18-12-2023, 10:26 PM
শম্ভু গোলামের ছোট ছেলে সইফুলের বাম পা'টা তুলে দেখল একবার। তৎক্ষনাৎ ওর মুখে হাসি খেলে গেল। একবার নয় দু' বার কামড় দিয়েছে সাপটা। ওর হাসিমুখ দেখে চিন্তিত গোলাম আলী বললে---কি রে শম্ভু, হাসিস কেন? ছিলাটা বাঁচবে তো।
অমনি তাগড়া বয়ঃসন্ধির কিশোর সইফুল ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললে---আমি বাঁচব লাই আব্বা! মইরে যাবো!
শম্ভুর তখন অদম্য হাসি। বললে---কামড়ায়ছে বটে, তাও একবার লয়, দু'বার।
---কি কস! চিন্তিত দেখালো গোলামকে।
জায়গাটা জল দিয়ে ধুয়ে দিয়ে পরিষ্কার করে শম্ভু গোলামের বউর দিকে তাকিয়ে বললে----বোরোলিন আছে গো চাচী।
সাপে কাটা রোগীর বোরোলিন দিয়ে কি চিকিৎসা করবে শম্ভু! দাওয়ায় জমে যাওয়া ভিড়, সকলে স্তম্ভিত। শম্ভু বোরোলিন দিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে বললে---যা, চিকিচ্ছা হয়ে গেছে। পঞ্চাশ টাকা দিও গো গোলাম চাচা।
---কি মজা কইরছিস আমার সাথে? গোলাম ক্রুদ্ধ ভাবে বললে কথাটা।
শম্ভুর মুখে তখনও হাসি। সে বললে---জলঢোড়া জাইনো চাচা? তোমার ব্যাটারে জলঢোড়া কামড়ায়ছে। বিলেডে কাটলে যেমনটা হয়, তেমুন হছে। কিচ্ছু চিন্তা করার লাই।
গোলামের পাশে দাঁড়ানো তার বাপ দাড়িওয়ালা বুড়ো গিয়াসউদ্দিন বললে---তাই ক। জলঢোড়ার তো বিষ লাই।
দুটো কুড়ি টাকা আর একটা দশটাকা সহ সঙ্গে একটা মুরগী দিল গোলাম আলী। শম্ভু মাংস খেতে ভালোবাসে। দাওয়ার পাশে মুরগীটাকে ঘুরঘুর করতে দেখে লোভ করে বলেছিল---খাসা আছে গো চাচা, দিবে লাকি?
মুরগীটা বগল দাবা করে ফিরল শম্ভু। বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করানো দেখে বুঝতে পারলো নির্ঘাত মাস্টারবাবু এসেছেন। উঠানে মুরগীটা ছেড়ে দিতেই কঁকিয়ে উঠল পাখিটা। রমা বললে---কে এলো রে লতা?
ষষ্ঠীর বাচ্চা মেয়ে বুলি বলে উঠল---শম্ভু কাকা আসছে গো দিমণি।
এই প্রথম মানুষটাকে দেখল পীযুষ। তার সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছে যে লোকটা, তাকে লোক নয় যুবক বলা ভালো। দীর্ঘ ছয় ফিটের চেহারার শক্ত বাঁধনে সে যেন লৌহমানব। ঘোর কালো গায়ে একখান জড়িবুটির মালা ছাড়া কিছু নেই। হাতের বাহু বন্ধনীতে একটা রুদ্রাক্ষ বাঁধা ঘুমসি আছে। যেখানে তার উদ্ধত শিরা-উপশিরার কঠিন পেশী ফুলে ওঠে। এই যুবকটিই তো রমার নকল স্বামী। এই এলাকায় তো রমার এখন পরিচয় এই বেদে যুবকের স্ত্রী হিসেবে।
শুধু পীযুষ নয়, শম্ভুও লক্ষ্য করল তাকে। তার মনের চারণভূমিতে আধিপত্যকারী রমণী রমা দিদিমণির যোগ্য স্বামীটির গায়ের রঙ ফর্সা, ঠিক দিদিমণির সাথে মানানসই। সুদর্শন পুরুষ যাকে বলে পীযুষ তাই। পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ বয়সে ইতিউতি এক দুটো চুল সামান্য পাক ধরেছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমায় একটি শিক্ষিত ব্যক্তির পরিচয় স্পষ্ট। শম্ভু যেন এক পলকের জন্য মাস্টারবাবুকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখল। হতে মাস্টার মশায়ের গায়ের রঙ দিদিমণির সাথে মিশে যায়, হতে পারে মাস্টার মশাই দিদিমণির যোগ্য শিক্ষিত পুরুষ। কিন্তু মাস্টারবাবুর কি তার মত দেহকাঠামো আছে! আছে এমন যুবকের দীর্ঘকাণ্ড গতর!
