28-10-2023, 02:59 AM
(This post was last modified: 03-11-2023, 12:37 PM by Nirjon_ahmed. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
একজন সার্জিও রামোসের ডিফেন্সিভ মিস্টেক
২
"ধন্যবাদ অনেক। অন্তত একজন আমার সাথে একমত!"
প্রোফাইল লকড। বিয়ে বাড়িতে তোলা একটি ছবি প্রোফাইলে ঝোলানো।
"তোমার চিন্তা ভালো লেগেছে আমার। আমিও মাঝেমাঝে মাসুদ রানা পড়তাম। এখন আর ওভাবে পড়তে পারবো না!"
লিখলাম, "সরি। আপনার আনন্দের একটা মাধ্যমকে প্রশ্ন করলাম। আমি পোস্টটা না লিখলে হয়তো আপনি আগের মতোই উপভোগ করতেন!"
"না ঠিক সেটা না। তুমি আসলেই ঠিক লিখছো। আমাদের সময়, মানে মোবাইল হাতে হাতে আসার আগে আরকি, বিনোদনের তো কোন উপায় ছিলো না। সেবা প্রকাশনী বলো, অন্যান্য প্রেমের সস্তা নভেল বলো, এসবই বিনোদনের মাধ্যম ছিলো। ছেলেমেয়েরা অবসরে কী করবে বলো? এসবের মান নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি। সময় কাটানো ছিলো কথা!"
উত্তর এলো ওপ্রান্ত হতে।
ম্যাসেজে বড় বড় কথা লেখাটা বিরক্তিকর। তবুও লিখলাম, "হ্যাঁ। নইলে সে সময়ে এতো বই বিক্রি হতো না। পত্রিকা, সাময়িকীও চলতো। অথচ ছিলো তো ওসব ট্রাশ।"
"তোমার সাথে কি কথা বলা যাবে?"
হঠাৎ প্রশ্ন। বসে ছিলাম জহু হলের পুকুরপাড়ে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কল দিলাম সরাসরি।
"হ্যালো" বলতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো, "তুমি কিছু মনে করো নাই তো আবার? হঠাৎ কথা বলতে চাইলাম?"
বললাম, "বরং রিলিভড হইলাম। বড় বড় ম্যাসেজ লিখতে হবে না আর!"
মৃদু হাসির পর বললেন, "আসলে আমার টাইপিং খুব স্লো। আর কথা বলতেও ইচ্ছে করছিলো কারও সাথে!"
অবাক হলাম। হওয়ারই কথা। কথা বলতে চাইলে আশেপাশের পরিচিতদের শরণাপন্ন হলেই তো পারেন! অপরিচিত একজনকে কল দিতে হবে কেন ফেসবুকে?
সে প্রশ্ন চেপে বললাম, "ভালো করেছেন। আমিও অকারণে বসে আছি আর সিগারেট খাচ্ছি।"
"অকারণে বসে আছো কেন?"
"বন্ধুরা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। আমিও আবেদন করছিলাম মানে সিভি দিছিলাম আরকি। কিন্তু ওরা আমাকে প্রিলির জন্যেও ডাকে নাই!"
সহানুভূতি আশা করেছিলাম। মহিলা তার ধার দিয়েও গেলেন না। উলটো বললেন, "তোমার রেজাল্ট সার্টেইনলি খারাপ। তাই ডাকে নাই। তুমি ব্যাংকের হর্তাকর্তা হলে তোমার ব্যাংকে খারাপ ছাত্র রাখতে? খারাপ ছাত্র, আমার মতে, ভালো এম্পলয়ি হয় না!"
একথার কী জবাব হয়?
বললাম, প্রসঙ্গ পালটে, "আপনি সেবার বই পড়তেন বললেন। তার মানে আপনার একটা বেশ হিউজ কালেকশন আছে ওদের বইয়ের, তাই না? আমার ভাল্লাগে না বটে তবে ওদের কিছু ভিন্টেজ বই কিন্তু বিক্রি করলে ভালো দাম পাবেন!"
