02-01-2024, 09:33 PM
পর্ব ১১
জাকার্তায় আজ মেঘাছন্নতা। ইন্দোনেশিয়ার এই রাজধানী শহর সমুদ্র তীরে। ভোর রাতেই ফ্লাইটে করে এ শহরে পৌঁছেছে পীযুষ। নতুন দেশের নুতন শহরে সঙ্গী বলতে এক তামিল অধ্যাপক।
হোটেলে সকালের জলখাবারে দেওয়া হল বাবুর, নাসি গোরেঙ ও গাডো গাডো নামে এক ধরনের স্যালাড। এই খাবারগুলি ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতির জলাহার। মন্দ নয় খেতে, বাবুর হল মোটা চালের এক বিচিত্র পোরিজ, নাসি গোরেঙ বরং ভালো। কিছুক্ষণ বাদে দিয়ে গেল সোটো নামক একপ্রকার চিকেন স্টু। মন্দ লাগলো না খেতে। বরং হ্যানয় শহরে ভিয়েতনামিজ খাবারগুলি বড্ড বিরক্তিকর ঠেকেছিল পীযুষের কাছে।
বিপুল জনসমাগমের শহর জাকার্তা। এখানে স্টেট ইউনিভার্সিটির সেমিনার হলে গবেষকরা বক্তব্য রাখবেন। তারপর পীযুষরা দুদিনের জন্য যাবে এখানকার বুকিত রায়া ন্যাশনাল পার্কে। বুকিত রায়াকে অনেকে 'বুকিত বায়া' বলে। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি হয়েছিল পীযুষের। গাইডলাইনে লেখা আছে 'রায়া' এখানে এসে জনলো 'বায়া'। অবশেষে এই বিভ্রান্তির নিষ্পত্তি হল ওদের সঙ্গে থাকা গাইড মার্দিনোর কাছ থেকে। 'বুকিত রায়া' আর 'বুকিত বায়া' অভিন্ন নাম। এই অরণ্যের এক আদিম মৃত আগ্নেয় গিরির নাম বুকিত বায়া। আর তাকেই স্থানীয়রা 'রায়া' বলে থাকে।
মার্দিনো ছেলেটা ইন্টার্ন। স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ওর ভালো নাম মহম্মদ মার্দিনো। ছেলেটা ভালো ইংরেজী বলতে পারে, এটাই যা পীযুষের সুবিধে। ফলত সমস্যা কমল বৈকি। স্টেট ইউনিভার্সিটির জুওলজি বিভাগের অধ্যক্ষ জুলকিফাইলি হাসান স্বাগত জানালেন দুই ভারতীয় অধ্যাপককে। বড় হল, প্রায় শ পাঁচেক শ্রোতা। যার বেশিরভাগই পোস্ট ডক্টরেটের ছাত্র। আর কিছু অধ্যাপক। একজন মিয়ানিজ অধ্যাপকও পীযুষদের সাথে রয়েছেন।
বড্ড ক্লান্তির গেল দিনটা। বিদেশ বিভুঁইতে এসে পীযুষ যতটা আরাম পাবে ভেবেছিল, এ ঠিক তার উল্টো। দিন কাটাতে না কাটতেই এ দেশ ও দেশ করে ইতিমধ্যে তিন দেশ ঘোরা হল। অদ্ভুত একটা ঠেকছে ওর। রমা থাকলে হয়ত এমন হত না। বেরোবার আগে, ব্যাগ, পেন, মোজা, শার্ট সবকিছুরই যত্ন নিত ও। রাতের বিছানায় বড্ড অবসন্নতা সর্বাঙ্গে। ফিরবার সময় জাকার্তার ফুটপাত থেকে একটা বই কিনেছিল পীযুষ, সেও ইতিহাসের। ইন্দোনেশিয়ার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস বড্ড রক্তক্ষয়ী, তা পীযুষের খানিক জানা। ইন্দোনেশিয়ানরা তাদের দেশের ইতিহাসকে কেমন দেখে, তা জানবার জন্যই এই বইটি কেনা। যে দেশ ঘোরা, সে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানব না, এমন রুচি পীযুষ রাখে না। অবশ্য ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তার সে প্রয়োজন পড়েনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস, আর সে দেশের দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ কে ই বা না জানে।
