23-10-2023, 08:52 PM
উপরের অংশের পর
রাতের আকাশের নিচে দুই পুরুষে মিলে ছাদে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে গল্প করছি। ঘুড়ন্ত গোলকের মাঝে দুটি অনু যেন নিজের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেই কবে কোথায় প্রথম দেখা, দুই বন্ধুর ঝগড়া, ক্লাসে জানলার ধারে বসে থাকা শান্ত ছেলেটার পেছনে লাগা থেকে পারিবারিক জীবন ও সেই বাঙালির অতি প্রিয় সাবজেক্ট স্ট্রাগল নিয়ে আলোচনা। মনে পড়ে ছোটবেলায় একবার দুই বন্ধুতে মাঠে খেলে ফেরার পথে ঝোপের ধারে মূত্রত্যাগের কথা। জায়গাটা ছিল কিছুটা উঁচু আর নিচে ঝোপটা নেমে গেছে অনেকটা। ইচ্ছে করেই ব্যাটাকে দিয়েছিলাম ধাক্কা। যদিও খুবই ধীরে তাতে বন্ধুটি এই এই করে চেঁচিয়ে উঠেছিল। যদিও একটু পরেই ফিক করে হেসে একটা অশ্লীল নামে আমায় ডেকে উঠে ছিল। আজও আমরা তেমনই একটা মুহূর্তে উপস্থিত। নিচের অন্ধকার অংশটা যেন বড্ড টানছে আমাকে। মাথার মধ্যে কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ফিসফিস করে বলছে " এইতো সুযোগ, দেখো কতটা কাছে দাঁড়িয়ে সে। দাও একটা ধাক্কা। ব্যাস তারপরেই তোমার সামনে আর কোনো বাঁধা থাকবেনা। অমন রমণী তোমার একার হবে। তাকে নিয়ে তখন যা খুশি করতে পারবে তুমি। তোমার সজ্জাসঙ্গিনী হয়ে ধন্য হয়ে যাবে সে। তার খুশির জন্য, তাকে পূর্ণতা দেবার জন্য কাজটা করতেই হবে তোমার। এই সুযোগ বারবার আসেনা। নাও দাও ধাক্কা!"
এই একটু আগেও তো আমার পাশে দাঁড়িয়ে কিসব যেন বলছিলো মানুষটা। এখন আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই সে। ওই নিচের অন্ধকারে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার পাশটা এখন ফাঁকা। ওটাকে পূর্ণ করতে হবে এবার আমায়। আমার অন্তরের সেই অচেনা কৃমিটা আমায় পশু বানিয়ে দিলো আজ। আর এই পশু এবার নবরূপে বিকশিত হবে। ওই বিছানায় আমার অধিকার, শুধুই আমার! আমার প্রেমকে ছিনিয়ে নিতে প্রেমিকাকেও প্রয়োজনে.........
এতটা পর্যন্ত লিখে থেমে গেলাম। নাহ..... এই মুহূর্তে আর কিছু মাথায় আসছেনা আগামী অংশের জন্য। ভেবেছিলাম রাতের মধ্যেই আমার গল্পের নায়ককে পাঠাবো তার প্রেয়সীর ঘরে। তারপরে সারারাত চলবে মদন খেলা কিন্তু আর পারছিনা। এইটুকু লিখে আজকের মতো মতো লেখাকে বিদায় জানিয়ে শুয়ে পড়লাম আমার জন্য নির্ধারিত বিছানায়। এই নতুন অংশটা একটু আগেই মাথায় এসেছে তাই চটপট লিখে রাখলাম। কিছু সময় পূর্বে সেই প্রতিবাদী মহিলার হাতের রান্নার স্বাদ নিয়ে মোরা দুই বন্ধুতে এ বাড়ির ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। সত্যিই অতীতের নানান সব কথা হারিয়ে যাওয়া জাহাজের নিচ থেকে উদ্ধার করে মণি মুক্তার ন্যায় বার করে আনছিলাম। ওই যে ধাক্কার কথাটি উল্লেখ করেছি..... উহা সত্যিই বাস্তব রূপ নিয়েছিল আমাদের শৈশবে। মানুষ বাস্তব থেকেই তো অনুপ্রেরণা পায়। কল্পনার রসদ তো লুকিয়ে থাকে আশেপাশেই। আমার বন্ধু ভীতুর ডিমটা ভয় পেয়ে তো নিজেই গেলাম গেলাম রব তুলে উল্টে পড়ছিলো হেহেহ। বড্ড ভালোমানুষ আমার ওই বন্ধুটা। মনটাতে ময়লা জমতে দেয়নি। আর সেই উপহার স্বরূপ বোধহয় এমন একজন গৃহনিপুনা অপ্সরা জুটেছে তার কপালে। যে সাংসারিক জীবনে লক্ষী হয়ে সব সামলে চলছে আবার অন্যদিকে নিজ কক্ষে মেনকা রূপে স্বামীকে পূর্ণতার সুখ দিয়ে চলেছে অনবরত। যত চিনছি তাকে ততই যেন অবাক হয়ে যাচ্ছি। আগের জন্মে নির্ঘাত বিখ্যাত কোনো নাট্যকর্মী ছিল সে। নইলে সন্ধ্যার সেই প্রতিবাদী ভাবমূর্তি সবটা লুকিয়ে একেবারে শান্ত মেয়েটা হয়ে অমন ধীর কণ্ঠে কিকরে বলতে পারে " আপনি তো কিছুই নিচ্ছেন না, আরেকটা মাছ দি?" এই মানুষটার সাথে এ গৃহে আসার পরেই পরিচিত হয়ে তার রূপের জাদুতে মুগ্ধ হলেও তার সেই ভিন্ন রূপটা আমাকে বাধ্য করেছে তাকে সম্মান করতে। তার মধ্যেকার লুকানো কষ্ট যেন সামান্য অংশে বেরিয়ে এসেছিলো আজ এই কক্ষে। হয়তো অনেক কিছুই বলার আছে তার কিন্তু উপায় নেই। তাই সে নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়েছিল। কিন্তু সেখানেই তো সমস্যাটা। কেন সে নিজেকে মুক্ত করলোনা? কেন সে আরও কয়েকটা কটু কথা বলে আমার লেখক রূপটাকে অপমান করলোনা? কেন আমায় অন্তর থেকে চিনতে পেরেও আমার দুই গালে সপাটে দুটো চড় মারলোনা? একটিবার যদি সে এই কাজটি করতো তাহলেই তো......... নাহ বড্ড একা আমি। নিজের গৃহে থাকলেও একা, এখানেও তাই। এই নিশি রাতের চাদর মুড়ে পথে পথে গল্প বেচা এক ফেরিওয়ালা ছাড়া আমি আর কিছুই নয়।