ফাতেমা রেজিনা বললেন, "বইগুলা আমার না। আমার হাসবেন্ডের। আমি এখন মাঝেমাঝে পড়ি সময় কাটাতে। আর টাকারও খুব একটা দরকার নাই আসলে। কোনদিন দরকার পড়লে তোমাকে জানাবো। মনে হয়, সেদিন আসবে না কোনদিন!"
ছ্যাবলার মতো হাসলাম। মহিলা বেশ চতুর। সে যে একেবেলে না, বেশ বিত্তশালী- কী নিপুণভাবে বুঝিয়ে তা দিলেন!
আমরা এক্কেবারে অপরিচিতের নিকট অহংকার করতেও পিছপা হই না!
বললাম, "ভালো লাগল জেনে। আচ্ছা, আপনি কী করেন? আপনার প্রোফাইল লক, আমি দেখতে পাইনি কিছুই!"
"কিছু না। হাউসওয়াইফ!"
এতক্ষণে বুঝলাম, কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছার রহস্য।
বললাম, "আপনাকে তো শিক্ষত মনে হচ্ছে। তবু কিছু করেন না যে?"
প্রশ্নটা করে ভুল করলাম কিনা জানি না, তবে আনন্দ পেলাম বিপুল। স্যাডিস্টিক আনন্দ। অনেকক্ষণ থেকে ভদ্রমহিলা আমাকে খোঁচাচ্ছিলেন।
"আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি ২০০৫ এ। আমার হাজবেন্ড বুয়েটের। ও এতো ভালো চাকরি করে, আমার চাকরির দরকার পড়ে নাই।"
বললাম, "আপনার তো বাড়িতে বিরক্ত লাগার কথা!"
বলল, "প্রথম দিকে লাগেনি। মানে বিয়ে করেছি ২০০৬ এ। বিয়ের পরেই বাচ্চা। ওদের সামলাতে সামলাতেই ৪/৫ বছর চলে গেলো। ততোদিনে চাকরির বয়স, গভমেন্ট জবের আরকি, চলে গেলো। বাচ্চাও বড় হয়ে গেলো। ওদের কলেজ কলেজ, আর এদিকে আমি বাড়িতে একা!"
"আপনার বাচ্চা একটাই?"
বলল, "না দুইজন। একজন কলেজে ভর্তি হলো এবারে। ছোটটা এইটে।"
"তাহলে তো আপনি সত্যিই একা। তবে এই চাকরি বা অন্য কিছু না করার সিদ্ধান্তটা মারাত্মক ভুল ছিলো। ময়মনসিংহ কৃষিতে ভালো ছাত্রছাত্রী ছাড়া কেউ চান্সই পায় না। আপনি সেখানে এতো ভালো জায়গা থেকে পড়ে বসে আছেন। প্যাথেটিক!"
"হ্যাঁ। এটা আমিও ভাবি এখন। আমার বন্ধু বান্ধবেরা ভালো ভালো জায়গায় আছে। ওদের সাথে দেখা হলে এখন লজ্জা লাগে।"
"চাকরি না করার সিদ্ধান্তটা আপনার ছিলো নাকি আপনার উপর কেউ চাপায় দিছে?"
একটু ভাবলেন ভদ্রমহিলা। তারপর বললেন, "দুইটাই। শশুর শাশুড়ি বলল, চাকরি করে কী হবে, আমার হাজবেন্ড তো ভালো বেতন পায়ই। আর পারিবারিক একটা ব্যাবসাও আছে আরকি। আমার হাসবেন্ড কিছু বলে নাই। তবে ওর মত ওর বাবামায়ের থেকে ডিফ্রেন্ট ছিলো না। আমি বুঝতাম!"
ব্যাঙ্গ করে বললাম, "এটাই তো দরকার। স্বামী মুখে কিছু বলল না, আপনি বুঝে গেলেন মুখ চোখ দেখেই। এই না হলে পরহেজগার স্ত্রী!"
