14-11-2023, 10:23 AM
কোনোরকম অতিবাহিত হল রাত্রি। সকালে হাসপাতালে ডঃ মাহাতো উঃ বঙ্গ থেকে এসে উপস্থিত হলেন। পীযুষের উপস্থিতিতেই ডঃ ভট্টাচার্য ও ডঃ মাহাতোর মধ্যে আলোচনা চলতে লাগলো। এই আলোচনাগুলি নতুন কিছু নয়। হারপেটোলজিস্ট হওয়ায় সাপের খুঁটিনাটি, তার কামড় খাওয়া রোগীদের বিষয়ে সমস্ত কিছু পীযুষের জানা। ও নিরুত্তর রয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। নতুন করে কোনো আশাও যে ও করেনি।
বেরিয়ে আসার সময় ডঃ মাহাতো হাত রাখেন পীযুষের পিঠে। একসময় একসাথেই তারা সর্প বিষয়ক একাধিক গবেষণামূলক প্রকল্পে অংশ গ্রহণ করেছে। ডঃ মাহাতো খানিক বয়সে বড় পীযুষের চেয়ে। তিনি বললেন---ডঃ মৈত্র, আমার জন্ম বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত জঙ্গলাকীর্ন এলাকায়। এরকম স্ট্রেঞ্জ একটি ঘটনা আমার কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতাতে না হলেও যৌবনের শুরুর দিকে দেখা। বাঁকুড়ার সিমলাপাল এলাকার এক হতদরিদ্র পরিবারের কিশোরের দেহে এমনই মাত্রাতিরিক্ত বিষ পাওয়া গেছিল। ওটাও ছিল গোখরোর কামড়। বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ব্যর্থ হয়ে কলকাতা রেফার করে রোগিটিকে। আদিবাসী কিশোরটির পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। তারপর বছর খানেক পরে ঐ কিশোরকে একে বারে সুস্থ সবল দেহে আমি গঞ্জ এলাকায় দেখতে পাই। তখন সবে কলেজে পাশ করেছি। এ বিষয়ে আগ্রহও তেমন ছিল না। পরে সর্প বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বহুবার কথাটি মোমে এসেছে। আজ আপনার ছেলের এই কেস স্টাডি করে জানতে ইচ্ছে করছে ঐ কিশোরের চিকিৎসা কোথায় হয়েছিল, মেডিক্যালের কি কি গাইডলাইন প্রয়োগ হয়েছিল তা নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, বছর কুড়ি আগের কথা, আজ আর খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব নয়। ছেলেটির ঠিক বাড়ি কোথায়, বা থাকে কোথায় খুঁজে বার করা কঠিন।
ডঃ মাহাতো বেরিয়ে গেলেন দশটার দিকে। পীযুষ একবার দেখে এলো পিকুলকে। পায়ের ক্ষত স্থান ফুলে গিয়ে বীভৎস এক কালচে আকার ধারণ করেছে। সর্বাঙ্গও কেমন কালচে নীল। ইনফেকশন এড়াতে আইসোলেশনে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়নি। শ্বাস-প্রশ্বাস এখনো স্বাভাবিক পিকলুর।