নানা! আমি ভুল বললাম। আছে তো! সে আছে আমার সাথে। সেদিনও ছিল, আজও আছে। কেন যে ভুলে যাই বারবার? ঐযে! জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সে মুচকি মুচকি হাসছে। বড্ড রাগ হয় আমার ওই হাসি দেখলে। যেন আমার অসহায় অবস্থাটাকে ব্যঙ্গ করতেই সে হাসে। এদিকে আমি নিজের জ্বালায় জ্বলছি আর সেই নগ্নীকা মুখ টিপে হেসেই চলেছে। একদিকে বন্ধুর বোন আমায় যার চোখের দিকে তাকালে আমি কমজোর হয়ে যাই, অন্যদিকে বন্ধুপত্নী যার চোখের আগুনে জ্বলতে ইচ্ছে জাগে আরেকজন ইনি যে প্রতিনিয়ত আমায় অন্তর থেকে জাগিয়ে পালিয়ে যায়। সেই দিনও পালিয়ে গেছিলো যেদিন....... হ্যা মনে পড়ে সেদিন। দুটো হাত আমায় নিজের মধ্যে চেপে বলেছিলো " আমি শুধুই তোমার, তোমারই থাকবো"। সে কথা রেখেছে। সে সেদিনের পর থেকে আমার সাথেই থাকে। শুধু মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় ক্ষনিকের জন্য। চঞ্চলা সে বড্ড।
আমার পাশে এসে চুপটি করে বসে সে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমিও চেয়ে তার পানে। জানলা দিয়ে আসা চন্দ্রমার আলোয় যেন হটাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারিপাশ। ছাতিমের গন্ধটায় যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। কিছু সময় পরেই মা নিজের ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি আসবেন। আবার ফিরেও যাবেন। রেখে যাবেন নানান সব সুখের স্মৃতি আর নিয়ে যাবেন জমে থাকা দুঃখ। তারপরে আবার নতুন করে ভরতে থাকবে জীবন রোমাঞ্চ,নতুন উদ্বেগ, নতুন দুঃখের ঝুলি। এমন একটা মহেন্দ্রক্ষনে আমিও কেন যে শৈশবে হারিয়ে যাচ্ছি জানিনা। পাশে সুন্দরী রমণী আমার পানে চেয়ে আর আমি কিনা কোনকালে গুরুজনের হাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়িয়েছি সেসব গুনতে শুরু করেছি। অজান্তেই চোখ থেকে একফোঁটা অবাধ্য তরল আমার গাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে জানতেও পারিনি। বিছানায় আমার পাশে অবশিষ্ট সামান্য জায়গাটুকুতে শায়িত হয়ে সে বললো "কি মহাশয়? গপ্পে মন বসছেনা বুঝি? অন্য সময় হলে তো রাত গভীর হয়ে গেলেও হাত থামতো না। এখন বুঝি লেখার থেকেও অধিক ভালোবাসার কিছু খুঁজে পেয়ে লেখার ভাষা হারিয়ে ফেলেছো?"
কি আশ্চর্য। এই রমণী বারবার কিকরে খুঁজে পায় আমার গোপনে লুকিয়ে রাখা ইচ্ছের ও অনুভূতির ঠিকানা? আগে তো অক্ষম ছিল সে। কি গুনে এসব আয়ত্ত করলো সে? আমার গাল বেয়ে বয়ে যাওয়া জল টুকু মুছে সে আমায় নিজের সাথে লেপ্টে নিলো। ঠিক যেভাবে ছোটবেলায় আমার জননীর কোলে আমি মুখ লুকাতাম আজও সেইভাবে নিজেকে অন্ধকারে মিশিয়ে দিয়ে শুয়ে রইলাম। সত্যিই.... মাথায় কিছুই আসছেনা। আমি যেন লেখার প্রগতির পথ খুঁজে পাচ্ছিনা। এই তো কিছুদিন আগেও নজরে আকর্ষণ করার মতন কিছু পড়লে তখনি মগজে নানান সব বাক্যমেলা কিলবিল করে উঠতো আর আজ? একি হলো আমার? লেখায় মন বসাতে পারছিনা কেন? আগে তো রতিক্রিয়ার বিবরণ লিখে পাতার পর পাতা ভরিয়েছি। নিজের অন্তরে জমে থাকা জঞ্জাল দিয়ে ভরিয়ে তুলেছি ডাইরির পাতাগুলি। সেসবের খোঁজ আমি ছাড়া আর কেউ জানেনি। আজও হয়তো আমার ঘরের কোনো কোণে ধুলো জমে পড়ে রয়েছে সেসব। লেখাপড়ার মাঝে যখনি রিপু দংশন করেছে আমায়, কিংবা আমার কামসঙ্গিনীর সাথে মেতে উঠেছি আদিম খেলায় আমি তা লিখে রেখেছি। বারবার চোখ বুলিয়েছি তাতে। যতদিন সময় পেয়েছি ততদিন। কিন্তু একটা সময় পর আর লিখিনি কিছুই। ফাঁকা রয়ে গেছে শেষের পাতাগুলি। কিছুই তো অবশিষ্ট ছিলোনা লেখার জন্য। কিংবা হয়তো ছিল, আমিই আর লিখতে দিইনি নিজেকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজার ভিতরে উঁকি দেওয়ার পর হাওয়ায় দুলন্ত পা জোড়া আমায় যেন সে সময় অকেজো করে দিয়েছিলো। হেরে যাচ্ছিলাম আমি একটু একটু করে। কিন্তু আমায় সে সময় রক্ষা করেছিল আমার এই ভালোবাসার মানুষটা। কোনো এক গভীর রাতে আমার কাছে এসে ছল ছল নয়নে সে বলেছিলো " আমি হেরেছি বলে কি তুমিও হেরে যাবে? এই তুমি আমার প্রিয় পুরুষ? আমি