15-06-2019, 05:37 PM
(পরবর্তী জবানবন্দি নুপুরের)
রহস্য
শুক্রুবার, ভোর ছটা। বাড়ির কাজের মেয়ে বৃহন্নলা প্লেটে চায়ের কাপ নিয়ে দোতলায় মালকিনের ঘরের দরজায় নক করে, ‘মেমসাব,চা।’
একটু সময় অপেক্ষা করে আবার দরজায় নক করে বলে, ‘মেমসাব, চা এনেছি, দরজা খুলুন।’ কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
কিছুক্ষন অপেক্ষার পরে বেশ জোরেই বলে, ‘মেমসাব, মেমসাব, চা। দরজা খুলুন।’
এরপরে বেশ কয়েকবার নক করার পরেও বিনোদিনী দেবি দরজা খোলেন না। ভয় পেয়ে বৃহন্নলা জোরে জোরে দরজায় ঘা দিতে থাকে আর চেচাতে থাকে, ‘মেমসাব, দরজা খুলুন। মেমসাব, দরজা খুলুন।’
বৃহন্নলার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বিনোদিনী দেবির একমাত্র সন্তানের বিধবা পত্নী মৃন্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মৃন্ময়ীর ঘর বাড়ির একতলায়। মৃন্ময়ী সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে শাশুড়ির ঘরের সামনে বৃহন্নলাকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘কি রে বৃহন্নলা কি হয়েছে?’
‘দেখুন না বৌদি, কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্চি। কিন্তু মেমসাব দরজা খুলছেন না।’
‘মা বোধহয় ঘুমোচ্ছেন ....’
‘কিন্তু বৌদি, মেমসাহেব তো ভোর ছটার সময় উঠে পড়েন।’
‘হয়ত অনেক রাত করে ঘুমিয়েছেন। ঠিক আছে, বৃহন্নলা তুই আর একবার ডাক।’
‘মেমসাহেব, মেমসাহেব, চা এনেছি। দরজা খুলুন।’
কিন্তু ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। এত ডাকাডাকিতেও শাশুড়ির কোন উত্তর না আসায় মৃন্ময়ী একটু চিন্তায় পড়ে যায়। মৃন্ময়ী এবারে দরজার কড়াটা জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে চেচায়, ‘মা, মা, দরজা খুলুন। মা, মা।’
মৃন্ময়ী একটু অপেক্ষা করে এবারে বেশ জোরেই চেচিয়ে ওঠে, ‘মা, মা, কি হল আপনার? দরজা খুলছেন না কেন?’
কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া যায় না। মৃন্ময়ী এবারে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। দরজায় কান পাতে, ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়ে আরও ভয় পেয়ে যায় মৃন্ময়ী।
‘মা, কি হয়েছে আপনার? দরজা খুলুন।’
ঘন ঘন দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বৃহন্নলাও চেচাতে থাকে, ‘মেমসাব, মেমসাব দরজা খুলুন।’
কিন্তু দরজা খোলার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ী দুজনেই এবারে বেশ ভয় পেয়ে যায়। মৃন্ময়ী ভীত স্বরে বলে, ‘মনে হচ্ছে মা খুব অসুস্থ বা মায়ের কিছু একটা হয়েছে। হয়ত মা দরজা খোলার অবস্থায় নেই। দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে।’
‘কিন্তু বৌদি, আমরা দুজনে কি এত মজবুত দরজা ভাংতে পারব?’
‘না, তুই এখানে দাড়া। আমি পাশের বাড়ির থেকে জ্যাঠামশাইদের ডেকে আনছি।’
‘কিন্তু বৌদি, তার আগে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি যদি.....’
‘না, তাতে দেরি হয়ে যাবে।’ এই বলে মৃন্ময়ী আর দাড়ায় না। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে।
আগেই বলেছি, দেব নারায়ন রায় দুই ছেলের জন্য একই ডিজাইনের দুটো বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়ি দুটোর অবস্থান দু দিকে, একটা উত্তর অপরটির দক্ষিণ দিক। তাই দুটো বাড়ির আলাদা আলাদা নাম রেখেছিলেন, একটা উত্তর মহল, অপরটির দক্ষিন মহল। উত্তর মহলটি বড় ছেলে বিরেনের ভাগে পড়ে আর দক্ষিণ মহলটি ছোট ছেলে সুরেনের।
এই দক্ষিণ মহলে মুল দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রথমেই পড়ে বিশাল ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। এই ড্রইং রুমটি বাড়ির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। ড্রয়িং রুমটির বাঁ পাশে শুরুতে এটাচ বাথরুম সহ একটা বড় বেডরুম, এর ঠিক পাশেই একটা কমন বাথরুম। তার পাশে রান্নাঘর। আর এর পাশেই একদম শেষে একটা ছোট রুম। এটিতে বৃহন্নলা থাকে। ড্রয়িং রুমটির একদম শেষদিকে একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। ড্রয়িং রুমটির ঠিক ডান পাশে এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম। এই বেডরুম দুটির একটিতে মৃন্ময়ী থাকে, অপরটি গেস্ট রুম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা লম্বা প্যেসেজ দোতলার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চলে গেছে। প্যাসেজটির বাম পাশে এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম আবার ডান পাশেও একি রকম এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম।
পরবর্তীকালে বিনোদিনী দেবি ওই ডান পাশের দুটো রুমকে ভেঙ্গে নিজের জন্য একটা বিশাল সাইজের বেডরুম ও বেশ বড়সড় সাইজের এটাচ বাথরুম বানিয়ে নেন। বিনোদিনী দেবি দোতলায় একাই থাকতেন। দোতলার বাকি দুটো রুম খালি থাকত।
বিনোদিনী দেবি বাড়িতে আর কোন কাজের লোক রাখেননি। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজ বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ীকে করতে হত।
যাইহোক মৃন্ময়ী খুব দ্রুত বিরেন রায়ের বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে ঘন ঘন কলিং বেল বাজাতে থাকে। বিরক্তির সাথে বিরেন রায় নিজে দরজা খুলে খেকিয়ে উঠতে যাবেন কিন্তু মৃন্ময়ীকে এবং তার অবস্থা দেখে হকচকিয়ে যান।
‘কি হয়েছে মৃন্ময়ী? তুমি এত সকালে?’
