17-06-2019, 05:48 PM
খুন ও খুনের তদন্ত
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার ছাড়া বাকি তিনজন গাড়ির থেকে নেমে আসে। সামনের সিটের লোকটা বলে, ‘কি বললি?’
অশোক করুন স্বরে বলে, ‘স্যার, এইভাবে থাকলে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমাকে নামান, আমি সব বলব।’
মুখোশ পরা দুজন গাড়ির উপরে উঠে দড়ির ফাঁসটা গলার থেকে খুলে অশোককে নামিয়ে আনে। আর হাতের বাধন খুলে দেয়। সামনের সিটের লোকটা গাড়ির ভেতর থেকে জলের একটা বোতল বার করে অশোকের হাতে ধরিয়ে দেয়। অশোক ঢক ঢক করে বেশ অনেকটাই জল খেয়ে নেয়।
অশোক যা বলে তা শুনে তিনজনই ভীষণ চমকে ওঠে। অশোকের বক্তব্যের সারমর্ম যেটা দাড়ায় সেটা হল-
অশোকদের আদি বাড়ি এই ভাগলপুরে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় অশোকের বাবা রমাকান্ত খুব ছোট বয়সে কাজের সন্ধানে রায়পুর চলে আসে। এখানে অশোকের বাবা রমাকান্তের যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন সে দেবনারায়ন বাবুর বাড়িতে অস্থায়ি মালি হিসাবে কাজে যোগ দেয়। রমাকান্ত যেমন সৎ ছিল তেমনি পরিশ্রমী ছিল। কিছুদিনের মধ্যে রমাকান্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাগানটা ফলে ফুলে ভরে যায়। রমাকান্তের কাজে খুশি হয়ে দেবনারায়ন বাবু তাকে পার্মানেন্ট মালি হিসাবে নিযুক্ত করেন। আর তার থাকার জন্য বাগানের ধারে একটা ঘর বানিয়ে দেন। ভাগলপুর এখন আধা মফঃস্বল হলে কি হবে তখন এটি একটি গ্রাম ছিল। যেহেতু আগেকার দিনে গ্রামে গঞ্জে খুব কম বয়সে ছেলে মেয়েদের বিয়ের চল ছিল। তাই এর এক দেড় বছরের মাথায় বাড়ির লোকেরা রমাকান্তের বিয়ে দিয়ে দেয়। রমাকান্তের মাকে দেখাশোনা করার জন্য রমাকান্তের বৌকে এই ভাগলপুরে থেকে যেতে হয়। রমাকান্ত একাই দেবনারায়ন বাবুদের বাড়িতে থাকত। ছুটি ছাটায় বাড়িতে আসত। বিয়ের তিনবছর পরে অশোক জন্মায়। রমাকন্ত যেমন কাজের লোক ছিল তেমনি ভীষণ অমায়িক ছিল। কিছুদিনের মধ্যে সে বাড়ির সবার মন জয় করে নিয়েছিল। বলতে গেলে সে বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল।
দেবনারায়ন বাবু ও তার স্ত্রী রমাকান্তকে ভীষণ স্নেহ করতেন। রমাকান্ত দেবনারায়নবাবুকে মালিক আর ওনার স্ত্রিকে মা বলে সম্বোধন করত। আবার রমাকান্ত বিরেনের থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড় ছিল। ফলে বিরেন ও সুরেন এই দুই ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মত ছিল। তবে রমাকান্ত দুই ভাইকে বড় সাহেব আর ছোট সাহেব বলে সম্বোধন করত। সুরেনের নানারকম ফুলের প্রতি ন্যাক ছিল তাই সে রমাকন্তের কাছে ফুল গাছের কিভাবে যত্ন নিতে হয় সেটা শেখার চেষ্টা করত। আবার বিরেনের ছিল ক্যামেরায় ফটো তোলার নেশা। এই কারনে দেবনারায়ন বাবু তার বড় ছেলেকে দামি ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। বিরেনের আরও একটা নেশা ছিল গুলতি, তির ধনুকের প্রতি। এই গুলতি, তির ধনুক রমাকান্ত বানিয়ে দিত আবার চালান শিখিয়ে দিত। আর তার বিনিময়ে বিরেন ক্যামেরায় কিভাবে ছবি তুলতে হয় সেটা রমাকান্তকে শেখাত। এইভাবে রমাকান্তের এখানে বেশ ভালভাবে দিন কাটতে থাকে।
এরপরে বিরেন ও সুরেন প্রাপ্তবয়স্ক হলে এক এক করে বিয়ে হয়। দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলেকে অন্ধের মত ভালবাসতেন। তাই দেবনারায়ন বাবু ছোট ছেলে আর ছোট ছেলের বৌকে নিয়ে দক্ষিণ মহলে চলে আসেন। উত্তর মহলে থাকত বড় ছেলের ফ্যামিলি। বড় ছেলের বৌ ঋতম্ভরা ছিল শান্ত শিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির। আর ছোট ছেলের বৌ বিনোদিনী ছিল একটু চঞ্চল প্রকৃতির কিন্তু মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। এই দুজনকে রমাকান্ত বড় বৌদি আর ছোট বৌদি বলে সম্বোধন করত। তবে বিনোদিনী শ্বশুরকে ভীষণ তোয়াজ করে চলত। আবার ঋতম্ভরা শ্বশুরকে যেমন শ্রদ্ধা করত তেমনি সমিহ করে চলত। এরপরে বড় ছেলে বিরেন ও ঋতম্ভরার এক এক করে তিনটি ছেলে হয় আবার ছোট ছেলে সুরেন ও বিনোদিনীর একটি ছেলে হয়। ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতিদের নিয়ে দেবনারায়ন বাবুর বেশ সুখেই দিন কেটে যায়।
হঠাৎ দেবনারায়নের ছোট ছেলে সুরেনের অকাল প্রয়ান ঘটে। সুরেনের মৃত্যুর পরেই রায় পরিবারে ভাঙ্গন শুরু হয়। দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলেকে অসম্ভব ভাল বাসতেন। সেই ছোট ছেলের অকাল মৃত্যুতে দেবনারায় বাবু মানসিক দিক থেকে ভেঙ্গে পড়েন। এইসময় বিরেন বাবার সাথে দুরত্ব কমানোর একটা চেষ্টা করেন। কিন্তু বিনোদিনী সবসময় শ্বশুরকে আগলে আগলে রাখত। আবার শ্বশুরের আমলে যে দুজন বাড়ির কাজের লোক ছিল তাদের বিনোদিনী দেবি তাড়িয়ে দিয়ে কুসুম নামের একজন নতুন কাজের মহিলাকে নিয়োগ করেন। কুসুম বিনোদিনীর দুবছরের ছেলের দেখভালের থেকে বাড়ির সব কাজ করত। কুসুম পুরোপুরি বিনোদিনী দেবির ইশারায় চলত। ফলে বিরেন তার বাবার কাছে ঘেষতে পারে না। রমাকান্তের নিজস্ব ধারনা সে যেহেতু দক্ষিণ মহলের বাইরে থাকে আর সামান্য মালির কাজ করে তাই তার চাকরিটা বেঁচে যায়। এদিকে দেবনারায়ন বাবু ক্রমশ বিনোদিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
দেবনারায়নের ছোট ছেলে সুরেন একটু ভলেভালা প্রকৃতির তাই দেবনারায়ন বাবুর ধারনা ছিল তার অবর্তমানে বড় ছেলে বিরেন সম্পত্তির ভাগ থেকে ভাইকে বঞ্চিত করতে পারে। সেই আশঙ্কায় দেবনারায়ন বাবু অনেক আগেই তাদের ছোট নাগপুরের কলিয়ারিটার অর্ধেক মালিকানা সুরেনের নামে আর বাকি অর্ধেকের মালিকানা নিজের হাতে রেখেছিলেন। আর তার অন্যান্য ব্যবসার সত্তর ভাগ নিজের হাতে রেখে বাকি তিরিশ ভাগ বিরেনকে দিয়ে দিয়েছিলেন। দেবনারায়ন বাবু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন বড় ছেলে বিরেনের মতিগতি যদি ঠিকঠাক থাকে আর ছোট ছেলে সুরেন যদি ব্যবসাটা ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে তবে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান ভাবে দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কিন্তু সুরেনের হঠাৎ মৃত্যু দেবনারায়নবাবুর সব চিন্তাভাবনা ওলট পালট করে দেয়।
