15-06-2019, 05:46 PM
খুন ও খুনের তদন্ত
কিছুক্ষন পরে পুলিশের জিপটা দক্ষিণ মহলের সামনে এসে দাড়ায়। মদন আর রতিকান্ত জিপ থেকে নেমে আসে। গেটের দিকে রতিকান্ত আগে আগে এগিয়ে যায়।
মদন গেটের কাছে এসে দেখতে পায়, ঠিক পাশেই একটা সুন্দর দোতলা বাড়ি আর সেই বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন বৃদ্ধ ইজি চেয়ারে বসে তাদের দিকে
তাকিয়ে আছে। মদন গেটের ভিতরে না ঢুকে সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দার নিচে দাড়িয়ে চেচিয়ে বলে, ‘স্যার, দু মিনিট কথা বলা যাবে, আমরা পুলিশ
থেকে আসছি।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক ইশারায় দাড়াতে বলে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। একটু পরে একটা চাকর নেমে মদন ও রতিকান্তকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে যায়। চাকরটা দুটো চেয়ার
এনে দেয়, তাতে মদন ও রতিকান্ত দুজনে বসে পড়ে। রতিকান্ত এবারে ভাল করে চেয়ে দেখে বৃদ্ধের সব চুল ধবধবে সাদা, রোগা কিন্তু হাত পায়ের গড়ন দেখলেই
বোঝা যায় এককালে ভালই স্বাস্থের অধিকারি ছিলেন।
মদন হাত জোড় করে নমস্কার করে বলে, ‘আমি মদন, আর এর নাম রতিকান্ত। আমরা দুজনেই পুলিশে চাকরি করি। জানেন তো বিনোদিনী দেবি খুন হয়েছেন,
সেই ব্যাপারে একটু কথা বলতে এলাম।’
বৃদ্ধ প্রতিনমস্কার করে বলে, ‘আমার নাম কিংকর চৌধুরী, রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। আমার এই জায়গাটা দেবনারায়ন রায়ের ছিল, আমি ওনার কাছ থেকে জমিটা
কিনে পরে বাড়ি করি। যাইহোক, আমি ভেবেছিলাম পুলিশ অনেক আগে আসবে আমার কাছে। কিন্তু অনেক দেরি করে এলেন।’
মদন ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘আসলে, বুঝতেই পারছেন, এই থানার এলাকাটা অনেক বড়, আবার পুলিশের লোকবল কম। তাই এই রতিকান্তকে সব ব্যাপারে সামাল
দিতে গিয়ে...........’
মদনের কথার মাঝে কিংকর চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘হ্যা, ওনার নাম আমি পেপারে পড়েছি। কিন্তু আপনাকে....’ কথা শেষ না করে বৃদ্ধ মদনের দিকে তাকিয়ে
থাকে।
মদন বলে, ‘হ্যা, এই কেসটায় সাহায্য করার জন্য আমি আজই এসেছি।’
‘হুম, আপনি খুব বুদ্ধিমান।’
বৃদ্ধের ঠেস দিয়ে কথাটা শুনে রতিকান্তের মুখটা একটু শুকিয়ে যায়। মদন অপ্রস্তুতে পড়ে যায়, কিন্তু কিন্তু করে বলে, ‘চৌধুরী সাহেব, আমার সঙ্গীটিও কম বুদ্ধিমান
নয়।’ কথাটা ঘোরানোর জন্য মদন বলে, ‘আপনি কি একাই থাকেন?’
বৃদ্ধের চোখ দেখলেই বোঝা যায়, বুদ্ধি প্রখর। মদনের কথা ঘোরান দেখে বৃদ্ধের মুখে হাল্কা হাসি খেলে যায়, কিন্তু মুখে বলে, ‘না, আমি আর আমার চাকর ভোলা এই
বাড়িতে থাকি। অনেকদিন আগে আমার স্ত্রী গত হয়েছেন। আর আমার একমাত্র ছেলে আমেরিকায় সেটল।’
এই বলে বৃদ্ধ থেমে গিয়ে মদন ও রতিকান্তের মুখের দিয়ে চায়। মদন ও রতিকান্ত কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। বৃদ্ধ একটু হেসে বলে, ‘দেখুন মদনবাবু, আমার
বয়স আশির ওপরে। বাড়ির থেকে বেরই না। শুধু প্রতিদিন বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে নটা অবধি এই বারান্দায় আমি বসে থাকি। চারটের থেকে যতক্ষন সূর্যের
আলো থাকে ততক্ষন খবরের কাগজটা পড়ি। তারপরে এখানে চুপ করে একা বসে থাকি। দুরের ওই পাহাড়টা দেখি, রাস্তার গাড়ি ঘোড়া দেখি। ঠিক রাত সাড়ে নটায়
ডিনার দেওয়া হয় তখন ঘরের ভেতরে চলে যাই। এই হল আমার রুটিন। এবারে বলুন আপনারা কি জানতে চান।’
মদন এই কথার মধ্যে বৃদ্ধের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পায়। মদন হেসে বলে, ‘চৌধুরী সাহেব, আপনার বুদ্ধিকে কুর্নিশ জানাই। আপনি কি জানাতে চান সেটা ঘুরিয়ে
বলে দিলেন। যাইহোক, বিনোদিনী দেবি খুনের আগেরদিন মানে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটের থেকে সাড়ে নটা অবধি আপনি কি দেখেছেন?’