‘জ্যাঠামশাই, মায়ের কিছু একটা হয়েছে, দরজা খুলছেন না, ভেতর থেকে শুধু গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। আপনারা একটু আসুন।’
ঘন ঘন কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ইতিমধ্যে বিরেন বাবুর পিছু পিছু তার বড় ছেলে মনোজ, বড় বৌমা লাবণ্য ও ছোট বৌমা প্রিয়ন্তি এসে হাজির হয়। মৃন্ময়ীর কথা শুনে সবাই দ্রুত পায়ে বিনোদিনী দেবির বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। গেটের বাইরে এখানকার থানার হাবিলদার রামদিনকে সাইকেলে চেপে যেতে বিরেন বাবু দেখতে পান। বিরেন বাবু চেচিয়ে রামদিনকে ডাকেন। রামদিন সাইকেল থেকে নেমে গেট খুলে ভেতরে আসে। যেতে যেতে রামদিনকে পুরো ব্যাপারটা মৃন্ময়ী বলে।
একটু পরেই মৃন্ময়ীর সাথে বিনোদিনী দেবির ভাসুর বিরেন ও তার বড় ছেলে মনোজ ও দুই পুত্রবধু লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি এবং এই অঞ্চলের থানার হাবিলদার রামদিন এসে হাজির হয়। সবাই একসাথে হন্তদন্ত হয়ে দোতলায় বিনোদিনী দেবির ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হয়। বিরেনবাবু দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে করতে বলে, ‘বিনোদিনী ..... বিনোদিনী..... কি হয়েছে? দরজা খোল।’
বিরেনবাবুর বড় ছেলে মনোজ জোরে চিৎকার দেয়, ‘কাকি ... কাকি ... দরজা খোল।’
এরপরে লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি দুজনেই ডাক দেয়, কিন্তু ভেতর থেকে কোন উত্তর আসে না, দরজাও খোলে না।
মৃন্ময়ী ভীত স্বরে বলে, ‘জ্যাঠামশাই, দরজায় কান পাতুন মায়ের গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পাবেন। মনে হচ্ছে মা খুব অসুস্থ বা মায়ের কিছু একটা হয়েছে। হয়ত মা দরজা খোলার অবস্থায় নেই।’
মৃন্ময়ীর কথা শুনে বিরেন, মনোজ, লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও রামদিন সবাই একে একে দরজায় কান পাতে এবং প্রত্যেকেই গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পায়।
বিরেনবাবু চিন্তিত স্বরে বলে, ‘মনে হচ্ছে দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে।’
এই শুনে রামদিন নিজের পালয়ানি দেখানোর জন্য সবাইকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের কাঁধ দিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা মারে। এরকম বেশ কয়েকবার ধাক্কা মারে কিন্তু তাতে কাঁধে ব্যথা পাওয়া ছাড়া লাভের লাভ কিছু হয় না।
বিরেন বাবু বাধ্য হয়ে রামদিনকে ক্ষান্ত করে বলেন, ‘রামদিন, এটা আগেকার দিনের সেগুন কাঠের মজবুত দরজা। এভাবে খোলা যাবেনা। আমাদের বাগানে একটা কাঠের গুড়ি আছে, সেটা নিয়ে এসে এই দরজা খুলতে হবে।’
বিরেন বাবু নিজের বড় ছেলেকে ইশারা করতেই মনোজ রামদিনকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের গুড়ি আনতে চলে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই দুজনে ধরাধরি করে কাঠের গুড়িটা নিয়ে এসে হাজির হয়। বিরেন বাবু মেয়েদেরকে একটু সরে যেতে বলে নিজেও হাত লাগায়। গুড়িটার মুখে রামদিন, মাঝে বিরেন বাবু ও শেষে মনোজ থাকে। তিনজনে গুড়িটা চাগিয়ে ধরে সজোরে গিয়ে দরজায় আঘাত করে। বারংবার আঘাত করতে থাকে। দরজার উপরে লাগানো ছিটকিনিটা একটু আলগা হয়। আরও বেশ কয়েকবার আঘাত করার পরে ছিটকিনিটা অনেকটাই আলগা হয়ে আসে। তিনজনে একটু দম নেয়। আবার গুড়িটা চাগিয়ে ধরে সজোরে দরজায় আঘাত করে। দরজার উপরের ছিটকিনিটা ভেঙ্গে গিয়ে ঘরের ভেতরে ছিটকে পরে। দরজাটা দড়াম করে খুলে যেতেই তিনজনে টাল সামলাতে না পেরে ঘরের ভিতরে হুরমুরিয়ে গিয়ে পড়ে। প্রথমে রামদিন তার উপরে বিরেন বাবু আর তার উপরে মনোজ গিয়ে পড়ে। হাত ফস্কে কাঠের গুড়িটা ঘরের ভেতরে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে। রামদিনের পায়ের হাঁটুতে ও হাতের কনুইয়ে সামান্য চোট পায়। কিন্তু তিনজনেই খুব দ্রুত সামলে নিয়ে উঠে দাড়ায়।
ইতিমধ্যে দরজা খুলে যেতেই মেয়েরাও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ঘরের ভেতর ঢুকে আসে। সবার চোখ বিনোদিনী দেবির খাটের দিকে চলে যায়। বীভৎস দৃশ্যটা চোখে পড়তেই সকলে আঁতকে ওঠে। খাটের পাশে চাপ চাপ রক্ত, আর সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে বিনোদিনী দেবি।
সকলে হতবাক হয়ে যায় বিনোদিনী দেবির রক্তাক্ত দেহটা দেখে। বিনোদিনী শুধু একটা নাইটি পরে চিত হয়ে শুয়ে আছেন, দুটো হাত বুকের উপরে জড় করা, ডান হাতটা বাঁ হাতের কব্জিটা চেপে ধরে আছে। নাইটি, বুক, হাত সব রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানি বের হচ্ছে। বিনোদিনী দেবির মুখ চোখ তীব্র যন্ত্রণা, ভয়, বিস্ময়ে একাকার হয়ে আছে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা, সাদা ফেনার মত গ্যাজলা বেরিয়ে রয়েছে। মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। বারংবার কেঁপে উঠছে দেহটা। পা দুটো কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে বর্ণনাতীত যন্ত্রণায়।
এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে সকলেই নির্বাক হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। সকলে সংবিৎ ফিরে পেতে সময় নেয়।
সর্ব প্রথম বৃহন্নলা হাইমাউ করে চেচিয়ে ওঠে, ‘মেমসাব, আপনার এ অবস্থা কি করে হল.... কে করল....’ বলতে বলতে বৃহন্নলা বিনোদিনী দেবির দিকে এগিয়ে যায়।
বাড়ির বাকি মেয়েরা অত রক্ত দেখে এগোতে সাহস পায় না, দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে। এদিকে বিরেন বাবু অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ মানুষ, অবস্থাটা বোধগম্য হতে সময় নেয় না। সকলকে অবাক করে দিয়ে বিরেন বাবু হুড়মুড়িয়ে ঘরের এটাচ বাথরুমটার কাছে চলে যান। বাথরুমের দরজাটা টান মেরে খুলতে যান, কিন্তু ছিটকিনি দেওয়া আছে দেখে তিনি ছিটকিনি খুলে বাথরুমের ভেতরে ঢোকেন। বাথরুমটা ভাল করে নিরীক্ষণ করেন কিন্তু কাউকে দেখতে পান না। বেরিয়ে আসেন বাথরুম থেকে। সকলে উৎকণ্ঠা নিয়ে বিরেন বাবুর দিকে চেয়ে থাকে।
এরপরে বিরেন বাবু যেটা করেন সেটাতে সবাই আরও আশ্চর্য হয়ে যায়। মাটিতে শুয়ে পড়ে বিরেন বাবু খাটের তলাটা ভাল করে নিরীক্ষণ করেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পান না।
এদিকে বৃহন্নলা চেচিয়ে ওঠে, ‘বাবু, এসব পরে করলেও চলবে। সবার আগে ডাক্তার, এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করুন। মেমসাবের ধড়ে এখনো প্রান আছে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে এখনো বাঁচান যাবে।’
বৃহন্নলার কথায় বিরেন বাবুর হুশ ফেরে, মনে মনে একটু লজ্জিত হন, বলেন, ‘মনোজ, তুই এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা কর আর আমি পাশেই ডাক্তার ঘোষাল থাকেন। ওনাকে ডেকে আনছি।’
মনোজ বলে, ‘আমার ঘরে নার্সিং হোম আর এম্বুল্যান্সের ফোন নাম্বার আছে। দুটোতে ফোন করে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
বিরেন বাবু আর মনোজ দুজনেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটে। মৃন্ময়ী ছোটবেলা থেকেই সামান্য কাটা ছেড়া, রক্ত দেখলেই ভয়ে মূর্ছা যায়। বীভৎস রক্তাত অবস্থায় শাশুড়িকে দেখে মৃন্ময়ী নিজেকে আর সামলাতে পারে না, জ্ঞান হারায়। ভাগ্যিস লাবণ্য ধরে না ফেললে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। লাবণ্য আর প্রিয়ন্তি দুজনে ধরাধরি করে মৃন্ময়ীকে দরজায় ঠেস দিয়ে বসায়। লাবণ্য প্রিয়ন্তিকে জল আনতে বলে। প্রিয়ন্তি একপ্রকার দৌড়ে নিচ থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে আসে। জলের ঝাপটা কয়েকবার দিতেই মৃন্ময়ীর জ্ঞান ফিরে আসে।
এদিকে হাবিলদার রামদিন বেকুফের মত ঘরের মধ্যে দাড়িয়ে থাকে। পুলিশে কাজ করলে কি হবে রামদিনও বেশি রক্তারক্তি নিতে পারে না। তাই চুপচাপ ঘরের মাঝে দাড়িয়ে সজাগ দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলায়।
গোঙ্গানির আওয়াজ পেতে সকলে বিনোদিনী দেবির দিকে চোখ ফেরায়।
বৃহন্নলা বলে, ‘মেমসাব, খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি, এখুনি ডাক্তার এসে যাবে। আপনার অবস্থা এরকম কি করে হল.... কে করল?’
বিনোদিনী দেবি ডানহাত দিয়ে বাম হাতের কব্জিটা চেপে ধরে খুব কষ্টের সাথে বাম হাতটা তুলে ধরে। বামহাতের তর্জনীটা সামনের দিকে দেখায়। সেদিকে ছ’ পাল্লার বিশাল কাঠের আলমারিটার দিকে সবার চোখে পড়ে। বিনোদিনী দেবির ইশারাটায় সবাই মনে মনে ধারনা করে, খুনি ওই আলমারির মধ্যে লুকিয়ে আছে।
রামদিনের পুলিশি সত্তা জেগে ওঠে, হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে খুব সন্তর্পণে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েরা ভয়ে আরও সিটিয়ে যায়। রামদিন মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে। ভয়ার্ত চোখে সবাই রামদিনের দিকে চেয়ে থাকে।
ছ’পাল্লার বিশাল কাঠের আলমারিটার সামনে রামদিন হাজির হয়। সন্তর্পণে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আলমারিটার বাম পাশে এসে দাড়ায়, আলমারিতে চাবি ঝুলছে কিন্তু দেওয়া নেই। ডান হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে বাম হাতে পাল্লার হাতল ধরে হ্যাচকা টান মারে। আলমারির বাম পাশের দুটো পাল্লা খুলে আসে। মেয়েদের ভয়ে হাত পা গুটিয়ে আসে। আলমারিতে তিনটে তাক, উপরের তাকে ডাই করা শিতের পোশাক, মাঝের তাকে লেপ, কম্বল। আর নিচের তাকে নানা ধরনের লেডিস জুতো। রামদিন তাও একবার সব কটা তাকে লাঠি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে দেখে নেয়।
পাশের পাল্লাদুটোতেও চাবি ঝুলছে, রামদিন চাবি ঘুরিয়ে দেখে খোলা আছে। এরপরে রামদিন খুব সন্তর্পণে পাশের পাল্লা দুটো খুলে ফেলে। এখানে দুটি তাক। উপরের তাকে সার দিয়ে হ্যাঙ্গারে শাড়ি ঝোলান রয়েছে। নিচের তাকে লন্ড্রির থেকে কেচে আসা শাড়ি থাক দিয়ে রাখা আছে। রামদিন শাড়িগুলো সব একটা একটা করে সরিয়ে লাঠি দিয়ে খুচিয়ে ভাল করে পরিক্ষা করে। নিচের তাকটাও ভাল করে চেক করে নেয়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না।