পীযুষ মৃদু হেসে বললে---এই যে তোমার খোঁজ করেও দেখা পাই না, যখনই আসি তোমার দেখা মেলে না।
শম্ভুর প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব ভেঙে গেল নিমেষে। অনুশোচনা হল তার। ছিঃ দিদিমণির বরটাকে সে কিনা এতক্ষণ প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছিল। কোথায় দিদিমণি আর মাস্টারবাবু, আর কোথায় সে সরবেড়িয়ার জংলী একটা বেদে। হলদে দাঁত বার করে হেসে বললে---সার, দিখাটা হয় লা। আসলে কামকাজের লিয়ে যেতে বার হয় কি লা।
---তোমাকে প্রথমে ধন্যবাদ দিই। যদিও ধন্যবাদ দেওয়া মানে তোমাকে খাটো করা। তুমি আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছ। যেটা আমার কাছে এখনো বিস্ময়। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।
রমা বললে---পরে বোলো সেসব। এখন কেউ কোথাও চলে যাচ্ছো না। শম্ভু, এই মুরগীটা কোত্থেকে পেলে? কিনে আনলে নাকি?
লাজুক হেসে একবার পীযুষ একবার রমার দিকে তাকিয়ে সে বলল---ভেট দিছে গো দিদিমণি। সাপে কাইটছে ঢোড়া, চিকিচ্ছার তো কিছু লাই। ইটা আজ সারের লগে রাঁইধে দেন দিদিমণি। দিশি আছে। ভালো মুখে রুচবে।
পীযুষ বাধা দিয়ে বললে---এই মাংস আমার মুখে আর তেমন রোচে না। তোমাদের এখানে তো ভালো নদীর মাছ কাঁকড়া মেলে, তাই ষষ্ঠীপদকে বাজার পাঠালাম।
---আগে জাইনলে সার নদী থিকে মাছ ধইরে আনতাম। এখুন ক'টা বাজে গো দিদিমণি?
রমা বারণ করে বললে---না, থাক। এখন আর কোথাও যেতে হবে। ষষ্ঠী গেছে বাজারে। ফিরলে আমি আর লতা মিলে মাছ রান্না করে দেব। রাতে না হয় মুরগীর কিছু একটা করা যাবে।
পীযুষও বলল---তাই ভালো। অন্য একদিন নদীতে আমি নিজে গিয়ে মাছ ধরা শিখব তোমার সাথে।
হেসে উঠল শম্ভু। শহরের শিক্ষিত বাবু তার সাথে ঠাট্টা করছে। নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা কি আর যে কেউ পারে।
দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর শম্ভুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল পীযুষ। রমা তখন গা এলিয়ে শুয়ে পড়েছে পিকলুর পাশে। পীযুষ সিগারেট ধরিয়ে শম্ভুকে দিতে গেলে শম্ভু বললে---সার, আমি গরীব মানুষ, সিগারেট আমার চইলবে লাই।
তারপর ও যেই বিড়ি বার করল, পীযুষ সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলল---তাহলে আমাকে একটা বিড়িই দাও।
শম্ভু বিস্মিত হল। রমা দিদিমণি শুধু নয়, মাস্টারবাবুও যে একজন মাটির কাছে নামতে পারার ক্ষমতাশালী মানুষ সেটা শম্ভুর কাছে চমকপ্রদ ঠেকলো। মাস্টারবাবু বা দিদিমণিরা বড়লোক, তাদের ঐশ্চর্য, বিভব আছে, তারা এমন গরীবের বন্ধু হতে পারে অবলীলায় শম্ভুর অভিজ্ঞতায় এ বড় মধুর স্থান নিল। যুবক ছোকরা সে, তবু তো তার দরিদ্র জীবনে অভিজ্ঞতা কম হল না। এমন মানুষ ক'জন হয়, যে একজন কলেজের অধ্যাপক হয়ে সামান্য বেদের কাছে বিড়ি চেয়ে খায়।
ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময়, পীযুষের কিছু বন্ধু বিড়ি খেত। যাদের সাথে এক দু'বার ও বিড়ির স্বাদ পেয়েছে। বিড়িতে টান দিয়ে সেই অনুভূতি যেন মনে করালো ওকে। যদিও বিড়িটার স্বাদ ও বিশেষ পছন্দ করেনি। তবু সে চায় সরবেড়িয়ার বেদে যুবকের সাথে মিশে যেতে। শুধু যে এই যুবক তার ছেলের প্রাণ ফিরিয়েছে তা নয়, এই বেদেদের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে ইন্টারেস্টও রয়েছে পীযুষের। হালকা ধোঁয়া ছেড়ে ও বললে---শম্ভু, এই নদীপথে তুমি কদ্দুর গেছো?
----গাঙ পর্যন্ত যাই লাই কখুনো। তবে বনে যে খালগুলা ঢুইকে গেছে সিদিকে বহুতবার গেছি।
---বাঘের দেখা পেয়েছ?
শম্ভু হাসলো। বললে---যে উঠানে আপনি বইসে আছেন, সিখান দিয়ে গেছে ক'বার। তবে সে অনেক বছর আগে। আমি তখুন ছোট ছিলি। তবে নদীতে দেখছি তারে সাঁতার দিতে। বছর খানিক আগে রসুলপুর ঘাটের মন্টু পালরে বাঘ খেয়ে ফেইলল জঙ্গলটারে গিয়ে মধু ভাঙতে গিছিল।
----জঙ্গলে ঢুকেছ কোনোদিন?
--সার সে তো যিতেই হবে। জড়ি বুটি যে সব লাগাইতে হয়, সবটা লিয়ে আসি জঙ্গলটা হতে।
---সেখানে কখনো বাঘ দেখোনি?
---দিখছি। একবার বাপের সঙ্গে গিয়ে। সার দিখতিছি বাঘ লিয়ে মজা পাইছেন, পিকলু বাবুর মত। চইলেন একবার বনে দিখলেও দিখা যেতে পাইরে।
পীযুষ হাসলো। বললে---সাপ টাপ যে ধরো, সেসব কি জঙ্গল হতে?
---জলা, খাল, জঙ্গল, পুন্না ঘর, ইটের খাদাল, যিখানে তার দিখা পাই ধইরে ফেইলি।
---আচ্ছা শম্ভু তুমি আমায় একটা কথা বলো তো। এইসব যে তুমি করো তোমাদের ভয় করে না? মানে কোনো না কোনো সময় তো তোমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি নাও কাজ দিতে পারে।
----হতে পাইরে সার। সে চন্দ্রবোড়া কাইটলে মাঝে মইধ্যে হয়। তবে আমি ভীমনাগ বেদের ব্যাটা কি লা। ঠিক সময় রুগীরে হাতে পাইলে সব হয়। তবে কি জাইনেন সার, গাঙে মাছ ধইরতে গেলে গাঙের সাপ কাটে মাঝিরে, তারে বাঁচাইতে আমার বাপ পারে লাই।
পীযুষ বুঝতে পারলো শম্ভু সামুদ্রিক কোরাল স্নেকের কথা বলছে। যার এন্টি ভেনম বিরল। ও খানিক জেরা করবার ভঙ্গিতে বলল---তোমরা এত কিছু পারো, তবু মেডিক্যাল সায়েন্স মানে কোনো উন্নত বিজ্ঞান তোমাদের কাছে আসছে না কেন। কিংবা তোমরা তো কার্যত হাসপাতাল খুলে ফেলতে পারো।।
শম্ভুর মুখে হালকা হাসি। এই হাসিটা বলে দেয় শম্ভু এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আগেও হয়েছে। বিশেষ করে ও যখন শহরে ফুটপাত পাশে সাপখেলা দেখায়, জড়িবুটি বিক্রি করে তখন শহরের বাবুরা এমন প্রশ্ন করে। খুব শান্তভাবেই বললে---সব বেদে চিকিচ্ছা পারে লাই। মিছা কথা কওয়া হাজারটা বেদেকে দিখা যায়। হাসপাতাল খুইলে বেদে রোজগার কইরবে লাই সার। আমার ঠাকুরদাদা, মানে আমার বাপের বাপ লখিন্দর বেদে ছিল যাযাবর। তাদের বসত বইলে কিছু লাই। গেরামের পর গেরাম ঘুরে ই দিশে কুত জাগায় ঘুইরে বেড়ায়। তাদের কুনো ইচ্ছা লাই যে বড় দোকান খুইলে চিকিচ্ছা কইরবে।
---তারমানে তুমি বলতে চাইছ, হাসপাতাল আসলেই দোকান?
