16-12-2023, 11:55 AM
<×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×>
অশনি সংকেত
<×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×>
কালী বাঁড়ুজ্জের বয়স বেশি না হলেও, গ্রামের আপামর জনসাধারণের কাছে ঠাকুর মশাই বলেই পরিচিত। নাম ধরে ডাকার মত গুটিকতক লোক এই গ্রামে আছেন। শয্যাশায়ী মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কালিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে কালী বাঁড়ুজ্জে। মাটিতে মাথা থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলো নরেন ঘটক,
- - বৌঠানের সন্ধান পেয়েছি ঠাকুর মশাই। পাশের গ্রামেই বাড়ি। তবে কিনা পুজুরি বামুনের মেয়ে, ভঙ্গ কুলীন। এখন আপনি বিচার করুন কি করবেন? হাতের কাছে ঘর গৃহস্তি চালাবার মত মেয়ে আর পাচ্ছিনা!
- - মেয়ের বয়স কত ঘর গেরস্থির কাজ পারে তো?
- - তা নিয্যস পারে ঠাকুর মশাই। মায়ের কোলে এট্টা ডেড় বছরের ছ্যানা। ওই মেয়েই টেনে যাচ্ছে সবাইকে। তবে পুজোরি বামুনের মেয়ে দেয়া-থোওয়া কিছু নেই ঠাকুর মশাই। এখন আপনি দয়া করলে সব হয়।
- - সেতো আগেই বলেছি, শাঁখা সিঁদুর দিয়ে মেয়ে তুলব আমি।
<><><><><><><><>
মঙ্গলের ঊষা বুধে পা; সেই বুধবারেই নমোনমো করে বিয়ে হয়ে গেল কালি বাঁড়ুজ্জ্যের। বৃহস্পতিবার সস্ত্রীক বাড়ি ঢুকলেন কালিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। মা শয্যাশায়ী, চলৎ শক্তিহীন। পাড়ার গৃহিনীরাই, বধূবরণ করে ঘরে তুললেন নববধূকে। বউ নিয়ে মায়ের ঘরে গেল কালিপ্রসাদ, মায়ের আশীর্বাদ নিতে। রোগাতুর মা বললেন,
- - কি আর বলবো বাছা, তোমার সংসার, তুমি নিজেই একটু কষ্ট করে বুঝে নাও। আমি তো চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় পড়ে আছি; নিজের মত একটু গুছিয়ে সংসার করো মা। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে, কালিকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলে দেবো।
সেদিন কালরাত্রি মায়ের ঘরেই ঠাঁই হলো নবোঢ়া পুত্রবধূর। পরদিন ফুলশয্যা। পাড়ার মেয়ে বউরাই সমস্ত আয়োজন করে দিলো। কিন্তু সংসারের সমস্ত কাজ, নতুন বউকেই করতে হলো।
রাতের বেলা, ফুল দিয়ে সুসজ্জিত ঘরে, প্রবেশ করলেন কালীপ্রসাদ। নবোঢ়া বধূ বিছানায় বসে আছে। নিজের পোষাক পরিবর্তন করে বিছানায় এসে বসলেন কালীপ্রসাদ। নতুন বউকে বললেন,
- - সারাদিনে অনেক খাটাখাটনি গেছে। আজ আর কিছু করতে হবে না। এই ভারী জামাকাপড়গুলো, ছেড়ে এসে শুয়ে পড়ো। কাল থেকে পুরোদস্তুর সংসার করতে হবে। তোমার সঙ্গে আলাপ তো হতেই থাকবে।
চোখ বন্ধ করে, নিদ্রা দেবীর আরাধনা করতে থাকেন।
মাঝরাতে, শরীরের একটা দম বন্ধ করা অনুভূতি। অস্থির লাগছে। কে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেল কালীপ্রসাদের। বুকের উপর একটা নারী দেহ।
হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন কালীপ্রসাদ। তাকিয়ে দেখবেন নবোঢ়া বধু, আলুথালু পোষাকে; শরীরে শরীর ঘষছে।
ফিসফিস করে যেন কথা বলছে। অধীর আগ্রহে, অনেক্ক্ষণ পরে, বুঝতে পারলেন কালীপ্রসাদ। নববধূ, তার বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে, নিজের ভাইকে খোঁজার চেষ্টা করছে।
স্তম্ভিত কালীপ্রসাদ; মেরুদন্ড সোজা করে উঠে বসলেন বিছানায়।
নববধূকে ডেকে বললেন, "যাও, মুখেচোখে জল দিয়ে এসো। শয্যামধ্যে পদ্মাসনে বসলেন নবীন কালীসাধক। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গা চোখে নতুন বউ; কিছু না বুঝেই, মুখেচোখে জল দিয়ে এসে দাঁড়ালেন বিছানার সামনে। কালি প্রসাদ বললেন, জল খেয়ে উঠে বোসো বিছানায়। তোমার সঙ্গে আলাপ করি। জল খেয়ে, জায়গা মতো গ্লাস রেখে, বিছানায় উঠে বসলো নতুন বউ।
সাংসারিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে শুরু হলো; সত্য অনুসন্ধানের প্রয়াস।
- - তোমাদের বাড়িতে ক'জন লোক?
