22-06-2019, 10:07 PM
কাজলদীঘি, শ্মশান ও পীরসাহেবের থান
লেখকঃ মামুন জাফরান ( অনুমতি না নিয়েই পোস্ট করলাম। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থী।)
পাঁচ বছর পর আমার নিজের বাসভূমিতে পা রাখলাম। এতদিন নিজভূমে পরবাসে ছিলাম। দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে জানি না। বাস থেকে চকে নামলাম। চকের নাম বড়চাড়া। গ্রাম্য ভাষায় বাস স্ট্যান্ডকে চক বলে। লাল ধূলো উড়িয়ে মোরাম রাস্তা দিয়ে বাসটা গর্জন করতে করতে চলে গেলো। গায়ে মাথায় লালাধূলোর পরশ। বাস থেকে নামতে সবাই কেমন উত্সুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ গাঁয়ের বাসস্টেন্ডে খুব একটা বেশি লোক নামে না। সারাদিনে তিনটে বাস। জনা তিনেক নামলে অনেক বেশি। আমার সঙ্গে আরও দুজন নামল। নেমেই তারা হন হন করে হাঁটতে আরম্ভ করলো মাঠের মোরাম রাস্তা ধরে। এখান থেকে আমায় দশ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। এই রাস্তাটুকু হাঁটতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। একটা সময় সাইকেল নিয়ে এসব রাস্তায় কত ঘোরা ঘুরি করেছি। আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে।
সূর্য এখন মধ্য গগনে। পাঁচবছর আগে এই চকে যে কয়টা দোকান দেখেছিলাম এখন তার থেকে কয়েকটা বেরেছে। পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কাউকেই চোখে পরছে না। হয়ত চিনতে পারছি না। আমরা যে চায়ের দোকানে এসে প্রায় আড্ডা মারতাম সেই দোকানে ঢুকলাম।
একটা বছর কুড়ি বয়সের ছেলে বসে আছে। আর দু’চারজন বসে আছেন। আমি চায়ের কথা বলতে ছেলেটি একটু ভ্রু-কুঁচকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। এটা পরিতোষদার চায়ের দোকান। আমরা সবাই পরিদা বলে ডাকতাম। পরিতোষদার কথা বলতেই ছেলেটি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাল। বুঝল আমি একেবারে অপরিচিত নয়। তারপর আস্তে করে বললো, বাবা বাড়িতে আছেন। চা দিতে একটু দেরি হবে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম ঠিক আছে, তুমি করে দাও। আমি একটু বসছি। আমি জানি এই দুপুর রোদে এখানে কেউ চা খায় না। তাই চায়ের সরঞ্জাম সব ধোয়া হয়ে গেছে। আমার জন্য আবার নতুন করে বানাতে হবে। তাই দেরি হবে।
দুটো দানাদার চেয়ে নিলাম। আমাদের কলকাতার চিনির ডেলা থেকে যথেষ্ট ভালো। ভাল লাগল। বললাম রসোগোল্লা আছে ? ছেলেটি হ্যাঁ বললো। আমি বললাম দুটো দাও। না মিষ্টির স্বাদ সেরকমই আছে। জলের স্বাদও একই রকম। যাক এত পরিবর্তনের মধ্যেও এই দুটোর স্বাদ এখনো ঠিক আছে। চা খেলাম। কথা বলতে বলতে জানলাম। এখন আর হেঁটে যাবার দরকার নেই। চাইলে ট্রলি পাওয়া যায়। লোক যদি বেশি হয় তাহলে পয়সা কম লাগে। না হলে পয়সা একটু বেশি লাগে। চা খেতে খেতে আমাদের হাউসের কাগজটায় একটু চোখ বোলালাম। আমার একটা লেখা বেরিয়েছে। এ লেখাটা অনেক দিন আগের লেখা। অমিতাভদা সরিয়ে রেখেছিলেন। মনে মনে হাসলাম।
বাবু আপনি যাবিন নাকি ?
কাগজ থেকে চেখ তুলে তাকালাম। একটা কালো কুচকুচে চেলে আমার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে। সারা শরীর রুক্ষ। পরনে মাইছাতি পরা সেন্ডো গেঞ্জি। একটা লুঙ্গি। কাঁধে একটা গামছা।
হ্যাঁ।
কোথায় যাবেন ?
কাজলদীঘি।
গ্রামের নাম বলতেই আশেপাশের অনেক লোক আমার দিকে তাকালেন।
কার ঘরে গো ?
দোকানে বসা একজন বয়স্ক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মনামাস্টার।
এবার সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন।
আপনি কে হন ?
আমি ওনার ছাত্র।
তা বাবু আপনি কোথা থেকে আসছেন।
কলকাতা থেকে।
উনার এক আত্মীয় কলকাতায় থাকে। খপররে কাগজে কাজ করে। রেপোর্টার।
হাসলাম।
তুমি থাকো কোথায় ?