এদিকে সুরেনের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী বিনোদিনী দেবির স্বরুপ ধিরে ধিরে প্রকাশ পেতে শুরু করে। স্বামির শোক কাটিয়ে উঠে বিনোদিনী দেবি শ্বশুরের মত নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। কিছুদিনের মধ্যেই বিনোদিনী দেবির ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ক্রমশ প্রকাশ পায় বিনোদিনী দেবি যেমন ধূর্ত তেমনি অসম্ভব বুদ্ধিমতি ছিলেন। ছলাকলায় পুরুষমানুষকে কিভাবে বশ করতে হয় সেটা বিনোদিনীর ভালই জানা ছিল। শ্বশুরকে পুরোপুরি নিজের বশে নিয়ে বিনোদিনী ঝোপ বুঝে কোপ মারতে শুরু করেন। শ্বশুরকে দিয়ে সম্পত্তি নিজের নামে লেখাতে শুরু করেন। দেবনারায়ন বাবু যখন ছোট বৌমার অভিসন্ধি বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ছোট নাগপুরের কলিয়ারি আর বিরেনের নামে যে ব্যবসাগুলো ছিল সেগুলো বাদ দিয়ে দেবনারায়নের নামে আর যেসব ব্যবসা ছিল তার সবটাই বিনোদিনী পাকাপাকি ভাবে নিজের নামে লিখিয়ে নেয়।
দেবনারায়ন বাবু নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন। তার বড় ছেলে যাতে ছোট ছেলেকে ঠকাতে না পারে তার জন্য তিনি বিনোদিনীর মত বুদ্ধিমতি মেয়ের সাথে ছোট ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। ছোট বৌমা তার পুরো পরিবারটাকে পথে বসাতে চলেছে। দেবনারায়নবাবু অনেকভাবে তার বড় ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কিন্তু বিনোদিনী আর কুসুমের জন্য সেটা সম্ভব হয় না।
বিনোদিনী দেবি এরপরে শ্বশুরকে ছোট নাগপুরের কলিয়ারিটা পুরো তার নামে লিখে দেবার চাপ সৃষ্টি করে তখন দেবনারায়ন বাবু বেঁকে বসেন। কিছুতেই কলিয়ারির পুরো মালিকানা বিনোদিনী দেবির নামে লিখে দিতে রাজি হননা। এই নিয়ে শুরু হয় শ্বশুর বৌমার তুমুল অশান্তি, মনোমালিন্য। দেবনারায়নবাবু বুঝতে পারেন তিনি নিজে পছন্দ করে বাড়িতে কালসাপ নিয়ে এসেছেন। এই কালসাপের ছোবলে তার পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যাবে। ছোট বৌমার লোভের জন্য তার বড় ছেলের পরিবার পথে গিয়ে বসবে। নিজের ভুল সিধান্তের জন্য অনুশোচনা হয়।
তার দ্রুত শরীর, স্বাস্থ ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনেও ছোট বৌমার হাত আছে বলে দেবনারায়ন বাবুর মনে সন্দেহ দেখা দেয়। দেবনারায়ন বাবু বুঝতে পারেন তিনি এখন বিনোদিনীর হাতের পুতুল হয়ে গেছেন। তিনি শারিরিক ও মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়েন যে ছোট বৌমার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতাটুকুও তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। দেবনারায়ন বাবু বুঝতে পারেন তাকে ভুল বুঝিয়ে বিনোদিনী অনেক সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু ছোটনাগপুরের কলিয়ারিটি তার হাতে রয়েছে। এর থেকে তার বড় ছেলে বিরেন যাতে বঞ্চিত না হয় দেবনারায়ন বাবু তার একটা শেষ চেষ্টা করেন। রমাকান্তকে দিয়ে অত্যন্ত গোপনে উকিলবাবুকে ডেকে পাঠান।
উকিলবাবু আসতে দেবনারায়নবাবু ছোট নাগপুরের কলিয়ারির পুরো মালিকানা বড় ছেলে বিরেনের নামে করে দিতে বলেন। উকিলবাবু জানায় সেটা সম্ভব নয়। কারন এই কলিয়ারির অর্ধেক মালিকানা দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলে সুরেনের নামে করে দিয়ে বসে আছেন। এখন সুরেনের মৃত্যুর পরে এই শেয়ারের বৈধ অধিকারি তার স্ত্রী বিনোদিনী দেবি। দেবনারায়ন বাবুর হাতে যেটুকু শেয়ার আছে শুধুমাত্র সেইটুকু বিরেনের নামে ট্রান্সফার করা যেতে পারে। দেবনারায়ন বাবুর আর কিছু করার থাকে না। অগত্যা উকিলবাবুকে তার অংশটুকু বিরেনের নামে ট্রান্সফার করে দিতে বলেন।
এর কিছুদিন পরে বিনোদিনী দেবি জানতে পারেন ছোট নাগপুরের কলিয়ারির শ্বশুরের শেয়ার তার ভাসুর বিরেনের নামে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। খবরটা শুনে বিনোদিনী দেবি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষেপে যান। বাড়িতে ফিরে তাণ্ডব শুরু করেন। বিনোদিনী দেবির মুখোসটা খসে গিয়ে আসল রূপটা বেরিয়ে আসে। শ্বশুরমশাইকে যা নয় তাই বলে অপমান শুরু করেন। বিনোদিনীর এই ভয়ঙ্কর রুপ দেখে রমাকান্ত ভয়ে কুঁকড়ে যায়।
দেবনারায়ন বাবুকে রমাকান্ত অসম্ভব শ্রদ্ধা ভক্তি করত। মালিকের এই অপমান সে সহ্য করতে পারে না। এই অশান্তির হাত থেকে মালিককে বাঁচানর জন্য সে একদিন মালিককে একা পেয়ে বলে যে ছোট বৌদি যেটা চাইছে সেটা করে দিতে। রমাকান্ত অশিক্ষিত, হিসেব নিকেস কিছুই বোঝে না। তাই রমাকান্তের কথায় দেবনারায়ন বাবু কিছুই মনে করেন না বরং তাকে অবস্থাটা বুঝিয়ে বলেন। ছোটনাগপুরের কলিয়ারি ছাড়া দেবনারায়ন বাবুর আর যেসব ব্যবসা আছে তার সত্তর ভাগ ছোট বৌমা নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। বড় ছেলের যেখানে ন্যায্য পাওনা পঞ্চাশ ভাগ সেখানে সে মাত্র তিরিশ ভাগ পেয়েছে। এই কলিয়ারির ব্যবসাটা তাদের মূল ব্যবসা। এখন এখান থেকেও যদি বড় ছেলেকে বঞ্চিত করা হয় সেটা খুব অন্যায় হবে। রমাকান্ত এইবারে পরিস্কার বুঝতে পারে এই বাড়ির ছোট বৌ খুব লোভী, এত কিছু পাবার পরেও ছোট বৌদির লোভের শেষ নেই। এই লোভ পরিবারটাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাড় করাবে সেটা ভেবে রমাকান্ত মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
কিছুদিনের মধ্যে রমাকান্তের আশঙ্কা সত্যি হয়। দক্ষিণ মহলের বাইরে গা ঘেষে রমাকান্তের থাকার ঘর। একদিন মাঝরাতে একটা গাড়ি থামার অওয়াজে রমাকান্তের ঘুম ভেঙ্গে যায়। শিতের রাত তাই রমাকান্ত চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে গাড়ির থেকে একটা ছায়ামূর্তি তাদের পাচিলের গেট খুলে ঢুকে আসছে। রমাকান্ত তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। লোকটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রমাকান্ত গাছের আড়াল থেকে লোকটাকে ভাল করে দেখতে পায়। লোকটা প্রায় ছফুটের মত লম্বা, চোখ মুখে হিংস্র ভাব, দৈত্যাকার চেহারা। লোকটার চেহারা দেখে রমাকান্ত বেশ ভয় পেয়ে যায়। লোকটা সদর দরজায় তিনবার টোকা দিতেই দরজা খুলে যায়। অবাক হয়ে দেখে বিনোদিনী দেবি দরজা খুলে লোকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়।
