Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
সেই রবিবারটায়...

 
সাতমাস আঠেরোদিন হলো এই খাবার ডেলিভারি দেবার অ্যাপে জয়েন করেছে বাবলু।
কিছু করার ছিল না, বাবা একটা অফিসে হাউসকিপিং এর কাজ করতেন। এমনি কাজটা বেশ ভাল ছিল, অফিসের লোকজন ও ভাল ছিল, শনি - রবি দু’দিন অফিস ছুটি থাকত।
কিন্তু হঠাৎ করেই বছরখানেক আগে কোম্পানির বড় সাহেবেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অফিস বন্ধ করে দেওয়া হবে, সবাই বাড়ি থেকেই কাজ করবে, যাতে এই এত বড় অফিসের ভাড়ার টাকাটা আর না লাগে। অফিসের সবাই খুশিও হয়েছিল। কিন্তু বাবলুর বাবার কাজটা চলে গেছিল। তারপর অনেক কাজের চেষ্টা করেছে, একটা কাজ দেবার এজেন্সিতেও নাম লিখিয়েছে বাবা, কিন্তু সব জায়গাতেই “আপনি তো প্রায় ষাট - কাজ করতে পারবেন?” শুনতে হয়েছে।
তখনই এই ডেলিভারি অ্যাপে জয়েন করেছিল বাবলু। ভেবেছিল নাইট কলেজে পড়ে পড়াশোনাটা শেষ করে নেবে, কিন্তু এখন আর সময় হয় না। বেশিরভাগ অর্ডার একটু রাতের দিকেই আসে, আর যতগুলো অর্ডার ডেলিভারি করতে পারবে, তত বেশি টাকা পাওয়া যাবে। তাই পড়াশোনাটা আপাতত বন্ধই আছে বাবলুর - যদিও ওর ইচ্ছে ওপেন ইউনিভার্সিটি তে খোঁজ নিয়ে পড়াশোনা আবার শুরু করার…
বাবার ভাল লাগবে…
বাবলু জানে ওর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ও কোনো অফিসে চাকরি করবে।
“তোমার মতো চাকরি করব, বাবা?” ছোটবেলায় একবার জিজ্ঞেস করেছিল বাবলু। কেন জানি না, বাবা খুব রেগে গেছিলেন শুনে। চিৎকার করে মারতে গেছিলেন।
পরে অবশ্য বুঝিয়ে বলেছিলেন, “আমার মতো না বাবা, অনেক ভাল কাজ করবে। বড় অফিসার হবে। আমার মতো লোকেরা তোমাকে চা, জল দেবে…”
কথা বাড়ায় নি বাবলু, তবে অত ছোটবেলাতেই বুঝেছিল বাবার জন্য অনেক কিছু করতে হবে…
এমন কিছু, যাতে বাবা খুশি হয়...
পড়াশোনায় সেরকম একটা ভাল ছিল না বাবলু, এক পড়া বারবার করে পড়তে হতো, নাহলে মাথায় ঢুকত না, তাও মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট হতো। স্যারেরা বলতেন "তোর কিন্তু বুদ্ধি আছে, তলিয়ে ভাবতে পারিস!" তবে অতিমারীর বছরে বাবার অনেক পুরোনো অফিসের চাকরিটা চলে গেল, তখন ও ক্লাস এইট। বছর ঘুরবে ঘুরবে করছে - তখন বাবা এই নতুন অফিসে চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু সেটাও উঠে যাবার পর হয়ে গেল মুশকিল। যাই হোক, বাবার মতের বাইরে গিয়েই এই ডেলিভারি বয়ের কাজটা নিয়েছে ও। ভাগ্যিস সাইকেল টা ছিল, নইলে অবশ্য এই কাজটা করতে পারত না।
আজ আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। খবরে বলেছে কী নাকি একটা মারাত্মক ঝড় আসছে, আমফানের মতোই প্রায়। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছে আবহাওয়া দপ্তর থেকে। হয়ত সেজন্যই আজ অর্ডার আসছে বেশি। কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে চায় না, এদিকে সবার জিনিস ও চাই। ও যে ডেলিভারি অ্যাপের হয়ে কাজ করে, তারা খাবার ছাড়াও বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনের জিনিস এমনকি মদ ও, বাড়িতে ডেলিভারি করে। অন্যদিন এই সময় দুটো বা বড়জোর তিনটে ডেলিভারি হয়, আজ দুপুর না গড়াতেই পাঁচটা অর্ডারের ডেলিভারি দিতে হল।
হোক, হোক! আরও কয়েক টা হোক… যত ডেলিভারি, তত বেশি পয়সা…
