31-12-2023, 12:10 AM
পর্ব ১০
কাদাপাড়ার কাছে জ্যামে পড়ল পীযুষ। আজ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ আছে। ভিড়ের ধাক্কায় গাড়িটা দু কদম এগোলেই আবার থেমে যেতে হয়। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরী করেই কলেজে ঢুকল ও। কটা দিন পরেই ছুটি নিয়ে বিদেশ যাবে। স্টাফ রুমে একটা হৈ হট্টগোল শুনে বুঝতে পারলো ছাত্র সংসদের ছেলেরা কিছু একটা বিষয়ে তৎপর। ওরাই বোধ হয় ক্লাসগুলি বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলার অধ্যাপক অখিলেশ সান্যাল। বিরোধী দলের অধ্যাপক সংগঠনের নেতা। বিরক্তি মুখে বললেন---মন্ত্রী মহোদয় আসবেন বুঝলেন? রুলিং পার্টির ছাত্র সংসদ বলে কথা, তাই ক্লাস বন্ধ রেখেছে।
পীযুষ হতবাক হয়ে বললে---সে কথা আগেই জানালে হত, অত দূর আর গাড়ি ড্রাইভ করে আসতাম না।
---তাও তো আপনি লাঞ্চ আওয়ারে এলেন। আমি সেই সকাল দশটায় এসে আটকা পড়ে আছি।
---তা বসে আছেন কেন, ফিরে চলুন, আপনাকে নামিয়ে দেব।
মৃদু হেসে সান্যাল বাবু বললেন---সে হবার জো নেই। প্রিন্সিপ্যাল স্যার বলেছেন থাকতে হবে। মন্ত্রী আসবেন কিনা! ডিস্টেন্সে পাশ করা কোনোরকম কলেজ পেরোনো ঘুষখোর মন্ত্রীর কথায় আমাদের ঘাড় নামিয় হেঁ হেঁ করে যেতে হবে।
পীযুষ ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে ঢোক গিলে বললে---প্রিন্সিপ্যাল বললেই হল! আমার অত ফালতু সময় নেই।
অখিলেশ সান্যাল বললেন---গাড়ি এনেছেন তো? আমাকে সল্টলেক স্টেডিয়াম নামিয়ে দেবেন তবে। ডার্বি আছে যে।
---সে তো দেখলুম। তার জন্যই তো জ্যামে ফাঁসলাম।
---চলুন তবে, যদি তেমন কাজ না থাকে, মাঠে চলুন।
পীযুষ হাসলো, বললে---আমি কিন্তু মোহনবাগানী।
---তাতে কি? আমি কোথায় নিজেকে চার্চিল ব্রাদার্স বলাম! আমিও মোহনবাগানী। ইস্টবেঙ্গল শেষ কবে ডার্বি জিতেছিল?
বহুদিন পর পীযুষ আজ মাঠে। একসময় ভালো ক্রিকেট খেলত পীযুষ। কলেজ ক্রিকেটে ভালোই সুনাম ছিল ওর। কলকাতায় বহুবার মাঠে খেলা দেখতে এসেছে। শেষবার বোধ হয় রমা আর পিকলুকে নিয়ে এসেছিল ইডেনে ম্যাচ দেখতে। তবে ডার্বি দেখতে বহু দিন পর, কলেজে পড়বার সময়ই শেষবার। এখন খেলোয়াড়দেরও তেমন চেনা নেই। এই যা মাঝে মধ্যে কাগজে খেলার পাতায় চোখ বুলোলে নজরে পড়ে দু একটা নাম।
অখিলেশ সান্যাল অবশ্য নিয়মিত খেলার দর্শক। মাঠে ময়দানের সকল প্লেয়ার থেকে ম্যানেজমেন্ট তার নখদর্পণে। মোহনবাগান ক্লাবের মেম্বারশিপও আছে তার। মাথায় পালতোলা নৌকা চিহ্নের ফেটি বেঁধে সুবজ-মেরুন উল্লাসে কাটলো দিনটা। খেলার ফল ১-০! মোহনবাগান জয় পেয়েছে।
সান্যাল লোকটাকে দেখলে সম্ভ্রম হয় পীযুষের।প্রিন্সিপাল হবার যোগ্য ছিলেন এই সান্যাল। কিন্তু ঐ মাপকাঠি যে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তা তো সব হয় না। খেলার ময়দান থেকে পীযুষ বাড়ি ঢুকল চারটে নাগাদ। চাঁপা বললে---দাদা, তাড়াতাড়ি ফিইরলে যে?