মাঝরাতে এইরকম একটা ষণ্ডা মতন লোক যে কোন ভাল উদ্দেশ্যে আসেনি সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি রমাকান্তের আছে। বাড়ির ছোট বৌ যে এই লোকটাকে ডেকে এনেছে সেটাও বুঝতে রমাকান্তের বাকি থাকে না। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে লোকটা এসেছে সেটা রমাকান্তের মাথায় ঢোকে না। হঠাৎ রমাকান্তের মনে মালিকের জন্য দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। মালিকের কোন ক্ষতি করার জন্য এই লোকটাকে ডাকা হয়নি তো, এটা ভেবে রমাকান্তের বুকে ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বিমূঢ় বিহ্বলের মত কিছু সময় রমাকান্ত গাছের নিচে দাড়িয়ে থাকে। মালিকের কথা ভেবে রমাকান্তের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। স্বয়ংচালিত যন্ত্রের মত রমাকান্ত দক্ষিণ মহলের দিকে হাটা দেয়।
সদর দরজা ঠেলে খুব সন্তর্পণে রমাকান্ত বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসে। দেখে বাড়ির ভেতরে খুব অল্প পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। একটা ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, রমাকান্তের বুক ঢিপঢিপ করে। বাড়ির কাজের মেয়ে কুসুমকে কোথাও দেখতে পায় না। মালিকের ঘরটা রমাকান্তের চেনা আছে, তাই সে পা টিপে টিপে মালিকের ঘরের জানলার নিচে গিয়ে দাড়ায়। ধিরে মাথা উঠিয়ে ঘরের মধ্যে দৃষ্টি দেয়। দেখে মালিক খাটের উপরে শুয়ে আছে। আর খাটের পাশে বিনোদিনী দেবি ও ষণ্ডা মতন লোকটা দাড়িয়ে আছে। মালিককে দেখে মনে হয় গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এবারে লোকটা তার এক পকেট থেকে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করে। আর অন্য পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের শিশি বার করে। লোকটা সিরিঞ্জের ছুঁচটা ওষুধের শিশির মধ্যে ঢুকিয়ে সিরিঞ্জটা ভরে নেয়।
এই দেখে রমাকান্তের বুকের ওঠানামা বেড়ে যায় আবার, দরদর করে ঘামতে থাকে। এরপরে লোকটা ইনজেকশনটা হাতে নিয়ে বিনোদিনী দেবিকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘুম থেকে উঠে যাবে নাতো?’
বিনোদিনী দেবি হেসে বলে, ‘না, কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাবারের সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। খুব সহজে ঘুম ভাংবে না।’
লোকটা সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কুসুম?’
‘ভয় নেই, কুসুমকেও ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি, সকালের আগে উঠবে না।’
বিনোদিনী দেবির ভয়ংকর কথা শুনে রমাকান্তের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ভয়ে আতঙ্কে রমাকান্তের রক্ত জল হয়ে যায়।
‘ছুঁচটা এমন ভাবে ফোটা যাতে ছুচের দাগ বোঝা না যায়।’
বিনোদিনীর মুখে এই কথা শুনে রমাকান্তের মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। কি ভয়ঙ্কর খুনে মহিলাকে মালিক নিজের ছোট ছেলের বৌ করে নিয়ে এসেছে এটা ভেবে রমাকান্তের শরীর অবশ হয়ে আসে।
এরপরে লোকটা ইনজেকশনের ছুঁচটা মালিকের পায়ে ফুটিয়ে দিয়ে ধিরে ধিরে সিরিঞ্জের সব ওষুধটা মালিকের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। ছুঁচটা ফুটতে মালিক সামান্য একটু নড়ে ওঠে কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে না।
বিনোদিনী দেবি লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ইনজেকশনটা কাজ করবে তো?’
লোকটা নির্বিকার ভাবে বলে, ‘যা ওষুধ দিয়েছি তাতে আধঘণ্টার মধ্যে হার্টফেল করে মারা যাবে। পুলিশ কিছু ধরতে পারবে না।’
এদের কথা শুনে রমাকান্তের মাথা ঘুরে যায়। দেওয়ালটা ধরে কোনরকমে টাল সামলায়। আর আধ ঘণ্টা পরে মালিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এখানে থাকাটা যে সমুহ বিপদের সেটা রমাকান্ত বুঝতে পারে। এদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। যারা দেবনারায়নের মত নামি লোককে খুন করতে দ্বিধা করে না, তার মত সামান্য মালিকে মেরে ফেলতে এরা এক মুহূর্ত সময় নেবে না। পা টিপে টিপে রমাকান্ত দক্ষিণ মহল থেকে বেরিয়ে আসে।
নিজের ঘরে ফিরে এসে রমাকান্ত খাটে বসতে বা শুতে পারে না, চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে ঘরময় পায়চারি করে। শরীরটা অস্থির অস্থির করে, শিতকালের রাতেও দরদর করে ঘামতে থাকে। রমাকান্ত এই মৃত্যুপুরী থেকে পালানোর চিন্তা করে। কিন্তু রমাকান্ত এটাও বোঝে বিনোদিনী দেবি যদি কোনভাবে বুঝে যায় যে সে এই ব্যাপারটা জেনে গেছে তাহলে তাকেও রেহাই দেবে না। বিনোদিনী দেবির এক ইশারায় তাকেও পৃথিবীর থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। যারা দেবনারায়ন বাবুর মত জাঁদরেল লোককে মেরে ফেলার হিম্মত রাখে তারা তো পিঁপড়ের মত তাকে পায়ের তলায় পিশে মেরে ফেলবে। এখন তার কি করনীয় সেটা রমাকান্ত কোনভাবেই ভেবে উঠতে পারে না। শুধু এটুকু তার মগজে খেলে যে বিনোদিনী দেবিকে কোনভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে এই খুনের ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে। সারারাত রমাকান্তের চোখে ঘুম আসে না, ঠায় বসে থাকে।
দেবনারায়নের মত নামকরা লোকের অস্বাভাবিক মৃত্যু, ফলে পরেরদিন সকালেই পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায়। রমাকান্তকেও পুলিশ জেরা করে। রমাকান্তের খুব সংক্ষিপ্ত জবাব, সে সারারাত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে, রাতে সে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি বা শোনেনি। কিন্তু বিরেনবাবু এসে হল্লা শুরু করে দেয়। তার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে এই অভিযোগ পুলিশের কাছে বিরেনবাবু বারংবার জানায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিনোদিনী দেবি শ্বশুরের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছে এরকম একটা ভাব নিয়ে বসে থাকেন। এই মহিলাই গতকাল রাতে নিজের শ্বশুরকে লোক দিয়ে খুন করিয়েছে। তার কোনরকম লক্ষন বিনোদিনী দেবির মুখে চোখে দেখা যায় না। দুঃখে কাতর হয়ে চুপ করে বসে থাকে, চোখে দিয়ে অবিরত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। বিনোদিনী দেবির এই অভিনয় দেখে রমাকান্ত অবাক হয়ে যায়।