মনামাস্টারের পাশের গ্রাম।
ও।
চলো তাহলে।
ওর ট্রলিতে চেপে বসলাম।
ছেলেটি মোরাম রাস্তায় ট্রলি নিয়ে উঠলো। কেঁচর কেঁচর শব্দে হেলেদুলে ট্রলি চলেছে। দুপাশে সবুজ ধানের খেত। আর কিছুদিন পরেই ধান কাটার মরশুম চলে আসবে।
কতোক্ষণ যেতে লাগবে।
আধঘন্টা খানেক।
তুমি কি বীরকটায় থাকো না লাড়োতে।
লাড়ো। আপনি চেনেন নাকি ?
না।
তাইলে বলছেন কি করে।
এসেছিলাম আগে। তখন তোমাদের এই রাস্তাটা তৈরি হয় নি।
হ্যাঁ বাবু। এতো বৎসর খানিক হল। তায় আবার বর্ষার সময় মোরাম ধুয়ে যায়।
রাস্তাটা মোরাম হয়েছে বলে তোমাদেরও কিছু রোজগার হচ্ছে বলো।
হ্যাঁ বাবু।
সামনের দিকে তাকালাম। আদাশিমলার সেই বিশাল মাঠ। এই দুপুরে চারিদিক জনমানবশূন্য। মাঝে মাঝে কয়েকজন মাঠে বাছার কাজ করছে। মাঠের মাঝে মাঝে ছোট ছোট খরের চালার টংগুলো শেলো টিউবওয়েল পোঁতা রয়েছে। দু’একটা চলছে মনেহয়। মৃদু আওয়াজ দূর থেকে কানে ভেসে আসছে। এখানে আমার কতো স্মৃতি লুকিয়ে আছে। ঐ দূরে দেখা যায় উনামাস্টারের বাড়ি। সামনের দিকটা আগে খরের ছিল একন দেখছি এ্যাজবেস্টর লাগানো হয়েছে। ওই বাঁধের ওপাশ দিয়ে গেলেই সৌমি পূর্নিমাদের বাড়ি। দূরে দেখা যাচ্ছে শ্মশানটা। না যেমন দেখে গেছিলাম, ঠিক তেমনি আছে। মাঠে এখন চাষ চলছে। সবুজ গালিচার মতো। যেদিকে তাকাও খালি সবুজ সবুজ। কলেজ জীবনের কথা মনে পরে যচ্ছে। এখানে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সব এখানে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একটু আনমনা হয়ে পরেছিলাম।
কে যায়, অনি না।
ট্রলিটা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমি ট্রলিওয়ালাকে থামাতে বললাম। ও ট্রলি থামালো। ছুটে কাছে এলাম। উনামাস্টার। জুতো খুলে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
থাক থাক। আমার থুতনি ধরে চুমু খেলেন।
তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস।
না স্যার। আপনার কাছে এখনো আমি অনিই আছি।
তোর লেখা গুলো পরি। আজও তোর লেখাটা পরেছি। তোর লেখার হাতটা বড়ো ভালো।
মাথা নীচু করলাম।
তোর লেখা গুলো এখনকার ছেলে গুলোকে পরাই বুঝলি। ওদের বলি। আনিও তোদের মতো আমার কাছে পরেছে। কিন্তু তোদের মতো এতো বখাটে ছিলো না। ও আমাদের গ্রামের গর্ব।
স্যারের মুখ থেকে এত প্রশংসা আমি আগে কখনো শুনি নি। বরং বেতের বাড়ি পিঠে পরেছে অসংখ্যবার। লজ্জায় আমার মাথা আর উঠছে না। খালি মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে স্যার স্যার বেরিয়ে আসছে।
সত্যি গ্রামের মানুষ গুলো এতো সাধাসিধে হয় যে তাদের কোন তুলনা হয় না।
কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে ।
হ্যাঁ।
কয়দিন থাকবি তো।
হ্যাঁ।
মনার আবার শরীরটা খারাপ হয়েছে। বয়স হচ্ছে তো।
উনামাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম।
যা। পারলে একবার দুয়ারে আসিস।
ঠিক আছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মনাকাকার শরীর খারাপ। কি হয়েছে! ধীরে ধীরে ট্রলিতে উঠে বসলাম। আর একটু খানি। তারপর নদী পেরিয়ে আমার স্বপ্নের বাড়ি।
বাবু আপনি চকে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলছেন।
আমি ! কই নাতো।
ওই যে আপনার পরিচয় গোপন করেছেন। আমি কিন্তু আপনাকে চিন্তি পেরেছি।
তুমি আমাকে চেনো।
হ্যাঁ বাবু। আমি বিজয়।
কুইল্যা ঘরের বিজয়।
হ্যাঁ।
হাঁড়িপারায় থাকো।
হ্যাঁ বাবু। আমি তো আপনার ক্ষেতটা ভাগে চাষ করতিছি। মনামাস্টার দেছেন।
আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকালাম।
নদী ঘাটের কাছে এসে বিজয় ট্রলি থামালো। আমি নামলাম। নড়বরে বাঁশের সাঁকোটা এখনো সেই জায়গাতেই আছে। কোন পরিবর্তন নেই।
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কতোদেবো।