হাসলেন উনিও। বললেন, "না না। এমন না যে কথা হয় নাই এটা নিয়ে। ওর কোন উৎসাহ ছিলো না!"
বললাম, "দোষটা আপনারই। ওর উৎসাহের উপর আপনি ডিপেন্ডেন্ট হবেন কেন? শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে, এটা তো, যাকে বলে সেল্ফ এভিডেন্ট যে মেয়েটা এখন কিছু করবে। নইলে এতোদিন ধরে পড়লো কেন কষ্ট করে?"
"হু। আসলেই! তবে ঐ যে বললাম, বয়স শেষ হয়ে গেছে বাচ্চা বড় করতে করতে। ওটাও কারণ ছিলো একটা।"
"প্রাইভেট জব তো ছিলোই। সেখানে তো আর বয়সের ব্যারিয়ার নাই!"
বললেন, "আমার হাজবেন্ড আবার প্রাইভেট জবে এলার্জিক। শুনবেই না ওই কথা। মেয়েদের নাকি অনেক বাজেভাবে ট্রিট করে, অনেক কুপ্রস্তাব আসে। বোঝো তো!"
চাকরিক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হয়রানি বা অকারণ চাপের মুখোমুখি হতে হয়, সেটা প্রায় সবারই জানা। কিন্তু সবাই তাই বলে ঘরে বসে থাকলে, এই সংস্কৃতি বদলাবে না কোনদিন। অবস্থার পরিবর্তন এর মধ্যেই হয়ে গেছে অনেকটা।
কথাটা বললাম না তাকে। শুধু বললাম, "আপনি যেসব বললেন, সেসব সত্য। তবে আপনার স্বামী একটু যদি সাপোর্ট দিতেন বা যদি আরেকটু কম পোজেসিভ হতেন, তাহলে হয়তো আপনাকে আজ এভাবে একঘেয়েমি জীবন যাপন করতে হতো না।"
তিনিই কথা ঘুরিয়ে বললেন, "তোমার আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে না তো?"
"না আপনার কণ্ঠ খুব সুরেলা। কথা বলার চেয়ে শুনতে ভালো লাগছে বেশি!"
মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, "তাই নাকি? অনেকদিন পর প্রশংসা শুনলাম!"
"আপনি বললেন, কথা বলতে ইচ্ছে করছিল কারো সাথে। আপনার কণ্ঠস্বর যারা অলরেডি শুনেছে, তাদের তো আপনার সাথে যেচে কথা বলার কথা!"
"হা হা। আসলে আমার পরিচিতদের সাথে কথা বলার আগ্রহ নাই কোন। মন খুলে কথা বলতে পারি না। অপরিচিতদেরই ভালো লাগে! তবে এখানেও অনেকে জ্বালায়। সবাইকে ভালো লাগেনা। নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ার মানুষের সাথেই কথা বলি আরকি!"
"তাই নাকি? আপনি অপরিচিতদের সাথে তাহলে নিয়মিত কথা বলেন? ফেসবুকে কল দিয়ে?"
"হ্যাঁ। বলি। প্রায়ই বলি। তবে বেশিরভাগের সাথে কথা বলেই আনন্দ পাই না। যাদের ভালো লাগে, পোস্ট পড়ে, ছবি দেখে, তাদের কল দেই। অনেকে অবশ্য কথা বলতে চায় না। ওদের গফ ঝামেলা করবে নাকি!"
বললাম, "সে একটা বড় সমস্যা বটে। গফ থাকলে ঝামেলা করারই কথা! কী নিয়ে কথা বলেন?"
"সবকিছু নিয়েই। এই যে তোমার সাথে আমার চাকরি না করা নিয়ে ফ্রাস্ট্রেশান ঝাড়লাম, এটা পরিচিত কারও সাথে পারতাম? ওরা জাজ করতো। অথচ তোমাকে বলতে আমার বাঁধলো না!"
