21-11-2023, 09:40 AM
উঠানে শুয়ে থাকা তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেটার মুখ দেখে মায়া হল শম্ভুর। গা'টার রঙ তার মায়ের মত ফর্সা। পায়ের দংশন স্থানকে দূর থেকে দেখে রোগীর কাছে আসতে না আসতেই বললে---দিখে তো মনে হয় গোখরো কাইটছে।
তারপর শম্ভু পিকলুর মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। একবার মা মনসার নাম করে কপালে হাত ছোঁয়ালো। এ তার বাপ-দাদার বেদে সংস্কৃতি। ঠিক ডাক্তারের কায়দায় বুকের কাছে হাত ঠেকিয়ে, হাতের পালস টিপে দেখল শম্ভু। জীবন আছে। ক্ষত স্থানে একটা ছোট ফলের মত কিছু ঘষতে লাগলো খানিক। সাদা হয়ে গেল জায়গাটা। তারপর রমার দিকে তাকিয়ে মুখের মধ্যে একরাশ হতভম্বতা এনে বললে---মনে হইল তিনবার কামড় দিছে। ঘরে সাপ ঢুকলো কি কইরে দিদিমণি? কলকাতা শহুরে তো বিষাক্ত সাপ থাইকবার কথা লয়।
ষষ্ঠী বললে---আমি যে কলকাতা শহুরে মাস্টার বাবুটারে সাপ বিক্রি করি; তার কাছে সাপটা ছিল। কাচের বাক্সটা হতে বার হছে কখন, কেউ বুঝতে পারে লাই।
তবে শম্ভুর মুখে গাম্ভীর্য দেখে ষষ্ঠী বুঝতে পারছে কিছু একটা সমস্যা আছে। শম্ভু বেদে তার আশৈশব বন্ধু, কত সাপে কাটা রুগী সে দেখেছে, শম্ভুর এমন চিন্তিত আর গম্ভীর মুখ কখনো দেখেনি সে। সচরাচর শম্ভু খুব তাচ্ছিল্যের সাথে রুগী দ্যাখে, যেন সাপে কাটা রুগী সারানো তার কাছে নস্যি। সেই শম্ভুই এমন কপাল কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছে ক্ষতস্থান। ফলত ষষ্ঠীপদও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল---কি কস শম্ভু?
শম্ভু ঈষৎ চিন্তিত। গম্ভীর হয়ে রয়েছে তার মুখ। বড্ড ভারী উষ্ণ গলায় বললে---পচুর বিষ ঢাইলছে দিদিমণি। কি কইরে হল, এ তো সাধারণ ব্যাপারটা আছে লাই। সাপটার শিকার লা হলে এ কামড় দেয় লাই।
কি আশ্চর্য! রমার বিস্ময় বাড়ছে। ডাক্তাররা যেখানে দীর্ঘ চিকিৎসার পর যেসব কিছু রিপোর্ট করেছে, এ গেঁয়ো বেদে এক লহমায় সে সব বলে দিচ্ছে! রমা বললে---আমরাও তো সেটা বুঝতে পারছি না ভাই। ডাক্তাররাও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না।
ষষ্ঠীর দিকে তাকালো এবার শম্ভু। জিজ্ঞেস করল---বাবুর ঘরে তুই দিছিস সাপটারে লিশ্চয়? কুত্থেকে পেলি?