রমাকান্ত একবার মনে মনে ভাবে গতকালের ঘটনাটা বিরেনবাবুকে জানিয়ে দেবে। তবে এটাও রমাকান্ত জানে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার প্রান যায়। বিরেনবাবু আর বিনোদিনী দেবি দুই রথী মহারথীর যুদ্ধ হবে আর মাঝখান থেকে তার মত সামান্য মালির প্রাণটা যাবে। রমাকান্ত তাই কথাটা বিরেনবাবুকে বলার ভরসা পায় না। আবার পুলিশকে রমাকান্ত একটুও বিশ্বাস করে না। পুলিশ মানেই বড় লোকদের পক্ষে কথা বলবে আর তার মত গরিব মানুষদের ফাসিয়ে দেবে। রমাকান্ত মুখে কুলুপ এঁটে থাকাটাই মনস্থির করে। আর মালিকের বিচারের ভার ভগবানের হাতে ছেড়ে দেয়।
কয়েকদিন পরে রমাকান্ত খবর পায় পুলিশ দেবনারায়ন বাবুকে খুন করা হয়েছে বলে মনে করছে। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টও নাকি তাই বলছে। রমাকান্ত খবরটা শুনে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। তবে তার এই খুশির ভাবটা সে সম্পূর্ণ গোপন রাখে। বিনোদিনী দেবির মত খুনে মহিলা যদি সামান্য কিছু আঁচ পায় তবে তার বিপদ ঘনিয়ে আসতে সময় নেবে না। এই সময় বিরেন বাবুর হম্বি তম্বি বেড়ে যায় আর বিনোদিনী দেবি একটু চুপসে যান।
এরপরেই দক্ষিণ মহলে বড় বড় নেতা ও উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের আনাগোনা শুরু হয়। যথারীতি কিছুদিন পরে পুলিশের বক্তব্য আর পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দুটোই পাল্টে যায়। এর পেছনে কি খেলা রয়েছে সেটা রমাকান্তের মত নগন্য এক মালির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানায় দেবনারায়ন বাবু বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন তাই হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। আর পুলিশ আত্মহত্যার ঘটনা বলে কেসটা বন্ধ করে দেয়। বিরেন বাবু তার প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেকভাবে চেষ্টা করেন যাতে তার বাবার মৃত্যুর তদন্তটা পুলিশ সঠিক ভাবে করে। কিন্তু তার সব চেষ্টা বৃথা যায়। এদিকে বিনোদিনী দেবি আবার স্বমূর্তি ধারন করেন।
পুলিশ প্রথমদিকে খুনের কেস বলায় রমাকান্তের মনে আশার সঞ্চার হয়। মালিক তার খুনের বিচার পাবে এই আশায় রমাকান্ত বুক বাধে। কিন্তু পুলিশ যখন আত্মহত্যা বলে কেস বন্ধ করে দেয় আর খুনিকে বহাল তবিয়তে ঘুরতে দেখে রমাকান্ত তখন ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। রমাকান্তের ভয়ে ভয়ে দিন কাটতে থাকে। এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে যদি বিনোদিনী দেবির মনে কোন সন্দেহ হয় তবে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এই ভয়ে রমাকান্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে না।
রমাকান্ত মুখ বুজে নিজের কাজ করে যেতে থাকে। এর ফলে যেটা হয় রমাকান্তের শরীর ক্রমশ ভাঙতে শুরু করে, ঘন ঘন অসুস্থ হতে শুরু করে। এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তার সংসার কিভাবে চলবে এই ভেবে রমাকান্ত ভাঙ্গা মন ও ভাঙ্গা শরীর নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়। একদিন রমাকান্ত দক্ষিণ মহলের সামনে ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল সেই সময় বিরেনের স্ত্রী ঋতম্ভরা দেবি হাতে কয়েকটা চিঠি নিয়ে দক্ষিণ মহলের সামনে এসে উপস্থিত হয়। রমাকান্তকে দেখে ঋতম্ভরা দেবি জিজ্ঞেস করে, ‘রমাকান্ত কেমন আছ? বাড়ির সব খবর ভাল তো?’
‘হ্যা, বড় বৌদি, বাড়ির সবাই ভাল আছে। বড় সাহেব কোথায়? ছেলেরা সবাই কেমন আছে?’
‘তোমার বড় সাহেব ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। দু তিনদিন পরে ফিরবে। ছেলেরা সবাই ভাল আছে।’
‘বড় বৌদি, আপনাদের বাড়ির থেকে একটা সুন্দর মত ছেলেকে বেরোতে দেখলাম, ওটি কে?’
‘ও আমার ভাই, সব্যসাচী। এখানে কয়েকদিন থাকার জন্য এসেছে।’
‘যাইহোক, বড় বৌদি, এখানে কি মনে করে?’
‘কি আর বলব রমাকান্ত, পিয়নটা ভুল করে বিনোদিনীর চিঠি আমাদের লেটার বক্সে ফেলে গেছে। সেগুলো দিতেই এসেছি।’
‘কেন, বড় বৌদি, আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে চম্পা নেই। তার হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিতে পারতেন।’
‘বাড়িতে কেউ নেই। বড় আর মেজ ছেলে কলেজে গেছে। চম্পা আর সব্যসাচী দুজনে আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। আমি ছাড়া এখন বাড়িতে কেউ নেই, তাই চিঠিগুলো আমি দিতে এসেছি। যাইহোক রমাকান্ত, বিনোদিনী বাড়িতে আছে?’
রমাকান্ত বলে, ‘হ্যা, ছোট বৌদি বাড়িতেই আছে।’
ঋতম্ভরা দেবি আর দেরি না করে দক্ষিণ মহলে ঢুকে যায়। কিছুক্ষন পরেই রমাকান্ত দেখে ঋতম্ভরা দেবি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে প্রায় ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়ির দিকে চলে যায়। রমাকান্ত বেশ অবাক হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথেই বিনোদিনী দেবি বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে। রমাকান্তকে দেখে জিজ্ঞেস করে ঋতম্ভরা এসেছিল কিনা। রমাকান্ত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শুনে বিনোদিনী দেবি আবার বাড়িতে ঢুকে যায়। দুই বৌয়ের কাজ কারবার দেখে রমাকান্ত বেশ অবাক হয়। রমাকান্ত আবার নিজের কাজে মন দেয়।
বেশ কিছুক্ষন পরে একটা গাড়ি এসে দক্ষিণ মহলের সামনে এসে দাড়ায়। গাড়ির থেকে যে লোকটা নেমে আসে তাকে দেখে রমাকান্তের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়।
****************************************************
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার ছাড়া বাকি তিনজন গাড়ির থেকে নেমে আসে। সামনের সিটের লোকটা বলে, ‘কি বললি?’