জহু হলের পুকুর পাড়টার চেয়ে প্রশান্ত পরিবেশ হয়তো মূল ঢাকায় কোথাও পাওয়া যাবে না। ধারে ধারে বিশাল সাইজের কিছু গাছ। তাদের পাতায় সারাদিন আলোছায়া খেলে, পাখি দোলে, ডাকে। কিছুদিন আগেও ছাত্ররা নিয়মিত গোসল করতো পুকুরে। সাম্প্রতি এক ছাত্র ডুবে মরে যাওয়ায় বন্ধ হয়েছে গোসল করা।
এই দগ্ধ দুপুরে কোথা থেকে যেন আসছে একটা চোরা হাওয়া। জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর। চিল ডাকছে একটা বাচ্চার মতো স্বরে কাছে কোথাও। শ্রীকান্ততে বাচ্চার ডাকের সাথে চিলের ডাকের তুলনা দিয়েছিলেন। সে কারণেই বোধহয় ছোট বাচ্চার কান্নার সাথে আমি এতো চিলের ডাকের মিল পাই।
বললাম, "ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আপনার এই র্যান্ডম কথা বলাটা। তবে ভাগ্যিস আপনি নারী। পুরুষ হলে কোথাও পাত্তা পেতেন না!"
ফাতেমা রেজিনা আবার হাসলেন সামান্য। বললেন, "এবসুলেটলি। আমার কোনদিন কথা বলার মানুষের অভাব হয়নি অনলাইনে। যাকেই কল দিয়েছি, কথা অন্তত বলেছে!"
"আপনার হাবি জানে ব্যাপারটা?"
জোর দিয়ে বললেন, "ইম্পসিবল! যা পোজেসিভ। কিছুদিন আগে একটা গেটটুগেদার ছিলো। বন্ধুরা আসবে জানার পর যাইতে দেয় নাই!"
বিস্মিত হয়ে বললাম, "তাই বলে এতোদিন পরও পোজেসিভনেস থাকবে? আপনাদের বিয়ে হওয়ার তো প্রায় ২০ বছর হয়ে গেলো!"
"আমিও বুঝি না ওর ব্যাপারস্যাপার!"
বললাম, "এখন বুঝতেছি আপনি কেন জবটব করেন না। আপনার স্বামী আসলে চায়ই না আপনি কিছু করেন!"
"হতে পারে। তবে কি জানো, আমি কিন্তু সুন্দরী। আম নট ব্রাগিং বাট ইটস ট্রু। কোথাও গেলে মানুষ যেভাবে তাকায়, তাতে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগে!"
"তাইলে তো সব সুন্দরীরই ঘরে বন্দী থাকা উচিত!"
এভাবেই চলল কথা সেদিন। আলবাল বিষয়েই সব কথাবার্তা। একজন মধ্যবয়সী নারীর সাথে এমন নিরামিষ ব্যাপারে কথা বলতে আমি খুব উদ্বাহু ছিলাম, এমন না।
তবে সেদিনের পর কথা হতো মাঝেমাঝে। টুকরো কথা। আমি নিজে থেকে তাকে নক করিনি কোনদিন। তিনিই কল দিতেন। এমন সব বিষয়ে কথা বলতেন, যেমন বাচ্চার রেজাল্ট, তার ছাদের বাগানে ফোটা গোলাপ, বাড়িতে পোষা বিড়ালটার ক্ষুধা মন্দা ইত্যাদি, সেসব বিষয়ে আমার কেন, যে কারোরই আগ্রহ থাকার কথা নয়। কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলাম আমিই।
ব্যক্তগত জীবন, চাকরির পড়াশুনা, সদ্য জোটানো একটা গফ- ভালোই যাচ্ছিলো দিনকাল। পৃথিবীতে এতো এতো অকর্মণ্য আছে, তাদের মধ্যে কোথায় কে একজন বিলাসিতায় ডুবে থেকেও একাকিত্বে ভুগছে- সে সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক আমি ছাড়াও ছিলো অনেকেই।
২
"ধন্যবাদ অনেক। অন্তত একজন আমার সাথে একমত!"