তোমায় মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন দেখছি আমার দায়িত্ব শেষ হয়নি। আমি এবার তোমার ঘাড়েই চাপলাম বুঝলে ছোড়া? খবরদার যদি আমায় ভয় পেয়েছো। মট করে মটকে দেবো হিহিহিহি। " অশ্রু নয়নে আমি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলেছিলাম সেদিন - "ভালোবাসি! তোমায় আমি ভালোবাসি। " কিন্তু সেই চিৎকার আমার মুখ দিয়ে নয়, তাকে ভালোবেসে আদর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম সে রাতে। তাতে না ছিল শরীরী লোভ, না ছিল যৌন যুদ্ধে জেতার ইচ্ছে। শুধুই কামপুকুরে ভেসে তলিয়ে যাওয়ার আনন্দ। আমি আর কাঁদিনি তার জন্য। কেন কাঁদবো? সেতো আমার সাথেই আছে। যখনই তার সময় হয় সে এসে আমার পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল ঘেঁটে দিয়ে পালিয়ে যায়। বড্ড দস্যি সে। মুক্তি পেয়ে যেন আরও পাখনা গজিয়েছে তার। কিন্তু রাত্রে আমাকে ছাড়া সে থাকতেও পারেনা। বলে নাকি ভয় লাগে। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ার পর প্রতি রাতে বুঝতে পারি কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কিংবা আমার পুরুষালি বক্ষে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। কিন্তু কেন জানি আমি তাকে তখন ছুঁতে পারিনা। এক নির্জীব বস্তুর মতো শুয়ে থাকি। আবার কোনো রাতে তাকে আদরে আদরে পাগল করে দিতেও ছাড়িনা। সবটাই যেন তার ওপর নির্ভর করে।
আজ এই রাতেও সে যেন আমায় নিজের করে পেতে চায়না। বরং আজ তার আমাকে অনেক কিছু বলার আছে। যবে থেকে এই নতুন ঠিকানায় এসেছি তখন থেকে দেখছি তার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। যেন কোনো শয়তানি ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। এতদিনে তাকে চিনতে আমার বাকি নেই। আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে রইলো। অন্ধকারে তার বুকে নিজেকে লুকিয়ে আমিও যেন বহু কক্ষপথ অতিক্রম করে আজ সর্বহারা এক ক্লান্ত পথিক। একটু তৃস্না মেটাতে চাই কিন্তু সেই উৎস খুঁজে এগিয়ে গিয়েও যেন কিছুতেই খোঁজ মিলছেনা পানির। তাই অশ্রু জলেই ভেজাচ্ছি নিজের কণ্ঠ। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে আমায় ঘুম পারিয়ে দিচ্ছে। যেন আমি তার কোলের শিশুটা।
- এইভাবে কমজোর হলে চলবে? তোমায় যে কঠোর হতেই হবে। নিজের জন্য, আমার জন্য। তোমার ওই লেখা যা তোমার কাছে বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন সেটাকে তো এতো সহজে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে পারোনা হে লেখক। ইচ্ছে হোক বা না হোক লিখতে তোমায় হবেই। তুমি যত লিখবে ততো তোমার জীবন শক্তি বাড়বে। আমি যে তোমায় থামতে দিতে পারিনা
- কিন্তু আমি যে সব ভাষা হারিয়ে ফেলছি! আজ হটাৎ করেই মনে হচ্ছে আমি ভুল, আমি এক হেরে যাওয়া মানুষ যে হয়তো জীবনে কোনোদিন কষ্ট দেখেনি, কিন্তু তার অন্তরআত্মা জানে সে কষ্ট অনুভব করেছে প্রতিদিন। তার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে বহুদিন আগেই
- আর সেটাই যে একটা নতুন মানুষকে জন্ম দিয়েছে, আর তার ভেঙে পড়াটা গড়ে তুলেছে তাকে আরও কঠিন আকারে। সেদিনের ভীতু ছেলেটা ঠিক যেভাবে হিংস্র বাঘ হয়ে উঠেছিল, সেইভাবেই এক সাধারণ ছেলে কষ্টে পুড়ে নতুন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে সকলের সামনে। সর্বোপরি নিজের সামনে। অনেক জমানো বেদনা গুলো একের পর এক খাতায় লিপিবদ্ধ করে খ্যাতি অর্জন করছে সে। তাকে তো আমি হেরে যেতে দেখতে পারিনা। আমার সেই হিংস্র বাঘ থাবা মেরে মাংস আদায় করতে জানে, ভীরু হয়ে লেজ ঘুটিয়ে পালাতে শেখায়নি তাকে।
- কিন্তু
- কিন্তু কিন্তু নয়। আমি জানি কেন তুমি ভাষা হারিয়ে ফেলছো। কামের জ্বালায় জ্বলতে থাকা জ্বলন্ত শরীরটা আজ এই প্রথম মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে। একদিকে এগোলে যেমন ঝলসে যাওয়া শরীরটা একটু মলম খুঁজে পাবে অন্যদিকে আরও একটা খোলা পথ। অগ্নিপথ। সে পথের শেষে দাঁড়িয়ে আরেকটি শরীর। যার কাছে গেলে আবারো এই বুক জ্বলে উঠবে কামের আগুনে। আবার সেই বন্য আদিম অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। সুস্বাদু হরিণী মাংস ভক্ষন করবে নাকি হে লেখক?