অশোক করুন স্বরে বলে, ‘স্যার, এইভাবে থাকলে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমাকে নামান, আমি সব বলব।’
মুখোশ পরা দুজন গাড়ির উপরে উঠে দড়ির ফাঁসটা গলার থেকে খুলে অশোককে নামিয়ে আনে। আর হাতের বাধন খুলে দেয়। সামনের সিটের লোকটা গাড়ির ভেতর থেকে জলের একটা বোতল বার করে অশোকের হাতে ধরিয়ে দেয়। অশোক ঢক ঢক করে বেশ অনেকটাই জল খেয়ে নেয়।
অশোক যা বলে তা শুনে তিনজনই ভীষণ চমকে ওঠে। অশোকের বক্তব্যের সারমর্ম যেটা দাড়ায় সেটা হল-
অশোকদের আদি বাড়ি এই ভাগলপুরে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় অশোকের বাবা রমাকান্ত খুব ছোট বয়সে কাজের সন্ধানে রায়পুর চলে আসে। এখানে অশোকের বাবা রমাকান্তের যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন সে দেবনারায়ন বাবুর বাড়িতে অস্থায়ি মালি হিসাবে কাজে যোগ দেয়। রমাকান্ত যেমন সৎ ছিল তেমনি পরিশ্রমী ছিল। কিছুদিনের মধ্যে রমাকান্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাগানটা ফলে ফুলে ভরে যায়। রমাকান্তের কাজে খুশি হয়ে দেবনারায়ন বাবু তাকে পার্মানেন্ট মালি হিসাবে নিযুক্ত করেন। আর তার থাকার জন্য বাগানের ধারে একটা ঘর বানিয়ে দেন। ভাগলপুর এখন আধা মফঃস্বল হলে কি হবে তখন এটি একটি গ্রাম ছিল। যেহেতু আগেকার দিনে গ্রামে গঞ্জে খুব কম বয়সে ছেলে মেয়েদের বিয়ের চল ছিল। তাই এর এক দেড় বছরের মাথায় বাড়ির লোকেরা রমাকান্তের বিয়ে দিয়ে দেয়। রমাকান্তের মাকে দেখাশোনা করার জন্য রমাকান্তের বৌকে এই ভাগলপুরে থেকে যেতে হয়। রমাকান্ত একাই দেবনারায়ন বাবুদের বাড়িতে থাকত। ছুটি ছাটায় বাড়িতে আসত। বিয়ের তিনবছর পরে অশোক জন্মায়। রমাকন্ত যেমন কাজের লোক ছিল তেমনি ভীষণ অমায়িক ছিল। কিছুদিনের মধ্যে সে বাড়ির সবার মন জয় করে নিয়েছিল। বলতে গেলে সে বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল।
দেবনারায়ন বাবু ও তার স্ত্রী রমাকান্তকে ভীষণ স্নেহ করতেন। রমাকান্ত দেবনারায়নবাবুকে মালিক আর ওনার স্ত্রিকে মা বলে সম্বোধন করত। আবার রমাকান্ত বিরেনের থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড় ছিল। ফলে বিরেন ও সুরেন এই দুই ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মত ছিল। তবে রমাকান্ত দুই ভাইকে বড় সাহেব আর ছোট সাহেব বলে সম্বোধন করত। সুরেনের নানারকম ফুলের প্রতি ন্যাক ছিল তাই সে রমাকন্তের কাছে ফুল গাছের কিভাবে যত্ন নিতে হয় সেটা শেখার চেষ্টা করত। আবার বিরেনের ছিল ক্যামেরায় ফটো তোলার নেশা। এই কারনে দেবনারায়ন বাবু তার বড় ছেলেকে দামি ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। বিরেনের আরও একটা নেশা ছিল গুলতি, তির ধনুকের প্রতি। এই গুলতি, তির ধনুক রমাকান্ত বানিয়ে দিত আবার চালান শিখিয়ে দিত। আর তার বিনিময়ে বিরেন ক্যামেরায় কিভাবে ছবি তুলতে হয় সেটা রমাকান্তকে শেখাত। এইভাবে রমাকান্তের এখানে বেশ ভালভাবে দিন কাটতে থাকে।
এরপরে বিরেন ও সুরেন প্রাপ্তবয়স্ক হলে এক এক করে বিয়ে হয়। দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলেকে অন্ধের মত ভালবাসতেন। তাই দেবনারায়ন বাবু ছোট ছেলে আর ছোট ছেলের বৌকে নিয়ে দক্ষিণ মহলে চলে আসেন। উত্তর মহলে থাকত বড় ছেলের ফ্যামিলি। বড় ছেলের বৌ ঋতম্ভরা ছিল শান্ত শিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির। আর ছোট ছেলের বৌ বিনোদিনী ছিল একটু চঞ্চল প্রকৃতির কিন্তু মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। এই দুজনকে রমাকান্ত বড় বৌদি আর ছোট বৌদি বলে সম্বোধন করত। তবে বিনোদিনী শ্বশুরকে ভীষণ তোয়াজ করে চলত। আবার ঋতম্ভরা শ্বশুরকে যেমন শ্রদ্ধা করত তেমনি সমিহ করে চলত। এরপরে বড় ছেলে বিরেন ও ঋতম্ভরার এক এক করে তিনটি ছেলে হয় আবার ছোট ছেলে সুরেন ও বিনোদিনীর একটি ছেলে হয়। ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতিদের নিয়ে দেবনারায়ন বাবুর বেশ সুখেই দিন কেটে যায়।
হঠাৎ দেবনারায়নের ছোট ছেলে সুরেনের অকাল প্রয়ান ঘটে। সুরেনের মৃত্যুর পরেই রায় পরিবারে ভাঙ্গন শুরু হয়। দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলেকে অসম্ভব ভাল বাসতেন। সেই ছোট ছেলের অকাল মৃত্যুতে দেবনারায় বাবু মানসিক দিক থেকে ভেঙ্গে পড়েন। এইসময় বিরেন বাবার সাথে দুরত্ব কমানোর একটা চেষ্টা করেন। কিন্তু বিনোদিনী সবসময় শ্বশুরকে আগলে আগলে রাখত। আবার শ্বশুরের আমলে যে দুজন বাড়ির কাজের লোক ছিল তাদের বিনোদিনী দেবি তাড়িয়ে দিয়ে কুসুম নামের একজন নতুন কাজের মহিলাকে নিয়োগ করেন। কুসুম বিনোদিনীর দুবছরের ছেলের দেখভালের থেকে বাড়ির সব কাজ করত। কুসুম পুরোপুরি বিনোদিনী দেবির ইশারায় চলত। ফলে বিরেন তার বাবার কাছে ঘেষতে পারে না। রমাকান্তের নিজস্ব ধারনা সে যেহেতু দক্ষিণ মহলের বাইরে থাকে আর সামান্য মালির কাজ করে তাই তার চাকরিটা বেঁচে যায়। এদিকে দেবনারায়ন বাবু ক্রমশ বিনোদিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
দেবনারায়নের ছোট ছেলে সুরেন একটু ভলেভালা প্রকৃতির তাই দেবনারায়ন বাবুর ধারনা ছিল তার অবর্তমানে বড় ছেলে বিরেন সম্পত্তির ভাগ থেকে ভাইকে বঞ্চিত করতে পারে। সেই আশঙ্কায় দেবনারায়ন বাবু অনেক আগেই তাদের ছোট নাগপুরের কলিয়ারিটার অর্ধেক মালিকানা সুরেনের নামে আর বাকি অর্ধেকের মালিকানা নিজের হাতে রেখেছিলেন। আর তার অন্যান্য ব্যবসার সত্তর ভাগ নিজের হাতে রেখে বাকি তিরিশ ভাগ বিরেনকে দিয়ে দিয়েছিলেন। দেবনারায়ন বাবু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন বড় ছেলে বিরেনের মতিগতি যদি ঠিকঠাক থাকে আর ছোট ছেলে সুরেন যদি ব্যবসাটা ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে তবে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান ভাবে দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কিন্তু সুরেনের হঠাৎ মৃত্যু দেবনারায়নবাবুর সব চিন্তাভাবনা ওলট পালট করে দেয়।
