18-12-2023, 10:26 PM
বড় প্রাণচ্ছল সময় কাটছে ওদের। পিকলুর ধীরে ধীরে শারীরিক উন্নতি রমাকেও চিন্তামুক্ত রাখছে। ম্যানগ্রোভ বন জঙ্গলের এমন নদী মাতৃক ভূমিতে রমার মনে হয় সে যেন ক'দিনের ভ্রমনার্থী। এই মাটির ঘরের চাল-চুলোহীন সংসার যেন একটা নতুন ফাটকা খেলা। শুধু পীযুষের অভাব বোধ করে রমা। ছুটি নিয়ে ক'টা দিন থেকে গেলেই পারতো। কিন্তু পীযুষের এখন সে সুযোগ নেই। অনার্সের সেমিস্টার শেষ হতে না হতেই মাস্টার্সের পরীক্ষা হাজির। শেষ হলেই একটা সেমিনারে যোগ দিতে দক্ষিণ এশিয়া যেতে হবে পীযুষকে। গোটা ট্যুরটাই স্পন্সর করছে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গবেষণাকারী সংস্থা। ভারত থেকে চারজনকে আমন্ত্রণ করেছে ওরা। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া এই চার দেশে একমাসের ভ্রমণ। পিকলুর অমন না হলে পরিবার নিয়ে যেত ও।
আজ সকাল সকাল পীযুষ যখন এলো তখন রমা ঘোর দোর ঝাঁট দিচ্ছিল। নিজের স্ত্রীকে পরের উঠোনে ঘর ঝাঁট দিতে দেখে কেমন একটা বাধল পীযুষের। রমার তাঁত শাড়ির আঁচলটা কোমরে বাঁধা, কপালের ওপর এসে পড়েছে অবিন্যস্ত চুল। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে মুখে ওর তখনও ঘুমের অবয়ব। পীযুষ এসে পড়তেই ঘড়ির দিকে তাকালো। দেয়াল ঘড়িটায় তখন সাড়ে সাত'টা। এমনিতে রমা এখানে আসার পর ভোর ভোর ওঠে। কলকাতায় যেখানে ও ছ'টায় উঠত, এখানে পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙে যায়। আজ দেরী হবার কারণ, কাল রাতে অকস্মাৎ শম্ভুর ডাক আসার জন্য। দেবীপুরের '. পাড়ায় নাকি কাকে সাপে কেটেছে। যেতে হবে শম্ভু বেদেকে। ফিরতে হবে কখন তার ঠিক নেই, তাই রমা হালকা টিফিন তৈরি করে দিয়েছে ঐ রাতে।
পীযুষ এসে পৌঁছে গাড়ি থেকে দুটো ভারী ব্যাগ নামালো। রমা বললে---কখন বেরোলে?
---ভোর চারটের সময়।
---ও মা! অত ভোরে কেন? পীযুষের হাত থেকে ব্যাগগুলো ধরে নিতে নিতে বললে রমা।
---অত ভারী ব্যাগ তুমি নিতে পারবে না। পীযুষ বাধা দিয়ে একটা ব্যাগ কেড়ে নিল।
রমা ভারী ব্যাগটা উঠোনে তুলতে তুলতে বলল---কি আছে গো?
---চাদর, কম্বল আছে। সামনে বর্ষা নামলে কিন্তু এসব জায়গায় ভীষণ আদ্রতা যেমন হয় তেমন ঠান্ডাও লাগে।
রমা ব্যাগটা তুলে এনে হাঁফ ছেড়ে বললে---শম্ভুটা থাকলে কষ্ট করতে হত না। এসব ভারী কাজ ও করে।
পীযুষ জুতোর লেস খুলে পা থেকে মোজা মুক্ত করতে করতে বললে---ও নেই নাকি? এবারেও ওর দেখা পাবো না!
