Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
আলোর দিকে

 
রোজকার মতোই চোখ রোদ পড়ে ঘুম ভেঙে গেল বিপিনবাবুর।
আরও একটা সকাল! আরও একবার বিরক্তিকর ভাবে ঘুম ভাঙা। জানেন, চোখে সামান্যতম আলো এলেও ঘুমোতে পারেন না উনি, তাও জানলার পর্দাটা টানটান করার কথা মনেই থাকে না রাত্তিরবেলা। অবশ্য জানলা বন্ধ করছেন আজকাল, এই না কত! অবশ্য জানলা বন্ধ না করে উপায়ই বা কি! সন্ধ্যে থেকেই মশা আসে বড্ড। আর বাকি সব কিছু সহ্য করা যায়, কিন্তু মশা - ওই ছোট্ট ছোট্ট জীব - ওদের কামড় - উফ অসহ্য এক্কেবারে! তাই এখন বিকেল হতেই ঘরের সবকটা জানলা বন্ধ করে দেন। তবে ওই, পর্দাটা টেনে দেবার কথা মনেই থাকে না।
আরও অনেক কিছুই মনে থাকে না। ওষুধ খাবার কথা, পাম্প চালাবার পরে বন্ধ করার কথা।
মানসী মনে রাখত সব! তখন মনে হতো না এসব খুব বড় কোনো কাজ। মনে হতো "এসব আর এমন কি, সবাই পারে"। কিন্তু আটমাস আগে বলা নেই কওয়া নেই মানসী ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবার পর থেকেই মনে হচ্ছে "তাই তো, এসব ও তো কাজ - করতে হয়।"
কথায় বলে "ভাগ্যবানের বৌ মরে"। এতদিন এইসব প্রবাদ - ট্রবাদ নিয়ে মাথা ঘামাননি বিপিনবাবু। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সংসার নিয়ে ভাবার সময় আর দরকার, কোনোটাই হয়নি। মাসের শুরুতে, স্যালারি হলেই সংসার খরচের টাকা দিয়ে দিতেন মানসীকে। কিভাবে সংসার চলে, মেয়ের পড়াশোনা, নাচের ইকলেজ, কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে হয়নি কখনও। ভাবার কথা মাথাতেও আসেনি। এমনকি মেয়ের যে কিভাবে বিয়েটাও হয়ে গেল, সেটা নিয়েও ভাবতে হয়নি। অনির্বাণ রিমির এম বি এ ক্লাসের বন্ধু ছিল। সেখানেই আলাপ হয়েছিল দুজনের। মেয়ের ফোনে কথা বলার বহর আর ধরণ দেখে বুঝে গেছিলেন 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'! তার কিছুদিন পরেই অর্নিবাণ আর রিমি দুজনেই দুটো ভাল ভাল কোম্পানিতে প্লেসমেন্ট পেয়ে গেল। আর চারহাত এক হয়ে গেল। মানসীর জন্যে বুঝতেও হয়নি মেয়ের বিয়ের ঝক্কি কাকে বলে! এখন তাই যেন আরও বেশি একা লাগে! মনে হয়, সারাটা জীবন কিছুই করেন নি, এক্কেবারে স্বার্থপরের মতো জীবন কাটানো ছাড়া। সকালবেলা অফিস যাওয়া, মুখ বুজে কাজ করা, দুপুরে টিফিন, সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে খবর দেখতে দেখতে চা - খানিক টিভি দেখা তারপর রাতের খাবার সেরে ঘুম - এই চক্রব্যূহেই কেটেছে এত্তগুলো বছর। রিটায়ার করার পরও প্রায় সেভাবেই জীবন কাটছিল। রিমিরা এখন ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে। অনেকবার বলেছিল ওর কাছে যেতে। ম্মানসী যেতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু, তার আগেই…
