11-01-2024, 04:14 PM
পর্ব ২৩
সমীরের আজ বড্ড বউটার কথা মনে পড়ছিলো। ভালোবাসার টান বোধহয় একেই বলে। স্ত্রী ওদিকে পরপুরুষের কামের জালে জড়িয়ে পড়েছে , তো এদিকে স্বামীর মন হঠাৎ করে উচাটন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন এই উচাটন মন আর কিই বা করবে। যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে সমীরের অগচরে। তাই হয়তো সমীরের মন আজ টিকছিলো না অফিসের ফাইলে।
অফিসে বসে আনমনে সমীর ভাবছিলো বিগত কয়েকদিন ধরে সে জেনে না জেনে কতখানি অনুরিমার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে ফেলেছে। বেচারি ! সে তো তাকে ভালোবাসে। আর সেই কিনা তার ভালোবাসাকে চোখের সামনে অন্য কারোর দ্বারা লুটতে দেখতে চায় ? নাহঃ নাহঃ ! ফ্যান্টাসি ফ্যান্টাসি করে না জানি সে কতদূর এগিয়ে গেছে। তারই জন্য অনুরিমাকে রাজীবের মতো এক অজানা অচেনা পুরুষের সাথে ভিক্টোরিয়ায় দেখা করতে যেতে হয়েছিল। রাজীব তার কাছে আসার চেষ্টা করেছিলো। এসব নিশ্চই অনুরিমার ভালো লাগেনি। না লাগারই কথা। অনুরিমা যে তাকে ছাড়া আর কাউকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি। অনুরিমা এই যাতনা সইবে কি করে ? না না সমীর , এটা ঠিক হচ্ছেনা। একদমই ঠিক হচ্ছেনা। তুই ভুল করছিস। সমীর বারংবার নিজের মনকে বলছিলো আর দুষছিলো। সে ঠিক করে নিয়েছিল যে অনেক হয়েছে আর না। এবার তার মনকে দড়ি পড়াতে হবে। নাহলে তার প্রতি অনুরিমার বিশ্বাস, ভালোবাসা সব নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা সে কিছুতেই মানতে পারবে না। তাই আজ সে বাড়ি গিয়ে অনুরিমাকে বলবে তার কোনো কাকোল্ড এক্সপিরিয়েন্স নেওয়ার দরকার নেই। সে যেমন আছে তেমনই ঠিক আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে সমীর একবার নিজের ফোনের দিকে তাকালো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো অথচ তার বউ তাকে আজকে একটাও কল দেয়নি ! Strange ! এরকম তো সে কখনো করেনা। তাহলে আজ কি হলো ? বলেছিলো ঠিকই যে সে আজ ওই সুচরিতার সাথে দেখা করতে যাবে। আর সুচরিতার সাথে কথা বলতে শুরু করলে তো অনুরিমার আর বাকি দুনিয়ার খেয়াল মাথায় থাকেনা। বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা ! কি জাদুই না জানে ওই মায়াবিনী সুচরিতা। এইজন্যই মেয়েটাকে আমার একদম ভালো লাগেনা। ভীষণ ম্যানিপুলেটিভ। না জানি আমার অনুকে কিনা কিই বুঝিয়ে দেবে ! কিন্তু অনুরিমার তো বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে আসার কথা। তাহলে সে ভুললো কি করে আজ আমায় কল করতে ? দেখি একবার ফোনটা করে।
নিজের মনে মনে এইভেবে সমীর ফোনটা হাতে নিলো। নিয়ে অনুরিমার নাম্বারে ডায়াল দিলো। কিন্তু নট্ রিচেয়েবেল ! কেন ? আজ বৃষ্টি হয়েছে বলে কি টাওয়ার এর প্রবলেম ? বেশ খান তিনেক বার সমীর ট্রাই করলো। প্রতিবার একই কথা , "The number you have dialed is not reachable at this moment, please try after sometime, or send a voice message by dialing............."
সমীর ফোনটা রেখে দিলো। ভাবলো কিছুক্ষণ পরে আবার ট্রাই করবে , না পেলে নাহয় বাড়িতে একটা কল দেবে। এখন তো সবে বিকেল হয়েছে , তাই বাইরে থাকলেও চিন্তার কিছু নেই। এইভেবে সমীর নিজের মনকে আস্বস্ত করলো। কিন্তু বাস্তবে সমীরের জীবনে নিস্তব্ধে যে প্রলয় এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল , তার পূর্বাভাস কোনো আবহাওয়া দপ্তর থেকে পাওয়াও অসম্ভব ছিল। স্বামীর স্ত্রীর জীবনে অলরেডি তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে গেছিলো , আর সেটা তার পরিচিত রাজীব নয়, তার স্ত্রীয়ের বান্ধবীর প্রাক্তন স্বামী আদিত্য সেনগুপ্ত। কখন কোথা থেকে সম্পর্কে সিঁধ কেটে চোর ঢুকে পড়ে মন চুরি করতে , তার খেয়াল কেই বা রাখে। ভীত নড়বড়ে হয়ে গেলে সিঁধ তো কাটা হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না তখন।
এসপ্ল্যানেড এর এক ছোট্ট লজে তিনতলার এক ঘরে তখন দুই নগ্ন নর নারী সামাজিক নৈতিকতার বিস্মরণ ঘটিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় ও অলীক স্বপ্নে মগ্ন ছিল। বিকেল বাড়ার সাথে সাথে যানবাহনের কোলাহল বাড়তে শুরু করলো। খোলা জানলা দিয়ে সেই আওয়াজ কানে পৌঁছতে শুরু করলো। এবং স্বাভাবিক নিয়মেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অনুরিমার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে সে দেখলো বাস্তব পৃথিবীটা কে। রিয়েলাইজেশন হলো সে এখন কোথায় আছে , কি অবস্থায় আছে এবং সর্বোপরি কার সাথে আছে !