বৃদ্ধ হেসে বলে, ‘মদনবাবু, আপনিও কিন্তু বুদ্ধিতে কম যান না। যাইহোক, সেদিন বিকেল তিনটের সময় বৃষ্টি নামে চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আমার রুটিন মত
বিকেল চারটের সময় বারান্দায় আমি এখন যেখানে বসে আছি সেখানে এসে বসি। বৃষ্টির জন্য আর সেদিন খবরের কাগজ পড়া হয় না। বারান্দায় চুপচাপ বসে রাস্তার
দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এখান থেকে বিনোদিনীর বাড়ির পাচিলের গেটটা আর বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকলে ড্রয়িং রুমের অনেকটা দেখা যায়। যাইহোক সন্ধ্যা
ছটার সময় ভাল স্বাস্থের একটা লোককে পাচিলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখি। এই লোকটাকে প্রতিমাসে একবার করে আসতে আগে দেখেছি। এই সময় সদর
দরজা খুলে বৃহন্নলা বেরিয়ে আসে, লোকটার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। লোকটা গিয়ে সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। দরজাটা হাট করে খোলা থাকে। তার ফলে
ড্রয়িং রুমের অনেকটা আমি দেখতে পাই। দেখি সোফায় বিনোদিনী বসে আছে। লোকটাকে দেখে বিনোদিনী ঘরের ভেতরে চলে যায়। একটু পরে ফিরে এসে
বিনোদিনী লোকটার হাতে একটা প্যাকেট দেয়। লোকটা সেটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে। সদর দরজাটা লোকটা বন্ধ করে দেয়।’
বৃদ্ধ দম নেবার জন্য থামে। তবে লোকটি কে সেটা রতিকান্ত ও মদনের বুঝতে বাকি থাকে না। অশোক তার মাসোয়ারা বাবদ পঁচিশ হাজার টাকাটা নিতে আসে।
আবার চৌধুরী সাহেব শুরু করেন, ‘হ্যা, যা বলছিলাম। লোকটা বেরিয়ে যাবার মিনিট দশেক পরে মানে সোয়া ছটার দিকে বিরেনকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখি। সদর
দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। এবারেও সদর দরজাটা খোলা থাকে। বিরেন ঢুকেই চেচাতে শুরু করে দেয়। এরপরে বিনোদিনীকে উত্তেজিত হয়ে কিছু
বলতে দেখি। এতদুর থেকে আমি ওদের কথাবার্তা শুনতে পাইনা। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারি দুজনে ঝগড়া করছে। যাইহোক একটু পরে বিরেন বেরিয়ে
আসে। বিরেন পাচিলের এই গেটটার সামনে এসে চেচিয়ে বলে, মাগি, মরণ খেলায় মেতেছিস তো, তোর মরন ঘনিয়ে আসছে। এইবলে বিরেন পাচিলের গেট খুলে
বেরিয়ে যায়।’
এই সময় চাকরটা চা নিয়ে আসে। মদন ও রতিকান্ত চা খেতে খেতে উৎসুক চোখে চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চৌধুরী সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে শুরু করে, ‘এরপরে ঠিক পৌনে সাতটার দিকে একটা রিক্সা এসে থামে। রিক্সার থেকে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা নামে। মহিলা
মাথায় ঘোমটাটা এতটা নামিয়ে রেখেছে যে মুখটা দেখা যায় না। ভদ্রলোকের মাথাটা এমনভাবে নামিয়ে রেখেছে যে আমি উপর থেকে মুখটা দেখতে পাইনা। রিক্সাটা
দাড়িয়ে থাকে। এরপরে দুজনে সদর দরজায় নক করে। বিনোদিনী দরজা খুলে হেসে দুজনকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। দরজাটা খোলাই থাকে। একটা সোফায়
বিনোদিনী বসে আর তার উল্টোদিকে ওই দুজন বসে। আমি এখান থেকে বিনোদিনীকে দেখতে পেলেও ওই দুজন আমার পেছন দিক করে বসায় মুখটা দেখতে পাই
না। খানিক্ষন তিনজনের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তারপরে ওই দুজন উঠে পড়ে, বিনোদিনী দুজনকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ওই
দুজন যখন পাচিলের গেটের কাছে আসে তখন লোকটা একবারের জন্য মুখটা উপরে তোলে। চিনতে পারি, বিরেনের মেজ ছেলে সরোজ। এরপরে সরোজ মেয়েটাকে
নুপুর বলে ডাকে। বুঝতে পারি সরোজ আর নুপুর দেখা করতে এসেছিল।’
দম নেবার জন্য বৃদ্ধ থামে। মদন রতিকান্তের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়। দুজনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে।
চৌধুরী সাহেব আবার শুরু করেন, ‘রিক্সাটা চলে যাবার একটু পরে প্রায় সাতটার দিকে দেখি লাবণ্য পাচিলের গেট খুলে ঢুকছে। আমাদের এখানে চুরি ডাকাতি কম
বলে এখানকার সবাই প্রায় সদর দরজা ভেজিয়ে রাখে, রাতে শোবার আগে খিল দেয়। যাইহোক লাবণ্য সদর দরজাটা ঠেলতেই খুলে যায়। সোফায় বিনোদিনীকে
বসে থাকতে দেখে তারদিকে এগিয়ে যায়। লাবন্যকে ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে দেখি। কিন্তু বিনোদিনীকে আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকতে
দেখি। লাবণ্যর একটা কথারও সে প্রতিবাদ করে না। এরপরে লাবণ্য বেরিয়ে আসে। সদর দরজাটা খোলাই থাকে। বিনোদিনীকে চুপ করে সোফায় বসে থাকতে দেখি।
প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে বিরেনের ছোট বৌমা প্রিয়ন্তি পাচিলের গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক চেয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সদর দরজা খোলা দেখে টুক করে ভেতরে
ঢুকে যায়। প্রিয়ন্তিকে দেখে বিনোদিনী দাড়িয়ে যায়। প্রিয়ন্তি বিনোদিনীর কাছে গিয়ে প্রনাম করে। বিনোদিনী প্রয়ন্তির মাথায় হাত রেখে বোধহয় আশীর্বাদ করে।
এরপরে বিনোদিনী ভেতরে চলে যায়, প্রিয়ন্তি ওখানেই দাড়িয়ে থাকে। একটু পরে বিনোদিনী ফিরে আসে, হাতে একটা গয়নার বাক্স দেখতে পাই। সেখান থেকে
একটা হার খুলে বিনোদিনী প্রিয়ন্তির গলায় পরিয়ে দেয়। আর কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে কথা চলে। তারপরে প্রিয়ন্তি বেরিয়ে চলে যায়। এরপরে প্রায় আটটার দিকে
মনোজকে গুটি গুটি পায়ে পাচিলের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখি। সদর দরজা খোলাই ছিল, মনোজ হাত জোড় করে বিনোদিনীর সামনে গিয়ে দাড়ায়। বিনোদিনীর মুখে
তাচ্ছ্যিলের ভাব দেখি, বারবার দরজার দিকে দেখিয়ে কিছু বলে। মনে হয় চলে যেতে বলছে। এরপরে হঠাৎ মনোজ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে
কিসব বলে। বিনোদিনী মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। মনোজ ধীরে ধীরে উঠে চলে আসে। মনোজ যখন পাচিলের কাছে আসে তখন তাকে দেখে মনে হয় ভীষণ হতাশ।’
চৌধুরী সাহেব কথা শেষ করে রতিকান্ত ও মদনের মুখের দিকে তাকায়। এতগুলো মারাত্মক ইনফরমেশন পেয়ে তখন দুজেনই খুব উত্তেজিত। মদন কিছুটা সামলে
নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা চৌধুরী সাহেব, বৃহন্নলাকে কখন ফিরতে দেখলেন?’
হেসে চৌধুরী সাহেব বলে, ‘ও হ্যা, বলতে ভুলে গেছি, বৃহন্নলা রাত সোয়া নটার দিকে ফেরে। সাড়ে নটার পরে ফিরলে বলতে পারতাম না। কারন তখন আমি
বারান্দা থেকে ঘরে চলে যাই।’
‘আর একটা প্রশ্ন,’ মদন জিজ্ঞেস করে, ‘মৃন্ময়ীকে সেদিন দেখেছিলেন?’