ষষ্ঠী বুঝল পদ্মের কথাটা ধরা পড়ে যেতে পারে। মোটেই এখুনি বলা যাবে না। সাংঘাতিক হয়ে যাবে। সে তাই বলল---হ' দিছি। সিটা ধইরেছিলাম মাতলার পাড়ে বাদাবন হতে। বড় ছিল কিনা।
শম্ভু বলল---বড় হলেই বিষ ঢাইলবে বেশি; কুথাটা ঠিক লয়। এ ঘটনা আমি আমার জেবনে একবারই দিখছি।
শম্ভুর মনে পড়ল তার তখন সাত-আট বছর বয়স। বাঁকুড়া থেকে এক সাপে কাটা আদিবাসী ছেলেকে আনা হয়েছিল তার ঘরে। এতদূর থেকে রোগী এসেছে ঘরে! তার বাপ ভীমনাগ বেদেও বিশ্বাস করতে পারেনি। কোনো না কোনো ভাবে খবর পেয়েছিল তারা। তা নাহলে ভীমনাগ যতই সাপে কাটায় চিকিৎসা করতে পারদর্শী হোক, দু-তিন গ্রাম লোক ছাড়া কেউ তাকে তেমন চেনে না। হয়ত লোকমুখে খবর ছড়িয়ে আরো কিছু দূরবর্তী জায়গা থেকে রুগী আসতো, যেমন বসিরহাট কিংবা ভাঙড় থেকেও রুগী এসেছে দু একবার। সেভাবেই এ অঞ্চলের কেউ পরিচিতি থাকায় বাঁকুড়া থেকে এসেছে! ভীমনাগ বিস্মিত হয়েছিল সেদিন। পরে অবশ্য ভীমনাগ বেদে বুঝেছিল সে রোগী আসার কারণ আছে। শম্ভুর মনে আছে সে রোগীর জ্ঞান ছিল না। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল। ছ' মাস তার বাড়িতে ফেলে রেখে চিকিৎসা করেছিল তার বাপ ভীমনাগ বেদে। শম্ভু তার বাপকে অত দরদ নিয়ে কখনো চিকিৎসা করতে দেখেনি কোনোদিন। জিজ্ঞেস করতে বাপ তাকে বলেছিল, 'মানুষটা সাপের শিকার লা রে শম্ভু, মানুষরে ভয় পায়ে সাপ কামড়ায়, কিন্তু ভুল কইরে যদি সাপটা মানুষটারে শিকার ভেবে লেয়, তারে মারাত্বক বিষ ঢালে, এর চিকিচ্ছা হাজারে একটা হয় রে শম্ভু; শিখে রাখ, লাইগতে পারে।'
বাপের সাথে প্রতিদিন নদীর চরে গিয়ে, সুন্দরী-গরান জঙ্গলে গিয়ে জড়ি বুটি, শিকড়-বাকড় সব সংগ্রহ করত সে। রাতে কাছ থেকে দেখত বাপ কিভাবে চিকিৎসা করে। বাপ যখন গেল, তারপর থেকে শম্ভু দশ-বারো বছর একাই বিশ-পঁচিশটা রুগীকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু কোনোদিন সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেনি।
শম্ভু লুঙ্গির গাঁট খুলে একটা বিড়ি ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরল। ষষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বললে---আগুনটা দে দিখি।
ষষ্ঠী লাইটার এগিয়ে দিল শম্ভুর দিকে। শম্ভু বিড়ি ধরিয়ে বললে---দিদিমণি জ্ঞান ফিরাইতে আজ রাইতটা রয়ে যাতে হবে। আমারে এখুন বার হতে হবে জঙ্গলটায়, ওষুধ পত্তর তৈরি কইরতে হবে।
রমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সরলার মুখে আনন্দচ্ছল হাসি। যদিও বা জ্ঞান ফিরবে আদৌ কিনা রমা এখনো সন্দিহান, তবু এই প্রথমবার কেউ তাকে ভরসা দিল পিকলুর জ্ঞান ফিরতে পারে।
ষষ্ঠী বলল---দিদিমণি, তা হইলে আজ রাইতটা জালি ঘরে দুটা খেয়ে লিবেন। কাঁসার ভালো থালা বাটিরে দিব।
সরলা প্রতিবাদ করে বললে---দিদিমণি বামুন ঘরেরটা আছে, তুই তারে খাওয়াইবি?
ষষ্ঠীর মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। রমা মৃদু হেসে বলল---না না, ভাই আমি জাত-পাত মানি না। তবে রাতে আর ভাত খাবো না। কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে আছে খেয়ে নেব। আমার ছেলেটাকে তোমরা বাঁচাও, শুধু এটুকু প্রার্থনা তোমাদের কাছে।
---সে ক্ষমতা তো শুধু শম্ভুটার আছে দিদিমণি। সে যতক্ষুন আছে কিছু তো একটা হবে। কি কস শম্ভু।
শম্ভু অবশ্য কিছু একটা ভাবছে। আর জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে আপন মনে। সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রমা দেখতে পাচ্ছে শেষ বিকেলের গোধূলি আভায় ওর এলোমেলো চুল দাড়িতে ভর্তি কুচকুচে কালো কঠোর মুখটা বিষন্ন ভাবুক। হাতের পেশল শরীরে শিরা উপশিরা টানটান। চাবুকের মত শরীরে যেন পরতে পরতে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা। কিছুক্ষন থেমে শম্ভু বললে---দিদিমণি, বাটনাটা বাইটতে পারেন?