এখন মনে হয়, কেন যে একটু অন্যভাবে জীবনটা কাটালেন না! মেয়েটার বেড়ে ওঠাটাই দেখা হল না। এখন খুব একা লাগে। খুব বড় না হলেও এই দোতলা বাড়ি, ছাদ - খাঁ খাঁ করে যেন খালি বাড়িটা।
আজকাল রাতে ঘুমও আসতে চায় না। আগে শুনেছিলেন বিপিনবাবু, বয়স হলে নাকি ঘুম কমে যায়। এখন নিজে হাড়ে হাড়ে বুঝছেন সেটা। শুয়ে পড়েন বেশ তাড়াতাড়ি, কিন্তু এপাশ ওপাশ করেই কাটে অনেকটা সময়। কত যে চিন্তা আসে মাথায়! রিমিরা ভাল আছে তো? রিমি আর অনির্বাণ অনেকদিন একসঙ্গে ফোন করে না… কোনো সমস্যা হয়নি তো ওদের মধ্যে? অর্থহীন ভাবনা, তাও একটার পর একটা চিন্তা মাথায় এসেই যায়। ঠিক যেন একটা 'চেইন অফ থটস'! আর রাতের ঘুমটা গাঢ় হয়ে আসে ভোরের দিকে। সেই ঘুমটা যদি এভাবে চোখে রোদ পড়ে ভেঙে যায় - দিনের শুরুটাই কেমন একটা হয়ে যায়! জোর করে কালমেঘ পাতার রস খাওয়ার মতো…
মানসী জোর করে খাওয়াত কালমেঘ!
মানসী! সারাজীবন পাশে থাকার কথা বলে কেমন চলে গেল! একবারও ভাবলো না উনি একা একা কিভাবে থাকবেন? মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই - তবু মাঝে মাঝেই মনে হয়, মানসী যেন ইচ্ছে করে নিজেকে কষ্ট দেবার জন্য রোগ বাঁধিয়েছিল। এমনকি কখনও মুখ ফুটে বলেওনি। বুঝতেও দেয়নি। আর তাই…
যতবার এইকথাটা ভাবেন - বুকটা ভারী হয়ে আসে বিপিনবাবুর। বরাবরের বেখেয়ালি মানুষ উনি - তাও সবচেয়ে কাছের মানুষটার শরীরের অবস্থা চোখেও পড়ল না? এটা কি স্বার্থপরতা না? এখন যে এক্কেবারে একা হয়ে গেলেন? একা এবং অর্থহীন একজন মানুষ!
রিমি অনেকবার ওর কাছে পাকাপাকি চলে যেতে বলেছে। কিন্তু, মন চায় না। এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরু - তাও ওরা দুজনেই সারাদিন ব্যস্ত থাকবে… নতুন শহরে তা আরও অসহ্য লাগবে না?
তারচেয়ে যদি এখানেই, এখনই মৃত্যু হতো? চুপিসারে… কাউকে কিচ্ছুটি জানতে না দিয়ে? আহ্! শান্তি হতো! "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান"।
টলমলে পায়ে উঠে বাথরুমে গেলেন বিপিনবাবু। একচিলতে বাথরুমে বেসিনের সামনে আয়না। পরিষ্কার হয়না অনেকদিন, তাই ঘষা ঘষা লাগে। ওপারের মানুষতা যেন বিপিনবাবু না, অন্য কেউ। দাঁত মাজার পেস্ট মুখে নিয়ে কেমন বীভৎস লাগছে!
ঠিক ওঁর জীবনের মতোই।
তারচেয়ে যদি শেষ করে দেওয়া যেত!
নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান!" মরতে হবে! এই একা একার জীবন আর মানা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, মেয়ে, হয়ত জামাই ও কষ্ট পাবে। তবে ভুলেও যাবে শিগগিরিই। জীবন থেমে থাকবে না ওদেরও। আর হয়ত উনি না থাকলে রিমি আর অনির্বাণের মধ্যে কোনো যদি সমস্যা হয়েও থাকে, মিটে যাবে… দুজন দুজনের কাছাকাছি চলে আসবে। অনেকসময় অনেক বড় শোক দুজন মানুষকে কাছে টেনে আনে…
কি যে হচ্ছে আজ বিপিনবাবুর, বারবার মনে হচ্ছে এই সেই দিন! আজ একটা কিছু করতে হবে! একটা কিছু… অন্যরকম কিছু…
আর উনি চলে গেলে কারো কিছু যায় আসবে না। হয়ত ঘর- ঝাঁট মোছা আর বাসন মাজার ঠিকে কাজ করে যে আরতি, সে ভাববে আরেক বাড়ি কাজ ধরতে হবে। আর হোম ডেলিভারিতে দুপুর আর রাতের খাবার দেয় যারা, তারাও বিরক্ত হবে। কিন্তু, থেমে থাকবে না কিছুই। তাই…
কিন্তু কি ভাবে?
ভাল সাঁতার জানতেন, ছোটবেলায় গ্রামের পুকুরে সাঁতার কেটেছেন বিস্তর। তাই জলে ডুববেন না। গলায় দড়ি? তারপর ফ্যান ভেঙে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে? তখন তো বেশি সমস্যা। মরে যাওয়া এক, আর শয্যাশায়ী হওয়া আরেক।
ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো। নোয়াপাড়া মেট্রো স্টেশানের কাছেই একটি নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ, এটাই, এটাই ভাল!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পরণের লুঙ্গিটা খুলে একটা পাজামা আর ফতুয়া পরে নিলেন বিপিনবাবু। আর কিছুক্ষণ - তারপরেই…
বাড়িতে তালা লাগিয়ে রাস্তায় বেরোলেন বিপিনবাবু। মোড়ের মিষ্টির দোকানে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে দুটো গরম গরম জিলিপি খেলে কেমন হয়? আর তো মাত্তর কিছুক্ষণ! একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। শুধু জিলিপি না, দুটো কচুরিও খাবেন।
বেঞ্চে বসে অর্ডার দিয়েছেন, চোখে পড়ল একটি বেঞ্চের ধারেই গুটিসুটি মেরে বসা একটি কুকুরের দিকে। ভাল জাতের কুকুর, কিন্তু বড্ড রোগা! মাথা নিচু করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যেন খুঁজছে কাউকে… এতটাই প্রতীক্ষা মেশানো সেই চাউনি!
অনেকবছর আগে, তখন পড়াশোনা করতে কলকাতায় এসেছিলেন, শিয়ালদার কাছে একটা মেসে থাকতেন বিপিনবাবু। একটা কুকুরকে রোজ খেতে দিতেন। বেশ বন্ধু হয়ে গেছিলেন দুজনে। তার কথা মনে পড়ে গেল বিপিনবাবুর। সে যদিও রাস্তার 'নেড়ি' ছিল। কিন্তু এত ভাল জাতের কুকুর এভাবে কেন?
"এটা কার কুকুর?" শালপাতার বাটিতে কচুরি দিতে আসা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন উনি।
"আর বলবেন না দাদু। কেউ একটা ফেলে রেখে গেছে। আর এ ও সেই থেকে এখানেই আছে। যত্তসব।" গজগজ করে বলে ওঠেন দোকানি।
"কি খায়?" কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়েছে কুকুরটা ওঁর দিকে। অপরাধীর মতো দৃষ্টি চোখে। যেন খুব একটা অন্যায় করে ফেলেছে…
"কি আবার খাবে! বিস্কুট টিস্কুট দিই দু চারটে। "
"আহা রে, কত রোগা। ঠিক মতো খেতে পায় না…" নিজের মনেই বলে উঠলেন উনি।
বয়স হয়েছে কুকুরটির। স্থবির একটা ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
কেউ কিভাবে এভাবে একজনকে ফেলে দিতে পারে?