না বাবু আপনের কাছ থিকা পয়সা নিতি পারবনি।
কেনো। তুমি এতটা পথ এলে।
সে বৈকালে যখন আপনের ঘর যাব তখন দিবেন।
না না তুমি এখন নাও।
না।
বিজয় ট্রলি ঘুরিয়ে চলে গেলো।
আমি আমার বাসভূমে পা রাখলাম। এতদিন নিজভূমে পরবাসে ছিলাম। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে নদী বাঁধে উঠলাম। চারিদিক শূনসান। বাঁধের ওপর উঠলে আমার বাড়ির টং দেখা যায়। আমিও দেখতে পেলাম। মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। বাঁশবাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির পেছন পাশের পুকুর ধারে এলাম। পানাভর্তি পুকুর। বুঝলাম বহুদিন সংস্কার হয়নি। বাঁশঝাড়ের তলা শুকনো পাতায় ভর্তি। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলেই একটা চড় চড় আওয়াজ হয়। তাই হলো। আমি আমার বাড়ির সামনে এলাম।
পাঁচবছর আগে যা দেখেছিলাম, পাঁচবছর পর তার বয়স প্লাস পাঁচ। এখানেও সংস্কারের অভাব চোখে পরল। বারান্দায় উঁকি মারলাম। কয়েকটা কাপর শুকোতে দেওয়া আছে। দেয়ালের মাটি খসে পরেছে। পাশাপাশি দুটো দোতলা মাটির বাড়ি। একটি আমার পৈত্রিক বাড়ি। আর একটি মনামাস্টারের। এই দুপুর বেলায় দূরে কোথায় কুব পাখি কুব কুব করে ডাকছে।
আমার জন্ম ভিটেয় কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। বাইরের গেটে তালা বন্ধ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা। চোখের কোল দুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। ভেতর থেকে কেউ যেন বললো অনি এসেছিস। আয় ভেতরে আয়। বাবা কতদিন পরে এলি। মা-বাবাকে একটুও মনে পরে না। চারিদিকে চোখ মেলে তাকালাম। না কেউ নেই।
পায়ে পায়ে আমার বাড়ি পেছনে রেখে মনাকাকার বাড়ি এলাম। কতটা দূরত্ব ? হাত পঁচিশেক হবে। ভেতরে এলাম। বাইরের দাওয়ায় বেঞ্চটা যেমন ছিলো ঠিক তেমনি আছে। একটা বছর আঠারোর মেয়ে ভেতর বাইরে বসে, মাটিতে ঘসে ঘসে চুনো মাছ বাছছে। পরনে স্কার্ট ব্লাউজ। ব্লাউজটা ঘটি হাতা। টিপিক্যাল গ্রাম্য পোষাক। অনেকদিন পর এই পোষাক চোখে পরলো। হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টটা তোলা। স্কার্টের ফাঁক দিয়ে ইজের দেখা যাচ্ছে। বেশ দেখতে মেয়েটাকে। টানা টানা চোখ। শ্যামলা গায়ের রং। গোলগাল চেহারা। মেয়েটা প্রথমে আমাকে দেখেত পায় নি। কাঁধ থেকে হাতের ল্যাপটপটা বেঞ্চের ওপর রাখতেই, সামান্য আওয়াজে, পলকে আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর হতচকিত হয়ে একটা গঁ গঁ শব্দ করে দৌরে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আমি হতবাকের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে চাঁচামেচির শব্দ। ধুপ ধাপ আওয়াজ। মনাকাকার গলা পেলাম। কিছুক্ষণ পর কাকীমা বেরিয়ে এলেন। কাকীমার পাশে আর একজন ভদ্রমহিলা। তার পেছনে সেই মেয়েটি। উঁকি মেরে আমাকে দেখছে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম এখনো তার বুকটা কামরশালার হাপরের মতো ওঠা নামা করছে। কাকীমা বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। ঝড় ঝড় কর কেঁদে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিন পর কাকা-কাকীমাকে মনে পরলো।
ভেতর থেকে কাকা তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন, কে এসেছে গো কে, তোমরা সবাই কথা বলছো না কেনো।
কাকীমা কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললেন, অনি এসেছে।
অনি এসেছে! কোথায়! কোথায়! ওকে ভেতরে নিয়ে এসো আগে।
মেয়েটার দিকে তাকালাম বিদ্যুতের মতন সামান্য হাসির ঝিলিক মুখের ওপর দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেলো।
