15-06-2019, 05:43 PM
খুন ও খুনের তদন্ত
বিনোদিনী দেবির মৃত্যুর পর প্রায় দু মাস কেটে যায়। এই দুমাসে তদন্তের খুব একটা আশানুরূপ অগ্রগতি হয় না। রতিকান্ত অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। চোখের সামনে
একটা খাতা খোলা আছে। তদন্তের প্রথমদিকে রতিকান্ত কতগুলো প্রশ্ন খাতায় নোট করেছিল। সেগুলি আর একবার ঝালিয়ে নেয়।
১. ঘর থেকে ঢোকা বেরোনোর একটিই পথ, সেটি দরজা। সেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে? খুনের অস্ত্রটাই বা কোথায়?
২. খুনি যেভাবে ছোরাটা বুকের মধ্যে বসিয়েছে তাতেই হার্ট ফুটো হয়ে বিনোদিনী দেবির মৃত্যু হয়েছে। তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকাল ব্যবহার করল কেন?
হাতের শিরাই বা কাটল কেন?
৩. বিনোদিনী দেবির রাতের পুরুষ সঙ্গীটি কে? নাকি রাতের সঙ্গী আর খুনি আলাদা লোক?
৪. বৃহন্নলা কেন কিছু টের পেল না?
৫. পচিশ হাজার টাকাটা কোথায় গেল?
৬. আলমারির লকারে গয়নার একটি বাক্স খালি কেন?
৭. অশোক কে? তার সাথে বিনোদিনী দেবির কি সম্পর্ক? সে প্রতিমাসে কি করতে আসে?
৮. বিনোদিনী দেবির ঘরে কোন ধ্বস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। তাহলে খুনি কি বিনোদিনী দেবির পরিচিত?
এই আটটা প্রশ্নের মধ্যে শুধু পাঁচ আর সাত এই দুটি প্রশ্নের মাত্র উত্তর পাওয়া গেছে। তাও সাত নম্বর প্রশ্নের পুরো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিনোদিনী দেবি প্রতি মাসে
পঁচিশ হাজার টাকা অশোককে কেন দিত সেটা জানা যায়নি। অশোক যে উত্তরটা দিয়েছে সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। খড়কুটোর মত যাও বা অশোককে পাওয়া
গিয়েছিল সেটাও তো কোর্ট থেকে খালাস নিয়ে ড্যাংড্যাং করে চলে গেল।
গত দুমাসের তদন্তের নিটফল আটটা প্রশ্নের মধ্যে মাত্র দেড়টার উত্তর পাওয়া গেছে। রতিকান্ত নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই হতাশ হয়ে পড়ে। এই পারফরম্যান্সে
চাকরিতে বদলি বা ডিমশন কপালে নাচছে সেটা রতিকান্ত ভালই বুঝতে পারে।
আজ বড় সাহেবের কাছে রতিকান্তের ডাক পড়েছে। রতিকান্ত জানে আজ তার দিনটা খারাপ যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। বড় সাহেবের ডাককে অমান্য করার
সাহস তার নেই। বড় সাহেবের ঘরের সামনে রতিকান্ত অপেক্ষা করে। একটু পরেই ডাক পড়ে।
রতিকান্ত ঘরে ঢুকেই একটা লম্বা স্যালুট দেয়। বড় সাহেবের চোখ একটা ফাইলে নিবদ্ধ, মুখ তুলে ইশারায় রতিকান্তকে বসতে বলে। রতিকান্ত বসে অপেক্ষা করে।
একটু পরে বড় সাহেব ফাইলটা সরিয়ে রেখে রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রতিকান্ত, কেসের কি খবর?’
‘স্যার, তদন্ত চলছে।’
‘আজীবন চলবে নাকি। অ্যা।’
‘না, স্যার চেষ্টা তো করছি।’
‘দেখ রতিকান্ত, মন্ত্রী সাহেব প্রতিদিন ফোন করে কেসের খবর নিচ্ছেন। আমি কোন উত্তর দিতে পারছি না। তোমার জন্য আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।’
রতিকান্ত গুম মেরে চুপ করে থাকে। সেটা বোধহয় বড় সাহেবের খেয়াল হয়, তাই মোলায়েম সুরে বলেন, ‘রতিকান্ত, তুমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ব্রাইট
অফিসার। তুমি তো জান মন্ত্রী সাহেবের সাথে বিনোদিনী দেবির একটু দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। বুঝতেই পারছ, মন্ত্রী সাহেবের কতটা ব্যথা আছে এই কেসটার জন্য।’
এই কথাটা বলার সময় বড় সাহেবের চোখেমুখে একটা দুষ্টুমির ভাব রতিকান্ত নজর এড়ায় না। রতিকান্ত চুপ করে থাকে। বড় সাহেব বলেন, ‘রতিকান্ত, কেসটার
আগা গোঁড়া সব আমাকে বল।’
রতিকান্ত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবিস্তারে আবার বলে। খুব মন দিয়ে বড় সাহেব রতিকান্তের কথা শুনে যায়। রতিকান্তের কথা শেষ হলে বড় সাহেব বলে,
‘রতিকান্ত তুমি ভুতে বিশ্বাস কর।’
বড় সাহেবের কথা শুনে রতিকান্ত অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘না, স্যার।’
বড় সাহেব একটু গুম মেরে থাকে, তারপরে চোখ দুটো কুঁচকে বলে, ‘রতিকান্ত, তুমি যা বললে তার মোদ্দা কথা, ঘরের দরজা ভেঙ্গে বিনোদিনীকে রক্তাক্ত অবস্থায়
পাওয়া যায়। তোমার কথা অনুযায়ী ঘরে ঢোকা বেরোনোর ওই একটিই পথ। আবার বিনোদিনীর শরীরে পুরুষের বীর্য পাওয়া গেছে, তারমানে রাতে ভালই মস্তি
লুটেছেন। দু মাস ধরে তদন্ত করে রতিকান্ত তুমি যা আমাকে বললে তাতে তো আমার তিনটি উপায় ছাড়া আমার মাথায় কিছুই আসছে না। এক নম্বর, খুনির অদৃশ্য
হবার ক্ষমতা আছে। দরজা ভেঙ্গে যখন ঢোকা হয় তখন খুনি অদৃশ্য হয়ে যায়। তাই তোমার কেউ তাকে দেখতে পাও নি। দুই নম্বর, খুনির বাতাসে মিলিয়ে যাবার
ক্ষমতা আছে। খুন করে বাতাসের সাথে মিশে দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিন নম্বর, খুনি আর কেউ নয় একটি ভুত। ভুতকে ধরা বাপেরও অসাধ্যি। ভুত বাবাজি
সারারাত মস্তি লুটে তারপরে খুন করে চলে যায়।’
বড় সাহেবের কথা শুনে রতিকান্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এটুকু বুঝতে পারে বড় সাহেব তাকে বিদ্রুপ করছে। তবুও মরিয়া হয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার,
আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’
‘মজা! রতিকান্ত, আমি মজা করছি না, তুমি মজা করছ আমার সাথে।’
‘মানে!’
