Thread Rating:
  • 9 Vote(s) - 2.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান)
#32
 পর্ব -২২



আজিজ তালুকদার থম মেরে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে কোন কথা নেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবে তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কি ভাবছে। শাহেদ অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। কথার মাঝখানে সে এক দু'বার আজিজ সাহেবের প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। এতো বড় সত্যিটা জানার পর আজিজ সাহেবের কি মত তা শাহেদের জানা দরকার। মানুষকে নিজের কথার আয়ত্বে আনতে পারা তার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজিজ সাহেবের মতো শক্ত মানুষকেও সে ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা রাখে। তারই প্রচেষ্টায় শাহেদ বিরতিহীন ভাবে বলে যেতে লাগলো,
'ভাইজান, এই ছেলে কতো বড় চতুর বুঝতে পারছেন? এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে৷ আর লুকোবেই না কেন! জানে তো সত্যিটা জানলে আর তালুকদার বাড়ির মেয়ে পাবে না। আমার তো মনে হয় এরা শুধু মিথ্যাবাদীই নয় এর সাথে লোভীও। ছি ছি আমি ভাবতেও পারছি না। শেষমেশ কিনা একটা পতিতার ছেলে!'

শেষের কথাটা শুনে আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেঁপে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আসমা আর জমিরন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যটা গ্রহণ করতে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলে,

'আমাদের তালুকদার বাড়ির একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বাপ দাদার আমলেও কোনদিন এমন ঘটনা ঘটে নাই। তারা কেউ উচ্চবংশীয় সম্বন্ধ ছাড়া আত্মীয়তা করতেন না। সবাই সম্মানের চোখে তাদেরকে দেখতো। এই ঘটনা যদি জানাজানি হয় আমাদের বংশের এতোদিনের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। লোকে শুনলে থু থু ছিটাবে, একটা পতিতার ছেলের সাথে কিনা তালুকদার বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে! আমার ভাবতেই গা গুলাচ্ছে ভাইজান। আপনি কিভাবে এমনটা করতে পারলেন! বিয়ে দেওয়ার আগে একটু তো ভালোমতো খোঁজ খবর নিয়ে নিবেন। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। কই একটু দেখে শুনে বড় ঘরে বিয়ে দিবেন তা না দিলেন তো দিলেন একটা ছোট ঘরে বিয়ে। তাও সবটা মেনে নিয়েছিলাম যাক বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন আর কি করার! কিন্তু এখন আবার এই কি কাহিনী বের হয়ে এলো! না জানি আরো কতো কেচ্ছা কাহিনী আছে এদের ভেতরে। আপনি রাগের মাথায় এই বিয়েটা দিয়ে যে কতো বড় ভুল করলেন! এর থেকে ভালো ছিল মেয়েকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়া।'

শাহেদ একটু থামলো। বোঝার চেষ্টা করলো আজিজ সাহেবকে আবার বেশি বেশি বলে ফেলছে কিনা! নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বলল,
'ভাইজান, একটু ভেবে দেখেন। এই খবর যদি সমাজে ছড়ায় তাহলে আমাদের মুখে কেমন কালিটা লাগবে। মানুষ হাসবে। এতদিনের সব সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে আপনি যে সামনে নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এই খবর জানাজানি হলে আর জীবনেও চেয়ারম্যান হতে পারবেন! মান সম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ তো তখন আরও আকাশে উঠবে। ভাইজান, একটু ভালো মতো ভেবে দেখেন। সবাই জানতে পারলে কি অবস্থাটা হবে আমাদের বংশের। এখনও সময় আছে। এই খবর জানাজানি হবার আগেই এর দফারফা করে ফেলেন। আমাদের ধারা দেখতে শুনতে গ্রামের মধ্যে সেরা। ও'র জন্য এরপর একটা উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অন্তত আর যাই হোক একটা পতিতার ছেলের কাছে আমাদের মেয়েকে আর রাখা যাবে না।'

শাহেদ খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করতে থাকে। আজিজ সাহেব এখনও চুপ হয়ে আছেন। আসমা সেই নিশ্চুপতায় শঙ্কিত বোধ করেন। না জানি এবার কি হয়!
__________________________________________

আকাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। রোদের তাপে খুব একটা জোর নেই। একটা শঙ্খ চিল ডানা মেলে শুদ্ধ'র মাথার উপরের আকাশ দিয়ে গোল গোল চক্কর দিচ্ছে। শুদ্ধ'র সেদিকে কোন নজর নেই। সে গভীর মনোযোগের সাথে ভ্রুকুটি করে একটা সরু বাঁশের মাথায় রশি দিয়ে খুঁটি বাঁধছে। বাড়ির পাশে একটা লম্বা পেঁপে গাছ হয়েছে। তার আগা ভর্তি শুধু পেঁপে। খালি হাতে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। তাই এই ব্যবস্থা। ধারা এসে সেই সময় দরজা পাশে দাঁড়ায়। শুদ্ধকে দেখতেই তার চোখের কোণে পানি জমে। গতকাল রাতে শুদ্ধ'র ফোন বিক্রির ব্যাপারটা জানতে পারার পর থেকে ধারা স্থির হতে পারছে না। বাঁশের খুটি বাঁধা হলে সেই দড়ি কাটবার জন্য শুদ্ধ একটা কাঁচির প্রয়োজন অনুভব করে। কাঁচি ঘরের সামনে 'ওডা'র উপরেই রেখে ছিল শুদ্ধ৷ ধারার সামনে দিয়ে সেটা আনতে গেলে ধারা অস্ফুট স্বরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই শুদ্ধ না তাকিয়েই চলে আসে। পুনরায় পেঁপে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয়। ধারাও তৎক্ষণাৎ শুদ্ধ'র পেছন পেছন চলে এসে ভেজা গলায় বলে উঠে,
'আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আপনাকে অনেক বড় আঘাত করেছি। ক্ষমা চাইবার মতোও আমার কোন মুখ নেই.....

রশি বাঁধা থেকে শুদ্ধ'র হাত থেমে যায়। তবে সে পেছনে ঘুরে না। ধারার কণ্ঠ কান্নামাখা। তার চোখ ভর্তি পানি। বুকে ভীষণ যন্ত্রণা। একটু থেমে সে বলতে থাকে,

'আমার মায়ের প্রথমেই দুটো মেয়ে হয়। সবসময় ছোট থেকে দেখে এসেছি রাতুল হওয়ার আগ পর্যন্ত পরপর দুটো মেয়ে হওয়ায় মাকে কতোটা কথা শুনতে হতো। অপয়া শব্দটাও নামের সাথে লেগে গিয়েছিল। একটা ছেলে জন্ম না দিতে পারায় দাদী কতো কিছুই না বলতো! ছোট থেকেই তাই সবসময় চাইতাম আমার নিজের কাজের জন্য যেন বাড়িতে কোন ঝামেলা না হয়। মেয়ে হয়েছে বলে আবারও যেন কোন কথা না শুনতে হয় আমার মাকে। সবসময় সবার মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। কারো কথার বাইরে যেতাম না। কাউকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিতে চাইতাম না। অন্তত আমার কারণে কারো যেন কোন সমস্যা না হয় সেই চেষ্টা করতাম। কিন্তু এরকম ভাবে সবার মন যুগিয়ে চলতে চলতে আমি কবে কখন এরকম হয়ে গেলাম আমি নিজেও জানি না। হয়ে গেলাম আমি এমনই। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি তার মান রাখতে পারিনি। আপনাকে প্রচুর আঘাত করেছি। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন। এরকম চুপ করে থাকবেন না। আপনি কথা না বললে আমার খুব ক.......'

ধারা আর ও'র কথা শেষ করতে পারলো না। ও'র কথার মাঝেই হঠাৎ সেই বাড়ির উঠোনে আজিজ সাহেবের ডাক শোনা গেলো। তার সাথে আছে শাহেদও। হঠাৎ নিজের বাপ চাচার আগমনে ধারা অবাক হয়ে গেলো। শব্দ পেয়ে খোদেজাও বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। শাহেদ ধারার অবাক মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
'ধারা, চল! তোকে আর এই ছোট ঘুপচি ঘরে থাকতে হবে না। তোকে আমরা নিতে এসেছি। এই
ছেলে যে তোর শ্বাশুড়ির আসল ছেলে না তা কি তুই জানিস!'

ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। খোদেজা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে কোন সময় না দিয়েই আজিজ সাহেব এবার ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন,
'এই কাজটা আপনি ঠিক করেননি। এভাবে একটা পতিতার ছেলের সাথে আপনি আমার মেয়ের বিয়ে করিয়ে নিলেন!'