ঘুমটা ধরে এলো তার। বুকের ওপর পড়ে রইল বইটা। রাত এখন অনেক গভীর। রমা আর পিকলুর থেকে পীযুষ এখন নয় হাজার কিমি দূরে। ঐ যে। বড় জানলাটা ওপারেই ভারত মহাসাগর, তার ঠিক পরেই, ঐ তো বঙ্গোপসাগর। একটা ডিঙি নৌকা জ্বেলে ঐ কারা চলেছে যেন। ঐ নৌকা চলে যাচ্ছে আরও দূরে। পীযুষ উদগ্রীব, উন্মত্ত ওই ডিঙিটিকে রোখা দরকার। ওরা যাবে সুন্দরবন, ঐ তো আরেকটু পরেই কালনাগিনী, সুন্দরবন। পীযুষ দিকভ্রান্তের মত ছুটে যাচ্ছে। ঢেউ ভাঙছে, সিন্ধু বুকের তীব্র ঘোর আঁধার ভাঙছে। রাতের সমুদ্রে শীতল জলে তার সমগ্র শরীর। দু পা অসাড়। কেউ দেখতে পাচ্ছে না পীযুষকে, আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেল ডিঙি নৌকার আলো। ঠিক যেন মহাশূন্যের বুকে হঠাৎ করে হারিয়ে গেল নক্ষত্রটা। তার বদলে ধেয়ে আসছে একটা প্রকান্ড ঢেউ। পীযুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁচবার। অসাড় পা তবু যেন আটকে গেছে তার। আটকে গেছে, এই অচলাবস্থা থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। দীর্ঘ লড়াই করতে করতে ঘুম ভাঙলো তার। তৎক্ষনাৎ চারপাশটা বদলে গেল। কি এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! হাতের কাছে বেড সুইচ। আলোটা না জ্বেলেই বোঝা যায় ভোর হতে আর কিছু সময় বাকি। হয়ত এখন বাইরে মৃদু আভা।
কাচের বিরাট শার্সির পর্দা টেনে সরালো সে। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। এই হোটেল সমুদ্র তীরেই। কোত্থাও কোনো ঢেউ নেই। ভোরের আলো ফুটেছে, হোটেলের লনে চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে। পীযুষের পুরুষালি বুক কাঁপছে, তার স্বপ্নগুলো কেন আজকাল এমন হিংস্র হয়ে উঠছে! বিষাক্ত সরীসৃপের গবেষক, যুক্তিবাদী সাহসী মাস্টারমশাইয়ের পিতার সন্তান, কলেজ-কলেজে পড়াশোনা, খেলাধুলায় পারদর্শী সেই ছেলেটা আজ না হয় শম্ভুর মত যুবক নয়। তা বলে তার বুকে কেন অমন কাঁপন ধরল!
++++++
জাকার্তায় আজ মেঘাছন্নতা। ইন্দোনেশিয়ার এই রাজধানী শহর সমুদ্র তীরে। ভোর রাতেই ফ্লাইটে করে এ শহরে পৌঁছেছে পীযুষ। নতুন দেশের নুতন শহরে সঙ্গী বলতে এক তামিল অধ্যাপক।
হোটেলে সকালের জলখাবারে দেওয়া হল বাবুর, নাসি গোরেঙ ও গাডো গাডো নামে এক ধরনের স্যালাড। এই খাবারগুলি ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতির জলাহার। মন্দ নয় খেতে, বাবুর হল মোটা চালের এক বিচিত্র পোরিজ, নাসি গোরেঙ বরং ভালো। কিছুক্ষণ বাদে দিয়ে গেল সোটো নামক একপ্রকার চিকেন স্টু। মন্দ লাগলো না খেতে। বরং হ্যানয় শহরে ভিয়েতনামিজ খাবারগুলি বড্ড বিরক্তিকর ঠেকেছিল পীযুষের কাছে।
বিপুল জনসমাগমের শহর জাকার্তা। এখানে স্টেট ইউনিভার্সিটির সেমিনার হলে গবেষকরা বক্তব্য রাখবেন। তারপর পীযুষরা দুদিনের জন্য যাবে এখানকার বুকিত রায়া ন্যাশনাল পার্কে। বুকিত রায়াকে অনেকে 'বুকিত বায়া' বলে। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি হয়েছিল পীযুষের। গাইডলাইনে লেখা আছে 'রায়া' এখানে এসে জনলো 'বায়া'। অবশেষে এই বিভ্রান্তির নিষ্পত্তি হল ওদের সঙ্গে থাকা গাইড মার্দিনোর কাছ থেকে। 'বুকিত রায়া' আর 'বুকিত বায়া' অভিন্ন নাম। এই অরণ্যের এক আদিম মৃত আগ্নেয় গিরির নাম বুকিত বায়া। আর তাকেই স্থানীয়রা 'রায়া' বলে থাকে।
মার্দিনো ছেলেটা ইন্টার্ন। স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ওর ভালো নাম মহম্মদ মার্দিনো। ছেলেটা ভালো ইংরেজী বলতে পারে, এটাই যা পীযুষের সুবিধে। ফলত সমস্যা কমল বৈকি। স্টেট ইউনিভার্সিটির জুওলজি বিভাগের অধ্যক্ষ জুলকিফাইলি হাসান স্বাগত জানালেন দুই ভারতীয় অধ্যাপককে। বড় হল, প্রায় শ পাঁচেক শ্রোতা। যার বেশিরভাগই পোস্ট ডক্টরেটের ছাত্র। আর কিছু অধ্যাপক। একজন মিয়ানিজ অধ্যাপকও পীযুষদের সাথে রয়েছেন।
