15-06-2019, 05:38 PM
খুন ও খুনের তদন্ত
বৃহন্নলার জেরার শেষে রতিকান্ত একবার ঘরে উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। রায় পরিবারের সবার মুখে চোখে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব। বিশেষ করে বিরেনবাবুকে অসম্ভব রকম বিচিলিত দেখায়। রতিকান্ত ইশারায় বৃহন্নলাকে তার সামনে একটা চেয়ার দিতে বলে। এরপরে রতিকান্ত মৃন্ময়ীকে ডেকে তার সামনের চেয়ারে বসতে বলে। রতিকান্ত তীক্ষ্ণচোখে মৃন্ময়ীকে আপাদমস্তক মেপে নেয়। মৃন্ময়ীর চোখে মুখে কোন শোকের ছায়া দেখতে না পেয়ে রতিকান্ত একটু অবাক হয়ে যায়। বরঞ্চ একটা নির্বিকার ভাব লক্ষ্য করে।
রতিকান্ত মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এবারে আপনি বলুন।’
মৃন্ময়ী খুব ধির স্থির গলায় বলে, ‘ইন্সপেক্টর সাহেব, আমি গতকাল এখানে ছিলাম না। আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছি।’
রতিকান্তের ছোট প্রশ্ন, ‘কোথায় ছিলেন?’
‘আমি ফিরজাবাদে আমার এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিলাম।’
‘হুম, তা বৃহন্নলা বলছিল আপনার সাড়ে সাতটায় ফেরার কথা ছিল, সেখানে আড়াই ঘণ্টা আগে এসে গেলেন, কি করে?’
‘আমার যে ট্রেনটায় ফেরার কথা ছিল লাকিলি তার আগের ট্রেনটা আমি পেয়ে যাই। আর আমার বান্ধবির বাবা ফিরজাবাদ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। উনিই সব ব্যবস্থা করে দেন। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি।’
‘হুম, বুঝলাম। তা বান্ধবির কি নাম? ফিরজাবাদে কোথায় বিয়ে হয়েছে?’
রতিকান্তের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মৃন্ময়ী উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। একটু পরেই মৃন্ময়ী এসে বিয়ের একটা কার্ড রতিকান্তের হাতে দিয়ে বলে, ‘গত সোমবার বিয়ে এটেণ্ড করার জন্য আমি মায়ের অনুমতি নিয়ে ফিরজাবাদ রওয়ানা দিই। বান্ধবির বাড়িতেই ছিলাম। বান্ধবির ঠিকানাটা বিয়ের কার্ডে পেয়ে যাবেন।’
মৃন্ময়ী যে বেশ শক্ত ধাচের মহিলা সেটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না।
আচমকা রতিকান্ত প্রশ্ন করেন, ‘আপনার সাথে আপনার শাশুড়ির কেমন সম্পর্ক ছিল?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ী একটু চমকে ওঠে কিন্তু ক্ষনিকের জন্য। সামলে নিয়ে সরাসরি রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে নিঃস্পৃহ গলায় বলে, ‘যেমন আর পাঁচটা শাশুড়ি বৌয়ের সম্পর্ক হয় আমার সাথেও সেইরকমছিল।’
‘মানে?’
‘না ভাল, না খারাপ, যতটুকু না রাখলে নয় ঠিক ততটুকুই ছিল।’
মৃন্ময়ীর কাট কাট জবাবে রতিকান্ত বেশ অবাক হয়। রতিকান্ত মৃন্ময়ীকে আপাদমস্তক ভাল করে মেপে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ফিরজাবাদ থেকে কখন রওয়ানা হয়েছিলেন?’
‘বৃহস্পতিবার রাত আটটায় ফিরজাবাদ ট্রেনে চাপি আর এখানে ভোর সোয়া চারটে নাগাদ নামি। তারপরে স্টেশন থেকে রিক্সা ধরে বাড়ি আসতে আসতে পাঁচটা বেজে যায়। বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পরে বৃহন্নলা দরজা খুলে দেয়। ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি তাই নিজের ঘরে গিয়েএকটু শুয়ে পড়ি। এরপরে ছটা নাগাদ বৃহন্নলার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এরপরের ঘটনা তো আপনি জানেন।’
রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাদের বিয়েটা কি লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ?’
মৃন্ময়ীর সংযত জবাব, ‘লাভ ম্যারেজ।’
‘আপনাদের বিয়েটা কি বিনোদিনী দেবি মেনে নিয়েছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ী সরাসরি রতিকান্তের চোখের দিকে তাকায়। তারপরে একটাই শব্দ উচ্চারন করেন, ‘না।’
উত্তর শুনে আর চোখ দেখে রতিকান্ত বুঝতে পারে এই মেয়ে একবারে ছাই চাপা আগুন। এটাও লক্ষ্য করে মৃন্ময়ীর কথা বলার ধরনে কোথাও যেন একটা ঘৃণার আভাষ আছে।
রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘আপনার সাথে আপনার স্বামির কিভাবে আলাপ হয়?’
মৃন্ময়ীর মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে, বলে, ‘এই তদন্তের জন্য এটা কি খুব দরকারি প্রশ্ন?’
মৃন্ময়ীর তাচ্ছিল্যের ভাব দেখে রতিকান্ত মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গলা চড়িয়ে বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, কোন প্রশ্নটা দরকারি আর কোনটা দরকারি নয়, সেটা নিশ্চয় আপনার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে না। যা প্রশ্ন করছি সেটার ঠিকঠাক জবাব দিন। এতে আপনার মঙ্গল।’
মৃন্ময়ী এই প্রথম একটু হকচকিয়ে যায়। তারপরে বলে, ‘আমার খুব ছোটবেলায় বাবা মা দুজনেই একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। মামাদের আশ্রয়ে আমি মানুষ হই। আমার মামার বাড়ি ফিরজাবাদ। সেখানেই একটা কোম্পানিতে দেবেন্দ্র চাকরি করত। আমার এক বান্ধবির বর দেবেন্দ্রর বন্ধু ছিল। সেইসুত্রেই আমার সাথে আলাপ। তারপরে প্রেম, তারপরে বিয়ে। আমাদের বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয়।’
‘আপনাদের বিয়েটা বিনোদিনী দেবি কেন মেনে নিতে পারেননি?’