রমা রান্নার জায়গাটা যেতে যেতে পেছন ফিরে হাসিমুখে বললে---কাল রাতে সাপে কাটা রোগী দেখতে যেতে হয়েছে। কখন ফিরবে কে জানে।
পীযুষ মুচকি হেসে বললে--বাপরে বাপ! এই বেদের যে দেখছি কলকাতার চিকিৎসকদের সমান ব্যস্ততা।
ঘরের মধ্যে তখনও পিকলু ঘুমোচ্ছে। রমা ডেকে তুলতে গেলে বারণ করল পীযুষ---ঘুমোচ্ছে ঘুমাক না।
ছেলের মুখের দিকে চেয়ে আছে পিতা। রমা বুঝতে পারছে এ ক'দিন তো শুধু তার নয়, পীযুষের ওপরও কম ধকল যায়নি। বরং এখন পিকলুর সুস্থ হওয়ার লক্ষণ রমার সামনে দিন দিন ফুটে উঠছে। পীযুষ তো সে খবর পায় না। নেটওয়ার্কহীন এই সুন্দরবনের নদীগাঁয়ে টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা বড্ড খারাপ। সরবেড়িয়া হাটের দিকে গেলে নাকি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
রমা পীযুষের জন্য চা করে এনে বললে---খেয়েছো কিছু?
পীযুষ ছেলের থেকে মুখ ফেরালো স্ত্রীয়ের দিকে। বললে---চাঁপা পরোটা তরকারি করে দিয়েছিল।
রমা ঘুরে পড়তেই পীযুষ পুনরায় বলল---কোথায় যাচ্ছো?
---ব্রাশ করিনি গো এখনো।
পীযুষ ঘুমন্ত ছেলেকে একবার দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রমার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো ওর দিকে। বললে---বেশ রোগা হয়ে গেছ রমা।
----ধ্যাৎ! মনের ভুল তোমার।
পীযুষ লক্ষ্য করল রমার হাতে শাঁখা-পোলা। দাম্পত্য জীবনে রমা কেবল সোনার দুটি সরু বালা দু'হাতে পরে থাকে, বিবাহের চিহ্ন হিসেবে একটি মাত্র লাল পোলা। যেটা নিয়েও পীযুষের বিরোধ আছে, এসব মানার কোনো যৌক্তিকতা নেই। হয়ত রমা পীযুষের মত নাস্তিক না হলেও, অতটা লৌকিকতাও মানে না। স্বামীর জন্য এই লাল পোলাটা পরতে তার ভালোই লাগে। এখন পোলার সাথে সদ্য কেনা সস্তার সাদা শাঁখা। এ যে তার স্ত্রীর নকল বিবাহের চিহ্ন তা বুঝতে বাকি নেই। রমা পীযুষের নজর এড়ায়নি, ও বললে---গ্রামের লোকেরা যাতে সন্দেহ না করে পরে থাকতে হয়।
পীযুষ রমার দিকে তাকালো। রমা তার স্বামীর এই চাহুনি চেনে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা রমার আধোয়া মুখ চেপে ধরল পীযুষ নিজের ওষ্ঠের সাথে। পীযুষের মুখেও সিগারেটের গন্ধ। কয়েক মাসের দূরত্বে সাত সকালের এই মিলনে দুজনেই আবেগতাড়িত ঘন চুম্বনে আবদ্ধ হল। রমাও অভুক্ত, পীযুষ তার চেয়েও বেশি যেন। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে স্ত্রীকে। এখুনি তার রমাকে চাই।
ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট, জিভের ঠোকাঠুকি আর মুখ ধোয়া এবং পুরুষালী ধূমপায়ী মুখের ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে। রমা শান্ত করল পীযুষকে। পীযুষ অবশ্য ততক্ষণে মুখ নামিয়ে রমার ঘরোয়া তাঁত শাড়ির আঁচল ঢাকা বুকে মুখ গুঁজে ওম নিচ্ছে। শিশুর মত মাতৃ স্নেহে স্বামীর চুলে বিলি কেটে আদর দিতে লাগলো রমা। বললে---পিকলু আছে, এখন নয়। ভারী মন খারাপ না গো তোমার?
পীযুষ মুখ তুলে তার চোখের চশমা ঠিক করে তাকালো। বললে---বড্ড একা লাগে। কলেজ থেকে ফিরলে তুমি, পিকলু কেউ নেই...এখন যেন রুটিন একঘেয়েমি।
রমারও চোখটা ছলছল করে উঠল। পীযুষের জামার বোতামে খুঁটখাঁট করতে করতে আবদারী সুরে বললে---আজ থেকে যেতে পারো তো।
---এখানে এইটুকু ঘরে?
---কেন নয়? আমরা আছি কি করে?