চোখ দিয়ে অঝোরে জল বেরিয়ে এলো, কোন বাঁধ যেন দেওয়া যাচ্ছিলো না অশ্রুনদীতে। ক্রমাগত বাধা হীন ভাবে বয়ে চলেছিলো চোখ থেকে গাল বেয়ে। প্রথমে নিস্তব্ধে পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হলো। সেই ক্রন্দনের আওয়াজে আদিত্যর ঘুমও ভাঙলো। সেও প্রথমে ঘোরের মধ্যেই ছিল , চারদিকটা চেয়ে দেখলো আগে। তারপর দেখলো তার পাশে বিছানায় বসে এক রূপসী পরী কাঁদছে। চোখের সামনে অনুরিমার খোলা নগ্ন পিঠ দেখে মন আবার চাইলো দুপুরের অঘটনের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। কিন্তু এখন যে হাওয়া অনুকূলে নেই তা অনুরিমার কান্না দেখেই আদি বুঝতে পারছিলো। তাই এখন সময় ছিল কামনার খোলস ছেড়ে মানবিকতার পোশাক পড়ার। প্রেমিকের বদলে ফের একবার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ানোর ও মিথ্যে শান্ত্বনা প্রদান করার।
আদিত্য উঠে বসে পেছন থেকে অনুরিমার কাঁধে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ বেঁকিয়ে অনুরিমা সেই হাত নিজের শরীর থেকে সরিয়ে দিলো। সে শুধু দুঃখী নয় , রেগেও ছিল। আদিত্য পরিস্থিতি বুঝে আর বেশি বাড়াবাড়ি করলো না। সে বিছানা থেকে উঠে মেলতে থাকা নিজের জামা কাপড় গুলো এক এক করে নিয়ে পড়ে নিলো। তারপর অনুরিমার জামাকাপড় গুলো দড়ি থেকে তুলে বিছানায় অনুরিমার সামনে এনে রাখলো।
অনুরিমা সেগুলো এক এক করে পড়ে নিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণ করলো। তারপর আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে অনুরিমা নিজের ব্যাগ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলো। তার পায়ের যন্ত্রণাটা এখনও অল্পবিস্তর ছিল , আগে তা কামের বশে টের পায়নি। এখন আবার ব্যাথাটা একটু ধরেছিলো। আদিত্য তা দেখে অনুরিমাকে আটকাতে গেলো , অনুরিমা খুব বাজে ভাবে রিয়েক্ট করবে তা জেনেও। হলোও তাই। যখন আদিত্য অনুরিমাকে পেছন থেকে গিয়ে হাত ধরে টানলো , তখন অলরেডি ইর্রিটেটেড হয়ে থাকা অনুরিমা আরো রেগে গিয়ে এক কষিয়ে চড় বসালো আদিত্যর গালে। আদিত্য হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুরিমা রিয়েক্ট করবে সেটা কাঙ্খিত ছিল , তবে এতোটা রুক্ষ ভাবে করবে সেটা জানা ছিলোনা।
অপমানে আদিত্যর পা যেন মাটিতে আটকে গেছিলো। সে স্থির হয়ে রইলো , একটুও নড়াচড়া করলো না। অনুরিমা বড়ো বড়ো চোখ করে কটমটিয়ে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ, বিরক্তি, উষ্মা প্রকাশ করছিলো, যেন সে আদিকে গিলে ফেলতে চায়। অনু ফের ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে যেতে লাগলো। এবার আদিত্য কিছুটা রেগে ক্রোধিত গলায় অনুরিমাকে ডাকলো , "অনুরিমা !!!!......"
আদিত্যর কড়া গলার আওয়াজ শুনে অনু থমকে গেলো কিছু মুহূর্তের জন্য। আদিত্য গটমটিয়ে হেঁটে অনুরিমার কাছে এলো , হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ঘোরালো। জবাবদিহি চাইলো এভাবে থাপ্পড় মারার, "তুমি আমাকে চড় মারলে কেন ? কি এমন ক্ষতি করেছি তোমার ? আমাদের মধ্যে যা হয়েছে , দুজনের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতেই হয়েছে। মানছি তুমি এসব করতে চাওনি , কিন্তু আল্টিমেটলি তুমি তো আমাকে বাঁধা দিতে পারোনি। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাকে কাটগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ ?"
"হ্যাঁ , করাচ্ছি। কারণ আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম , বন্ধু হিসেবে। আর তুমি সেই বিশ্বাস ভেঙেছো। তুমি যখন জানতেই যে আমি কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ছি , তাহলে কেন নিজেকে সংযত করলে না ? কেন আমার দুর্বলতার সুযোগ এভাবে নিলে আদি ? লজ্জা করলো না একবারও তোমার তা করতে? ছিঃ! এই তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে ? এই তোমার বন্ধুত্ব ?" , এই বলে অনুরিমা অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
অনুর এই একগুচ্ছ প্রশ্নবাণের উত্তর আদির কাছে ছিলোনা। সে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না। অগত্যা চুপ করে মাথা নিচু হয়ে সে অনুরিমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আর সেই সুযোগে অনুরিমা আদিত্যর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে খানিকটা খুঁড়িয়ে, দৌড়াতে দৌড়োতে দরজা দিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। আদিত্য চেষ্টা করলো পেছন পেছন খানিকটা গিয়ে অনুকে ডেকে থামানোর, কিন্তু অনু তখন শোনে কার কথা ! সে চোখের জল মুছতে মুছতে লিফট দিয়ে নেমে চলে গেলো। আর আদিত্য? সে বেচারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
বাইরে বেরিয়ে অনুরিমা একটা ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলো। পেয়েও গেলো। ট্যাক্সিতে উঠে সে প্রথমে তার ব্যাগটা চেক করলো, সবকিছু রয়েছে কিনা , কিছু ছেড়ে আসেনি তো। ফোনটা দেখলো ডেড হয়ে পড়ে আছে। অনেক কষ্টে অন করে নেটওয়ার্ক পেলো। নেটওয়ার্ক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বাজলো , সমীরের নম্বর।
ফোন তুলতেই সমীর জিজ্ঞেস করে উঠলো , "কি গো , এতোবার করে ফোন করছি , ফোন আনরিচেবল আসছে ? বাড়িতেও তখন ফোন করলাম , বললো তুমি ফেরোনি। এখন কোথায় আছো তুমি ? বাড়িতে? ফিরেছো ?"