মৃন্ময়ীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে, সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। ব্যাপারটা রতিকান্তের চোখ এড়ায় না। মৃন্ময়ী শান্ত গলায় জবাব দেয়, ‘এক তো আমি অনাথ তার উপর আমার মামারাও গরিব। সেই কারনে ওনার অমত ছিল। তার উপর আমার বংশ পরিচয় কিছু বলার মত নয়।’
একটু চুপ করে যায় মৃন্ময়ী, চোখ দুটো ছলছল করে, কান্না ভেজা গলায় বলে, ‘দেবেন্দ্র আমাকে খুব ভালবাসত। এতটাই যে মায়ের অমতে আমাকে বিয়ে করে। ফিরজাবাদই দেবেন্দ্র একটা বাড়ি ভাড়া করে আর সেখানেই আমরা সংসার পাতি। কিন্তু... কিন্তু আমার পোড়া কপাল... এই সুখ আমার কপালে টেকে না। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় দেবেন্দ্রের মৃত্যু হয়। তখন... তখন আমি দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’
এইটুকু বলেই মৃন্ময়ী আর নিজেকে সামলাতে পারে না, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হু হু করে কেদে ফেলে। এই অবস্থায় সবাই নির্বাক হয়ে যায়। পুলিশদের সেন্টিমেন্ট থাকলে চলে না। রতিকান্ত তাই মৃন্ময়ীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য অপেক্ষা করে।
একটু পরে মৃন্ময়ীর কান্না থামলে রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘তারপর?’
‘তারপর!’ বলে মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে চোখ পড়তে রতিকান্ত চমকে ওঠে। একটু আগে মৃন্ময়ীর চোখে যে ছাইচাপা আগুন দেখেছিল সেটা পুরোপুরি অন্তর্হিত। সেখানে এখন শূন্যতা বিরাজ করছে। তেজি ভাব চলে গিয়ে মৃন্ময়ী ভীষণ রকম মিইয়ে গেছে। তবুও রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘আপনি দু মাসের অন্তসত্বা, তারপরে কি হল?’
‘তারপর, তারপর সব শেষ।’
সেন্টিমেন্ট, হেয়ালি দুটোই রতিকান্তের অপছন্দ। অস্বাভাবিক রকম গলা চড়িয়ে রতিকান্ত বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, পুলিশ আপনাকে আপনার শাশুড়ির খুনের তদন্তের জন্য জেরা করছে। আপনি হেয়ালি না করে ঠিক করে জবাব দিন।’
রতিকান্তের ধমকে মৃন্ময়ী চমকে ওঠে। আনমনা ভাবটা চলে যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। একটু সময় চুপ থেকে বলে,‘পেটের সন্তানকে নিয়ে কি করব, কোথায় যাব কিছুই ঠাহর করতে পারি না। পেটে সন্তান না থাকলে হয়ত আমি এখানে আসতাম না। যাহোক করে নিজেরটা চালিয়ে নিতাম। সন্তানের ভবিষ্যতের কথাভেবে আমি একপ্রকার বাধ্য হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিই।’
এটুকু বলে মৃন্ময়ী চুপ মেরে যায়, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। রতিকান্ত একদৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন প্রশ্ন করে না। কিন্তু মৃন্ময়ী রতিকান্তের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে রতিকান্ত কি জানতে চায়। এই প্রসঙ্গটা আসলেই মৃন্ময়ীর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। এতদিন প্রসঙ্গটাকে মৃন্ময়ী এড়িয়ে যেত, আজ সে এড়িয়ে যাবে না ঠিক করে।
মৃন্ময়ীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমার মিসক্যারেজ হয়।’
‘কি করে?’
‘সিঁড়ির থেকে আমি পড়ে যাই।’
মৃন্ময়ীর সংক্ষিপ্ত ও রুক্ষ জবাবে রতিকান্ত মনে মনে চমকালেও মুখে প্রকাশ করে না। মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘সিঁড়ির থেকে কিভাবে পড়ে গেলেন?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে, বেশ রুক্ষ স্বরে বলে, ‘আমাকে দোতলার সিঁড়ির থেকে কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা আমি প্রমান করতে পারব না তাই বলে কি লাভ। আর তাছাড়া শাশুড়ির মৃত্যুর পরে এই প্রসঙ্গটার আর কোন দাম নেই।’
মৃন্ময়ীর উত্তর শুনে রতিকান্ত কেন ঘরের সবাই চমকে ওঠে। মৃন্ময়ী কার দিকে ইঙ্গিত করছে সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। লোকে সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসে তাই রতিকান্ত প্রশ্ন জারি রাখে, ‘আপনার পেটের সন্তান সে তো এই বংশের বাতি ছিল। তাহলে কেন আপনাকে শাশুড়ি ঠেলে ফেলে দিতে যাবে?’
একদম সরাসরি রতিকান্ত বিনোদিনীর নামটা নিয়ে আসায় সকলেই চমকে ওঠে। মৃন্ময়ী রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পুলিশ তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে কিনা, তাই সজাগ হয়ে বলে, ‘কিন্তু অফিসার আমি তো কারো নাম করিনি।’
‘না, আপনি কারো নাম নেননি তবে ইঙ্গিতটা আপনার শাশুড়ির দিকেই যাচ্ছে। আমি শুধু জানতে চাইছি আপনার মনে এরকম ধারনাটা হল কেন?’
