Thread Rating:
  • 135 Vote(s) - 3.69 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Adultery পদ্ম নাগের বিষ
রাতের দিকে এসে হাজির হল ষষ্ঠীপদ। দোচালার মাটির ঘরে তখন সর্বত্র বিরাজমান অন্ধকার। উঠানে ছায়ামূর্তির মত একা বসে আছে শম্ভু। ষষ্ঠীর ভয় হচ্ছে, কোনোভাবে তাকে সন্দেহ করেনি তো।

দু' পা এগিয়ে গিয়ে বলল---কি রে ঘরে আলো জ্বালাসনি!

শম্ভু নিরুত্তর। হাতে বিড়ির জোনাকি সদৃশ আলো। ষষ্ঠীর নাকে ঠেকল অকস্মাৎ দিশি মদের গন্ধ। শম্ভু মদ গিলেছে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এক আধবার হয়ত সে আর শম্ভু একসাথে খেয়েছে, তবে সে বহুদিন আগে। বিশেষ পছন্দ করেনি শম্ভু।


ষষ্ঠীপদ বললে---কি হল, কথা কস না কেন?

শম্ভু বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে বলল---পদ্মটারে দেখছিস?

----কেন পদ্মর আবার কি হইল? না জানার ভান করে কথাটা বলল ষষ্ঠী।

---পদ্ম পালাইছে।

ষষ্ঠীপদ চুপ করে গেল। শম্ভুর গলায় তেজ স্পষ্ট। নিজে একটা বিড়ি ধরিয়ে বললে---বনের জীব সুযোগ পাইলে পালাইতে পারে। এ আবার নূতন কি!

---পদ্ম এদ্দিন পালাইল লা, আজ কেন পালাইল, ব্যাপারখানা মাথায় ঢুইকছে লা।

---শম্ভু, খালি খালি তু পদ্মরে মানুষটার মত ভাইবতিস। পালাইছে তো ভালো হছে। তুর ন্যাশাটা ছাড়বে।

---ন্যাশা! পদ্ম মোর কাছে শুধু ন্যাশা ছিল!

---আঃ শম্ভু। বনের জীব, কেন তার লিয়ে অত ভাবিস। কাজের কথায় আয়। শহরের বাবুটা একটা শঙ্খিনী লিবে, তুর ঝাঁপি থিকা লিব।

শম্ভু মদ্যপ অবস্থায় রাগত সুরে বলল---লে, সব লে যা। বেইচে দে সব। একটাও সাপ রাইখবো লাই।

উঠতে গিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ল শম্ভু। ষষ্ঠী ধরে ফেলল ওকে। এত শক্তপোক্ত চেহারার শম্ভুকে সামলানো ষষ্ঠীর পক্ষে কঠিন। তবু কোনরকমে তাকে একচালায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। নেশার ঘোরে তখনও বিড়িবিড় করে যাচ্ছে সে।