"কি আর বলব দাদু। এইভাবে একটা জীবনকে মিত্যুর মুখে ফেলে দিতে হয়? জীবন তো ভগমানের দান! নিজেরা তো সিষ্টি করতে পারিনা আমরা। তাহলে কেড়ে নেবার সাহস দেখাই কিভাবে? পাপ! পাপ! মহাপাপ!" কচুরির লেচি বানাতে বানাতেই বলেন দোকানি।
"আমাদের তো খাবারের দোকান, এখানে ঢোকাতে সাহস পাই না। যদি খাবারে কোনোমতে চুল টুল পড়ে! লোকে আর আসবেই না। এই ডিসেম্বর মাসে… এভাবে কেউ একটা প্রাণ ফেলে দিতে পারে? শাল্লা!"
জীবন তো সত্যিই নিজেদের সৃষ্টি না! তাহলে কেড়ে নেবার অধিকারও তো নিজের না…
কথাগুলো মনে মনে আওড়ান বিপিনবাবু।
ঠিক! ঠিকই তো!
বাবা মা জীবনদান করেন ঠিকই, কিন্তু শুধুই কি বাবা মা? নাকি ইলেকট্রন-প্রোটনের আড়ালে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা অন্য কেউ? আর সেই জীবন এইভাবে নিয়ে নেওয়া যায়?
পাপ! পাপ! মহাপাপ!
আর উনিও যে সেটাই করতে যাচ্ছিলেন!
পলকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। আজ, হ্যাঁ, আজ একটা ভাল দিন হোক।
জীবন ফিরিয়ে দেবার দিন হোক।
"আমি ওকে নিয়ে যাব আমার বাড়ি? এভাবে ঠান্ডায় কষ্ট পাবার থেকে আমার সঙ্গে থাকুক? ডাক্তারও দেখিয়ে নেব একবার।" বলে ওঠেন উনি।
"নিয়ে যাবেন দাদু? খুব ভাল হয় তবে! বেঁচে যাবে ও।" একগাল হেসে বলেন দোকানি।
হেসে ওঠেন বিপিনবাবুও। তারপর কুকুরটার কাছে গিয়ে বলে ওঠেন "আয়, আয়, তোর নতুন বাড়িতে যাবি আয়।"
কুকুরটাও উঠে বসে…
ব্যস্ত রাস্তার দিকে একবার তাকান বিপিনবাবু। এই তো, আর নিজেকে একা, অসহায়, কর্মহীন লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে আবার একজন সঙ্গী পেলেন। বাড়িটা আর খাঁ খাঁ করবে না…
আচ্ছা, একজন লোক যদি রাখা যায়, যে ওকে দেখাশোনা করবে? আর ওর মতো আরও যদি কেউ বৃদ্ধ হয়ে, স্থবির হয়ে যায়, বাড়ির লোকেরা অবহেলা করে রাস্তায় রেখে যায়, তাদেরও যদি নিয়ে আসা যায়?
হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে ঠিকই। এতবছর সংসারের তো কিছুই দেখেন নি উনি। কিন্তু তাও, পারবেন উনি ঠিক…
আহ্! কী শান্তি এই ভাবনাতেই।
"আয় বাবা, চল" বলার সাথে সাথেই 'বাবা' উঠে ওঁর কাছে এসে দাঁড়ায়। যেন যাবার জন্য তৈরি!
একটু হেসে আবার বাড়ির পথ ধরেন বিপিনবাবু।
ঝোঁকের মাথায় কি করতে যাচ্ছিলেন... ভাগ্যিস চৈতন্যোদয় হলো!
সামান্য পরে মানুষ এবং না - মানুষের জুটি পাশাপাশি হাঁটছিল। আলোর দিকে। আলো মেখে...

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 02-07-2024, 03:22 PM



Users browsing this thread: 21 Guest(s)