এতদিন মৃন্ময়ীর বুকের মধ্যে কথাগুলো চেপে ছিল, আজ আর সে মনের কথা চেপে রাখতে পারে না, বলে ফেলে, ‘স্বামির মৃত্যুর পর আমার এখানে আসাটা শাশুড়ি একদম মেনে নিতে পারেননি। প্রতিপদে আমাকে অপদস্থ করতেন, অপমান করতেন। বাড়ির থেকে চলে যেতে বলতেন। পেটের সন্তানের কথা ভেবে সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে যেতাম। আমার পেটের সন্তানটা যে আমার স্বামির এটা উনি বিশ্বাস করতেন না। এই নিয়ে প্রায়শই আমাকে খোঁটা দিতেন। সময় সব ঠিক করে দেবে আই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই সময়ই আমার বুক থেকে আশাটাই কেড়ে নিল।’
বলেই মৃন্ময়ী আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ঝরঝর করে কেদে ফেলে। মৃন্ময়ীর কথা শুনে সকলের মন ভারাক্রান্ত হয়, কারো মুখে কোন কথা থাকে না। শুধু লাবণ্য আর প্রিয়ন্তি মৃন্ময়ীর পাশে এসে দাড়ায়। একটু পরে মৃন্ময়ী নিজেকে সামলে নেয়।
রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, এত কিছুর পরেও আপনি এখানে থেকে গেলেন কেন?’
এই প্রশ্নে মৃন্ময়ী পুরো জ্বলে ওঠে, আহত বাঘিনীর মত গর্জে ওঠে, ‘কেন, কেন আমি যাব। এটা আমার স্বামির পৈত্রিক ভিটে। এখানে আমার শাশুড়ির যেমন অধিকার আছে আমারও অধিকার আছে।’
মৃন্ময়ী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে রতিকান্ত পরের প্রশ্ন করে, ‘আপনার কি ধারনা, বিনোদিনী দেবিকে কে খুন করতে পারেন?’
‘সেটা আপনারা বার করবেন। আমার কোন ধারনা নেই।’
রতিকান্ত আচমকাই একটা মারাত্মক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘খুনটা আপনিও করতে পারেন?’
ঘরের সকলে রতিকান্তের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মৃন্ময়ীর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। ফিরে আসে তার সেই আগুনে চোখ। এই চোখ যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব খাক করে দেবে। কিন্তু রতিকান্তের মুখে ব্যাঙ্গের হাসি লেগেই থাকে। যা মৃন্ময়ীকে আরও ক্রোধান্বিত করে। মৃন্ময়ী পারলে রতিকান্তকে এখনই ভস্ম করে দেয়।
গর্জে ওঠে মৃন্ময়ী, ‘আমি কেন করতে যাব?’
নিঃস্পৃহ গলায় রতিকান্ত বলে, ‘আপনি আপনার শাশুড়িকে ঘৃণা করতেন, আপনার পেটের সন্তানের মৃত্যুর জন্য আপনি আপনার শাশুড়িকে দায়ি মনে করতেন। আর সবচেয়ে বড় কারন বিনোদিনী দেবির মৃত্যুর পর আপনি তার সব সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবেন। খুন করার জন্য এই কারনগুলি কি যথেষ্ট নয়।’
মৃন্ময়ী কোন উত্তর খুজে পায় না, আগুনে দৃষ্টিতে রতিকান্তের দিকে চেয়ে থাকে। রতিকান্ত মৃন্ময়ীর ক্রোধকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বরঞ্চ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, এই মুহূর্তে আপনাকে আমার আর কোন প্রশ্ন নেই। তবে আপনি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।’
এরপরে রতিকান্ত একে একে বিরেনবাবু ও তার পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিরেন বাবুর কথাতেই বোঝা যায় তার মধ্যেও বিনোদিনী দেবির প্রতি যথেষ্ট ক্ষোভ, ঘৃণা রয়েছে। বিরেনবাবু জানায় তার বাবা দেবনারায়নের মৃত্যুর পর বিনোদিনী দেবির সাথে তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি মৌখিক আলাপটুকুও ছিল না। দেবনারায়নের মৃত্যুর পর থেকে তারা এই বাড়িতে আর পা রাখেনি। কারন বিনোদিনী দেবি তার শ্বশুরকে হাত করে তাদের অনেক সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছেন। বিরেনবাবুর মতে বিনোদিনী দেবি নাকি একটা নচ্ছার মহিলা ছিলেন।
মনোজ ছোটবেলায় কয়েকবার এখানে এসেছে তবে দাদুর মৃত্যুর পর আর আসেনি। লাবণ্য, প্রিয়ন্তি তারা আজ প্রথম এই বাড়িতে পা রাখে।
তবে ছোট নাগপুরের কলিয়ারিতে বিনোদিনী ও বিরেনবাবু দুজনেরই শেয়ার আছে তাই বোর্ড মিটিঙে দুজনের দেখা হত। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যতটুকু কথা ততটুকু কথাই দুজনের মধ্যে হত। মনোজের সাথে বিনোদিনীর ব্যবসায়িক কোন লেনদেন ছিল না তাই দুজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাত বা কথাবার্তা কিছুই ছিল না। লাবণ্য আজকে এই প্রথম বিনোদিনীকে সামনে থেকে দেখল।
জেরা করে আরও জানতে পারা যায় গতকাল বিরেন বাবু সকাল নটায় কাজে বেরিয়ে যান, ফেরেন বিকেল পাঁচটা নাগাদ। এরপরে তিনি সোয়া ছটা নাগাদ বাড়ির থেকে বেরিয়ে লিকার শপে যান সেখান থেকে হুইস্কির বোতল কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপরে আর তিনি বাড়ির থেকে বেরননি।
মনোজ বাবার সাথেই সকাল নটা নাগাদ বাড়ির থেকে বেরয়, ফেরে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। এরপরে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ ক্লাবে যান। রাত এগারোটা নাগাদ ক্লাব থেকে বাড়ি ফেরেন।
লাবন্য ও প্রিয়ন্তি দুজনেই হাউস ওয়াইফ, সারাদিন বাড়িতেই ছিল। লাবণ্য শুধু একবার বাড়ির থেকে বেরিয়েছিল, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ টেলারিং শপে ব্লাউজ আনতে গিয়েছিল। প্রিয়ন্তি দুবার বাড়ির থেকে বেরিয়েছিল। সকাল দশটা নাগাদ মুদির দোকানে গিয়েছিল কিছু মশলাপাতি আনতে আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ওষুধের দোকানে গিয়েছিল কিছু ওষুধ আনতে। এরপরে প্রিয়ন্ত যেটা বলে সেটা শুনে বিরনবাবু, মনোজ ও লাবণ্য তিনজনেই চমকে ওঠে। সেটা রতিকান্তের চোখ এড়ায় না।
সকাল দশটা নাগাদ প্রিয়ন্তি যখন মার্কেটে যাচ্ছিল সেই সময় বিনোদিনী দেবি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়ন্তিকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসেন। প্রিয়ন্তির কাছে এসে বলেন, ‘আমি বিনোদিনী, তোমাদের পাশেই থাকি। তুমি ধিরজের বৌ?’