রমা এসে পড়বে এগারোটার দিকে। ও ট্যাক্সি করে নিজেই চলে আসবে বলেছে। পীযুষ জানে রমা ভেতর থেকে বেশ শক্ত ধাতের। নিজেকে ধীরে ধীরে আগত পরিস্থিতির জন্য তৈরী করতে পারবে। যদিও পীযুষকে একবার এর মাঝে কলেজ যেতে হবে। সাইন করে একটা বড় মেডিক্যাল লিভ নিতে হবে। কখন কি হয়ে যাবে বলা অনিশ্চিত, তখন রমাকে সামলাতে তাকেই থাকতে হবে সঙ্গে।
স্নান সেরে রমা শাড়িটা পরছিল। ঠিক সেসময় চাঁপা এসে বললে---বৌদি আমার মা আসছে। কিছু বইলতে চায়।
চাঁপার মা সরলা এ বাড়িতে এর আগেও বহুবার এসেছে। এসময় কি বলতে চায়, তা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই রমার। তবু ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো ও। সরলা বললে---দিদিমণি, আমি বইলছিলাম কি, একবার ছেলাটাকে আমার শ্বশুরের গেরামের ভীমনাগ বেদের ব্যাটাটারে দিখাইলে ভালো হত। বড় নামডাক ছিল ভীমনাগ বেদের। কত সাপে কাটা রোগীকে বাঁচাইছে। আমি লিজে দেইখছি দিদিমণি, কেউ বইলছিলনি দাস পাড়ার বউটা বাঁইচবে। সেই বউটারে বাঁচাই ফেলল ভীমনাগ। তার ব্যাটাটাও নাকি সে ক্ষমতা রাখে। তবে সে নাকি বড্ড মেজাজী। আমার ভাসুরের পো ভগিরথ কইল, তারে বোঝাইলে অবশ্য শুইনবে।
রমা জলের খালি বোতলটায় জল ভরতে ভরতে বললে---পিকলুর বাবা ঝাড়, ফুঁক এসবে বিশ্বাস করে না সরলা মাসি। আমিও তেমন বিশ্বাস করতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে সরলা বাধা দিয়ে বললে---ঝাড় ফুঁক নয় গো দিদিমণি। ভীমনাগ বেদে জড়ি বুটি, গাছ-পাতা দিয়া চিকিচ্ছা কইরে। আমি লিজে দেইখছি, কুনো মন্ত্র, তাবিজ, মাদুলি দেয় নাই বউটারে।
চাঁপাও তার মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বললে---বৌদি পিকলুটারে ডাক্তার তো কয়ে দিছে পারবে নাই। একবার যদি মা যে বেদেটার কথা বইলছে তারে দিখাও ক্ষতি কি।
পীযুষ কলেজ থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা হাসপাতালে ফিরল দুপুর একটা নাগাদ। হাসপাতালে এসেই খবরটা পেল, পিকলুকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে রমা। কোথায় নিয়ে যেতে পারে রমা? ওই বেদের কাছে! সে তো অনেকদূর সুন্দরবন না কোথায় যেন বাড়ী!
পীযুষ রমাকে ফোন করেও পাচ্ছে না। বারবার নট রিচিবল বলছে ফোনটা। বাড়ি ফিরে দেখল চাঁপা একা রয়েছে। পীযুষ জিজ্ঞেস করল চাঁপাকে রমা কোথায় গেছে।
চাঁপা জানালো---বৌদি পিকলু বাবুটারে লয়ে আমার মার সাথে বেদের ঘরে গেছে গো দাদা। ফিরতে কাল বিকাল হতে পারে।
----মানে! বলা নেই কওয়া নেই, ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল কোথাকার কোন বেদের কাছে! আশ্চর্য তো। আর থাকবেই বা কোথায়?