- করলে মন্দ হয়না কিন্তু
- এই ছিল তাহলে মনের গভীরে লুকানো অভিপ্রায়? শয়তান ছেলে! আমাকে দিয়ে হচ্ছেনা? আরও চাই? খুব লোভ জেগেছে না মনে ওই শরীরটা নিয়ে খেলার? অমন বিদ্রোহী অভিমানী নাগিনীকে বশে আনার মজাই আলাদা কি বলো হে? নাকি সাথে আরও কাউকে চাই যে আবার তোমার কথা ভাবতে ভাবতে এই মাঝরাতেও লজ্জা পাচ্ছে নিজের ঘরে শুয়ে। উফফফফ ছেলে বটে তুমি একখান। একসাথে দু দুটো নারী হৃদয়ে ঢুকে বসে আছো?
- পারুল বড্ড ভালো গো। ওকে নিয়ে খেলতে চাইনা আমি। বরং ওকে তোমার সতীন করবো ভাবছি। তুমি অভিমানী হয়ে দেখবে কিভাবে রোজ রাত্রে তোমার প্রেমিক নিজের ভালোবাসা উজাড় করে দেয় তার ওপর। খুব রাগ হবে না তোমার?
- উহহ...আমার বয়ে গেছে রাগতে। আমি কি জানিনা তোমরা সবকটা এক গোয়ালের। একজনেতে মন ভরেনা। বারবার নতুনের দিকে নজর। তা সে যতই ভদ্রবাবু হয়ে ঘোরো।
- আমাকে অন্য কারোর সাথে লিপ্ত দেখেও রাগ হবেনা তোমার?
- নাগো.... সত্যি বলছি একটুও হবেনা। বরং আমি খুশি হবো আবার আমার সেই পুরুষ সিংহকে ফিরে পেয়ে। তাই তো বলছি আর নয় বেশিদিন। এবার তোমার জীবনে রক্তমাংসের কাউকে নিয়ে এসো। তোমার গৃহে আসুক গৃহলক্ষী আর আমার সতীন। তাকে দিনরাত ভোগ করো। তাকে পোয়াতি করো। যেভাবে আমায় নিজের মতো গড়ে তুলেছিলে ঠিক সেইভাবে তাকেও নিজের করে গড়ে তোলো।
শেষের কথাগুলি বলার সময় তার কণ্ঠে কেমন একটা কম্পন অনুভব করলাম আমি। সেকি কাঁদছে? জানিনা। আমি অনন্ত অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে সেই দেহের রন্ধ্রে মিশে যাবার চেষ্টায় মগ্ন তখন। আমি স্বৈরাচারী, আমি স্বার্থপর, আমি হিংস্র হয়ে উঠছি সে সময়। কোনো কালের জমিদারি সত্তা যেন ক্রমশ বিকাশ পাচ্ছে আমার মধ্যে। মনে হচ্ছে এই নারী শরীর কেন এতো ভালোবাসে আমায়? কেন এতো মায়াময়ী সে? কেন বারবার আমার পুরুষত্ব হার মানে এই নারীর কাছে? খয়ব রাগ হচ্ছে আমার। ঠিক আমার গল্পের নায়কের মতন। ইচ্ছে করছে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি এই লাস্যময়ী শরীরটার ওপর আর ক্ষততে ভরিয়ে দিই তার দেহ কিন্তু আমি অপারক। কেন সে চায় আমি অন্য কারো হই? কেন সে আমায় আটকায় না? কেন প্রতিবার কোনো সুন্দরীর প্রতি আমার লোভ আরও বাড়িয়ে দেয় সে? একি তার কোনো পরীক্ষা নাকি পৈশাচিক সুখ পায় সে এসব করে? বেশ.... তবে তাই হোক। আমিও তার কথা মতো চলবো। যেমন এতদিন চলে এসেছি। আমার মতো জ্ঞানী অপদার্থর জীবনে বেশ কয়েক জন নারী বা বলা উচিত কাম সঙ্গিনী এসেছে যাদের আমি সুখে পাগল করে দিয়েছি। আমার হাতিয়ার বার বার আঘাত হেনে বিপরীত লিঙ্গকে বিদ্ধ করেছে প্রতিবার। আর সেসবের সাক্ষী শুধুই দুই নর নারী হয়নি, ইনিও হয়েছেন। চুপটি করে নিজেকে লুকিয়ে পিরিতের নাগরকে পরস্ত্রীকে ভোগ করতে দেখেছে। কে জানে কতবার গর্বিত হয়েছে আর কতবার তার চোখ ঝাপসা হয়েছে। কিন্তু আমায় থামতে দেয়নি সে। যে নারীই আমার নিকটে আসতে চেয়েছে তাকে আমার কাছে এক মায়াবলে টেনে এনেছে সে প্রতিবার বা আমায় বুদ্ধি জুগিয়েছে।