গাড়িটা দেখে ষষ্ঠী বুঝতে পারলো স্যার এসেছেন। ওকে দেখে পীযুষ বললে---ষষ্ঠীপদ, বলো কেমন আছো?
ষষ্ঠীপদ আনুগত্য দেখিয়ে বললে---ভালো আছি সার। ছিলাটাকে দেইখলেন, কত ভালো হইগেছে লা?
পীযুষ তখন পিকলুর সাথেই বসেছিল বিছানার ওপরে। পিকলু বললে---ষষ্ঠী আঙ্কেল কালকে কি শম্ভু আঙ্কেলকে কেউ ডাকতে এসেছিল?
---হুম্ম, বাবু। সাপে কাইটছে '. পাড়ার গোলাম আলির ব্যাটাটারে।
---তাকেও কি আমার মত স্পেক্টাকল্ড কোবরা কামড়েছে?
ষষ্ঠী ইংরেজি না বুঝলেও পিকলুর কথার জবাবে বললে---সে এখুনো জাইনি লা বাবু। তবে বিষধরটা মনে হয়।
পীযুষ বলল---তোর কি মনে আছে পিকলু তোকে যে সাপটা কামড়েছিল কেমন দেখতে?
---হুম্ম মনে আছে বাবা?
---তুই জানলিস কি করে ওটার নাম স্পেক্টাকল্ড কোবরা?
----মা বলছিল ষষ্ঠী কাকু যে স্পেক্টাকল্ড কোবরাটা তোমার ল্যাবে দিয়েছিল আমাকে ওটাই কামড়েছে।
ষষ্ঠী তৎক্ষনাৎ জিভ কেটে বললে---খবরদার বাবু, শম্ভুর কানে একথা তুইলবে লাই। সাংঘাতিক হবে তালে।
রমা বলল---কেন বলতো ষষ্ঠী? ওটাই কি শম্ভুর ঐ পোষা পদ্ম?
---দিদিমণি, ঠিক ধইরেছেন। শম্ভু উটারে বড্ড ভালোবাইসতো। জানতি পাইরলে আমারে আস্ত রাইখবে লাই।
রমা বললে---ওটা একটা বদ সাপ ছিল।
পীযুষ হেসে বললে---সাপের কি দোষ। ওরা আবার ভালো-বদ হয় নাকি!
---তুমি আরো বলছ? আমার ছেলেটাকে... এত সাপ তো রেখেছো, কেউ তো কোনোদিন এমন করল না। আমি ওকে মেরে ফেলেছি, ঠিক করেছি।
ষষ্ঠী তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠল আবার---সব্বনাশ! দিদিমণি কখুনো শম্ভুরে বইলবেন লাই, যে আপনি উটারে মাইরে ফেলছেন! বড় বিপদ হই যাবে। চিকিচ্ছাটা কইরতে দেন উরে। বড্ড মাথা গরম জোয়ান আছে, জেদ চাইপলে কি করে কে জানে...!
রমাও খানিক ভয় পেল। বললে---এই পিকলু তুইও কখনো শম্ভু আঙ্কেলকে বলবি না। যা শুনলি তা তো আবার তোর পেটে থাকে না।
পীযুষ বললে---ষষ্ঠীপদ, এসব কথা থাক। আজ ভাবছি তোমাদের এখানটা থেকেই যাবো। ভালো নোনা মাছের বাজার হয় এখানে শুনেছি।
---সত্যি! সার আজ থিকে যাবেন? ষষ্ঠী আনন্দৎসাহিত হয়ে পুনরায় বললে----সার আমি এখুনি বাজার যাবো। সেখান থিকা ভালো মাছ আইনবো।
---এনো, তার আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাও।
ষষ্ঠী দেখলে অদূরে তার স্ত্রী লতা দাঁড়িয়ে আছে উঠোন লাগোয়া। ঘরের ভিতরের কথোপকথন সে শুনছিল কি এক তীব্র কৌতুহলে। ষষ্ঠীপদ এত বছর পরেও তার বউটাকে ঠিক বুঝতে পারে না। সংসারের সব কাজ, ষষ্ঠীর স্বামী সেবাটুকুতেও খামতি নেই। তবু তার সাথে দু একটা ভালোমন্দ যেমন স্বামী-স্ত্রীয়ে কথা হয়, বলতে পারে না। লতার যেন কোনো আগ্রহই নেই ষষ্ঠীর প্রতি। সে যে অন্য পুরুষে ভেতরে ভেতরে মজে আছে, তা'ও ষষ্ঠী ভালোমত জানে। সে লতার কৌতুহলকে তাচ্ছিল্য করে আদেশের সুরে বলল---আজ সার ইখানে থাইকবেন, দিদিমণিরে রান্নায় সাহায্য কইরবি যা।