এদিকে সুরেনের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী বিনোদিনী দেবির স্বরুপ ধিরে ধিরে প্রকাশ পেতে শুরু করে। স্বামির শোক কাটিয়ে উঠে বিনোদিনী দেবি শ্বশুরের মত নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। কিছুদিনের মধ্যেই বিনোদিনী দেবির ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ক্রমশ প্রকাশ পায় বিনোদিনী দেবি যেমন ধূর্ত তেমনি অসম্ভব বুদ্ধিমতি ছিলেন। ছলাকলায় পুরুষমানুষকে কিভাবে বশ করতে হয় সেটা বিনোদিনীর ভালই জানা ছিল। শ্বশুরকে পুরোপুরি নিজের বশে নিয়ে বিনোদিনী ঝোপ বুঝে কোপ মারতে শুরু করেন। শ্বশুরকে দিয়ে সম্পত্তি নিজের নামে লেখাতে শুরু করেন। দেবনারায়ন বাবু যখন ছোট বৌমার অভিসন্ধি বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ছোট নাগপুরের কলিয়ারি আর বিরেনের নামে যে ব্যবসাগুলো ছিল সেগুলো বাদ দিয়ে দেবনারায়নের নামে আর যেসব ব্যবসা ছিল তার সবটাই বিনোদিনী পাকাপাকি ভাবে নিজের নামে লিখিয়ে নেয়।
দেবনারায়ন বাবু নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন। তার বড় ছেলে যাতে ছোট ছেলেকে ঠকাতে না পারে তার জন্য তিনি বিনোদিনীর মত বুদ্ধিমতি মেয়ের সাথে ছোট ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। ছোট বৌমা তার পুরো পরিবারটাকে পথে বসাতে চলেছে। দেবনারায়নবাবু অনেকভাবে তার বড় ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কিন্তু বিনোদিনী আর কুসুমের জন্য সেটা সম্ভব হয় না।
বিনোদিনী দেবি এরপরে শ্বশুরকে ছোট নাগপুরের কলিয়ারিটা পুরো তার নামে লিখে দেবার চাপ সৃষ্টি করে তখন দেবনারায়ন বাবু বেঁকে বসেন। কিছুতেই কলিয়ারির পুরো মালিকানা বিনোদিনী দেবির নামে লিখে দিতে রাজি হননা। এই নিয়ে শুরু হয় শ্বশুর বৌমার তুমুল অশান্তি, মনোমালিন্য। দেবনারায়নবাবু বুঝতে পারেন তিনি নিজে পছন্দ করে বাড়িতে কালসাপ নিয়ে এসেছেন। এই কালসাপের ছোবলে তার পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যাবে। ছোট বৌমার লোভের জন্য তার বড় ছেলের পরিবার পথে গিয়ে বসবে। নিজের ভুল সিধান্তের জন্য অনুশোচনা হয়।
তার দ্রুত শরীর, স্বাস্থ ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনেও ছোট বৌমার হাত আছে বলে দেবনারায়ন বাবুর মনে সন্দেহ দেখা দেয়। দেবনারায়ন বাবু বুঝতে পারেন তিনি এখন বিনোদিনীর হাতের পুতুল হয়ে গেছেন। তিনি শারিরিক ও মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়েন যে ছোট বৌমার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতাটুকুও তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। দেবনারায়ন বাবু বুঝতে পারেন তাকে ভুল বুঝিয়ে বিনোদিনী অনেক সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু ছোটনাগপুরের কলিয়ারিটি তার হাতে রয়েছে। এর থেকে তার বড় ছেলে বিরেন যাতে বঞ্চিত না হয় দেবনারায়ন বাবু তার একটা শেষ চেষ্টা করেন। রমাকান্তকে দিয়ে অত্যন্ত গোপনে উকিলবাবুকে ডেকে পাঠান।
উকিলবাবু আসতে দেবনারায়নবাবু ছোট নাগপুরের কলিয়ারির পুরো মালিকানা বড় ছেলে বিরেনের নামে করে দিতে বলেন। উকিলবাবু জানায় সেটা সম্ভব নয়। কারন এই কলিয়ারির অর্ধেক মালিকানা দেবনারায়ন বাবু তার ছোট ছেলে সুরেনের নামে করে দিয়ে বসে আছেন। এখন সুরেনের মৃত্যুর পরে এই শেয়ারের বৈধ অধিকারি তার স্ত্রী বিনোদিনী দেবি। দেবনারায়ন বাবুর হাতে যেটুকু শেয়ার আছে শুধুমাত্র সেইটুকু বিরেনের নামে ট্রান্সফার করা যেতে পারে। দেবনারায়ন বাবুর আর কিছু করার থাকে না। অগত্যা উকিলবাবুকে তার অংশটুকু বিরেনের নামে ট্রান্সফার করে দিতে বলেন।
এর কিছুদিন পরে বিনোদিনী দেবি জানতে পারেন ছোট নাগপুরের কলিয়ারির শ্বশুরের শেয়ার তার ভাসুর বিরেনের নামে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। খবরটা শুনে বিনোদিনী দেবি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষেপে যান। বাড়িতে ফিরে তাণ্ডব শুরু করেন। বিনোদিনী দেবির মুখোসটা খসে গিয়ে আসল রূপটা বেরিয়ে আসে। শ্বশুরমশাইকে যা নয় তাই বলে অপমান শুরু করেন। বিনোদিনীর এই ভয়ঙ্কর রুপ দেখে রমাকান্ত ভয়ে কুঁকড়ে যায়।
দেবনারায়ন বাবুকে রমাকান্ত অসম্ভব শ্রদ্ধা ভক্তি করত। মালিকের এই অপমান সে সহ্য করতে পারে না। এই অশান্তির হাত থেকে মালিককে বাঁচানর জন্য সে একদিন মালিককে একা পেয়ে বলে যে ছোট বৌদি যেটা চাইছে সেটা করে দিতে। রমাকান্ত অশিক্ষিত, হিসেব নিকেস কিছুই বোঝে না। তাই রমাকান্তের কথায় দেবনারায়ন বাবু কিছুই মনে করেন না বরং তাকে অবস্থাটা বুঝিয়ে বলেন। ছোটনাগপুরের কলিয়ারি ছাড়া দেবনারায়ন বাবুর আর যেসব ব্যবসা আছে তার সত্তর ভাগ ছোট বৌমা নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। বড় ছেলের যেখানে ন্যায্য পাওনা পঞ্চাশ ভাগ সেখানে সে মাত্র তিরিশ ভাগ পেয়েছে। এই কলিয়ারির ব্যবসাটা তাদের মূল ব্যবসা। এখন এখান থেকেও যদি বড় ছেলেকে বঞ্চিত করা হয় সেটা খুব অন্যায় হবে। রমাকান্ত এইবারে পরিস্কার বুঝতে পারে এই বাড়ির ছোট বৌ খুব লোভী, এত কিছু পাবার পরেও ছোট বৌদির লোভের শেষ নেই। এই লোভ পরিবারটাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাড় করাবে সেটা ভেবে রমাকান্ত মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
কিছুদিনের মধ্যে রমাকান্তের আশঙ্কা সত্যি হয়। দক্ষিণ মহলের বাইরে গা ঘেষে রমাকান্তের থাকার ঘর। একদিন মাঝরাতে একটা গাড়ি থামার অওয়াজে রমাকান্তের ঘুম ভেঙ্গে যায়। শিতের রাত তাই রমাকান্ত চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে গাড়ির থেকে একটা ছায়ামূর্তি তাদের পাচিলের গেট খুলে ঢুকে আসছে। রমাকান্ত তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। লোকটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রমাকান্ত গাছের আড়াল থেকে লোকটাকে ভাল করে দেখতে পায়। লোকটা প্রায় ছফুটের মত লম্বা, চোখ মুখে হিংস্র ভাব, দৈত্যাকার চেহারা। লোকটার চেহারা দেখে রমাকান্ত বেশ ভয় পেয়ে যায়। লোকটা সদর দরজায় তিনবার টোকা দিতেই দরজা খুলে যায়। অবাক হয়ে দেখে বিনোদিনী দেবি দরজা খুলে লোকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়।