---তা বইলছি লা সার। আমার মা'টা যখুন পোয়াতি ছিল, হাসপাতালে পইড়ে মরল দুদিন পর। পয়সা লাই তখুন তেমন যে মারে ইকটা ভালো ডাক্তার দিখাইবে। তারে আপনি দোকান বইলবেন লাকি হাসপাতাল?
পীযুষ এবার সিগারেট ধরালো। বললে---কিন্তু তুমি তো যাযাবর নও। তোমার তো কোনো এম্বিশন মানে টাকাপয়সা বাড়ুক এমন ইচ্ছে থাকতে পারে।
এবার বোধ হয় শম্ভুর কথাটা পছন্দ হল না। তবু হাসিমুখে বললে---টাকাপয়সার লোভ লাই আমার, সার। ভাত, মাছ, মাংস পাইলে আমার চইলে যায়। বিড়ি বাদ দিয়া ন্যাশা তেমুন লাই একটা।
----তুমি কি বিয়ে করবে না? মানে যুবক ছেলে। রমার কাছে শুনেছি মাত্র তিরিশ-বত্রিশ বয়স তোমার। সংসারী তো হবে। আজকের দিনে কি বেদে জীবনযাপন করে সংসার চালাতে পারবে?
দাঁড়ি গোঁফ না কাটা কালো পুরুষ্ঠু ঠোঁটের মাঝে হলদে দাঁত স্পষ্ট বার হয়ে এলো শম্ভুর। মুখের মধ্যে একটা ঠাট্টা করবার প্রবণতা যুক্ত হাসি, বললে---বে তো হই গাছে সার, দিদিমণিটার সাথে। মজা কইরলি সার। বে আমার হছিল, বউ ভেগেছে। বেদে ঘরের ছিলের লিগে মেয়েছেলে পাওয়া মুশকিল, বুইঝলেন সার। বিবাগী হইয়ে বাকি জীবন কাটাই দিব।
পীযুষও হেসে উঠল। বললে---তোমার দিদিমণি বলছিল এবার তোমার সত্যিকারে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।
ওরা দুজনেই হেসে উঠল। ওদের হাসির শব্দ রমার কানে গেল। শাড়িটা ঠিক করে উঠে এলো উঠানে। বললে---কি এত হাসি তোমাদের?
পীযুষ বললে---এই যুবক ছোকরা নাকি বিয়ে টিয়ে না করে বিবাগী হতে চায়। আমি বললাম তোমার দিদিমণি কিন্তু এবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।
শম্ভু বললে----দিদিমণি দিখে দেন তালে একটা মেয়ে। লিশ্চয় বে কইরব।
রমা বলল---ষষ্ঠীপদকে তো এজন্য আমি বলে রেখেছি। এই ছেলের বিয়ে করার জন্য একটা পাত্রী খুঁজে দিতেই হবে। ও নাকি খালি মাছ আর সাপ ধরে জীবন কাটিয়ে দেবে!