‘না, সেদিন বিনোদিনীকে একাই ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখেছিলাম। এখন ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকলে আলাদা কথা। তবে মৃন্ময়ী আমার চোখে পড়েনি।’
এরপরে সামান্য কিছু মামুলি কথাবার্তা হয়। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে মদন ও রতিকান্ত বেরিয়ে আসে।
মদন চৌধুরী সাহেবের বাড়ির থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ির দিকে হাটা দেয়। অবাক হয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে রায় বাড়িতে ঢুকবি না।’
‘না।’ মদনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘কিন্তু, বিনোদিনী যে ঘরে খুন হয়েছিল সেই ঘরটা একবার দেখবি না।’
মদন হাটতে হাটতে বলে, ‘না, তুই যখন দেখে নিয়েছিস তখন আমার গিয়ে লাভ নেই। আমি গিয়ে নতুন কিছু জানতে পারব না।’
রতিকান্ত নাছোড় হয়ে বলে, ‘চৌধুরী সাহেবের কাছে যেসব খবর পেলাম সেই নিয়ে একবার জেরা করবি না?’
জিপে উঠে বসে মদন বলে, ‘আয়, ওঠ। যথা সময়ে জিজ্ঞেস করব।’
রতিকান্ত বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
কিছুক্ষন পরেই মদন ও রতিকান্ত থানায় পৌঁছে যায়। মদন ও রতিকান্তের জন্য একটু পরে চা এসে যায়। চা খেতে খেতে মদন গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। রতিকান্ত
একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে মদনের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, বেটা এসে না এসেই কি খেল নাই দেখাল। একদিনে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করে নিল।
আর আমি কিনা.....।
খুনের আগের দিনে বিরেনবাবুর পুরো পরিবারটাই বিনোদিনীর ড্রয়িং রুমে হাজির হয়েছিল। বৃহন্নলা যখন বাড়িতে ছিল না ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যা ছটার থেকে
নটার মধ্যেই সবাই আলাদা আলাদা সময়ে এসে হাজির হয়েছিল। সবার আসা যাওয়ার গতিবিধির কথা চৌধুরী সাহেবের কাছে শুনে রতিকান্তের দৃঢ ধারনা হয় যে
প্রত্যেকেই তাদের বিনোদিনীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা ভীষণভাবে গোপন রেখেছিল। একে অপরের কথাটা জানত বলে মনে হয় না। কিন্তু কেন? রতিকান্তের মনে
প্রশ্ন দেখা দেয়।
বিরেনবাবু ও তার বড় ছেলে মনোজের বিনোদিনীর কাছে আসার ব্যাপারে রতিকান্ত মনে মনে একটা আন্দাজ করতে পারে। বিরেনবাবুর সাথে বিনোদিনীর ছোট
নাগপুরের কলিয়ারি নিয়ে বেশ মতের অমিল ছিল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে এর আগেও ঝামেলা হয়েছে। হয়ত সেই কারনে বিরেনবাবু বিনোদিনীর সাথে দেখা করতে
আসতে পারে। আর মনোজের একটা বড় কন্ট্রাক্ট বিনোদিনী হস্তগত করে। হয়ত সেই কন্ট্রাক্টটা ফেরত পাবার জন্য মনোজ অনুনয় বিনয় করতে আসতে পারে। কিন্তু
আর বাকি সদস্যদের আসার পেছনের কারন সম্পর্কে রতিকান্ত কোন আন্দাজ করতে পারে না।
রতিকান্ত এইসব ভাবতে ভাবতে টেবিলের উপরে তার নিজস্ব তদন্তের খাতাটা দেখতে পায়, খাতাটা টেনে নিয়ে চোখ বোলায়। খাতায় লেখা প্রশ্নগুলো চোখে পড়ে।
১. ঘর থেকে ঢোকা বেরোনোর একটিই পথ, সেটি দরজা। সেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে? খুনের অস্ত্রটাই বা কোথায়?
২. খুনি যেভাবে ছোরাটা বুকের মধ্যে বসিয়েছে তাতেই হার্ট ফুটো হয়ে বিনোদিনী দেবির মৃত্যু হয়েছে। তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকাল ব্যবহার করল কেন?
হাতের শিরাই বা কাটল কেন?
৩. বিনোদিনী দেবির রাতের পুরুষ সঙ্গীটি কে? নাকি রাতের সঙ্গী আর খুনি আলাদা লোক?
৪. বৃহন্নলা কেন কিছু টের পেল না?
৫. পচিশ হাজার টাকাটা কোথায় গেল?
৬.আলমারির লকারে গয়নার একটি বাক্স খালি কেন?
৭. অশোক কে? তার সাথে বিনোদিনী দেবির কি সম্পর্ক? সে প্রতিমাসে কি করতে আসে?
৮. বিনোদিনী দেবির ঘরে ধ্বস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। কেন? তাহলে খুনি কি বিনোদিনী দেবির পরিচিত?
রতিকান্ত দেখে শুধু তার ছ’নম্বরের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। কিন্তু আজকের ঘটনার পরে আরও কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। সেগুলি পরপর লিখে ফেলে।
৯. বিনোদিনীর সাথে বিরেনবাবুর কি নিয়ে বাদানুবাদ চলছিল? ব্যবসা সংক্রান্ত না অন্য কিছু?
১০. মনোজ হাত জোড় করে বিনোদিনীর কাছে কি চাইছিল? কন্টাক্ট ফেরত না অন্য কিছু?
১১. লাবণ্য কি নিয়ে তড়পাচ্ছিল? আর সেটা বিনোদিনী মুখ বুজে সহ্য করে গেল কেন?
১১. বিনোদিনীর কাছে সরোজ ও নুপুর কি গোপন শলা পরামর্শ করতে এসেছিল?
১২. প্রিয়ন্তি ঘরে ঢুকে বিনোদিনীকে প্রনাম করল কেন? দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক? সোনার হারটা প্রিয়ন্তিকে দিল কেন?
রতিকান্ত দেখে আলমারির লকারের গয়নার খালি বাক্সের উত্তরটা যেমন পাওয়া গেছে তেমন আরও পাঁচটা প্রশ্ন বেড়ে গেছে। পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে রতিকান্ত জানে
তদন্তের ক্ষেত্রে যত প্রশ্ন আসে তত উত্তরও খুজতে হয়, আর উত্তরগুলোই সমাধানের কাছে পৌঁছে দেয়।
রতিকান্তকে খাতায় মুখ গুঁজে লিখতে দেখে মদন জিজ্ঞেস করে, ‘রতি, কি লিখছিস?’
রতিকান্ত হেসে খাতাটা মদনের দিকে এগিয়ে দেয়। মদন মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নগুলো পড়ে। তারপরে বলে, ‘হুম, তুই পাঁচ, ছয়, আর সাত এই তিনটে প্রশ্নের উত্তর তো
পেয়ে গেছিস।’
রতিকান্ত বেজার মুখ করে বলে, ‘না, পুরো তিনটে নয় আড়াইটে প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।’
ভুরু কুঁচকে মদন জিজ্ঞেস করে, ‘কি রকম?’