আমিও ভালো ছাত্রের মতো পরীক্ষায় পাশ করে এসেছি এতদিন। কিন্তু আর কত পরীক্ষা দেবো? আজও মনে আছে যৌবনের সূচনায় যখন আমার জীবনে আসা প্রথম এই প্রেয়সীর সহিত রতিক্রিয়া শেষে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম সে আমার পানে চেয়ে থাকতো। আমার বড্ড অদ্ভুত লাগতো সেই চাহুনি। যেন সেই বিশেষ মুহূর্তে কেমন ভয় লাগতো আমার ওই মায়াবিনীর আঁখির দিকে তাকাতে। একদিন প্রশ্ন করেছিলাম কি দেখে সে আমার পানে চেয়ে। এমন কি আহামরি সৌন্দর্য আছে এই মুখে যে সে তাকিয়ে থাকে। উত্তরে সে বলেছিলো " তুমি বুঝবেনা বোকা ছেলে, তোমার বোঝার দরকারও নেই। এটা শুধুই আমরা বুঝবো। দেখবে এই আমার মতোই অনেকেই তোমার কাছে আসবে নিজের পিপাসা মেটাতে। আমি আশীর্বাদ করি তাই হোক। রতিদেব সর্বদা প্রসন্ন থাকুন তোমার উপরে...... আমার বোকা ছেলেটা।"
কে সে? সে আমার প্রেমিকা? সে আমার শিক্ষিকা? নাকি সে আমার জননী ছিল সেই মুহূর্তে? আমি জানিনা। সত্যিই বোকা ছেলেটা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। পীনোন্নতস্তনী তখন আমার শুকনো ঠোঁটে পুরে দিয়েছিলো নিজের বৃন্তখানি। আমিও শিশুর মতন স্তন লেহনে নিজেকে ব্যাস্ত করে ফেলি। মিলন শেষের ক্লান্তি আহ বড়ো মধুর। যেন সেই ক্লান্তিই আজ আবার নেমে এসেছে আমার ওপর। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। খোলা জানলা দিয়ে বাতাসের সাথে বয়ে আসা সেই ছাতিম ফুলের মনমোহিনী গন্ধ যেন নাসিকা হয়ে অন্তরে গিয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। আর আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। আমার নায়ক ওদিকে পাপে লিপ্ত হয়ে নিজের প্রেমিকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আর আমি? আমি নিজেই একটু একটু করে নাম না জানা গল্পের চরিত্র হয়ে উঠছি। একটা সময় পর আর কিছুই মনে নেই। শুধুই অন্ধকার। হটাৎ দেখলাম ফাঁকা মাঠের মাঝে একটি সুসজ্জিত বিছানা। আর তাতে শায়িত এক নারী। আমার সেই প্রথম নারী। উলঙ্গ শরীরটি সামান্য একটি সাদা কাপড়ের অন্তরালে। আমি এগিয়ে চলেছি তার দিকে এক পা এক পা করে। আমার খেয়াল নেই নিজের দিকে। যদি দিতুম তাহলে দেখতাম এই হাত,এই পা, এই শরীর আর আজকের নেই। সেই বহু যুগ আগের এক কিশোরের। যে ভীরু, যে কৌতূহলী কিন্তু যে ভালোবাসা চেনে। জানে মায়ের মমতা ও বাবার স্নেহ। যে চেনে প্রেমের পরশ ও কষ্টের কান্নার স্বাদ।
"কি হে ছেলে? আজ আবার এসেছো? আগের দিন বুঝি শাস্তিটা কম হয়ে গেছিলো তাই আবার আসা হয়েছে? তবে আরকি? উঠে এসো চটপট। আজ নতুন কঠিন শাস্তি দেবো তোমায়। আজ থেকে তোমার পুরুষ হবার যাত্রা শুরু। একবার তোমার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিই তারপরে আমিও জ্বলবো সে আগুনে। পুড়ে শেষ হবো আমিও সে আগুনে। কি হলো কি? অমন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো বলছি। হিহিহিহি অবস্থা দেখেছো ছোড়ার। মুখে ভয় আর ওদিকে আমার ডবগা শরীর দেখে হে ইয়েটাকে জাগিয়ে ফেলেছো।"
" আমার বড্ড ভয় করছে। আমি পারবোনা না গো। আমি ভুল করে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করো। আমি.... আমি পারবোনা "
" পারবিনা তো কোন সাহসে সেদিন আমার ঘরে ঢুকেছিলি? এক পুরুষের অত্যাচার সহ্য করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছি তারওপর আরেকজন এসেছে। অন্তত সে পুরুষের ক্ষমতা আছে আমায় আঘাত দেবার। তোর তো তাও নেই। অতই যদি ভীতু তো অমন হিংস্র পশুটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াস কেন? মুক্তি দে ওটাকে। তোর মতো কাপুরুষের অমন পশু পোষার কোনো অধিকার নেই। তুই যোগ্য নয় ওটার। বেরো এখান থেকে হতভাগা!"
আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো তখন। চোখ ফেটে জল আসছিলো। আমার জীবনে আসা প্রথম সেই নারীর থেকে এরূপ অপমান আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। ইচ্ছে করছিলো ছুটে পালিয়ে যাই। ত্যাগ করি ওই স্থান। কিন্তু কেউ যেন আমার পদযুগল চেপে ধরে আছে। আমি তাই অসহায় নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়েই রয়েছি। এদিকে আমার সম্মুখে এক কামিনী হিংস্র নয়নে চেয়ে। উফফফফফ যেন কোনো ক্ষুদার্থ বাঘিনী নিজের পেটের আগুন নেভানোর আগে ভালো করে জীবন্ত শিকারের ভয়ার্ত রূপের সাক্ষী হয়ে মজা পায়। আমি আর তাকাতে পারছিনা। মাথা নামিয়ে সত্যিই হতভাগা সর্বহারা রাখাল ছেলেটার মতো কেঁদেই ফেললাম। আমার অশ্রুধারা বোধহয় কাজে এলো। সে চণ্ডালি মূর্তি একটু একটু করে শান্ত হতে থাকলো।
" ব্যাস? এইটুকুতেই চোখে জল? এই তুমি পুরুষ? আমায় দেখো । দেখেছো আমার সর্ব শরীরে? আমার ঘরের মানুষটার দেওয়া উপহার এগুলি। আমি প্রতিরাতে মাথা পেতে সেগুলো গ্রহণ করে আসছি। কই আমি তো কাঁদিনি? আমার চোখে জল আর আসেনা। বিনা দোষে শাস্তি পেতে পেতে একদিন ভেবেই ফেললাম না হয় দোষ করেই শাস্তি পাই। অন্তত মানুষটার আঘাত গুলোর একটা দাম তো উসুল হবে হিহিহিহি। এমন বহু আঘাত সহ্য করতে হবে তোমাকেও। মুক্তি নেই যে। কারোর থেকে মুক্তি নেই। আমার চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা এই উজ্জ্বল রশ্মির উৎস খুঁজে পেতে আমাকেও তো অন্ধকারে হারাতে হয়েছে। যে মানুষ কালোকে গ্রহণ করেনা সে আলোর মর্মও বোঝেনা বুঝলে ছোড়া। এই আলোর উৎস পর্যন্ত পৌঁছতে তোমাকে সহস্র পাহাড় টপকে যেতে হবে। হয়তো বহুবার গড়িয়ে পড়বে, ব্যাথা পাবে হার মেনে নিতে ইচ্ছে জাগবে, পিছুটান অনুভব করবে কিন্তু সেসবই যে তোমাকে হারানোর কৌশল। আমিও হেরেছি। কিন্তু থেমে থাকিনি। হারতে হারতে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে একদিন খুঁজে পেয়েছি এই ঠিকানা। তুমিও পাবে। কিন্তু যতদিন না পাচ্ছ তোমার যে মুক্তি নেই। এসো...... কাছে এসো। খুব বকেছি তোমায়। এবার একটু আদর করে দিই। এসো।"
আমও আর ওই ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকি কাঠের স্তুপে শায়িত রমণীর দিকে। সে আমায় চায়। যতই আমায় অপমান করুক তার কাছে আমিই সব। উফফফ কি আনন্দ। আমিও এগিয়ে যেতে লাগলাম তার কাছে। আর তারপরে আমি সে পুড়তে লাগলাম ভালোবাসার আগুনে। এই আগুন আমায় কৈশোরকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলো। শেষে দেখলাম অবশিষ্ট রইলো খালি যৌবন টুকু। সেটিও তাকে সমর্পিত করলাম।
------------------------------------------------------
ঘুম ভাঙিলো ভোরের মিষ্টি আলোয়। উঠিয়া দেখি পাশ বালিশে মুখখানি গুঁজে ঘুমিয়ে ছিলাম। চোখ ডলিতে ডলিতে পাখির কুহুকাঞ্চন শুনিতে পাচ্ছি। আহ কি মধুর সেই সংগীত। যেন তাহারাও রাতের শেষে পূর্বের হলুদ রাঙা মেঘ দেখিয়া আনন্দে উল্লাস করিতেছে। আমিও অনুভব করিলাম রাতের সমস্ত কষ্ট ও চিন্তার ভিড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কে আর যেন কোনো চাপ নাই। মনের কালি মুছে গিয়ে মাথা আবারো পরিষ্কার। চোখ গেলো টেবিলের দিকে। সেখানে এখনো খাতাটি খোলা অবস্থায় পড়িয়া আছে। সত্যিই! আমি যে কি কর্তব্যজ্ঞানহীন মানুষ সেটির আবার প্রমান পাইলাম। নিজের রুজিরুটির কারনকে অমন অবহেলা করিতে নাই। উঠিয়া পড়লাম বিছানা হতে। আর যে শুয়ে থাকলে চলেনা। এই যৌবন যখন তাকেই সমর্পন করে দিয়েছি তখন তার আদেশ যে পালন করতেই হইবে।
বাহ! এই লাইনগুলি তো বেশ ভালো। আমার নায়ক হবে দোষ গুনে ভরপুর এক পুরুষ। সে রাগ করে, অভিমান করে, ভুল করে কিন্তু হার মানেনা। লাইনগুলো লিখে ফেলতে হবে ঝটপট। দরজা খুলতেই এক ঝাঁক শীতল বাতাস রোদের আলোয় লুকিয়ে এসে ধাক্কা মারলো গায়ে। নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম কলঘরে। ফেরত এসেই কোনো দিকে না তাকিয়ে বসে পড়লাম ফাঁকা চেয়ারটায়। তারপরে পাতার পর পাতা ভরিয়ে দিতে লাগিলাম অদ্ভুত অশ্লীল সব লেখায়। কত যে সময় পার হয়ে যাচ্ছিলো কে জানে? লিখতে লিখতে নিজেরই মনে হচ্ছিলো এগুলো ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলছিনা কেন? কিন্তু আবার এও মনে হচ্ছিলো এতেই যে লুকানো আমার প্রাণভোমরা। হায়রে কি অসহায় আমি। আমার নায়ককে খুনি হতে দিইনি। তাই আগের লেখা অংশটুকু দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিজের সৃষ্টি থেকে উপড়ে ঘরের কোনায় ফেলে দিয়েছি। আমার নায়ক শরীরে ক্ষত না করেও খুন করতে পারদর্শী। সম্মুখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা জানবেও না কখন তার বক্ষে প্রবেশ করে গেছে ধারালো ছুড়ি খানি যা তার হৃদয় ভেদ করে গভীরে লুকানো আত্মাকে বধ করেছে। তবেই না সে যোগ্য খুনি।
চুড়ির মধুর শব্দে পেছনে ফিরে দেখি চায়ের কাপ হাতে হাসিমুখে ঘরে প্রবেশ করছেন এক সুন্দরী রমণী। তবে কাল সন্ধের মিষ্টি মেয়েটি নয়, ইনি আমার প্রিয় বন্ধুর অর্ধাঙ্গিনী। এ যে দেখি আপন গৃহেই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে হেহেহেহে। টেবিলে কাপ খানি সে তাকালো সম্মুখে রাখা পৃষ্ঠা গুলোর দিকে। আর আমি তাকিয়ে রইলাম তার নয়নের পানে। মেয়েটির স্পর্ধা তো খুব। এভাবে অপরিচিত পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে তারই লেখায় চোখ বোলানো হচ্ছে। যদি এক্ষুনি তার হাত ধরে কাছে টেনে নি কি হবে সেটা কি একবারো ভেবেছে?