যাচ্ছি কাকা। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি ভেতরে যাচ্ছি।
ও সুরমা, সুরমা। ওঃ এরা ডাক দিলে সারা দেয়না কেনো। কোথায় যায় যে এরা।
কাকীমা ধরা গলায় বললেন এই তো এখানে।
বুঝলাম সুরমা এই ভদ্রমহিলার নাম। গ্রামের রীতি একজনকে প্রনাম করলে সকলকে প্রণাম করতে হয়। আমিও সেই ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করলাম। উনি পাটা সামান্য সরিয়ে নিয়ে বললেন থাক থাক বাবা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও ভেতরে যাও। তোমার জন্যই ওই লোকটা এখনো বেঁচে আছে।
কাকীমাকে জরিয়ে ধরে ভেতরে এলাম। এ পৃথিবীতে আমার আপনার বলতে কেউ নেই। কিন্তু আমি একা নই। বুকটা আবার কেমন ভারী হয়ে এলো। ভেতরে এলাম। কাকা বিছানায় বসে আছেন। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই কাকা খাট থেকে নেমে এসে আমায় বুকে জরিয়ে ধরলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার চোখে মুখে হাত বোলাচ্ছেন। যেন কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা । তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।
তুই কি আমাদের একবারে ভুলে গেলি।
আমার গলাটাও ধরে এসেছে। খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নিলাম।
কোথায় ভুলে গেলাম। তোমার চিঠি পর্শুদিন পেয়েছি। আজই চলে এলাম।
বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকার পর কাকা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বললেন, যাও যাও ওর খাবার ব্যবস্থা করো। ও এখন একটু বিশ্রাম নিক। ও নিপা। উঃ মেয়েটা যায় কোথা বলোতো।
এই তো আমি এখানে।
যা যা অনিদার ঘরটা একটু গুছিয়ে দে।
গোছানো আছে। তোমাকে হুড়াহুড়ি করতে হবে না।
এবার কাকীমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এঁদের তো চিনতে পারলাম না।
চিনবি কি করে। সেই কবে ছোট সময়ে দেখেছিলি। আমার বোন সুরমা। আর ওটা ওর মেয়ে নিপা। এবার বারো ক্লাস দিয়েছে। তুই যখন সুরকে দেখেছিস তখন ওর বিয়েই হয় নি।
আমি নিপার দিকে তাকালাম। নিপা মাথা নীচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। আমাকে ঠক করে একটা পেন্নাম করলো।
বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাঁশবাগানটা যেমন দেখেছিলাম তেমন আছে। চারিদিকে জঙ্গল একটু বেশি হয়ে গেছে। সামনের একটু জায়গায় পালং শাক, সুশনি শাকের বীজ ফেলা হয়েছে। সামনের ছোট্ট খেতটায় কয়েকটা কফির চাড়াও পোঁতা হয়েছে। ধান সেদ্ধ করার দোপাখা উনুনটার কাছে একরাশ পাঁউশ (ছাই) ডাঁই করে রাখা রয়েছে। গোয়ালঘরটা ফাঁকা। মনে হয়ে গরুগুলোকে মাঠে বেঁধে আসা হয়েছে। মনাকাকার ঘরের পুকুরটা ঠিক আছে। জল টলটল করছে। দু’একটা মাছ মাঝে মাঝে ভুঁট মারছে।
স্নান করবে না।
তাকালাম। সেই মেয়েটি। চোখ দিয়ে কথা বলছে। আমার দিকে তাকিয়ে। হাসি হাসি মুখ। কাকীমা তখন ওর কি যেন নাম বললো। নীপা।
জামা কাপরটা ছেরে নিই চলো।
ভেতরে এলাম।
কাকীমা দাঁড়িয়ে আছে।
দেখা হলো।
হাসলাম।
এই ছোট্ট শাক বাড়ি কি তুমি করেছো।
না। সুরো করেছে। ও আর নীপা জল ঢালে।
খেতের কফি বাড়ি।
ওটা বিজয় দেখাশুনা করে।
পান্তা আছে।
কাকীমা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
আছে কিনা বলো।
আছে।
নীপা তো চুনো মাছ বাছছে।
ওটাও তোর চোখে পরেছে।
হ্যাঁ। ওই তো বাইরের বারান্দায় বসে। ওখান থেকে কিছুটা নিয়ে ভজে দাও। লঙ্কা পেঁয়াজ তো আছেই।
কাকীমা হাসলেন, তোর কি এখোনো এই সব খাওয়ার অভ্যাস আছে।
জন্ম আমার এই ভিটেতে। বড় হয়েছি এখানে। মাটিটাকে ভুলি কি করে বলো।
কাকা আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলেন। ও নীপা আজ হাটবার না। তুই এক কাজ কর অনিলকে একবার ডাক। ওকে হাটে পাঠাই।