- - মা, বাবা আর দুই ভাই। এই চারজন। আমি তো চলে এলাম।
- - তোমাদের কটা ঘর?
- - দুটো, একটা দোচালা, আমি আর ভাই থাকি। আরেকটা বড় চার চালা ঘর। বাবা থাকেন চৌকিতে। মা মাটিতে বিছানা করে ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে। পাশেই রান্না করার জন্য ছোট একটা একচালা ঘর আছে।
- - তোমার ভাই তোমার চেয়ে কত ছোট?
- - ছুটকু আমার চেয়ে দু বছরের ছোট; আর পুচকু এই সবে দেড় বছর হল।
- - তোমার বাবার জন্যে তো রাতে চৌকিতে বিছানা হয়। তোমাদের ঘরে কি চৌকি আছে?
- - না আমাদের একটাই চৌকি; আমি আর ভাই, মাটিতে বিছানা করে একসঙ্গে শুয়ে পড়ি। … সাংসারিক জ্ঞানহীন বালিকার, নিঃশঙ্ক উত্তর,
- - তুমি বাড়ির বাইরে যাও কখনো?
- - না, আগে যেতাম। এখন আর বাড়ির বাইরে যাবার সময় পাইনা। মা তো পুচকুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সংসারের যাবতীয় কাজ, আমাকেই করতে হয়।
- - বাড়ির বাইরের কেউ আসে তোমার বাড়িতে?
- - আমাদের মত গরিবের সংসারে কে আসবে?
- - না তাই জিজ্ঞেস করলাম।
- - ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়ো। এখনো রাত আছে। আমার জপ করবার সময় হয়ে গেছে। আমি মন্দিরে গেলাম।
মাতৃমূর্তির সামনে পদ্মাসনে বসলেন কালিকাপ্রসাদ। ঠোঁটের কম্পন দেখে বোঝা গেল না; জপ করছেন নাকি ঈশ্বরের কাছে নিজের অভিযোগের বার্তা নিবেদন করছেন।
নিঃশব্দ সময়, গড়িয়ে যেতে লাগলো। একসময় সকাল হয়ে গেল। নিজের মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন কালিকাপ্রসাদ। নিজের সন্দেহের কথা মাকে জানালেন। ধৈর্য্য ধরে সব শুনলেন। তারপর বললেন,
- - শোন বাবা কালি, সংসারের এখন যা অবস্থা, একজন লোক না হলে চলবে না। আর, সন্দেহের বশে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ভুল তুমি করবে না; সেটা আমি জানি। অষ্টমঙ্গলার আগে, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার সু্যোগও নেই। আর জোড় না ভেঙে, গুরুদেবের আশ্রমেও যেতে পারবে না। কারণ, যেতে আসতে দু'দিন। অষ্টমঙ্গলার আগে যেতে পারবে না। … একটু থেমে আবার বললেন,
- - তার চেয়ে বধূমাতাকে বল, ফুলশয্যার পরদিন থেকে, তোমার ব্রত আছে। তুমি বধূমাতার সাথে এক শয্যায় শয়ন করবে না। অষ্টমঙ্গলের পরেই সেটা হতে পারবে। এবার জোড় ভাঙতে তেরাত্তির শশুর বাড়িতে কাটাতে হয়; শশুর-শাশুড়ি থেকে সব বুঝে নিয়ে, তুমি দু'রাত্তিরের জন্য, গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাবে। … একটু থামলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,
- - এরপর গুরুদেবের আদেশ, আর তোমার বিবেচনা; যেটা ঠিক হয়, তাই করবে। আপাতত লোক জানাজানি করে কোন লাভ নেই। বৌমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও; আমি দেখি, তুমি যেটা সন্দেহ করছ, সেটা কতটা সত্যি।