প্রোফাইল লকড। বিয়ে বাড়িতে তোলা একটি ছবি প্রোফাইলে ঝোলানো।
"তোমার চিন্তা ভালো লেগেছে আমার। আমিও মাঝেমাঝে মাসুদ রানা পড়তাম। এখন আর ওভাবে পড়তে পারবো না!"
লিখলাম, "সরি। আপনার আনন্দের একটা মাধ্যমকে প্রশ্ন করলাম। আমি পোস্টটা না লিখলে হয়তো আপনি আগের মতোই উপভোগ করতেন!"
"না ঠিক সেটা না। তুমি আসলেই ঠিক লিখছো। আমাদের সময়, মানে মোবাইল হাতে হাতে আসার আগে আরকি, বিনোদনের তো কোন উপায় ছিলো না। সেবা প্রকাশনী বলো, অন্যান্য প্রেমের সস্তা নভেল বলো, এসবই বিনোদনের মাধ্যম ছিলো। ছেলেমেয়েরা অবসরে কী করবে বলো? এসবের মান নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি। সময় কাটানো ছিলো কথা!"
উত্তর এলো ওপ্রান্ত হতে।
ম্যাসেজে বড় বড় কথা লেখাটা বিরক্তিকর। তবুও লিখলাম, "হ্যাঁ। নইলে সে সময়ে এতো বই বিক্রি হতো না। পত্রিকা, সাময়িকীও চলতো। অথচ ছিলো তো ওসব ট্রাশ।"
"তোমার সাথে কি কথা বলা যাবে?"
হঠাৎ প্রশ্ন। বসে ছিলাম জহু হলের পুকুরপাড়ে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কল দিলাম সরাসরি।
"হ্যালো" বলতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো, "তুমি কিছু মনে করো নাই তো আবার? হঠাৎ কথা বলতে চাইলাম?"
বললাম, "বরং রিলিভড হইলাম। বড় বড় ম্যাসেজ লিখতে হবে না আর!"
মৃদু হাসির পর বললেন, "আসলে আমার টাইপিং খুব স্লো। আর কথা বলতেও ইচ্ছে করছিলো কারও সাথে!"
অবাক হলাম। হওয়ারই কথা। কথা বলতে চাইলে আশেপাশের পরিচিতদের শরণাপন্ন হলেই তো পারেন! অপরিচিত একজনকে কল দিতে হবে কেন ফেসবুকে?
সে প্রশ্ন চেপে বললাম, "ভালো করেছেন। আমিও অকারণে বসে আছি আর সিগারেট খাচ্ছি।"
"অকারণে বসে আছো কেন?"
"বন্ধুরা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। আমিও আবেদন করছিলাম মানে সিভি দিছিলাম আরকি। কিন্তু ওরা আমাকে প্রিলির জন্যেও ডাকে নাই!"
সহানুভূতি আশা করেছিলাম। মহিলা তার ধার দিয়েও গেলেন না। উলটো বললেন, "তোমার রেজাল্ট সার্টেইনলি খারাপ। তাই ডাকে নাই। তুমি ব্যাংকের হর্তাকর্তা হলে তোমার ব্যাংকে খারাপ ছাত্র রাখতে? খারাপ ছাত্র, আমার মতে, ভালো এম্পলয়ি হয় না!"
একথার কী জবাব হয়?
বললাম, প্রসঙ্গ পালটে, "আপনি সেবার বই পড়তেন বললেন। তার মানে আপনার একটা বেশ হিউজ কালেকশন আছে ওদের বইয়ের, তাই না? আমার ভাল্লাগে না বটে তবে ওদের কিছু ভিন্টেজ বই কিন্তু বিক্রি করলে ভালো দাম পাবেন!"