মাঝরাতে এইরকম একটা ষণ্ডা মতন লোক যে কোন ভাল উদ্দেশ্যে আসেনি সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি রমাকান্তের আছে। বাড়ির ছোট বৌ যে এই লোকটাকে ডেকে এনেছে সেটাও বুঝতে রমাকান্তের বাকি থাকে না। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে লোকটা এসেছে সেটা রমাকান্তের মাথায় ঢোকে না। হঠাৎ রমাকান্তের মনে মালিকের জন্য দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। মালিকের কোন ক্ষতি করার জন্য এই লোকটাকে ডাকা হয়নি তো, এটা ভেবে রমাকান্তের বুকে ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বিমূঢ় বিহ্বলের মত কিছু সময় রমাকান্ত গাছের নিচে দাড়িয়ে থাকে। মালিকের কথা ভেবে রমাকান্তের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। স্বয়ংচালিত যন্ত্রের মত রমাকান্ত দক্ষিণ মহলের দিকে হাটা দেয়।
সদর দরজা ঠেলে খুব সন্তর্পণে রমাকান্ত বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসে। দেখে বাড়ির ভেতরে খুব অল্প পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। একটা ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, রমাকান্তের বুক ঢিপঢিপ করে। বাড়ির কাজের মেয়ে কুসুমকে কোথাও দেখতে পায় না। মালিকের ঘরটা রমাকান্তের চেনা আছে, তাই সে পা টিপে টিপে মালিকের ঘরের জানলার নিচে গিয়ে দাড়ায়। ধিরে মাথা উঠিয়ে ঘরের মধ্যে দৃষ্টি দেয়। দেখে মালিক খাটের উপরে শুয়ে আছে। আর খাটের পাশে বিনোদিনী দেবি ও ষণ্ডা মতন লোকটা দাড়িয়ে আছে। মালিককে দেখে মনে হয় গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এবারে লোকটা তার এক পকেট থেকে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করে। আর অন্য পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের শিশি বার করে। লোকটা সিরিঞ্জের ছুঁচটা ওষুধের শিশির মধ্যে ঢুকিয়ে সিরিঞ্জটা ভরে নেয়।
এই দেখে রমাকান্তের বুকের ওঠানামা বেড়ে যায় আবার, দরদর করে ঘামতে থাকে। এরপরে লোকটা ইনজেকশনটা হাতে নিয়ে বিনোদিনী দেবিকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘুম থেকে উঠে যাবে নাতো?’
বিনোদিনী দেবি হেসে বলে, ‘না, কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাবারের সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। খুব সহজে ঘুম ভাংবে না।’
লোকটা সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কুসুম?’
‘ভয় নেই, কুসুমকেও ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি, সকালের আগে উঠবে না।’
বিনোদিনী দেবির ভয়ংকর কথা শুনে রমাকান্তের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ভয়ে আতঙ্কে রমাকান্তের রক্ত জল হয়ে যায়।
‘ছুঁচটা এমন ভাবে ফোটা যাতে ছুচের দাগ বোঝা না যায়।’
বিনোদিনীর মুখে এই কথা শুনে রমাকান্তের মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। কি ভয়ঙ্কর খুনে মহিলাকে মালিক নিজের ছোট ছেলের বৌ করে নিয়ে এসেছে এটা ভেবে রমাকান্তের শরীর অবশ হয়ে আসে।
এরপরে লোকটা ইনজেকশনের ছুঁচটা মালিকের পায়ে ফুটিয়ে দিয়ে ধিরে ধিরে সিরিঞ্জের সব ওষুধটা মালিকের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। ছুঁচটা ফুটতে মালিক সামান্য একটু নড়ে ওঠে কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে না।
বিনোদিনী দেবি লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ইনজেকশনটা কাজ করবে তো?’
লোকটা নির্বিকার ভাবে বলে, ‘যা ওষুধ দিয়েছি তাতে আধঘণ্টার মধ্যে হার্টফেল করে মারা যাবে। পুলিশ কিছু ধরতে পারবে না।’
এদের কথা শুনে রমাকান্তের মাথা ঘুরে যায়। দেওয়ালটা ধরে কোনরকমে টাল সামলায়। আর আধ ঘণ্টা পরে মালিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এখানে থাকাটা যে সমুহ বিপদের সেটা রমাকান্ত বুঝতে পারে। এদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। যারা দেবনারায়নের মত নামি লোককে খুন করতে দ্বিধা করে না, তার মত সামান্য মালিকে মেরে ফেলতে এরা এক মুহূর্ত সময় নেবে না। পা টিপে টিপে রমাকান্ত দক্ষিণ মহল থেকে বেরিয়ে আসে।
নিজের ঘরে ফিরে এসে রমাকান্ত খাটে বসতে বা শুতে পারে না, চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে ঘরময় পায়চারি করে। শরীরটা অস্থির অস্থির করে, শিতকালের রাতেও দরদর করে ঘামতে থাকে। রমাকান্ত এই মৃত্যুপুরী থেকে পালানোর চিন্তা করে। কিন্তু রমাকান্ত এটাও বোঝে বিনোদিনী দেবি যদি কোনভাবে বুঝে যায় যে সে এই ব্যাপারটা জেনে গেছে তাহলে তাকেও রেহাই দেবে না। বিনোদিনী দেবির এক ইশারায় তাকেও পৃথিবীর থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। যারা দেবনারায়ন বাবুর মত জাঁদরেল লোককে মেরে ফেলার হিম্মত রাখে তারা তো পিঁপড়ের মত তাকে পায়ের তলায় পিশে মেরে ফেলবে। এখন তার কি করনীয় সেটা রমাকান্ত কোনভাবেই ভেবে উঠতে পারে না। শুধু এটুকু তার মগজে খেলে যে বিনোদিনী দেবিকে কোনভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে এই খুনের ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে। সারারাত রমাকান্তের চোখে ঘুম আসে না, ঠায় বসে থাকে।
দেবনারায়নের মত নামকরা লোকের অস্বাভাবিক মৃত্যু, ফলে পরেরদিন সকালেই পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায়। রমাকান্তকেও পুলিশ জেরা করে। রমাকান্তের খুব সংক্ষিপ্ত জবাব, সে সারারাত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে, রাতে সে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি বা শোনেনি। কিন্তু বিরেনবাবু এসে হল্লা শুরু করে দেয়। তার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে এই অভিযোগ পুলিশের কাছে বিরেনবাবু বারংবার জানায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিনোদিনী দেবি শ্বশুরের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছে এরকম একটা ভাব নিয়ে বসে থাকেন। এই মহিলাই গতকাল রাতে নিজের শ্বশুরকে লোক দিয়ে খুন করিয়েছে। তার কোনরকম লক্ষন বিনোদিনী দেবির মুখে চোখে দেখা যায় না। দুঃখে কাতর হয়ে চুপ করে বসে থাকে, চোখে দিয়ে অবিরত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। বিনোদিনী দেবির এই অভিনয় দেখে রমাকান্ত অবাক হয়ে যায়।