‘পাঁচের প্রশ্নের পঁচিশ হাজার টাকাটা কে পেয়েছে সেটার উত্তর আগেই পেয়েছি। ছয়ের প্রশ্নের গয়নার বাক্স খালি কেন সেটা আজ জানলাম। সাতের প্রশ্নের অর্ধেক
উত্তর পেয়েছি। অশোক কে সেটা পরিস্কার হয়েছে কিন্তু বিনোদিনী দেবি কেন তাকে এত টাকা দিত সেটার কোন উত্তর পাইনি।’
হা, হা করে মদন হেসে ওঠে। বলে, ‘ধিরে, বেটা, ধিরে, সব জানা যাবে।’
রতিকান্ত অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, ‘খুনের আগের দিনে বিরেন রায়ের পুরো পরিবারটাই বিনোদিনীর ড্রয়িং রুমে হাজির হয়েছিল। অথচ জেরার সময় এই ব্যাপারটা
সবাই চেপে গেছে।’
মদন হেসে বলে, ‘সেটাই স্বাভাবিক, খুনের ঝামেলায় কে পড়তে চায়। আর তাছাড়া কেউ তো আর বিনোদিনী দেবির সাথে খেজুরে গল্প করতে যায়নি। সবারই কিছু
না কিছু ঝামেলা ছিল বিনোদিনীর সাথে। আর এই ঝামেলার ব্যাপারটা প্রকাশ পেলে পুলিশের সন্দেহ তার উপরে পড়বে। তাই সবাই সেই রাতের সাক্ষাতের কথাটা
চেপে যায়।’
রতিকান্ত ব্যগ্র হয়ে বলে, ‘প্রিয়ন্তির সাথে সেই রাতে বিনোদিনীর তো কোন ঝামেলা হয়নি, বরং বিনোদিনী তাকে সোনার গলার হার দিয়েছে। তাহলে সে চেপে গেল
কেন?’
মদন শান্ত হয়ে বলে, ‘প্রিয়ন্তি ঘরে ঢুকেই বিনোদিনীকে প্রনাম করে সেটা শুনে আমার ধারনা, প্রিয়ন্তির সাথে বিনোদিনীর কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। এখন প্রিয়ন্তির
শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে বিনোদিনীর আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। তাই সে চেপে গেছে।’
রতিকান্ত এবারে মদনকে চেপে ধরে, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ভয়ে সে রাতের সাক্ষাতের কথাটা চেপে গেল। তাই যদি হয়, তাহলে সে সকালে বিনোদিনীর সাথে তার
সাক্ষাতের কথাটা চেপে গেল না কেন?’
মদন হেসে উত্তর দেয়, ‘প্রিয়ন্তি অত্যন্ত বুদ্ধমতি। সেদিন বিনোদিনীর সাথে গাড়িতে ম্যানেজার ছিল। ম্যানেজার তাকে দেখে নেয়। পুলিশ কোন না কোন ভাবে কথাটা
ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে যাবে। তাই আগে ভাগে কথাটা বলে দেয়।’
মদনের কথা শেষ হবার পরেই হাবিলদার রামদিন ঘরে ঢুকে আসে। রামদিন রতিকান্তের কাছে এসে বলে, ‘স্যার, আমার আর দু বছর আছে রিটায়ার্ড করতে। তাই
বলছিলাম কি রিটায়ারমেন্টের কাগজ পত্রগুলো একটু যদি দেখে দেন।’
রতিকান্ত কিছু উত্তর দেবার আগেই, মদন রামদিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রামদিন, তুমি কি বললে?’
রামদিন তটস্থ হয়ে বলে, ‘স্যার, আমি আপনাকে কিছু বলিনি। আমি রতিকান্ত স্যারকে বলেছি।’
‘না, না কি বললে?’
রামদিন বেশ ভয়ে ভয়ে বলে, ‘স্যার, আমার দু বছর রিটায়ারমেন্টের বাকি আছে সেটাই বলছিলাম।’
মদন বিড়বিড় করে, ‘দুবছর, দুবছর।’
মদনের হাবভাব দেখে রতিকান্ত ও রামদিন দুজনেই অবাক হয়ে যায়। মদন বিড়বিড় করতে করতে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দেয়। রামদিনের রিটায়ার করতে
দুবছর বাকি, এটা শুনে সি.আই.ডি সাহেব এতটা ক্ষেপে যাবে রামদিন ভাবতে পারেনি। এখান থেকে সরে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে রামদিন দ্রুত ওখান থেকে
কেটে পড়ে।
মদনের হাবভাব দেখে রতিকান্তও বেশ অবাক হয়ে যায়। দুবছর কথাটা শুনে মদন এতটা ক্ষেপে গেল কেন সেটা রতিকান্তও ধরতে পারে না।
রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে মদন আচমকা প্রশ্ন করে, ‘রতিকান্ত, এই দুবছর কথাটা কোথায় শুনেছি বলতো?’
মদনের এই অদ্ভুত প্রশ্নের মানে রতিকান্তের মাথায় ঢোকে না। মদন আবার প্রশ্নটা করে কিন্তু রতিকান্ত কোন খেই না পেয়ে বলে, ‘কোথায় শুনেছিস?’
মদনকে বেশ বিচলিত দেখায়। বলে, ‘আরে, এই কেসের মধ্যেই কোথাও শুনেছি। তুই মনে করতে পারছিস না?’