‘রতিকান্ত, বন্ধ ঘরের মধ্যে খুন করা যেতে পারে কিন্ত পালানর জন্য তো একটা রাস্তা দরকার। সেটা কোথায়, তুমি আমাকে বোঝাও। তাহলে খুনি কিভাবে পালাল?’
‘স্যার, সেটাই তো বড় প্রশ্ন।’
‘বড় প্রশ্ন! রতিকান্ত, তুমি সামান্য ব্যাপারটাকে জটিল করে তুলছ।’
‘বুঝলাম না, স্যার।’
‘আমার কাছে ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার। রতিকান্ত, তুমি এতদিন পুলিশে কাজ করছ আর ব্যাপারটা ধরতে পারছ না।’
বড় সাহেবের কথার মাথামুণ্ডু রতিকান্ত কিছুই ধরতে পারে না। বড় সাহেব সিরিয়াসলি বলছে না ঠাট্টা করছে সেটাও রতিকান্ত বুঝতে পারে না। তাই রতিকান্ত চুপ
করে থাকাই শ্রেয় মনে করে।
বড় সাহেব আবার শুরু করে, ‘রতিকান্ত, কেসটা আমি সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। বিনোদিনী সুচতুর মহিলা ছিলেন। বিনোদিনী তার শ্বশুরকে হাত করে রায়
পরিবারের বেশির ভাগ সম্পত্তি, টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন। কাজেই বিরেন ও তার পরিবারের বিনোদিনীর উপর রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার
মৃন্ময়ীর সাথে তার শাশুড়ির আদায় কাঁচকলায়। মৃন্ময়ী মনে মনে বিনোদিনীকে অসম্ভব ঘৃণা করে। শত্রুর শ্ত্রু বন্ধু, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিনোদিনীর দুই প্রবল শ্ত্রু
বিরেন ও মৃন্ময়ী এক হয়ে গেছে। দুজনে হাত মিলিয়ে নিয়েছে। বিনোদিনীর মৃত্যু হলে দুপক্ষেরই লাভ। মৃন্ময়ীর যেমন বুকের জ্বালা মিটবে তেমনি বিনোদিনীর পরে
সমস্ত সম্পত্তির সেই একমাত্র উত্তরাধিকারী। বিনোদিনীর জন্য যেমন বিরেন অনেক সম্পত্তির থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার বিনোদিনী বিরেন ও তার পরিবারের
বর্তমান ব্যবসাগুলিতে থাবা বসাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। কাজেই বিনোদিনীর মৃত্যু হলে বিরেন ও তার পরিবার যেমন স্বস্তি পাবে তেমনি তাদের মনের
প্রতিশোধটাও নেওয়া হয়ে যাবে। এই খুনের প্ল্যানটা কার্যকরী করার জন্য হয়ত মৃন্ময়ীর সাথে বিরেনের এমন একটা বোঝাপড়া হয়েছে যাতে কিছু সম্পত্তি বিরেন
ফিরে পায়। এটা আমার অনুমান, এরকম বোঝাপড়া নাও হতে পারে। যাইহোক খুনটা মৃন্ময়ী ও বিরেন পুরো ছক কষে করেছে।’
‘কিন্তু স্যার, আমাদের হাবিলদার রামদিনও তো দরজা ভাঙ্গার সময় উপস্থিত ছিল।’
‘হুম, রামদিনের চাকরি আর মাত্র দুবছর আছে। দু বছর পরে রিটায়ার্ড করার পরে রামদিন কত টাকা পাবে সেটা তুমি ভাল করেই জান। টাকার প্রয়োজন সবার
আছে আর বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা সবাই চায়। রামদিনের হাতে বিশাল অঙ্কের টাকা গুঁজে দিয়ে তাকে প্লানে সামিল করাটা খুব সহজ ব্যাপার।’
রামদিনকে অনেকদিন ধরে রতিকান্ত দেখে আসছে। রামদিন খুবই সত প্রকৃতির মানুষ। তাকে এইভাবে ঘুষখোর, অসৎ বলাটা রতিকান্ত মেনে নিতে পারে না, বলে,
‘স্যার, রামদিনের সার্ভিস রিপোর্ট ক্লিন। তাকে সৎ বলে থানার সবাই জানে। এতদিনের চাকরি জীবনে তার কোন গণ্ডগোল পাওয়া যায়নি।’
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বড় সাহেব বলে, ‘আরে দুর দুর, মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই কেউ খুনি, চোর, ডাকাত হয়না। একটা আটান্ন বছরের লোক চুরি করতে গিয়ে
ধরা পড়ল। এখন যেহেতু সে সাতান্ন বছর চুরি করেনি তাই সে চুরি করতে পারে না। এটা কি কোন কথা হল। দেখ রতিকান্ত, মতিভ্রম কার কখন হবে সেটা বলা
যায়না।’
রতিকান্ত এই ছেঁদো যুক্তির কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। তাই চুপ থাকাই মনস্থির করে।
এরপরে বড় সাহেব সিরিয়াস মুখ করে বলে, ‘শোন রতিকান্ত, খুনটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্লান করে করা হয়েছে। এই প্লানে মৃন্ময়ী, বিরেন ও তার পরিবার এবং রামদিন
সবাই জড়িত। এদের মিলি ভগতের কাজ। যথেষ্ট আটঘাট বেঁধে তোমাকে এগোতে হবে। বিরেনের উপরমহলে ভাল কানেকশন আছে তাই প্রথমে মৃন্ময়ী, বিরেন ও
তার পরিবারের কাউকে ছুতে যেওনা। প্রথমে রামদিনকে তোল। আচ্ছা মতন দাওয়াই দাও, দেখবে পেট থেকে সব বেরিয়ে আসবে। এরপরে তোমার মৃন্ময়ী, বিরেনকে
এরেস্ট করতে অসুবিধে হবে না।’
ফ্যালফ্যাল করে রতিকান্ত বড় সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, এই লোকটাই কিছুদিন আগে তাকে অশোকের ক্ষেত্রে এইরকম একটা উদ্ভট বুদ্ধি
দিয়েছিল। তাতে পুলিশকে বেইজ্জতের একশেষ হতে হয়। এরপরে রতিকান্ত মনে মনে বড় সাহেবের উদ্দেশ্যে যেসব শব্দ আওড়ায় সেসব বড় সাহেবের কানে গেলে