বিনোদিনী দেবির নামটাই শুধু প্রিয়ন্তি শুনেছিল, কিন্তু কোনদিন দেখা সাক্ষাত হয়নি। প্রিয়ন্তি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল বিনোদিনী দেবি তার সাথে যেচে আলাপ করতে আসায়। প্রিয়ন্তি মুখে শুধু ‘হু’ বলে মাথা নাড়ায়। এরপরে বিনিদিনি দেবি নাম জানতে চাইলে প্রিয়ন্তি বলে।
এরপরে বিনোদিনী দেবি অদ্ভুত একটা কথা বলেন, ‘আমার ছেলে দেবেন্দ্র আর তোমার স্বামি ধিরজ মাত্র এক মাসের ছোট বড় ছিল। আজ দুজনেই এই পৃথিবীতে নেই। তোমার আর মৃন্ময়ীর জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। যাইহোক ভাল থেকে।’
এই বলে বিনোদিনী দেবি কোনদিকে না চেয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান।
প্রিয়ন্তির কথা শেষ হতে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘গাড়িতে সেই সময় আর কেউ ছিল?’
প্রিয়ন্তি বলে, ‘হ্যা, একটা লোক বসেছিল তবে চিনিনা তাকে।’
এরপরে রতিকান্ত জেরা পর্ব শেষ করে উঠে পড়ে। ইতিমধ্যে ফটোগ্রাফার, ফরেন্সিক আর ফিঙ্গার প্রিন্টের লোকেদের কাজ শেষ হয়ে যায়। বিনোদিনীর ঘরে যে জলের গ্লাসটা ছিল সেটা আর খালি মদের বোতলটা পরিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। পোস্টমর্টেমের জন্য বডি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। বিনোদিনী দেবির ঘরটা সিল করে দেওয়া হয়।
আসার জন্য রতিকান্ত যখন তোরজোড় শুরু করে সেই সময় বৃহন্নলা ইতস্তত করে একটা কথা বলে, ‘স্যার, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।’
রতিকান্ত বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’
‘স্যার, সন্ধ্যার সময় আমি যখন বাড়ির থেকে বেরচ্ছিলাম সেই সময় দেখা করতে অশোক এসেছিল।’
‘অশোক কে?’
‘স্যার, সেটা জানিনা, শুধু নামটাই জানি। লোকটা মাসে একবার করে আসে। আসলে মেমসাহেব ওকে নিজের ঘরে ডেকে নিতেন। দুজনের কি কথাবার্তা হত সেসব কিছু জানিনা, স্যার।’
‘নামটা জানলে কি করে?’
‘স্যার, মেমসাহেবের মুখ থেকে। মেমসাহেব একবার আমাকে বলেছিল অশোক আসলে ঘরে পাঠিয়ে দিতে।’
‘অশোক কখন আসত?’
‘স্যার, সন্ধ্যার দিক করে।’
মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি দেখেছেন এই অশোককে?’
‘হ্যা, বৃহন্নলা ঠিকই বলেছে। প্রত্যেক মাসে লোকটা একবার করে আসত।’
‘আর কিছু জানেন?’