----একদিকে ভালো বুঝলে শম্ভু। বিবাগী জীবনে ইচ্ছেমত অনেক কিছু করা যায় বটে। তবুও দিনের শেষে একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
রমা ঘরের ভেতর থেকে বললে---তোমরা চা খাবে?
অমনি তাগড়া বয়ঃসন্ধির কিশোর সইফুল ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললে---আমি বাঁচব লাই আব্বা! মইরে যাবো!
শম্ভুর তখন অদম্য হাসি। বললে---কামড়ায়ছে বটে, তাও একবার লয়, দু'বার।
---কি কস! চিন্তিত দেখালো গোলামকে।
জায়গাটা জল দিয়ে ধুয়ে দিয়ে পরিষ্কার করে শম্ভু গোলামের বউর দিকে তাকিয়ে বললে----বোরোলিন আছে গো চাচী।
সাপে কাটা রোগীর বোরোলিন দিয়ে কি চিকিৎসা করবে শম্ভু! দাওয়ায় জমে যাওয়া ভিড়, সকলে স্তম্ভিত। শম্ভু বোরোলিন দিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে বললে---যা, চিকিচ্ছা হয়ে গেছে। পঞ্চাশ টাকা দিও গো গোলাম চাচা।
---কি মজা কইরছিস আমার সাথে? গোলাম ক্রুদ্ধ ভাবে বললে কথাটা।
শম্ভুর মুখে তখনও হাসি। সে বললে---জলঢোড়া জাইনো চাচা? তোমার ব্যাটারে জলঢোড়া কামড়ায়ছে। বিলেডে কাটলে যেমনটা হয়, তেমুন হছে। কিচ্ছু চিন্তা করার লাই।
গোলামের পাশে দাঁড়ানো তার বাপ দাড়িওয়ালা বুড়ো গিয়াসউদ্দিন বললে---তাই ক। জলঢোড়ার তো বিষ লাই।
দুটো কুড়ি টাকা আর একটা দশটাকা সহ সঙ্গে একটা মুরগী দিল গোলাম আলী। শম্ভু মাংস খেতে ভালোবাসে। দাওয়ার পাশে মুরগীটাকে ঘুরঘুর করতে দেখে লোভ করে বলেছিল---খাসা আছে গো চাচা, দিবে লাকি?
মুরগীটা বগল দাবা করে ফিরল শম্ভু। বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করানো দেখে বুঝতে পারলো নির্ঘাত মাস্টারবাবু এসেছেন। উঠানে মুরগীটা ছেড়ে দিতেই কঁকিয়ে উঠল পাখিটা। রমা বললে---কে এলো রে লতা?
ষষ্ঠীর বাচ্চা মেয়ে বুলি বলে উঠল---শম্ভু কাকা আসছে গো দিমণি।
এই প্রথম মানুষটাকে দেখল পীযুষ। তার সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছে যে লোকটা, তাকে লোক নয় যুবক বলা ভালো। দীর্ঘ ছয় ফিটের চেহারার শক্ত বাঁধনে সে যেন লৌহমানব। ঘোর কালো গায়ে একখান জড়িবুটির মালা ছাড়া কিছু নেই। হাতের বাহু বন্ধনীতে একটা রুদ্রাক্ষ বাঁধা ঘুমসি আছে। যেখানে তার উদ্ধত শিরা-উপশিরার কঠিন পেশী ফুলে ওঠে। এই যুবকটিই তো রমার নকল স্বামী। এই এলাকায় তো রমার এখন পরিচয় এই বেদে যুবকের স্ত্রী হিসেবে।
শুধু পীযুষ নয়, শম্ভুও লক্ষ্য করল তাকে। তার মনের চারণভূমিতে আধিপত্যকারী রমণী রমা দিদিমণির যোগ্য স্বামীটির গায়ের রঙ ফর্সা, ঠিক দিদিমণির সাথে মানানসই। সুদর্শন পুরুষ যাকে বলে পীযুষ তাই। পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ বয়সে ইতিউতি এক দুটো চুল সামান্য পাক ধরেছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমায় একটি শিক্ষিত ব্যক্তির পরিচয় স্পষ্ট। শম্ভু যেন এক পলকের জন্য মাস্টারবাবুকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখল। হতে মাস্টার মশায়ের গায়ের রঙ দিদিমণির সাথে মিশে যায়, হতে পারে মাস্টার মশাই দিদিমণির যোগ্য শিক্ষিত পুরুষ। কিন্তু মাস্টারবাবুর কি তার মত দেহকাঠামো আছে! আছে এমন যুবকের দীর্ঘকাণ্ড গতর!