ফিরবার সময় ষষ্ঠী ভাবতে লাগলো পদ্মকে ধরতে তাকে কতই না কসরত করতে হল সেদিন। শম্ভু চলে যাবার পর হাজির হয়েছিল ষষ্ঠী। মা মনসার নাম নিয়ে ঝাঁপি থেকে বার করতে গেলেই ফোঁস করে তেড়ে এসেছিল তার দিকে। কোনোভাবেই তাকে ধরতে পারছিল না সে। শেষমেষ শম্ভুর সাপে বশ আনার হিং নেশা ছড়িয়ে দিল পদ্মগোখরোটার উপর। ঘরে দু'দিন না খেতে দিয়ে ফেলে রেখেছিল। যাতে দুর্বল হয়ে যায়। তারপরেও বাবুর ঘরে তার তেজ দেখেছে ষষ্ঠী। এখন বেটি চিরজীবনের জন্য কাচের বাক্সে বন্দী। মনে মনে আনন্দ হচ্ছে ষষ্ঠীপদর। পয়সাও তো দু'হাজার পেয়েছে। শম্ভুকে ভাগ না দিয়ে সে কখনো পয়সা নেয়নি। কিন্তু ভাগ দিতে গেলে যদি সন্দেহ করে! তারচেয়ে ষষ্ঠীপদ ঠিক করে নিল, এখন কিছু বলবে না সে শম্ভুকে। শম্ভুকে একটা বে দিতে হবে। জোয়ান মরদটাকে ঠিক পথে বাঁধতে হবে। তারপর কোনো একদিন বলবে কথাটা।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো শম্ভুর। মনে পড়ল কাল রাতে সে রসুলপুর ঘাট থেকে দেশি মদ কিনে এনেছিল। বড় বিস্বাদ লেগেছিল তার। মা'টা মরে যাবার পর তার বাপ মদ খেত। শম্ভু ষষ্ঠীর সাথে ক'বার আগেও খেয়েছে। মুখে রুচেনি তার। নেশা বলতে বিড়ি ছাড়া কিছু ছুঁত না সে। ঠিক করেছিল এক সময় বিয়ে করে ঘরটা বড় করে বাঁধবে। বাচ্চা কাচ্চা হবে। তাদের সে ইস্কুলে দেবে। কিন্তু দেড় বছরে তার জীবনে এক একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। প্রথমে গোলাপি পালালো, তারপর বাপটাও গেল মরে। শেষে এলো পদ্ম, পদ্মর বিষের নেশা চাপলো ঘাড়ে। সেই পদ্মও পালালো। এখন সকালটা নিঃস্ব লাগছে তার।
কাল দুপুরে রাঁধা মাংসের বাটি থেকে ঝোল নিয়ে মুড়ি মেখে খেল। তারপর জানালা দিয়ে চেয়ে রইল কালনাগিনীর দিকে। সূর্যের প্রখর আলো পড়ে নদীটা পদ্মের গায়ের মত সোনারবর্ণ। বহুদিন নদীতে যায়নি সে। ডিঙিটা বাঁধা আছে ঘাটে। আগে সে ষষ্ঠীকে সঙ্গে নিত। কখনো কখনো একা ঘুরে বেড়াত রায়মঙ্গল, মাতলা, বিদ্যধরী পর্যন্ত। জেলে রক্ত তারও গায়ে। মাঝিরা তাকে অনেকে চেনে, তারা অবশ্য বেদের পো বলে গাল দেয় না। বরং সনাতন মাঝির নাতি বলে সমীহ করে। সমীহ করবার মতই শম্ভুর চেহারা ও মেজাজ। আজ সে যাবে নদীতে। বুলিকে গল্প শুনিয়েছিল নদীর গল্প, কুমিরের গল্প, ঘড়িয়াল আর বাঘের গল্প। বুলিটা এখন ছোটো, একদিন নিয়ে যাবে তাকে কুমির দেখাতে। গোলাপি যদি থাকতো, তারও বুলির মত একটা মেয়ে হত।

জালটা নিবে নাকি! কি মনে করে চৌকির তলা থেকে বার করে আনলো তার দাদুর জালটা। প্রায় এক বছরের বেশি হল সে নৌকা বেয়ে জাল ফেলেনি নদীতে। পদ্ম যাওয়ায় তার বুকে যেমন কাঁটার মত বিরহ যন্ত্রনা আছে, তেমন শরীরটাও চাঙা লাগছে তার। এতক্ষনে দু'বার ঝিম ধরানো নেশা হত তার। আজ তার সুঠাম শরীরে সে বিষ পড়েনি।