মৃন্ময়ী একটু চিন্তা করে বলে, ‘না, তেমন কিছু জানিনা। তবে লোকটা দু মিনিটের বেশি থাকত না।’
বৃহন্নলা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘স্যার, স্যার, মনে পড়েছে, লোকটা ভাগলপুর থেকে আসত। একবার লোকটা যখন এসেছিল সেই সময় মেমসাহেবের ঘরে ম্যানেজারবাবু ছিল তাই মেমসাহেব অশোককে নিচে বসতে বলে। দেখি অশোক বারবার হাতঘড়ি দেখছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে অশোক আমাকে মেমসাহেবকে গিয়ে বলতে বলে যে ভাগলপুরের শেষ বাসটা মিস হয়ে গেলে ফিরতে পারবে না। তাই আমার ধরনা অশোক ভাগলপুর থেকে আসত।’
বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রতিকান্ত বলে, ‘অশোক যদি আসে, সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দেবেন। ঠিক আছে।’
রতিকান্তর এরপরে থানার দিকে রওয়ানা দেয়।
বৃহন্নলার জেরার শেষে রতিকান্ত একবার ঘরে উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। রায় পরিবারের সবার মুখে চোখে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব। বিশেষ করে বিরেনবাবুকে অসম্ভব রকম বিচিলিত দেখায়। রতিকান্ত ইশারায় বৃহন্নলাকে তার সামনে একটা চেয়ার দিতে বলে। এরপরে রতিকান্ত মৃন্ময়ীকে ডেকে তার সামনের চেয়ারে বসতে বলে। রতিকান্ত তীক্ষ্ণচোখে মৃন্ময়ীকে আপাদমস্তক মেপে নেয়। মৃন্ময়ীর চোখে মুখে কোন শোকের ছায়া দেখতে না পেয়ে রতিকান্ত একটু অবাক হয়ে যায়। বরঞ্চ একটা নির্বিকার ভাব লক্ষ্য করে।
রতিকান্ত মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এবারে আপনি বলুন।’
মৃন্ময়ী খুব ধির স্থির গলায় বলে, ‘ইন্সপেক্টর সাহেব, আমি গতকাল এখানে ছিলাম না। আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছি।’
রতিকান্তের ছোট প্রশ্ন, ‘কোথায় ছিলেন?’
‘আমি ফিরজাবাদে আমার এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিলাম।’
‘হুম, তা বৃহন্নলা বলছিল আপনার সাড়ে সাতটায় ফেরার কথা ছিল, সেখানে আড়াই ঘণ্টা আগে এসে গেলেন, কি করে?’
‘আমার যে ট্রেনটায় ফেরার কথা ছিল লাকিলি তার আগের ট্রেনটা আমি পেয়ে যাই। আর আমার বান্ধবির বাবা ফিরজাবাদ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। উনিই সব ব্যবস্থা করে দেন। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি।’
‘হুম, বুঝলাম। তা বান্ধবির কি নাম? ফিরজাবাদে কোথায় বিয়ে হয়েছে?’
রতিকান্তের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মৃন্ময়ী উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। একটু পরেই মৃন্ময়ী এসে বিয়ের একটা কার্ড রতিকান্তের হাতে দিয়ে বলে, ‘গত সোমবার বিয়ে এটেণ্ড করার জন্য আমি মায়ের অনুমতি নিয়ে ফিরজাবাদ রওয়ানা দিই। বান্ধবির বাড়িতেই ছিলাম। বান্ধবির ঠিকানাটা বিয়ের কার্ডে পেয়ে যাবেন।’
মৃন্ময়ী যে বেশ শক্ত ধাচের মহিলা সেটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না।
আচমকা রতিকান্ত প্রশ্ন করেন, ‘আপনার সাথে আপনার শাশুড়ির কেমন সম্পর্ক ছিল?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ী একটু চমকে ওঠে কিন্তু ক্ষনিকের জন্য। সামলে নিয়ে সরাসরি রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে নিঃস্পৃহ গলায় বলে, ‘যেমন আর পাঁচটা শাশুড়ি বৌয়ের সম্পর্ক হয় আমার সাথেও সেইরকমছিল।’
‘মানে?’
‘না ভাল, না খারাপ, যতটুকু না রাখলে নয় ঠিক ততটুকুই ছিল।’
মৃন্ময়ীর কাট কাট জবাবে রতিকান্ত বেশ অবাক হয়। রতিকান্ত মৃন্ময়ীকে আপাদমস্তক ভাল করে মেপে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ফিরজাবাদ থেকে কখন রওয়ানা হয়েছিলেন?’
‘বৃহস্পতিবার রাত আটটায় ফিরজাবাদ ট্রেনে চাপি আর এখানে ভোর সোয়া চারটে নাগাদ নামি। তারপরে স্টেশন থেকে রিক্সা ধরে বাড়ি আসতে আসতে পাঁচটা বেজে যায়। বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পরে বৃহন্নলা দরজা খুলে দেয়। ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি তাই নিজের ঘরে গিয়েএকটু শুয়ে পড়ি। এরপরে ছটা নাগাদ বৃহন্নলার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এরপরের ঘটনা তো আপনি জানেন।’
রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাদের বিয়েটা কি লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ?’
মৃন্ময়ীর সংযত জবাব, ‘লাভ ম্যারেজ।’
‘আপনাদের বিয়েটা কি বিনোদিনী দেবি মেনে নিয়েছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ী সরাসরি রতিকান্তের চোখের দিকে তাকায়। তারপরে একটাই শব্দ উচ্চারন করেন, ‘না।’
উত্তর শুনে আর চোখ দেখে রতিকান্ত বুঝতে পারে এই মেয়ে একবারে ছাই চাপা আগুন। এটাও লক্ষ্য করে মৃন্ময়ীর কথা বলার ধরনে কোথাও যেন একটা ঘৃণার আভাষ আছে।
রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘আপনার সাথে আপনার স্বামির কিভাবে আলাপ হয়?’
মৃন্ময়ীর মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে, বলে, ‘এই তদন্তের জন্য এটা কি খুব দরকারি প্রশ্ন?’
মৃন্ময়ীর তাচ্ছিল্যের ভাব দেখে রতিকান্ত মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গলা চড়িয়ে বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, কোন প্রশ্নটা দরকারি আর কোনটা দরকারি নয়, সেটা নিশ্চয় আপনার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে না। যা প্রশ্ন করছি সেটার ঠিকঠাক জবাব দিন। এতে আপনার মঙ্গল।’
মৃন্ময়ী এই প্রথম একটু হকচকিয়ে যায়। তারপরে বলে, ‘আমার খুব ছোটবেলায় বাবা মা দুজনেই একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। মামাদের আশ্রয়ে আমি মানুষ হই। আমার মামার বাড়ি ফিরজাবাদ। সেখানেই একটা কোম্পানিতে দেবেন্দ্র চাকরি করত। আমার এক বান্ধবির বর দেবেন্দ্রর বন্ধু ছিল। সেইসুত্রেই আমার সাথে আলাপ। তারপরে প্রেম, তারপরে বিয়ে। আমাদের বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয়।’
‘আপনাদের বিয়েটা বিনোদিনী দেবি কেন মেনে নিতে পারেননি?’