পিলে চমকে উঠত। বড় সাহেবের প্রস্তাবটা যে একটুও তার মনপুত হয়নি সেটা রতিকান্তের মুখচোখই বলে দেয়। সেটা বড় সাহেবের নজর এড়ায় না, তাই একটু রুড
হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে রতিকান্ত, তোমাকে আর সাতদিন সময় দিলাম। এই সাতদিনে কিছু করতে না পারলে কেসটা সি.আই. ডি র হাতে চলে যাবে। এখন
আসতে পার।’
রতিকান্ত সাথে সাথে উঠে পড়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে, যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তবে রতিকান্ত মনে মনে ভাবে, লোকটা যতই ভাট বকুক, যুক্তিগুলো খুব একটা
ফেলনা নয়। বিনোদিনীর প্রতি বিরেনবাবু আর মৃন্ময়ীর চোখেমুখে অসম্ভব ঘৃণা সেটার আঁচ রতিকান্ত জেরা করতে গিয়েই পেয়েছে। বড়সাহেবের কথা মত, যদি সত্যি
বিরেনবাবু আর মৃন্ময়ী হাত মিলিয়ে নেয় তবে তাদের কাছে রামদিন ও বৃহন্নলা এই দুজনকে প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে খুনের প্লানে সামিল করিয়ে নেওয়াটা কোন
অসম্ভব ব্যাপার নয়। এতে বিনোদিনী দেবির খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে এই জটটার একটা সহজ উত্তর পাওয়া যায়।
বড় সাহেবের কথা অনুযায়ী রতিকান্ত মনে মনে খুনের প্ল্যানটার একটা কাল্পনিক রুপ দেবার চেষ্টা করে। রতিকান্ত মনে মনে ভেবে নেয়, ভোর ছটায় বৃহন্নলা বিনোদিনী
দেবির ঘরে চা দিয়ে আসে। রামদিনের নাইট ডিউটি ছিল, তাই সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সাতটার সময় বিরেনবাবু, মনোজ ও রামদিন এই তিনজন পুরুষ
বিনোদিনীর উপর চড়াও হয় এবং হাতের শিরা কেটে বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করে ফেলে। এরপরে মৃন্ময়ী বা যে কোন একজন মেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজার
ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। সাজানো নাটকের মত বিরেনবাবু, মনোজ আর রামদিন কাঠের গুড়ি দিয়ে দরজাটা ভেঙ্গে ফেলে। ঘরে ঢুকে রামদিন আলমারি সার্চ করার
একটা নাটক করে। প্লান মাফিক মনোজ এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে আর ডক্টর ঘোষালকে বিরেনবাবু ডেকে নিয়ে আসেন। এই প্ল্যানে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে
এই ধন্দে পুলিশকে খুব সহজে ফেলা যায়।
এই ভাবনার মধ্যে যুক্তি থাকলেও রতিকান্তের কেন জানিনা মনে হয় ব্যাপারটা অতিসরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। আর তাছাড়া রতিকান্তের মনে আরও একটা প্রশ্ন দেখা
দেয়, যদি এইভাবেই খুন করার থাকে তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকালটি ব্যবহার করল কেন? নাকি এটাও পুলিশকে বিভ্রান্ত করার একটা প্রচেষ্টা। রতিকান্তের
সবকিছু গুলিয়ে যায়। মাথা ভনভন করে।
রতিকান্ত থানায় ফিরে আসে। হাতে মাত্র সাতদিন সময়। এই সাতদিনের মধ্যে কিছু করে না দেখাতে পারলে কেসটা সি. আই. ডি র হাতে চলে যাবে।
এই দুমাসে রতিকান্ত কেসটার পেছনে কম পরিশ্রম করেনি। রায় পরিবারের উত্তর মহল ও দক্ষিণ মহল এই দুই বাড়ির উপর নজর রাখার জন্য সর্বক্ষণের জন্য চর ছেড়ে
রেখেছে। এই দুই বাড়িতে কে কখন আসছে, কে কখন বেরচ্ছে সব খবরই রতিকান্ত নিয়মিত পায়। এছাড়াও বিরেনবাবু, মনোজ ও মৃন্ময়ীর পেছনে আলাদা করে
ফেউ লাগিয়ে রেখেছে। কে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে সব খবরই রতিকান্তের কানে পৌঁছে যায়। কিন্তু এই দু মাসে রায় পরিবারের সদশ্যদের মধ্যে বেচাল
কিছু পায় না।
এছাড়াও বিরেনবাবু, মনোজ, সরোজ, লাবণ্য, নুপুর, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ী এদের অতীত সম্পর্কেও রতিকান্ত খোঁজ খবর লাগায়। এদের অতীত সম্পর্কে যেসব তথ্য
পাওয়া যায় সেগুলি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে রতিকান্তের মনে হয় না। তবে কয়েকজনের অতীত বেশ চমকে দেবার মত কিন্তু এই কেসের সাথে সেইসব তথ্যের খুব
একটা লিংক আছে বলে রতিকান্তের মনে হয় না।
রতিকান্ত বড় সাহেবের সাথে দেখা করে আসার পর থেকে গুম মেরে আছে। সেদিন রামদিনকে রতিকান্ত সামান্য কারনে ঝাড় দিয়ে দেয়। বোঝা যায় রতিকান্তের
মেজাজটা খিচড়ে আছে। ভয়ে কেউ রতিকান্তের কাছে ঘেঁষে না। রতিকান্তর সামনে বিনোদিনী দেবির খুনের কেসের ফাইলটা খোলা। সেদিকে তাকিয়ে রতিকান্ত গভীর
চিন্তায় ডুবে যায়। বিনোদিনীর খুনের কেসটা এমন ভাবে জট পাকিয়ে রয়েছে যে রতিকান্ত তদন্তটা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
এইসময় সামনের খোলা ফাইলটায় দেখে রায় পরিবারের সব সদস্যদের অতীত নিয়ে খবর নেওয়া হয়েছে কিন্তু বিনোদিনী দেবির অতীত নিয়ে তো কোন খবর জোগাড়