ডান দিকের পাল্লাদুটোর দিকে সবাই ভয়ে ভয়ে চেয়ে থাকে। সবার মনে মনে ধারনা হয় খুনি এটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। রামদিনও আরও সজাগ হয়ে যায়। এখানেও চাবি ঝুলছে কিন্তু চাবি দেওয়া নেই। লাঠিটা মুঠিতে ভাল করে চেপে ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রামদিন আলমারির শেষ দুটো পাল্লা একটানে খুলে ফেলেই লাঠিটা উচিয়ে ধরে। এখানেও তিনটে তাক, উপরের তাকে মেয়েদের যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রী। মাঝের তাকে লকার, বন্ধ। নিচের তাকে মেয়েদের অন্তর্বাস, ব্লাউজ, ব্রা এইসব। রামদিন উপরের আর নিচের তাক দুটো ভাল করে পরীক্ষা করে নেয়। মাঝের লকারটি টান মেরে দেখে চাবি দেওয়া আছে। কিন্তু লকারের সাথে চাবিটা লাগান নেই।
আলমারির ভেতরে কাউকে পাওয়া না যাওয়ায় সবাই মনে মনে একটু হতাশ হয়। রামদিন সব থেকে বেশি হতাশ হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আশা করেছিল খুনিকে হাতে নাতে ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।
এদিকে নিচ থেকে একটা সোরগোলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। একটু পরেই বিরেন বাবু ডাক্তার ঘোষালকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হয়। পিছু পিছু মনোজও এসে হাজির হয়। মনোজ হাপাতে হাপাতে বলে, ‘এম্বুল্যান্স এখুনি আসছে আর নার্সিং হোমের ইমারজেন্সিতে বলে দিয়েছি।’
ডক্টর ঘোষাল চারিদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ধির পায়ে বিনোদিনী দেবির পাশে গিয়ে দাড়ায়। ডাক্তারের সুবিধের জন্য বৃহন্নলা একটু সরে বসে। ডাক্তার উবু হয়ে বসে প্রথমে বিনোদিনী দেবির নাকের কাছে হাত নিয়ে যায়।
বিনোদিনী দেবির অবস্থা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার ভুরু দুটো কপালের দিকে উঠে গেছে, চোখ দুটো যেন বিস্ফোরিত হয়ে বাইরে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, মুখ হা করে আছে। কিন্তু গোঙ্গানি থেমে গেছে, পা দুটো স্থির হয়ে আছে। আজানা আশঙ্কায় সকলের বুক কেপে ওঠে।
ডাক্তারবাবু ইতিমধ্যে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা করে। উঠে দাঁড়ানোর আগে বিনোদিনী দেবির চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে দেন। বিরেনবাবুর দিকে চেয়ে হতাশ স্বরে ডক্টর ঘোষাল বলেন, ‘সরি, বিরেনবাবু, শি ইজ নো মোর। উনি মারা গেছেন।’
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই বৃহন্নলার বুক চাপড়ানো বিলাপের শব্দ শোনা যায়। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে বৃহন্নলা। তবে লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ীর মধ্যে বুক চাপড়ানো বিলাপ নেই। তারা কেবল পাথরের মতো চুপচাপ বসে থাকে, আর তাদের চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়াতে থাকে। লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ী এক অপরকে জড়িয়ে ধরে চোখে আঁচল চাপা দেয়, মৃন্ময়ীর শরীরের নিঃশব্দ কাঁপুনি দেখে আঁচ করা যায়, রুদ্ধ কান্নার দমকে এই আলোড়ন।
ডক্টর ঘোষাল ঘরের সবার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘বিরেনবাবু, মনে হচ্ছে খুনের কেস। পুলিশকে ডাকার ব্যবস্থা করুন।’
ডক্টর ঘোষালের কথাটা রামদিনের কানে যায়, বলে, ‘হ্যা, আমি এখুনি থানায় ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।’
ডক্টর ঘোষাল মৃদু হেসে বলেন, ‘হ্যা রামদিন, তার আগে সবাইকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।’
ডাক্তারবাবুর কথার মর্মটা বিরেনবাবু ও রামদিন ভালই বুঝতে পারে। বিরেন বাবু দেরি না করে সবাইকে নিয়ে নিচের ড্রয়িং রুমে নেমে আসেন। রামদিন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে হুক টেনে দেয়। রামদিন নিচে এসে ড্রয়িং রুমে রাখা ল্যান্ড ফোন থেকে থানায় ফোন করে দেয়।
সবাই নিথর হয়ে বসে থাকে, কারো মুখে কোন কথা নেই। তবে দুঃখের থেকেও রায় পরিবারের সদস্যদের মুখের মধ্যে বেশি আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। একটা সোফায় মৃন্ময়ীকে মাঝে রেখে লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি বসে থাকে। উল্টোদিকের সোফায় ডক্টর ঘোষাল আর বিরেনবাবু বসে থাকেন। মনোজ একটা সিঙ্গল সোফায় চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বসে হাতের নখ চিবোয়। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে রামদিন বসে থানার বড় বাবুদের আসার অপেক্ষায় থাকে। বৃহন্নলাএকটা কোনায় চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।
গলা খাকরে বিরেন বাবু বলেন, ‘ডক্টর ঘোষাল, চা খাবেন?’
