29-05-2024, 07:05 AM
পর্ব -২০
সারাটা দিনই বাস স্ট্যান্ডে পড়ে রইলো শুদ্ধ। বাড়ি ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা বোধ হলো না। রাতের বেলা তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। পাশের চায়ের স্টলের এক বুড়ো লোক শুদ্ধ'র গায়ের জ্বর দেখে নিজের ঝুপড়ি মতো ঘরটায় আশ্রয় দিলো। নিজের দূর্বল হাতের সেবায় জ্বর নামানোর প্রয়াসও করলো। শেষ রাতের দিকে জ্বর নেমে গেলো বটে তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ নেতিয়ে রইলো। যতোটা না শরীরে, তার চাইতেও বেশি মনে৷ সকাল নাগাদ সে ফিরে এলো নিজ বাড়িতে। খোদেজা তখন দাওয়ায় কুলো পেতে মড়া চাল বাছতে বসেছিল। শুদ্ধ'র এমন উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে চিন্তামুখে প্রশ্ন করলো,
'কিরে মাহতাব, এতো তাড়াতাড়িই চলে আসলি যে! রাতের বাসে রওনা দিছিলি? বউ কই?'
শুদ্ধ আস্তে করে মায়ের পাশে বসে পড়ে। ফ্যাকাসে একটা হাসি দিয়ে বলে, 'ধারা পরীক্ষা দিতে আসে নাই আম্মা।'
খোদেজা অবাক হয়ে বলল, 'আসে নাই মানে?'
কথা বলতে বলতে শুদ্ধ'র গলা হঠাৎ ধরে এলো। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে শুদ্ধ ধরা গলায় বলল, 'আমি ধারার উপর ভরসা করেছিলাম। ও আমার ভরসা রাখতে পারে নাই আম্মা। রাখতে পারে নাই!'
কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধ'র চোখ বেঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যে অশ্রুতে মিশে থাকে এক বুক হাহাকার।
এরপর সময় গড়ায়, দিনের পরের দিন যায়। শুদ্ধ ধারার প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলে না। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যস্ত করে ফেলে কাজে। খোদেজা ধারাকে নিয়ে যখনই কিছু বলতে যায় শুদ্ধ পাশ কাটিয়ে যায়। এমনিতেও যথেষ্ঠ সময় অপচয় করে ফেলেছে সে। নিজের কাজ ব্যতীত এখন আর অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না। ধারাকে নিয়ে তো একদমই না। খোদেজা বিচলিত বোধ করে। ওদের সম্পর্কটা কি কোনদিনও ঠিক হবে না?
__________________________________________
আসমা বেশ কিছুদিন ধরেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। দুশ্চিন্তা তার মেয়েটাকে নিয়ে। ধারাকে নিয়ে। ধারা আজকাল শুধু বিষন্ন হয়ে থাকে৷ ঠিকমতো খায় না। রাত হলেই তার রুম থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। বেশ কিছুদিন এই কান্নার শব্দ ধারার রুমের বাহিরে শুনেছে আসমা। ধারাকে এ নিয়ে খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ধারা কিছু বলে না। নানা কথায় পাশ কাটিয়ে যায়। এমন না যে ধারা সবসময়ই হাসি খুশি থাকা মেয়ে। সে চুপচাপ স্বভাবেরই। বাড়িতেও খুব একটা কথা বলে না। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। হঠাৎ কি এমন হলো আসমা ভেবে পায় না। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পরও তো ঠিকই ছিল। তারপরই হঠাৎ কি হলো! আসমা মনে মনে মেয়ের জন্য একবুক প্রার্থনা করে আল্লাহ'র কাছে। মেয়েটার জন্য তার ভারী কষ্ট হয়। কখনো কারো কথার বাইরে যায় না ধারা। তবুও এ বাড়ির সবার তার প্রতি শত শত অভিযোগ। এখানে মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় যেন প্রাণটা হাতে নিয়ে ঘুরে। একটু মন খুলে কথা বলতেও যেনো কত সংকোচ। আর হবেই বা না কেন? এ বাড়ির পরিবেশটাই এমন। আসমা গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাতের কাজ সেড়ে ধারাকে খুঁজতে যায়।
ছাদের কোণে স্টিলের দোলনায় বসে আছে ধারা। আজ তিন, চারদিন হয়ে গেলো ধারা এ বাড়িতে। সেদিন সেই যে শুদ্ধ পরীক্ষার দিন ধারাকে অনবরত ফোন করেছিল তারপর থেকে আর একটা ফোনও করেনি। ধারারও আর শুদ্ধ'র সামনে দাঁড়ানোর মতো কোন মুখ ছিলো না। তাই শত ইচ্ছার পরও সেও ফোন করতে পারেনি। আর না পেরেছে ও বাড়িতে ফিরে যাবার কথা ভাবতে। সে যা করেছে তার পর আর কিভাবেই বা শুদ্ধ'র সামনে দাঁড়াবে ধারা! তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ধারা গতকাল রাতে শুদ্ধকে ফোন করেছিল। একবার, দুইবার তারপর বারবার। কিন্তু শুদ্ধ তার ফোন ধরেনি। একবারের জন্যও না। ভাবনার ভেতরেই যা ছিল আদৌও তাই ঘটার পরও যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলো। দিনের আলোয় ছাদে নিরিবিলি বসেও ধারা এতক্ষণ সেই নিরর্থক প্রয়াসই করছিল। তখন আসমা এলো তার পেছনে। ধারার কাঁধে হাত রাখার পর ধারা মাথা ঘুরাতেই দেখলো মেয়ের কানে ফোন আর চোখে অনবরত ঝরে পড়া অশ্রুমালা। আসমা আঁতকে উঠে বলল,
'কি হয়েছে ধারা?'