বাটনা! মানে শিল-নোড়া! রমা কখনো বাটনা বাটেনি। ওসব তার বাপের বাড়িতে মাকে দেখেছে। রান্নার জন্য মিক্সি মেশিনে মশলা করে নেয় রমা। এমনকি চাঁপাও আজকালকার মেয়ে, বাটন বাটা ওর দ্বারাও হয় না। সরলা বরং বললে---দিদিমনি পারবে নাই। আমি বাইটে দিব। বল কি কইরতে হবে।
শম্ভু একটা ঝুলি খুলে কিছু শকুনো কাঠের টুকরো, শিকড় আর শুকনো হরিতকীর মত দেখতে কিছু ফল মাটিতে ঢেলে দিল। তারপর বললে---এগুলা তেল দিয়া বাইটতে হবে। তবে সরিষার তেল দিয়া লয়।
একটা শিশিতে করে কিছু সবুজ তেল রাখা। ঐটা শিলে ঢেলে দিল শম্ভু। বললে---মাসি, দের লা কইরে কাজ শুরু কইরে দেন।
সারা সন্ধে এমনই নিস্তব্ধ অরণ্যশঙ্কুল নদীতীরের মাটির দোচালা ঘরে পিকলুর শুশ্রূষা নিয়ে কাটলো রমার। আসলে রমার নয়, রমা শুধু বিষন্ন মুখে দেখতে লাগলো শম্ভুর নানা চিকিৎসা পদ্ধতি। রমা জানে না আসলেই কোনো বুজরুকী কিনা, তবে শম্ভুর তৎপরতায় সে দেখতে পাচ্ছে, যদিও এটি বুজরুকী হয়, তবে সেই বুজরুকীতে শম্ভুর গভীর বিশ্বাস রয়েছে। রমা আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করল, এ পর্যন্ত বেদেটি কোনো মন্ত্রচ্চারণ, জলপোড়া, তাবিজ-কবচ এসব কিছুই করেনি।
পিকলুর হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়ে ওই আঠালো সবুজ বাটনটা লাগিয়ে দিয়েছে শম্ভু। তার ওপর কিছু পাতা চাপিয়ে একটা ময়লা পাতলা কাপড় দিয়ে মৃদু করে বেঁধে দিয়েছে। ঠিক কামড়ের দাগ তিনটির মধ্যবর্তী স্থানে তিনটে সূচ গাঁথা। তার সাথে অনবরত পিকলুর বুকে তেল মালিশ করছে শম্ভু। ওর শক্ত দীর্ঘ হাতের থাবায় পিকলুর নরম বুকের পাঁজর দেখা যাচ্ছে। রাত্রি ন'টা পর্যন্ত একই ভাবেই শম্ভু রয়ে গেল পিকলুর চিকিৎসায়। মাঝে রমাকে বললে---দিদিমণি, কিছু খাবার হলে খেয়েলেন। ঘুম পাইলে ঘুমিয়েটা লিবেন ইখানটা। দো চালায় আমার সাপঘরটা আছে। সিখানটা আমি শুয়ে পইড়বো।
খেতে তো ইচ্ছে নেই রমার। তবু পেটের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে। সেই সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। শুকনো কিছু স্নাক্স সরলা মাসির সাথে ভাগ করে খেলো ও। পীযুষকে ফোন করে সবটা জানাতে চেয়েছিল রমা। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক বলে কিছু নেই। সুন্দরবনের এক অচেনা আদিম অরণ্য যেন। গ্রীষ্মের দিন হলেও রাতে ফুরফুরে নদীর বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। ছোট তক্তাপোষের মত খাটে পিকলুকে মাঝে রেখে সরলা মাসি আর রমা ঘুমিয়ে পড়ল রাত্রি এগারোটা নাগাদ। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তেই ওদের সকলের চোখে ঘুম এসে গেছে।
পীযুষের অবশ্য ঘুম আসছে না। রমা একা একা ছেলেটাকে নিয়ে বাইরে আছে। ষষ্ঠীর ফোন নম্বরটা ছিল। আসলে পীযুষের অভ্যাস জরুরী নম্বর না হলে সেভ করে না। ষষ্ঠী তার মত করে যখন ইচ্ছে হত সাপ দিয়ে গেছে। পীযুষ বাড়ি না থাকলে ফিরে গেছে। ফলত নম্বরটা একটা কাগজের টুকরোতে লিখে গেছিল ষষ্ঠীপদ। সে কাগজের টুকরো আদৌ গচ্ছিত আছে কিনা তাও মনে নেই পীযুষের। ভোরবেলা ও নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরোবে। দেউলবাড়ি জায়গাটা যেহেতু গুগল মানচিত্রে দেখাচ্ছে। সেখানে গেলেই নিশ্চই একটা সুরাহা হবে।