মৃন্ময়ীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে, সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। ব্যাপারটা রতিকান্তের চোখ এড়ায় না। মৃন্ময়ী শান্ত গলায় জবাব দেয়, ‘এক তো আমি অনাথ তার উপর আমার মামারাও গরিব। সেই কারনে ওনার অমত ছিল। তার উপর আমার বংশ পরিচয় কিছু বলার মত নয়।’
একটু চুপ করে যায় মৃন্ময়ী, চোখ দুটো ছলছল করে, কান্না ভেজা গলায় বলে, ‘দেবেন্দ্র আমাকে খুব ভালবাসত। এতটাই যে মায়ের অমতে আমাকে বিয়ে করে। ফিরজাবাদই দেবেন্দ্র একটা বাড়ি ভাড়া করে আর সেখানেই আমরা সংসার পাতি। কিন্তু... কিন্তু আমার পোড়া কপাল... এই সুখ আমার কপালে টেকে না। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় দেবেন্দ্রের মৃত্যু হয়। তখন... তখন আমি দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’
এইটুকু বলেই মৃন্ময়ী আর নিজেকে সামলাতে পারে না, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হু হু করে কেদে ফেলে। এই অবস্থায় সবাই নির্বাক হয়ে যায়। পুলিশদের সেন্টিমেন্ট থাকলে চলে না। রতিকান্ত তাই মৃন্ময়ীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য অপেক্ষা করে।
একটু পরে মৃন্ময়ীর কান্না থামলে রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘তারপর?’
‘তারপর!’ বলে মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে চোখ পড়তে রতিকান্ত চমকে ওঠে। একটু আগে মৃন্ময়ীর চোখে যে ছাইচাপা আগুন দেখেছিল সেটা পুরোপুরি অন্তর্হিত। সেখানে এখন শূন্যতা বিরাজ করছে। তেজি ভাব চলে গিয়ে মৃন্ময়ী ভীষণ রকম মিইয়ে গেছে। তবুও রতিকান্ত প্রশ্ন করে, ‘আপনি দু মাসের অন্তসত্বা, তারপরে কি হল?’
‘তারপর, তারপর সব শেষ।’
সেন্টিমেন্ট, হেয়ালি দুটোই রতিকান্তের অপছন্দ। অস্বাভাবিক রকম গলা চড়িয়ে রতিকান্ত বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, পুলিশ আপনাকে আপনার শাশুড়ির খুনের তদন্তের জন্য জেরা করছে। আপনি হেয়ালি না করে ঠিক করে জবাব দিন।’
রতিকান্তের ধমকে মৃন্ময়ী চমকে ওঠে। আনমনা ভাবটা চলে যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। একটু সময় চুপ থেকে বলে,‘পেটের সন্তানকে নিয়ে কি করব, কোথায় যাব কিছুই ঠাহর করতে পারি না। পেটে সন্তান না থাকলে হয়ত আমি এখানে আসতাম না। যাহোক করে নিজেরটা চালিয়ে নিতাম। সন্তানের ভবিষ্যতের কথাভেবে আমি একপ্রকার বাধ্য হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিই।’
এটুকু বলে মৃন্ময়ী চুপ মেরে যায়, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। রতিকান্ত একদৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন প্রশ্ন করে না। কিন্তু মৃন্ময়ী রতিকান্তের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে রতিকান্ত কি জানতে চায়। এই প্রসঙ্গটা আসলেই মৃন্ময়ীর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। এতদিন প্রসঙ্গটাকে মৃন্ময়ী এড়িয়ে যেত, আজ সে এড়িয়ে যাবে না ঠিক করে।
মৃন্ময়ীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমার মিসক্যারেজ হয়।’
‘কি করে?’
‘সিঁড়ির থেকে আমি পড়ে যাই।’
মৃন্ময়ীর সংক্ষিপ্ত ও রুক্ষ জবাবে রতিকান্ত মনে মনে চমকালেও মুখে প্রকাশ করে না। মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘সিঁড়ির থেকে কিভাবে পড়ে গেলেন?’
প্রশ্নটা শুনে মৃন্ময়ীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে, বেশ রুক্ষ স্বরে বলে, ‘আমাকে দোতলার সিঁড়ির থেকে কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা আমি প্রমান করতে পারব না তাই বলে কি লাভ। আর তাছাড়া শাশুড়ির মৃত্যুর পরে এই প্রসঙ্গটার আর কোন দাম নেই।’
মৃন্ময়ীর উত্তর শুনে রতিকান্ত কেন ঘরের সবাই চমকে ওঠে। মৃন্ময়ী কার দিকে ইঙ্গিত করছে সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। লোকে সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসে তাই রতিকান্ত প্রশ্ন জারি রাখে, ‘আপনার পেটের সন্তান সে তো এই বংশের বাতি ছিল। তাহলে কেন আপনাকে শাশুড়ি ঠেলে ফেলে দিতে যাবে?’
একদম সরাসরি রতিকান্ত বিনোদিনীর নামটা নিয়ে আসায় সকলেই চমকে ওঠে। মৃন্ময়ী রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পুলিশ তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে কিনা, তাই সজাগ হয়ে বলে, ‘কিন্তু অফিসার আমি তো কারো নাম করিনি।’
‘না, আপনি কারো নাম নেননি তবে ইঙ্গিতটা আপনার শাশুড়ির দিকেই যাচ্ছে। আমি শুধু জানতে চাইছি আপনার মনে এরকম ধারনাটা হল কেন?’