ধারা মায়ের কোমর জাপটে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'আমি এমন কেন হলাম মা? কেন এমন হলাম? দাদী আমাকে নিয়ে যা যা বলে ঠিকই বলে। আমাকে এক্ষুনি রূপনগরে নিয়ে যাও মা।'
__________________________________________
খোদেজা মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছে। চারপাশে এলোমেলো হয়ে আছে রান্নার সরঞ্জাম। কাজে তার মন নেই। সর্বক্ষণ উদ্গ্রীব ছেলের জন্য। তার প্রিয় মাহতাবের জীবনে একটার পর একটা এসব কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। আজ গরমটা যেন একটু বেশিই। রোদের তেজ কমার নামই নিচ্ছে না। খোদেজা আঁচল দিয়ে একবার কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নেয়। ঠিক সেই সময় তার উঠোনে এসে হাঁক পারে এক ফকির বাবা। রান্না ঘর থেকে উঁকি দিয়ে খোদেজা দেখে নোংরা একটা লম্বা জামা গায়ে এলোমেলো চুল বড় বড় নখের এক লোক এসে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা কাপড়ের পুটলী ঝুলানো। গলায় আর হাতে অনেকগুলো তাবিজ। খোদেজা বাইরে বেড়িয়ে এলে ফকির বেশের লোকটি বলে,
'এক গ্লাস পানি খাওয়াও মা।'
লোকটাকে বেশভূষায় খোদেজার সাধারণ মনে হয় না। সে এসব ফকির তাবিজে বিশ্বাসী। অপরিচিত লোকটাকে গন্য করে সে ভেতর থেকে পরিষ্কার এক গ্লাসে পানি নিয়ে আসে। ফকির লোকটা খোদেজার ঘরের দাওয়ায় বসে সময় নিয়ে পানি খায়। তারপর খোদেজার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
'তুই নিশ্চয়ই কোন অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। সমস্যার সমাধান এখনই না করলে সামনে তোর ঘোর বিপদ।'
খোদেজার মনের দুশ্চিন্তা তার চেহারায় স্পষ্ট। শুধু ফকির বাবা না যে কেউ দেখলেই বুঝে যাবে। কিন্তু এতটুকু তেই ফকির লোকটার প্রতি খোদেজার বিশ্বাস পাকা পোক্ত হয়ে যায়। তার ছেলের জীবনে এতো ঝামেলা হচ্ছে বলে সে একবার ভাবে যদি এর কোন সমাধান ফকির বাবার কাছে থাকে! তাই খোদেজা অনুরোধের সুরে বলে, 'আপনি ঠিকই বলতাছেন। আমার ছেলেটার জীবনে কিচ্ছু ঠিক হইতাছে না। একটার পর একটা অশান্তি হইতাছে। আপনের কাছে কি এর কোন সমাধান আছে?'
ফকির লোকটা গাম্ভীর্য্যের ভাব ধরে থম মেরে খোদেজার সব কথা শুনে বলে,
'হুম, বুঝতে পারছি। চিন্তা করিস না। একটা তাবিজ দিলেই ঠিক হইয়া যাইবো। আমি এক্ষুনি প্রস্তুত কইরা দিতাছি। তাবিজের দাম পাঁচশো টাকা। এইটা লাগাইলে তোর পোলার সব বালা মুছিবত কাইটা যাইবো।'
খোদেজা রাজী হয়ে যায়। পুকুরপাড় দিয়ে ক্ষেত থেকে তখন ফিরছিল শুদ্ধ। উঠোনে মায়ের সাথে ফকির বেশের লোকটাকে দেখেই তার কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়। তার মা আবার এসব মিথ্যা ভন্ডামীর চালে পড়ছে! শুদ্ধ ভেবে নেয় লোকটার সামনে গিয়েই একটা আচ্ছা মতো ধমক লাগাতে হবে। সে দ্রুত পা চালায়।
এইদিকে ফকির লোকটা তার পুটলি থেকে একটা তাবিজ আর কালো সুতা বের করে বলে,
'কাজটা কিন্তু অতো সহজ না। এর জন্য তোর পোলার জন্ম তারিখ, সাল আর মায়ের নাম মানে তোর নাম বলতে হবে। শোন, মায়ের নামটা কিন্তু একদম আসল টা বলবি। যেটা বাপ মায়ের দেওয়া। ডাক নাম টুক নাম কিন্তু হইবো না।'
খোদেজা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করলো। আস্তে আস্তে করে শুদ্ধ'র জন্ম তারিখ বলল। আর মায়ের নামের জায়গায় খুব সময় নিয়ে বলল, 'নুরুন্নাহার।'
ফকির লোকটির দৃষ্টি হঠাৎ খোদেজার পাশে গেলো। দেখলো একটি ছেলে অবাক মুখে খোদেজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফকির লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে খোদেজাও তাকালো সেদিকে। দেখে তার হুঁশ উড়ে গেলো। বাড়িতে পুরুষের উপস্থিতি দেখে এই ফাঁকে কেটে পড়লো ফকির লোকটি। দ্রুত দু কদম খোদেজার দিকে এগিয়ে এলো শুদ্ধ। সন্ধিগ্ন চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'আম্মা, তুমি আমার মায়ের নামের জায়গায় তোমার নাম না বলে নুরুন্নাহার বললে কেন?'
প্রশ্ন শুনে খোদেজার গলা শুকিয়ে এলে। চেহারাটা মুহুর্তের মধ্যেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার।
চলবে***********।
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)