অনুরিমার প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। অপরাধবোধে সে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ থেমে কোনোমতে নিজের কান্নাকে আটকে সে উত্তর দিলো , "না.... , আমার এখনও ফেরা হয়নি। "
"এখনও ফেরোনি ??", অবাক হয়ে সমীর জিজ্ঞেস করলো।
"নাহঃ। ...."
"কোথায় আছো ? কি করছো ? কখন ফিরবে ?"
"আমি আসছি , এক্ষুনি আসছি। ট্যাক্সিতেই রয়েছি।"
"ঠিক আছে সাবধানে এসো", কিছুটা হতাশ গলায় সমীর বললো।
হুম, এসে সব বলছি ", বলেই অনুরিমা ফোনটা কেটে দিলো।
মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলো ! অনুরিমার এরূপ ঠান্ডা ও অপ্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া দেখে , শুনে , অনুভব করে সমীর হতবাক ! মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, "কি হয়েছে অনুরিমার ? শরীরটা ঠিক নেই নাকি ?"
ওদিকে অনুরিমা ফোনটা রেখেই আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো। ট্যাক্সির ড্রাইভারটা মানবিকতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলো , "কেয়া হুয়া মেমসাহাব , সাব ঠিক হ্যাঁ না ?"
অনুরিমা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিলো। বললো কিছু হয়নি তার। ট্যাক্সি ড্রাইভারটাও আর বেশি কথা বাড়ালো না। চুপচাপ অনুরিমাকে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দিতে ফোর্থ গিয়ারে দিলো গাড়ি। রাস্তা মোটামোটি ফাঁকা থাকায় তাড়াতাড়ি লেক টাউনে ঢুকে গেলো গাড়ি। বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লো অনুরিমা।
সমীর দরজা খোলায় বেশ খানিকটা অবাক হলো অনু। এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরার কারণ জিজ্ঞেস করলো তো সমীর উত্তর দিলো যে তার আজ কেন জানিনা অফিসের কাজকর্মে মন টিকছিলো না , বারবার নিজের স্ত্রীয়ের কথা মনে পড়ছিলো। তাই সাত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড়িয়ে এসছে। এই সবে ফিরলো সে। বাড়ি ঢোকার ঠিক আগে সে অনুরিমাকে ফোন করেছিলো। ফোনে যখন কথা হচ্ছিলো তখন সে ভিআইপি রোডে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল। একজন ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে নিজের বউয়ের জন্য ফুল কিনেছিলো। ভেবেছিলো অনুরিমা হয়তো এতোক্ষণে বাড়িতে চলে এসছে। সেটা জানতেই তখন সে অনুরিমাকে কল করেছিলো। সময়ের আগে তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরিমাকে ফুল দিয়ে সারপ্রাইস দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফোনে তো অনুরিমা বললো সে আসছে। মানে এখনও বাড়িই ফেরেনি !
দুঃখী মুখ করে সমীর কথা গুলো বলে গেলো। সমীরের কথা শুনে অনুরিমার বুকটা ফেটে গেলো। চেষ্টা করেও দু এক ফোঁটা জল চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ার থেকে আটকাতে পারলো না নিজেকে। অনুরিমার মুখ চোখ দেখে সমীরের ভালো ঠেক ছিলোনা। সে এই অশ্রুর পিছনের যথার্থ কারণ জিজ্ঞেস করতেই যাবে কি খেয়াল করলো অনুরিমার পায়ে ব্যাণ্ডেজ দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো তার স্ত্রীয়ের পায়ে কি হয়েছে ??
অনুরিমা বললো সব কথা দরজায় দাঁড়িয়ে বলা যাবেনা। সমীর তাকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। অনুরিমার এই অবস্থা দেখে তার শ্বশুর শাশুড়িও চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাকে নিয়ে সবাই ধর ধর করতে লাগলো। অনুরিমা মনে মনে ভাবলো এতো ভাগ্য করে সে এরকম একটা কেয়ারিং শশুর বাড়ি পেয়েছে , যেখানে স্বামীর সাথে সাথে তার শশুর শাশুড়িও তার এতো খেয়াল রাখে , সেখানে সে অবুজের মতো এরকম একটা কাজ করতে পারলো কি করে। পুরোনো কলকাতার বনেদি মল্লিক বাড়ির বউ হয়ে সে এক পরপুরুষের সাথে এসপ্লানেডের এক ছোট্ট হোটেলে সহবাস কি করে করতে পারে , তাও আবার তার বান্ধবীর প্রাক্তন স্বামীর সাথে ! ছিঃ! তার ওই লেক টাউনের খালের জলে দড়ি কলসি নিয়ে ডুবে মরতে ইচ্ছে করছিলো।
এসব ভেবে ভেবে অনুরিমার চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু নির্গত হচ্ছিলো , আর তার পরিবারের লোকজন ভাবছিলো ব্যাথার কারণে সেই অশ্রু নির্গত হচ্ছে। পায়ের ব্যাথা তো সে কখন সেরে গ্যাছে আদিত্যর শুশ্রূষায়। এটা তো ছিল অনুশোচনা , অপরাধবোধ, এবং আত্মগ্লানির ব্যাথা যা ভেতর থেকে তাকে শেষ করে দিচ্ছিলো।
খানিকক্ষণ শুশ্রূষা যত্ন-আত্তি করার পর অবশেষে সমীর তার বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে অনুরিমাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরে তাকে বিছানায় বসিয়ে আলতো করে তার উরুতে সমীর নিজের হাত বোলালো। খুব নরমভাবে সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো , "কি হয়েছে ? কিভাবে কাটলো পা ?"
অনুরিমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সত্যিটা সে বলতে পারবেনা , আর মিথ্যে সে বলতে পারেনা। তাই অর্ধ সত্যি ও অর্ধ মিথ্যের মিশ্রণ করতে হলো তাকে। খানিকটা "অশ্বত্থামা হত,.. ইতি গজ" এর মতো। সে বললো বাড়ি ফেরার পথে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। বাস ট্যাক্সি কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছিলো না। একটা শেল্টার খুঁজে দৌড়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভেজা ফুটপাথে পা পিছলে সে পড়ে যায়। পথচলতি এক অজানা পুরুষ তাকে এসে সাহায্য করে। তার জন্য ওষুধের দোকান থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ , মলম , ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে আসে , এবং তার শুশ্রূষা করে। সেই লোকটার পরামর্শে অনুরিমা কাছে পিঠের এক ছোট্ট রেস্টুরেন্ট কাম হোটেলে কিছুক্ষণ স্টেই করে। বৃষ্টি ছাড়লেও রাস্তায় যানবাহন বেশি চলাচল করছিলো না। গুটিকয়েক ট্যাক্সি থাকলেও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ট্যাক্সির আগুন ভাড়া চড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তার উপর অনুরিমার করুণ অবস্থা দেখে কিছু অসৎ হলুদ ট্যাক্সিওয়ালা খুব বেশি ভাড়া চার্জ করছিলো। তাই সে সঠিক সময়ে সঠিক দামের মিটার অন থাকা নো রিফিউসাল ট্যাক্সির অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে পেলোও , এবং তাতে করে বাড়ি ফিরে এলো। তাই তার আসতে এতোটা দেরী হয়েছে আজ।
অনুরিমার সাজিয়ে বলা কথাগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁকফোকড় ছিলোনা। তাই সমীর সবটাই বিশ্বাস করলো। অনুরিমাই জানতো তার এই কথার মধ্যে কতোটা সত্যি আর কতোটা জল মেশানো আছে। সত্যিই তো আদিত্য একজন অজানা পুরুষই , তার সবটা জানা থাকলে কি আর অনুরিমার তার পাতা কামের ফাঁদে পা থুড়ি শরীরটা দিতো।
যাই হোক , সবকিছু শুনে সমীর আর কথা বাড়ালো না। অনুরিমাকে রেস্ট নিতে বললো। বলে সে ডাইনিং রুমে ফিরে এলো। নিজের বাবা মা-কে সবটা বললো। বাবা মাও পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনুরিমার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হলো , ছেলেকে বউমার পাশে থাকতে বললো। যে বউমা একা হাতে সবটা সামলায় , সেই বউমা আজ আহত। এখন তাকে সামলানো বাড়ির বাকি সদস্যদের কর্তব্য। এই ভেবে তারা সবাই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে অনুরিমা আজ সারা সন্ধ্যে বিশ্রাম নেবে। রাতের খাবারটা নাহয় তার শাশুড়ি মা বানিয়ে নেবে। সমীর যদিও তার মায়ের দিকটাও বিবেচনা করে হোম ডেলিভারি থেকে খাবার আনতে চাইলো , কিন্তু সমীরের মা সত্বর জানিয়ে দিলো যে আজকে বউমা কে বাইরের খাবার খাওয়ানোর ঝুঁকি নেওয়া যাবেনা। কোন খাবার থেকে ভেতরে কি ইনফেক্শন হয়ে যা , তা কে জানে ? তার চেয়ে বরং আজ বাড়িতেই রান্না হবে এবং চারুলতা দেবী অর্থাৎ সমীরের মা নিজেই রান্না-বান্নার সব দায়িত্ব নেবে। কালকে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর বউমা-কে কোনো কাজ করতে অ্যালাও করা হবে, তার আগে নয়।
এদিকে ডাইনিং রুমে বাবা মা ও ছেলের মধ্যে এসব আলোচনা হচ্ছিলো , তো ওদিকে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে অনুরিমা আজকে ঘটে যাওয়া সব মুহূর্তগুলোকে এক এক করে সাজিয়ে পূনরায় মনের পর্দা দিয়ে দেখছিলো, এবং না চাইতেও সেসব মুহূর্তগুলো ফীল করে যাচ্ছিলো। পাশে ছোট্ট তিন্নি অঘোড়ে ঘুমোচ্ছিলো। কিছুক্ষণ নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মন কে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ও মন প্লিজ আমাকে বিপথে চালিত করোনা। দেখো আমি শুধু কারোর স্ত্রী নয় , কারোর মাও , এবং কারোর বউমাও বটে। এতগুলো সম্পর্কের মায়াজাল ভেদ করে তুমি আমাকে অনির্দিষ্ট ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দিওনা। দোহাই তোমার , পায়ে পড়ি।
সমীরের আজ বড্ড বউটার কথা মনে পড়ছিলো। ভালোবাসার টান বোধহয় একেই বলে। স্ত্রী ওদিকে পরপুরুষের কামের জালে জড়িয়ে পড়েছে , তো এদিকে স্বামীর মন হঠাৎ করে উচাটন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন এই উচাটন মন আর কিই বা করবে। যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে সমীরের অগচরে। তাই হয়তো সমীরের মন আজ টিকছিলো না অফিসের ফাইলে।