এতদিন মৃন্ময়ীর বুকের মধ্যে কথাগুলো চেপে ছিল, আজ আর সে মনের কথা চেপে রাখতে পারে না, বলে ফেলে, ‘স্বামির মৃত্যুর পর আমার এখানে আসাটা শাশুড়ি একদম মেনে নিতে পারেননি। প্রতিপদে আমাকে অপদস্থ করতেন, অপমান করতেন। বাড়ির থেকে চলে যেতে বলতেন। পেটের সন্তানের কথা ভেবে সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে যেতাম। আমার পেটের সন্তানটা যে আমার স্বামির এটা উনি বিশ্বাস করতেন না। এই নিয়ে প্রায়শই আমাকে খোঁটা দিতেন। সময় সব ঠিক করে দেবে আই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই সময়ই আমার বুক থেকে আশাটাই কেড়ে নিল।’
বলেই মৃন্ময়ী আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ঝরঝর করে কেদে ফেলে। মৃন্ময়ীর কথা শুনে সকলের মন ভারাক্রান্ত হয়, কারো মুখে কোন কথা থাকে না। শুধু লাবণ্য আর প্রিয়ন্তি মৃন্ময়ীর পাশে এসে দাড়ায়। একটু পরে মৃন্ময়ী নিজেকে সামলে নেয়।
রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, এত কিছুর পরেও আপনি এখানে থেকে গেলেন কেন?’
এই প্রশ্নে মৃন্ময়ী পুরো জ্বলে ওঠে, আহত বাঘিনীর মত গর্জে ওঠে, ‘কেন, কেন আমি যাব। এটা আমার স্বামির পৈত্রিক ভিটে। এখানে আমার শাশুড়ির যেমন অধিকার আছে আমারও অধিকার আছে।’
মৃন্ময়ী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে রতিকান্ত পরের প্রশ্ন করে, ‘আপনার কি ধারনা, বিনোদিনী দেবিকে কে খুন করতে পারেন?’
‘সেটা আপনারা বার করবেন। আমার কোন ধারনা নেই।’
রতিকান্ত আচমকাই একটা মারাত্মক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘খুনটা আপনিও করতে পারেন?’
ঘরের সকলে রতিকান্তের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মৃন্ময়ীর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। ফিরে আসে তার সেই আগুনে চোখ। এই চোখ যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব খাক করে দেবে। কিন্তু রতিকান্তের মুখে ব্যাঙ্গের হাসি লেগেই থাকে। যা মৃন্ময়ীকে আরও ক্রোধান্বিত করে। মৃন্ময়ী পারলে রতিকান্তকে এখনই ভস্ম করে দেয়।
গর্জে ওঠে মৃন্ময়ী, ‘আমি কেন করতে যাব?’
নিঃস্পৃহ গলায় রতিকান্ত বলে, ‘আপনি আপনার শাশুড়িকে ঘৃণা করতেন, আপনার পেটের সন্তানের মৃত্যুর জন্য আপনি আপনার শাশুড়িকে দায়ি মনে করতেন। আর সবচেয়ে বড় কারন বিনোদিনী দেবির মৃত্যুর পর আপনি তার সব সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবেন। খুন করার জন্য এই কারনগুলি কি যথেষ্ট নয়।’
মৃন্ময়ী কোন উত্তর খুজে পায় না, আগুনে দৃষ্টিতে রতিকান্তের দিকে চেয়ে থাকে। রতিকান্ত মৃন্ময়ীর ক্রোধকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বরঞ্চ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলে, ‘মৃন্ময়ী দেবি, এই মুহূর্তে আপনাকে আমার আর কোন প্রশ্ন নেই। তবে আপনি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।’
এরপরে রতিকান্ত একে একে বিরেনবাবু ও তার পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিরেন বাবুর কথাতেই বোঝা যায় তার মধ্যেও বিনোদিনী দেবির প্রতি যথেষ্ট ক্ষোভ, ঘৃণা রয়েছে। বিরেনবাবু জানায় তার বাবা দেবনারায়নের মৃত্যুর পর বিনোদিনী দেবির সাথে তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি মৌখিক আলাপটুকুও ছিল না। দেবনারায়নের মৃত্যুর পর থেকে তারা এই বাড়িতে আর পা রাখেনি। কারন বিনোদিনী দেবি তার শ্বশুরকে হাত করে তাদের অনেক সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছেন। বিরেনবাবুর মতে বিনোদিনী দেবি নাকি একটা নচ্ছার মহিলা ছিলেন।
মনোজ ছোটবেলায় কয়েকবার এখানে এসেছে তবে দাদুর মৃত্যুর পর আর আসেনি। লাবণ্য, প্রিয়ন্তি তারা আজ প্রথম এই বাড়িতে পা রাখে।
তবে ছোট নাগপুরের কলিয়ারিতে বিনোদিনী ও বিরেনবাবু দুজনেরই শেয়ার আছে তাই বোর্ড মিটিঙে দুজনের দেখা হত। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যতটুকু কথা ততটুকু কথাই দুজনের মধ্যে হত। মনোজের সাথে বিনোদিনীর ব্যবসায়িক কোন লেনদেন ছিল না তাই দুজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাত বা কথাবার্তা কিছুই ছিল না। লাবণ্য আজকে এই প্রথম বিনোদিনীকে সামনে থেকে দেখল।
জেরা করে আরও জানতে পারা যায় গতকাল বিরেন বাবু সকাল নটায় কাজে বেরিয়ে যান, ফেরেন বিকেল পাঁচটা নাগাদ। এরপরে তিনি সোয়া ছটা নাগাদ বাড়ির থেকে বেরিয়ে লিকার শপে যান সেখান থেকে হুইস্কির বোতল কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপরে আর তিনি বাড়ির থেকে বেরননি।
মনোজ বাবার সাথেই সকাল নটা নাগাদ বাড়ির থেকে বেরয়, ফেরে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। এরপরে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ ক্লাবে যান। রাত এগারোটা নাগাদ ক্লাব থেকে বাড়ি ফেরেন।
লাবন্য ও প্রিয়ন্তি দুজনেই হাউস ওয়াইফ, সারাদিন বাড়িতেই ছিল। লাবণ্য শুধু একবার বাড়ির থেকে বেরিয়েছিল, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ টেলারিং শপে ব্লাউজ আনতে গিয়েছিল। প্রিয়ন্তি দুবার বাড়ির থেকে বেরিয়েছিল। সকাল দশটা নাগাদ মুদির দোকানে গিয়েছিল কিছু মশলাপাতি আনতে আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ওষুধের দোকানে গিয়েছিল কিছু ওষুধ আনতে। এরপরে প্রিয়ন্ত যেটা বলে সেটা শুনে বিরনবাবু, মনোজ ও লাবণ্য তিনজনেই চমকে ওঠে। সেটা রতিকান্তের চোখ এড়ায় না।
সকাল দশটা নাগাদ প্রিয়ন্তি যখন মার্কেটে যাচ্ছিল সেই সময় বিনোদিনী দেবি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়ন্তিকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসেন। প্রিয়ন্তির কাছে এসে বলেন, ‘আমি বিনোদিনী, তোমাদের পাশেই থাকি। তুমি ধিরজের বৌ?’