করা হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা তার নজর এড়িয়ে যাওয়াতে রতিকান্তের নিজের উপরেই রাগ হয়। রতিকান্ত এক মুহূর্ত দেরি না করে থানা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
কিছু সময় পরে রতিকান্ত বিরেন বাবুর অফিসে এসে হাজির হয়। এখানে আসার আগে অবশ্য রতিকান্ত টেলিফোনে বিরেনবাবুর সাথে কথা বলে নিয়েছিল। সোজা
বিরেনবাবুর চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত হয়।
বিরেনবাবু সাদরে আহ্বান করে রতিকান্তকে চেয়ারে বসতে বলেন। রতিকান্ত বসেই সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে, বিরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি
বিনোদিনী দেবির অতীত সম্পর্কে যা জানেন সব বলুন?’
‘রতিকান্তবাবু, মুশকিলে ফেলে দিলেন। বিনোদিনীর অতীত সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। শুনলে আরও অবাক হবেন, বিনোদিনীর বাড়ি কোথায়, তার মা বাবার
কি নাম, তার পরিবারে আর কেউ আছে কিনা এসবের কিছুই জানিনা।’
বিরেনবাবুর কথা শুনে রতিকান্ত ভীষণ অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘কিন্তু বিনোদিনী দেবি তো আপনার ভাইয়ের বৌ ছিলেন, আর যতদূর জানি বিয়েটা এরেঞ্জ ম্যারেজ
ছিল। তাহলে বিনোদিনী সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না, এটা কি করে হয়?’
রতিকান্তের চোখেমুখে অবিশ্বাস ভাব ফুটে ওঠে, সেটা বিরেনবাবুর নজর এড়ায় না, বলে, ‘দেখুন রতিকান্তবাবু, আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন তাহলে
আমার তো কিছু করার নেই। কিন্তু যেটা বলছি সেটাই সত্যি। আমার ভাইয়ের জন্য বিনোদিনীকে পছন্দ করে এনেছিলেন আমার বাবা দেবনারায়ন। বিনোদিনী এক
কাপড়ে আমাদের বাড়িতে আসে। মেয়েদের বাড়ির থেকে যা যা করনীয়, শাড়ির থেকে, গয়নার থেকে সব কিছু বাবা করেছিলেন। শুধু বিনোদিনীর সম্প্রদানটা বাবার
এক বন্ধু করেছিলেন। সেই সময় বিয়ে বাড়িতে এই নিয়ে বেশ গুঞ্জন উঠেছিল। বাবা ছিল ভীষণ মেজাজি মানুষ, তাই বিনোদিনী সম্পর্কে সাহস করে বাবাকে কেউ
কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। তাও বাবার কানে বোধহয় গুঞ্জনটা গিয়েছিল, তাই বাবা একদিন বাড়ির সবাইকে ডেকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বিনোদিনী
তার ছোটছেলের বৌ, এটাই তার পরিচয়। এর বাইরে বিনোদিনীর আজ থেকে অন্য কোন পরিচয় নেই। এই বিষয়ে আর কারও কিছু জানার দরকার নেই। বাবার এই
এক হুঁশিয়ারিতে সব ঠাণ্ডা মেরে যায়। আমিও আর এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পরে বুঝতে পেরেছি এটা আমি ভুল করেছি।’
এই বলে বিরেনবাবু চুপ করে যায়। কিন্তু রতিকান্ত কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না, বলে, ‘ভুল করেছেন কেন?’
‘বাবার মৃত্যুর পরে বুঝতে পারি, এক মায়াবি নাগিন আমাদের পরিবারে ঢুকে গেছে। ওই নচ্ছার মহিলা আমাদের পরিবারটাকে যেভাবে শেষ করে দিয়ে গেছে তাতে
বুঝতে পারি এই মহিলা আর যাই হোক কোন ভদ্র পরিবার থেকে আসেনি। সেই সময় বিনোদিনীর বাপ মায়ের হদিশ পাবার জন্য আমি অনেক চেষ্টা চরিত্র করি কিন্তু
কিছুই জানতে পারিনা। কি বলব রতিকান্তবাবু, এমনকি আমি বেশ্যা পল্লীতেও পাতা লাগাই যদি কিছু খবর পাওয়া যায়। যাইহোক বাবাই একমাত্র জানত
বিনোদিনীর অতীতটা। বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে বিনোদিনীর অতীতটাও মুছে গেছে।’
এইসব কথা বলার সময় বিরেনবাবুর চোখেমুখে অসম্ভব ঘৃণা লক্ষ্য করা যায়। শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য বিরেনবাবুর নিজের ভাইয়ের বৌয়ের প্রতি এত বিদ্বেষ নাকি
আরও অন্য কোন কারন আছে সেটা ঠিক রতিকান্তের বোধগম্য হয় না। এরপরে রতিকান্ত আর দাড়ায় না, চলে আসে।
বহু চেষ্টা করেও বিনোদিনী দেবির অতীত সম্পর্কে জানার কোন সুত্রই রতিকান্ত পায় না।
************************************************
বিনোদিনী দেবির মৃত্যুর পর প্রায় দু মাস কেটে যায়। এই দুমাসে তদন্তের খুব একটা আশানুরূপ অগ্রগতি হয় না। রতিকান্ত অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। চোখের সামনে
একটা খাতা খোলা আছে। তদন্তের প্রথমদিকে রতিকান্ত কতগুলো প্রশ্ন খাতায় নোট করেছিল। সেগুলি আর একবার ঝালিয়ে নেয়।
১. ঘর থেকে ঢোকা বেরোনোর একটিই পথ, সেটি দরজা। সেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে? খুনের অস্ত্রটাই বা কোথায়?