রতিকান্ত দ্বিধায় পড়ে যায়। মনে করার চেষ্টা করে এই খুনের কেসের মধ্যে দুবছর কথাটা কখন শোনা গেছে। রতিকান্তের হঠাৎ মৃন্ময়ীর কথাটা মনে পড়ে, মৃন্ময়ী
বলেছিল সে অন্তসত্তা। কিন্তু সেটা তো দু মাসের, দুবছরের নয়। রতিকান্ত চিন্তায় পড়ে যায়। আচমকা তার কিছু মনে পড়ে যায়।
রতিকান্ত আশা নিয়ে বলে, ‘দেবনারায়ন তার ছোট ছেলে সুরেনের মৃত্যুর দুবছর পরে মারা যান।’
কথাটা বলে রতিকান্ত মদনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মদনের মুখ চোখে বেশ বিরক্তির ভাব দেখা যায়, মাথা নাড়িয়ে সে জানিয়ে দেয় রতিকান্তের উত্তরটা ঠিক
হয়নি। রতিকান্ত আরও চিন্তায় পড়ে যায়। মদন ঘরময় পায়চারি করতে থাকে।
রতিকান্ত শেষ চেষ্টা করে, ‘দেবনারায়নের মৃত্যুর দুবছর পরে তার বড় ছেলের বৌ ঋতম্ভরা আত্মহত্যা করেন।’
মদনের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে, খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে বলে, ‘উফ, রতিকান্ত, না, না, এটা নয়।’
রতিকান্ত খানিকটা অপ্রস্তুতে পড়ে যায়। মদন আচমকা টেবিলের উপরে একটা ঘুশি মেরে বলে, ‘ইয়েস, ইয়েস, মনে পড়েছে।’
মদনের ভাবভঙ্গি দেখে রতিকান্ত অবাক হয়ে যায়। কিন্তু মদন ততক্ষনে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে কাউকে ফোন করে। টেলিফোনে মদনের বাক্যালাপ শুনে রতিকান্তের
মুখে হাসি খেলে যায়। এতক্ষনে তার কাছেও দুবছর কথাটার মানে পরিস্কার হয়।
****************************************************
কিছুক্ষন পরে পুলিশের জিপটা দক্ষিণ মহলের সামনে এসে দাড়ায়। মদন আর রতিকান্ত জিপ থেকে নেমে আসে। গেটের দিকে রতিকান্ত আগে আগে এগিয়ে যায়।
মদন গেটের কাছে এসে দেখতে পায়, ঠিক পাশেই একটা সুন্দর দোতলা বাড়ি আর সেই বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন বৃদ্ধ ইজি চেয়ারে বসে তাদের দিকে
তাকিয়ে আছে। মদন গেটের ভিতরে না ঢুকে সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দার নিচে দাড়িয়ে চেচিয়ে বলে, ‘স্যার, দু মিনিট কথা বলা যাবে, আমরা পুলিশ
থেকে আসছি।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক ইশারায় দাড়াতে বলে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। একটু পরে একটা চাকর নেমে মদন ও রতিকান্তকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে যায়। চাকরটা দুটো চেয়ার
এনে দেয়, তাতে মদন ও রতিকান্ত দুজনে বসে পড়ে। রতিকান্ত এবারে ভাল করে চেয়ে দেখে বৃদ্ধের সব চুল ধবধবে সাদা, রোগা কিন্তু হাত পায়ের গড়ন দেখলেই
বোঝা যায় এককালে ভালই স্বাস্থের অধিকারি ছিলেন।
মদন হাত জোড় করে নমস্কার করে বলে, ‘আমি মদন, আর এর নাম রতিকান্ত। আমরা দুজনেই পুলিশে চাকরি করি। জানেন তো বিনোদিনী দেবি খুন হয়েছেন,
সেই ব্যাপারে একটু কথা বলতে এলাম।’
বৃদ্ধ প্রতিনমস্কার করে বলে, ‘আমার নাম কিংকর চৌধুরী, রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। আমার এই জায়গাটা দেবনারায়ন রায়ের ছিল, আমি ওনার কাছ থেকে জমিটা
কিনে পরে বাড়ি করি। যাইহোক, আমি ভেবেছিলাম পুলিশ অনেক আগে আসবে আমার কাছে। কিন্তু অনেক দেরি করে এলেন।’
মদন ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘আসলে, বুঝতেই পারছেন, এই থানার এলাকাটা অনেক বড়, আবার পুলিশের লোকবল কম। তাই এই রতিকান্তকে সব ব্যাপারে সামাল
দিতে গিয়ে...........’
মদনের কথার মাঝে কিংকর চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘হ্যা, ওনার নাম আমি পেপারে পড়েছি। কিন্তু আপনাকে....’ কথা শেষ না করে বৃদ্ধ মদনের দিকে তাকিয়ে
থাকে।
মদন বলে, ‘হ্যা, এই কেসটায় সাহায্য করার জন্য আমি আজই এসেছি।’
‘হুম, আপনি খুব বুদ্ধিমান।’
বৃদ্ধের ঠেস দিয়ে কথাটা শুনে রতিকান্তের মুখটা একটু শুকিয়ে যায়। মদন অপ্রস্তুতে পড়ে যায়, কিন্তু কিন্তু করে বলে, ‘চৌধুরী সাহেব, আমার সঙ্গীটিও কম বুদ্ধিমান
নয়।’ কথাটা ঘোরানোর জন্য মদন বলে, ‘আপনি কি একাই থাকেন?’
বৃদ্ধের চোখ দেখলেই বোঝা যায়, বুদ্ধি প্রখর। মদনের কথা ঘোরান দেখে বৃদ্ধের মুখে হাল্কা হাসি খেলে যায়, কিন্তু মুখে বলে, ‘না, আমি আর আমার চাকর ভোলা এই
বাড়িতে থাকি। অনেকদিন আগে আমার স্ত্রী গত হয়েছেন। আর আমার একমাত্র ছেলে আমেরিকায় সেটল।’
এই বলে বৃদ্ধ থেমে গিয়ে মদন ও রতিকান্তের মুখের দিয়ে চায়। মদন ও রতিকান্ত কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। বৃদ্ধ একটু হেসে বলে, ‘দেখুন মদনবাবু, আমার
বয়স আশির ওপরে। বাড়ির থেকে বেরই না। শুধু প্রতিদিন বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে নটা অবধি এই বারান্দায় আমি বসে থাকি। চারটের থেকে যতক্ষন সূর্যের
আলো থাকে ততক্ষন খবরের কাগজটা পড়ি। তারপরে এখানে চুপ করে একা বসে থাকি। দুরের ওই পাহাড়টা দেখি, রাস্তার গাড়ি ঘোড়া দেখি। ঠিক রাত সাড়ে নটায়
ডিনার দেওয়া হয় তখন ঘরের ভেতরে চলে যাই। এই হল আমার রুটিন। এবারে বলুন আপনারা কি জানতে চান।’
মদন এই কথার মধ্যে বৃদ্ধের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পায়। মদন হেসে বলে, ‘চৌধুরী সাহেব, আপনার বুদ্ধিকে কুর্নিশ জানাই। আপনি কি জানাতে চান সেটা ঘুরিয়ে
বলে দিলেন। যাইহোক, বিনোদিনী দেবি খুনের আগেরদিন মানে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটের থেকে সাড়ে নটা অবধি আপনি কি দেখেছেন?’