অফিসে বসে আনমনে সমীর ভাবছিলো বিগত কয়েকদিন ধরে সে জেনে না জেনে কতখানি অনুরিমার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে ফেলেছে। বেচারি ! সে তো তাকে ভালোবাসে। আর সেই কিনা তার ভালোবাসাকে চোখের সামনে অন্য কারোর দ্বারা লুটতে দেখতে চায় ? নাহঃ নাহঃ ! ফ্যান্টাসি ফ্যান্টাসি করে না জানি সে কতদূর এগিয়ে গেছে। তারই জন্য অনুরিমাকে রাজীবের মতো এক অজানা অচেনা পুরুষের সাথে ভিক্টোরিয়ায় দেখা করতে যেতে হয়েছিল। রাজীব তার কাছে আসার চেষ্টা করেছিলো। এসব নিশ্চই অনুরিমার ভালো লাগেনি। না লাগারই কথা। অনুরিমা যে তাকে ছাড়া আর কাউকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি। অনুরিমা এই যাতনা সইবে কি করে ? না না সমীর , এটা ঠিক হচ্ছেনা। একদমই ঠিক হচ্ছেনা। তুই ভুল করছিস। সমীর বারংবার নিজের মনকে বলছিলো আর দুষছিলো। সে ঠিক করে নিয়েছিল যে অনেক হয়েছে আর না। এবার তার মনকে দড়ি পড়াতে হবে। নাহলে তার প্রতি অনুরিমার বিশ্বাস, ভালোবাসা সব নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা সে কিছুতেই মানতে পারবে না। তাই আজ সে বাড়ি গিয়ে অনুরিমাকে বলবে তার কোনো কাকোল্ড এক্সপিরিয়েন্স নেওয়ার দরকার নেই। সে যেমন আছে তেমনই ঠিক আছে।
![[Image: Part-23-A.jpg]](https://i.ibb.co/SyspGZf/Part-23-A.jpg)
![[Image: Part-23-B.jpg]](https://i.ibb.co/kx2pb2t/Part-23-B.jpg)
এসব ভাবতে ভাবতে সমীর একবার নিজের ফোনের দিকে তাকালো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো অথচ তার বউ তাকে আজকে একটাও কল দেয়নি ! Strange ! এরকম তো সে কখনো করেনা। তাহলে আজ কি হলো ? বলেছিলো ঠিকই যে সে আজ ওই সুচরিতার সাথে দেখা করতে যাবে। আর সুচরিতার সাথে কথা বলতে শুরু করলে তো অনুরিমার আর বাকি দুনিয়ার খেয়াল মাথায় থাকেনা। বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা ! কি জাদুই না জানে ওই মায়াবিনী সুচরিতা। এইজন্যই মেয়েটাকে আমার একদম ভালো লাগেনা। ভীষণ ম্যানিপুলেটিভ। না জানি আমার অনুকে কিনা কিই বুঝিয়ে দেবে ! কিন্তু অনুরিমার তো বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে আসার কথা। তাহলে সে ভুললো কি করে আজ আমায় কল করতে ? দেখি একবার ফোনটা করে।
নিজের মনে মনে এইভেবে সমীর ফোনটা হাতে নিলো। নিয়ে অনুরিমার নাম্বারে ডায়াল দিলো। কিন্তু নট্ রিচেয়েবেল ! কেন ? আজ বৃষ্টি হয়েছে বলে কি টাওয়ার এর প্রবলেম ? বেশ খান তিনেক বার সমীর ট্রাই করলো। প্রতিবার একই কথা , "The number you have dialed is not reachable at this moment, please try after sometime, or send a voice message by dialing............."
সমীর ফোনটা রেখে দিলো। ভাবলো কিছুক্ষণ পরে আবার ট্রাই করবে , না পেলে নাহয় বাড়িতে একটা কল দেবে। এখন তো সবে বিকেল হয়েছে , তাই বাইরে থাকলেও চিন্তার কিছু নেই। এইভেবে সমীর নিজের মনকে আস্বস্ত করলো। কিন্তু বাস্তবে সমীরের জীবনে নিস্তব্ধে যে প্রলয় এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল , তার পূর্বাভাস কোনো আবহাওয়া দপ্তর থেকে পাওয়াও অসম্ভব ছিল। স্বামীর স্ত্রীর জীবনে অলরেডি তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে গেছিলো , আর সেটা তার পরিচিত রাজীব নয়, তার স্ত্রীয়ের বান্ধবীর প্রাক্তন স্বামী আদিত্য সেনগুপ্ত। কখন কোথা থেকে সম্পর্কে সিঁধ কেটে চোর ঢুকে পড়ে মন চুরি করতে , তার খেয়াল কেই বা রাখে। ভীত নড়বড়ে হয়ে গেলে সিঁধ তো কাটা হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না তখন।
![[Image: Part-23-C.jpg]](https://i.ibb.co/MPbXS3Y/Part-23-C.jpg)
এসপ্ল্যানেড এর এক ছোট্ট লজে তিনতলার এক ঘরে তখন দুই নগ্ন নর নারী সামাজিক নৈতিকতার বিস্মরণ ঘটিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় ও অলীক স্বপ্নে মগ্ন ছিল। বিকেল বাড়ার সাথে সাথে যানবাহনের কোলাহল বাড়তে শুরু করলো। খোলা জানলা দিয়ে সেই আওয়াজ কানে পৌঁছতে শুরু করলো। এবং স্বাভাবিক নিয়মেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অনুরিমার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে সে দেখলো বাস্তব পৃথিবীটা কে। রিয়েলাইজেশন হলো সে এখন কোথায় আছে , কি অবস্থায় আছে এবং সর্বোপরি কার সাথে আছে !