ডক্টর ঘোষাল মৃদু হেসে সম্মতি দেন। বিরেনবাবু মেয়েদের দিকে তাকান। মৃন্ময়ী উঠতে যাবার আগেই বৃহন্নলা বলে ওঠে, ‘বৌদি, আপনি বসুন। আমি সবার জন্য চা করে নিয়ে আসছি।’
একটু পরেই ট্রেতে করে সবার চা নিয়ে বৃহন্নলা হাজির হয়। মৃন্ময়ী চা খায় না, তাই মৃন্ময়ী ছাড়া সকলে ট্রের থেকে একটা করে কাপ তুলে নেয়। সকলে নিঃশব্দে চা পান করে যায়, কারো মুখে কোন কথা নেই। বিরেনবাবুকে ভীষণ রকম চিন্তিত দেখায়।
এই সময় বাইরে জিপ থামার আওয়াজ পাওয়া যায়।
রহস্য
শুক্রুবার, ভোর ছটা। বাড়ির কাজের মেয়ে বৃহন্নলা প্লেটে চায়ের কাপ নিয়ে দোতলায় মালকিনের ঘরের দরজায় নক করে, ‘মেমসাব,চা।’
একটু সময় অপেক্ষা করে আবার দরজায় নক করে বলে, ‘মেমসাব, চা এনেছি, দরজা খুলুন।’ কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
কিছুক্ষন অপেক্ষার পরে বেশ জোরেই বলে, ‘মেমসাব, মেমসাব, চা। দরজা খুলুন।’
এরপরে বেশ কয়েকবার নক করার পরেও বিনোদিনী দেবি দরজা খোলেন না। ভয় পেয়ে বৃহন্নলা জোরে জোরে দরজায় ঘা দিতে থাকে আর চেচাতে থাকে, ‘মেমসাব, দরজা খুলুন। মেমসাব, দরজা খুলুন।’
বৃহন্নলার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বিনোদিনী দেবির একমাত্র সন্তানের বিধবা পত্নী মৃন্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মৃন্ময়ীর ঘর বাড়ির একতলায়। মৃন্ময়ী সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে শাশুড়ির ঘরের সামনে বৃহন্নলাকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘কি রে বৃহন্নলা কি হয়েছে?’
‘দেখুন না বৌদি, কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্চি। কিন্তু মেমসাব দরজা খুলছেন না।’
‘মা বোধহয় ঘুমোচ্ছেন ....’
‘কিন্তু বৌদি, মেমসাহেব তো ভোর ছটার সময় উঠে পড়েন।’
‘হয়ত অনেক রাত করে ঘুমিয়েছেন। ঠিক আছে, বৃহন্নলা তুই আর একবার ডাক।’
‘মেমসাহেব, মেমসাহেব, চা এনেছি। দরজা খুলুন।’
কিন্তু ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। এত ডাকাডাকিতেও শাশুড়ির কোন উত্তর না আসায় মৃন্ময়ী একটু চিন্তায় পড়ে যায়। মৃন্ময়ী এবারে দরজার কড়াটা জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে চেচায়, ‘মা, মা, দরজা খুলুন। মা, মা।’
মৃন্ময়ী একটু অপেক্ষা করে এবারে বেশ জোরেই চেচিয়ে ওঠে, ‘মা, মা, কি হল আপনার? দরজা খুলছেন না কেন?’
কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া যায় না। মৃন্ময়ী এবারে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। দরজায় কান পাতে, ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়ে আরও ভয় পেয়ে যায় মৃন্ময়ী।
‘মা, কি হয়েছে আপনার? দরজা খুলুন।’
ঘন ঘন দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বৃহন্নলাও চেচাতে থাকে, ‘মেমসাব, মেমসাব দরজা খুলুন।’
কিন্তু দরজা খোলার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ী দুজনেই এবারে বেশ ভয় পেয়ে যায়। মৃন্ময়ী ভীত স্বরে বলে, ‘মনে হচ্ছে মা খুব অসুস্থ বা মায়ের কিছু একটা হয়েছে। হয়ত মা দরজা খোলার অবস্থায় নেই। দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে।’
‘কিন্তু বৌদি, আমরা দুজনে কি এত মজবুত দরজা ভাংতে পারব?’
‘না, তুই এখানে দাড়া। আমি পাশের বাড়ির থেকে জ্যাঠামশাইদের ডেকে আনছি।’
‘কিন্তু বৌদি, তার আগে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি যদি.....’
‘না, তাতে দেরি হয়ে যাবে।’ এই বলে মৃন্ময়ী আর দাড়ায় না। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে।
আগেই বলেছি, দেব নারায়ন রায় দুই ছেলের জন্য একই ডিজাইনের দুটো বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়ি দুটোর অবস্থান দু দিকে, একটা উত্তর অপরটির দক্ষিণ দিক। তাই দুটো বাড়ির আলাদা আলাদা নাম রেখেছিলেন, একটা উত্তর মহল, অপরটির দক্ষিন মহল। উত্তর মহলটি বড় ছেলে বিরেনের ভাগে পড়ে আর দক্ষিণ মহলটি ছোট ছেলে সুরেনের।
এই দক্ষিণ মহলে মুল দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রথমেই পড়ে বিশাল ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। এই ড্রইং রুমটি বাড়ির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। ড্রয়িং রুমটির বাঁ পাশে শুরুতে এটাচ বাথরুম সহ একটা বড় বেডরুম, এর ঠিক পাশেই একটা কমন বাথরুম। তার পাশে রান্নাঘর। আর এর পাশেই একদম শেষে একটা ছোট রুম। এটিতে বৃহন্নলা থাকে। ড্রয়িং রুমটির একদম শেষদিকে একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। ড্রয়িং রুমটির ঠিক ডান পাশে এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম। এই বেডরুম দুটির একটিতে মৃন্ময়ী থাকে, অপরটি গেস্ট রুম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা লম্বা প্যেসেজ দোতলার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চলে গেছে। প্যাসেজটির বাম পাশে এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম আবার ডান পাশেও একি রকম এটাচ বাথরুম সহ দুটো বড় বেডরুম।
পরবর্তীকালে বিনোদিনী দেবি ওই ডান পাশের দুটো রুমকে ভেঙ্গে নিজের জন্য একটা বিশাল সাইজের বেডরুম ও বেশ বড়সড় সাইজের এটাচ বাথরুম বানিয়ে নেন। বিনোদিনী দেবি দোতলায় একাই থাকতেন। দোতলার বাকি দুটো রুম খালি থাকত।
বিনোদিনী দেবি বাড়িতে আর কোন কাজের লোক রাখেননি। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজ বৃহন্নলা ও মৃন্ময়ীকে করতে হত।
যাইহোক মৃন্ময়ী খুব দ্রুত বিরেন রায়ের বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে ঘন ঘন কলিং বেল বাজাতে থাকে। বিরক্তির সাথে বিরেন রায় নিজে দরজা খুলে খেকিয়ে উঠতে যাবেন কিন্তু মৃন্ময়ীকে এবং তার অবস্থা দেখে হকচকিয়ে যান।
‘কি হয়েছে মৃন্ময়ী? তুমি এত সকালে?’