বৃদ্ধ হেসে বলে, ‘মদনবাবু, আপনিও কিন্তু বুদ্ধিতে কম যান না। যাইহোক, সেদিন বিকেল তিনটের সময় বৃষ্টি নামে চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আমার রুটিন মত
বিকেল চারটের সময় বারান্দায় আমি এখন যেখানে বসে আছি সেখানে এসে বসি। বৃষ্টির জন্য আর সেদিন খবরের কাগজ পড়া হয় না। বারান্দায় চুপচাপ বসে রাস্তার
দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এখান থেকে বিনোদিনীর বাড়ির পাচিলের গেটটা আর বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকলে ড্রয়িং রুমের অনেকটা দেখা যায়। যাইহোক সন্ধ্যা
ছটার সময় ভাল স্বাস্থের একটা লোককে পাচিলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখি। এই লোকটাকে প্রতিমাসে একবার করে আসতে আগে দেখেছি। এই সময় সদর
দরজা খুলে বৃহন্নলা বেরিয়ে আসে, লোকটার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। লোকটা গিয়ে সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। দরজাটা হাট করে খোলা থাকে। তার ফলে
ড্রয়িং রুমের অনেকটা আমি দেখতে পাই। দেখি সোফায় বিনোদিনী বসে আছে। লোকটাকে দেখে বিনোদিনী ঘরের ভেতরে চলে যায়। একটু পরে ফিরে এসে
বিনোদিনী লোকটার হাতে একটা প্যাকেট দেয়। লোকটা সেটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে। সদর দরজাটা লোকটা বন্ধ করে দেয়।’
বৃদ্ধ দম নেবার জন্য থামে। তবে লোকটি কে সেটা রতিকান্ত ও মদনের বুঝতে বাকি থাকে না। অশোক তার মাসোয়ারা বাবদ পঁচিশ হাজার টাকাটা নিতে আসে।
আবার চৌধুরী সাহেব শুরু করেন, ‘হ্যা, যা বলছিলাম। লোকটা বেরিয়ে যাবার মিনিট দশেক পরে মানে সোয়া ছটার দিকে বিরেনকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখি। সদর
দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। এবারেও সদর দরজাটা খোলা থাকে। বিরেন ঢুকেই চেচাতে শুরু করে দেয়। এরপরে বিনোদিনীকে উত্তেজিত হয়ে কিছু
বলতে দেখি। এতদুর থেকে আমি ওদের কথাবার্তা শুনতে পাইনা। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারি দুজনে ঝগড়া করছে। যাইহোক একটু পরে বিরেন বেরিয়ে
আসে। বিরেন পাচিলের এই গেটটার সামনে এসে চেচিয়ে বলে, মাগি, মরণ খেলায় মেতেছিস তো, তোর মরন ঘনিয়ে আসছে। এইবলে বিরেন পাচিলের গেট খুলে
বেরিয়ে যায়।’
এই সময় চাকরটা চা নিয়ে আসে। মদন ও রতিকান্ত চা খেতে খেতে উৎসুক চোখে চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চৌধুরী সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে শুরু করে, ‘এরপরে ঠিক পৌনে সাতটার দিকে একটা রিক্সা এসে থামে। রিক্সার থেকে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা নামে। মহিলা
মাথায় ঘোমটাটা এতটা নামিয়ে রেখেছে যে মুখটা দেখা যায় না। ভদ্রলোকের মাথাটা এমনভাবে নামিয়ে রেখেছে যে আমি উপর থেকে মুখটা দেখতে পাইনা। রিক্সাটা
দাড়িয়ে থাকে। এরপরে দুজনে সদর দরজায় নক করে। বিনোদিনী দরজা খুলে হেসে দুজনকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। দরজাটা খোলাই থাকে। একটা সোফায়
বিনোদিনী বসে আর তার উল্টোদিকে ওই দুজন বসে। আমি এখান থেকে বিনোদিনীকে দেখতে পেলেও ওই দুজন আমার পেছন দিক করে বসায় মুখটা দেখতে পাই
না। খানিক্ষন তিনজনের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তারপরে ওই দুজন উঠে পড়ে, বিনোদিনী দুজনকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ওই
দুজন যখন পাচিলের গেটের কাছে আসে তখন লোকটা একবারের জন্য মুখটা উপরে তোলে। চিনতে পারি, বিরেনের মেজ ছেলে সরোজ। এরপরে সরোজ মেয়েটাকে
নুপুর বলে ডাকে। বুঝতে পারি সরোজ আর নুপুর দেখা করতে এসেছিল।’
দম নেবার জন্য বৃদ্ধ থামে। মদন রতিকান্তের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়। দুজনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে।
চৌধুরী সাহেব আবার শুরু করেন, ‘রিক্সাটা চলে যাবার একটু পরে প্রায় সাতটার দিকে দেখি লাবণ্য পাচিলের গেট খুলে ঢুকছে। আমাদের এখানে চুরি ডাকাতি কম
বলে এখানকার সবাই প্রায় সদর দরজা ভেজিয়ে রাখে, রাতে শোবার আগে খিল দেয়। যাইহোক লাবণ্য সদর দরজাটা ঠেলতেই খুলে যায়। সোফায় বিনোদিনীকে
বসে থাকতে দেখে তারদিকে এগিয়ে যায়। লাবন্যকে ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে দেখি। কিন্তু বিনোদিনীকে আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকতে
দেখি। লাবণ্যর একটা কথারও সে প্রতিবাদ করে না। এরপরে লাবণ্য বেরিয়ে আসে। সদর দরজাটা খোলাই থাকে। বিনোদিনীকে চুপ করে সোফায় বসে থাকতে দেখি।
প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে বিরেনের ছোট বৌমা প্রিয়ন্তি পাচিলের গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক চেয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সদর দরজা খোলা দেখে টুক করে ভেতরে
ঢুকে যায়। প্রিয়ন্তিকে দেখে বিনোদিনী দাড়িয়ে যায়। প্রিয়ন্তি বিনোদিনীর কাছে গিয়ে প্রনাম করে। বিনোদিনী প্রয়ন্তির মাথায় হাত রেখে বোধহয় আশীর্বাদ করে।
এরপরে বিনোদিনী ভেতরে চলে যায়, প্রিয়ন্তি ওখানেই দাড়িয়ে থাকে। একটু পরে বিনোদিনী ফিরে আসে, হাতে একটা গয়নার বাক্স দেখতে পাই। সেখান থেকে
একটা হার খুলে বিনোদিনী প্রিয়ন্তির গলায় পরিয়ে দেয়। আর কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে কথা চলে। তারপরে প্রিয়ন্তি বেরিয়ে চলে যায়। এরপরে প্রায় আটটার দিকে
মনোজকে গুটি গুটি পায়ে পাচিলের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখি। সদর দরজা খোলাই ছিল, মনোজ হাত জোড় করে বিনোদিনীর সামনে গিয়ে দাড়ায়। বিনোদিনীর মুখে
তাচ্ছ্যিলের ভাব দেখি, বারবার দরজার দিকে দেখিয়ে কিছু বলে। মনে হয় চলে যেতে বলছে। এরপরে হঠাৎ মনোজ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে
কিসব বলে। বিনোদিনী মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। মনোজ ধীরে ধীরে উঠে চলে আসে। মনোজ যখন পাচিলের কাছে আসে তখন তাকে দেখে মনে হয় ভীষণ হতাশ।’
চৌধুরী সাহেব কথা শেষ করে রতিকান্ত ও মদনের মুখের দিকে তাকায়। এতগুলো মারাত্মক ইনফরমেশন পেয়ে তখন দুজেনই খুব উত্তেজিত। মদন কিছুটা সামলে
নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা চৌধুরী সাহেব, বৃহন্নলাকে কখন ফিরতে দেখলেন?’
হেসে চৌধুরী সাহেব বলে, ‘ও হ্যা, বলতে ভুলে গেছি, বৃহন্নলা রাত সোয়া নটার দিকে ফেরে। সাড়ে নটার পরে ফিরলে বলতে পারতাম না। কারন তখন আমি
বারান্দা থেকে ঘরে চলে যাই।’
‘আর একটা প্রশ্ন,’ মদন জিজ্ঞেস করে, ‘মৃন্ময়ীকে সেদিন দেখেছিলেন?’