"কি? কেমন লাগছে আমার নায়ককে?" জিজ্ঞেস করেই ফেললাম তাকে।
- ওমা! এ পুরুষ যে দেখি মোটেও হিংস্র নয়। বরং মানবিক দিক থেকে বড্ড ভালো। নইলে অমন সুন্দরীকে সামনে পেয়েও নমস্কার করেই মুক্তি দিলো? তাহলে যে কালকে অন্য পুরুষের কথা বলছিলেন?
- ভেবে দেখলাম আমার নায়ককে অতটাও ক্রুর বানাবো না। তারচেয়ে এই ভালো। একটু ভীরু, একটু দুঃখী আর একটু নষ্ট।
- আপনার যা ইচ্ছে। তবে আমার কিন্তু ওই পূর্বের নায়ককেই বেশি পছন্দ হয়েছিল। সে আর হাই হোক মিথ্যের মুখোশে লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতো না। ভোগী স্বৈরাচ্ছি খুনি হলেও সে ছিল পুরুষ। একে তো আমার মিচকে শয়তান মনে হচ্ছে।
- একদমই ঠিক ধরেছেন। এই হতভাগা সেটাই। সুযোগ বুঝে কাজ সারে ব্যাটা। এইতো সবে ব্যাটাকে বন্ধুর বাড়িতে পাঠালাম। সবে সুন্দরী বৌঠানের সহিত পরিচয় হলো। এখনো তো সবকিছুই বাকি।
- বেশ। আপনার সৃষ্টি যখন আপনিই ভালো বুঝবেন। তবে ভালো লাগলো যে আপনার ভোরে ওঠার অভ্যেস আছে। অমন বাড়ির ছেলে তাই ভেবেছিলাম বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমান। নিন আগে চা টুকু খেয়ে নিন দেখি তারপরে যা করার করুন। আমি যাই সকালের খাবার........ একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো যদি কিছু মনে না করেন?
- অবশ্যই। মনে করবো কেন?
- নায়কের অভিপ্রায় কি?
- সেটা এখন থেকেই কেন বলে দেবো বলতে পারেন? তাহলে তো আগামী পর্বের মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। পর তো দূরের কথা, অনেক সময় লেখক লেখিকা নিজেকেই জানতে দেয়না আগামী অংশে চরিত্রদের ভবিতব্য। তাই......
- ওহ.... হ্যা..... তাওতো। ঠিকাছে। দুঃখিত। আমি আর বিরক্ত করবোনা। আপনি বরং চা পান করুন.....আমি যাই।
সে বিদায় নিয়ে শুকনো মুখে কক্ষ ত্যাগ করছিলো। পেছন থেকে আমার " শুনুন " শুনে ফিরে তাকালো। আমি আমার খাতা খানি নিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। অপ্সরা সম সুন্দরী হলেও আমার সামনে সে সত্যিই যেন হরিণী আর আমি বিরাটাকার এক বাঘ। আমি চোখ পড়তে পারি। তাই জানি সে এই গল্পের নায়কের জায়গায় কাকে কল্পনায় স্থান দিয়েছে। তাই এটাই বোধহয় সঠিক সময়। হাতের খাতাটি তার দিকে বাড়িয়ে বললাম " আমার নায়কের অভিপ্রায় কি সেটা জানতে হলে যে আমার নায়ককে জানতে হবে। তার অতীত না জানলে ভবিষ্যত জানবেন কিকরে? আর তার বর্তমান কি সেটাও বা কিভাবে পরিষ্কার হবে? তাই নিন আমার সৃষ্টির কিছুটা তুলে দিলাম আপনার হাতে। নিজের একাকিত্বকে কাজে লাগিয়ে পড়ে ফেলুন এইটুকু। তারপরে একটা মতামত দিন তো দেখি। মানে ওই কমেন্টস এন্ড সাজেসশন আরকি "
- সেকি? আমি কেন?