চাঁপা কিছু সদুত্তর দিতে পারলো না। পীযুষ বুঝতে পারছে রমার যেহেতু মনের মধ্যে অস্থিরতা তাই সে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়ত শেষবেলায় যদি সে এমনটা করেও খানিক হালকা হতে পারে। পরে হয়ত তখন মনে হতে পারতো তার ঐ বেদের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হতে পারতো। তবু দুশ্চিন্তা কাটছে না পীযুষের। থাকবে কোথায় রমা। সুন্দরবনের সরবেড়িয়া গ্রাম সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই পীযুষেরও। ষষ্ঠীপদর মুখে শুনেছে রায়মঙ্গল লাগোয়া কালনাগিনী বলে একটি নদী আছে ওখানে। দেউলবাড়ি না কি যেন একটা গ্রাম আছে নিকটে।
গুগল ম্যাপ খুলে দেখল পীযুষ। দেউলবাড়ি সুন্দরবনের গ্রাম দেখালেও সড়বেড়িয়ার কোনো চিহ্ন নেই। ওখানেই কোথাও হবে হয়ত। পীযুষ ঠিক করল কাল ভোরে ও নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে যাবে ওখানে।
চলবে।
বেরিয়ে আসার সময় ডঃ মাহাতো হাত রাখেন পীযুষের পিঠে। একসময় একসাথেই তারা সর্প বিষয়ক একাধিক গবেষণামূলক প্রকল্পে অংশ গ্রহণ করেছে। ডঃ মাহাতো খানিক বয়সে বড় পীযুষের চেয়ে। তিনি বললেন---ডঃ মৈত্র, আমার জন্ম বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত জঙ্গলাকীর্ন এলাকায়। এরকম স্ট্রেঞ্জ একটি ঘটনা আমার কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতাতে না হলেও যৌবনের শুরুর দিকে দেখা। বাঁকুড়ার সিমলাপাল এলাকার এক হতদরিদ্র পরিবারের কিশোরের দেহে এমনই মাত্রাতিরিক্ত বিষ পাওয়া গেছিল। ওটাও ছিল গোখরোর কামড়। বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ব্যর্থ হয়ে কলকাতা রেফার করে রোগিটিকে। আদিবাসী কিশোরটির পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। তারপর বছর খানেক পরে ঐ কিশোরকে একে বারে সুস্থ সবল দেহে আমি গঞ্জ এলাকায় দেখতে পাই। তখন সবে কলেজে পাশ করেছি। এ বিষয়ে আগ্রহও তেমন ছিল না। পরে সর্প বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বহুবার কথাটি মোমে এসেছে। আজ আপনার ছেলের এই কেস স্টাডি করে জানতে ইচ্ছে করছে ঐ কিশোরের চিকিৎসা কোথায় হয়েছিল, মেডিক্যালের কি কি গাইডলাইন প্রয়োগ হয়েছিল তা নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, বছর কুড়ি আগের কথা, আজ আর খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব নয়। ছেলেটির ঠিক বাড়ি কোথায়, বা থাকে কোথায় খুঁজে বার করা কঠিন।
ডঃ মাহাতো বেরিয়ে গেলেন দশটার দিকে। পীযুষ একবার দেখে এলো পিকুলকে। পায়ের ক্ষত স্থান ফুলে গিয়ে বীভৎস এক কালচে আকার ধারণ করেছে। সর্বাঙ্গও কেমন কালচে নীল। ইনফেকশন এড়াতে আইসোলেশনে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়নি। শ্বাস-প্রশ্বাস এখনো স্বাভাবিক পিকলুর।
রমা এসে পড়বে এগারোটার দিকে। ও ট্যাক্সি করে নিজেই চলে আসবে বলেছে। পীযুষ জানে রমা ভেতর থেকে বেশ শক্ত ধাতের। নিজেকে ধীরে ধীরে আগত পরিস্থিতির জন্য তৈরী করতে পারবে। যদিও পীযুষকে একবার এর মাঝে কলেজ যেতে হবে। সাইন করে একটা বড় মেডিক্যাল লিভ নিতে হবে। কখন কি হয়ে যাবে বলা অনিশ্চিত, তখন রমাকে সামলাতে তাকেই থাকতে হবে সঙ্গে।