‘না, সেদিন বিনোদিনীকে একাই ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখেছিলাম। এখন ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকলে আলাদা কথা। তবে মৃন্ময়ী আমার চোখে পড়েনি।’
এরপরে সামান্য কিছু মামুলি কথাবার্তা হয়। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে মদন ও রতিকান্ত বেরিয়ে আসে।
মদন চৌধুরী সাহেবের বাড়ির থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ির দিকে হাটা দেয়। অবাক হয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে রায় বাড়িতে ঢুকবি না।’
‘না।’ মদনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘কিন্তু, বিনোদিনী যে ঘরে খুন হয়েছিল সেই ঘরটা একবার দেখবি না।’
মদন হাটতে হাটতে বলে, ‘না, তুই যখন দেখে নিয়েছিস তখন আমার গিয়ে লাভ নেই। আমি গিয়ে নতুন কিছু জানতে পারব না।’
রতিকান্ত নাছোড় হয়ে বলে, ‘চৌধুরী সাহেবের কাছে যেসব খবর পেলাম সেই নিয়ে একবার জেরা করবি না?’
জিপে উঠে বসে মদন বলে, ‘আয়, ওঠ। যথা সময়ে জিজ্ঞেস করব।’
রতিকান্ত বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
কিছুক্ষন পরেই মদন ও রতিকান্ত থানায় পৌঁছে যায়। মদন ও রতিকান্তের জন্য একটু পরে চা এসে যায়। চা খেতে খেতে মদন গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। রতিকান্ত
একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে মদনের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, বেটা এসে না এসেই কি খেল নাই দেখাল। একদিনে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করে নিল।
আর আমি কিনা.....।
খুনের আগের দিনে বিরেনবাবুর পুরো পরিবারটাই বিনোদিনীর ড্রয়িং রুমে হাজির হয়েছিল। বৃহন্নলা যখন বাড়িতে ছিল না ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যা ছটার থেকে
নটার মধ্যেই সবাই আলাদা আলাদা সময়ে এসে হাজির হয়েছিল। সবার আসা যাওয়ার গতিবিধির কথা চৌধুরী সাহেবের কাছে শুনে রতিকান্তের দৃঢ ধারনা হয় যে
প্রত্যেকেই তাদের বিনোদিনীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা ভীষণভাবে গোপন রেখেছিল। একে অপরের কথাটা জানত বলে মনে হয় না। কিন্তু কেন? রতিকান্তের মনে
প্রশ্ন দেখা দেয়।
বিরেনবাবু ও তার বড় ছেলে মনোজের বিনোদিনীর কাছে আসার ব্যাপারে রতিকান্ত মনে মনে একটা আন্দাজ করতে পারে। বিরেনবাবুর সাথে বিনোদিনীর ছোট
নাগপুরের কলিয়ারি নিয়ে বেশ মতের অমিল ছিল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে এর আগেও ঝামেলা হয়েছে। হয়ত সেই কারনে বিরেনবাবু বিনোদিনীর সাথে দেখা করতে
আসতে পারে। আর মনোজের একটা বড় কন্ট্রাক্ট বিনোদিনী হস্তগত করে। হয়ত সেই কন্ট্রাক্টটা ফেরত পাবার জন্য মনোজ অনুনয় বিনয় করতে আসতে পারে। কিন্তু
আর বাকি সদস্যদের আসার পেছনের কারন সম্পর্কে রতিকান্ত কোন আন্দাজ করতে পারে না।
রতিকান্ত এইসব ভাবতে ভাবতে টেবিলের উপরে তার নিজস্ব তদন্তের খাতাটা দেখতে পায়, খাতাটা টেনে নিয়ে চোখ বোলায়। খাতায় লেখা প্রশ্নগুলো চোখে পড়ে।
১. ঘর থেকে ঢোকা বেরোনোর একটিই পথ, সেটি দরজা। সেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে? খুনের অস্ত্রটাই বা কোথায়?
২. খুনি যেভাবে ছোরাটা বুকের মধ্যে বসিয়েছে তাতেই হার্ট ফুটো হয়ে বিনোদিনী দেবির মৃত্যু হয়েছে। তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকাল ব্যবহার করল কেন?
হাতের শিরাই বা কাটল কেন?
৩. বিনোদিনী দেবির রাতের পুরুষ সঙ্গীটি কে? নাকি রাতের সঙ্গী আর খুনি আলাদা লোক?
৪. বৃহন্নলা কেন কিছু টের পেল না?
৫. পচিশ হাজার টাকাটা কোথায় গেল?
৬.আলমারির লকারে গয়নার একটি বাক্স খালি কেন?
৭. অশোক কে? তার সাথে বিনোদিনী দেবির কি সম্পর্ক? সে প্রতিমাসে কি করতে আসে?
৮. বিনোদিনী দেবির ঘরে ধ্বস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। কেন? তাহলে খুনি কি বিনোদিনী দেবির পরিচিত?
রতিকান্ত দেখে শুধু তার ছ’নম্বরের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। কিন্তু আজকের ঘটনার পরে আরও কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। সেগুলি পরপর লিখে ফেলে।
৯. বিনোদিনীর সাথে বিরেনবাবুর কি নিয়ে বাদানুবাদ চলছিল? ব্যবসা সংক্রান্ত না অন্য কিছু?
১০. মনোজ হাত জোড় করে বিনোদিনীর কাছে কি চাইছিল? কন্টাক্ট ফেরত না অন্য কিছু?
১১. লাবণ্য কি নিয়ে তড়পাচ্ছিল? আর সেটা বিনোদিনী মুখ বুজে সহ্য করে গেল কেন?
১১. বিনোদিনীর কাছে সরোজ ও নুপুর কি গোপন শলা পরামর্শ করতে এসেছিল?
১২. প্রিয়ন্তি ঘরে ঢুকে বিনোদিনীকে প্রনাম করল কেন? দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক? সোনার হারটা প্রিয়ন্তিকে দিল কেন?
রতিকান্ত দেখে আলমারির লকারের গয়নার খালি বাক্সের উত্তরটা যেমন পাওয়া গেছে তেমন আরও পাঁচটা প্রশ্ন বেড়ে গেছে। পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে রতিকান্ত জানে
তদন্তের ক্ষেত্রে যত প্রশ্ন আসে তত উত্তরও খুজতে হয়, আর উত্তরগুলোই সমাধানের কাছে পৌঁছে দেয়।
রতিকান্তকে খাতায় মুখ গুঁজে লিখতে দেখে মদন জিজ্ঞেস করে, ‘রতি, কি লিখছিস?’
রতিকান্ত হেসে খাতাটা মদনের দিকে এগিয়ে দেয়। মদন মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নগুলো পড়ে। তারপরে বলে, ‘হুম, তুই পাঁচ, ছয়, আর সাত এই তিনটে প্রশ্নের উত্তর তো
পেয়ে গেছিস।’
রতিকান্ত বেজার মুখ করে বলে, ‘না, পুরো তিনটে নয় আড়াইটে প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।’
ভুরু কুঁচকে মদন জিজ্ঞেস করে, ‘কি রকম?’