থাক না, আমি যাব খেয়ে দেয়ে। কাকা চুপ করলেন।
লেখকঃ মামুন জাফরান ( অনুমতি না নিয়েই পোস্ট করলাম। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থী।)
পাঁচ বছর পর আমার নিজের বাসভূমিতে পা রাখলাম। এতদিন নিজভূমে পরবাসে ছিলাম। দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে জানি না। বাস থেকে চকে নামলাম। চকের নাম বড়চাড়া। গ্রাম্য ভাষায় বাস স্ট্যান্ডকে চক বলে। লাল ধূলো উড়িয়ে মোরাম রাস্তা দিয়ে বাসটা গর্জন করতে করতে চলে গেলো। গায়ে মাথায় লালাধূলোর পরশ। বাস থেকে নামতে সবাই কেমন উত্সুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ গাঁয়ের বাসস্টেন্ডে খুব একটা বেশি লোক নামে না। সারাদিনে তিনটে বাস। জনা তিনেক নামলে অনেক বেশি। আমার সঙ্গে আরও দুজন নামল। নেমেই তারা হন হন করে হাঁটতে আরম্ভ করলো মাঠের মোরাম রাস্তা ধরে। এখান থেকে আমায় দশ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। এই রাস্তাটুকু হাঁটতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। একটা সময় সাইকেল নিয়ে এসব রাস্তায় কত ঘোরা ঘুরি করেছি। আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে।
সূর্য এখন মধ্য গগনে। পাঁচবছর আগে এই চকে যে কয়টা দোকান দেখেছিলাম এখন তার থেকে কয়েকটা বেরেছে। পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কাউকেই চোখে পরছে না। হয়ত চিনতে পারছি না। আমরা যে চায়ের দোকানে এসে প্রায় আড্ডা মারতাম সেই দোকানে ঢুকলাম।
একটা বছর কুড়ি বয়সের ছেলে বসে আছে। আর দু’চারজন বসে আছেন। আমি চায়ের কথা বলতে ছেলেটি একটু ভ্রু-কুঁচকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। এটা পরিতোষদার চায়ের দোকান। আমরা সবাই পরিদা বলে ডাকতাম। পরিতোষদার কথা বলতেই ছেলেটি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাল। বুঝল আমি একেবারে অপরিচিত নয়। তারপর আস্তে করে বললো, বাবা বাড়িতে আছেন। চা দিতে একটু দেরি হবে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম ঠিক আছে, তুমি করে দাও। আমি একটু বসছি। আমি জানি এই দুপুর রোদে এখানে কেউ চা খায় না। তাই চায়ের সরঞ্জাম সব ধোয়া হয়ে গেছে। আমার জন্য আবার নতুন করে বানাতে হবে। তাই দেরি হবে।
দুটো দানাদার চেয়ে নিলাম। আমাদের কলকাতার চিনির ডেলা থেকে যথেষ্ট ভালো। ভাল লাগল। বললাম রসোগোল্লা আছে ? ছেলেটি হ্যাঁ বললো। আমি বললাম দুটো দাও। না মিষ্টির স্বাদ সেরকমই আছে। জলের স্বাদও একই রকম। যাক এত পরিবর্তনের মধ্যেও এই দুটোর স্বাদ এখনো ঠিক আছে। চা খেলাম। কথা বলতে বলতে জানলাম। এখন আর হেঁটে যাবার দরকার নেই। চাইলে ট্রলি পাওয়া যায়। লোক যদি বেশি হয় তাহলে পয়সা কম লাগে। না হলে পয়সা একটু বেশি লাগে। চা খেতে খেতে আমাদের হাউসের কাগজটায় একটু চোখ বোলালাম। আমার একটা লেখা বেরিয়েছে। এ লেখাটা অনেক দিন আগের লেখা। অমিতাভদা সরিয়ে রেখেছিলেন। মনে মনে হাসলাম।
বাবু আপনি যাবিন নাকি ?
কাগজ থেকে চেখ তুলে তাকালাম। একটা কালো কুচকুচে চেলে আমার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে। সারা শরীর রুক্ষ। পরনে মাইছাতি পরা সেন্ডো গেঞ্জি। একটা লুঙ্গি। কাঁধে একটা গামছা।
হ্যাঁ।
কোথায় যাবেন ?
কাজলদীঘি।
গ্রামের নাম বলতেই আশেপাশের অনেক লোক আমার দিকে তাকালেন।
কার ঘরে গো ?
দোকানে বসা একজন বয়স্ক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মনামাস্টার।
এবার সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন।
আপনি কে হন ?
আমি ওনার ছাত্র।
তা বাবু আপনি কোথা থেকে আসছেন।
কলকাতা থেকে।
উনার এক আত্মীয় কলকাতায় থাকে। খপররে কাগজে কাজ করে। রেপোর্টার।
হাসলাম।
তুমি থাকো কোথায় ?