নদী বক্ষে নামলো সনাতন জেলের নাতি। নৌকা বেয়ে যতই এগোয় অতল জলের আহ্বান তাকে আরো দূরে নিয়ে যেতে চায়। মনে পড়ল একদিন রাতে কিশোর বয়সে এমনই নদী বক্ষে সে আর ষষ্ঠী ঠিক করেছিল সমুদ্রে চলে যাবে। তা আর হয়নি কোনোদিন। মজবুত হাতে কালনাগিনীর মাঝ বুকে ছুঁড়ে দিল জ্বাল। গোখরোর ফনার মত জ্বালটা ছড়িয়ে গেল নৌকার তিনদিকে। জ্বাল ফেলার সুন্দর দক্ষতা ছিল তার দাদুর। বাপ ভীমনাগ বেদে চেষ্টা করেও শশুরের কাছে শিখে নিতে পারেনি এতটা পারদর্শিতা। বরং দাদুর কাছে এটা ভালোই রপ্ত করেছে শম্ভু। দাদু চাইতো তার নাতি বেদে নয়, জেলে হয়ে উঠুকু। বাপ চাইতো বেদের ছেলে বেদে। দুজনেরই কথা রেখেছে সে। শুধু পারেনি মায়ের ইচ্ছের মত হতে। মা কমলা চাইতো তার ছেলে শহুরে ভদ্রলোকের মত ফুলবাবুটা হয়ে উঠুক। শম্ভু জানে সে আর এ জন্মে হবে না।
নদী, সাপ, সুন্দর বনের গরান জঙ্গল আর হোগলা পাতার ঝাড় ভালোবেসেছে সে। ভালোবেসেছে একদিনের বউ গোলাপিকে নিয়ে ফিকে হয়ে আসা স্বপ্ন। ভালোবেসেছে বিষধর পদ্মের শীতল শরীরের বিষময় কামড়। ভালোবাসে সে বন্ধু ষষ্ঠীর ছোট বাচ্চা মেয়ে বুলির আধো আধো কথা। অথচ কিশোর বয়সে যখন একদিন ষষ্ঠী বলেছিল গেরামে মিলিটারি এসেছে, তখন দেখেছিল সরবেড়িয়া বাজারে ভোটের সময় বন্দুকধারী মিলিটারিদের। পড়াশুনাটা করলে সেও হত, তার চেহারায় নাকি মিলিটারি ছাপ। ভোটের ঐ ক'দিন; প্রতিদিন বিকেল হলে চলে যেত সরবেড়িয়া বাজারে। মিলিটারিরা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলত। একজন মিলিটারি ভুটভূট করা মোটর বাইকে চেপে এসেছিল একদিন। শম্ভু স্বপ্ন দেখেছিল মিলিটারি না হতে পারুক; সে একদিন এরকম একটা ভুটভূট করা মোটর বাইক কিনবে। এটাই ছিল শম্ভুর কিশোর বয়সের সবচেয়ে অবাস্তবোচিত স্বপ্ন। সুন্দরবনের নদীর পাড়ে বাস করা তার মত বেদের বাচ্চা কি আর মোটর সাইকেল চাপে!

এসব কথা ভাবলে এখন হাসি পায় শম্ভুর। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তার জীবনের দর্শন যেন বাপ ভীমনাগকেও ছাড়িয়েছে। বত্রিশের যৌবন তাড়নার স্বপ্নগুলো যা সে চেপে রেখেছিল পদ্মের ছোঁবলের নীচে, তা আজ যেন নতুন করে মনে এলো। পরক্ষনে নিজেকে অবজ্ঞা করে বিড়বিড় করে বললে---শম্ভু ন্যাশা দরকার তোর, বেদের পো হয়ে জনম হছিস, ইটা ভুইলে যাস না।

জালটা ভার হচ্ছে। গুটিয়ে গুটিয়ে টেনে আনলো। শুধুই গজাল। দু চারটা ট্যাংরা ছাড়া কিছু উঠল না। ঠিক করল রায়মঙ্গল বা মাতলায় গিয়ে জাল ফেলবে। বড় নদী, বড় মাছ উঠবে।
Like Reply


Messages In This Thread
পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 21-10-2023, 11:21 PM
RE: পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 10-11-2023, 11:41 PM



Users browsing this thread: 7 Guest(s)