‘পাঁচের প্রশ্নের পঁচিশ হাজার টাকাটা কে পেয়েছে সেটার উত্তর আগেই পেয়েছি। ছয়ের প্রশ্নের গয়নার বাক্স খালি কেন সেটা আজ জানলাম। সাতের প্রশ্নের অর্ধেক
উত্তর পেয়েছি। অশোক কে সেটা পরিস্কার হয়েছে কিন্তু বিনোদিনী দেবি কেন তাকে এত টাকা দিত সেটার কোন উত্তর পাইনি।’
হা, হা করে মদন হেসে ওঠে। বলে, ‘ধিরে, বেটা, ধিরে, সব জানা যাবে।’
রতিকান্ত অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, ‘খুনের আগের দিনে বিরেন রায়ের পুরো পরিবারটাই বিনোদিনীর ড্রয়িং রুমে হাজির হয়েছিল। অথচ জেরার সময় এই ব্যাপারটা
সবাই চেপে গেছে।’
মদন হেসে বলে, ‘সেটাই স্বাভাবিক, খুনের ঝামেলায় কে পড়তে চায়। আর তাছাড়া কেউ তো আর বিনোদিনী দেবির সাথে খেজুরে গল্প করতে যায়নি। সবারই কিছু
না কিছু ঝামেলা ছিল বিনোদিনীর সাথে। আর এই ঝামেলার ব্যাপারটা প্রকাশ পেলে পুলিশের সন্দেহ তার উপরে পড়বে। তাই সবাই সেই রাতের সাক্ষাতের কথাটা
চেপে যায়।’
রতিকান্ত ব্যগ্র হয়ে বলে, ‘প্রিয়ন্তির সাথে সেই রাতে বিনোদিনীর তো কোন ঝামেলা হয়নি, বরং বিনোদিনী তাকে সোনার গলার হার দিয়েছে। তাহলে সে চেপে গেল
কেন?’
মদন শান্ত হয়ে বলে, ‘প্রিয়ন্তি ঘরে ঢুকেই বিনোদিনীকে প্রনাম করে সেটা শুনে আমার ধারনা, প্রিয়ন্তির সাথে বিনোদিনীর কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। এখন প্রিয়ন্তির
শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে বিনোদিনীর আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। তাই সে চেপে গেছে।’
রতিকান্ত এবারে মদনকে চেপে ধরে, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ভয়ে সে রাতের সাক্ষাতের কথাটা চেপে গেল। তাই যদি হয়, তাহলে সে সকালে বিনোদিনীর সাথে তার
সাক্ষাতের কথাটা চেপে গেল না কেন?’
মদন হেসে উত্তর দেয়, ‘প্রিয়ন্তি অত্যন্ত বুদ্ধমতি। সেদিন বিনোদিনীর সাথে গাড়িতে ম্যানেজার ছিল। ম্যানেজার তাকে দেখে নেয়। পুলিশ কোন না কোন ভাবে কথাটা
ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে যাবে। তাই আগে ভাগে কথাটা বলে দেয়।’
মদনের কথা শেষ হবার পরেই হাবিলদার রামদিন ঘরে ঢুকে আসে। রামদিন রতিকান্তের কাছে এসে বলে, ‘স্যার, আমার আর দু বছর আছে রিটায়ার্ড করতে। তাই
বলছিলাম কি রিটায়ারমেন্টের কাগজ পত্রগুলো একটু যদি দেখে দেন।’
রতিকান্ত কিছু উত্তর দেবার আগেই, মদন রামদিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রামদিন, তুমি কি বললে?’
রামদিন তটস্থ হয়ে বলে, ‘স্যার, আমি আপনাকে কিছু বলিনি। আমি রতিকান্ত স্যারকে বলেছি।’
‘না, না কি বললে?’
রামদিন বেশ ভয়ে ভয়ে বলে, ‘স্যার, আমার দু বছর রিটায়ারমেন্টের বাকি আছে সেটাই বলছিলাম।’
মদন বিড়বিড় করে, ‘দুবছর, দুবছর।’
মদনের হাবভাব দেখে রতিকান্ত ও রামদিন দুজনেই অবাক হয়ে যায়। মদন বিড়বিড় করতে করতে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দেয়। রামদিনের রিটায়ার করতে
দুবছর বাকি, এটা শুনে সি.আই.ডি সাহেব এতটা ক্ষেপে যাবে রামদিন ভাবতে পারেনি। এখান থেকে সরে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে রামদিন দ্রুত ওখান থেকে
কেটে পড়ে।
মদনের হাবভাব দেখে রতিকান্তও বেশ অবাক হয়ে যায়। দুবছর কথাটা শুনে মদন এতটা ক্ষেপে গেল কেন সেটা রতিকান্তও ধরতে পারে না।
রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে মদন আচমকা প্রশ্ন করে, ‘রতিকান্ত, এই দুবছর কথাটা কোথায় শুনেছি বলতো?’
মদনের এই অদ্ভুত প্রশ্নের মানে রতিকান্তের মাথায় ঢোকে না। মদন আবার প্রশ্নটা করে কিন্তু রতিকান্ত কোন খেই না পেয়ে বলে, ‘কোথায় শুনেছিস?’
মদনকে বেশ বিচলিত দেখায়। বলে, ‘আরে, এই কেসের মধ্যেই কোথাও শুনেছি। তুই মনে করতে পারছিস না?’
রতিকান্ত দ্বিধায় পড়ে যায়। মনে করার চেষ্টা করে এই খুনের কেসের মধ্যে দুবছর কথাটা কখন শোনা গেছে। রতিকান্তের হঠাৎ মৃন্ময়ীর কথাটা মনে পড়ে, মৃন্ময়ী
বলেছিল সে অন্তসত্তা। কিন্তু সেটা তো দু মাসের, দুবছরের নয়। রতিকান্ত চিন্তায় পড়ে যায়। আচমকা তার কিছু মনে পড়ে যায়।
রতিকান্ত আশা নিয়ে বলে, ‘দেবনারায়ন তার ছোট ছেলে সুরেনের মৃত্যুর দুবছর পরে মারা যান।’
কথাটা বলে রতিকান্ত মদনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মদনের মুখ চোখে বেশ বিরক্তির ভাব দেখা যায়, মাথা নাড়িয়ে সে জানিয়ে দেয় রতিকান্তের উত্তরটা ঠিক
হয়নি। রতিকান্ত আরও চিন্তায় পড়ে যায়। মদন ঘরময় পায়চারি করতে থাকে।
রতিকান্ত শেষ চেষ্টা করে, ‘দেবনারায়নের মৃত্যুর দুবছর পরে তার বড় ছেলের বৌ ঋতম্ভরা আত্মহত্যা করেন।’
মদনের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে, খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে বলে, ‘উফ, রতিকান্ত, না, না, এটা নয়।’
রতিকান্ত খানিকটা অপ্রস্তুতে পড়ে যায়। মদন আচমকা টেবিলের উপরে একটা ঘুশি মেরে বলে, ‘ইয়েস, ইয়েস, মনে পড়েছে।’
মদনের ভাবভঙ্গি দেখে রতিকান্ত অবাক হয়ে যায়। কিন্তু মদন ততক্ষনে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে কাউকে ফোন করে। টেলিফোনে মদনের বাক্যালাপ শুনে রতিকান্তের
মুখে হাসি খেলে যায়। এতক্ষনে তার কাছেও দুবছর কথাটার মানে পরিস্কার হয়।
****************************************************