পীযুষ মৃদু হেসে বললে---এই যে তোমার খোঁজ করেও দেখা পাই না, যখনই আসি তোমার দেখা মেলে না।
শম্ভুর প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব ভেঙে গেল নিমেষে। অনুশোচনা হল তার। ছিঃ দিদিমণির বরটাকে সে কিনা এতক্ষণ প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছিল। কোথায় দিদিমণি আর মাস্টারবাবু, আর কোথায় সে সরবেড়িয়ার জংলী একটা বেদে। হলদে দাঁত বার করে হেসে বললে---সার, দিখাটা হয় লা। আসলে কামকাজের লিয়ে যেতে বার হয় কি লা।
---তোমাকে প্রথমে ধন্যবাদ দিই। যদিও ধন্যবাদ দেওয়া মানে তোমাকে খাটো করা। তুমি আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছ। যেটা আমার কাছে এখনো বিস্ময়। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।
রমা বললে---পরে বোলো সেসব। এখন কেউ কোথাও চলে যাচ্ছো না। শম্ভু, এই মুরগীটা কোত্থেকে পেলে? কিনে আনলে নাকি?
লাজুক হেসে একবার পীযুষ একবার রমার দিকে তাকিয়ে সে বলল---ভেট দিছে গো দিদিমণি। সাপে কাইটছে ঢোড়া, চিকিচ্ছার তো কিছু লাই। ইটা আজ সারের লগে রাঁইধে দেন দিদিমণি। দিশি আছে। ভালো মুখে রুচবে।
পীযুষ বাধা দিয়ে বললে---এই মাংস আমার মুখে আর তেমন রোচে না। তোমাদের এখানে তো ভালো নদীর মাছ কাঁকড়া মেলে, তাই ষষ্ঠীপদকে বাজার পাঠালাম।
---আগে জাইনলে সার নদী থিকে মাছ ধইরে আনতাম। এখুন ক'টা বাজে গো দিদিমণি?
রমা বারণ করে বললে---না, থাক। এখন আর কোথাও যেতে হবে। ষষ্ঠী গেছে বাজারে। ফিরলে আমি আর লতা মিলে মাছ রান্না করে দেব। রাতে না হয় মুরগীর কিছু একটা করা যাবে।
পীযুষও বলল---তাই ভালো। অন্য একদিন নদীতে আমি নিজে গিয়ে মাছ ধরা শিখব তোমার সাথে।
হেসে উঠল শম্ভু। শহরের শিক্ষিত বাবু তার সাথে ঠাট্টা করছে। নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা কি আর যে কেউ পারে।
দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর শম্ভুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল পীযুষ। রমা তখন গা এলিয়ে শুয়ে পড়েছে পিকলুর পাশে। পীযুষ সিগারেট ধরিয়ে শম্ভুকে দিতে গেলে শম্ভু বললে---সার, আমি গরীব মানুষ, সিগারেট আমার চইলবে লাই।
তারপর ও যেই বিড়ি বার করল, পীযুষ সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলল---তাহলে আমাকে একটা বিড়িই দাও।
শম্ভু বিস্মিত হল। রমা দিদিমণি শুধু নয়, মাস্টারবাবুও যে একজন মাটির কাছে নামতে পারার ক্ষমতাশালী মানুষ সেটা শম্ভুর কাছে চমকপ্রদ ঠেকলো। মাস্টারবাবু বা দিদিমণিরা বড়লোক, তাদের ঐশ্চর্য, বিভব আছে, তারা এমন গরীবের বন্ধু হতে পারে অবলীলায় শম্ভুর অভিজ্ঞতায় এ বড় মধুর স্থান নিল। যুবক ছোকরা সে, তবু তো তার দরিদ্র জীবনে অভিজ্ঞতা কম হল না। এমন মানুষ ক'জন হয়, যে একজন কলেজের অধ্যাপক হয়ে সামান্য বেদের কাছে বিড়ি চেয়ে খায়।
ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময়, পীযুষের কিছু বন্ধু বিড়ি খেত। যাদের সাথে এক দু'বার ও বিড়ির স্বাদ পেয়েছে। বিড়িতে টান দিয়ে সেই অনুভূতি যেন মনে করালো ওকে। যদিও বিড়িটার স্বাদ ও বিশেষ পছন্দ করেনি। তবু সে চায় সরবেড়িয়ার বেদে যুবকের সাথে মিশে যেতে। শুধু যে এই যুবক তার ছেলের প্রাণ ফিরিয়েছে তা নয়, এই বেদেদের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে ইন্টারেস্টও রয়েছে পীযুষের। হালকা ধোঁয়া ছেড়ে ও বললে---শম্ভু, এই নদীপথে তুমি কদ্দুর গেছো?