চোখ দিয়ে অঝোরে জল বেরিয়ে এলো, কোন বাঁধ যেন দেওয়া যাচ্ছিলো না অশ্রুনদীতে। ক্রমাগত বাধা হীন ভাবে বয়ে চলেছিলো চোখ থেকে গাল বেয়ে। প্রথমে নিস্তব্ধে পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হলো। সেই ক্রন্দনের আওয়াজে আদিত্যর ঘুমও ভাঙলো। সেও প্রথমে ঘোরের মধ্যেই ছিল , চারদিকটা চেয়ে দেখলো আগে। তারপর দেখলো তার পাশে বিছানায় বসে এক রূপসী পরী কাঁদছে। চোখের সামনে অনুরিমার খোলা নগ্ন পিঠ দেখে মন আবার চাইলো দুপুরের অঘটনের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। কিন্তু এখন যে হাওয়া অনুকূলে নেই তা অনুরিমার কান্না দেখেই আদি বুঝতে পারছিলো। তাই এখন সময় ছিল কামনার খোলস ছেড়ে মানবিকতার পোশাক পড়ার। প্রেমিকের বদলে ফের একবার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ানোর ও মিথ্যে শান্ত্বনা প্রদান করার।
আদিত্য উঠে বসে পেছন থেকে অনুরিমার কাঁধে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ বেঁকিয়ে অনুরিমা সেই হাত নিজের শরীর থেকে সরিয়ে দিলো। সে শুধু দুঃখী নয় , রেগেও ছিল। আদিত্য পরিস্থিতি বুঝে আর বেশি বাড়াবাড়ি করলো না। সে বিছানা থেকে উঠে মেলতে থাকা নিজের জামা কাপড় গুলো এক এক করে নিয়ে পড়ে নিলো। তারপর অনুরিমার জামাকাপড় গুলো দড়ি থেকে তুলে বিছানায় অনুরিমার সামনে এনে রাখলো।
অনুরিমা সেগুলো এক এক করে পড়ে নিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণ করলো। তারপর আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে অনুরিমা নিজের ব্যাগ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলো। তার পায়ের যন্ত্রণাটা এখনও অল্পবিস্তর ছিল , আগে তা কামের বশে টের পায়নি। এখন আবার ব্যাথাটা একটু ধরেছিলো। আদিত্য তা দেখে অনুরিমাকে আটকাতে গেলো , অনুরিমা খুব বাজে ভাবে রিয়েক্ট করবে তা জেনেও। হলোও তাই। যখন আদিত্য অনুরিমাকে পেছন থেকে গিয়ে হাত ধরে টানলো , তখন অলরেডি ইর্রিটেটেড হয়ে থাকা অনুরিমা আরো রেগে গিয়ে এক কষিয়ে চড় বসালো আদিত্যর গালে। আদিত্য হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুরিমা রিয়েক্ট করবে সেটা কাঙ্খিত ছিল , তবে এতোটা রুক্ষ ভাবে করবে সেটা জানা ছিলোনা।
অপমানে আদিত্যর পা যেন মাটিতে আটকে গেছিলো। সে স্থির হয়ে রইলো , একটুও নড়াচড়া করলো না। অনুরিমা বড়ো বড়ো চোখ করে কটমটিয়ে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ, বিরক্তি, উষ্মা প্রকাশ করছিলো, যেন সে আদিকে গিলে ফেলতে চায়। অনু ফের ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে যেতে লাগলো। এবার আদিত্য কিছুটা রেগে ক্রোধিত গলায় অনুরিমাকে ডাকলো , "অনুরিমা !!!!......"
আদিত্যর কড়া গলার আওয়াজ শুনে অনু থমকে গেলো কিছু মুহূর্তের জন্য। আদিত্য গটমটিয়ে হেঁটে অনুরিমার কাছে এলো , হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ঘোরালো। জবাবদিহি চাইলো এভাবে থাপ্পড় মারার, "তুমি আমাকে চড় মারলে কেন ? কি এমন ক্ষতি করেছি তোমার ? আমাদের মধ্যে যা হয়েছে , দুজনের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতেই হয়েছে। মানছি তুমি এসব করতে চাওনি , কিন্তু আল্টিমেটলি তুমি তো আমাকে বাঁধা দিতে পারোনি। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাকে কাটগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ ?"
"হ্যাঁ , করাচ্ছি। কারণ আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম , বন্ধু হিসেবে। আর তুমি সেই বিশ্বাস ভেঙেছো। তুমি যখন জানতেই যে আমি কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ছি , তাহলে কেন নিজেকে সংযত করলে না ? কেন আমার দুর্বলতার সুযোগ এভাবে নিলে আদি ? লজ্জা করলো না একবারও তোমার তা করতে? ছিঃ! এই তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে ? এই তোমার বন্ধুত্ব ?" , এই বলে অনুরিমা অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
অনুর এই একগুচ্ছ প্রশ্নবাণের উত্তর আদির কাছে ছিলোনা। সে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না। অগত্যা চুপ করে মাথা নিচু হয়ে সে অনুরিমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আর সেই সুযোগে অনুরিমা আদিত্যর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে খানিকটা খুঁড়িয়ে, দৌড়াতে দৌড়োতে দরজা দিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। আদিত্য চেষ্টা করলো পেছন পেছন খানিকটা গিয়ে অনুকে ডেকে থামানোর, কিন্তু অনু তখন শোনে কার কথা ! সে চোখের জল মুছতে মুছতে লিফট দিয়ে নেমে চলে গেলো। আর আদিত্য? সে বেচারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
বাইরে বেরিয়ে অনুরিমা একটা ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলো। পেয়েও গেলো। ট্যাক্সিতে উঠে সে প্রথমে তার ব্যাগটা চেক করলো, সবকিছু রয়েছে কিনা , কিছু ছেড়ে আসেনি তো। ফোনটা দেখলো ডেড হয়ে পড়ে আছে। অনেক কষ্টে অন করে নেটওয়ার্ক পেলো। নেটওয়ার্ক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বাজলো , সমীরের নম্বর।
ফোন তুলতেই সমীর জিজ্ঞেস করে উঠলো , "কি গো , এতোবার করে ফোন করছি , ফোন আনরিচেবল আসছে ? বাড়িতেও তখন ফোন করলাম , বললো তুমি ফেরোনি। এখন কোথায় আছো তুমি ? বাড়িতে? ফিরেছো ?"
