Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
[Image: FB-IMG-1698980745806.jpg]

|| রঙ ||

কলমে :- অমৃতা বিশ্বাস সরকার

নামটা তার বাবা খুব আদরের সঙ্গে রেখেছিল মেয়ে হওয়াতে - উমা।
তাদের বনেদী বাড়ি।
কত লোকজন সারাক্ষন তাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করে।
কত কাজের লোক আছে তাদের। তার ঠাকুরদা,ঠাকুমা,কাকারা,কাকিরা,ভাই বোনেরা সবাই আছে...নেই শুধু বাবা।
সে শুনেছে তার জন্মের মাসখানেকের ভেতরই নাকি বাবার কঠিন অসুখ করে ও তিনি মারা যান।
তাকে ও মাকে সবাই তাড়িয়ে দেয়নি বটে তবে খুব যে যত্নে রেখেছে সেটাও না।
তারা প্রায় একঘরে হয়েই পরে আছে এই সুবিশাল বাড়িটায়।
তাকে সবাই একটু এড়িয়েই চলে।
সে নাকি অপয়া। জন্মেই নাকি বাবাকে খেয়েছে,বাকিদের ও খাওয়ার তালে আছে।
সে তো বুঝতেই পারেনা যে কি এমন করেছে সে? আর কি করেই বা এত বড় বড় মানুষদের সে খেয়ে নিতে পারবে? তার তো সেই মায়ের কাছে শোনা গল্পের রাক্ষসদের মত বড় বড় দাঁত নেই,তার চোখ দিয়ে আগুন ও বের হয়না- তাহলে??? অনেক ভেবেও এইটা মাথায় আসে না উমার।
তার নাম উমা হলেও তার গায়ের রঙ বেশ চাপা।
তার বাবা নাকি তাদের বাড়ির আর সকলের মতই ছিল-খুব ফরস,আর তাই যখন প্রেম করে তার মায়ের মত কালো একজনকে বিয়ে করে আনেন তিনি তখন অশান্তিও নাকি খুব হয়েছিল।
তবে তার বাবার জেদের কাছে হার মেনে ও বংশের নামের কথা চিন্তা করে ওই নিম পাতা গেলার মত করে তার মাকে মেনে নিয়েছিল তাদের বাড়ির লোকেরা। তবে মাকে এই রঙের খোঁটা সারা জীবন শুনতে হয়েছে। আর সেও যখন মায়ের গায়ের রঙ নিয়ে জন্মালো তখন তাকেও বাদ দেয়নি তারা। তাকে কেউ নাকি দেখতেও যায়নি হাসপাতালে, শুধু বাবা যেতেন।খুব আদর করতেন, খুব ভালোবাসতেন তাকে…সবই তার শোনা কথা-কিছুটা মার মুখে,কিছুটা বাড়ির কাজের লোক হরিদাদুর মুখে। হরি দাদু নাকি বাবার ছোট বয়স থেকে বাবাকে কোলে পিঠে মানুষ করে ছিল। বাবাকে খুব ভালো বাসতো এবং তাই তার মেয়ে বউকেও খুব ভালোবাসে। উমার কাছে মায়ের পর এই হরিদাদুই সব।