মনামাস্টারের পাশের গ্রাম।
ও।
চলো তাহলে।
ওর ট্রলিতে চেপে বসলাম।
ছেলেটি মোরাম রাস্তায় ট্রলি নিয়ে উঠলো। কেঁচর কেঁচর শব্দে হেলেদুলে ট্রলি চলেছে। দুপাশে সবুজ ধানের খেত। আর কিছুদিন পরেই ধান কাটার মরশুম চলে আসবে।
কতোক্ষণ যেতে লাগবে।
আধঘন্টা খানেক।
তুমি কি বীরকটায় থাকো না লাড়োতে।
লাড়ো। আপনি চেনেন নাকি ?
না।
তাইলে বলছেন কি করে।
এসেছিলাম আগে। তখন তোমাদের এই রাস্তাটা তৈরি হয় নি।
হ্যাঁ বাবু। এতো বৎসর খানিক হল। তায় আবার বর্ষার সময় মোরাম ধুয়ে যায়।
রাস্তাটা মোরাম হয়েছে বলে তোমাদেরও কিছু রোজগার হচ্ছে বলো।
হ্যাঁ বাবু।
সামনের দিকে তাকালাম। আদাশিমলার সেই বিশাল মাঠ। এই দুপুরে চারিদিক জনমানবশূন্য। মাঝে মাঝে কয়েকজন মাঠে বাছার কাজ করছে। মাঠের মাঝে মাঝে ছোট ছোট খরের চালার টংগুলো শেলো টিউবওয়েল পোঁতা রয়েছে। দু’একটা চলছে মনেহয়। মৃদু আওয়াজ দূর থেকে কানে ভেসে আসছে। এখানে আমার কতো স্মৃতি লুকিয়ে আছে। ঐ দূরে দেখা যায় উনামাস্টারের বাড়ি। সামনের দিকটা আগে খরের ছিল একন দেখছি এ্যাজবেস্টর লাগানো হয়েছে। ওই বাঁধের ওপাশ দিয়ে গেলেই সৌমি পূর্নিমাদের বাড়ি। দূরে দেখা যাচ্ছে শ্মশানটা। না যেমন দেখে গেছিলাম, ঠিক তেমনি আছে। মাঠে এখন চাষ চলছে। সবুজ গালিচার মতো। যেদিকে তাকাও খালি সবুজ সবুজ। কলেজ জীবনের কথা মনে পরে যচ্ছে। এখানে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সব এখানে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একটু আনমনা হয়ে পরেছিলাম।
কে যায়, অনি না।
ট্রলিটা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমি ট্রলিওয়ালাকে থামাতে বললাম। ও ট্রলি থামালো। ছুটে কাছে এলাম। উনামাস্টার। জুতো খুলে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
থাক থাক। আমার থুতনি ধরে চুমু খেলেন।
তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস।
না স্যার। আপনার কাছে এখনো আমি অনিই আছি।
তোর লেখা গুলো পরি। আজও তোর লেখাটা পরেছি। তোর লেখার হাতটা বড়ো ভালো।
মাথা নীচু করলাম।
তোর লেখা গুলো এখনকার ছেলে গুলোকে পরাই বুঝলি। ওদের বলি। আনিও তোদের মতো আমার কাছে পরেছে। কিন্তু তোদের মতো এতো বখাটে ছিলো না। ও আমাদের গ্রামের গর্ব।
স্যারের মুখ থেকে এত প্রশংসা আমি আগে কখনো শুনি নি। বরং বেতের বাড়ি পিঠে পরেছে অসংখ্যবার। লজ্জায় আমার মাথা আর উঠছে না। খালি মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে স্যার স্যার বেরিয়ে আসছে।
সত্যি গ্রামের মানুষ গুলো এতো সাধাসিধে হয় যে তাদের কোন তুলনা হয় না।
কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে ।
হ্যাঁ।
কয়দিন থাকবি তো।
হ্যাঁ।
মনার আবার শরীরটা খারাপ হয়েছে। বয়স হচ্ছে তো।
উনামাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম।
যা। পারলে একবার দুয়ারে আসিস।
ঠিক আছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মনাকাকার শরীর খারাপ। কি হয়েছে! ধীরে ধীরে ট্রলিতে উঠে বসলাম। আর একটু খানি। তারপর নদী পেরিয়ে আমার স্বপ্নের বাড়ি।
বাবু আপনি চকে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলছেন।
আমি ! কই নাতো।
ওই যে আপনার পরিচয় গোপন করেছেন। আমি কিন্তু আপনাকে চিন্তি পেরেছি।
তুমি আমাকে চেনো।
হ্যাঁ বাবু। আমি বিজয়।
কুইল্যা ঘরের বিজয়।
হ্যাঁ।
হাঁড়িপারায় থাকো।
হ্যাঁ বাবু। আমি তো আপনার ক্ষেতটা ভাগে চাষ করতিছি। মনামাস্টার দেছেন।
আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকালাম।
নদী ঘাটের কাছে এসে বিজয় ট্রলি থামালো। আমি নামলাম। নড়বরে বাঁশের সাঁকোটা এখনো সেই জায়গাতেই আছে। কোন পরিবর্তন নেই।
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কতোদেবো।