পীযুষ জামা কাপড় বদলে বললে---চাঁপা, হালকা কিছু খাবার বানিয়ে দিস।
গা'টা বড্ড ম্যাজ ম্যাজ করছে। বড্ড ক্লান্তি শরীরে। রমাহীন, পিকলুহীন অনভ্যস্ত জীবন বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে পীযুষের। সাউথ-এশিয়ান রেপটাইলস কনভার্সেশন এলায়েন্স এর সেমিনারে ভারতবর্ষ থেকে অন্যতম গবেষক হিসেবে উপস্থিত থাকবে পীযুষ। মায়ানমারের একটি পা হীন টিকটিকি ডোপাসিয়া গ্রাসিলিস, যাকে উত্তর ভারতে আবার সাপ বলেই ধরা হয়, বাংলায় যা জলকেঁচো বলেও পরিচিত; সেই এশিয়ান গ্লাস লিজার্ড বিষয়ে একটা বক্তৃতা রেডি করতে হবে পীযুষকে। যদিও নইপাইডাও শহরে এ বিষয়ে অন্যতম বক্তা মিয়ানিজ অধ্যাপক চাও কিন, যেহেতু ভারতেও এই প্রাণীর দেখা মেলে, তাই ভারতীয় অধ্যাপক ডঃ পীযুষ মৈত্রকেও এ বিষয়ে কিছু বলতে হতে পারে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইগুলো ওলটপালট করে দেখছিল পীযুষ। বড্ড ঘুম ধরে আসছে চোখে। এমন অনভ্যস্ত জীবনে সে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিচ্ছে যদিও, তবুও সাবলীল হয়ে উঠছে না তার হৃদয়। আবার আগের মত তার সংসার ছন্দময় হয়ে উঠবে কবে, তার নিশ্চিত করে জানা নেই। এই প্রবল শূন্যতা নিয়ে সে কাটাচ্ছে প্রতিদিন। এত বড় বাড়ির সারাটা ঘর খাঁ খাঁ করে। পীযুষের মনে হচ্ছে সে একা হয়ে পড়তে পড়তে কেমন তলিয়ে যাচ্ছে এই ঘরের চারকুঠুরির একটা ঘরে।
++++++
কাদাপাড়ার কাছে জ্যামে পড়ল পীযুষ। আজ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ আছে। ভিড়ের ধাক্কায় গাড়িটা দু কদম এগোলেই আবার থেমে যেতে হয়। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরী করেই কলেজে ঢুকল ও। কটা দিন পরেই ছুটি নিয়ে বিদেশ যাবে। স্টাফ রুমে একটা হৈ হট্টগোল শুনে বুঝতে পারলো ছাত্র সংসদের ছেলেরা কিছু একটা বিষয়ে তৎপর। ওরাই বোধ হয় ক্লাসগুলি বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলার অধ্যাপক অখিলেশ সান্যাল। বিরোধী দলের অধ্যাপক সংগঠনের নেতা। বিরক্তি মুখে বললেন---মন্ত্রী মহোদয় আসবেন বুঝলেন? রুলিং পার্টির ছাত্র সংসদ বলে কথা, তাই ক্লাস বন্ধ রেখেছে।
পীযুষ হতবাক হয়ে বললে---সে কথা আগেই জানালে হত, অত দূর আর গাড়ি ড্রাইভ করে আসতাম না।
---তাও তো আপনি লাঞ্চ আওয়ারে এলেন। আমি সেই সকাল দশটায় এসে আটকা পড়ে আছি।
---তা বসে আছেন কেন, ফিরে চলুন, আপনাকে নামিয়ে দেব।
মৃদু হেসে সান্যাল বাবু বললেন---সে হবার জো নেই। প্রিন্সিপ্যাল স্যার বলেছেন থাকতে হবে। মন্ত্রী আসবেন কিনা! ডিস্টেন্সে পাশ করা কোনোরকম কলেজ পেরোনো ঘুষখোর মন্ত্রীর কথায় আমাদের ঘাড় নামিয় হেঁ হেঁ করে যেতে হবে।
পীযুষ ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে ঢোক গিলে বললে---প্রিন্সিপ্যাল বললেই হল! আমার অত ফালতু সময় নেই।
অখিলেশ সান্যাল বললেন---গাড়ি এনেছেন তো? আমাকে সল্টলেক স্টেডিয়াম নামিয়ে দেবেন তবে। ডার্বি আছে যে।
---সে তো দেখলুম। তার জন্যই তো জ্যামে ফাঁসলাম।
---চলুন তবে, যদি তেমন কাজ না থাকে, মাঠে চলুন।
পীযুষ হাসলো, বললে---আমি কিন্তু মোহনবাগানী।
---তাতে কি? আমি কোথায় নিজেকে চার্চিল ব্রাদার্স বলাম! আমিও মোহনবাগানী। ইস্টবেঙ্গল শেষ কবে ডার্বি জিতেছিল?