লেকটাউনের একটা বাড়িতে ডেলিভারি দিতে হবে এখন। জনপ্রিয় বিরিয়ানির দোকান থেকে মিলিয়ে অর্ডারটা নিয়ে নিল বাবলু। হ্যাঁ এই তো - একটা মাটন বিরিয়ানি, একটা চিকেন চাঁপ আর একটা ফিরনি। এই যাঃ, ভুল হয়ে যাচ্ছিল, এর সাথেই একটা কোল্ড ড্রিংক আছে তো, অফারে! না নিয়ে গেলে আবার এসে আবার যেতে হতো।
বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেল চালিয়ে অর্ডারটা দিতে চলে এলো বাবলু। আজ আবার ক্রিকেট ম্যাচ আছে সন্ধ্যেবেলা - ইস যদি এই ঝড়টা আসার ব্যাপার না থাকত, অনেক বেশি অর্ডার আসত আজও। আগে হলে বাবলু নিজেই পাড়ার ক্লাবে চলে যেত খেলা দেখতে, সবাই মিলে মজা করতে করতে খেলা দেখার তো মজাই আলাদা! তবে এখন আর ইচ্ছেই করে না… খালি মনে হয় বাবা কেমন শূন্য দৃষ্টি মেলে দেখেন ওকে রোজ। একদিন তো দুঃঃখ করে বলেই দিয়েছিলেন “কোথায় আমি কাজ করব, তুই পড়াশোনা করবি, আমার জন্য তোর জীবনটা শেষ হয়ে গেল…”
বাবাকে আর কথা বাড়াতে দেয়নি বাবলু। বলে উঠেছিল “তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমি খুব ভাল কাজ করব…”
“আর কী কাজ করবি!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন বাবা।
“আরে দেখো না তুমি - এমন কাজ করব যে… ইয়ে… পেপার… পেপারে নাম উঠে যাবে গো!” একগাল হেসে বলেছিল বাবলু।
ছোটবেলায় খুব ইচ্ছে ছিল ওর মাধ্যমিকে ফার্স্ট হবার - যাতে পেপারে নাম ওঠে! সেই থেকেই মাথায় রয়েই গেছে।
বাবাও হেসে ফেলেছিলেন। সেদিনের মতো বাবার বুকের হাহাকারটা মুখে আসেনি আর…
উফ! এই রাস্তাটা এমন, কিছুতেই ঠি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। বারোর এক নাম্বার বাড়ির পরের বাড়ি হল আঠেরো - মাঝখানের ছ’টা বাড়ি কী মামার বাড়ি চলে গেল!
বাড়িরও মামার বাড়ি! নিজের কথাতেই নিজের হাসি পেয়ে যায় বাবলুর।
নাহ! কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাড়িটাকে। বাধ্য হয়েই ফোন করে অর্ডার যিনি দিয়েছিলেন তাঁর নাম্বারে।
ইংরিজি গান বাজছে কলার টিউনে।
ফোনটা পুরো রিং হয়ে কেটে গেল। রাস্তাতেও কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করতে পারে ঠিকানাটা।
ম্যাপেও বোঝা যাচ্ছে না - কাছাকাছিই হবে খুব, কিন্তু …
আবার ফোন করে বাবলু। আবার সেই ইংরিজি গান।
“হ্যালোওওও” বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোন ধরল কাস্টমার।
এই ‘হ্যালো’ এমন একটা শব্দ, যেটা অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। কতরকম মানুষ যে আছে, তাঁদের ‘হ্যালো’ শুনলেই বোঝা যায়। কেউ খুব মিষ্টি করে বলেন “হ্যালোও?” শুনেই বাবলুর মনে হয় গুবলু গাবলু মিষ্টি মানুষ, যেন গেলেই অর্ডারটা নিয়ে এক মুখ হেসে বলবেন ‘থ্যাংক ইউ!” আবার কেউ কেউ ফোন ধরেই হ্যালো বলেন না, বলেন ‘হাঁ?’ শুনেই বাবলুর মনে হয় যেন গুটকা মুখে নিয়ে কথা বলছেন কেউ, খুব রাগী মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অনুমানটা মিলেও যায়। যেমন একবার নাগেরবাজারে একটা দিদি, খুব মিষ্টি গলায় ‘হ্যালো’ বলেছিলেন। আর ডেলিভারি দেবার পরে জোর করে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন একটা ছোট্ট জ্যুসের প্যাকেট, “এত রোদে এসেছ - খেয়ে নিও ভাই” বলে।
কিন্তু এই ‘হ্যালো’টা অন্যরকম। একদম রুক্ষ একটা শব্দ, একটু হাঁফ ধরা গলা।
“স্যার একটা খাবারের ডেলিভারি দেবার ছিল।”
“তো দিন।”
“স্যার অ্যাড্রেসটা একটু বলবেন?”