----গাঙ পর্যন্ত যাই লাই কখুনো। তবে বনে যে খালগুলা ঢুইকে গেছে সিদিকে বহুতবার গেছি।
---বাঘের দেখা পেয়েছ?
শম্ভু হাসলো। বললে---যে উঠানে আপনি বইসে আছেন, সিখান দিয়ে গেছে ক'বার। তবে সে অনেক বছর আগে। আমি তখুন ছোট ছিলি। তবে নদীতে দেখছি তারে সাঁতার দিতে। বছর খানিক আগে রসুলপুর ঘাটের মন্টু পালরে বাঘ খেয়ে ফেইলল জঙ্গলটারে গিয়ে মধু ভাঙতে গিছিল।
----জঙ্গলে ঢুকেছ কোনোদিন?
--সার সে তো যিতেই হবে। জড়ি বুটি যে সব লাগাইতে হয়, সবটা লিয়ে আসি জঙ্গলটা হতে।
---সেখানে কখনো বাঘ দেখোনি?
---দিখছি। একবার বাপের সঙ্গে গিয়ে। সার দিখতিছি বাঘ লিয়ে মজা পাইছেন, পিকলু বাবুর মত। চইলেন একবার বনে দিখলেও দিখা যেতে পাইরে।
পীযুষ হাসলো। বললে---সাপ টাপ যে ধরো, সেসব কি জঙ্গল হতে?
---জলা, খাল, জঙ্গল, পুন্না ঘর, ইটের খাদাল, যিখানে তার দিখা পাই ধইরে ফেইলি।
---আচ্ছা শম্ভু তুমি আমায় একটা কথা বলো তো। এইসব যে তুমি করো তোমাদের ভয় করে না? মানে কোনো না কোনো সময় তো তোমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি নাও কাজ দিতে পারে।
----হতে পাইরে সার। সে চন্দ্রবোড়া কাইটলে মাঝে মইধ্যে হয়। তবে আমি ভীমনাগ বেদের ব্যাটা কি লা। ঠিক সময় রুগীরে হাতে পাইলে সব হয়। তবে কি জাইনেন সার, গাঙে মাছ ধইরতে গেলে গাঙের সাপ কাটে মাঝিরে, তারে বাঁচাইতে আমার বাপ পারে লাই।
পীযুষ বুঝতে পারলো শম্ভু সামুদ্রিক কোরাল স্নেকের কথা বলছে। যার এন্টি ভেনম বিরল। ও খানিক জেরা করবার ভঙ্গিতে বলল---তোমরা এত কিছু পারো, তবু মেডিক্যাল সায়েন্স মানে কোনো উন্নত বিজ্ঞান তোমাদের কাছে আসছে না কেন। কিংবা তোমরা তো কার্যত হাসপাতাল খুলে ফেলতে পারো।।
শম্ভুর মুখে হালকা হাসি। এই হাসিটা বলে দেয় শম্ভু এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আগেও হয়েছে। বিশেষ করে ও যখন শহরে ফুটপাত পাশে সাপখেলা দেখায়, জড়িবুটি বিক্রি করে তখন শহরের বাবুরা এমন প্রশ্ন করে। খুব শান্তভাবেই বললে---সব বেদে চিকিচ্ছা পারে লাই। মিছা কথা কওয়া হাজারটা বেদেকে দিখা যায়। হাসপাতাল খুইলে বেদে রোজগার কইরবে লাই সার। আমার ঠাকুরদাদা, মানে আমার বাপের বাপ লখিন্দর বেদে ছিল যাযাবর। তাদের বসত বইলে কিছু লাই। গেরামের পর গেরাম ঘুরে ই দিশে কুত জাগায় ঘুইরে বেড়ায়। তাদের কুনো ইচ্ছা লাই যে বড় দোকান খুইলে চিকিচ্ছা কইরবে।
---তারমানে তুমি বলতে চাইছ, হাসপাতাল আসলেই দোকান?