২. খুনি যেভাবে ছোরাটা বুকের মধ্যে বসিয়েছে তাতেই হার্ট ফুটো হয়ে বিনোদিনী দেবির মৃত্যু হয়েছে। তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকাল ব্যবহার করল কেন?
হাতের শিরাই বা কাটল কেন?
৩. বিনোদিনী দেবির রাতের পুরুষ সঙ্গীটি কে? নাকি রাতের সঙ্গী আর খুনি আলাদা লোক?
৪. বৃহন্নলা কেন কিছু টের পেল না?
৫. পচিশ হাজার টাকাটা কোথায় গেল?
৬. আলমারির লকারে গয়নার একটি বাক্স খালি কেন?
৭. অশোক কে? তার সাথে বিনোদিনী দেবির কি সম্পর্ক? সে প্রতিমাসে কি করতে আসে?
৮. বিনোদিনী দেবির ঘরে কোন ধ্বস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। তাহলে খুনি কি বিনোদিনী দেবির পরিচিত?
এই আটটা প্রশ্নের মধ্যে শুধু পাঁচ আর সাত এই দুটি প্রশ্নের মাত্র উত্তর পাওয়া গেছে। তাও সাত নম্বর প্রশ্নের পুরো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিনোদিনী দেবি প্রতি মাসে
পঁচিশ হাজার টাকা অশোককে কেন দিত সেটা জানা যায়নি। অশোক যে উত্তরটা দিয়েছে সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। খড়কুটোর মত যাও বা অশোককে পাওয়া
গিয়েছিল সেটাও তো কোর্ট থেকে খালাস নিয়ে ড্যাংড্যাং করে চলে গেল।
গত দুমাসের তদন্তের নিটফল আটটা প্রশ্নের মধ্যে মাত্র দেড়টার উত্তর পাওয়া গেছে। রতিকান্ত নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই হতাশ হয়ে পড়ে। এই পারফরম্যান্সে
চাকরিতে বদলি বা ডিমশন কপালে নাচছে সেটা রতিকান্ত ভালই বুঝতে পারে।
আজ বড় সাহেবের কাছে রতিকান্তের ডাক পড়েছে। রতিকান্ত জানে আজ তার দিনটা খারাপ যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। বড় সাহেবের ডাককে অমান্য করার
সাহস তার নেই। বড় সাহেবের ঘরের সামনে রতিকান্ত অপেক্ষা করে। একটু পরেই ডাক পড়ে।
রতিকান্ত ঘরে ঢুকেই একটা লম্বা স্যালুট দেয়। বড় সাহেবের চোখ একটা ফাইলে নিবদ্ধ, মুখ তুলে ইশারায় রতিকান্তকে বসতে বলে। রতিকান্ত বসে অপেক্ষা করে।
একটু পরে বড় সাহেব ফাইলটা সরিয়ে রেখে রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রতিকান্ত, কেসের কি খবর?’
‘স্যার, তদন্ত চলছে।’
‘আজীবন চলবে নাকি। অ্যা।’
‘না, স্যার চেষ্টা তো করছি।’
‘দেখ রতিকান্ত, মন্ত্রী সাহেব প্রতিদিন ফোন করে কেসের খবর নিচ্ছেন। আমি কোন উত্তর দিতে পারছি না। তোমার জন্য আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।’
রতিকান্ত গুম মেরে চুপ করে থাকে। সেটা বোধহয় বড় সাহেবের খেয়াল হয়, তাই মোলায়েম সুরে বলেন, ‘রতিকান্ত, তুমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ব্রাইট
অফিসার। তুমি তো জান মন্ত্রী সাহেবের সাথে বিনোদিনী দেবির একটু দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। বুঝতেই পারছ, মন্ত্রী সাহেবের কতটা ব্যথা আছে এই কেসটার জন্য।’
এই কথাটা বলার সময় বড় সাহেবের চোখেমুখে একটা দুষ্টুমির ভাব রতিকান্ত নজর এড়ায় না। রতিকান্ত চুপ করে থাকে। বড় সাহেব বলেন, ‘রতিকান্ত, কেসটার
আগা গোঁড়া সব আমাকে বল।’
রতিকান্ত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবিস্তারে আবার বলে। খুব মন দিয়ে বড় সাহেব রতিকান্তের কথা শুনে যায়। রতিকান্তের কথা শেষ হলে বড় সাহেব বলে,
‘রতিকান্ত তুমি ভুতে বিশ্বাস কর।’
বড় সাহেবের কথা শুনে রতিকান্ত অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘না, স্যার।’
বড় সাহেব একটু গুম মেরে থাকে, তারপরে চোখ দুটো কুঁচকে বলে, ‘রতিকান্ত, তুমি যা বললে তার মোদ্দা কথা, ঘরের দরজা ভেঙ্গে বিনোদিনীকে রক্তাক্ত অবস্থায়
পাওয়া যায়। তোমার কথা অনুযায়ী ঘরে ঢোকা বেরোনোর ওই একটিই পথ। আবার বিনোদিনীর শরীরে পুরুষের বীর্য পাওয়া গেছে, তারমানে রাতে ভালই মস্তি
লুটেছেন। দু মাস ধরে তদন্ত করে রতিকান্ত তুমি যা আমাকে বললে তাতে তো আমার তিনটি উপায় ছাড়া আমার মাথায় কিছুই আসছে না। এক নম্বর, খুনির অদৃশ্য
হবার ক্ষমতা আছে। দরজা ভেঙ্গে যখন ঢোকা হয় তখন খুনি অদৃশ্য হয়ে যায়। তাই তোমার কেউ তাকে দেখতে পাও নি। দুই নম্বর, খুনির বাতাসে মিলিয়ে যাবার
ক্ষমতা আছে। খুন করে বাতাসের সাথে মিশে দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিন নম্বর, খুনি আর কেউ নয় একটি ভুত। ভুতকে ধরা বাপেরও অসাধ্যি। ভুত বাবাজি
সারারাত মস্তি লুটে তারপরে খুন করে চলে যায়।’
বড় সাহেবের কথা শুনে রতিকান্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এটুকু বুঝতে পারে বড় সাহেব তাকে বিদ্রুপ করছে। তবুও মরিয়া হয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার,
আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’
‘মজা! রতিকান্ত, আমি মজা করছি না, তুমি মজা করছ আমার সাথে।’
‘মানে!’