উমাদের বাড়িতে দুর্গা পূজো হয় খুব বড় করে,কত লোক পূজো দেখতে আসে,ভোগ খেতে আসে। তার দাদা-দিদি,ভাই বোনরা কত সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়,খেলা করে। বাড়ির সবাই কত রকমের সাজে,চাকরাও নতুন জামা কাপড় পায়, শুধু পায় না উমা ও তার মা। তাতে অবশ্য উমার কষ্ট হয়না,সে দিব্বি দিদিদের পুরানো জামা পড়ে কাটিয়ে দেয়। তবে মা যখন শুধু বাবার পুরানো ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলেন, তখনই খুব কষ্ট হয় উমার। মার কষ্ট তার মন খারাপ করে দেয় যে বড্ড। উমা তাদের চিলে কোঠার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বসে থাকে,জলে ভরা থাকে তারও দুটো চোখ। দুর্গা ঠাকুর এলে তাদের বিশাল বারান্দায় পূজো হয়। সবাই বরন করে,কত আয়োজন পূজোর,কত মন্ত্রপাঠ হয়। তবে পূজোতে যাওয়ার অনুমতি নেই তার ও তার মায়ের । তাই উমা লুকিয়ে বসে সিঁড়ি থেকে সব লক্ষ্য করে। খুব ভালো লাগে তার। ইচ্ছে করে ঠাকুরকে একটু ছুঁয়ে দেখে, কিন্তু ঠাকুরের সামনে তার যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাহস নেই। কেউ দেখতে পেলে তাকে ও তার মাকে খেতে হবে বিস্তর বকুনি। অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করেছে উমা। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন একবার যাবে সে ঠাকুরের কাছে,ছুঁয়ে দেখবে। সবাই বলে দুর্গা ঠাকুর নাকি সকলের মা, তার কাছে কিছু চাইলে নাকি কাউকে খালি হাতে ফিরতে হয়না। উমাও চাইবে ঠাকুরের কাছে-তার ও তার মায়ের জন্য একটু শান্তি আর ভালোবাসা। তাদের যেন সবাই সমান-সমান ভাবে বাকিদের মত। মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে এইসব কথাই ভাবছিল উমা। মা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, দালানের বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ৩টে বাজলো। উমা চুপি চুপি উঠে পরে মায়ের পাশ থেকে, পা টিপে টিপে দরজার আগলটা খোলে, তারপর বেরিয়ে পরে বাইরে। এক দৌড়ে চলে যায় সিঁড়ি বেঁয়ে সোজা নিচে - ঠাকুরের সামনে। দুর্গা ঠাকুরের মুখের দিকে তাকায় একবার উমা। এই প্রথম এত কাছ থেকে দুর্গা মাকে দেখলো সে। মুখটা কি সুন্দর মায়ের, মমতা মাখানো চোখ দুটো ,ঠিক তার নিজের মায়ের মত...কি সুন্দর হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সাহস করে উমা ঠাকুরের পায়ে হাত দিতে যায়...আর ঠিক‌ তখনই তার হাতটা কেউ চেপে ধরে। ভয় পেয়ে ঘুরে তাকায় উমা...

একজন মহিলা। বেশ সুন্দর দেখতে। সে ধরেছে উমার হাতটা। উমা বকুনি খাওয়ার ভয়ে কাঁপতে থাকে। চোখ দিয়ে জল বের হয়ে পরে। আমতা আমতা করে উমা বলতে চেষ্টা করে যে সে ঠাকুরের গায়ে হাত দেয়নি। তার চোখে জল দেখে মহিলাটা তাকে কোলে তুলে নেয। মিষ্টি করে হেসে তার নাম জিজ্ঞাসা করে । উমা নিজের নাম বলে। মহিলাটি তার গাল টিপে বলে : "ভারী মিষ্টি নাম তো তোমার! কে দিয়েছে নামটা?"
উমার মহিলাটিকে খুব ভালো লেগে যায়। সব কথা বলতে থাকে এক এক করে। ভদ্রমহিলাটি মন দিয়ে শুনতে থাকে। ওনার কাছে সব বলতে ভালোও লাগে  উমার। কি সুন্দর মমতা মাখা মুখখানি। গায়ে খুব সুন্দর একটা গন্ধ - মা মা গন্ধ। উমা ওনার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে। তার মনের সব ইচ্ছার কথা বলতে থাকে। উনিও শোনেন,নিজের মত করে উমাকে উনিও কত কথা বলেন। উমাও বিভোর হয়ে শুনতে থাকে ওনার কথা। উমা ওনাকে বলে : "ঠাকুরকে বললে আমাকে ফর্সা করে দেবে গো?"।  উনি হেসে ফেলেন ,জিজ্ঞাসা করেন : "ফর্সা হতে চাও কেন?" উমা বলে : "আমি ফর্সা হলে আর কেউ আমাকে বা মাকে কথা শোনাবে না।আমাদের কেও ভালোবাসবে...."।
উনি বলেন : "গায়ের রঙে কিচ্ছু এসে যায়না মা আমার। মানুষের কর্মই মানুষকে শ্রেষ্ঠ বা নিম্ন করে।"
উমা হাঁ করে শোনে...উনি বলতে থাকেন : "আমার এক বোন আছে জানো...তোমার মত গায়ের রঙ,কিন্তু তাকে সবাই চেনে,তাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায়,ভালোবাসে,সম্মান ও করে খুব...তাকে কতজন ডাকে নিজেদের কাজের জন্য..."
উমা : "তাই!"
মহিলা : "হ্যাঁ"।
উমা : "কালো বলে কেউ কথা শোনায় না?"
মহিলা : "না কারন তার রুপ নয় তার কাজই তার পরিচয়।কত শত মানুষকে সে রক্ষা করেছে।এখনও করে। কতজন মানুষের উপকার করেছে। সবাই তাকে মা বলেই ডাকে।"
উমা জিজ্ঞাসা করে : "নাম কি গো তার?"
মহিলা : "নাম বললে তুমি চিনবে না।"
উমা : "বল না।"
মহিলা : "তার নাম শ্যামা। মনে রেখো তোমার কাজই তোমার পরিচয়। রুপ বা রঙ না। আজ যারা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে,ভালোবাসছে না,বাজে কথা বলছে, তারাই তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। কর্ম করে যাও,ফলও পাবে তুমি ঠিক একদিন।" ভদ্রমহিলা আরো কত কথা বলে চলে। শুনতে শুনতে উমা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে দেখে যে সে তার মায়ের পাশেই শুয়ে আছে নিজেদের ঘরের বিছানায়। তবে উমার আর মন খারাপ লাগছে না কেন জানি। সে এত ছোট বয়সেই যেন নিজের মনের রাস্তা ঠিক করে ফেলেছে। সে জেনে গেছে তাকে কি করতে হবে।