স্নান সেরে রমা শাড়িটা পরছিল। ঠিক সেসময় চাঁপা এসে বললে---বৌদি আমার মা আসছে। কিছু বইলতে চায়।
চাঁপার মা সরলা এ বাড়িতে এর আগেও বহুবার এসেছে। এসময় কি বলতে চায়, তা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই রমার। তবু ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো ও। সরলা বললে---দিদিমণি, আমি বইলছিলাম কি, একবার ছেলাটাকে আমার শ্বশুরের গেরামের ভীমনাগ বেদের ব্যাটাটারে দিখাইলে ভালো হত। বড় নামডাক ছিল ভীমনাগ বেদের। কত সাপে কাটা রোগীকে বাঁচাইছে। আমি লিজে দেইখছি দিদিমণি, কেউ বইলছিলনি দাস পাড়ার বউটা বাঁইচবে। সেই বউটারে বাঁচাই ফেলল ভীমনাগ। তার ব্যাটাটাও নাকি সে ক্ষমতা রাখে। তবে সে নাকি বড্ড মেজাজী। আমার ভাসুরের পো ভগিরথ কইল, তারে বোঝাইলে অবশ্য শুইনবে।
রমা জলের খালি বোতলটায় জল ভরতে ভরতে বললে---পিকলুর বাবা ঝাড়, ফুঁক এসবে বিশ্বাস করে না সরলা মাসি। আমিও তেমন বিশ্বাস করতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে সরলা বাধা দিয়ে বললে---ঝাড় ফুঁক নয় গো দিদিমণি। ভীমনাগ বেদে জড়ি বুটি, গাছ-পাতা দিয়া চিকিচ্ছা কইরে। আমি লিজে দেইখছি, কুনো মন্ত্র, তাবিজ, মাদুলি দেয় নাই বউটারে।
চাঁপাও তার মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বললে---বৌদি পিকলুটারে ডাক্তার তো কয়ে দিছে পারবে নাই। একবার যদি মা যে বেদেটার কথা বইলছে তারে দিখাও ক্ষতি কি।
পীযুষ কলেজ থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা হাসপাতালে ফিরল দুপুর একটা নাগাদ। হাসপাতালে এসেই খবরটা পেল, পিকলুকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে রমা। কোথায় নিয়ে যেতে পারে রমা? ওই বেদের কাছে! সে তো অনেকদূর সুন্দরবন না কোথায় যেন বাড়ী!
পীযুষ রমাকে ফোন করেও পাচ্ছে না। বারবার নট রিচিবল বলছে ফোনটা। বাড়ি ফিরে দেখল চাঁপা একা রয়েছে। পীযুষ জিজ্ঞেস করল চাঁপাকে রমা কোথায় গেছে।
চাঁপা জানালো---বৌদি পিকলু বাবুটারে লয়ে আমার মার সাথে বেদের ঘরে গেছে গো দাদা। ফিরতে কাল বিকাল হতে পারে।
----মানে! বলা নেই কওয়া নেই, ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল কোথাকার কোন বেদের কাছে! আশ্চর্য তো। আর থাকবেই বা কোথায়?
চাঁপা কিছু সদুত্তর দিতে পারলো না। পীযুষ বুঝতে পারছে রমার যেহেতু মনের মধ্যে অস্থিরতা তাই সে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়ত শেষবেলায় যদি সে এমনটা করেও খানিক হালকা হতে পারে। পরে হয়ত তখন মনে হতে পারতো তার ঐ বেদের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হতে পারতো। তবু দুশ্চিন্তা কাটছে না পীযুষের। থাকবে কোথায় রমা। সুন্দরবনের সরবেড়িয়া গ্রাম সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই পীযুষেরও। ষষ্ঠীপদর মুখে শুনেছে রায়মঙ্গল লাগোয়া কালনাগিনী বলে একটি নদী আছে ওখানে। দেউলবাড়ি না কি যেন একটা গ্রাম আছে নিকটে।
গুগল ম্যাপ খুলে দেখল পীযুষ। দেউলবাড়ি সুন্দরবনের গ্রাম দেখালেও সড়বেড়িয়ার কোনো চিহ্ন নেই। ওখানেই কোথাও হবে হয়ত। পীযুষ ঠিক করল কাল ভোরে ও নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে যাবে ওখানে।
চলবে।