---তা বইলছি লা সার। আমার মা'টা যখুন পোয়াতি ছিল, হাসপাতালে পইড়ে মরল দুদিন পর। পয়সা লাই তখুন তেমন যে মারে ইকটা ভালো ডাক্তার দিখাইবে। তারে আপনি দোকান বইলবেন লাকি হাসপাতাল?
পীযুষ এবার সিগারেট ধরালো। বললে---কিন্তু তুমি তো যাযাবর নও। তোমার তো কোনো এম্বিশন মানে টাকাপয়সা বাড়ুক এমন ইচ্ছে থাকতে পারে।
এবার বোধ হয় শম্ভুর কথাটা পছন্দ হল না। তবু হাসিমুখে বললে---টাকাপয়সার লোভ লাই আমার, সার। ভাত, মাছ, মাংস পাইলে আমার চইলে যায়। বিড়ি বাদ দিয়া ন্যাশা তেমুন লাই একটা।
----তুমি কি বিয়ে করবে না? মানে যুবক ছেলে। রমার কাছে শুনেছি মাত্র তিরিশ-বত্রিশ বয়স তোমার। সংসারী তো হবে। আজকের দিনে কি বেদে জীবনযাপন করে সংসার চালাতে পারবে?
দাঁড়ি গোঁফ না কাটা কালো পুরুষ্ঠু ঠোঁটের মাঝে হলদে দাঁত স্পষ্ট বার হয়ে এলো শম্ভুর। মুখের মধ্যে একটা ঠাট্টা করবার প্রবণতা যুক্ত হাসি, বললে---বে তো হই গাছে সার, দিদিমণিটার সাথে। মজা কইরলি সার। বে আমার হছিল, বউ ভেগেছে। বেদে ঘরের ছিলের লিগে মেয়েছেলে পাওয়া মুশকিল, বুইঝলেন সার। বিবাগী হইয়ে বাকি জীবন কাটাই দিব।
পীযুষও হেসে উঠল। বললে---তোমার দিদিমণি বলছিল এবার তোমার সত্যিকারে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।
ওরা দুজনেই হেসে উঠল। ওদের হাসির শব্দ রমার কানে গেল। শাড়িটা ঠিক করে উঠে এলো উঠানে। বললে---কি এত হাসি তোমাদের?
পীযুষ বললে---এই যুবক ছোকরা নাকি বিয়ে টিয়ে না করে বিবাগী হতে চায়। আমি বললাম তোমার দিদিমণি কিন্তু এবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।
শম্ভু বললে----দিদিমণি দিখে দেন তালে একটা মেয়ে। লিশ্চয় বে কইরব।
রমা বলল---ষষ্ঠীপদকে তো এজন্য আমি বলে রেখেছি। এই ছেলের বিয়ে করার জন্য একটা পাত্রী খুঁজে দিতেই হবে। ও নাকি খালি মাছ আর সাপ ধরে জীবন কাটিয়ে দেবে!
----একদিকে ভালো বুঝলে শম্ভু। বিবাগী জীবনে ইচ্ছেমত অনেক কিছু করা যায় বটে। তবুও দিনের শেষে একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
রমা ঘরের ভেতর থেকে বললে---তোমরা চা খাবে?