“মানে?”
“স্যার আসলে খুঁজে পাচ্ছি না।”
“আমি তো অর্ডার দেবার সময় অ্যাপে লিখেছিলাম আমাকে যাতে ফোন না করা হয়!” খুব রাগী গলায় কথা বলছেন উনি।
‘স্যার, আসলে খুঁজে পাচ্ছিনা ঠিক… আমি বারোর এক বাড়িটার কাছে…” কথা শেষ করার আগেই শুনতে পায় “আহহহ” করে একটা আওয়াজ।
নারীকণ্ঠ!
“খুঁজে নে শা লা! খুঁজে পাচ্ছি না আবার কি?” বলে ফোন টা কেটে দিল কাস্টমার।
স্তব্ধ হয়ে গেল বাবলু।
অনেকেই ফোন করে বাড়ির ঠিকানা চাইলে বিরক্ত হন দেখেছে ও। কিন্তু এভাবে কেউ কখনও গালাগালি করেন নি।
চোখে জল এলো বাবলুর।
আজ বাড়ি থেকে বেরোতে দিতে চাইছিলেন না বাবা। বারবার বলছিলেন “এত বৃষ্টি, তারমধ্যে ঝড় আসবে, আজ না গেলেই নয়?”
“আজ তাড়াতাড়ি চলে আসব বাবা” বলে এসেছিল ও।
আসলে এইসব দিনে কাজ করলে কাস্টমার রা অনেকে ‘টিপস’ দেন ওদের, সেই টাকা পুরোটাই ওরা পায়। আর এখন একটা টাকারও কত দাম, জানে ও…
কিন্তু অর্ডারটা ডেলিভারির কি হবে?
ডেলিভারি না হলে পুরো টাকাটাই ওদের পকেট থেকে কেটে নেবে কোম্পানি। এতগুলো টাকা শুধুশুধু জলে দেবে ও?
আবার ফোন করে ওই নাম্বারে বাবলু।
অনেক সময় তো লোকে মুখ ফসকেও গালি দিয়ে দেয়! হয়ত এই কাস্টমার নিজেই এরকম একজন মানুষ।
“উফ, জ্বালিয়ে খেল বাঁ!” ফোন ধরেই বলে উঠল কাস্টমার টা।
এনাকে আর ‘আপনি আজ্ঞে’ করতে ইচ্ছে করছে না, তাও ভদ্রভাবে কথা তো বলতেই হবে! তাই বলে ওঠে “স্যার, আমি কিছুতেই আপনার অ্যাড্রেস টা খুঁজে পাচ্ছি না”
“আহ! শা লী, কু ত্তী - তোর এতবড় সাহস আমাকে কামড়ে দিলি? আহ!” কানের পর্দা যেন ফেটে যাবে এত জোরে চিৎকার করে উঠল লোকটা ফোনে।
কেউ একটা কাঁদছে খুব। নারীকণ্ঠের কান্না!
একটা যেন জোরে আওয়াজ এলো, খুব কাছ থেকেই। তারপর ফোনটা কেটে গেল।
এই সাত মাসে কম ডেলিভারি তো করেনি বাবলু? কতরকম মানুষ দেখেছে। সেই দিদিটার মতো জোর করে জ্যুস দেওয়া মানুষ যেমন দেখেছে, তেমনি খাবার নিয়েও “ডেলিভারি পাই নি” বা “খাবার ঠান্ডা ছিল” বলা মানুষও পেয়েছে বাবলু। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি ওর।
কিন্তু আর ফোন করার ও সাহস হচ্ছে না।
বৃষ্টি টা বেড়ে গেল। এই অঞ্চলে আবার একটুতেই জল জমে যায়। এখনই জমতে শুরু করেছে।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে আবার ঠিকানাটা দেখে বাবলু
সৃষ্টি আবাসন, ফ্ল্যাট নাম্বার ৬, সেকেন্ড ফ্লোর, ১৭, এ. ডি দত্ত লেন।
এটা বারো, তাহলে… পাশের গলিতে একবার দেখবে? যদি ওখানে থাকে?
পাশের গলির একদম শেষের সবুজ রঙের বাড়িটা ‘সৃষ্টি আবাসন’ । দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ও।
এই ডেলিভারিটা দিয়ে বাড়ি যাবে ও। স্নান করতে হবে ভাল করে, এমনিতেই রেনকোটের নিচে থেকেও ভিজে একশা হয়ে গেছে ও।

Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 20-06-2024, 04:08 PM



Users browsing this thread: 19 Guest(s)