‘জ্যাঠামশাই, মায়ের কিছু একটা হয়েছে, দরজা খুলছেন না, ভেতর থেকে শুধু গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। আপনারা একটু আসুন।’
ঘন ঘন কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ইতিমধ্যে বিরেন বাবুর পিছু পিছু তার বড় ছেলে মনোজ, বড় বৌমা লাবণ্য ও ছোট বৌমা প্রিয়ন্তি এসে হাজির হয়। মৃন্ময়ীর কথা শুনে সবাই দ্রুত পায়ে বিনোদিনী দেবির বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। গেটের বাইরে এখানকার থানার হাবিলদার রামদিনকে সাইকেলে চেপে যেতে বিরেন বাবু দেখতে পান। বিরেন বাবু চেচিয়ে রামদিনকে ডাকেন। রামদিন সাইকেল থেকে নেমে গেট খুলে ভেতরে আসে। যেতে যেতে রামদিনকে পুরো ব্যাপারটা মৃন্ময়ী বলে।
একটু পরেই মৃন্ময়ীর সাথে বিনোদিনী দেবির ভাসুর বিরেন ও তার বড় ছেলে মনোজ ও দুই পুত্রবধু লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি এবং এই অঞ্চলের থানার হাবিলদার রামদিন এসে হাজির হয়। সবাই একসাথে হন্তদন্ত হয়ে দোতলায় বিনোদিনী দেবির ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হয়। বিরেনবাবু দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে করতে বলে, ‘বিনোদিনী ..... বিনোদিনী..... কি হয়েছে? দরজা খোল।’
বিরেনবাবুর বড় ছেলে মনোজ জোরে চিৎকার দেয়, ‘কাকি ... কাকি ... দরজা খোল।’
এরপরে লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি দুজনেই ডাক দেয়, কিন্তু ভেতর থেকে কোন উত্তর আসে না, দরজাও খোলে না।
মৃন্ময়ী ভীত স্বরে বলে, ‘জ্যাঠামশাই, দরজায় কান পাতুন মায়ের গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পাবেন। মনে হচ্ছে মা খুব অসুস্থ বা মায়ের কিছু একটা হয়েছে। হয়ত মা দরজা খোলার অবস্থায় নেই।’
মৃন্ময়ীর কথা শুনে বিরেন, মনোজ, লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও রামদিন সবাই একে একে দরজায় কান পাতে এবং প্রত্যেকেই গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পায়।
বিরেনবাবু চিন্তিত স্বরে বলে, ‘মনে হচ্ছে দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে।’
এই শুনে রামদিন নিজের পালয়ানি দেখানোর জন্য সবাইকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের কাঁধ দিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা মারে। এরকম বেশ কয়েকবার ধাক্কা মারে কিন্তু তাতে কাঁধে ব্যথা পাওয়া ছাড়া লাভের লাভ কিছু হয় না।
বিরেন বাবু বাধ্য হয়ে রামদিনকে ক্ষান্ত করে বলেন, ‘রামদিন, এটা আগেকার দিনের সেগুন কাঠের মজবুত দরজা। এভাবে খোলা যাবেনা। আমাদের বাগানে একটা কাঠের গুড়ি আছে, সেটা নিয়ে এসে এই দরজা খুলতে হবে।’
বিরেন বাবু নিজের বড় ছেলেকে ইশারা করতেই মনোজ রামদিনকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের গুড়ি আনতে চলে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই দুজনে ধরাধরি করে কাঠের গুড়িটা নিয়ে এসে হাজির হয়। বিরেন বাবু মেয়েদেরকে একটু সরে যেতে বলে নিজেও হাত লাগায়। গুড়িটার মুখে রামদিন, মাঝে বিরেন বাবু ও শেষে মনোজ থাকে। তিনজনে গুড়িটা চাগিয়ে ধরে সজোরে গিয়ে দরজায় আঘাত করে। বারংবার আঘাত করতে থাকে। দরজার উপরে লাগানো ছিটকিনিটা একটু আলগা হয়। আরও বেশ কয়েকবার আঘাত করার পরে ছিটকিনিটা অনেকটাই আলগা হয়ে আসে। তিনজনে একটু দম নেয়। আবার গুড়িটা চাগিয়ে ধরে সজোরে দরজায় আঘাত করে। দরজার উপরের ছিটকিনিটা ভেঙ্গে গিয়ে ঘরের ভেতরে ছিটকে পরে। দরজাটা দড়াম করে খুলে যেতেই তিনজনে টাল সামলাতে না পেরে ঘরের ভিতরে হুরমুরিয়ে গিয়ে পড়ে। প্রথমে রামদিন তার উপরে বিরেন বাবু আর তার উপরে মনোজ গিয়ে পড়ে। হাত ফস্কে কাঠের গুড়িটা ঘরের ভেতরে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে। রামদিনের পায়ের হাঁটুতে ও হাতের কনুইয়ে সামান্য চোট পায়। কিন্তু তিনজনেই খুব দ্রুত সামলে নিয়ে উঠে দাড়ায়।
ইতিমধ্যে দরজা খুলে যেতেই মেয়েরাও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ঘরের ভেতর ঢুকে আসে। সবার চোখ বিনোদিনী দেবির খাটের দিকে চলে যায়। বীভৎস দৃশ্যটা চোখে পড়তেই সকলে আঁতকে ওঠে। খাটের পাশে চাপ চাপ রক্ত, আর সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে বিনোদিনী দেবি।
সকলে হতবাক হয়ে যায় বিনোদিনী দেবির রক্তাক্ত দেহটা দেখে। বিনোদিনী শুধু একটা নাইটি পরে চিত হয়ে শুয়ে আছেন, দুটো হাত বুকের উপরে জড় করা, ডান হাতটা বাঁ হাতের কব্জিটা চেপে ধরে আছে। নাইটি, বুক, হাত সব রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানি বের হচ্ছে। বিনোদিনী দেবির মুখ চোখ তীব্র যন্ত্রণা, ভয়, বিস্ময়ে একাকার হয়ে আছে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা, সাদা ফেনার মত গ্যাজলা বেরিয়ে রয়েছে। মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। বারংবার কেঁপে উঠছে দেহটা। পা দুটো কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে বর্ণনাতীত যন্ত্রণায়।
এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে সকলেই নির্বাক হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। সকলে সংবিৎ ফিরে পেতে সময় নেয়।
সর্ব প্রথম বৃহন্নলা হাইমাউ করে চেচিয়ে ওঠে, ‘মেমসাব, আপনার এ অবস্থা কি করে হল.... কে করল....’ বলতে বলতে বৃহন্নলা বিনোদিনী দেবির দিকে এগিয়ে যায়।
বাড়ির বাকি মেয়েরা অত রক্ত দেখে এগোতে সাহস পায় না, দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে। এদিকে বিরেন বাবু অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ মানুষ, অবস্থাটা বোধগম্য হতে সময় নেয় না। সকলকে অবাক করে দিয়ে বিরেন বাবু হুড়মুড়িয়ে ঘরের এটাচ বাথরুমটার কাছে চলে যান। বাথরুমের দরজাটা টান মেরে খুলতে যান, কিন্তু ছিটকিনি দেওয়া আছে দেখে তিনি ছিটকিনি খুলে বাথরুমের ভেতরে ঢোকেন। বাথরুমটা ভাল করে নিরীক্ষণ করেন কিন্তু কাউকে দেখতে পান না। বেরিয়ে আসেন বাথরুম থেকে। সকলে উৎকণ্ঠা নিয়ে বিরেন বাবুর দিকে চেয়ে থাকে।
এরপরে বিরেন বাবু যেটা করেন সেটাতে সবাই আরও আশ্চর্য হয়ে যায়। মাটিতে শুয়ে পড়ে বিরেন বাবু খাটের তলাটা ভাল করে নিরীক্ষণ করেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পান না।
এদিকে বৃহন্নলা চেচিয়ে ওঠে, ‘বাবু, এসব পরে করলেও চলবে। সবার আগে ডাক্তার, এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করুন। মেমসাবের ধড়ে এখনো প্রান আছে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে এখনো বাঁচান যাবে।’
বৃহন্নলার কথায় বিরেন বাবুর হুশ ফেরে, মনে মনে একটু লজ্জিত হন, বলেন, ‘মনোজ, তুই এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা কর আর আমি পাশেই ডাক্তার ঘোষাল থাকেন। ওনাকে ডেকে আনছি।’
মনোজ বলে, ‘আমার ঘরে নার্সিং হোম আর এম্বুল্যান্সের ফোন নাম্বার আছে। দুটোতে ফোন করে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
বিরেন বাবু আর মনোজ দুজনেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটে। মৃন্ময়ী ছোটবেলা থেকেই সামান্য কাটা ছেড়া, রক্ত দেখলেই ভয়ে মূর্ছা যায়। বীভৎস রক্তাত অবস্থায় শাশুড়িকে দেখে মৃন্ময়ী নিজেকে আর সামলাতে পারে না, জ্ঞান হারায়। ভাগ্যিস লাবণ্য ধরে না ফেললে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। লাবণ্য আর প্রিয়ন্তি দুজনে ধরাধরি করে মৃন্ময়ীকে দরজায় ঠেস দিয়ে বসায়। লাবণ্য প্রিয়ন্তিকে জল আনতে বলে। প্রিয়ন্তি একপ্রকার দৌড়ে নিচ থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে আসে। জলের ঝাপটা কয়েকবার দিতেই মৃন্ময়ীর জ্ঞান ফিরে আসে।
এদিকে হাবিলদার রামদিন বেকুফের মত ঘরের মধ্যে দাড়িয়ে থাকে। পুলিশে কাজ করলে কি হবে রামদিনও বেশি রক্তারক্তি নিতে পারে না। তাই চুপচাপ ঘরের মাঝে দাড়িয়ে সজাগ দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলায়।
গোঙ্গানির আওয়াজ পেতে সকলে বিনোদিনী দেবির দিকে চোখ ফেরায়।
বৃহন্নলা বলে, ‘মেমসাব, খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি, এখুনি ডাক্তার এসে যাবে। আপনার অবস্থা এরকম কি করে হল.... কে করল?’
বিনোদিনী দেবি ডানহাত দিয়ে বাম হাতের কব্জিটা চেপে ধরে খুব কষ্টের সাথে বাম হাতটা তুলে ধরে। বামহাতের তর্জনীটা সামনের দিকে দেখায়। সেদিকে ছ’ পাল্লার বিশাল কাঠের আলমারিটার দিকে সবার চোখে পড়ে। বিনোদিনী দেবির ইশারাটায় সবাই মনে মনে ধারনা করে, খুনি ওই আলমারির মধ্যে লুকিয়ে আছে।
রামদিনের পুলিশি সত্তা জেগে ওঠে, হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে খুব সন্তর্পণে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েরা ভয়ে আরও সিটিয়ে যায়। রামদিন মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে। ভয়ার্ত চোখে সবাই রামদিনের দিকে চেয়ে থাকে।
ছ’পাল্লার বিশাল কাঠের আলমারিটার সামনে রামদিন হাজির হয়। সন্তর্পণে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আলমারিটার বাম পাশে এসে দাড়ায়, আলমারিতে চাবি ঝুলছে কিন্তু দেওয়া নেই। ডান হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে বাম হাতে পাল্লার হাতল ধরে হ্যাচকা টান মারে। আলমারির বাম পাশের দুটো পাল্লা খুলে আসে। মেয়েদের ভয়ে হাত পা গুটিয়ে আসে। আলমারিতে তিনটে তাক, উপরের তাকে ডাই করা শিতের পোশাক, মাঝের তাকে লেপ, কম্বল। আর নিচের তাকে নানা ধরনের লেডিস জুতো। রামদিন তাও একবার সব কটা তাকে লাঠি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে দেখে নেয়।
পাশের পাল্লাদুটোতেও চাবি ঝুলছে, রামদিন চাবি ঘুরিয়ে দেখে খোলা আছে। এরপরে রামদিন খুব সন্তর্পণে পাশের পাল্লা দুটো খুলে ফেলে। এখানে দুটি তাক। উপরের তাকে সার দিয়ে হ্যাঙ্গারে শাড়ি ঝোলান রয়েছে। নিচের তাকে লন্ড্রির থেকে কেচে আসা শাড়ি থাক দিয়ে রাখা আছে। রামদিন শাড়িগুলো সব একটা একটা করে সরিয়ে লাঠি দিয়ে খুচিয়ে ভাল করে পরিক্ষা করে। নিচের তাকটাও ভাল করে চেক করে নেয়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না।