‘রতিকান্ত, বন্ধ ঘরের মধ্যে খুন করা যেতে পারে কিন্ত পালানর জন্য তো একটা রাস্তা দরকার। সেটা কোথায়, তুমি আমাকে বোঝাও। তাহলে খুনি কিভাবে পালাল?’
‘স্যার, সেটাই তো বড় প্রশ্ন।’
‘বড় প্রশ্ন! রতিকান্ত, তুমি সামান্য ব্যাপারটাকে জটিল করে তুলছ।’
‘বুঝলাম না, স্যার।’
‘আমার কাছে ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার। রতিকান্ত, তুমি এতদিন পুলিশে কাজ করছ আর ব্যাপারটা ধরতে পারছ না।’
বড় সাহেবের কথার মাথামুণ্ডু রতিকান্ত কিছুই ধরতে পারে না। বড় সাহেব সিরিয়াসলি বলছে না ঠাট্টা করছে সেটাও রতিকান্ত বুঝতে পারে না। তাই রতিকান্ত চুপ
করে থাকাই শ্রেয় মনে করে।
বড় সাহেব আবার শুরু করে, ‘রতিকান্ত, কেসটা আমি সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। বিনোদিনী সুচতুর মহিলা ছিলেন। বিনোদিনী তার শ্বশুরকে হাত করে রায়
পরিবারের বেশির ভাগ সম্পত্তি, টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন। কাজেই বিরেন ও তার পরিবারের বিনোদিনীর উপর রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার
মৃন্ময়ীর সাথে তার শাশুড়ির আদায় কাঁচকলায়। মৃন্ময়ী মনে মনে বিনোদিনীকে অসম্ভব ঘৃণা করে। শত্রুর শ্ত্রু বন্ধু, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিনোদিনীর দুই প্রবল শ্ত্রু
বিরেন ও মৃন্ময়ী এক হয়ে গেছে। দুজনে হাত মিলিয়ে নিয়েছে। বিনোদিনীর মৃত্যু হলে দুপক্ষেরই লাভ। মৃন্ময়ীর যেমন বুকের জ্বালা মিটবে তেমনি বিনোদিনীর পরে
সমস্ত সম্পত্তির সেই একমাত্র উত্তরাধিকারী। বিনোদিনীর জন্য যেমন বিরেন অনেক সম্পত্তির থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার বিনোদিনী বিরেন ও তার পরিবারের
বর্তমান ব্যবসাগুলিতে থাবা বসাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। কাজেই বিনোদিনীর মৃত্যু হলে বিরেন ও তার পরিবার যেমন স্বস্তি পাবে তেমনি তাদের মনের
প্রতিশোধটাও নেওয়া হয়ে যাবে। এই খুনের প্ল্যানটা কার্যকরী করার জন্য হয়ত মৃন্ময়ীর সাথে বিরেনের এমন একটা বোঝাপড়া হয়েছে যাতে কিছু সম্পত্তি বিরেন
ফিরে পায়। এটা আমার অনুমান, এরকম বোঝাপড়া নাও হতে পারে। যাইহোক খুনটা মৃন্ময়ী ও বিরেন পুরো ছক কষে করেছে।’
‘কিন্তু স্যার, আমাদের হাবিলদার রামদিনও তো দরজা ভাঙ্গার সময় উপস্থিত ছিল।’
‘হুম, রামদিনের চাকরি আর মাত্র দুবছর আছে। দু বছর পরে রিটায়ার্ড করার পরে রামদিন কত টাকা পাবে সেটা তুমি ভাল করেই জান। টাকার প্রয়োজন সবার
আছে আর বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা সবাই চায়। রামদিনের হাতে বিশাল অঙ্কের টাকা গুঁজে দিয়ে তাকে প্লানে সামিল করাটা খুব সহজ ব্যাপার।’
রামদিনকে অনেকদিন ধরে রতিকান্ত দেখে আসছে। রামদিন খুবই সত প্রকৃতির মানুষ। তাকে এইভাবে ঘুষখোর, অসৎ বলাটা রতিকান্ত মেনে নিতে পারে না, বলে,
‘স্যার, রামদিনের সার্ভিস রিপোর্ট ক্লিন। তাকে সৎ বলে থানার সবাই জানে। এতদিনের চাকরি জীবনে তার কোন গণ্ডগোল পাওয়া যায়নি।’
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বড় সাহেব বলে, ‘আরে দুর দুর, মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই কেউ খুনি, চোর, ডাকাত হয়না। একটা আটান্ন বছরের লোক চুরি করতে গিয়ে
ধরা পড়ল। এখন যেহেতু সে সাতান্ন বছর চুরি করেনি তাই সে চুরি করতে পারে না। এটা কি কোন কথা হল। দেখ রতিকান্ত, মতিভ্রম কার কখন হবে সেটা বলা
যায়না।’
রতিকান্ত এই ছেঁদো যুক্তির কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। তাই চুপ থাকাই মনস্থির করে।
এরপরে বড় সাহেব সিরিয়াস মুখ করে বলে, ‘শোন রতিকান্ত, খুনটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্লান করে করা হয়েছে। এই প্লানে মৃন্ময়ী, বিরেন ও তার পরিবার এবং রামদিন
সবাই জড়িত। এদের মিলি ভগতের কাজ। যথেষ্ট আটঘাট বেঁধে তোমাকে এগোতে হবে। বিরেনের উপরমহলে ভাল কানেকশন আছে তাই প্রথমে মৃন্ময়ী, বিরেন ও
তার পরিবারের কাউকে ছুতে যেওনা। প্রথমে রামদিনকে তোল। আচ্ছা মতন দাওয়াই দাও, দেখবে পেট থেকে সব বেরিয়ে আসবে। এরপরে তোমার মৃন্ময়ী, বিরেনকে
এরেস্ট করতে অসুবিধে হবে না।’
ফ্যালফ্যাল করে রতিকান্ত বড় সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, এই লোকটাই কিছুদিন আগে তাকে অশোকের ক্ষেত্রে এইরকম একটা উদ্ভট বুদ্ধি
