷ প্রমিজ!'
শুদ্ধ বলল, 'না। এখন মানে এখনই। তোমার পড়ায় এমনিতেই অনেক ঢিলামি এসে পড়েছে। আমারই দোষ। আমিই খেয়াল করিনি। আজকে অনেকক্ষণ পড়াবো।'
ধারা বিরক্তি ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আবারো একটু বই পড়ার পরই মুখ তুলে উৎফুল্ল হয়ে বলল, 'জানো? আজকে আবুল ভাইদের গাভির একটা বাছুর হয়েছে। দেখতে কি কিউট!'

শুদ্ধ ধারার বইয়ের দিকে চোখ রেখেই আস্তে করে বলল, 'ভালো।'
'আমার না এতো ভালো লেগেছে! গাভিটাকেও খুব খুশি লাগছিল। বাছুরটা খুবই সুন্দর হয়েছে দেখতে। জানো, আমি না আজকে একটা কথা ভেবেছি।'
'কি?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে খানিক এগিয়ে একটু আহ্লাদি স্বরে বলল, 'আমাদেরও যদি এমন একটা ছোট্ট কিউট বাবু হয় তাহলে কতো সুন্দর হবে তাই না!'
'হুম।'
ধারা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'তাই না! আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আমরাও খুব শীঘ্রই একটা বাবু নেবো।'
শুদ্ধ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
'আমি শীঘ্রইয়ের কথা কখন বললাম? আমাদেরও বাবু হবে। কিন্তু এখন না। এখন হলে তোমার পড়ালেখার অনেক ডিস্টার্ব হবে। তাই আগে তোমার পড়ালেখা সম্পূর্ণ শেষ হবে তারপর।'

ধারা পুরো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কি বলে কি শুদ্ধ! পড়ালেখা শেষ হবার পর মানে? ধারা আঙ্গুল দিয়ে গুনতে লাগলো অনার্সের পর মাস্টার্স আর সাথে অল্প স্বল্প সেশনজট মেলালে পড়ালেখা শেষ হতে লাগবে আরো ছয় বছর। তার মানে আরো ছয় বছর পর! ধারা উদ্গ্রীব হয়ে দ্রুত বলে উঠে, 'ছয় বছর পর কতো দেরি হয়ে যাবে জানো...

ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। পড়তে বসার পর পড়া নিয়েই থাকতে হবে। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।'

ধারা আবারো খানিক পড়ার চেষ্টা করে। আবারো প্রচুর বোরিং ফিল হয়। সে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে ধারার বই দাগিয়ে যাচ্ছে। কতো সুন্দর লাগছে তাকে। কাঁচা হলুদ রঙের শার্ট, খানিক এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ধারা খানিক শুদ্ধ'র কাছে ঘেঁষে বসে৷ দু হাত দিয়ে শুদ্ধ'র গলা পেঁচিয়ে ধরে। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ধারাকে ইশারা করে। ধারা মুচকি হেসে বলে,
'এখন আমি আর পড়বো না। এখন আমি শুধু তোমাকে দেখবো। সারাদিন ধরে দেখিনি। আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না।'

শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'এতো রোমান্টিক কথাবার্তা বলে লাভ নেই। পড়ার থেকে আজকে তুমি রেহাই পাচ্ছো না ম্যাডাম। যথেষ্ঠ ফাঁকিবাজি করে ফেলেছো। যা যা দাগিয়ে দিয়েছি আজ সব পড়বে। তারপরই উঠতে পারবে।'

ধারার মুখ ফুলে গেলো। সে দ্রুত সোজা হয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে আমিও পড়বো না। আমিও দেখি তুমি জোর করে আমাকে কিভাবে পড়াও।'

'তুমি পড়বে না?'

'না, পড়বো না।'

'সত্যিই তো?'

ধারা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একটা তীর্যক হাসি দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ সত্যি। আর তুমিই এখন নিজেই আমাকে বলবে যে, ধারা থাক! আর পড়া লাগবে না। দেখতে চাও?'

এই বলে ধারা ও'র মাথার চুলগুলো খুলে দিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে দু হাত রেখে ও'র কাছে যেতে লাগলো। শুদ্ধ খানিক ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল,
'ধারা, ভালো হবে না কিন্তু! পড়তে বসো।'
ধারা শুনলো না। মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হঠাৎ শুদ্ধ ধারার পায়ে স্কেল দিয়ে আস্তে করে একটা বারি দিলো। ধারা বিস্ফোরিত গলায় বলল,
'তুমি আমাকে মারলে?'
শুদ্ধ ও'র শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
'পড়তে বসে বাঁদরামি করলে তো মারবোই। পড়ো! রাত এগারোটার আগে তুমি উঠতে পারবে না।'

ধারা মুখ ফুলিয়ে বসে বলল,
'পড়বো না। পড়বো না। পড়বো না।'

শুদ্ধ স্কেল দিয়ে পুনরায় আরেকটা বারি দিলো। ধারা আবারো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে শেষমেশ রাগে জেদে একদম রাত এগারোটা পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়েই ঘুমানোর জন্য ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে ধারার বইগুলো গুছিয়ে রেখে ঝটপট বিছানায় শুয়ে ধারাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ধারা যে আজ ভীষণ ক্ষ্যাপা ক্ষেপেছে! এই রাগ ভাঙানো সহজ নয়। শুদ্ধ ধরতেই ধারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ ছাড়লো না। ধারা চেষ্টা সচল রেখে বলল, 'এখন আমাকে ধরেছো কেন? ছাড়ো! পড়ানো তো শেষ। এখন কি? আর আসবা না আমার কাছে।'

শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, 'ইশ! বললেই হলো! এতক্ষণ যে কষ্ট করে পড়ালাম এখন তার পারিশ্রমিক নিতে এসেছি। আমি কোন মাগনা কাজ করি না।'

ধারা শুদ্ধ'র হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় থেকে বলল,
'আমি বলছিলাম আমাকে পড়াতে? পড়াইছো কেন? আমি কোন পারিশ্রমিক দিবো না।'

'আমি তো নিবোই।'

এই বলে শুদ্ধ ধারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

শেষ রাতের দিকে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে দ্রুত উঠে বসলো শুদ্ধ। যা মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই দিনে তো বৃষ্টি নামার কথা না! ক্ষেতে এই সবেই নতুন বোরো ধান লাগানো হয়েছে। অ-দিনের এই বৃষ্টি যে কতো মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা ভাবনার বাহিরে নয়। শুদ্ধ'র মুখ শুকিয়ে গেলো। তখনই সে ছাতা মাথায় দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। ধারা শুদ্ধ'র বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ'র শুকিয়ে যাওয়া মুখটা বারবার আঘাত হানতে লাগলো তার বুকে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিলে ধারা জায়নামাজ নিয়ে তৎক্ষনাৎ নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply


Messages In This Thread
RE: হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান) (পর্ব -৩০) - by Bangla Golpo - 08-08-2024, 11:52 PM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)