অনুরিমার প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। অপরাধবোধে সে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ থেমে কোনোমতে নিজের কান্নাকে আটকে সে উত্তর দিলো , "না.... , আমার এখনও ফেরা হয়নি। "
"এখনও ফেরোনি ??", অবাক হয়ে সমীর জিজ্ঞেস করলো।
"নাহঃ। ...."
"কোথায় আছো ? কি করছো ? কখন ফিরবে ?"
"আমি আসছি , এক্ষুনি আসছি। ট্যাক্সিতেই রয়েছি।"
"ঠিক আছে সাবধানে এসো", কিছুটা হতাশ গলায় সমীর বললো।
হুম, এসে সব বলছি ", বলেই অনুরিমা ফোনটা কেটে দিলো।
মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলো ! অনুরিমার এরূপ ঠান্ডা ও অপ্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া দেখে , শুনে , অনুভব করে সমীর হতবাক ! মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, "কি হয়েছে অনুরিমার ? শরীরটা ঠিক নেই নাকি ?"
ওদিকে অনুরিমা ফোনটা রেখেই আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো। ট্যাক্সির ড্রাইভারটা মানবিকতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলো , "কেয়া হুয়া মেমসাহাব , সাব ঠিক হ্যাঁ না ?"
অনুরিমা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিলো। বললো কিছু হয়নি তার। ট্যাক্সি ড্রাইভারটাও আর বেশি কথা বাড়ালো না। চুপচাপ অনুরিমাকে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দিতে ফোর্থ গিয়ারে দিলো গাড়ি। রাস্তা মোটামোটি ফাঁকা থাকায় তাড়াতাড়ি লেক টাউনে ঢুকে গেলো গাড়ি। বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লো অনুরিমা।
সমীর দরজা খোলায় বেশ খানিকটা অবাক হলো অনু। এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরার কারণ জিজ্ঞেস করলো তো সমীর উত্তর দিলো যে তার আজ কেন জানিনা অফিসের কাজকর্মে মন টিকছিলো না , বারবার নিজের স্ত্রীয়ের কথা মনে পড়ছিলো। তাই সাত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড়িয়ে এসছে। এই সবে ফিরলো সে। বাড়ি ঢোকার ঠিক আগে সে অনুরিমাকে ফোন করেছিলো। ফোনে যখন কথা হচ্ছিলো তখন সে ভিআইপি রোডে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল। একজন ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে নিজের বউয়ের জন্য ফুল কিনেছিলো। ভেবেছিলো অনুরিমা হয়তো এতোক্ষণে বাড়িতে চলে এসছে। সেটা জানতেই তখন সে অনুরিমাকে কল করেছিলো। সময়ের আগে তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরিমাকে ফুল দিয়ে সারপ্রাইস দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফোনে তো অনুরিমা বললো সে আসছে। মানে এখনও বাড়িই ফেরেনি !
![[Image: Part-23-D.jpg]](https://i.ibb.co/kqyv0Y2/Part-23-D.jpg)
দুঃখী মুখ করে সমীর কথা গুলো বলে গেলো। সমীরের কথা শুনে অনুরিমার বুকটা ফেটে গেলো। চেষ্টা করেও দু এক ফোঁটা জল চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ার থেকে আটকাতে পারলো না নিজেকে। অনুরিমার মুখ চোখ দেখে সমীরের ভালো ঠেক ছিলোনা। সে এই অশ্রুর পিছনের যথার্থ কারণ জিজ্ঞেস করতেই যাবে কি খেয়াল করলো অনুরিমার পায়ে ব্যাণ্ডেজ দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো তার স্ত্রীয়ের পায়ে কি হয়েছে ??
অনুরিমা বললো সব কথা দরজায় দাঁড়িয়ে বলা যাবেনা। সমীর তাকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। অনুরিমার এই অবস্থা দেখে তার শ্বশুর শাশুড়িও চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাকে নিয়ে সবাই ধর ধর করতে লাগলো। অনুরিমা মনে মনে ভাবলো এতো ভাগ্য করে সে এরকম একটা কেয়ারিং শশুর বাড়ি পেয়েছে , যেখানে স্বামীর সাথে সাথে তার শশুর শাশুড়িও তার এতো খেয়াল রাখে , সেখানে সে অবুজের মতো এরকম একটা কাজ করতে পারলো কি করে। পুরোনো কলকাতার বনেদি মল্লিক বাড়ির বউ হয়ে সে এক পরপুরুষের সাথে এসপ্লানেডের এক ছোট্ট হোটেলে সহবাস কি করে করতে পারে , তাও আবার তার বান্ধবীর প্রাক্তন স্বামীর সাথে ! ছিঃ! তার ওই লেক টাউনের খালের জলে দড়ি কলসি নিয়ে ডুবে মরতে ইচ্ছে করছিলো।
এসব ভেবে ভেবে অনুরিমার চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু নির্গত হচ্ছিলো , আর তার পরিবারের লোকজন ভাবছিলো ব্যাথার কারণে সেই অশ্রু নির্গত হচ্ছে। পায়ের ব্যাথা তো সে কখন সেরে গ্যাছে আদিত্যর শুশ্রূষায়। এটা তো ছিল অনুশোচনা , অপরাধবোধ, এবং আত্মগ্লানির ব্যাথা যা ভেতর থেকে তাকে শেষ করে দিচ্ছিলো।
খানিকক্ষণ শুশ্রূষা যত্ন-আত্তি করার পর অবশেষে সমীর তার বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে অনুরিমাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরে তাকে বিছানায় বসিয়ে আলতো করে তার উরুতে সমীর নিজের হাত বোলালো। খুব নরমভাবে সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো , "কি হয়েছে ? কিভাবে কাটলো পা ?"