না বাবু আপনের কাছ থিকা পয়সা নিতি পারবনি।
কেনো। তুমি এতটা পথ এলে।
সে বৈকালে যখন আপনের ঘর যাব তখন দিবেন।
না না তুমি এখন নাও।
না।
বিজয় ট্রলি ঘুরিয়ে চলে গেলো।
আমি আমার বাসভূমে পা রাখলাম। এতদিন নিজভূমে পরবাসে ছিলাম। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে নদী বাঁধে উঠলাম। চারিদিক শূনসান। বাঁধের ওপর উঠলে আমার বাড়ির টং দেখা যায়। আমিও দেখতে পেলাম। মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। বাঁশবাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির পেছন পাশের পুকুর ধারে এলাম। পানাভর্তি পুকুর। বুঝলাম বহুদিন সংস্কার হয়নি। বাঁশঝাড়ের তলা শুকনো পাতায় ভর্তি। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলেই একটা চড় চড় আওয়াজ হয়। তাই হলো। আমি আমার বাড়ির সামনে এলাম।
পাঁচবছর আগে যা দেখেছিলাম, পাঁচবছর পর তার বয়স প্লাস পাঁচ। এখানেও সংস্কারের অভাব চোখে পরল। বারান্দায় উঁকি মারলাম। কয়েকটা কাপর শুকোতে দেওয়া আছে। দেয়ালের মাটি খসে পরেছে। পাশাপাশি দুটো দোতলা মাটির বাড়ি। একটি আমার পৈত্রিক বাড়ি। আর একটি মনামাস্টারের। এই দুপুর বেলায় দূরে কোথায় কুব পাখি কুব কুব করে ডাকছে।
আমার জন্ম ভিটেয় কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। বাইরের গেটে তালা বন্ধ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা। চোখের কোল দুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। ভেতর থেকে কেউ যেন বললো অনি এসেছিস। আয় ভেতরে আয়। বাবা কতদিন পরে এলি। মা-বাবাকে একটুও মনে পরে না। চারিদিকে চোখ মেলে তাকালাম। না কেউ নেই।
পায়ে পায়ে আমার বাড়ি পেছনে রেখে মনাকাকার বাড়ি এলাম। কতটা দূরত্ব ? হাত পঁচিশেক হবে। ভেতরে এলাম। বাইরের দাওয়ায় বেঞ্চটা যেমন ছিলো ঠিক তেমনি আছে। একটা বছর আঠারোর মেয়ে ভেতর বাইরে বসে, মাটিতে ঘসে ঘসে চুনো মাছ বাছছে। পরনে স্কার্ট ব্লাউজ। ব্লাউজটা ঘটি হাতা। টিপিক্যাল গ্রাম্য পোষাক। অনেকদিন পর এই পোষাক চোখে পরলো। হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টটা তোলা। স্কার্টের ফাঁক দিয়ে ইজের দেখা যাচ্ছে। বেশ দেখতে মেয়েটাকে। টানা টানা চোখ। শ্যামলা গায়ের রং। গোলগাল চেহারা। মেয়েটা প্রথমে আমাকে দেখেত পায় নি। কাঁধ থেকে হাতের ল্যাপটপটা বেঞ্চের ওপর রাখতেই, সামান্য আওয়াজে, পলকে আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর হতচকিত হয়ে একটা গঁ গঁ শব্দ করে দৌরে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আমি হতবাকের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে চাঁচামেচির শব্দ। ধুপ ধাপ আওয়াজ। মনাকাকার গলা পেলাম। কিছুক্ষণ পর কাকীমা বেরিয়ে এলেন। কাকীমার পাশে আর একজন ভদ্রমহিলা। তার পেছনে সেই মেয়েটি। উঁকি মেরে আমাকে দেখছে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম এখনো তার বুকটা কামরশালার হাপরের মতো ওঠা নামা করছে। কাকীমা বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। ঝড় ঝড় কর কেঁদে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিন পর কাকা-কাকীমাকে মনে পরলো।
ভেতর থেকে কাকা তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন, কে এসেছে গো কে, তোমরা সবাই কথা বলছো না কেনো।
কাকীমা কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললেন, অনি এসেছে।
অনি এসেছে! কোথায়! কোথায়! ওকে ভেতরে নিয়ে এসো আগে।
মেয়েটার দিকে তাকালাম বিদ্যুতের মতন সামান্য হাসির ঝিলিক মুখের ওপর দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেলো।
যাচ্ছি কাকা। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি ভেতরে যাচ্ছি।