বড্ড ক্লান্তির গেল দিনটা। বিদেশ বিভুঁইতে এসে পীযুষ যতটা আরাম পাবে ভেবেছিল, এ ঠিক তার উল্টো। দিন কাটাতে না কাটতেই এ দেশ ও দেশ করে ইতিমধ্যে তিন দেশ ঘোরা হল। অদ্ভুত একটা ঠেকছে ওর। রমা থাকলে হয়ত এমন হত না। বেরোবার আগে, ব্যাগ, পেন, মোজা, শার্ট সবকিছুরই যত্ন নিত ও। রাতের বিছানায় বড্ড অবসন্নতা সর্বাঙ্গে। ফিরবার সময় জাকার্তার ফুটপাত থেকে একটা বই কিনেছিল পীযুষ, সেও ইতিহাসের। ইন্দোনেশিয়ার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস বড্ড রক্তক্ষয়ী, তা পীযুষের খানিক জানা। ইন্দোনেশিয়ানরা তাদের দেশের ইতিহাসকে কেমন দেখে, তা জানবার জন্যই এই বইটি কেনা। যে দেশ ঘোরা, সে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানব না, এমন রুচি পীযুষ রাখে না। অবশ্য ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তার সে প্রয়োজন পড়েনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস, আর সে দেশের দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ কে ই বা না জানে।
ঘুমটা ধরে এলো তার। বুকের ওপর পড়ে রইল বইটা। রাত এখন অনেক গভীর। রমা আর পিকলুর থেকে পীযুষ এখন নয় হাজার কিমি দূরে। ঐ যে। বড় জানলাটা ওপারেই ভারত মহাসাগর, তার ঠিক পরেই, ঐ তো বঙ্গোপসাগর। একটা ডিঙি নৌকা জ্বেলে ঐ কারা চলেছে যেন। ঐ নৌকা চলে যাচ্ছে আরও দূরে। পীযুষ উদগ্রীব, উন্মত্ত ওই ডিঙিটিকে রোখা দরকার। ওরা যাবে সুন্দরবন, ঐ তো আরেকটু পরেই কালনাগিনী, সুন্দরবন। পীযুষ দিকভ্রান্তের মত ছুটে যাচ্ছে। ঢেউ ভাঙছে, সিন্ধু বুকের তীব্র ঘোর আঁধার ভাঙছে। রাতের সমুদ্রে শীতল জলে তার সমগ্র শরীর। দু পা অসাড়। কেউ দেখতে পাচ্ছে না পীযুষকে, আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেল ডিঙি নৌকার আলো। ঠিক যেন মহাশূন্যের বুকে হঠাৎ করে হারিয়ে গেল নক্ষত্রটা। তার বদলে ধেয়ে আসছে একটা প্রকান্ড ঢেউ। পীযুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁচবার। অসাড় পা তবু যেন আটকে গেছে তার। আটকে গেছে, এই অচলাবস্থা থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। দীর্ঘ লড়াই করতে করতে ঘুম ভাঙলো তার। তৎক্ষনাৎ চারপাশটা বদলে গেল। কি এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! হাতের কাছে বেড সুইচ। আলোটা না জ্বেলেই বোঝা যায় ভোর হতে আর কিছু সময় বাকি। হয়ত এখন বাইরে মৃদু আভা।
কাচের বিরাট শার্সির পর্দা টেনে সরালো সে। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। এই হোটেল সমুদ্র তীরেই। কোত্থাও কোনো ঢেউ নেই। ভোরের আলো ফুটেছে, হোটেলের লনে চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে। পীযুষের পুরুষালি বুক কাঁপছে, তার স্বপ্নগুলো কেন আজকাল এমন হিংস্র হয়ে উঠছে! বিষাক্ত সরীসৃপের গবেষক, যুক্তিবাদী সাহসী মাস্টারমশাইয়ের পিতার সন্তান, কলেজ-কলেজে পড়াশোনা, খেলাধুলায় পারদর্শী সেই ছেলেটা আজ না হয় শম্ভুর মত যুবক নয়। তা বলে তার বুকে কেন অমন কাঁপন ধরল!
++++++