![[Image: Part-23-E.jpg]](https://i.ibb.co/kq3zqBW/Part-23-E.jpg)
অনুরিমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সত্যিটা সে বলতে পারবেনা , আর মিথ্যে সে বলতে পারেনা। তাই অর্ধ সত্যি ও অর্ধ মিথ্যের মিশ্রণ করতে হলো তাকে। খানিকটা "অশ্বত্থামা হত,.. ইতি গজ" এর মতো। সে বললো বাড়ি ফেরার পথে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। বাস ট্যাক্সি কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছিলো না। একটা শেল্টার খুঁজে দৌড়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভেজা ফুটপাথে পা পিছলে সে পড়ে যায়। পথচলতি এক অজানা পুরুষ তাকে এসে সাহায্য করে। তার জন্য ওষুধের দোকান থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ , মলম , ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে আসে , এবং তার শুশ্রূষা করে। সেই লোকটার পরামর্শে অনুরিমা কাছে পিঠের এক ছোট্ট রেস্টুরেন্ট কাম হোটেলে কিছুক্ষণ স্টেই করে। বৃষ্টি ছাড়লেও রাস্তায় যানবাহন বেশি চলাচল করছিলো না। গুটিকয়েক ট্যাক্সি থাকলেও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ট্যাক্সির আগুন ভাড়া চড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তার উপর অনুরিমার করুণ অবস্থা দেখে কিছু অসৎ হলুদ ট্যাক্সিওয়ালা খুব বেশি ভাড়া চার্জ করছিলো। তাই সে সঠিক সময়ে সঠিক দামের মিটার অন থাকা নো রিফিউসাল ট্যাক্সির অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে পেলোও , এবং তাতে করে বাড়ি ফিরে এলো। তাই তার আসতে এতোটা দেরী হয়েছে আজ।
অনুরিমার সাজিয়ে বলা কথাগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁকফোকড় ছিলোনা। তাই সমীর সবটাই বিশ্বাস করলো। অনুরিমাই জানতো তার এই কথার মধ্যে কতোটা সত্যি আর কতোটা জল মেশানো আছে। সত্যিই তো আদিত্য একজন অজানা পুরুষই , তার সবটা জানা থাকলে কি আর অনুরিমার তার পাতা কামের ফাঁদে পা থুড়ি শরীরটা দিতো।
যাই হোক , সবকিছু শুনে সমীর আর কথা বাড়ালো না। অনুরিমাকে রেস্ট নিতে বললো। বলে সে ডাইনিং রুমে ফিরে এলো। নিজের বাবা মা-কে সবটা বললো। বাবা মাও পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনুরিমার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হলো , ছেলেকে বউমার পাশে থাকতে বললো। যে বউমা একা হাতে সবটা সামলায় , সেই বউমা আজ আহত। এখন তাকে সামলানো বাড়ির বাকি সদস্যদের কর্তব্য। এই ভেবে তারা সবাই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে অনুরিমা আজ সারা সন্ধ্যে বিশ্রাম নেবে। রাতের খাবারটা নাহয় তার শাশুড়ি মা বানিয়ে নেবে। সমীর যদিও তার মায়ের দিকটাও বিবেচনা করে হোম ডেলিভারি থেকে খাবার আনতে চাইলো , কিন্তু সমীরের মা সত্বর জানিয়ে দিলো যে আজকে বউমা কে বাইরের খাবার খাওয়ানোর ঝুঁকি নেওয়া যাবেনা। কোন খাবার থেকে ভেতরে কি ইনফেক্শন হয়ে যা , তা কে জানে ? তার চেয়ে বরং আজ বাড়িতেই রান্না হবে এবং চারুলতা দেবী অর্থাৎ সমীরের মা নিজেই রান্না-বান্নার সব দায়িত্ব নেবে। কালকে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর বউমা-কে কোনো কাজ করতে অ্যালাও করা হবে, তার আগে নয়।
এদিকে ডাইনিং রুমে বাবা মা ও ছেলের মধ্যে এসব আলোচনা হচ্ছিলো , তো ওদিকে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে অনুরিমা আজকে ঘটে যাওয়া সব মুহূর্তগুলোকে এক এক করে সাজিয়ে পূনরায় মনের পর্দা দিয়ে দেখছিলো, এবং না চাইতেও সেসব মুহূর্তগুলো ফীল করে যাচ্ছিলো। পাশে ছোট্ট তিন্নি অঘোড়ে ঘুমোচ্ছিলো। কিছুক্ষণ নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মন কে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ও মন প্লিজ আমাকে বিপথে চালিত করোনা। দেখো আমি শুধু কারোর স্ত্রী নয় , কারোর মাও , এবং কারোর বউমাও বটে। এতগুলো সম্পর্কের মায়াজাল ভেদ করে তুমি আমাকে অনির্দিষ্ট ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দিওনা। দোহাই তোমার , পায়ে পড়ি।