ও সুরমা, সুরমা। ওঃ এরা ডাক দিলে সারা দেয়না কেনো। কোথায় যায় যে এরা।
কাকীমা ধরা গলায় বললেন এই তো এখানে।
বুঝলাম সুরমা এই ভদ্রমহিলার নাম। গ্রামের রীতি একজনকে প্রনাম করলে সকলকে প্রণাম করতে হয়। আমিও সেই ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করলাম। উনি পাটা সামান্য সরিয়ে নিয়ে বললেন থাক থাক বাবা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও ভেতরে যাও। তোমার জন্যই ওই লোকটা এখনো বেঁচে আছে।
কাকীমাকে জরিয়ে ধরে ভেতরে এলাম। এ পৃথিবীতে আমার আপনার বলতে কেউ নেই। কিন্তু আমি একা নই। বুকটা আবার কেমন ভারী হয়ে এলো। ভেতরে এলাম। কাকা বিছানায় বসে আছেন। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই কাকা খাট থেকে নেমে এসে আমায় বুকে জরিয়ে ধরলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার চোখে মুখে হাত বোলাচ্ছেন। যেন কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা । তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।
তুই কি আমাদের একবারে ভুলে গেলি।
আমার গলাটাও ধরে এসেছে। খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নিলাম।
কোথায় ভুলে গেলাম। তোমার চিঠি পর্শুদিন পেয়েছি। আজই চলে এলাম।
বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকার পর কাকা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বললেন, যাও যাও ওর খাবার ব্যবস্থা করো। ও এখন একটু বিশ্রাম নিক। ও নিপা। উঃ মেয়েটা যায় কোথা বলোতো।
এই তো আমি এখানে।
যা যা অনিদার ঘরটা একটু গুছিয়ে দে।
গোছানো আছে। তোমাকে হুড়াহুড়ি করতে হবে না।
এবার কাকীমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এঁদের তো চিনতে পারলাম না।
চিনবি কি করে। সেই কবে ছোট সময়ে দেখেছিলি। আমার বোন সুরমা। আর ওটা ওর মেয়ে নিপা। এবার বারো ক্লাস দিয়েছে। তুই যখন সুরকে দেখেছিস তখন ওর বিয়েই হয় নি।
আমি নিপার দিকে তাকালাম। নিপা মাথা নীচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। আমাকে ঠক করে একটা পেন্নাম করলো।
বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাঁশবাগানটা যেমন দেখেছিলাম তেমন আছে। চারিদিকে জঙ্গল একটু বেশি হয়ে গেছে। সামনের একটু জায়গায় পালং শাক, সুশনি শাকের বীজ ফেলা হয়েছে। সামনের ছোট্ট খেতটায় কয়েকটা কফির চাড়াও পোঁতা হয়েছে। ধান সেদ্ধ করার দোপাখা উনুনটার কাছে একরাশ পাঁউশ (ছাই) ডাঁই করে রাখা রয়েছে। গোয়ালঘরটা ফাঁকা। মনে হয়ে গরুগুলোকে মাঠে বেঁধে আসা হয়েছে। মনাকাকার ঘরের পুকুরটা ঠিক আছে। জল টলটল করছে। দু’একটা মাছ মাঝে মাঝে ভুঁট মারছে।
স্নান করবে না।
তাকালাম। সেই মেয়েটি। চোখ দিয়ে কথা বলছে। আমার দিকে তাকিয়ে। হাসি হাসি মুখ। কাকীমা তখন ওর কি যেন নাম বললো। নীপা।
জামা কাপরটা ছেরে নিই চলো।
ভেতরে এলাম।
কাকীমা দাঁড়িয়ে আছে।
দেখা হলো।
হাসলাম।
এই ছোট্ট শাক বাড়ি কি তুমি করেছো।
না। সুরো করেছে। ও আর নীপা জল ঢালে।
খেতের কফি বাড়ি।
ওটা বিজয় দেখাশুনা করে।
পান্তা আছে।
কাকীমা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
আছে কিনা বলো।
আছে।
নীপা তো চুনো মাছ বাছছে।
ওটাও তোর চোখে পরেছে।
হ্যাঁ। ওই তো বাইরের বারান্দায় বসে। ওখান থেকে কিছুটা নিয়ে ভজে দাও। লঙ্কা পেঁয়াজ তো আছেই।
কাকীমা হাসলেন, তোর কি এখোনো এই সব খাওয়ার অভ্যাস আছে।
জন্ম আমার এই ভিটেতে। বড় হয়েছি এখানে। মাটিটাকে ভুলি কি করে বলো।
কাকা আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলেন। ও নীপা আজ হাটবার না। তুই এক কাজ কর অনিলকে একবার ডাক। ওকে হাটে পাঠাই।
থাক না, আমি যাব খেয়ে দেয়ে। কাকা চুপ করলেন।