বিনোদিনী দেবির নামটাই শুধু প্রিয়ন্তি শুনেছিল, কিন্তু কোনদিন দেখা সাক্ষাত হয়নি। প্রিয়ন্তি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল বিনোদিনী দেবি তার সাথে যেচে আলাপ করতে আসায়। প্রিয়ন্তি মুখে শুধু ‘হু’ বলে মাথা নাড়ায়। এরপরে বিনিদিনি দেবি নাম জানতে চাইলে প্রিয়ন্তি বলে।
এরপরে বিনোদিনী দেবি অদ্ভুত একটা কথা বলেন, ‘আমার ছেলে দেবেন্দ্র আর তোমার স্বামি ধিরজ মাত্র এক মাসের ছোট বড় ছিল। আজ দুজনেই এই পৃথিবীতে নেই। তোমার আর মৃন্ময়ীর জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। যাইহোক ভাল থেকে।’
এই বলে বিনোদিনী দেবি কোনদিকে না চেয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান।
প্রিয়ন্তির কথা শেষ হতে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘গাড়িতে সেই সময় আর কেউ ছিল?’
প্রিয়ন্তি বলে, ‘হ্যা, একটা লোক বসেছিল তবে চিনিনা তাকে।’
এরপরে রতিকান্ত জেরা পর্ব শেষ করে উঠে পড়ে। ইতিমধ্যে ফটোগ্রাফার, ফরেন্সিক আর ফিঙ্গার প্রিন্টের লোকেদের কাজ শেষ হয়ে যায়। বিনোদিনীর ঘরে যে জলের গ্লাসটা ছিল সেটা আর খালি মদের বোতলটা পরিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। পোস্টমর্টেমের জন্য বডি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। বিনোদিনী দেবির ঘরটা সিল করে দেওয়া হয়।
আসার জন্য রতিকান্ত যখন তোরজোড় শুরু করে সেই সময় বৃহন্নলা ইতস্তত করে একটা কথা বলে, ‘স্যার, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।’
রতিকান্ত বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’
‘স্যার, সন্ধ্যার সময় আমি যখন বাড়ির থেকে বেরচ্ছিলাম সেই সময় দেখা করতে অশোক এসেছিল।’
‘অশোক কে?’
‘স্যার, সেটা জানিনা, শুধু নামটাই জানি। লোকটা মাসে একবার করে আসে। আসলে মেমসাহেব ওকে নিজের ঘরে ডেকে নিতেন। দুজনের কি কথাবার্তা হত সেসব কিছু জানিনা, স্যার।’
‘নামটা জানলে কি করে?’
‘স্যার, মেমসাহেবের মুখ থেকে। মেমসাহেব একবার আমাকে বলেছিল অশোক আসলে ঘরে পাঠিয়ে দিতে।’
‘অশোক কখন আসত?’
‘স্যার, সন্ধ্যার দিক করে।’
মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রতিকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি দেখেছেন এই অশোককে?’
‘হ্যা, বৃহন্নলা ঠিকই বলেছে। প্রত্যেক মাসে লোকটা একবার করে আসত।’
‘আর কিছু জানেন?’
মৃন্ময়ী একটু চিন্তা করে বলে, ‘না, তেমন কিছু জানিনা। তবে লোকটা দু মিনিটের বেশি থাকত না।’
বৃহন্নলা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘স্যার, স্যার, মনে পড়েছে, লোকটা ভাগলপুর থেকে আসত। একবার লোকটা যখন এসেছিল সেই সময় মেমসাহেবের ঘরে ম্যানেজারবাবু ছিল তাই মেমসাহেব অশোককে নিচে বসতে বলে। দেখি অশোক বারবার হাতঘড়ি দেখছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে অশোক আমাকে মেমসাহেবকে গিয়ে বলতে বলে যে ভাগলপুরের শেষ বাসটা মিস হয়ে গেলে ফিরতে পারবে না। তাই আমার ধরনা অশোক ভাগলপুর থেকে আসত।’
বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রতিকান্ত বলে, ‘অশোক যদি আসে, সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দেবেন। ঠিক আছে।’
রতিকান্তর এরপরে থানার দিকে রওয়ানা দেয়।