দিয়েছিল। তাতে পুলিশকে বেইজ্জতের একশেষ হতে হয়। এরপরে রতিকান্ত মনে মনে বড় সাহেবের উদ্দেশ্যে যেসব শব্দ আওড়ায় সেসব বড় সাহেবের কানে গেলে
পিলে চমকে উঠত। বড় সাহেবের প্রস্তাবটা যে একটুও তার মনপুত হয়নি সেটা রতিকান্তের মুখচোখই বলে দেয়। সেটা বড় সাহেবের নজর এড়ায় না, তাই একটু রুড
হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে রতিকান্ত, তোমাকে আর সাতদিন সময় দিলাম। এই সাতদিনে কিছু করতে না পারলে কেসটা সি.আই. ডি র হাতে চলে যাবে। এখন
আসতে পার।’
রতিকান্ত সাথে সাথে উঠে পড়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে, যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তবে রতিকান্ত মনে মনে ভাবে, লোকটা যতই ভাট বকুক, যুক্তিগুলো খুব একটা
ফেলনা নয়। বিনোদিনীর প্রতি বিরেনবাবু আর মৃন্ময়ীর চোখেমুখে অসম্ভব ঘৃণা সেটার আঁচ রতিকান্ত জেরা করতে গিয়েই পেয়েছে। বড়সাহেবের কথা মত, যদি সত্যি
বিরেনবাবু আর মৃন্ময়ী হাত মিলিয়ে নেয় তবে তাদের কাছে রামদিন ও বৃহন্নলা এই দুজনকে প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে খুনের প্লানে সামিল করিয়ে নেওয়াটা কোন
অসম্ভব ব্যাপার নয়। এতে বিনোদিনী দেবির খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে এই জটটার একটা সহজ উত্তর পাওয়া যায়।
বড় সাহেবের কথা অনুযায়ী রতিকান্ত মনে মনে খুনের প্ল্যানটার একটা কাল্পনিক রুপ দেবার চেষ্টা করে। রতিকান্ত মনে মনে ভেবে নেয়, ভোর ছটায় বৃহন্নলা বিনোদিনী
দেবির ঘরে চা দিয়ে আসে। রামদিনের নাইট ডিউটি ছিল, তাই সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সাতটার সময় বিরেনবাবু, মনোজ ও রামদিন এই তিনজন পুরুষ
বিনোদিনীর উপর চড়াও হয় এবং হাতের শিরা কেটে বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করে ফেলে। এরপরে মৃন্ময়ী বা যে কোন একজন মেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজার
ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। সাজানো নাটকের মত বিরেনবাবু, মনোজ আর রামদিন কাঠের গুড়ি দিয়ে দরজাটা ভেঙ্গে ফেলে। ঘরে ঢুকে রামদিন আলমারি সার্চ করার
একটা নাটক করে। প্লান মাফিক মনোজ এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে আর ডক্টর ঘোষালকে বিরেনবাবু ডেকে নিয়ে আসেন। এই প্ল্যানে খুনি ঘর থেকে বেরোল কিভাবে
এই ধন্দে পুলিশকে খুব সহজে ফেলা যায়।
এই ভাবনার মধ্যে যুক্তি থাকলেও রতিকান্তের কেন জানিনা মনে হয় ব্যাপারটা অতিসরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। আর তাছাড়া রতিকান্তের মনে আরও একটা প্রশ্ন দেখা
দেয়, যদি এইভাবেই খুন করার থাকে তাহলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ক্যামিকালটি ব্যবহার করল কেন? নাকি এটাও পুলিশকে বিভ্রান্ত করার একটা প্রচেষ্টা। রতিকান্তের
সবকিছু গুলিয়ে যায়। মাথা ভনভন করে।
রতিকান্ত থানায় ফিরে আসে। হাতে মাত্র সাতদিন সময়। এই সাতদিনের মধ্যে কিছু করে না দেখাতে পারলে কেসটা সি. আই. ডি র হাতে চলে যাবে।
এই দুমাসে রতিকান্ত কেসটার পেছনে কম পরিশ্রম করেনি। রায় পরিবারের উত্তর মহল ও দক্ষিণ মহল এই দুই বাড়ির উপর নজর রাখার জন্য সর্বক্ষণের জন্য চর ছেড়ে
রেখেছে। এই দুই বাড়িতে কে কখন আসছে, কে কখন বেরচ্ছে সব খবরই রতিকান্ত নিয়মিত পায়। এছাড়াও বিরেনবাবু, মনোজ ও মৃন্ময়ীর পেছনে আলাদা করে
ফেউ লাগিয়ে রেখেছে। কে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে সব খবরই রতিকান্তের কানে পৌঁছে যায়। কিন্তু এই দু মাসে রায় পরিবারের সদশ্যদের মধ্যে বেচাল
কিছু পায় না।
এছাড়াও বিরেনবাবু, মনোজ, সরোজ, লাবণ্য, নুপুর, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ী এদের অতীত সম্পর্কেও রতিকান্ত খোঁজ খবর লাগায়। এদের অতীত সম্পর্কে যেসব তথ্য
পাওয়া যায় সেগুলি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে রতিকান্তের মনে হয় না। তবে কয়েকজনের অতীত বেশ চমকে দেবার মত কিন্তু এই কেসের সাথে সেইসব তথ্যের খুব
একটা লিংক আছে বলে রতিকান্তের মনে হয় না।
রতিকান্ত বড় সাহেবের সাথে দেখা করে আসার পর থেকে গুম মেরে আছে। সেদিন রামদিনকে রতিকান্ত সামান্য কারনে ঝাড় দিয়ে দেয়। বোঝা যায় রতিকান্তের
মেজাজটা খিচড়ে আছে। ভয়ে কেউ রতিকান্তের কাছে ঘেঁষে না। রতিকান্তর সামনে বিনোদিনী দেবির খুনের কেসের ফাইলটা খোলা। সেদিকে তাকিয়ে রতিকান্ত গভীর