আজিজ সাহেবের কথা শুনে ধারা স্তব্ধ। সেই বাকরুদ্ধ ধারাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই আজিজ সাহেব মেয়ের হাত খপ করে ধরলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা কিছু বলার জন্য অস্ফুট স্বরে 'বাবা' বলে ডাকতেই আজিজ সাহেব তাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলেন। ধারা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অপর হাত শুদ্ধ'র দিকে বাড়ানোর চেষ্টা করে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নড়লো না। তার বুকে একধরনের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো, তবুও বাইরে তার আঁচ পড়তে দিলো না। ধারাকে নিয়ে চলে গেলে খোদেজা শুদ্ধ'র কাছে এসে বিচলিত স্বরে বলল,
'এইটা কি হইলো মাহতাব? তুই বউরে আটকে রাখলি না কেন?'
শুদ্ধ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পেছনে ঘুরে বলল, 'রাখা তাকে যায়, যে থাকতে চায়। ধারার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। সে তাই করবে, যা তাকে করতে বলা হবে।'
__________________________________________

রাতুল একটা সমস্যা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছে। কলেজ থেকে ক্রিকেট খেলে সে উপজেলা পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এদিকে বাবা বলে দিয়েছে ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করা যাবে না। ক্রিকেট রাতুলের খুব প্রিয়। বাবাকে সে ভয় পায় সত্য। কিন্তু ক্রিকেটও ছাড়ার কথা ভাবতে পারছে না। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে সে শুদ্ধকে ফোন দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করলো। তার দুলাভাই ভীষণ বুদ্ধিমান। এটা সে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিল৷ রাতুল মাঝে মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ফোন দেয়। রাতুল নিশ্চিত, সব সমস্যার মতো এই সমস্যার সমাধানও তার দুলাভাইয়ের নিকট থাকবে। এই ভেবে সে বাড়িতে সবসময় থাকা ফোনটা হাতে নেয়। শুদ্ধ'র নাম্বার বের করে তাতে কল দেয়। হঠাৎ শুদ্ধ'র ফোনে ধারাদের বাড়ি থেকে কল এসেছে দেখে শুদ্ধ অবাক হয় না। সে জানে কে হবে? এর আগেও রাতুল এই নাম্বার দিয়ে অনেকবার ফোন করেছে। শুদ্ধ কল রিসিভ করে ফোন কানে নেয়। রাতুল খুশিমনে কিছু কথা বলার পর যখনই তার সমস্যার কথা তুলতে যাবে তখনই তাদের বাসায় আগমন ঘটে তার বাবা আর চাচার। সাথে ধারাও। বাড়িতে তাদের পা পড়তেই একধরনের হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। আজিজ সাহেবের মাথা প্রচুর গরম। হঠাৎ আকস্মিক কোলাহলে ভয় পেয়ে রাতুল ঝট করে ফোন কান থেকে নামিয়ে সেই সোফার উপরে ফেলে রেখেই সেখান থেকে চলে যায়। ধারার অবস্থা একদম পর্যুদস্ত। আসমা আর জমিরন উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসে। আজিজ সাহেব ধারার কাছে এসে দায় ছাড়া স্বরে বলতে থাকে,
'ধারা, তোমার বিয়ে ওখানে দিয়ে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তবে ব্যাপার না। এখনও সব ঠিক করা যাবে। তুমি ঐ ছেলেকে ছেড়ে দিবে।'

ধারা ঝট করে ও'র বাবার মুখের দিকে তাকায়। অশ্রু জমা স্তব্ধিত দুটি চোখ অপলক চেয়েই রয়। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন,
'কালকে সকালে আমি উকিলকে আসতে বলবো। তার সাথে কথা বার্তা হবে। কিভাবে কি করতে হবে জানা যাবে। তারপর তুমি ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।'

ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই দ্রুত বলে উঠে, 'না।'

কখনো হয়তো মেয়ের মুখে না শব্দটা শুনেনি বলেই আজিজ সাহেব সাথে সাথেই কথাটা ধরতে পারেন না। উত্তর 'হ্যাঁ' মনে করে তিনি মাথা দুলিয়ে উঠতেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পান। দ্রুত ঘুরে বলে উঠেন,
'কি?'
বাবার দিকে তাকিয়ে ধারা স্পষ্ট করে বলে,
'আমি তাকে ছাড়তে পারবো না।'

আজিজ সাহেব মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন,

'কেন?'

ধারা বিনা দ্বিধায় বলল,
'আমি শুদ্ধকে ভালোবাসি।'

এই পুরো কথোপকথনটিই ফোনের ওপার থেকে শুনলো একজন। শুনে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপের এক শিহরিত অদৃশ্য কম্পন একদম স্থির করে ফেললো তাকে।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply


Messages In This Thread
RE: হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান) - by Bangla Golpo - 02-06-2024, 11:06 AM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)