ডান দিকের পাল্লাদুটোর দিকে সবাই ভয়ে ভয়ে চেয়ে থাকে। সবার মনে মনে ধারনা হয় খুনি এটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। রামদিনও আরও সজাগ হয়ে যায়। এখানেও চাবি ঝুলছে কিন্তু চাবি দেওয়া নেই। লাঠিটা মুঠিতে ভাল করে চেপে ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রামদিন আলমারির শেষ দুটো পাল্লা একটানে খুলে ফেলেই লাঠিটা উচিয়ে ধরে। এখানেও তিনটে তাক, উপরের তাকে মেয়েদের যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রী। মাঝের তাকে লকার, বন্ধ। নিচের তাকে মেয়েদের অন্তর্বাস, ব্লাউজ, ব্রা এইসব। রামদিন উপরের আর নিচের তাক দুটো ভাল করে পরীক্ষা করে নেয়। মাঝের লকারটি টান মেরে দেখে চাবি দেওয়া আছে। কিন্তু লকারের সাথে চাবিটা লাগান নেই।
আলমারির ভেতরে কাউকে পাওয়া না যাওয়ায় সবাই মনে মনে একটু হতাশ হয়। রামদিন সব থেকে বেশি হতাশ হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আশা করেছিল খুনিকে হাতে নাতে ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।
এদিকে নিচ থেকে একটা সোরগোলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। একটু পরেই বিরেন বাবু ডাক্তার ঘোষালকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হয়। পিছু পিছু মনোজও এসে হাজির হয়। মনোজ হাপাতে হাপাতে বলে, ‘এম্বুল্যান্স এখুনি আসছে আর নার্সিং হোমের ইমারজেন্সিতে বলে দিয়েছি।’
ডক্টর ঘোষাল চারিদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ধির পায়ে বিনোদিনী দেবির পাশে গিয়ে দাড়ায়। ডাক্তারের সুবিধের জন্য বৃহন্নলা একটু সরে বসে। ডাক্তার উবু হয়ে বসে প্রথমে বিনোদিনী দেবির নাকের কাছে হাত নিয়ে যায়।
বিনোদিনী দেবির অবস্থা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার ভুরু দুটো কপালের দিকে উঠে গেছে, চোখ দুটো যেন বিস্ফোরিত হয়ে বাইরে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, মুখ হা করে আছে। কিন্তু গোঙ্গানি থেমে গেছে, পা দুটো স্থির হয়ে আছে। আজানা আশঙ্কায় সকলের বুক কেপে ওঠে।
ডাক্তারবাবু ইতিমধ্যে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা করে। উঠে দাঁড়ানোর আগে বিনোদিনী দেবির চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে দেন। বিরেনবাবুর দিকে চেয়ে হতাশ স্বরে ডক্টর ঘোষাল বলেন, ‘সরি, বিরেনবাবু, শি ইজ নো মোর। উনি মারা গেছেন।’
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই বৃহন্নলার বুক চাপড়ানো বিলাপের শব্দ শোনা যায়। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে বৃহন্নলা। তবে লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ীর মধ্যে বুক চাপড়ানো বিলাপ নেই। তারা কেবল পাথরের মতো চুপচাপ বসে থাকে, আর তাদের চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়াতে থাকে। লাবণ্য, প্রিয়ন্তি ও মৃন্ময়ী এক অপরকে জড়িয়ে ধরে চোখে আঁচল চাপা দেয়, মৃন্ময়ীর শরীরের নিঃশব্দ কাঁপুনি দেখে আঁচ করা যায়, রুদ্ধ কান্নার দমকে এই আলোড়ন।
ডক্টর ঘোষাল ঘরের সবার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘বিরেনবাবু, মনে হচ্ছে খুনের কেস। পুলিশকে ডাকার ব্যবস্থা করুন।’
ডক্টর ঘোষালের কথাটা রামদিনের কানে যায়, বলে, ‘হ্যা, আমি এখুনি থানায় ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।’
ডক্টর ঘোষাল মৃদু হেসে বলেন, ‘হ্যা রামদিন, তার আগে সবাইকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।’
ডাক্তারবাবুর কথার মর্মটা বিরেনবাবু ও রামদিন ভালই বুঝতে পারে। বিরেন বাবু দেরি না করে সবাইকে নিয়ে নিচের ড্রয়িং রুমে নেমে আসেন। রামদিন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে হুক টেনে দেয়। রামদিন নিচে এসে ড্রয়িং রুমে রাখা ল্যান্ড ফোন থেকে থানায় ফোন করে দেয়।
সবাই নিথর হয়ে বসে থাকে, কারো মুখে কোন কথা নেই। তবে দুঃখের থেকেও রায় পরিবারের সদস্যদের মুখের মধ্যে বেশি আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। একটা সোফায় মৃন্ময়ীকে মাঝে রেখে লাবণ্য ও প্রিয়ন্তি বসে থাকে। উল্টোদিকের সোফায় ডক্টর ঘোষাল আর বিরেনবাবু বসে থাকেন। মনোজ একটা সিঙ্গল সোফায় চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বসে হাতের নখ চিবোয়। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে রামদিন বসে থানার বড় বাবুদের আসার অপেক্ষায় থাকে। বৃহন্নলাএকটা কোনায় চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।
গলা খাকরে বিরেন বাবু বলেন, ‘ডক্টর ঘোষাল, চা খাবেন?’
ডক্টর ঘোষাল মৃদু হেসে সম্মতি দেন। বিরেনবাবু মেয়েদের দিকে তাকান। মৃন্ময়ী উঠতে যাবার আগেই বৃহন্নলা বলে ওঠে, ‘বৌদি, আপনি বসুন। আমি সবার জন্য চা করে নিয়ে আসছি।’
একটু পরেই ট্রেতে করে সবার চা নিয়ে বৃহন্নলা হাজির হয়। মৃন্ময়ী চা খায় না, তাই মৃন্ময়ী ছাড়া সকলে ট্রের থেকে একটা করে কাপ তুলে নেয়। সকলে নিঃশব্দে চা পান করে যায়, কারো মুখে কোন কথা নেই। বিরেনবাবুকে ভীষণ রকম চিন্তিত দেখায়।
এই সময় বাইরে জিপ থামার আওয়াজ পাওয়া যায়।