শম্ভু গিয়েছিল গোলাম আলির ঘরে। দাওয়ায় ছেলেটা দিব্যি বসে রয়েছে। এই যা চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে কামড় দিয়েছে কিছু একটা।
আজ সকাল সকাল পীযুষ যখন এলো তখন রমা ঘোর দোর ঝাঁট দিচ্ছিল। নিজের স্ত্রীকে পরের উঠোনে ঘর ঝাঁট দিতে দেখে কেমন একটা বাধল পীযুষের। রমার তাঁত শাড়ির আঁচলটা কোমরে বাঁধা, কপালের ওপর এসে পড়েছে অবিন্যস্ত চুল। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে মুখে ওর তখনও ঘুমের অবয়ব। পীযুষ এসে পড়তেই ঘড়ির দিকে তাকালো। দেয়াল ঘড়িটায় তখন সাড়ে সাত'টা। এমনিতে রমা এখানে আসার পর ভোর ভোর ওঠে। কলকাতায় যেখানে ও ছ'টায় উঠত, এখানে পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙে যায়। আজ দেরী হবার কারণ, কাল রাতে অকস্মাৎ শম্ভুর ডাক আসার জন্য। দেবীপুরের '. পাড়ায় নাকি কাকে সাপে কেটেছে। যেতে হবে শম্ভু বেদেকে। ফিরতে হবে কখন তার ঠিক নেই, তাই রমা হালকা টিফিন তৈরি করে দিয়েছে ঐ রাতে।
পীযুষ এসে পৌঁছে গাড়ি থেকে দুটো ভারী ব্যাগ নামালো। রমা বললে---কখন বেরোলে?
---ভোর চারটের সময়।
---ও মা! অত ভোরে কেন? পীযুষের হাত থেকে ব্যাগগুলো ধরে নিতে নিতে বললে রমা।
---অত ভারী ব্যাগ তুমি নিতে পারবে না। পীযুষ বাধা দিয়ে একটা ব্যাগ কেড়ে নিল।
রমা ভারী ব্যাগটা উঠোনে তুলতে তুলতে বলল---কি আছে গো?
---চাদর, কম্বল আছে। সামনে বর্ষা নামলে কিন্তু এসব জায়গায় ভীষণ আদ্রতা যেমন হয় তেমন ঠান্ডাও লাগে।
রমা ব্যাগটা তুলে এনে হাঁফ ছেড়ে বললে---শম্ভুটা থাকলে কষ্ট করতে হত না। এসব ভারী কাজ ও করে।
পীযুষ জুতোর লেস খুলে পা থেকে মোজা মুক্ত করতে করতে বললে---ও নেই নাকি? এবারেও ওর দেখা পাবো না!
রমা রান্নার জায়গাটা যেতে যেতে পেছন ফিরে হাসিমুখে বললে---কাল রাতে সাপে কাটা রোগী দেখতে যেতে হয়েছে। কখন ফিরবে কে জানে।
পীযুষ মুচকি হেসে বললে--বাপরে বাপ! এই বেদের যে দেখছি কলকাতার চিকিৎসকদের সমান ব্যস্ততা।
ঘরের মধ্যে তখনও পিকলু ঘুমোচ্ছে। রমা ডেকে তুলতে গেলে বারণ করল পীযুষ---ঘুমোচ্ছে ঘুমাক না।
ছেলের মুখের দিকে চেয়ে আছে পিতা। রমা বুঝতে পারছে এ ক'দিন তো শুধু তার নয়, পীযুষের ওপরও কম ধকল যায়নি। বরং এখন পিকলুর সুস্থ হওয়ার লক্ষণ রমার সামনে দিন দিন ফুটে উঠছে। পীযুষ তো সে খবর পায় না। নেটওয়ার্কহীন এই সুন্দরবনের নদীগাঁয়ে টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা বড্ড খারাপ। সরবেড়িয়া হাটের দিকে গেলে নাকি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
রমা পীযুষের জন্য চা করে এনে বললে---খেয়েছো কিছু?