++++++
তারপর শম্ভু পিকলুর মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। একবার মা মনসার নাম করে কপালে হাত ছোঁয়ালো। এ তার বাপ-দাদার বেদে সংস্কৃতি। ঠিক ডাক্তারের কায়দায় বুকের কাছে হাত ঠেকিয়ে, হাতের পালস টিপে দেখল শম্ভু। জীবন আছে। ক্ষত স্থানে একটা ছোট ফলের মত কিছু ঘষতে লাগলো খানিক। সাদা হয়ে গেল জায়গাটা। তারপর রমার দিকে তাকিয়ে মুখের মধ্যে একরাশ হতভম্বতা এনে বললে---মনে হইল তিনবার কামড় দিছে। ঘরে সাপ ঢুকলো কি কইরে দিদিমণি? কলকাতা শহুরে তো বিষাক্ত সাপ থাইকবার কথা লয়।
ষষ্ঠী বললে---আমি যে কলকাতা শহুরে মাস্টার বাবুটারে সাপ বিক্রি করি; তার কাছে সাপটা ছিল। কাচের বাক্সটা হতে বার হছে কখন, কেউ বুঝতে পারে লাই।
তবে শম্ভুর মুখে গাম্ভীর্য দেখে ষষ্ঠী বুঝতে পারছে কিছু একটা সমস্যা আছে। শম্ভু বেদে তার আশৈশব বন্ধু, কত সাপে কাটা রুগী সে দেখেছে, শম্ভুর এমন চিন্তিত আর গম্ভীর মুখ কখনো দেখেনি সে। সচরাচর শম্ভু খুব তাচ্ছিল্যের সাথে রুগী দ্যাখে, যেন সাপে কাটা রুগী সারানো তার কাছে নস্যি। সেই শম্ভুই এমন কপাল কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছে ক্ষতস্থান। ফলত ষষ্ঠীপদও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল---কি কস শম্ভু?
শম্ভু ঈষৎ চিন্তিত। গম্ভীর হয়ে রয়েছে তার মুখ। বড্ড ভারী উষ্ণ গলায় বললে---পচুর বিষ ঢাইলছে দিদিমণি। কি কইরে হল, এ তো সাধারণ ব্যাপারটা আছে লাই। সাপটার শিকার লা হলে এ কামড় দেয় লাই।
কি আশ্চর্য! রমার বিস্ময় বাড়ছে। ডাক্তাররা যেখানে দীর্ঘ চিকিৎসার পর যেসব কিছু রিপোর্ট করেছে, এ গেঁয়ো বেদে এক লহমায় সে সব বলে দিচ্ছে! রমা বললে---আমরাও তো সেটা বুঝতে পারছি না ভাই। ডাক্তাররাও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না।
ষষ্ঠীর দিকে তাকালো এবার শম্ভু। জিজ্ঞেস করল---বাবুর ঘরে তুই দিছিস সাপটারে লিশ্চয়? কুত্থেকে পেলি?
ষষ্ঠী বুঝল পদ্মের কথাটা ধরা পড়ে যেতে পারে। মোটেই এখুনি বলা যাবে না। সাংঘাতিক হয়ে যাবে। সে তাই বলল---হ' দিছি। সিটা ধইরেছিলাম মাতলার পাড়ে বাদাবন হতে। বড় ছিল কিনা।
শম্ভু বলল---বড় হলেই বিষ ঢাইলবে বেশি; কুথাটা ঠিক লয়। এ ঘটনা আমি আমার জেবনে একবারই দিখছি।
শম্ভুর মনে পড়ল তার তখন সাত-আট বছর বয়স। বাঁকুড়া থেকে এক সাপে কাটা আদিবাসী ছেলেকে আনা হয়েছিল তার ঘরে। এতদূর থেকে রোগী এসেছে ঘরে! তার বাপ ভীমনাগ বেদেও বিশ্বাস করতে পারেনি। কোনো না কোনো ভাবে খবর পেয়েছিল তারা। তা নাহলে ভীমনাগ যতই সাপে কাটায় চিকিৎসা করতে পারদর্শী হোক, দু-তিন গ্রাম লোক ছাড়া কেউ তাকে তেমন চেনে না। হয়ত লোকমুখে খবর ছড়িয়ে আরো কিছু দূরবর্তী জায়গা থেকে রুগী আসতো, যেমন বসিরহাট কিংবা ভাঙড় থেকেও রুগী এসেছে দু একবার। সেভাবেই এ অঞ্চলের কেউ পরিচিতি থাকায় বাঁকুড়া থেকে এসেছে! ভীমনাগ বিস্মিত হয়েছিল সেদিন। পরে অবশ্য ভীমনাগ বেদে বুঝেছিল সে রোগী আসার কারণ আছে। শম্ভুর মনে আছে সে রোগীর জ্ঞান ছিল না। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল। ছ' মাস তার বাড়িতে ফেলে রেখে চিকিৎসা করেছিল তার বাপ ভীমনাগ বেদে। শম্ভু তার বাপকে অত দরদ নিয়ে কখনো চিকিৎসা করতে দেখেনি কোনোদিন। জিজ্ঞেস করতে বাপ তাকে বলেছিল, 'মানুষটা সাপের শিকার লা রে শম্ভু, মানুষরে ভয় পায়ে সাপ কামড়ায়, কিন্তু ভুল কইরে যদি সাপটা মানুষটারে শিকার ভেবে লেয়, তারে মারাত্বক বিষ ঢালে, এর চিকিচ্ছা হাজারে একটা হয় রে শম্ভু; শিখে রাখ, লাইগতে পারে।'
বাপের সাথে প্রতিদিন নদীর চরে গিয়ে, সুন্দরী-গরান জঙ্গলে গিয়ে জড়ি বুটি, শিকড়-বাকড় সব সংগ্রহ করত সে। রাতে কাছ থেকে দেখত বাপ কিভাবে চিকিৎসা করে। বাপ যখন গেল, তারপর থেকে শম্ভু দশ-বারো বছর একাই বিশ-পঁচিশটা রুগীকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু কোনোদিন সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেনি।
শম্ভু লুঙ্গির গাঁট খুলে একটা বিড়ি ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরল। ষষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বললে---আগুনটা দে দিখি।
ষষ্ঠী লাইটার এগিয়ে দিল শম্ভুর দিকে। শম্ভু বিড়ি ধরিয়ে বললে---দিদিমণি জ্ঞান ফিরাইতে আজ রাইতটা রয়ে যাতে হবে। আমারে এখুন বার হতে হবে জঙ্গলটায়, ওষুধ পত্তর তৈরি কইরতে হবে।
রমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সরলার মুখে আনন্দচ্ছল হাসি। যদিও বা জ্ঞান ফিরবে আদৌ কিনা রমা এখনো সন্দিহান, তবু এই প্রথমবার কেউ তাকে ভরসা দিল পিকলুর জ্ঞান ফিরতে পারে।
ষষ্ঠী বলল---দিদিমণি, তা হইলে আজ রাইতটা জালি ঘরে দুটা খেয়ে লিবেন। কাঁসার ভালো থালা বাটিরে দিব।
সরলা প্রতিবাদ করে বললে---দিদিমণি বামুন ঘরেরটা আছে, তুই তারে খাওয়াইবি?
ষষ্ঠীর মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। রমা মৃদু হেসে বলল---না না, ভাই আমি জাত-পাত মানি না। তবে রাতে আর ভাত খাবো না। কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে আছে খেয়ে নেব। আমার ছেলেটাকে তোমরা বাঁচাও, শুধু এটুকু প্রার্থনা তোমাদের কাছে।
---সে ক্ষমতা তো শুধু শম্ভুটার আছে দিদিমণি। সে যতক্ষুন আছে কিছু তো একটা হবে। কি কস শম্ভু।
শম্ভু অবশ্য কিছু একটা ভাবছে। আর জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে আপন মনে। সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রমা দেখতে পাচ্ছে শেষ বিকেলের গোধূলি আভায় ওর এলোমেলো চুল দাড়িতে ভর্তি কুচকুচে কালো কঠোর মুখটা বিষন্ন ভাবুক। হাতের পেশল শরীরে শিরা উপশিরা টানটান। চাবুকের মত শরীরে যেন পরতে পরতে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা। কিছুক্ষন থেমে শম্ভু বললে---দিদিমণি, বাটনাটা বাইটতে পারেন?