চিন্তায় ডুবে যায়। বিনোদিনীর খুনের কেসটা এমন ভাবে জট পাকিয়ে রয়েছে যে রতিকান্ত তদন্তটা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
এইসময় সামনের খোলা ফাইলটায় দেখে রায় পরিবারের সব সদস্যদের অতীত নিয়ে খবর নেওয়া হয়েছে কিন্তু বিনোদিনী দেবির অতীত নিয়ে তো কোন খবর জোগাড়
করা হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা তার নজর এড়িয়ে যাওয়াতে রতিকান্তের নিজের উপরেই রাগ হয়। রতিকান্ত এক মুহূর্ত দেরি না করে থানা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
কিছু সময় পরে রতিকান্ত বিরেন বাবুর অফিসে এসে হাজির হয়। এখানে আসার আগে অবশ্য রতিকান্ত টেলিফোনে বিরেনবাবুর সাথে কথা বলে নিয়েছিল। সোজা
বিরেনবাবুর চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত হয়।
বিরেনবাবু সাদরে আহ্বান করে রতিকান্তকে চেয়ারে বসতে বলেন। রতিকান্ত বসেই সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে, বিরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি
বিনোদিনী দেবির অতীত সম্পর্কে যা জানেন সব বলুন?’
‘রতিকান্তবাবু, মুশকিলে ফেলে দিলেন। বিনোদিনীর অতীত সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। শুনলে আরও অবাক হবেন, বিনোদিনীর বাড়ি কোথায়, তার মা বাবার
কি নাম, তার পরিবারে আর কেউ আছে কিনা এসবের কিছুই জানিনা।’
বিরেনবাবুর কথা শুনে রতিকান্ত ভীষণ অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘কিন্তু বিনোদিনী দেবি তো আপনার ভাইয়ের বৌ ছিলেন, আর যতদূর জানি বিয়েটা এরেঞ্জ ম্যারেজ
ছিল। তাহলে বিনোদিনী সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না, এটা কি করে হয়?’
রতিকান্তের চোখেমুখে অবিশ্বাস ভাব ফুটে ওঠে, সেটা বিরেনবাবুর নজর এড়ায় না, বলে, ‘দেখুন রতিকান্তবাবু, আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন তাহলে
আমার তো কিছু করার নেই। কিন্তু যেটা বলছি সেটাই সত্যি। আমার ভাইয়ের জন্য বিনোদিনীকে পছন্দ করে এনেছিলেন আমার বাবা দেবনারায়ন। বিনোদিনী এক
কাপড়ে আমাদের বাড়িতে আসে। মেয়েদের বাড়ির থেকে যা যা করনীয়, শাড়ির থেকে, গয়নার থেকে সব কিছু বাবা করেছিলেন। শুধু বিনোদিনীর সম্প্রদানটা বাবার
এক বন্ধু করেছিলেন। সেই সময় বিয়ে বাড়িতে এই নিয়ে বেশ গুঞ্জন উঠেছিল। বাবা ছিল ভীষণ মেজাজি মানুষ, তাই বিনোদিনী সম্পর্কে সাহস করে বাবাকে কেউ
কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। তাও বাবার কানে বোধহয় গুঞ্জনটা গিয়েছিল, তাই বাবা একদিন বাড়ির সবাইকে ডেকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বিনোদিনী
তার ছোটছেলের বৌ, এটাই তার পরিচয়। এর বাইরে বিনোদিনীর আজ থেকে অন্য কোন পরিচয় নেই। এই বিষয়ে আর কারও কিছু জানার দরকার নেই। বাবার এই
এক হুঁশিয়ারিতে সব ঠাণ্ডা মেরে যায়। আমিও আর এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পরে বুঝতে পেরেছি এটা আমি ভুল করেছি।’
এই বলে বিরেনবাবু চুপ করে যায়। কিন্তু রতিকান্ত কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না, বলে, ‘ভুল করেছেন কেন?’
‘বাবার মৃত্যুর পরে বুঝতে পারি, এক মায়াবি নাগিন আমাদের পরিবারে ঢুকে গেছে। ওই নচ্ছার মহিলা আমাদের পরিবারটাকে যেভাবে শেষ করে দিয়ে গেছে তাতে
বুঝতে পারি এই মহিলা আর যাই হোক কোন ভদ্র পরিবার থেকে আসেনি। সেই সময় বিনোদিনীর বাপ মায়ের হদিশ পাবার জন্য আমি অনেক চেষ্টা চরিত্র করি কিন্তু
কিছুই জানতে পারিনা। কি বলব রতিকান্তবাবু, এমনকি আমি বেশ্যা পল্লীতেও পাতা লাগাই যদি কিছু খবর পাওয়া যায়। যাইহোক বাবাই একমাত্র জানত
বিনোদিনীর অতীতটা। বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে বিনোদিনীর অতীতটাও মুছে গেছে।’
এইসব কথা বলার সময় বিরেনবাবুর চোখেমুখে অসম্ভব ঘৃণা লক্ষ্য করা যায়। শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য বিরেনবাবুর নিজের ভাইয়ের বৌয়ের প্রতি এত বিদ্বেষ নাকি
আরও অন্য কোন কারন আছে সেটা ঠিক রতিকান্তের বোধগম্য হয় না। এরপরে রতিকান্ত আর দাড়ায় না, চলে আসে।
বহু চেষ্টা করেও বিনোদিনী দেবির অতীত সম্পর্কে জানার কোন সুত্রই রতিকান্ত পায় না।
************************************************