পীযুষ ছেলের থেকে মুখ ফেরালো স্ত্রীয়ের দিকে। বললে---চাঁপা পরোটা তরকারি করে দিয়েছিল।
রমা ঘুরে পড়তেই পীযুষ পুনরায় বলল---কোথায় যাচ্ছো?
---ব্রাশ করিনি গো এখনো।
পীযুষ ঘুমন্ত ছেলেকে একবার দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রমার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো ওর দিকে। বললে---বেশ রোগা হয়ে গেছ রমা।
----ধ্যাৎ! মনের ভুল তোমার।
পীযুষ লক্ষ্য করল রমার হাতে শাঁখা-পোলা। দাম্পত্য জীবনে রমা কেবল সোনার দুটি সরু বালা দু'হাতে পরে থাকে, বিবাহের চিহ্ন হিসেবে একটি মাত্র লাল পোলা। যেটা নিয়েও পীযুষের বিরোধ আছে, এসব মানার কোনো যৌক্তিকতা নেই। হয়ত রমা পীযুষের মত নাস্তিক না হলেও, অতটা লৌকিকতাও মানে না। স্বামীর জন্য এই লাল পোলাটা পরতে তার ভালোই লাগে। এখন পোলার সাথে সদ্য কেনা সস্তার সাদা শাঁখা। এ যে তার স্ত্রীর নকল বিবাহের চিহ্ন তা বুঝতে বাকি নেই। রমা পীযুষের নজর এড়ায়নি, ও বললে---গ্রামের লোকেরা যাতে সন্দেহ না করে পরে থাকতে হয়।
পীযুষ রমার দিকে তাকালো। রমা তার স্বামীর এই চাহুনি চেনে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা রমার আধোয়া মুখ চেপে ধরল পীযুষ নিজের ওষ্ঠের সাথে। পীযুষের মুখেও সিগারেটের গন্ধ। কয়েক মাসের দূরত্বে সাত সকালের এই মিলনে দুজনেই আবেগতাড়িত ঘন চুম্বনে আবদ্ধ হল। রমাও অভুক্ত, পীযুষ তার চেয়েও বেশি যেন। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে স্ত্রীকে। এখুনি তার রমাকে চাই।
ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট, জিভের ঠোকাঠুকি আর মুখ ধোয়া এবং পুরুষালী ধূমপায়ী মুখের ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে। রমা শান্ত করল পীযুষকে। পীযুষ অবশ্য ততক্ষণে মুখ নামিয়ে রমার ঘরোয়া তাঁত শাড়ির আঁচল ঢাকা বুকে মুখ গুঁজে ওম নিচ্ছে। শিশুর মত মাতৃ স্নেহে স্বামীর চুলে বিলি কেটে আদর দিতে লাগলো রমা। বললে---পিকলু আছে, এখন নয়। ভারী মন খারাপ না গো তোমার?
পীযুষ মুখ তুলে তার চোখের চশমা ঠিক করে তাকালো। বললে---বড্ড একা লাগে। কলেজ থেকে ফিরলে তুমি, পিকলু কেউ নেই...এখন যেন রুটিন একঘেয়েমি।
রমারও চোখটা ছলছল করে উঠল। পীযুষের জামার বোতামে খুঁটখাঁট করতে করতে আবদারী সুরে বললে---আজ থেকে যেতে পারো তো।
---এখানে এইটুকু ঘরে?
---কেন নয়? আমরা আছি কি করে?
গাড়িটা দেখে ষষ্ঠী বুঝতে পারলো স্যার এসেছেন। ওকে দেখে পীযুষ বললে---ষষ্ঠীপদ, বলো কেমন আছো?
ষষ্ঠীপদ আনুগত্য দেখিয়ে বললে---ভালো আছি সার। ছিলাটাকে দেইখলেন, কত ভালো হইগেছে লা?
পীযুষ তখন পিকলুর সাথেই বসেছিল বিছানার ওপরে। পিকলু বললে---ষষ্ঠী আঙ্কেল কালকে কি শম্ভু আঙ্কেলকে কেউ ডাকতে এসেছিল?