রমাকান্ত একবার মনে মনে ভাবে গতকালের ঘটনাটা বিরেনবাবুকে জানিয়ে দেবে। তবে এটাও রমাকান্ত জানে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার প্রান যায়। বিরেনবাবু আর বিনোদিনী দেবি দুই রথী মহারথীর যুদ্ধ হবে আর মাঝখান থেকে তার মত সামান্য মালির প্রাণটা যাবে। রমাকান্ত তাই কথাটা বিরেনবাবুকে বলার ভরসা পায় না। আবার পুলিশকে রমাকান্ত একটুও বিশ্বাস করে না। পুলিশ মানেই বড় লোকদের পক্ষে কথা বলবে আর তার মত গরিব মানুষদের ফাসিয়ে দেবে। রমাকান্ত মুখে কুলুপ এঁটে থাকাটাই মনস্থির করে। আর মালিকের বিচারের ভার ভগবানের হাতে ছেড়ে দেয়।
কয়েকদিন পরে রমাকান্ত খবর পায় পুলিশ দেবনারায়ন বাবুকে খুন করা হয়েছে বলে মনে করছে। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টও নাকি তাই বলছে। রমাকান্ত খবরটা শুনে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। তবে তার এই খুশির ভাবটা সে সম্পূর্ণ গোপন রাখে। বিনোদিনী দেবির মত খুনে মহিলা যদি সামান্য কিছু আঁচ পায় তবে তার বিপদ ঘনিয়ে আসতে সময় নেবে না। এই সময় বিরেন বাবুর হম্বি তম্বি বেড়ে যায় আর বিনোদিনী দেবি একটু চুপসে যান।
এরপরেই দক্ষিণ মহলে বড় বড় নেতা ও উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের আনাগোনা শুরু হয়। যথারীতি কিছুদিন পরে পুলিশের বক্তব্য আর পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দুটোই পাল্টে যায়। এর পেছনে কি খেলা রয়েছে সেটা রমাকান্তের মত নগন্য এক মালির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানায় দেবনারায়ন বাবু বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন তাই হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। আর পুলিশ আত্মহত্যার ঘটনা বলে কেসটা বন্ধ করে দেয়। বিরেন বাবু তার প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেকভাবে চেষ্টা করেন যাতে তার বাবার মৃত্যুর তদন্তটা পুলিশ সঠিক ভাবে করে। কিন্তু তার সব চেষ্টা বৃথা যায়। এদিকে বিনোদিনী দেবি আবার স্বমূর্তি ধারন করেন।
পুলিশ প্রথমদিকে খুনের কেস বলায় রমাকান্তের মনে আশার সঞ্চার হয়। মালিক তার খুনের বিচার পাবে এই আশায় রমাকান্ত বুক বাধে। কিন্তু পুলিশ যখন আত্মহত্যা বলে কেস বন্ধ করে দেয় আর খুনিকে বহাল তবিয়তে ঘুরতে দেখে রমাকান্ত তখন ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। রমাকান্তের ভয়ে ভয়ে দিন কাটতে থাকে। এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে যদি বিনোদিনী দেবির মনে কোন সন্দেহ হয় তবে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এই ভয়ে রমাকান্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে না।
রমাকান্ত মুখ বুজে নিজের কাজ করে যেতে থাকে। এর ফলে যেটা হয় রমাকান্তের শরীর ক্রমশ ভাঙতে শুরু করে, ঘন ঘন অসুস্থ হতে শুরু করে। এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তার সংসার কিভাবে চলবে এই ভেবে রমাকান্ত ভাঙ্গা মন ও ভাঙ্গা শরীর নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়। একদিন রমাকান্ত দক্ষিণ মহলের সামনে ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল সেই সময় বিরেনের স্ত্রী ঋতম্ভরা দেবি হাতে কয়েকটা চিঠি নিয়ে দক্ষিণ মহলের সামনে এসে উপস্থিত হয়। রমাকান্তকে দেখে ঋতম্ভরা দেবি জিজ্ঞেস করে, ‘রমাকান্ত কেমন আছ? বাড়ির সব খবর ভাল তো?’
‘হ্যা, বড় বৌদি, বাড়ির সবাই ভাল আছে। বড় সাহেব কোথায়? ছেলেরা সবাই কেমন আছে?’
‘তোমার বড় সাহেব ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। দু তিনদিন পরে ফিরবে। ছেলেরা সবাই ভাল আছে।’
‘বড় বৌদি, আপনাদের বাড়ির থেকে একটা সুন্দর মত ছেলেকে বেরোতে দেখলাম, ওটি কে?’
‘ও আমার ভাই, সব্যসাচী। এখানে কয়েকদিন থাকার জন্য এসেছে।’
‘যাইহোক, বড় বৌদি, এখানে কি মনে করে?’
‘কি আর বলব রমাকান্ত, পিয়নটা ভুল করে বিনোদিনীর চিঠি আমাদের লেটার বক্সে ফেলে গেছে। সেগুলো দিতেই এসেছি।’
‘কেন, বড় বৌদি, আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে চম্পা নেই। তার হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিতে পারতেন।’
‘বাড়িতে কেউ নেই। বড় আর মেজ ছেলে কলেজে গেছে। চম্পা আর সব্যসাচী দুজনে আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। আমি ছাড়া এখন বাড়িতে কেউ নেই, তাই চিঠিগুলো আমি দিতে এসেছি। যাইহোক রমাকান্ত, বিনোদিনী বাড়িতে আছে?’
রমাকান্ত বলে, ‘হ্যা, ছোট বৌদি বাড়িতেই আছে।’
ঋতম্ভরা দেবি আর দেরি না করে দক্ষিণ মহলে ঢুকে যায়। কিছুক্ষন পরেই রমাকান্ত দেখে ঋতম্ভরা দেবি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে প্রায় ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়ির দিকে চলে যায়। রমাকান্ত বেশ অবাক হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথেই বিনোদিনী দেবি বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে। রমাকান্তকে দেখে জিজ্ঞেস করে ঋতম্ভরা এসেছিল কিনা। রমাকান্ত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শুনে বিনোদিনী দেবি আবার বাড়িতে ঢুকে যায়। দুই বৌয়ের কাজ কারবার দেখে রমাকান্ত বেশ অবাক হয়। রমাকান্ত আবার নিজের কাজে মন দেয়।
বেশ কিছুক্ষন পরে একটা গাড়ি এসে দক্ষিণ মহলের সামনে এসে দাড়ায়। গাড়ির থেকে যে লোকটা নেমে আসে তাকে দেখে রমাকান্তের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়।
****************************************************