ফাতেমা রেজিনা বললেন, "বইগুলা আমার না। আমার হাসবেন্ডের। আমি এখন মাঝেমাঝে পড়ি সময় কাটাতে। আর টাকারও খুব একটা দরকার নাই আসলে। কোনদিন দরকার পড়লে তোমাকে জানাবো। মনে হয়, সেদিন আসবে না কোনদিন!"
ছ্যাবলার মতো হাসলাম। মহিলা বেশ চতুর। সে যে একেবেলে না, বেশ বিত্তশালী- কী নিপুণভাবে বুঝিয়ে তা দিলেন!
আমরা এক্কেবারে অপরিচিতের নিকট অহংকার করতেও পিছপা হই না!
বললাম, "ভালো লাগল জেনে। আচ্ছা, আপনি কী করেন? আপনার প্রোফাইল লক, আমি দেখতে পাইনি কিছুই!"
"কিছু না। হাউসওয়াইফ!"
এতক্ষণে বুঝলাম, কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছার রহস্য।
বললাম, "আপনাকে তো শিক্ষত মনে হচ্ছে। তবু কিছু করেন না যে?"
প্রশ্নটা করে ভুল করলাম কিনা জানি না, তবে আনন্দ পেলাম বিপুল। স্যাডিস্টিক আনন্দ। অনেকক্ষণ থেকে ভদ্রমহিলা আমাকে খোঁচাচ্ছিলেন।
"আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি ২০০৫ এ। আমার হাজবেন্ড বুয়েটের। ও এতো ভালো চাকরি করে, আমার চাকরির দরকার পড়ে নাই।"
বললাম, "আপনার তো বাড়িতে বিরক্ত লাগার কথা!"
বলল, "প্রথম দিকে লাগেনি। মানে বিয়ে করেছি ২০০৬ এ। বিয়ের পরেই বাচ্চা। ওদের সামলাতে সামলাতেই ৪/৫ বছর চলে গেলো। ততোদিনে চাকরির বয়স, গভমেন্ট জবের আরকি, চলে গেলো। বাচ্চাও বড় হয়ে গেলো। ওদের কলেজ কলেজ, আর এদিকে আমি বাড়িতে একা!"
"আপনার বাচ্চা একটাই?"
বলল, "না দুইজন। একজন কলেজে ভর্তি হলো এবারে। ছোটটা এইটে।"
"তাহলে তো আপনি সত্যিই একা। তবে এই চাকরি বা অন্য কিছু না করার সিদ্ধান্তটা মারাত্মক ভুল ছিলো। ময়মনসিংহ কৃষিতে ভালো ছাত্রছাত্রী ছাড়া কেউ চান্সই পায় না। আপনি সেখানে এতো ভালো জায়গা থেকে পড়ে বসে আছেন। প্যাথেটিক!"
"হ্যাঁ। এটা আমিও ভাবি এখন। আমার বন্ধু বান্ধবেরা ভালো ভালো জায়গায় আছে। ওদের সাথে দেখা হলে এখন লজ্জা লাগে।"
"চাকরি না করার সিদ্ধান্তটা আপনার ছিলো নাকি আপনার উপর কেউ চাপায় দিছে?"
একটু ভাবলেন ভদ্রমহিলা। তারপর বললেন, "দুইটাই। শশুর শাশুড়ি বলল, চাকরি করে কী হবে, আমার হাজবেন্ড তো ভালো বেতন পায়ই। আর পারিবারিক একটা ব্যাবসাও আছে আরকি। আমার হাসবেন্ড কিছু বলে নাই। তবে ওর মত ওর বাবামায়ের থেকে ডিফ্রেন্ট ছিলো না। আমি বুঝতাম!"
ব্যাঙ্গ করে বললাম, "এটাই তো দরকার। স্বামী মুখে কিছু বলল না, আপনি বুঝে গেলেন মুখ চোখ দেখেই। এই না হলে পরহেজগার স্ত্রী!"