---হুম্ম, বাবু। সাপে কাইটছে '. পাড়ার গোলাম আলির ব্যাটাটারে।
---তাকেও কি আমার মত স্পেক্টাকল্ড কোবরা কামড়েছে?
ষষ্ঠী ইংরেজি না বুঝলেও পিকলুর কথার জবাবে বললে---সে এখুনো জাইনি লা বাবু। তবে বিষধরটা মনে হয়।
পীযুষ বলল---তোর কি মনে আছে পিকলু তোকে যে সাপটা কামড়েছিল কেমন দেখতে?
---হুম্ম মনে আছে বাবা?
---তুই জানলিস কি করে ওটার নাম স্পেক্টাকল্ড কোবরা?
----মা বলছিল ষষ্ঠী কাকু যে স্পেক্টাকল্ড কোবরাটা তোমার ল্যাবে দিয়েছিল আমাকে ওটাই কামড়েছে।
ষষ্ঠী তৎক্ষনাৎ জিভ কেটে বললে---খবরদার বাবু, শম্ভুর কানে একথা তুইলবে লাই। সাংঘাতিক হবে তালে।
রমা বলল---কেন বলতো ষষ্ঠী? ওটাই কি শম্ভুর ঐ পোষা পদ্ম?
---দিদিমণি, ঠিক ধইরেছেন। শম্ভু উটারে বড্ড ভালোবাইসতো। জানতি পাইরলে আমারে আস্ত রাইখবে লাই।
রমা বললে---ওটা একটা বদ সাপ ছিল।
পীযুষ হেসে বললে---সাপের কি দোষ। ওরা আবার ভালো-বদ হয় নাকি!
---তুমি আরো বলছ? আমার ছেলেটাকে... এত সাপ তো রেখেছো, কেউ তো কোনোদিন এমন করল না। আমি ওকে মেরে ফেলেছি, ঠিক করেছি।
ষষ্ঠী তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠল আবার---সব্বনাশ! দিদিমণি কখুনো শম্ভুরে বইলবেন লাই, যে আপনি উটারে মাইরে ফেলছেন! বড় বিপদ হই যাবে। চিকিচ্ছাটা কইরতে দেন উরে। বড্ড মাথা গরম জোয়ান আছে, জেদ চাইপলে কি করে কে জানে...!
রমাও খানিক ভয় পেল। বললে---এই পিকলু তুইও কখনো শম্ভু আঙ্কেলকে বলবি না। যা শুনলি তা তো আবার তোর পেটে থাকে না।
পীযুষ বললে---ষষ্ঠীপদ, এসব কথা থাক। আজ ভাবছি তোমাদের এখানটা থেকেই যাবো। ভালো নোনা মাছের বাজার হয় এখানে শুনেছি।
---সত্যি! সার আজ থিকে যাবেন? ষষ্ঠী আনন্দৎসাহিত হয়ে পুনরায় বললে----সার আমি এখুনি বাজার যাবো। সেখান থিকা ভালো মাছ আইনবো।
---এনো, তার আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাও।
ষষ্ঠী দেখলে অদূরে তার স্ত্রী লতা দাঁড়িয়ে আছে উঠোন লাগোয়া। ঘরের ভিতরের কথোপকথন সে শুনছিল কি এক তীব্র কৌতুহলে। ষষ্ঠীপদ এত বছর পরেও তার বউটাকে ঠিক বুঝতে পারে না। সংসারের সব কাজ, ষষ্ঠীর স্বামী সেবাটুকুতেও খামতি নেই। তবু তার সাথে দু একটা ভালোমন্দ যেমন স্বামী-স্ত্রীয়ে কথা হয়, বলতে পারে না। লতার যেন কোনো আগ্রহই নেই ষষ্ঠীর প্রতি। সে যে অন্য পুরুষে ভেতরে ভেতরে মজে আছে, তা'ও ষষ্ঠী ভালোমত জানে। সে লতার কৌতুহলকে তাচ্ছিল্য করে আদেশের সুরে বলল---আজ সার ইখানে থাইকবেন, দিদিমণিরে রান্নায় সাহায্য কইরবি যা।
শম্ভু গিয়েছিল গোলাম আলির ঘরে। দাওয়ায় ছেলেটা দিব্যি বসে রয়েছে। এই যা চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে কামড় দিয়েছে কিছু একটা।