বহুদিন পর পীযুষ আজ মাঠে। একসময় ভালো ক্রিকেট খেলত পীযুষ। কলেজ ক্রিকেটে ভালোই সুনাম ছিল ওর। কলকাতায় বহুবার মাঠে খেলা দেখতে এসেছে। শেষবার বোধ হয় রমা আর পিকলুকে নিয়ে এসেছিল ইডেনে ম্যাচ দেখতে। তবে ডার্বি দেখতে বহু দিন পর, কলেজে পড়বার সময়ই শেষবার। এখন খেলোয়াড়দেরও তেমন চেনা নেই। এই যা মাঝে মধ্যে কাগজে খেলার পাতায় চোখ বুলোলে নজরে পড়ে দু একটা নাম।
অখিলেশ সান্যাল অবশ্য নিয়মিত খেলার দর্শক। মাঠে ময়দানের সকল প্লেয়ার থেকে ম্যানেজমেন্ট তার নখদর্পণে। মোহনবাগান ক্লাবের মেম্বারশিপও আছে তার। মাথায় পালতোলা নৌকা চিহ্নের ফেটি বেঁধে সুবজ-মেরুন উল্লাসে কাটলো দিনটা। খেলার ফল ১-০! মোহনবাগান জয় পেয়েছে।
সান্যাল লোকটাকে দেখলে সম্ভ্রম হয় পীযুষের।প্রিন্সিপাল হবার যোগ্য ছিলেন এই সান্যাল। কিন্তু ঐ মাপকাঠি যে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তা তো সব হয় না। খেলার ময়দান থেকে পীযুষ বাড়ি ঢুকল চারটে নাগাদ। চাঁপা বললে---দাদা, তাড়াতাড়ি ফিইরলে যে?
পীযুষ জামা কাপড় বদলে বললে---চাঁপা, হালকা কিছু খাবার বানিয়ে দিস।
গা'টা বড্ড ম্যাজ ম্যাজ করছে। বড্ড ক্লান্তি শরীরে। রমাহীন, পিকলুহীন অনভ্যস্ত জীবন বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে পীযুষের। সাউথ-এশিয়ান রেপটাইলস কনভার্সেশন এলায়েন্স এর সেমিনারে ভারতবর্ষ থেকে অন্যতম গবেষক হিসেবে উপস্থিত থাকবে পীযুষ। মায়ানমারের একটি পা হীন টিকটিকি ডোপাসিয়া গ্রাসিলিস, যাকে উত্তর ভারতে আবার সাপ বলেই ধরা হয়, বাংলায় যা জলকেঁচো বলেও পরিচিত; সেই এশিয়ান গ্লাস লিজার্ড বিষয়ে একটা বক্তৃতা রেডি করতে হবে পীযুষকে। যদিও নইপাইডাও শহরে এ বিষয়ে অন্যতম বক্তা মিয়ানিজ অধ্যাপক চাও কিন, যেহেতু ভারতেও এই প্রাণীর দেখা মেলে, তাই ভারতীয় অধ্যাপক ডঃ পীযুষ মৈত্রকেও এ বিষয়ে কিছু বলতে হতে পারে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইগুলো ওলটপালট করে দেখছিল পীযুষ। বড্ড ঘুম ধরে আসছে চোখে। এমন অনভ্যস্ত জীবনে সে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিচ্ছে যদিও, তবুও সাবলীল হয়ে উঠছে না তার হৃদয়। আবার আগের মত তার সংসার ছন্দময় হয়ে উঠবে কবে, তার নিশ্চিত করে জানা নেই। এই প্রবল শূন্যতা নিয়ে সে কাটাচ্ছে প্রতিদিন। এত বড় বাড়ির সারাটা ঘর খাঁ খাঁ করে। পীযুষের মনে হচ্ছে সে একা হয়ে পড়তে পড়তে কেমন তলিয়ে যাচ্ছে এই ঘরের চারকুঠুরির একটা ঘরে।
++++++