হাসলেন উনিও। বললেন, "না না। এমন না যে কথা হয় নাই এটা নিয়ে। ওর কোন উৎসাহ ছিলো না!"
বললাম, "দোষটা আপনারই। ওর উৎসাহের উপর আপনি ডিপেন্ডেন্ট হবেন কেন? শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে, এটা তো, যাকে বলে সেল্ফ এভিডেন্ট যে মেয়েটা এখন কিছু করবে। নইলে এতোদিন ধরে পড়লো কেন কষ্ট করে?"
"হু। আসলেই! তবে ঐ যে বললাম, বয়স শেষ হয়ে গেছে বাচ্চা বড় করতে করতে। ওটাও কারণ ছিলো একটা।"
"প্রাইভেট জব তো ছিলোই। সেখানে তো আর বয়সের ব্যারিয়ার নাই!"
বললেন, "আমার হাজবেন্ড আবার প্রাইভেট জবে এলার্জিক। শুনবেই না ওই কথা। মেয়েদের নাকি অনেক বাজেভাবে ট্রিট করে, অনেক কুপ্রস্তাব আসে। বোঝো তো!"
চাকরিক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হয়রানি বা অকারণ চাপের মুখোমুখি হতে হয়, সেটা প্রায় সবারই জানা। কিন্তু সবাই তাই বলে ঘরে বসে থাকলে, এই সংস্কৃতি বদলাবে না কোনদিন। অবস্থার পরিবর্তন এর মধ্যেই হয়ে গেছে অনেকটা।
কথাটা বললাম না তাকে। শুধু বললাম, "আপনি যেসব বললেন, সেসব সত্য। তবে আপনার স্বামী একটু যদি সাপোর্ট দিতেন বা যদি আরেকটু কম পোজেসিভ হতেন, তাহলে হয়তো আপনাকে আজ এভাবে একঘেয়েমি জীবন যাপন করতে হতো না।"
তিনিই কথা ঘুরিয়ে বললেন, "তোমার আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে না তো?"
"না আপনার কণ্ঠ খুব সুরেলা। কথা বলার চেয়ে শুনতে ভালো লাগছে বেশি!"
মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, "তাই নাকি? অনেকদিন পর প্রশংসা শুনলাম!"
"আপনি বললেন, কথা বলতে ইচ্ছে করছিল কারো সাথে। আপনার কণ্ঠস্বর যারা অলরেডি শুনেছে, তাদের তো আপনার সাথে যেচে কথা বলার কথা!"
"হা হা। আসলে আমার পরিচিতদের সাথে কথা বলার আগ্রহ নাই কোন। মন খুলে কথা বলতে পারি না। অপরিচিতদেরই ভালো লাগে! তবে এখানেও অনেকে জ্বালায়। সবাইকে ভালো লাগেনা। নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ার মানুষের সাথেই কথা বলি আরকি!"
"তাই নাকি? আপনি অপরিচিতদের সাথে তাহলে নিয়মিত কথা বলেন? ফেসবুকে কল দিয়ে?"
"হ্যাঁ। বলি। প্রায়ই বলি। তবে বেশিরভাগের সাথে কথা বলেই আনন্দ পাই না। যাদের ভালো লাগে, পোস্ট পড়ে, ছবি দেখে, তাদের কল দেই। অনেকে অবশ্য কথা বলতে চায় না। ওদের গফ ঝামেলা করবে নাকি!"
বললাম, "সে একটা বড় সমস্যা বটে। গফ থাকলে ঝামেলা করারই কথা! কী নিয়ে কথা বলেন?"
"সবকিছু নিয়েই। এই যে তোমার সাথে আমার চাকরি না করা নিয়ে ফ্রাস্ট্রেশান ঝাড়লাম, এটা পরিচিত কারও সাথে পারতাম? ওরা জাজ করতো। অথচ তোমাকে বলতে আমার বাঁধলো না!"
জহু হলের পুকুর পাড়টার চেয়ে প্রশান্ত পরিবেশ হয়তো মূল ঢাকায় কোথাও পাওয়া যাবে না। ধারে ধারে বিশাল সাইজের কিছু গাছ। তাদের পাতায় সারাদিন আলোছায়া খেলে, পাখি দোলে, ডাকে। কিছুদিন আগেও ছাত্ররা নিয়মিত গোসল করতো পুকুরে। সাম্প্রতি এক ছাত্র ডুবে মরে যাওয়ায় বন্ধ হয়েছে গোসল করা।
এই দগ্ধ দুপুরে কোথা থেকে যেন আসছে একটা চোরা হাওয়া। জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর। চিল ডাকছে একটা বাচ্চার মতো স্বরে কাছে কোথাও। শ্রীকান্ততে বাচ্চার ডাকের সাথে চিলের ডাকের তুলনা দিয়েছিলেন। সে কারণেই বোধহয় ছোট বাচ্চার কান্নার সাথে আমি এতো চিলের ডাকের মিল পাই।
বললাম, "ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আপনার এই র্যান্ডম কথা বলাটা। তবে ভাগ্যিস আপনি নারী। পুরুষ হলে কোথাও পাত্তা পেতেন না!"
ফাতেমা রেজিনা আবার হাসলেন সামান্য। বললেন, "এবসুলেটলি। আমার কোনদিন কথা বলার মানুষের অভাব হয়নি অনলাইনে। যাকেই কল দিয়েছি, কথা অন্তত বলেছে!"
"আপনার হাবি জানে ব্যাপারটা?"
জোর দিয়ে বললেন, "ইম্পসিবল! যা পোজেসিভ। কিছুদিন আগে একটা গেটটুগেদার ছিলো। বন্ধুরা আসবে জানার পর যাইতে দেয় নাই!"
বিস্মিত হয়ে বললাম, "তাই বলে এতোদিন পরও পোজেসিভনেস থাকবে? আপনাদের বিয়ে হওয়ার তো প্রায় ২০ বছর হয়ে গেলো!"
"আমিও বুঝি না ওর ব্যাপারস্যাপার!"
বললাম, "এখন বুঝতেছি আপনি কেন জবটব করেন না। আপনার স্বামী আসলে চায়ই না আপনি কিছু করেন!"
"হতে পারে। তবে কি জানো, আমি কিন্তু সুন্দরী। আম নট ব্রাগিং বাট ইটস ট্রু। কোথাও গেলে মানুষ যেভাবে তাকায়, তাতে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগে!"
"তাইলে তো সব সুন্দরীরই ঘরে বন্দী থাকা উচিত!"
এভাবেই চলল কথা সেদিন। আলবাল বিষয়েই সব কথাবার্তা। একজন মধ্যবয়সী নারীর সাথে এমন নিরামিষ ব্যাপারে কথা বলতে আমি খুব উদ্বাহু ছিলাম, এমন না।
তবে সেদিনের পর কথা হতো মাঝেমাঝে। টুকরো কথা। আমি নিজে থেকে তাকে নক করিনি কোনদিন। তিনিই কল দিতেন। এমন সব বিষয়ে কথা বলতেন, যেমন বাচ্চার রেজাল্ট, তার ছাদের বাগানে ফোটা গোলাপ, বাড়িতে পোষা বিড়ালটার ক্ষুধা মন্দা ইত্যাদি, সেসব বিষয়ে আমার কেন, যে কারোরই আগ্রহ থাকার কথা নয়। কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলাম আমিই।
ব্যক্তগত জীবন, চাকরির পড়াশুনা, সদ্য জোটানো একটা গফ- ভালোই যাচ্ছিলো দিনকাল। পৃথিবীতে এতো এতো অকর্মণ্য আছে, তাদের মধ্যে কোথায় কে একজন বিলাসিতায় ডুবে থেকেও একাকিত্বে ভুগছে- সে সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক আমি ছাড়াও ছিলো অনেকেই।