- কারণ আপনি আর পাঁচটা পাঠকের মতন নন তাই। সেটা কালকেই বুঝেছি। আমার অন্তরের লেখক এতদিনে তার প্রিয় পাঠিকা বন্ধুর খোঁজ পেয়েছে। তাকে যে আমি ছাড়বোনা। নিন এটি। শুধু এইটুকুই অনুরোধ এর কথা যেন আমার বন্ধু জানতে না পারে। সে আমার নিকট হলেও এই একটা ব্যাপারে আমি তাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। তাছাড়া আমার মনে হয় আমার এই সব সামান্য লেখালিখি নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তার সাংসারিক দায়িত্ব আছে। এটি শুধুই অপনার জন্য। কারণ আপনাকেও আমি সেই বন্ধুর আসনেই বসিয়েছি। আপনিই হবেন আমার প্রথম পাঠক যে একটু একটু করে সবটা জানতে পারবেন। আমার প্রতিদিনের সৃষ্টি তুলে দেবো আপনার হাতে আর আপনি রোজ তার স্বাদ নিয়ে জানাবেন নুন লঙ্কা হলুদের পরিমান ঠিকঠাক আছে কিনা। যদি এই শর্তে রাজি হন তবেই কিন্তু ওই ধুমায়িত চায়ে চুমুক দেবো, নচেৎ পারুলও কিন্তু ভালোই চা বানায়।
আমার শর্ত শুনে নাকি শেষের কথাটুকু শুনে জানিনা কিন্তু এক মুহুর্ত আমার হাতে ধরে থাকা খাতাটির দিকে চেয়ে থেকে একটানে সেটি আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমিও হেসে ফিরে গেলাম পূর্বের স্থানে। সেখানে যে এক কাপ গরম চা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। চায়ের কাপে কিনা জানিনা কিন্তু কোনো এক হৃদয়ে হয়তো তুফান দেখা দিয়েছে।
ব্যাস তারপর থেকে এই ভাবেই কাটতে লাগলো বন্ধুর বাড়িতে প্রতিটা দিন। বন্ধুর সাথে সময় কাটানো আড্ডবাজি, তার অনুপস্থিতিতে তার মাকে সময় দেওয়া, গল্প করা আর সেই মিষ্টি মেয়েটার সাথে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ার মাঝেই এক মিচকে শয়তান অতিথি বাবু নিজের সঞ্চয়ের মনিমুক্ত তুলে দিতে লাগলো পরের ভার্যার হাতে। পরের দিন কোনো এক সময় সে কখন জানি এসে রেখে যেত খাতাটি। সেটি খুলে আবিষ্কার করতাম আমার লেখার নিচে কয়েকটা লাইন লেখা। যেমন মুক্তোর মতো শরীর তেমনি হাতের লেখা। গল্প সম্পর্কে তার মনে কথা পড়ে আমিও এক নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতে লাগলাম। আর সেও একটু একটু করে চিনতে লাগলো আমার গপ্পের নায়ককে। যে নায়ক একদিন ছিল তার কাছে এক হতভাগা কাপুরুষের মতন, সেই যেন তার কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে লাগলো। নায়কের অতীতের অংশ যত লিখেছি ততই দেখেছি ফেরত পাওয়া খাতার পৃষ্ঠায় নানান জায়গায় কয়েকটা জল বিন্দুর শুকিয়ে যাওয়া দাগ। কে জানে? হয়তো আমারই সেসব। এক বন্ধু, এক অতিথি, এক প্রেমিকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এক লেখক হবার জন্য সময় জ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলছিলাম আমি ক্রমে। আপন বাড়িতে থাকাকালীন ভাবতাম সময় যেন কাটতেই চায়না আর এখানে কখন যেন দিনের শেষে রাত নেমে আসে। আর রাত নামলেই সে ফিরে আসে আমার কাছে। রাত টুকুও উজাড় করে দিই তার ওপর। ঠান্ডা মায়াবী শরীরটা আমাকে নিয়ে মেতে ওঠে আদিম খেলায়। শুধুই আমি নয়, এই রাতের শুন্যতায় কোনো এক বন্ধ ঘরে স্বামীর পাশে শুয়ে থাকা এক নারীরও যে আমার মতোই হালত হয় সেটাও সে এসে ফিসফিস করে জানিয়ে দিয়ে যায় আমার কানে। আমার সৃষ্টির মধ্যভাগের অংশের নীল কালীতে ফুটিয়ে তোলা লাইনগুলোর মাঝে হারিয়ে গিয়ে সেই প্রতিবাদী নারীও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজের সাথে নতুন খেলায় মেতে ওঠে সেটা জেনে আমিও গর্বিত। এক ভিন্ন বিকৃত উত্তেজনায় ভোরে যায় সারা অঙ্গ। মনে হয় আমার সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে ভোগ করে চলেছি প্রতিরাতে। উফফফফফ সে যে কি পৈশাচিক সুখ তা অবর্ণনীয়। জৈবিক প্রবৃত্তি গুলোর জালে জড়িয়ে বাস্তবে না হোক, এইভাবেই না হয় ব্যাভিচার চলুক নায়কের সাথে নায়িকার। নায়কের জায়গায় আমি আর নায়িকার জায়গায় সে। দারুন ব্যাপার তো! এইভাবেই চলতে চলতে হয়তো দেখবো কোনো রাতে আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়বে। রাতের আঁধারেই ফিরে পাবো আমার খাতা। যেথায় আমার সৃষ্টির নিচে কয়েকটা লাইন জ্বল জ্বল করবে। সকলের অজান্তে একই পাতায় লেখক লেখিকার হস্তলিপি যেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে , তেমনি হয়তো এই বিছানাটাতেও দুই রক্ত মাংসের নর নারী খুঁজে পাবে গল্পের বাকি অংশটুকু। লেখা সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সে হয়ে উঠবে আমার অন্যতম দোসর। ভাবছি আমার নায়ক এইভাবেই খুন করুক নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে। তার ভাগের সুখের একটু না হয় ছিনিয়ে নিক সে। এই না হলে যথার্থ খুনি। সকল অতিথি যে নারায়ণ হতেই হবে তার কি মানে? এক আধটা অসুর হলে ক্ষতি নেই।
সবই সম্ভব হলো আমার সেই প্রথম প্রেমিকার জন্য। তার জন্য সতীন আনার বন্দোবস্ত যখন সে নিজেই করে দিচ্ছে তবে আমিও দেখিয়ে দেবো খেলতে আমিও পারি। মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার একান্ত আপন মানুষটার কাছে। হাত রাখলাম তার কাঁধে। ঘুরে দাঁড়ালো সে। লক্ষ করলাম তার চোখে জল। দুঃখ নাকি খুশির? জানিনা। জড়িয়ে ধরলাম তাকে। আর কিচ্ছু চাইনা আমার। শুধুই একটা চাহিদা। সে যেন..... না যেন কেন? সে চিরকাল আমার পাশে এইভাবেই থাকবে। চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না। সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো। তার আমার সম্পর্কের লুকোচুরি এইভাবেই চলতে থাকুক।
|| সমাপ্ত ||