বাটনা! মানে শিল-নোড়া! রমা কখনো বাটনা বাটেনি। ওসব তার বাপের বাড়িতে মাকে দেখেছে। রান্নার জন্য মিক্সি মেশিনে মশলা করে নেয় রমা। এমনকি চাঁপাও আজকালকার মেয়ে, বাটন বাটা ওর দ্বারাও হয় না। সরলা বরং বললে---দিদিমনি পারবে নাই। আমি বাইটে দিব। বল কি কইরতে হবে।
শম্ভু একটা ঝুলি খুলে কিছু শকুনো কাঠের টুকরো, শিকড় আর শুকনো হরিতকীর মত দেখতে কিছু ফল মাটিতে ঢেলে দিল। তারপর বললে---এগুলা তেল দিয়া বাইটতে হবে। তবে সরিষার তেল দিয়া লয়।
একটা শিশিতে করে কিছু সবুজ তেল রাখা। ঐটা শিলে ঢেলে দিল শম্ভু। বললে---মাসি, দের লা কইরে কাজ শুরু কইরে দেন।
সারা সন্ধে এমনই নিস্তব্ধ অরণ্যশঙ্কুল নদীতীরের মাটির দোচালা ঘরে পিকলুর শুশ্রূষা নিয়ে কাটলো রমার। আসলে রমার নয়, রমা শুধু বিষন্ন মুখে দেখতে লাগলো শম্ভুর নানা চিকিৎসা পদ্ধতি। রমা জানে না আসলেই কোনো বুজরুকী কিনা, তবে শম্ভুর তৎপরতায় সে দেখতে পাচ্ছে, যদিও এটি বুজরুকী হয়, তবে সেই বুজরুকীতে শম্ভুর গভীর বিশ্বাস রয়েছে। রমা আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করল, এ পর্যন্ত বেদেটি কোনো মন্ত্রচ্চারণ, জলপোড়া, তাবিজ-কবচ এসব কিছুই করেনি।
পিকলুর হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়ে ওই আঠালো সবুজ বাটনটা লাগিয়ে দিয়েছে শম্ভু। তার ওপর কিছু পাতা চাপিয়ে একটা ময়লা পাতলা কাপড় দিয়ে মৃদু করে বেঁধে দিয়েছে। ঠিক কামড়ের দাগ তিনটির মধ্যবর্তী স্থানে তিনটে সূচ গাঁথা। তার সাথে অনবরত পিকলুর বুকে তেল মালিশ করছে শম্ভু। ওর শক্ত দীর্ঘ হাতের থাবায় পিকলুর নরম বুকের পাঁজর দেখা যাচ্ছে। রাত্রি ন'টা পর্যন্ত একই ভাবেই শম্ভু রয়ে গেল পিকলুর চিকিৎসায়। মাঝে রমাকে বললে---দিদিমণি, কিছু খাবার হলে খেয়েলেন। ঘুম পাইলে ঘুমিয়েটা লিবেন ইখানটা। দো চালায় আমার সাপঘরটা আছে। সিখানটা আমি শুয়ে পইড়বো।
খেতে তো ইচ্ছে নেই রমার। তবু পেটের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে। সেই সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। শুকনো কিছু স্নাক্স সরলা মাসির সাথে ভাগ করে খেলো ও। পীযুষকে ফোন করে সবটা জানাতে চেয়েছিল রমা। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক বলে কিছু নেই। সুন্দরবনের এক অচেনা আদিম অরণ্য যেন। গ্রীষ্মের দিন হলেও রাতে ফুরফুরে নদীর বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। ছোট তক্তাপোষের মত খাটে পিকলুকে মাঝে রেখে সরলা মাসি আর রমা ঘুমিয়ে পড়ল রাত্রি এগারোটা নাগাদ। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তেই ওদের সকলের চোখে ঘুম এসে গেছে।
পীযুষের অবশ্য ঘুম আসছে না। রমা একা একা ছেলেটাকে নিয়ে বাইরে আছে। ষষ্ঠীর ফোন নম্বরটা ছিল। আসলে পীযুষের অভ্যাস জরুরী নম্বর না হলে সেভ করে না। ষষ্ঠী তার মত করে যখন ইচ্ছে হত সাপ দিয়ে গেছে। পীযুষ বাড়ি না থাকলে ফিরে গেছে। ফলত নম্বরটা একটা কাগজের টুকরোতে লিখে গেছিল ষষ্ঠীপদ। সে কাগজের টুকরো আদৌ গচ্ছিত আছে কিনা তাও মনে নেই পীযুষের। ভোরবেলা ও নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরোবে। দেউলবাড়ি জায়গাটা যেহেতু গুগল মানচিত্রে দেখাচ্ছে। সেখানে গেলেই নিশ্চই একটা সুরাহা হবে।
++++++