৩০ বছর কেটে গেছে তারপর...আজ উমা নাম করা ডাক্তার। বাড়ির কারুর টাকা তার লাগেনি। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করে সে প্রতিটা ক্লাসে বৃত্তি নিয়ে পাশ করেছে। তার এখন চারিদিকে কত নামডাক। সে কালো হলেও তার কাছে প্রচুর মানুষ আসে দূর দূর থেকে চিকিৎসা করানোর জন্য। ঠাকুরদার অত বড় অসুখটা যেটা প্রায় কোনো ডাক্তারই সারাতে পারছিল না,সে যখন সেটা সারিয়ে দিল তখন তাকে তার বাড়ির লোকেরাও আর অবহেলা করতে পারেন। উমার নাম এখন সবার মুখে মুখে,সবাই তাকে নিজেদের পরিচিত বলতে পেরে যেন খুশি হয়,গর্ব করে তাকে নিয়ে তার বাড়ির লোকেরা। তার মাকেও এখন সবাই সম্মান দেয়। চিলেকোঠার ঘরটার জায়গায় তারা ফিরে এসেছে তার বাবার ঘরে। তাদের ভাগে এখন শুধুই সম্মান ও ভালোবাসা।

আবার আজকে এক দুর্গা পূজো। উমার মনে পরে সেই মা মা গন্ধওলা ভদ্রমহিলাটার কথা। তার কথাই তো উমার জীবনের মানে বদলে দিয়েছিল সেই রাতে। আজীবন কৃতজ্ঞ উমা তার কাছে। আজ উমা বোঝে যে সত্যি রুপ - রঙ না,  মানুষের কর্মই তার সঠিক পরিচয়। দুর্গা ঠাকুরের আরতির সময় কি মনে হতে একবার চোখ খোলে উমা। চোখ খুলে আবার আজকে উমা দেখতে পায় সেই ভদ্রমহিলাকে। তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে মহিলাটি মিশে যায় দুর্গা ঠাকুরের প্রতিমার ভেতরে।
সারা শরীর একবার কেঁপে ওঠে উমার।
চোখ দিয়ে বইতে থাকে আনন্দাশ্রু।

|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 4 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 11-11-2023, 11:23 AM



Users browsing this thread: